ঢাকাতে— শহর থেকে শহরে

নীলাঞ্জন হাজরা

 

প্রথম পর্ব

শব্দ-গন্ধ-বর্ণ-স্বাদের ফুলকারিতে ভরপুর আশ্চর্য নকশি কাঁথায় আলগোছে ঢেকে রাখা অগণিত ক্ষত-খরিত এক বিস্তীর্ণ হৃদয়। এই কথাটাই আমার প্রথম মনে এল চোখ বন্ধ করে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা থেকে কলকাতাগামী ফ্লাইট তখন ২০২২-এর শেষ সন্ধ্যায় মহাহুঙ্কার আর থরথর কাঁপুনিতে উড়ান নিয়েছে। জানালার ওপারে শহরের কুয়াশামাখা আলোর জাল আরও ফিকে হতে-হতে একেবারে মিলিয়ে গিয়ে নিকষ কালোটুকু রয়ে গেছে। আমাদের শুভযাত্রাকামনার শেষে বিমানপরিচারিকার চিকন গলার ‘আল্লা হাফিজ়’ তখনও আমার কানে লেগে। সিটে পিঠ এলিয়ে দিয়ে ভাবছিলাম গত সাত দিনের কথা। ভাবছিলাম সেই ঠিকানাটার কথা যার অমোঘ টানে এই সাতদিনের ছোট্ট সফর।

কণিকা। ৩৫৫ এলিফ্যান্ট রোড। ঢাকা। ১৯৯৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই ঠিকানার টান তীব্র হতে-হতে শেষে ২৩ বছর তিন মাস পার করে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠায় ২০২২-এর ২৪ ডিসেম্বর, শনিবার গভীর রাতে হাজির হলাম হয্‌রত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আকাশে। নিচের আলোগুলো এগিয়ে আসছে হু হু করে। ক্যাপ্টেন বাজখাঁই গলায় ‘Cabin crew to landing stations’ নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ভেতরের আলো ঢিমে হয়ে যাওয়ায় বইটা বন্ধ করে আমার কাঁধের ঝোলায় পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস, কোভিড প্রতিষেধক নেওয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি সবচেয়ে জরুরি দলিলগুলির সঙ্গে ঢুকিয়ে দিলাম।

‘একাত্তরের দিনগুলি’। জাহানারা ইমাম। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে মার্কিন দূতাবাসের কর্মী হিসেবে যেবার আমি প্রথম ঢাকা গিয়েছিলাম দিন তিনেকের জন্য, সেবার ফিরে আসার দিন নিজের বাড়িতে ডেকে আমাকে ও আমার তদানীন্তন বস্‌কে জোড়া ইলিশ (ঠিক— একটুও ভুল পড়ছেন না, দুজনের জন্য দুটো আস্ত) বেক করে খাইয়ে এই বই আমায় উপহার দিয়েছিলেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের প্রেস সেকশনের প্রধান আবুল আহসান আহমেদ আলি ও তাঁর স্ত্রী খুরশিদ আরা বেগম। নিজেদের নাম আর তারিখের ওপরে লিখে দিয়েছিলেন— ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’।

কোনও একটি দেশে পর্যটনে গিয়ে তার হৃদয়ের নাগাল পাওয়া গেছে মনে করার মতো অর্বাচীনতা আর কিছু হতে পারে না। নাগাল যে পাওয়া যেতে পারে না তা জেনেও স্রেফ সেই হৃদয়ের খোঁজের তাগিদেই জীবনে হাতে গোনা যে কয়েকটি বই আমাকে যে কয়েকটি গন্তব্যে হাজির হতে বাধ্য করেছে, তার মধ্যে উজ্জ্বল ‘একাত্তরের দিনগুলি’। যেমন করেছে ফুরুঘ ফ্যারোখজ়াদের কবিতা সঙ্কলনের ইংরেজি তরজমা ‘Bride of Acacias’— ইরানে। যেমন করেছে— ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর কাব্যসংগ্র ‘নুসখাহা-এ-বফা’— পাকিস্তানে। যেমন করেছে জিম করবেটের পরমাশ্চর্য অরণ্যকথা ‘Jungle Lore’— উত্তরাখণ্ডের কালাধুঙ্গিতে। আমার পড়া এমন বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। আবার, বইগুলি পড়া মাত্রই যে কোথাও দৌড়েছি, তা-ও নয়। মুশকিল হল, এইসব বই মনের মধ্যে ক্রমাগত গজিয়ে উঠে বেড়ে চলতে থাকে। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে। যেন তার গভীর রাত্রির প্রগাঢ় অরণ্যলতায় আমার বল্গাহরিণ-শিং জড়িয়ে গিয়েছে। নিস্তার নেই। সে বইয়ের পাতায় গিয়ে হাজির হতে পারলেই বুঝি সেই জট ছাড়ানো সম্ভব। ঘটনা এটাই যে, তা আসলে অসম্ভব। কারণ, সে পাতা তো শুধু কোনও ভূগোলে গড়া নয়, সময়ে গড়া, ইতিহাসে গড়া— যার বিষয়ে জানা যায়, কিন্তু তাতে হাজির থাকা যায় না। তথাপি, এই সব বইয়ের ঠিকানায় দু দণ্ড দাঁড়ানো, সেই সফরটা করা, আমার মনে হয়েছে, এক একটা সীমানা পার, এক একটা ‘অ্যারাইভাল’— যার অনুভূতি অনির্বচনীয়।

