অসমিয়া ছোটগল্পের সতত ব্যতিক্রমী ঋত্বিক সৌরভ কুমার চলিহা (১৯৩৩- ২০১১)

অসমিয়া ছোটগল্পের সতত ব্যতিক্রমী ঋত্বিক সৌরভ কুমার চলিহা (১৯৩৩- ২০১১) | অমৃতজ্যোতি মহন্ত

অমৃতজ্যোতি মহন্ত

 

ইংরেজি থেকে বাংলা তরজমা: বিপ্লব বিশ্বাস

বৈজ্ঞানিক মন, শিল্পীর হৃদয় আর প্রযুক্তিবিদের শৈলী— এসবের সমন্বয়ে রচিত সৌরভ কুমার চলিহার গদ্যভাষা অসমিয়া সাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রত্যেক পাঠকের কাছে এ কথা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, বিশ শতকের ছোটগল্পের কোনও আলোচনাই সৌরভ কুমার চলিহার সম্মানজনক উল্লেখ ব্যতীত সম্পূর্ণ হবে না

 

অসমিয়া সাময়িকপত্র ‘রামধেনু’তে ১৯৫০ সালে একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হল। নাম, ‘অশান্ত ইলেকট্রন’। সেই সময় অসমের দশটিরও কম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল। আপাতভাবে এই দুটি অসম খবরের টুকরো অতি সংক্ষেপে এই গল্পের লেখকের অদ্ভুত বিশিষ্টতা বুঝিয়ে দেয়— তিনি সৌরভ কুমার চলিহা— তৎকালীন বিজ্ঞানের এক তরুণ ছাত্র যিনি পরবর্তী অর্ধশতকে অসমিয়া ছোটগল্পের এক নতুন সংজ্ঞা নির্ণয় করলেন। ‘অশান্ত ইলেকট্রন’ কোনও কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। কিন্তু দেশের নব্য স্বাধীনতার মুহূর্তে মধ্যবিত্তশ্রেণির মানসিকতাকে ইলেকট্রন-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে প্রতীকরূপে জুড়ে দিয়ে এমন এক সৃজন তিনি পাঠকের সামনে রাখলেন যেখানে বেশিরভাগ পাঠকের কাছেই পৌঁছনোর আশা করা গেল না।

