সুব্রত রায়
প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী
যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষ-গণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষোচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
—বেগম রোকেয়া (আমাদের অবনতি)
কোভিড অতিমারি পুরোদমে চলার সময়, ২০২১ সালে, বলিউড অভিনেত্রী দিয়া মির্জার বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। সেলিব্রিটিসুলভ জাঁকজমকের জন্য নয়; এর কারণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, দিয়ার বিয়ের ধর্মীয় আচারগুলি সম্পাদনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জনৈকা মহিলা পুরোহিত। পুরোহিতের আসনে কোনও পুরুষপুঙ্গবকে দেখতেই লোকজন অভ্যস্ত, কাজেই, চোখে লাগারই কথা। ইদানীং ভারতের ইতিউতি এরকম ‘অলক্ষুণে’ ঘটনা অল্পবিস্তর ঘটছিল, কিন্তু বলিউডে সেই প্রথম। কয়েক বছর হল, খোদ কলকাতায় ‘শুভমস্তু’ নামক উদ্যোগটি গড়ে তুলেছেন একদল নারী, যাঁর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংস্কৃতের অধ্যাপিকা। এঁরা গৃহপ্রবেশ থেকে চণ্ডীপাঠ সবেতেই পুরুতগিরি করতে তুমুল উৎসাহী। বিয়ের আসরে প্রশিক্ষিত কণ্ঠে নির্ভুল বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, এমনকি, কখনও কখনও ইংরেজি বা স্থানীয় ভাষায় মন্ত্রগুলির তর্জমা করে দিয়ে, এবং নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিটি আচার সম্পাদন করে মেয়ে পুরোহিতরা হইহই করে বংশপরম্পরায় পুরোহিত দর্পণ ওগরানো পুরুতমশাইদের চৌহদ্দিতে পা রেখেছেন। সমাজের একটা অংশের কাছে দ্রুত এঁরা গ্রহণীয় হয়ে উঠছেন। এসব দেখে, কেউ বলছেন হুজুগ! কেউ বলছেন যুগের হাওয়া! কিন্তু, ঘটনাটিকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। গোটা ভারতেই এই নতুন পুরুতশ্রেণিটির সদস্যসংখ্যা একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। ঘোমটা টেনে পুজোআচ্চার জোগাড়যন্তর করা আর ব্রতকথা পাঠের মেয়েলি আবহ থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষতন্ত্রের আগল ভেঙে বৈদিক মন্ত্রপাঠের অধিকার আদায় করা খুব সহজ কথা ছিল না। বাস্তবে তা এক চমৎকার রূপকথার গল্প। বৈদিক মন্ত্রের উড়ানে ভর করে ফেমিনিজ়মের ধ্বজা উড়িয়ে নারী পুরোহিত এখন এক দুর্দান্ত ক্রেজ় হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
কিন্তু, হিন্দু বিবাহের সাম্প্রতিক এই ট্রেন্ড কি সত্যিই প্রগতিশীল? এতে কি মেয়েরা সত্যি করে লাভবান হচ্ছেন কিছু? এর উত্তর খুঁজতে গেলে একটু পেছন ফিরে তাকানো দরকার।
‘অমন্ত্রবৎ’ থেকে পুরোহিতের আসনে