তাড়াহুড়োতে অ্যারাইভাল কার্ড ভর্তি না-করেই ইমিগ্রেশন কাউন্টারে হাজির হওয়ায় মৃদু তিরস্কৃত হয়ে ফিরে গিয়ে সে কার্ড ভরে ফের লাইন দেওয়া, বিমান নামার ঘণ্টা দেড়েক পরেও কারওই লাগেজ না-আসায় তারস্বরে যাত্রীবিক্ষোভ— ইত্যাকার ছোটখাটো দুর্যোগ কাটিয়ে যখন টার্মিনাল ১-এর দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখন রাত বারোটা বেজে গিয়েছে। আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই। থাকার কথা যদিও। স্থানীয় সিমকার্ড নেই। ফোনের নেট-যোগাযোগ নেই, কাজেই হোয়াট্‌সঅ্যাপ বন্ধ। মনের মধ্যে শিরশিরে উদ্বেগ বাড়তে-বাড়তে মরিয়া হয়ে একে তাকে জিজ্ঞাসা— “আচ্ছা, বলতে পারেন, ফ্লাইটে আসা যাত্রীদের যাঁরা রিসিভ করতে আসেন তাঁরা কোথায় অপেক্ষা করেন?”

যে কয়েক জায়গায় করেন সেখানে আমার জন্য কেউ অপেক্ষারত নেই। ‘‘কিছু সমস্যায় পড়্‌সেন নাকি?’’ শীর্ণকায় প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পরণে পায়জামা, কুর্তা, খয়েরি গুলুবন্দ কোট। পায়ে কালো ফিতেহীন খপাত-জুতো। মাথায় ফেজ টুপি। চিমড়ে মার্কা মুখে একগাছা সাদা লম্বা দাড়ি। ‘‘আজ্ঞে। আমার হোটেলের ড্রাইভারের আসার কথা, নেম ট্যাগ হাতে। আসেননি। কলকাতা থেকে আসছি তো, ফোন কাজ করছে না।’’ একগাল হাসি— ‘‘আসব। আসব। আটকায়া গেসে কোনও কারণে। ফোন নম্বর আসে?’’… হোটেলে একাধিক ফোন করে, তাদেরকে ওঁর নিজের নম্বর দিয়ে, নিজের গাড়ি এসে যাওয়া সত্ত্বেও অন্তত আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করে, হোটেলের ‘প্রোটোকল অফিসার’-এর সঙ্গে আমার কথা বলিয়ে দিয়ে তবে তিনি বিদায় নেন। বাবুরা নেম ট্যাগ হাতে দু নম্বর টার্মিনালের গেটে অপেক্ষা করছিলেন!! এয়ারপোর্টের বাইরে পেল্লায় পেল্লায় জাপানি গাড়ির জট কাটিয়ে এঁকে-বেঁকে আমাদের গাড়ির দিকে এগোতে-এগোতে অনভ্যস্ত চোখে প্রথম চমক লাগল— প্রত্যেকটা গাড়ির নম্বর প্লেট বাংলায় লেখা! ঢাকা-মেট্রো-গ-৮০৯৫!…