‘…অ্যাটমের কথা ভাবুন। এর কেন্দ্রে ধনাত্মক শক্তি আর চারদিকে ঋণাত্মক শক্তি। প্রোটন আর ইলেকট্রন। আবার সেখানে আছে অক্ষম কণা— নিউট্রন। তেমনি এই জগতেও ভাল-মন্দ যেমন আছে, আছে ঠিক-ভুল। এখানেও আছে নিরপেক্ষ দিক, নিউট্রনসমূহ। প্রতিটি বস্তুরই দুটি দিক বর্তমান। অ্যাটম থেকে সূত্র গ্রহণ করুন। রাজনৈতিক দলগুলোই বা এর ব্যতিক্রম হবে কেন? ব্যক্তিই বা হবে কেন ব্যতিক্রম? সমাজকেই বা এর বাইরে রাখবেন কীভাবে? অ্যাটম থেকে যতই এগোনো যাবে ততই ফুটে উঠবে বস্তু, বিরুদ্ধ-বস্তুর অজস্র জটিলতা…।’ এটি অসমিয়া ছোটগল্পে আধুনিকতাবাদের সূচনা নির্দেশ করে যেখানে তৎকালীন আখ্যানের বিষয়বস্তু ছিল কেতাদুরস্ত সামাজিক অবস্থার রোম্যান্টিক চিত্রায়ণ যা পাওয়া যায় রমা দাশ, আব্দুল মালিক প্রমুখের রচনায়। চলিহার মৃত্যুর পর অধ্যাপক রঞ্জিত দেব গোস্বামী লিখেছিলেন, ‘চলিহা তাঁর ক্ষেত্রে একটি বাগধারা তৈরি করেছিলেন যা তৎকালিক মানসমৃদ্ধ সাহিত্যিক বাগধারার কাছে “ভেজালপূর্ণ” (ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে যা ছিল বহমান, আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় যা ছিল “বহ্নি” ও “জোনাকি”র সাহিত্যযুগের সামসময়িক) এবং যা একে আধুনিক, স্বাধীনোত্তর প্রজন্মের উদ্বেগ, একাকিত্ব ও অস্থিরতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সুবেদী করেছে যে প্রজন্মের সামনে সেই বিশ্ব যা ঐতিহ্যবাহী নিশ্চিন্তিরহিত…।’ এখানেই ক্ল্যাসিক বাস্তববাদ থেকে চলিহার বেরিয়ে আসা স্পষ্ট তথা নির্ভুল। ঊনবিংশ শতকের শেষ লগ্নে অসমিয়া সাহিত্যে ‘জোনাকি’ গোষ্ঠীর যে ত্রিমূর্তি আধুনিক যুগের ডাক দিয়েছিলেন লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া তাদের পিতৃস্বরূপ। তাঁর গল্পবিষয়ে এক প্রাথমিক নিরীক্ষা হল, প্রায়শই তাঁর গল্পের মধ্যে রূপকথা আর ছোটগল্পের সীমারেখাটি মুছে যায়। উত্তরপুরুষেরা তাঁর গল্পকে এক বিশেষ ঢংবিশিষ্ট বলে আস্বাদন করে; তাদের প্রশংসায় থাকে সেই ভাবনা যে অগ্রদূত হিসাবে বেজবড়ুয়া ছোটগল্পের শিল্পটিকে যথাযথ রপ্ত করতে পারেননি। আবার এটাও কেউ অনুমান করতে পারে যে গর্বভরে অসমিয়া সাহিত্যের সঙ্গে ঐতিহ্যগত সম্পদের যোগসূত্র নির্ধারণে আধুনিক আবহ সৃজনের ক্ষেত্রে বেজবড়ুয়ার জীবনভর দায় তথা প্রতিশ্রুতি তাঁর মধ্যেকার গল্পকারকে প্রভাবিত করেছিল। বিংশ শতকের প্রথমদিকে ছোটগল্প তার যথাযথ তাত্ত্বিক গঠনে ক্ষুদ্র পাঠকগোষ্ঠীর সঙ্গে সঠিক সংযোগ ঘটাতে পারেনি। শতাব্দীবাহিত গল্পকথনের পুরনো ঐতিহ্য-প্রভাবিত পাঠকের রুচিকে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমি ধাঁচের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়েছে। (এই সময়ের উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একইরকম সচেতনতা স্পষ্ট করতে হয়েছে। সেই নবগঠনের বছরসমূহে সমস্ত উপন্যাসই হয় ইতিহাস নয় অতীতনির্ভর ছিল। রজনীকান্ত বরদলুইয়ের লেখা ‘মিরি জিয়োরি’ যা ছিল প্রথম সফল ‘সামাজিক’ উপন্যাস, তাও এমন একটা সমাজের ওপর ভিত্তি করে রচিত যা নবগঠিত শহুরে উচ্চবিত্ত ও সনাতন গ্রামীণ আভিজাত্য— উভয় ক্ষেত্রেই সমদূরত্বে সুবিধাজনক ঢঙে অবস্থিত।) যাই হোক, লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার সেইসব প্রাথমিক প্রচেষ্টার পর অসমিয়া ছোটগল্প তার শক্ত মাটি খুঁজে পেল শরৎচন্দ্র গোস্বামী, মহিচন্দ্র বোরা, নকুল চন্দ্র ভুঁইয়া এবং পরবর্তী দশকসমূহের অন্যান্যদের রচনায়। যখন রমা দাশ, আব্দুল মালিক, কৃষ্ণ ভুঁইয়া প্রমুখ গল্পকারদের সঙ্গে মিলিতভাবে বেজবড়ুয়ার সময় থেকে ঐতিহ্যকে অগ্রগামী করেছিলেন, সৌরভ কুমার চলিহা সেখানে স্পষ্ট নির্ধারকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর গল্প পড়ার জন্য পাঠকের মধ্যে একটি বাধ্য ‘প্রস্তুতি’র উপস্থাপনা করেছিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এই শক্তিশালী লেখক গল্পের আঙিনায় অর্ধশতকেরও বেশি বিরাজমান থেকেও ‘জনপ্রিয়তম’দের একজন হয়ে উঠতে পারেননি। এমত ‘কবোষ্ণ’ সাড়ার কথা উল্লেখ করে অপর লেখক অপূর্ব শর্মা দেখিয়েছিলেন, ‘এ আমাদের মানস-গঠনে একজাতীয় অজ্ঞাতসার মস্তিষ্কক্রিয়ার প্রতি চরম ঔদাস্য, বা এক হীনম্মন্যতাবোধ এবং একজাতীয় ঈর্ষাও বটে।’