আদিম সাম্যবাদী সমাজে নারী-পুরুষের সমতা বজায় ছিল। এমনকি, কখনও কখনও নারীরা থাকত নামভূমিকায়। তারা শিকার, আচারঅনুষ্ঠান ও গোষ্ঠীর নেতৃত্বও দিত। কৃষিকাজের আবিষ্কারক তারা, যুগ যুগ ধরে এ কাজের ভার ন্যস্ত ছিল তাদেরই হাতে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অনেক নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে ও কোনও কোনও মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আজও খুঁজে পাওয়া যায়। বৈদিক যুগের প্রথম দিকেও এমন কিছু নারীর নাম পাওয়া যায়, যাঁরা অর্চনায় মুখ্য ভূমিকা নিতেন, শিক্ষয়িত্রীর দায়িত্ব পালন করতেন, বেদের ভাষ্যকার হিসেবেও তাঁদের নাম ঋগ্বেদ-এ উল্লিখিত আছে। এঁদেরকে ‘ব্রহ্মবাদিনী’ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য বেদের শ্লোকগুলির কিয়দংশের রচয়িতা হিসেবে অদিতি, অপালা, ঘোষা, লোপামুদ্রা প্রমুখ যে কয়েকজন নারীর কথা বলা হয়ে থাকে, তাঁদের সত্যিকারের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এঁদের কথা নিশ্চিতভাবেই বেদে লিখিত আছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট শ্লোকগুলি তাঁদেরই রচনা কিনা বোঝা দুষ্কর। যদি তা হয়েও থাকে, সেগুলির মোট আয়তন গোটা বৈদিক সাহিত্যের একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। এটা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। বৈদিক সমাজ মোটের ওপর পিতৃতান্ত্রিক ছিল। বেদে কয়েকজন দেবী আছেন ঠিকই, কিন্তু দেব ও দেবী সংখ্যার অনুপাতটা দেবীদের পক্ষে আদৌ সম্মানজনক নয়, এবং কেবল দেবীদের উপস্থিতি দিয়ে সমাজে নারীর অবস্থান ও ক্ষমতা মাপা যায় না। তার ওপর ছিল বর্ণাশ্রম প্রথা। ঋগ্বেদ-এর পুরুষসূক্তে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শূদ্র জন্মের কথা বলা হয়েছে। কাজেই, ‘বৈদিক সাম্যাবস্থা’ বলতে যতটা ফলাও করে প্রচার করা হয়, বাস্তব তা থেকে অনেকটাই আলাদা। স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করার জন্য ‘স্বর্ণযুগের’ এই মিথটির অনেকখানি নির্মাণ করা হয়েছিল।
পরের দিকে সমাজে পুরুষতন্ত্রের প্রভাব অনেকখানি বেড়ে উঠলে, বিশেষ করে বৈদিক যুগের মধ্য ও শেষদিকে, যাজ্ঞবল্ক্য-মনু-ভার্গব ত্রয়ীর পাল্লায় পড়ে নারী শূদ্রের মতোই অন্ত্যজ শ্রেণিতে পতিত হয়। সর্বগুণসমন্বিতা নারীকেও নামিয়ে দেওয়া হয় নিকৃষ্টতম পুরুষের চাইতেও নিচে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এ ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য পুরুষকে পরামর্শ দেন এভাবে যে, স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে প্রহার করে তাকে স্ববশে আনা যাবে। মনু দুর্ভাষিণী স্ত্রীকে বিবাহের এক বছর পরে গয়নাগাটি কেড়ে নিয়ে পরিত্যাগের নিদান দেন অথচ উন্মাদ, নির্বীজ ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে পীড়িত স্বামীর পরিচর্যার দায়িত্ব যাতে নারী অস্বীকার করতে না পারে তার পাকা বন্দোবস্ত করে রাখেন। প্রাচীন সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সাহিত্য থেকেও নারীকে ঊনমানব করে তোলার এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ উত্তম নারীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে: স্বামীকে তুষ্টকারী, পুত্রসন্তানের জন্মদাত্রী ও নির্বিবাদে স্বামীর মতামতের অনুসরণকারিণীই হল উত্তম নারী। বৌধায়ন ধর্মসূত্র বন্ধ্যা স্ত্রীকে দশ বছর পরে ও মৃতবৎসাকে পনেরো বছর পরে তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তুলে দেয় পুরুষের হাতে। স্বভাবত, তাঁদের শিক্ষার তথা বেদপাঠের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়। কারণ, সে হল পাপিষ্ঠা ও অশুচি। সে পাপিষ্ঠা, কারণ তার হৃদয় নাকি নেকড়ে বাঘের মতো (ঋগ্বেদ-এ ঊর্বশী তাঁর প্রেমিক পুরুরবাকে বলেছে এ কথা) এবং সে প্রকৃতিগতভাবেই হৃদয়বৃত্তিতে অবিশ্বাসী, যৌনাচারের ইচ্ছে ছাড়া নাকি আর কিছুই সে বোঝে না (মহাভারত-এ অপ্সরা পঞ্চচূড়ার মুখে এ কথা বসানো হয়েছে)। সে অশুচি, কারণ সে রজস্বলা হয় এবং তাকে সন্তানের জন্ম দিতে হয়। এখানে প্রযোজ্য হয় চমৎকার সার্কুলার লজিক। সে পাপিষ্ঠা বলে বেদপাঠ ও বেদমন্ত্র শ্রবণের (বিশেষত গায়ত্রী মন্ত্র) অধিকার হারায়, আবার, বেদমন্ত্র শ্রবণ করেনি বলে তার পাপমুক্তিও ঘটে না! নারী হয়ে ওঠে ‘অমন্ত্রবৎ’।
বৈদিক যুগের গোড়ায় ‘উপনয়ন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শৈশবে ছেলেদের মতো মেয়েরাও উপবীত ধারণ করত ও জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেত। এক্ষেত্রে বর্ণাশ্রম প্রথাকেও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা, ব্রাহ্মণদের মতো উপবীত ধারণের সুযোগ পেলেও সকলে সে সুযোগ পেত না। অবশ্য ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দিষ্ট সকল প্রকার আরাধনা ও মন্ত্রপাঠের সুযোগও উপরোক্ত দুই বর্ণের ছিল না। ধীরে ধীরে সমাজে নারীদের অবনমন ঘটতে শুরু করলে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক নাগাদ তাদের জন্য ‘উপনয়ন’ এক প্রতীকী রূপ পরিগ্রহ করে— উপবীত কেবল পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট হয় এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত মেয়েদের ক্ষেত্রেও শৈশবের পরিবর্তে বিবাহের অনতিকাল পূর্বে প্রক্রিয়াটি সেরে ফেলা হতে থাকে। মনুস্মৃতি-র কালেও (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০-২০০) তা প্রচলিত ছিল, অবশ্য গায়ত্রী মন্ত্র ব্যতিরেকেই তা নমোনমো করে সম্পন্ন হত। যাজ্ঞবল্ক্য (২০০-৪০০ খ্রিস্টাব্দ) নিয়ম করে তা বন্ধ করে দেন। তারপর থেকে শত শত বছর ধরে নারী সম্পর্কে ওইসব শাস্ত্রবচন ভারতীয় সমাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। ঋতুচক্র ও সন্তান জন্মদানে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কায় নারীরা বেদপাঠ থেকে নিজেদের বিরত রাখে। মীরাবাই ও আক্কামহাদেবীর মতো ঈশ্বরপ্রেমে আকুল কবিরা বৈদিকমন্ত্রের অভাব মাতৃভাষায় গীত রচনার মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়াকেই শ্রেয় বলে মনে করেন, অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত কবীর ও রামদাস যে পথ বেছে নিয়েছিলেন। গার্হস্থ্য জীবনে পুজোআচ্চায় নারীর ভূমিকা হয়ে ওঠে গৌণ। অষ্টাদশ শতকে লিখিত স্ত্রীধর্মপদ্ধতি পুজোআচ্চায় গৃহকর্তার পাশাপাশি স্ত্রীর উপস্থিতিকেও জরুরি বলে মেনে নেয়। তবে স্বামী পুরোহিতের নির্দেশমাফিক হোমযজ্ঞ, মন্ত্রপাঠ ইত্যাদি প্রধান কাজে লিপ্ত