কিছু কী ছুঁয়ে গেল মনে? না। বাংলা ভাষা নিয়ে আমার মনে কোনও আবেগমথিত সবুজ কোণ সৃষ্টির সুযোগ জীবন আমায় দেয়নি। আমি ছ বছর বয়স থেকে ছাত্রজীবনের একটা বড় অংশ সেইসব বোর্ডিং স্কুলে বা কলেজে বড় হয়েছি যেখানে পড়ুয়ারা আসত দেশের নানা প্রান্ত থেকে। লেখাপড়ার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। অবাঙালিদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যম হিন্দি। শুধু ভাষার কারণে কাউকে ‘অপর’— ‘the other’— মনে করার সুযোগ আমার হয়নি। ক্লাস ফোরে, নাটকের রিহার্সালের সময় মহাহুল্লোড়ে বারান্দা-ক্রিকেট খেলার অপরাধে যেবার আমাদের বাংলার মাস্টারমশাই শ্রীনিবাসদা বেতের বাড়ি মেরে আমাকে প্রায় জেব্রা বানিয়ে দিয়েছিলেন, সেবার যে ছেলেটি সবার আগে আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, ‘‘ধুর, কাঁদিস না তো! তোর জন্য পাকা বেল পেড়ে রেখেছি গাছ থেকে। চল্‌, খাবি চল্‌’’, তার নাম কেইশাম নীলকান্ত সিং। সে মণিপুরি। আর সেই বয়সে আমাদের অনেকেরই প্রিয়তম গান ছিল— ‘সানা লইবাক মণিপুর, মণিপুর/ কোলোই নঙ্গি মণিপুর, মণিপুর’!! সর্বোপরি, বাঙালির প্রথম ভাষা হবে বাংলা— এ দাবিটুকু তোলার ‘অপরাধে’ অব্যবহিত পরিপার্শ্বের মানুষদের বা তাদের পূর্বজদের ধর্ষিতা হতে, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে, সন্তানহারা হতে, স্থাবর-অস্থাবর সর্বস্ব খুইয়েও অস্ত্রহাতে রুখে দাঁড়াতে আমি দেখিনি, শুনিনি। সে মিছিলে থাকার বা তার উত্তরাধিকার বহনের সুযোগ ইতিহাস আমায় দেয়নি।

এই এক ঝলকের ঢাকা সফরের দু কথা বলার গোড়াতেই এ কথাও বলে রাখা ভাল যে, বাংলাদেশ নিয়েও আমার কোনও ‘আহা সেই ফেলে আসা দেশ’ গোছের নস্টালজিয়া নেই। আমি বাংলাদেশ যাচ্ছি শুনেই মা বলেছিল, আমার দাদু— মায়ের বাবা— ঢাকা বিক্রমপুরের রাজদিয়া গ্রামের মানুষ। দিদা বরিশাল উজিরপুরের বড়পাইকা গ্রামের। দাদুর বাবা ছিলেন রাজশাহি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। সেজমামার ইচ্ছে— আমি ওই সব জায়গায় যেতে পারলে যেন একটু মাটি নিয়ে আসি! আমি তন্নিষ্ঠ পর্যটক। গন্তব্যের বিষয়ে যদ্দূর সম্ভব খোঁজ-খবর, পড়াশুনা করে সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টার ভ্রমণসূচি— কোথায় যাব, কী চড়ে যাব, কী দেখব, কী করব, কোখায় খাব, কী খাব, এই সব— গুগ্‌ল মানচিত্রের প্রিন্টআউট-সহ আমার সঙ্গের ঝোলাতে থাকে। স্থানীয়দের পরামর্শে প্রত্যয় জন্মালে তবেই তার পরিবর্তন হয়, নচেৎ নয়। সেই সূচি করার সময় বিক্রমপুরের রাজদিয়া বা বরিশালের বড়পাইকা যাওয়ার কোনও তাগিদ আমি অনুভব করিনি। আমি বাংলাদেশ গিয়েছি আর একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম নতুন পড়শি দেশে যাওয়ার মন নিয়ে।

