পাড়ার খেলার মাঠে মেয়েদের ফুটবল-ক্রিকেট দেখা যাবে কোনওদিন আদৌ?

স্বাতী মৈত্র

 



অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

“কলকাতায় এখন আর বন্ধ হয় না?”
“কোথায় গেল সেই বন্ধের দিন, কোথায় গেল সেই রাস্তায় ক্রিকেট খেলা!”

দুই অধুনা-প্রবাসী বন্ধুর কথা শুনতে শুনতে আনমনে ভাবছিলাম খবরের কাগজে বন্ধের দিনে কলকাতার পুরনো ছবি। রাস্তার মাঝখানে ইট পেতে উইকেট, সস্তার ব্যাট আর ক্যাম্বিসের বল হাতে একদল ছেলে, গলিক্রিকেট খেলায় মগ্ন। মাঝে মাঝে দুই-একটা সাইকেল অথবা কোনও পথকুকুর, এরাই তাদের সঙ্গী।

মফস্বলের যে শহরে আমি বড় হয়েছিলাম ৯০-এর দশকে, সেখানে রাস্তার মাঝখানে ইট পেতে খেলবার প্রয়োজন কারও পড়েনি কোনওদিন। আশেপাশে মাঠ-ঘাটের অভাব নেই, রাস্তার ধারে ফুটপাথের বদলে ঘাসের গালিচা। সে সময় আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতন আমরাও স্কুল সেরে বেরিয়ে পড়তাম মাঠের উদ্দেশ্যে। দোলনা-স্লিপ-ঢেঁকি থেকে কুমিরডাঙ্গা-লুকোচুরি, সেইখান থেকে উত্তরণ হয়ে বাড়ির গেটের এপার-ওপার ব্যাডমিন্টন অথবা (আরেকটু বড় হয়ে) মাঠে কোর্ট কেটে, নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন। ইস্কুলে খোখো কাবাডি ছাড়াও আমার শখের ক্রিকেট ব্যাটটার দৌলতে অল্পস্বল্প ক্রিকেট। অনেক সময় ক্রিকেট ব্যাটটা নিয়ে পার্কেও চলে যেতাম আমরা, একদিকে বড় দাদাদের সিরিয়াস ক্রিকেটের দল আর অন্য প্রান্তে সদলবলে আমরা কয়েকজন ছেলেমেয়ে। ইস্কুলের অথবা বিকেলের এই খেলার দলগুলো অনেকদিনই টিকে ছিল, যদিও মাঝেমাঝেই একেকদিন একেকজন উধাও হয়ে যেত টিউশন পড়বার চক্করে। একটু বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের খেলার দলগুলো যেন কমতে শুরু করল, যদিও পুরোপুরি উধাও হল মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়। ক্রিকেট ব্যাট-ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট ছেড়ে আমরা প্রতিদিন বিকেলবেলা টিউশন ক্লাসে এসে জুটলাম। এর পরবর্তী শরীরচর্চার অধ্যায় সবারই মধ্যবয়সে এসে, যোগব্যায়াম, জিম অথবা জুম্বা নাচের ক্লাসে।

ছেলেদের খেলার দলগুলো তখনও পুরো ভেঙে যায়নি। ছুটির সকালে, অথবা সবার অজান্তে ক্লাস-টিউশন কামাই করে খেলবার রেওয়াজ পুরো ভেঙে যায়নি। অনেকে সে অভ্যাস কলেজজীবনেও বজায় রেখেছিল, এখনও তাদের অফিসজীবনের ফাঁক-ফোকরে মাঠে দেখতে পাওয়া যায় হয়তো। এই ছেলেদের অনেকেই এখন ঘোর সংসারী। রাস্তায় গাড়ি, পার্কে অচেনা লোকজনের মাঝে মেয়েকে ছেড়ে দিতে রাজি না হলেও তাদের কাউকে অনেক কিছুর ফাঁকে মেয়েকে সাঁতার, ক্রিকেট অথবা ক্যারাটে কোচিং ক্লাসে নিয়ে যেতে দেখা যায়। মাধ্যমিক অথবা উচ্চমাধ্যমিকের সামনে এসে এই মেয়েগুলোর খেলার দলগুলোও আস্তে আস্তে ভেঙে উধাও হয়ে যাবে, শরীরচর্চার পরবর্তী গন্তব্য হবে যোগব্যায়াম, জিম অথবা জুম্বা নাচের ক্লাসে।