থাকবে, উপাচারের আয়োজন ইত্যাদি অপ্রধান কাজ করবে স্ত্রী। অবশ্য নারীর রয়েছে কিছু নিজস্ব মেয়েলি আচার। তাতে স্ত্রী ‘ব্রত’ রাখে, উপোস করে, সুর করে ব্রতকথা পড়ে, কিন্তু সেখানে বৈদিক মন্ত্রের কোনও ব্যাপার নেই। উপরন্তু, এসব আচার পালন তার নিজের জন্যও নয়। নিজেই নিজের অস্তিত্বকে নির্মমভাবে অস্বীকার করে সে এসব আচরণের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে কেবল স্বামী-সন্তান-পরিবারের স্বাস্থ্য-সমৃদ্ধির কল্যাণ কামনা করে চলে।
১৯৭০-র দশকে পুনে শহরের জনৈক উৎসাহী পুরোহিত শিশুদের বেদশিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। কিন্তু শিশুদের চেয়ে তাদের মায়েদের উৎসাহই ধরা পড়ে বেশি। এভাবেই শুরু হয় আধুনিক ভারতে মেয়েদের বেদমন্ত্রে প্রশিক্ষণ। কালক্রমে ব্রাহ্মণ ছাড়াও অন্যান্য জাতের মেয়েদের জন্য খুলে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের দরজা। দেখাদেখি আরও কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। এই মুহূর্তে, যতদূর জানি, গোটা দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত মহিলা পুরোহিত রয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভাল যে, দক্ষিণ ভারতে অবৈদিক দেবদেবীর আরাধনায় কিছু মন্দিরে নারীরা পৌরোহিত্য করার সুযোগ পান। আবার, এই বৈপরীত্যটিও লক্ষ করার মতো যে, দক্ষিণ ভারতেরই একটি রাজ্য কেরলে শবরীমালা মন্দিরে ঋতুবতী নারীদের প্রবেশের অধিকার নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। শবরীমালার এ ইতিহাসের এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তবে, মহিলা পুরোহিত বিষয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটে উত্তর ভারতে, ২০১১ সালে। ধর্মকেন্দ্রিক ভ্রমণবাণিজ্যের কারণে দেশের স্বনামধন্য অঙ্গরাজ্য উত্তরাখণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হরিদ্বারে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে ১০৮ জন নারী বৈদিক মন্ত্র পাঠ করেন। আরও আশ্চর্যের যে, ওই নারীরা সকলে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না, এমনকি, কয়েকজন ছিলেন দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। এরপর, ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুরে একটি ৯০০ বছরের পুরনো মন্দিরের পৌরোহিত্যের অধিকার থেকে স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটি ১২৯ জন পুরোহিত পদপ্রার্থীর ইন্টারভিউ নিয়ে অনেক ঝাড়াইবাছাইয়ের পর মন্দিরের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে একজন নারীকে পুরোহিত হিসেবে নির্বাচন করে। নিশ্চয়ই ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যরা তাঁকে যোগ্যতর ভেবেই নির্বাচিত করেছিলেন। এসব ঘটনা যখন ঘটে চলেছে, তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যক্তিগত পুজোআচ্চা বা বিবাহ অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্যের জন্যও মহিলা পুরোহিতদের ডাক আসতে শুরু করেছে।