মায়ের এই অনুরোধ না-রাখায় আমার মনে কোনও আক্ষেপ নেই। সত্যিই আক্ষেপ হল যখন ঢাকা থেকে সুস্থ-সবল ঠিকঠাক ফিরেছি জানার পরেই মা প্রথম প্রশ্ন করল— “আমার জন্য বাকরখানি এনেছিস?” কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছে করছিল এই কারণেই যে, ২৫ ডিসেম্বর আমার বিশেষ বন্ধু সৌমিত্রদার (দস্তিদার) ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়— মানে ষাটের এদিক-ওদিক, জাকির হোসেন যখন কথামতো কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় হোটেলের ব্যুফে ব্রেকফাস্ট সাজানো রেস্তোরাঁয় হাজির হলেন, আমি তাঁকে জানালাম— ‘‘চলুন, একটু কফি খেয়েই বেরিয়ে পড়ব।’’

‘‘সে কী! ব্রেকফাস্ট করবেন না?’’
‘‘করব। এখানে নয়। পুরান ঢাকায়। বাকরখানি!’’

বেরিয়ে পড়লাম। জাকির সাহেব লম্বা, সুঠাম নির্মেদ চেহারার মানুষ। পরিপাটি করে ছাঁটা সাদা দাড়ি, গোঁফ, চুল। চোখে চশমা। কালো ট্রাউজার্স, ঘিয়ে ফুলহাতা পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা, গলায় ক্যামেরা। তাঁরও পাক্কা টুরিস্টের বেশ।

‘‘রিকশায় যাবেন তো?’’
‘‘অবশ্যই। পায়ে হেঁটে আর রিকশায় না-ঘুরলে কোনও জায়গা দেখা হয় নাকি!’’

কলকাতার রিকশার সঙ্গে ঢাকার রিকশার মূল তফাৎ বাহারে। যদিও জাকির সাহেব দুঃখ করলেন— ঢাকার রিকশ-আর্ট আর সেই আগের মতো নেই। তাও রংবাহারের ছড়াছড়ি। নয়া পল্টনে আমার হোটেল থেকে বড়দিনের ঝলমলে রোদে রিকশায় মিনিট কুড়ি পার করে জাকির সাহেব আমায় যেখানে হাজির করলেন তার গন্ধ-বর্ণ-শব্দ সবই হোটেলের অব্যবহিত সংলগ্ন যে এলাকাটা পেরিয়ে এলাম তার চেয়ে এক্কেবারে আলাদা। কলকাতার চেয়ে তো বটেই। পরবর্তী দিনগুলিতে প্রায় রোজই একটু একটু করে আবিষ্কার করেছি এই ঢাকা— পুরান ঢাকা। মসজিদ-মন্দির-গির্জা-বন্দর-বাজার-কেল্লা-বিরিয়ানিঘর-কাবাবি-বেকারিতে জমজমাট এক মুঘল শহর। আর সে ঢাকায় ঢোকামাত্র প্রথম আবেশে আচ্ছন্ন হল নাক। মুচমুচে পরোটা ভাজার অবধারিত জিভে-জল-আনা গন্ধ। দোকানের পর দোকান থেকে। ক্যামেরা তাগ করতেই সে কী হাসাহাসি! সহস্র ফুলমালার মহার্ঘ্য অভ্যর্থনা এ হাসির কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ। ভুলটা ভাঙল ফোকাস করতেই— পরোটা তো নয়, এ তো পেল্লায় সাইজের লুচি। এ লুচি রুটির মাপের, এ লুচি নিটোল গোল নয়, এবড়ো-খেবড়ো, আর এ লুচির ফিনফিনে ফুলকো পেট আঙুল দিয়ে ফুটো করে ভুসভুসিয়ে ধোঁয়া বের করা যায় না— এ লুচি চ্যাপটা। এ হেন লুচির যে দাপট ঢাকায় দেখেছি, তেমনটি আর অন্য কোনও শহরে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আর সে দাপটের সবচেয়ে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতাটি হল দিনকয়েক পরে।