 

ডিভিশন খেলা-খেপ খেলা অথবা স্টেট-ন্যাশনাল খেলে পুলিশ-সার্ভিসেসে চাকরি খোঁজা যে নিম্নবিত্ত জগৎটা, তার থেকে বহু দূরে আমার বর্ণনার এই স্বচ্ছন্দ উচ্চবিত্ত জীবন। সেখানে খেলার অথবা বহির্জগতের সঙ্গে, প্রাকৃতিক জগতের অথবা শহুরে ধুলোবালির সঙ্গে বেশি সম্পর্ক রাখবার প্রয়োজন আগেও সেরকম পড়ত না, এখন আরওই পড়ে না। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে অনেকেই এখন দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে গেটেড কমিউনিটির বাসিন্দা, কেউ আবার বিদেশে সংসার পেতে ‘আউটডোর্সি’ হয়েছেন, সুদূর আমেরিকায় সমুদ্রের ধারে সপরিবারে ছবি তুলে থাকেন। সংগঠিত ক্রীড়াজগৎ থেকে এতটাই দূরে এই উচ্চবিত্ত জগত যে মাঝেমাঝে কেউ পথ ভুলে অন্যপ্রান্তে গিয়ে না পড়লে ক্রীড়াসংস্কৃতি অথবা তার অভাব নিয়ে বিশেষ ভাবার প্রয়োজন পড়ে না আদৌ।

ভাবতে হয় এরকম কিছু মানুষকে যারা খেলার জগতের সঙ্গে যুক্ত, অথবা যাদের পরিবারে খেলাধূলায় উৎসাহী সন্তান থেকে থাকে। চুঁচুড়ার রণদীপ সাধু আজকে ‘তিতাস সাধুর বাবা’ হিসেবেই পরিচিত। পারিবারিক সূত্রে একটি ক্লাবের সঙ্গে বহুদিন যুক্ত রণদীপ। বাবার সঙ্গে খেলার মাঠে যেতে যেতে শিশু তিতাসের খেলায় উৎসাহ বাড়ে। ক্রিকেট ছাড়াও সাঁতার, টেবিল টেনিসে উৎসাহ দেখায় সে। তিতাসের বাবা— হয়তো খেলার জগতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেই— মেয়ের প্রতিভা চিনতে পারেন। ক্লাস সেভেনের তিতাস যখন ক্রিকেট খেলাতে মনোযোগ দেওয়া শুরু করে, তখন রণদীপ মেয়েকে পাঠিয়ে দেন প্রাক্তন রঞ্জি খেলোয়াড় প্রিয়ঙ্কর মুখার্জির কাছে স্থানীয় অ্যাকাডেমিতে। কোচের প্রচেষ্টায় তিতাস নিয়মিত ম্যাচও খেলে— তবে মেয়েদের সঙ্গে নয়, ছেলেদের সঙ্গে। জেলাস্তরে মেয়েদের ম্যাচ হলেও নিয়মিত ম্যাচ প্র্যাকটিস পাওয়ার মতন মেয়েদের খেলা হত না সেইভাবে। কোচ প্রিয়ঙ্কর বলেছেন এতে হয়তো শাপে বর হয়ে তিতাসের খেলোয়াড় হিসেবে উন্নতিতে সুবিধাই হয়েছে। আজকের তিতাস ভারতীয় আন্ডার-১৯ দলের চ্যাম্পিয়ন বোলার, উইমেন্স আইপিএলের পরে হয়তো তাকে সিনিয়র দলেও দেখা যেতে পারে।