বাধা যে একেবারে আসেনি, তা নয়। তবে হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে কোনও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কাজটাতে খুব বেগ পেতে হয়নি। শঙ্করাচার্য একজন আছেন বটে, তবে তার ক্ষমতা পোপতুল্য নয়। কাজেই, রোমান ক্যাথলিক ‘মহিলা যাজক’দের মতো গির্জা থেকে বিতাড়িত হতে হয়নি এই হিন্দু মহিলাদের। দু-একটা বিদ্রূপ, ছোটখাটো হুমকি, পারিবারিক বাধা ইত্যাদি পেরিয়ে দিব্যি মেয়েরা এগিয়ে আসছেন এ কাজে। কিন্তু বৈদিক মন্ত্রগুলি, যা সম্বল করে তাঁরা পুরোহিতগিরির পেশায় ব্রাহ্মণ পুরুষদের একচেটিয়া রাজপাট দখল করতে উদ্যত হলেন, সেই মন্ত্রগুলি কি আদৌ তাঁদের জন্য সম্মানজনক? ওই মন্ত্রগুলি উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে তাঁরা কি নিজেদের মহিমান্বিত করছেন, নাকি প্রকারান্তরে নিজেদের খাটো করে ফেলছেন? বৈদিক বিবাহের মন্ত্র ও আচারগুলিকে একটু খুঁটিয়ে দেখলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বৈদিক বিবাহ কিংবা অশ্মচরিত
প্রথমেই একটি কথা বলে নেওয়া দরকার। বৈদিক বিবাহ বলতে সাধারণত যা বোঝানো হয়, তাতে বৈদিক মন্ত্রপাঠের বিষয়টিকেই নির্দেশ করা হয়। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, বৈদিক যুগে বিবাহপদ্ধতির কোনও রকমফের ছিল না। অর্চনার পদ্ধতিপ্রকরণ যুগে যুগে বদলায়, তার উপরে সময়ের পলি পড়ে, লোকাচার যুক্ত হয়। কিন্তু মন্ত্র হল এমন এক অভিচার, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় অবিকৃতই থেকে যায়। বিবাহ অনুষ্ঠানেও যুগে যুগে পরিবর্তন এসেছে, মন্ত্রগুলি না বদলালেও সংখ্যায় হ্রাস পেয়েছে। হিন্দু বিবাহের আচারঅনুষ্ঠানে কালক্রমে যেমন অনেক লৌকিক আচার জায়গা করে নিয়েছে, তেমনি বিবাহের বৈদিক মন্ত্রগুলিও কাটছাঁট করে কমে এসেছে অনেকখানি। তবে যেটুকু টিঁকে আছে, সেটুকুই আমাদের বিচারবিবেচনার জন্য যথেষ্ট।
স্বমহিমায় উজ্জ্বল এক বৈবাহিক আচারের নাম ‘অশ্মারোহণ’। বরের নির্দেশে বধূ এক খণ্ড পাথরের উপরে দাঁড়ালে বরকণ্ঠে উচ্চারিত হয় এই বৈদিক মন্ত্রটি:
এহি অশ্মানমাতিষ্ঠ অশ্মেব ত্বং স্থিরা ভব।
অর্থাৎ অশ্মখণ্ডের মতোই স্থিরতা প্রত্যাশা করা হয় বধূটির কাছে, যে ধ্রুব ও প্রস্তরবৎ বধূটিকে বিবাহ-অনুষ্ঠানের গোড়াতেই পিতা নিতান্ত বস্তুসামগ্রীর মতো সম্প্রদান করে তুলে দিয়েছেন বরের হাতে (‘কন্যা-সম্প্রদান’)। কূলগোত্র সবই এক ধাক্কায় পালটে গেছে তার। মনুস্মৃতি তো বলেই দিয়েছে যে, নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররাই তার রক্ষাকর্তা। কাজেই, সে হস্তান্তরযোগ্য। এই হস্তান্তরে তার সম্মতি অপ্রয়োজনীয়, এখানেও অভিপ্রেত তার স্থিরতা। বিয়েতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সহাস্য উপস্থিতিতে এক আলোঝলমলে মণ্ডপে সংস্কৃত মন্ত্রের দুর্বোধ্যতাকে ঢাল করে এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। মিহি কণ্ঠে বরের কাছে প্রত্যাশা করা হয়, যেন সে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে বধূটির দোষত্রুটি মার্জনা করে দেয় ও গুণের কদর করে:
তস্যা দোষাঃ ক্ষন্তব্যাঃ।
গুণাশ্চ প্রশংসনীয়াঃ।
যৌবনে স্বামীগৃহই যে বধূটির অভীষ্ট স্থান, ‘পাণিগ্রহণ’ পর্বে তা উচ্চারণ করতে হয় তাকে:
প্র মে পতি র্বা নঃ পন্থাঃ কল্পনাম্।
শিবা অরিষ্টা পতিলোকং গমেয়ম্।
বরও সন্তোষ প্রকাশ করে বলে যে, গৃহের দায়দায়িত্ব সামলানোর জন্য ঈশ্বর তোমাকে আমার হাতে সমর্পণ করেছেন:
মহং ত্বাদু র্গার্হপত্যায় দেবাঃ।
এবং আরও প্রত্যাশা করা হয় যে, বধূটি যেন স্বামী ও নতুন গৃহের অন্যান্যদের কোনও ক্ষতি না করে; উপরন্তু, বীরপ্রসবিনী হয়, মৃতবৎসা না হয়, নতুন গৃহের সকলের (এমনকি পশুদেরও প্রতি) প্রতি সদাচারী ও দয়ালু হয়:
অঘোর-চক্ষুর্ অপতিঘ্ন্যেধি
শিবা পশুভ্যঃ— সুমনাঃ সুবর্চাঃ।
বীর-সুর্ জীব-সুর্ দেব-কামা স্যোনা—
শন্ নো ভব দ্বিপদে শং চতুষ্পদে।
বধূর দায়িত্ব হল পতির শতায়ু কামনা করা এবং জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সদস্য বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিই তার একমাত্র অভীষ্ট। যজ্ঞের আগুনে খই-ঘি ছুঁড়ে দিতে দিতে বধূকে বলতে হয় (‘কুশণ্ডিকা’ পর্ব):
দীর্ঘায়ুরস্তু মে পতিঃ।
শতং বর্ষাণি জীবতু।
এধন্তাং জ্ঞাতয়ো মম।
অগ্নিকে বেষ্টন করে সাত পাক আবর্তনের সময়েও (‘সপ্তপদী’) নতুন গৃহের জন্য সুখ, শান্তি, ধনসম্পত্তি সব কিছুই কামনা করতে হয় বধূটিকে। তাকে ওই নতুন গৃহের সঙ্গে একাত্ম করে নেওয়া হয়। পিতৃগৃহ তার কাছে অতীত হয়ে ওঠে। বিবাহের শেষতম পর্বে (‘আশীর্বচন, প্রার্থনা’) বর বধূটির কাছে প্রত্যাশা করে যে, বধূর মন তারই মনের অনুগামী হবে এবং সর্বদাই তার কথায় বধূ তৃপ্ত হবে, সে কথা যেমনই হোক না কেন:
মম চিত্তমনু চিত্তং তেস্তু।
মম বাচমেকমনা জুষস্ব।
বধূটির নিজস্ব মনের হদিশ পাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
বিবাহের শেষে বধূও ধ্রুবতারাকে উদ্দেশ্য করে আওড়ায় যে, সে যেন ওই নক্ষত্রের মতোই নতুন গৃহে ধ্রুব হয়ে ওঠে:
ধ্রুবমসি। ধ্রুবাহং পতিকুলে ভূয়াসম্।
এবং অরুন্ধতির প্রতি বলে, সে যেন তার মতোই বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে ওঠে, এবং এভাবে নতুন আশ্রয়ে তার বন্দিত্ব স্বীকার করে নেয়:
অরুন্ধতি অবরুদ্ধাহমস্মি।
এক-তরফা ধ্রুবতা, স্বামীর প্রতি অযৌক্তিক বিশ্বস্ততা ও অসহায় বন্দিত্ব— বৈদিক যুগে লিখিত ওই মন্ত্রগুলির পরতে পরতে নববধূটির জন্য লুকোনো থাকে হরেক অসম্মান। বৈদিক সংস্কৃত মন্ত্রের দুর্ভেদ্য আবরণ ছিন্ন করে তাকে উন্মোচিত করা সকলের সাধ্যে কুলোয় না। কাজেই, এই মন্ত্রগুলি যে আজকের আধুনিক সমাজ ও মননের পক্ষে নিদারুণভাবে বেমানান, তা অনেকের অজানাই থেকে যায়। মানবতার পক্ষে চরম অবমাননাকর একটি কুনাট্য যুগের পর যুগ ধরে অভিনীত হতে দেখেও কোনও অস্বস্তিও অনুভূত হয় না। একজন প্রশিক্ষিত পুরোহিত কিন্তু জানবেন এ সব মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ এবং টের পাবেন নারীত্বের প্রতি মন্ত্র রচয়িতাদের চরম অসম্মানের মনোভাব। একজন নারী-পুরোহিতের তা একেবারেই ভাল লাগার কথা নয়।
কেবল ব্রহ্মাই জানবেন গোপন কম্মটি?