ঢাকা যাব বলে যে কয়েকজন ঢাকাই বন্ধু আমায় বিপুল উৎসাহিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সবার আগে বলতেই হবে ছন্দা মাহবুবের নাম। ছিপছিপে ছোটখাটো মানুষ। চওড়া কপাল। চোখে চশমা। দরাজ হাসি। ছন্দা ও কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি বই প্রকাশনা চালান— উজান। কাঁটাবনে একটা শপিং মলের মধ্যে দোকান। সেখানে টুল-চেয়ার পেতে আড্ডার সঙ্গে চলে— আমার কাছে এক্কেবারে নতুন নামের এক পুরনো পানীয়— রং চা। কালো চা নয়, লাল চা নয়, লিকার চা নয়— রং চা। ঢাকায় সব্বাই দেখলাম এ নামেই ডাকে। বরিশালে, বানারিপাড়ায়, ভোলাতে— সর্বত্রই দেখলাম রং চায়ের চল। কড়াপাকের কষে চিনি আর আদা দেওয়া লিকার চা। আর উজানে আসার আগে শপিং মলের ঠিক বাইরে যে দুই খানার অভিজ্ঞতা হল তার প্রথমটি পুরনো নামের এক্কেবারে এক নয়া খানা— ফুচকা। প্রথম দিনই লালবাগ কেল্লার ঠিক বাইরে দেখেছিলাম ঘটা করে বিক্রি হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান পানি পুরি’। সুন্দর সাজানোগোছানো ঠেলা-গাড়িতে সোনালি কলসির সারি— তেঁতুল পানি, বোরহানি পানি, পুদিনা পানি…। সেখানে খাইনি। খাওয়া দেখলাম বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে।

কলকাতার ফুচকা খাওয়া আর ঢাকার ফুচকা খাওয়ার মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য আছে— গতির পার্থক্য। কলকাতায় ফুচকা খাওয়াটা এক রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা। হাতে শালপাতার বাটি বা খোলা ধরিয়ে পলকমাত্র তা পুর-দেওয়া-জলভরা ফুচকায় ভরে দিতে থাকেন ফুচকাওয়ালা। বিরাট এক হাঁ করে প্রথমটি মুখে পোরার আগেই দ্বিতীয়টি হাজির। জাত ফুচকাখানেওয়ালা (আসলে খানেওয়ালি) আর পাকা ফুচকাওয়ালার মধ্যে চলে এক রুদ্ধশ্বাস অসিক্রীড়া। সুযোগ পেয়েই ফুচকাওয়ালা একটা ফাটা ফুচকা চালিয়ে দিতে পারবেন, নাকি, তড়িঘড়িতে মুখে পুরতে গিয়ে ফিনফিনে ফুচকা ফাটিয়ে ফেলে সারা ওড়নাময় তেঁতুলজল ছড়িয়ে খানেওয়ালি বেইজ্জত হবেন তার এক দুরন্ত প্রতিযোগিতা। যদি খানেওয়ালি তেমন গৌরবর্ণা হন, তবে ফুচকার আলুপুরের বেদম ঝালে ক্রমে তাঁর দুই গালে রং ধরা মেঘলা গোধূলির আকাশের চেয়ে কোনও অংশে কম রংদার নয়। তবু মনে রাখি— “চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি। চেয়ো ‌না চেয়ো না তারে নিকটে নিতে টানি…”

ঢাকার ফুচকা সেবনের গতি এখনও বুর্জোয়া কর্পোরেট চাল পায়নি। তার চাল মুঘলাই সামন্ততান্ত্রিক, রইসি। ফুচকাওয়ালা ধীরে সুস্থে একটি-একটি করে একাধিক ফুচকা পরিবেশন করবেন প্লাস্টিকের মাঝারি মাপের প্লেটে। ওপরে গোল করে ছড়িয়ে দেবেন পাতলা কুচিকরা শসা। প্লেট ধরিয়ে দেবেন খদ্দেরের হাতে। খদ্দের এবার বেছে নেবে সামনের হাঁড়ির জল। প্রত্যেক হাঁড়িতে চোবানো আছে সরু ডান্ডির মুখে ছোট্ট পাত্র ঝালাই করা যে বস্তুটি দিয়ে গ্রামের মুদি টিন থেকে তেল তুলে খরিদ্দারকে দেন তেমন পাত্র— ছন্দা জানালেন তার ঢাকাইয়া নাম চুঙ্গা! দেখেশুনে বেছে নিলেই হল। লালাবাগে যা দেখায় সীমিত ছিল, ছন্দাদের উজানে ঢোকার মুখে তাই চাখার জেদ ধরলাম। ইনি অত বাহারের নন। ‘ইন্ডিয়ান’ (বাংলাদেশের কোনও মানুষকে আমি কদাচ ‘ভারত’ বলতে শুনিনি। কেন, তা মা বুড়িগঙ্গাই জানেন) কিছু পরিবেশনের দাবিও নেই। কিন্তু যা খেলাম, তেমন উপাদেয় ফুচকা আমি অন্তত আগে খাইনি। প্লেটেই সাজিয়ে দিলেন শসাকুচি দিয়ে। ফুচকাগুলি আকারে আমাদের সাধারণ ফুচকার অর্ধেক। অনেক বেশি পুরু আর কুড়মুড়ে। পুর আলু নয়, ছোলার ডালসিদ্ধ কিছু একটা মশলা আর অল্প নুন দিয়ে একেবারে মসৃণ করে মাখা। ফুচকা দেওয়ার পর প্লেটের ওপরে ছড়িয়ে দিলেন তেঁতুলপানি, আমার আপত্তিতে অতি সামান্য।

