চার নম্বর নিউজডেস্ক
নারীত্ব অভ্যেসের মতো। গোটা জীবন, বয়ে নিয়ে চলা অভ্যেসের মতো। আর সেই নারীত্বের সঙ্গে যখন লড়াই চলে দারিদ্র, অপমান এবং হিংস্র পৌরুষের সঙ্গে, তখন তা অসহনীয় হয়ে ওঠে। সেই অসহনীয়তা থেকে বেরোতে পারে না সবাই। বেরোলেও, সেই জেদ ধরে থেকে উত্তরণের গল্প কজনের জানা? ঝুনবালা মালিক সেই অল্প কয়েকজনের ভেতর পড়েন। একটু প্রেক্ষাপট জেনে নেওয়া দরকার। আদিবাসী ভারতবর্ষ, গ্রামীণ ভারতবর্ষের অবস্থানটা জেনে নেওয়া দরকার।
ওডিশার জয়পুর জেলার প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রাম কাচেরি গাঁও। কৃষি-শ্রমিক এবং দিনমজুর প্রধান গ্রাম, যার অধিকাংশ বাসিন্দা ভূমিহীন চাষি। মায়ের হৃদরোগ-জনিত সমস্যা বহু আগে থেকেই। বাবা-মা এবং তিন ভাইবোন – ঝুনবালা ক্লাস ফাইভের গন্ডি পেরোতে পারলেন না। ঘর দেখবে কে? কে সামলাবে সব? অতএব চিরাচরিত ত্যাগের লেগ্যাসি। যার পরিণতি নিজের মানুষজনের কাছেই অনুযোগ, অবহেলা। সেই অনুযোগের কথায়, পরে আসছি। কৃষি-শ্রমিক বাবার সঙ্গে কাজে সাহায্য করতে ছুটতেন কিশোরী ঝুনবালা। অসম্ভব অর্থকষ্ট, একদিন খাওয়া হলে পরের দিন খালিপেট বাধ্যতামূলক। এইসব অনটনের দিন পেরিয়ে একদিন বিয়ে। ঝুনবালা একটু আশা দেখলেন। একটু আলোর খোঁজ করলেন। পেলেন না। বরং জুটে গেল বরাদ্দ কিছু গৃহ-হিংসার চেনা ছবি। পণের পাওনা ২০,০০০ টাকার ভেতর দরিদ্র পিতা জোগাড় করতে পেরেছিলেন ১৫০০০ টাকা। এই পাঁচ হাজারের শূন্যতা অর্থপিশাচ পরিবার শুনবে কেন? অতএব চলুক ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। প্রত্যন্ত গ্রামে কোথায় সংবাদমাধ্যম, কোথায় ওম্যান সেল! ঝুনবালা আর পাঁচটা মেয়ের মতো মার খেতে থাকলেন। মদ্যপ স্বামীর হাতে মার, বাকি আত্মীয়দের হাতে লাঞ্ছনা, কখনও শারীরিক নির্যাতন – কিছুই বাদ গেল না। সীমা ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেছিল আগেই। তবু, দেরি করে হলেও একদিন বাড়ি যাওয়ার অছিলায় ঝুনবালা সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন নিজের বাড়ি। কয়েকমাস পরে ডাক পড়ল। সভ্য হয়ে যাওয়ার, নরম হওয়ার অভিনয় চলল। ঝুনবালার নিজের বাড়ির লোকজনও সেই ফাঁদেই পা দিল। অথচ একফোঁটাও টলানো গেল না ঝুনবালাকে। নরক থেকে বেরিয়ে আর ফেরার রাস্তা নেই। সমস্ত অপমান শুনেও আশ্চর্য মনোবলে ঝুনবালা শক্ত থাকলেন।
আর এখানেই অন্য লড়াই। দ্বিতীয় ধাপ। রাস্তা তৈরি করলেই হবে না, সেই রাস্তায় চলতেও হবে। সেই রাস্তা ভয়ঙ্করতম হতে পারে জেনেও থামা চলবে না। ঝুনবালার এই রাস্তাটা কেমন ছিল? শুরুতেই বীভৎস পাহাড়। ব্যক্তিগত লড়াইয়ের সঙ্গে শোক। দাদা যন্ত্রপাতি সারাইয়ের কাজ করতেন। স্থানীয় বচসার জোরে খুন হয়ে গেলেন হঠাৎ। মাসে ৩০,০০০ টাকা আয় ছিল। এখন আচমকা একঘর শোক, অর্থকষ্ট ও শূন্যতা। ঝুনবালা আরও একা হয়ে গেলেন। আর্থিক সঙ্গতি ফেরানোর লড়াই তাঁর? পারবেন একা? ঝুনবালা কিন্তু পেরেছিলেন। ২০১৮ সালে একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রায় নেতৃত্ব দিলেন একা। মেয়েদের আয় বাড়ানোর ব্যাপারে জোর দিলেন, নিজেও ক্রমশ আলোর রাস্তা দেখার চেষ্টা করে গেলেন। দুবার করে মিটিং প্রতিমাসে, ঘরে ঘরে গিয়ে উদ্বুদ্ধ করলেন গ্রামের মেয়েদের। ২০২১ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের সহায়তায় এনজিও ‘হ্যাবিটাট ফর হিউম্যানিটি ইন্ডিয়া’ পাশে দাঁড়াল ঝুনবালাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজে। আর্থিক ভরসা দিল অনেকটাই। কলা, টমাটো, বেগুন, ফুলকপিসহ বিভিন্ন মরশুমি ফল ও সবজি চাষে প্রশিক্ষণ দিল এই সংস্থা। বিকল্প জীবিকার সন্ধানে তালপাতার হাতপাখা ও খাবার প্লেট তৈরির কর্মশালা আয়োজন করা হল অনেকগুলি। মাত্র আট মাসের মধ্যে গোষ্ঠীর দশজন সদস্যের আয় বেড়ে গেল অনেকটাই। একসাথে মোট ৫৫,০০০ টাকা দিয়ে শুরু করে মোট ৫ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হল এই সংঘবদ্ধ লড়াইয়ে। এই মুহূর্তে মাসে অন্তত ১০,০০০ টাকা আয় খুব সহজের সম্ভব হচ্ছে ঝুনবালাদের প্রত্যেকের পক্ষে।
ঝুনবালার নিজস্ব লড়াই চলছে। হার্টের সমস্যায় মায়ের চিকিৎসায় মাসে ৩,০০০ টাকার ওষুধের জোগান, গৃহস্থ সবকিছুর সঙ্কুলান একাই সামলাতে হচ্ছে ঝুনবালাকে, ভরসা সেই স্বনির্ভর গোষ্ঠী। আয় আরও অনেকটা বেড়ে যাবে, এ আশা খুব বাড়াবাড়ি নয় হয়তো। পারিবারিক হিংস্রতা থেকে যে আলো দেখেছেন ঝুনবালা মালিক, যে অবিশ্বাস্য বদল এনেছেন জীবনে, তা বাকি জীবন, বাকি মেয়েদের এভাবেই আলো দিক। আশা থাকুক…
এমন লোকের সন্ধান জারি থাকুক আপনাদের পত্রিকার পাতায়।
হীরক সেনগুপ্ত
চারিদিকে এত হাহাকারের মধ্যে ঝুনয়ালা মালিকের সাহসী সংগ্রামের কথা শুনে মন ভাল হয়ে গেল। হয়ত এই নিয়ো -ক্যাপিটালিস্ট পৃথিবীর পরেও একটা আশার আলো কোথাও আছে।