যে সময় আমার মফস্বল শহরে আমাদের খেলার দল ব্যাট আর র‍্যাকেট নিয়ে দাপাদাপি করে বেড়াত, সে সময়েই তার থেকে সামান্য দূরে— মাত্র দুটো স্টেশন— আরও একটি ছোট শহর থেকে একটি মেয়ে নিয়মিত ট্রেনে চড়ে কলকাতার বিবেকানন্দ পার্কে স্বপন সাধুর কাছে ক্রিকেট কোচিং নিতে যেত। তার নাম ঝুলন গোস্বামী। আজকে অবশ্য তাঁর আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। নিজের ক্রিকেটজীবনের শুরুর দিনগুলো ও বর্তমান সময়ের ফারাক প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ঝুলন বলেছিলেন— ২০১৫ সালে সাংবাদিক নিয়ন্থা শেখরকে দেওয়া একটি ইন্টারভিউতে— যে চাকদায় বড় হওয়ার সময় তিনি ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে কুস্তির মতন কন্ট্যাক্ট স্পোর্টসও খেলতে দেখেছেন, এসব বিষয়ে তাঁর ছোট্ট মফস্বল শহরে কোনও সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল না। যেটা ছিল না, তা হল সংগঠিত ক্রীড়া পরিকাঠামো। চাকদার মতন শহরের মেয়েরা আজকে কল্যাণী অথবা কৃষ্ণনগরে অ্যাকাডেমিতে গিয়ে খেলতে পারে, খুব খুশি হয়ে ঝুলন বলেছিলেন। রোজ ট্রেনে চড়ে সুদূর কলকাতা শহরে ছুটতে হয় না তাদের। তাদের সময় নষ্ট হয় না, লেখাপড়া করবার সময়টাও থাকে। জেলাস্তরে ক্রিকেট খেলবার সুযোগও বেড়েছে মেয়েদের, যা ঝুলনের সময়ে একেবারেই ছিল না। ঠিক সেই কারণেই শিলিগুড়ির রিচা ঘোষ— এখন ভারতীয় সিনিয়র দলের নিয়মিত সদস্য— অথবা চুঁচুড়ার তিতাস সাধুরা এখন ক্রীড়াজগতে সগর্বে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। ছোট শহরের মেয়েদের মা-বাবারাও এখন বলেন, খেলুক না আমার মেয়ে, সমস্যা কী? হয়তো একদিন এমনও আসবে, যে তিতাস-রিচাদের মতন মেয়েরা নিয়মিত নিজেদের মাঠে ম্যাচ প্র্যাকটিস পেতে পারবে, নাম লুকিয়ে ছেলেদের সঙ্গে খেলবার প্রয়োজন হবে না আদৌ।

 

প্রতিবারই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পর প্রশ্ন উঠতে থাকে, আমরা পারি না কেন? আমরা জিতব কবে? একেকজন মেরি কম অথবা পিভি সিন্ধুর জয় দেখে খুশি হলেও আমরা ভুলে যাই, মেয়েদের খেলাধূলার পরিকাঠামো কতটা অপ্রতুল এই সুবৃহৎ দেশে। শিশুর স্বাভাবিক নিয়মেই ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে খেলাধূলা করে থাকলেও আস্তে আস্তে সেই খেলার পরিসর সঙ্কীর্ণ হয়ে আসতে থাকে। খেলার মাঠে যাওয়া অথবা অন্য পাড়ায় যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা বসে। সাইকেল চালানোয় আতঙ্ক জাগে। ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে চিন্তা হয়। বয়ঃসন্ধির সময় থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন, যথেষ্ট জল অথবা ঠিকঠাক স্পোর্টস ব্রা-র অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে থাকে টিউশন, বড় বড় পরীক্ষা। মাঠে অথবা গলিতে খেলার জায়গাগুলো চলে যায় ছেলেদের দখলে। এসবের মধ্যেও সংগঠিত ক্রীড়াক্ষেত্রে ঢুকে যেতে পারা কিছু মেয়ে ছাড়া বাকিদের জন্য ‘খেলা’ তখন অতীত, শিশুসুলভ। এই সার্বিক ক্রীড়াসংস্কৃতির অভাবের মধ্যেও যে ঝুলন থেকে তিতাসের মতন মেয়েরা আদৌ উঠে আসতে পেরেছেন, তা হয়তো কিছুটা ক্রিকেট খেলার দাপটের কারণেই। অনূর্ধ্ব-১৬ স্তরে ভারতের হয়ে ফুটবল খেলা পৌলমী অধিকারীর পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি, তাই তিনি এখন খাবার ডেলিভারি দিয়ে সংসার চালান।