‘শুভমস্তু’-র মেয়েরা ‘কন্যাদান’ অনুষ্ঠানটিকে বিবাহ প্রণালী থেকে ছেঁটে ফেলেছেন। এ যে নারীত্বের জন্য চরম অসম্মানের, তা তাঁরা ভালোই বুঝেছেন। কিন্তু, অন্যান্য প্রক্রিয়াগুলি? সেগুলিও কি খুব সম্ভ্রমের? পুরোহিতের আসনে বসে একজন নারী পুরোহিত কি তাঁর নারীসত্তাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন? শোনা যাচ্ছে, নারীবাদের ধ্বজা তুলে এই নারী পুরোহিতরা কোথাও কোথাও সিঁদুর দান অনুষ্ঠানেও অনেক পরিবর্তন এনেছেন। স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই পরস্পরের ললাটে সিঁদুররেখা এঁকে দিচ্ছেন। অবশ্য নারী পুরোহিতরাও জানেন যে, প্রক্রিয়াটি বিবাহের দিনের জন্য কেবল পালনযোগ্য, বিবাহ-পরবর্তী জীবনযাপনে নিশ্চয়ই স্বামী ললাটে সিঁদুরচিহ্ন বহন করবেন না। কিন্তু শাঁখা-নোয়া-পলার ব্যাপারে কী হবে? কিংবা দক্ষিণভারতীয় বধূর তালি-বন্ধন বা মঙ্গলসূত্রের বেলায়? অর্থাৎ প্রশ্ন হল এই যে, বিবাহের হরেক ‘স্ত্রী আচার’, যেগুলি লিঙ্গবৈষম্যের দ্যোতক এবং যাদের তুল্য কোনও পুরুষ আচার নেই, তাদের সবগুলির বেলায় এই নারী পুরোহিতরা সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে পারবেন? বৈবাহিক আচারে এভাবে কাঁচি চালাতে থাকলে একটি ঘোরতর সমস্যা এসে পড়ছে। এভাবে খুঁটে খুঁটে ভালমন্দ বাছতে থাকলে ঠগ বাছতে যে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে! কাজেই, অল্পকালের মধ্যেই মেয়েদের কাছে পৌরোহিত্য নামক পেশাটির আকর্ষণ অন্তর্হিত হওয়ার কথা। নারী হিসেবে পেশাটি বেছে নেওয়ার স্ববিরোধ বোধহয় এটিই।
আরও লক্ষণীয় যে, মেয়েরা কেবল বিশুদ্ধ স্বরক্ষেপণে বৈদিক মন্ত্রের অনুরণন তুলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, স্থানীয় ভাষাতেও তার মর্মার্থ তুলে ধরছেন। বিবাহের এই নতুন আঙ্গিকে সংস্কৃত মন্ত্রের দুর্বোধ্যতার আড়ালটি সরে যাচ্ছে, এর নারীবিদ্বেষী চরিত্রটি খুল্লামখুল্লা হয়ে পড়ছে। অতএব, এইরকম বিবাহ যদি সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তার অস্তিত্বের সঙ্কট ঘনিয়ে উঠতে বাধ্য। তখন হিন্দু বিবাহের এই ধর্মীয় কর্মকাণ্ডটি টিঁকিয়ে রাখার জন্য কেবল পড়ে থাকছে বংশপরম্পরায় বিনা প্রশ্নে বহমান লোকাচার মেনে চলার আকর্ষণ আর ধর্মীয় ঐতিহ্য মেনে চলার ভক্তি গদগদ আকুতিটুকু। এর ফলাফল কী দাঁড়ায় তা ভবিষ্যৎ বলবে।
একে যদি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে জয় বলে ধরি, তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে, পুরুষতন্ত্র বিষয়টি কি অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় ব্যতিরেকেই ‘পুরুষতন্ত্র’ হয়ে ওঠে? ধর্ম হল এমনই এক বিষয়, যা পুরুষতন্ত্রের গতিপ্রকৃতি স্থির করতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। ধর্ম