সৌরভ কুমার চলিহার মধ্যে কী এমন বিশেষত্ব বর্তমান? তাঁর গল্পের এক প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হল সেগুলি লেখকের (সচেতন?) ঔদাস্য প্রকাশ করে উদ্দেশ্যের একমুখিতার প্রতি তথা ফলাফলের একতার প্রতি যা কিনা একটি ছোটগল্প প্রতিবিম্বিত করবে বলে দাবি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ তাঁর ‘অশান্ত ইলেকট্রন’-এর প্রতি ইশারা করে অপর গল্পকার ও সমালোচক হরেকৃষ্ণ ডেকা একে বলেছিলেন, ‘এক টুকরো জীবন’। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এই গল্পের চরিত্রাঙ্কন যতই খাপছাড়া লাগুক না কেন, এখানে বরাবর লেখকের যে উদ্দেশ্য কাজ করে তা হল, আধুনিক জীবনের ছিন্ন ছন্দকে গ্রথিত করা।’ সৌরভ কুমার চলিহার ওপর যে সমস্ত বিশ্লেষণাত্মক রচনা সেখানে পাঠক প্রায়ই এটাই অবলোকন করে থাকে যে অসমিয়া সাহিত্যে তিনিই প্রথম চেতনাপ্রবাহশৈলীর (stream of consciousness) প্রয়োগ করেন। পরবর্তীকালের কিছু রচনায় এইজাতীয় শৈলীর প্রয়োগ দেখা গেছে। ১৯৯৩ সালে একটি বাংলা সাময়িকপত্রে এই বিষয়ে এক দুর্লভ সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি কতিপয় শব্দে যা বলেছিলেন, (যদিও একই বিষয়ের সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে একস্বরা শব্দে উত্তর দিয়েছিলেন) তা শুধু তাঁর চেতনাপ্রবাহকেই সুদৃঢ় করে না বা তাঁর ঘাটতিকে প্রকট করে না, সেই সময়ের অসমিয়া সাহিত্য সমালোচনার কতিপয় বৈশিষ্ট্যের ওপর তাঁর ক্ষমাহীন মূল্যায়নকেও স্পষ্ট করে। তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘এই চেতনাপ্রবাহ বিষয়টি সম্পর্কে আমার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই আর যেহেতু এই অসমিয়া সমালোচকদের কোনও না কোনওভাবে বিদেশি লেখকদের প্রভাব বা সাদৃশ্য খুঁটে খুঁটে বের করার প্রবণতা, তাই এই অধুনাবিলুপ্ত শৈলী বিষয়ে আগ্রহের কারণে… শুনেছিলাম, এই প্রবাহ প্রথম দেখা যায় কিছু ফরাসি লেখকের মধ্যে ও পরে ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েসের রচনায় তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে… কিন্তু মজা হল, ‘ইউলিসিস’ না পড়া সত্ত্বেও আমাকে এই জাতীয় সমালোচনা শুনতে হল যে, সৌরভ কুমার চলিহা জেমস জয়েসীয় চেতনাপ্রবাহের অনুসরণকারী এবং এমন আরও অনেক কিছু… আর এভাবেই আমার মধ্যে এমন এক বিতৃষ্ণা জমা হয় যে একদিন যখন প্রকৃতই বইটা হাতে পেলাম, তা না পড়েই ফিরিয়ে দিলাম যদিও বইটি পড়ার অসীম আকুলতা ছিল আমার মনে। এটা কি পূর্বনির্ধারিত কোনও সিদ্ধান্ত যে আমরা নিজেদের কলমের জোরে এমন কিছু সৃষ্টি করতে পারি না কিংবা ভাবতেও পারি না? অথবা এ দেশের কোনও লেখকের পক্ষে বা দূরবর্তী অন্য কোনও লেখকের পক্ষে স্বাধীনভাবে একইরকম রচনাশৈলী উদ্ভাবন করা একেবারেই সম্ভব নয়?’

উত্তরকালে চলিহার এই শেষ প্রশ্নটি সেই লেখকের বিচক্ষণ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ববহ যিনি অসমিয়া ছোটগল্পে এক পৃথক অবস্থান নির্মাণ করেছিলেন, বিষয়ভাবনায় স্বকীয়তার প্রয়োগ করেছিলেন তথা পাঠকমনে এক মস্তিষ্কক্রিয়া সৃজনে বাধ্য করেছিলেন। এই একই সাক্ষাৎকারে (পূর্বদেশ, ১৯৯৩, গুয়াহাটি) লেখককে তাঁর গল্পের ‘দুর্বোধ্যতা’ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর উত্তরে তাঁর ‘কোনও মন্তব্য নয়’ জবাব ব্যক্তি এবং লেখকের জীবনভর (সচেতন) বিচ্ছিন্নতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করে।