 

কল্পনা করা যেতে পারে, কোনও এক বন্ধের দিন (সরকার বাহাদুর মাফ করবেন)। কলকাতার রাস্তায় কিছু সাইকেল, দু-একটি পথকুকুর। একদল মেয়ে হইহই করে ক্রিকেট অথবা ফুটবল খেলছে সেই রাস্তায়, মুখে হাসি। কল্পনা করা যেতে পারে একেকটা খেলার মাঠে মেয়েদের খেলার দল, স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দল বেঁধে মাঠে খেলতে যাওয়া। কাদা-মেখে ফুটবল, হাঁটু-কনুই ছড়ে রক্তারক্তি। বয়ঃসন্ধিতে পরিবর্তিত শরীরের ভয়ে গুটিয়ে না যাওয়া, কলেজে-অফিসে গিয়েও খেলবার অভ্যাসটা বজায় রাখতে পারা অন্তত কিছুজনের।

এরকম সমাজ আদৌ কল্পনা করা যায় কী?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অসাধারণ স্মৃতি রোমন্থন l
    প্রথম এবং শেষের দিকে ছোট বেলার স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠলো l তবে আমি যেখানে ছিলাম সেটা সেইসময় ছিলো গ্রাম , বর্তমানে শহর কলকাতার অধীনে l ফলে খেলার মাঠ পেয়েছি l আর শহর কলকাতার যে বর্ণনা দিলেন সেটাও দেখেছি l
    আপনি সঠিক বলেছেন মেয়েদের খেলার পরিকাঠামো খুবই খারাপ l দীর্ঘদিন যাবৎ এখানে ছেলেদের খেলার সামান্যতম পরিকাঠামো টুকু নেই l “মেয়েরা তো কোন্ ছাড়” !!

    সুন্দরবন এলাকায় সিংহরায় পরিবারের সহায়তায় মেয়েদের ফুটবল খেলার কম বেশি সাত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম , এখানে প্রতিভা আছে যথেষ্ট l তবে অভিভাবকের উৎসাহ নেই কারণ তারা ভাবতেই পারেন না যে মেয়ে খেলাধুলা, লেখাপড়া শিখে চাকরি পেতে পারে l এটা তাদের ভাবনার বাইরে l আজও অভিভাবকরা ভাবেন, মেয়ে ষোলো সতেরো হলেই বিয়ে দিতে পারলে বাঁচি l আপনি উল্লেখ করেছেন সেটা এখানকার ক্ষেত্রেও একই যে পরিকাঠামো নেই l এখানকার পরিবেশ এতটাই খারাপ যে ছেলে মেয়েরা খুললাম খুল্লা অসভ্যতা করে l বড়দের সমীহ করার ব্যাপারটাও নেই l Facebook Post দেখলেই সেটা বোঝা যায় l মেয়ে শিশুটির দোষ নয় , ছোটবেলা থেকে যা দেখছে সেটাতেই অভ্যস্ত হচ্ছে l ফলে যার প্রতিভা দেখে আমরা অবাক হই, যাকে নিয়ে আমরা খুব আশায় থাকি , প্রতিনিয়তই আমি এবং দেবাশীষ বাবু তার বাড়িতে গিয়ে কখনো ফোন করে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি সেই হতাশ করে l মেয়েগুলোকে যত ধরে রাখার চেষ্টা করছি ততই তারা বিপথে চালিত হচ্ছে l অভিভাবকদের পক্ষে তার মেয়েকে দেখাশোনা করার সময় , ধৈর্য , ইচ্ছে কোনোটাই নেই l কারণ অভিভাবক ছুটছে রুটি রুজির সন্ধানে l ফলে বয়ঃ সন্ধিকালে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিভাবান মেয়েগুলো l এমনকি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে l এখানে অপসংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানের প্রভাব বেড়েছে l

    এতো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সুন্দরবনের মেয়েদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেবার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি l সিংহরায় পরিবার তাদের পাশে আছে l

আপনার মতামত...