কেবল বিবাহের আনুষ্ঠানিকতাই নয়, বিবাহের সঙ্গে জড়িত হাজারো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে— সঙ্গী বাছাই (এর সঙ্গে জড়িত আছে অসবর্ণ বিবাহের প্রসঙ্গ), বিবাহের বয়স (বাল্যবিবাহ নারীর ‘শুদ্ধতা’ রক্ষার অন্যতম উপায়, গ্রামনির্ভর ভারতীয় সভ্যতায় আজও তা বাস্তব), পণপ্রথা ইত্যাদি। ধর্মের প্রশ্রয় পায় বলেই সমাজের মধ্যে পরিবারের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভাই-ভগিনীর মধ্যে পুরুষতন্ত্র মসৃণভাবে থাবা বসাতে পারে। ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী সবেতেই পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কার। লৌকিকতার আবরণ আর ধর্মের চশমাটা খুলে ফেললে কি এসবের মধ্যে লালিত কদর্য পুরুষতান্ত্রিকতা উন্মুক্ত হয়ে পড়বে না? ধর্মের এই ভূমিকাগুলিকে উপেক্ষা করে লিঙ্গবৈষম্যের গতিপ্রকৃতিকে বোঝা যাবে কেমন করে?
পুরুষতন্ত্রের পেশাগত দখলদারি অতিক্রম করাটা নিশ্চয়ই নারীবাদের এক রকম সাফল্য এবং এক্ষেত্রে তা এক রকমের ধর্মসংস্কারও বটে, কিন্তু একবিংশ শতকের নারীবাদকে ওটুকুতেই তৃপ্ত হলে চলবে কেন? ধর্মের শতজীর্ণ পোশাকটি যদি আধুনিক মানুষের শরীরে প্রদাহই ফুটিয়ে তোলে, তাকে টান মেরে ফেলে দিলেই তো হয়। তার ওপর একের পর এক তালি মেরে কার লাভ? আর যারই হোক, নারীর নিশ্চয়ই নয়।
গ্রন্থপঞ্জী
- ভট্টাচার্য, সুকুমারী। বিবাহপ্রসঙ্গে। কলকাতা: ক্যাম্প। ১৯৯৮।
- Chatterjee, Ananya. Dia Mirza’s Wedding Solemnised By A Woman Priest Defines Equality In The Truest Sense. 14 Feb 2023.
- Chatterjee, Suniti Kumar. A Shortened Arya Hindu Vedic Wedding and Initiation Ritual. Calcutta: Jijnasa. 1976.
- Denton, Lynn Teskey. Female Ascetics in Hinduism. Albany: State University of New York Press. 2004.
- Frayer, Lauren. Hindu priestesses fight the patriarchy, one Indian wedding at a time. NPR. 15 Oct 2021.
- Kimmel, Michael. The Gendered Society. New York & Oxford: Oxford University Press. 2011.
- Lobo, Feelix. “India’s female Hindu priests challenge age-old tradition”. UCA News. 8 Aug 2014.
- Narayanan, Vasudha. “Gender and Priesthood in the Hindu Traditions”. Journal of Hindu-Christian Studies: Vol. 18, Article 8. 2005.
- The Logical Indian. “West Bengal: First Woman Priest Performs Marriage Without Kanyadaan”. 14 Mar 2018.
- Warty, Daksha. “INDIA: Women As Hindu Priests Have An Edge”. IPS. 24 Nov 2009.
- Witzel, Michael. “Female Rishis and philosophers in the Veda?”. Journal of South Asia Women Studies: 11(1). 28 Mar 2009.