তবে শুধু ফুচকাই নয়, ফের বায়না— পাশেই আর একটা ঠেলাগাড়িতে ওটা কী? খুব খুশবু ছড়াচ্ছে। চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠা, জানালেন ছন্দা। ফের খাওয়াতে হল তাঁকে (এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিরা অতিথিকে দাম দিতে দেবেন এমন কল্পনাও করা কঠিন)। চিতই পিঠা অনেকটা ফ্রায়েড ইডলির মতো। প্লেটে একটা নিয়ে ওপর থেকে সসের মতো যা ছড়িয়ে খেতে হবে, তাকে বলে ‘ভরতা’। ফের দেখেশুনে বেছে নিলেই হল— যদ্দূর মনে পড়ছে বিকল্পগুলো ছিল: শুঁটকির ভরতা, ধনিয়া পাতার ভরতা, মরিচের ভরতা আর সবজির ভরতা। শুঁটকিরটাই নিলাম— বেশ খেতে, কিন্তু বেতাক ঝাল। রক্ষা করল ভাপা পিঠে। একটা হিন্ডেলিয়ামের হাঁড়িতে টগবগিয়ে ফুটছে জল, তার মুখটা বন্ধ করা একটা মাটির সরার কানায় আটা লেপে। সরার ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট ফুটো, যা দিয়ে প্রবল বেগে বের হচ্ছে বাষ্প। একটা স্টিলের স্বল্প গভীর বাটিতে চেপে চেপে চালগুঁড়ি ঠেসে, সেই সরার মুখে একটা পাতলা কাপড় বিছিয়ে তার ওপর উপুড় করে দেওয়া হচ্ছে সেই বাটি। বড় জোর মিনিটদুয়েক। কাপড় টেনে বাটি তুলে ঠুকলেই বেরিয়ে আসছে হাতে গরম গোল চ্যাপটা ভাপা পিঠে। ওপরে নলেন গুড় একটু ছড়ানো, আর দেশলাইকাঠির মতো সরু করে কাটা— যাকে রান্নার ভাষায় ‘জুলিয়েন’ বলে, নারকোলের সেই জুলিয়েন। হাল্কা শীতের সন্ধ্যায় অমৃত।

ইত্যাকার পেটপুজোয় ফুরফুরে মনে উজানে কিছুক্ষণ আড্ডা হল রং চা সহযোগে। সেখানে পরিচয় হল সুলতান আহমদ সাহেবের সঙ্গে। ছোটখাটো মানুষ। সাংবাদিক। আর ছিলেন দারুণ হাসিখুশি ফেরদৌসি রিতা। কথায়-কথায় বুঝলাম তিনি আমারই মতো খাদ্যরসিক। ‘কাবাব কিস্‌সা’ নামে কাবাব নিয়ে আমার লেখা একখানা আস্ত কেতাবই আছে শুনে লাফিয়ে উঠলেন— ‘‘তবে তো আপনাকে কাবাব খাওয়াতেই হবে!’’

‘‘কোথায়?’’
‘‘পুরান ঢাকায়। আমার বাড়ির একদম কাছেই।’’