এটা লক্ষণীয় যে ‘সৌরভ কুমার চলিহা’ ছদ্মনাম। পদার্থবিদ্যার এই অধ্যাপক কখনও কোনও পুরস্কার গ্রহণ করতে আসেননি। (এখানে ভিন্নসূত্রে সংগৃহীত আরও তথ্য দিই— গল্পকার চলিহার প্রকৃত নাম সুরেন্দ্র নাথ মেধি। অসমিয়া সাহিত্যের এই নির্জনবাসী লেখক কখনওই প্রশংসক জনতার সামনে নিজেকে মেলে ধরেননি। ১৯৭৪-এ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার নিতেও যাননি; এমনকি সম্মানজনক অসম উপত্যকা সাহিত্য পুরস্কারও তিনি গ্রহণ করতে যাননি। তাঁর একান্ত বিশ্বাস ছিল, শেষত লেখক নন, তার লেখাই পাঠকমনে থেকে যায়। তাঁর মতো এমন নিরাসক্ত লেখক বিরলপ্রজ।) যাই হোক, চলিহা বিষয়ে অনুভবী ‘অ-পাঠযোগ্যতা’ ও ‘পড়তে হবে’ এই ভাবনার মধ্যে সেতুবন্ধন ত্বরান্বিত করতে রঞ্জিত দেব গোস্বামীর পর্যবেক্ষণ হল, ‘চলিহার লেখালিখি বিষয়ে একজন পাঠককে বেশ কিছু পৃথক পরিকাঠামোর সাহায্য নিতে হয়: ইম্প্রেশনিজম, কিউবিজম, সুররিয়ালিজম ও অন্তর্লীন স্বগোতক্তি, অন্য সবকিছুর মধ্যে যা বিশেষ। আর সৌরভ কুমার চলিহাই কতিপয় অসমিয়া লেখকদের অন্যতম যাঁর রচনাসামগ্রী অবধারিতভাবে অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বা তার অংশীদার। যেমন সঙ্গীত (বিশেষত পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীত), চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও চলচ্চিত্র আবশ্যিকভাবেই। তাঁর ‘এহাত দাবা’ পড়তে হলে পাঠককে দাবাখেলার কায়দাকানুন জানতেই হবে। এই গল্পে পুরনো দুই বন্ধুর সম্পর্ক (এবং উত্তেজনা) দুজনের মধ্যেকার দাবাখেলার মাঝ দিয়ে গড়ে উঠেছে। একইভাবে জ্যামিতির প্রাথমিক জ্ঞান ছাড়া পাঠকের পক্ষে ‘জিয়োমিতি’ গল্পের প্রেম-চিত্রণ সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