যেমন কথা তেমনি কাজ। তিনজনে উঠে পড়লাম— দুই রিকশায়। একটায় আমি, অন্যটাতে ছন্দা আর তাঁর ফেরদৌসি আপা। সন্ধ্যার পুরান ঢাকার চেহারা সকালের চেয়ে কোনও অংশে কম গমগমে নয়। ঢাকায় রিকশা চড়াও এক অভিজ্ঞতা। লম্বা-লম্বা পথ লোকে রিকশায় নয় তো অটোতে পাড়ি দেয়। কাজেই পঞ্চাশ টাকার নিচে বোধহয় কোনও ভাড়া নেই। প্রায়শই একশোও ছাড়িয়ে যায়। রিকশাচালক গাড়ি চালান ঊর্ধ্বশ্বাসে, প্রবল বেগে। রিকশাতে প্যাঁকপেকি নেই— ক্রিংক্রিং ঘণ্টি। প্রাণপণে তা-ই বাজাতে-বাজাতে, কখনও চেঁচিয়ে, কখনও হাত তুলে পথচারী বা অন্য রিকশাকে সাবধান করে, কখনও গর্জন করে ধেয়ে আসা রংচটা বাস এড়াতে সাঁ করে গোঁৎ খেয়ে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরেই টাল সামলে ফের ঘুরে নিজের পথ ধরে চলতে থাকেন নির্বিকার রিকশাওয়ালা। কলকাতার নাদুসনুদুস বাবু তখন দাঁতে দাঁত চেপে দু-হাতে হুডের গোড়া খামচে, কারণ ঢাকার রিকশায় যাত্রীসিটের দুপাশে হ্যান্ডেল নেই, সরু সিট থেকে পশ্চাদ্দেশ হড়কে যাওয়া কোনও ক্রমে আটকে, ইষ্টনাম জপতে-জপতে গন্তব্যের অধীর অপেক্ষায়।

সেই সন্ধ্যাতেও গন্তব্যে পৌঁছনোর প্রথম ইঙ্গিত দিল নাক। এ গন্ধের সঙ্গে আমি বিলকুল পরিচিত— এ খুশবুদার ধোঁয়াটে সন্ধ্যা-রাতের ঢেউয়ে আমি ভেসেছি শাহজাহানাবাদে— যার হালফিলের নাম পুরানি দিল্লি, তার বুক চিতনো জামা মসজিদের এক নম্বর গেটের উল্টোদিকের কাবাবওয়ালি গলিতে কিংবা হজ়রত নিজ়ামউদ্দিন আর হজ়রত আমির খুসরোর পবিত্র দরগার ঠিক পিছনের বাওলি গেট ফুড স্ট্রিটে, লখনউয়ের চওক বা আমিনাবাদের তুন্দে কাবাবির পাড়ায়, তেহরানে পথ হারিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জনবিহীন রাস্তার ধারের আড্ডায়, পশ্চিম আজ়েরবইজান প্রদেশের একরত্তি রাজধানী খোই শহরের হোজালি রেস্তোরাঁয় পা রেখেই, লাহোরের আলোকিত সদর্প বাদশাহি কেল্লার ঠিক পাশের রওশনাই দরোয়াজ়া ফুড স্ট্রিটে, করাচিতে গভীর মধ্যরাতের লোকে লোকারণ্য বোট বেসিন ফুড স্ট্রিটে— যার গালভরা নাম খয়াবান-এ-সাদি। পুরান ঢাকায় এ কাবাবি পাড়ার পোশাকি নাম নাজিমুদ্দিন রোড।

পাশাপাশি ঠেসাঠেসি খানতিনেক দোকান। যেমন হয় খাস কাবাবির জয়েন্ট। দশ ফুট বাই দশ ফুট। সামনে লোহার চুলিতে গনগনিয়ে কয়লা জ্বলছে কালি-চিটচিটে ছোট্ট টেবিল ফ্যানের হাওয়ায়। ওপরে সারি সারি রংবেরঙের শিকে পুড়ছে মুর্গি আর গরুর মাংসের নানা মাপের টুকরো। আর তা থেকেই ভলকে-ভলকে ওঠা ধোঁয়ায় ম ম সারা পাড়া। দোকানে বসার কোনও ব্যবস্থা নেই। একচিলতে রাস্তায় কাতারে-কাতারে মানুষ আর রিকশার গুঁতোগুতি। তারই ওপাশে কয়েকটা নড়বড়ে বেঞ্চি পাতা। দোকানের দেওয়ালের হুকে ফোঁড়া আছে ছোট-ছোট কাগজের চিরকুটে লেখা এক একজন খদ্দেরের অর্ডার। লম্বা লাইন।