অসমের সাহিত্যিক মহলে লেখকের ভাষা বিষয়ে প্রায়ই কিছু অ-তোষামুদে কথাবার্তা শোনা যায়। ‘অসমিয়া নয়’ এমন শব্দ ব্যবহারের কারণে চলিহাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এই দিকটি ইংরেজি পর্যালোচনায় বিশ্লেষণ করা কঠিন কিন্তু এই পাঠকই সম্ভবত এমন মত প্রকাশে একমাত্র নন যিনি বলবেন যে তাঁর বিজ্ঞান-ছবি অঙ্কন ও দ্রুতগতিসম্পন্ন শহুরে জীবনের বর্ণনা খুব একটা শক্তিশালী হতে পারত না যদি চলিহা নিজেকে ‘খাঁটি’ অসমিয়াতেই আটকে রাখতেন। অসমিয়া ভাষা বেড়ে উঠেছিল প্রাথমিকভাবে দীর্ঘ সঙ্কীর্ণ উপত্যকা অঞ্চলে, কৃষিভিত্তিক সমাজের হাত ধরে। এর ঐতিহ্যবাহী সম্পদ ও সমৃদ্ধি প্রকট হয় ‘জীবনর বাতত’ (বীণা বড়ুয়ার বিখ্যাত উপন্যাস) অথবা ‘কাথনিবাড়ি ঘাট’ (মহিম বোড়ার গল্প) কিংবা ‘সূর্যমুখীর স্বপ্ন’ (সৈয়দ আবদুল মালিকের উপন্যাস) ইত্যাকার লেখায়। গ্রামীণ ও মফস্বলি অসমের ওপর ভিত্তি করে রচিত বেশ কিছু রচনার মধ্যে এগুলি কয়েকটি উজ্জ্বল রত্ন মাত্র। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন অনড় মেঠো প্রশান্তিতে লালিত কাব্যিক ভাষায় শহুরে জীবনের আত্মঘাতী বস্তুবাদকে (উদাহরণস্বরূপ ‘বীণা কুটির’) বাণীরূপ দেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। (দীনেশ গোস্বামীর কল্প-বিজ্ঞানের কাহিনিতেও ইংরেজি শব্দের উদার ব্যবহার লক্ষণীয়) চলিহার গদ্যবিষয়ে অপূর্ব শর্মার পর্যবেক্ষণ হল যে সেখানে আছে জোরালো প্রকাশ ও এক অ-কাব্যিক শুষ্কতা যা পাঠকের হৃদয় নয়, মন ও মননকে লক্ষ্যস্থল করে লেখা; এবং এটাই হল চলিহার গল্পপাঠের সঠিক পন্থা। সম্ভবত এভাবে সিদ্ধান্তে আসা অতিশয়োক্তি হবে না যে চলিহা তাঁর লেখায় অ-অসমিয়া শব্দের প্রবেশ ঘটিয়ে অসমিয়া ভাষার শরীরে নতুন মাংস সঞ্চার করেছেন। আবার অপর অসমিয়া সমালোচক প্রভাত বোরা এক ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যায় চলিহার গদ্যের অসাধারণত্বের প্রতি ইশারা করেছেন। তিনি বলেছেন যে অসমিয়া ভাষার লেখকদের অনেকেই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। সে কারণে স্বভাবসিদ্ধ ঢঙেই তাদের লেখায় ‘ইংরেজি কাব্যিক’ সুর এসেছে। জি এন ডেভির বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পাঠক্রমে চার্লস ল্যাম, কার্লাইলের মতো লেখকদের রচনার অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে ছাত্ররা এই কাব্যিক সুরকে আদর্শ হিসেবে আত্মস্থ করেছে। বোরা বলেছেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে চলিহা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না।’ পরিবর্তে, বোরা বলেছেন, চলিহাই অসমিয়াদের মধ্যে প্রথম লেখক যাঁর সম্ভবত জার্মান সংযোগ ছিল। বোরা যখন বলছেন, চলিহা প্রাঞ্জল অসমিয়া গদ্য রচনায় দায়বদ্ধ ছিলেন, ঠিক জার্মানে গুন্টার গ্রাসের মতো, তখন তিনি এও বলছেন যে চলিহা সম্পর্কে তার জানাশোনা সংখ্যা দিয়ে বিচার্য নয়, তা শুধু উপলব্ধির বিষয়। তাঁর সঙ্গে জার্মান সংযোগ থাক বা না থাক, পাঠক চলিহার গদ্যের ক্ষমতা ও স্বকীয়তা অনুভব করতে পারেন— সেই গদ্যের ‘অশুদ্ধতা’ সত্ত্বেও।

এরপর প্রখ্যাত মরাঠি লেখক বিলাস সারং-এর বক্তব্য উল্লেখ করে বলা যায়, সৌরভ কুমার চলিহার দৃষ্টিতে অস্তিত্বের নিমিত্তস্বরূপ উদ্দেশ্য তেমন কিছু নেই যার জন্য বিস্তৃত বর্ণনা নির্মাণে অযথা সময় ব্যয় করতে হবে। যেখানে তারা যা চায় তা ছোটগল্পের পরিসরেই মিটে যায়— তাঁর দৃষ্টিতে যা আঁটোসাঁটো ও গুরুত্বপূর্ণ যা তারা আকাঙ্ক্ষা করে। কবিরা কি প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দসম্ভার না ঘটিয়ে গুরুগম্ভীর, জটিল ও বোধগম্য কবিতা লিখে সফল হন না? গল্পকারেরা তা পারবেন না কেন?

শেষত বলি, বৈজ্ঞানিক মন, শিল্পীর হৃদয় আর প্রযুক্তিবিদের শৈলী— এসবের সমন্বয়ে রচিত চলিহার গদ্যভাষা অসমিয়া সাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও তাঁর কিছু গল্প ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে তবু্ও এক্ষেত্রে অধিক সযত্ন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সেটি হলে প্রত্যেক পাঠকের কাছে এ কথা স্পষ্ট হবে, বিশ শতকের ছোটগল্পের কোনও আলোচনাই সৌরভ কুমার চলিহার সম্মানজনক উল্লেখ ব্যতীত সম্পূর্ণ হবে না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...