কিন্তু এ কাবাবির কাছে ফেরদৌসি আপার স্পেশাল খাতির। তাঁর দলের চিরকুটের দরকার নেই। আমারই পছন্দমতো অর্ডার হল বিফ শিক কাবাব, চিকেন বোটি কাবাব আর চিকেন হরিয়ালি কাবাব। চমকটা লাগল পরিবেশনের সময়। রাস্তার ওপাশে একটু অপেক্ষার পরেই এক ছোকরা হাতে ধরিয়ে দিল খোপকাটা স্টিলের থালা। তাতে ছোট-ছোট খোপে নানা কিসিমের নানা রঙের চাটনির মতো কী সব— ছুঁয়েও দেখিনি, আর মাঝখানে লম্বা কাবাবের নীচে একখানা লুচি। পরাঠা, তন্দুরি রুটি, রুমালি রুটি, হরেক কিসিমের নানের সঙ্গে এনতার কাবাব খেয়েছি এতকাল। মায় ভাতের সঙ্গেও খেয়েছি খোই শহরের বিখ্যাত হোজালি রেস্তোরাঁর ‘চেলো ক্যাবব’। কিন্তু লুচি-কাবাব? আশ্চর্য এক যুগলবন্দি! সক্কাল সক্কাল পুরান ঢাকার দোকানে-দোকানে যে লুচি ভাজা হতে দেখেছিলাম, এ লুচি ঠিক সেই লুচি। এ বিফ শিক কাবাব যে কোনও শহরের সেরা শিকের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দেবে— গভীর গন্ধ, ওপরের ত্বক হালকা পোড়া, মুচমুচে, দাঁত বসালেই নরম গোস্ত, চিবোতে হয় সামান্যই। দাঁতখড়কের কোনও প্রয়োজন এ শিক কাবাব খেয়ে হবে না। খানদুয়েক লুচি সাবড়ানোর পর মনে হল আমি নই, মেজাজটাই তো বাদশা!

ছন্দা আর ফেরদৌসি হাসির ফোয়ারা ঝরিয়ে বিদায় নিলেন। সন্ধ্যা রাত্রির দিকে গড়াচ্ছে। আমি আর একটা রিকশা নিয়ে হোটেলমুখী। রাস্তার ভিড় ফিকে হয়ে এসেছে। অচেনা শহর, অচেনা পথঘাট। তাকাতে-তাকাতে মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকল গত কয়েকদিনের নানা ছবি, নানা কথা— মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেখা ছবি, বঙ্গবন্ধুর জাদুঘর-হয়ে-যাওয়া বাড়ির ছবি-তুলতে-না-দেওয়া একগোছা টকটকে গোলাপ রাখা সেই সিঁড়িটার ছবি, মধুদার ক্যান্টিনের হলঘরের ছবি, জগন্নাথ হলের গেটের ছবি। আর নানা কথা। ছন্দার কথা… রংপুরে বড় হওয়া ছন্দার মা রেখা চৌধুরীর কথা… অকালপ্রয়াত কবি, অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের ছিপছিপে, অতি অমিতবাক কন্যা অদিতি কবির খেয়ার কথা… জাকির সাহেবের কথা…  বরিশালের সুপ্রিয় দত্তর কথা… ভোলা শহরের স্বপনবাবুর কথা… আরও কত পরিচয় হওয়া-না-হওয়া মানুষের কথা। এত হাসি, এত রং, এত সুগন্ধের সঙ্গে যেন কোথায় এক গভীর গরমিল।

অনেক-অনেক বছর আগে একটা কবিতা লিখেছিলাম, যার কয়েকটা পংক্তি খাপছাড়াভাবে বারবার আমার মাথায় বাড়ি দিতে থাকল—

এই শহরের নীচে
একটা শহর আছে
বেনাম
বেনামই শুধু নয়
অদৃশ্য…
সম্মিলিত আর্তনাদ
আর ভুলে-যাওয়া-ভরা
একটা শহর

সেই শহরে আমি কোনও দিনই পৌঁছতে পারব না। কিন্তু এই সব হাসি-রং-গন্ধ-স্বাদ ছাপিয়ে সেই শহরটা আমায় ডাকছে। সেই ঠিকানাটা আমায় ডাকছে। আমার সফরসূচি বলছে ঢাকা ছাড়ার দিনটিতেই, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, শনিবারেই শুধু, সে ঠিকানায় পৌঁছনো সম্ভব, তার আগে কিছুতেই নয়। অপেক্ষা।

 

[ক্রমশ]


*সঙ্গের সব ছবি নীলাঞ্জন হাজরার তোলা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. ঢাকাতে— শহর থেকে শহরে – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...