আমেরিকায় ধর্ম-বিজ্ঞান সংঘাত ও বিবর্তনতত্ত্ব

আশীষ লাহিড়ী

 



বিজ্ঞানের দর্শন ও ইতিহাসের গবেষক, প্রবন্ধকার, অনুবাদক

 

 

 

 

যতক্ষণ না বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্ব বা তথ্য বাইবেলের বিরুদ্ধে যচ্ছে, ততক্ষণ বিজ্ঞান নিয়ে, এমনকী বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নিয়েও কোনও আপত্তি ছিল না, বরং সমর্থন ছিল। মুশকিল হচ্ছে, বিবর্তন-তত্ত্ব, বিশেষ করে প্রাকৃতিক চয়ন বা নির্বাচনের ধারণা, সরাসরি বাইবেলের সেই কর্তৃত্বকেই আঘাত করল

 

উনিশ শতকের শেষদিকে বাণিজ্য আর ম্যানুফ্যাকচারের তাগিদে আমেরিকায় বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবেই মাথা চাড়া দিল ধর্ম-বিজ্ঞান দ্বন্দ্ব। প্রশ্ন উঠল, বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মকে মেলানো যায় কি? জন ড্রেপার আর অ্যান্ড্রু হোয়াইট একদিকে, অন্যদিকে চার্লস হজ আর জেমস ম্যাক্‌কশ-এর তর্কবিতর্কে মুখরিত হল আমেরিকার চিন্তাজগৎ।

জন ড্রেপার

জন উইলিয়াম ড্রেপার (১৮১১-১৮৮২) ছিলেন বিখ্যাত ডাক্তার, রসায়নবিদ, ইতিহাসবিদ এবং ফটোগ্রাফার। ১৮৪০ সালে তিনি প্রথম চাঁদের বিস্তারিত ছবি তোলেন।

ড্রেপারের তোলা চাঁদের ছবি

এছাড়া তিনি ছিলেন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি (১৮৭৬-৭৭) এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৮৭৪ সালে ধর্ম আর বিজ্ঞানের স্বভাব-বৈরিতার তত্ত্ব খুব জোরের সঙ্গে উপস্থিত করেছিলেন তিনি তাঁর History of the Conflict between Religion and Science বইতে। বইটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। আমেরিকায় এর পঞ্চাশটি সংস্করণ হয়েছিল, অনুবাদ হয়েছিল দশটি ভাষায়। ধর্ম আর বিজ্ঞানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণা সমূলে বাতিল করে দেন তিনি।

ড্রেপারের বইয়ের প্রচ্ছদ (আধুনিক সংস্করণ)

তাঁর মতে, বিজ্ঞানের ইতিহাস তো ‘কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন আবিষ্কারের খতিয়ান নয়, তা হল দুটি বিপরীতমুখী বলের সংঘাতের ইতিবৃত্ত। একদিকে মানুষের মননশক্তির প্রসারণ-বল, অন্যদিকে যুগবাহিত বিশ্বাস আর স্বার্থ থেকে উদ্ভূত সংকোচন-বল।’ প্রাচীন গ্রিসে বিজ্ঞানের উৎপত্তির বর্ণনা করে তিনি দেখান, কীভাবে পরে রোমক আমলে খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব বিজ্ঞানের বিকাশকে থামিয়ে দিয়েছিল। নিজে ক্যাথলিক-বিরোধী প্রোটেস্টান্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বীকার করেন যে খ্রিস্টধর্মের এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শাখা কিন্তু ‘একটা ব্যাপারে একমত: তাঁদের মতে শাস্ত্রের সঙ্গে বিজ্ঞানের যেসব তত্ত্ব খাপ খেয়ে যায়, সেগুলি ছাড়া আর কোনও বিজ্ঞানই গ্রাহ্য নয়।’

ড্রেপারের পথ ধরেই এগিয়ে এসেছিলেন অ্যান্ড্রু ডিকসন হোয়াইট (১৮৩১-১৯১৮)। নিউ ইয়র্ক স্টেটের সেনেটর, জার্মানি আর রাশিয়াতে আমেরিকার কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বেশ প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন।

অ্যান্ড্রু হোয়াইট

তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৬৫ সালের ২৭ এপ্রিল কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও, পঠনপাঠন শুরু হয় ১৮৬৮-র অক্টোবর মাস থেকে। হোয়াইট স্বয়ং ঘুরে ঘুরে এর জন্য ছাত্র ও শিক্ষক সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় হবে ‘বিজ্ঞানের এক আশ্রয়-শিবির, যেখানে সত্যের অনুসন্ধান চলবে সত্যের খাতিরেই, ঈশ্বর-প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের ছাঁচমাফিক সত্যকে কেটেছেঁটে নেওয়ার জন্য নয়।’ মনে রাখতে হবে, কর্নেল-এর আগে অব্দি আমেরিকার বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপিত হয়েছিল। সেসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণভাবে মানবিকীবিদ্যা আর ধর্মীয় প্রশিক্ষণের ওপরেই জোর দেওয়া হত, বিজ্ঞানের ওপরে নয়। একটু পরে আমরা জানব, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে এ সমস্যার মোকাবিলা করেছিল।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিরূপ

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হওয়ার পরেই, অর্থাৎ ড্রেপারের বই বেরোবার পাঁচ বছর আগেই, ১৮৬৯ সালে হোয়াইট ‘বিজ্ঞানের রণক্ষেত্র’ শীর্ষক একটি বক্তৃতায় বলেন, ইতিহাস এই কথাই জানায় যে ধর্ম যখনই বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে রোধ করতে চেয়েছে তখনই ফল হয়েছে নেতিবাচক। এই নিয়ে সুদীর্ঘ গবেষণার পর তিনি লেখেন দু খণ্ডে সম্পূর্ণ A History of the Warfare of Science with Theology in Christendom (1896)। তাতে তিনি ইতিহাস থেকে নজির তুলে তুলে মতান্ধ ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানের চির-সংঘাতের তত্ত্ব প্রতিপন্ন করেন।

হোয়াইটের বইয়ের প্রচ্ছদ

তাঁর বই যদিও ড্রেপারের বইয়ের মতো অত জনপ্রিয় হয়নি, ধর্ম আর বিজ্ঞানের সম্পর্ক বিষয়ে এটি এক উল্লেখযোগ্য রচনা বলে স্বীকৃত।

 

প্রিন্সটন: বিবর্তন বিসংবাদ

প্রিন্সটন সেমিনারি বা ধর্মমহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ (১৮৫১-১৮৭৮), মহাপণ্ডিত চার্লস হজ (১৭৯৭-১৮৭৮) বাইবেলকে সাক্ষাৎ ঈশ্বরের বাণী বলে মানতেন। ঠিক-বেঠিকের বিচারে বাইবেলই ছিল তাঁর কাছে একমাত্র অভ্রান্ত নিরিখ। যেমন তিনি ক্রীতদাসদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা করলেও দাসপ্রথার বিরোধী ছিলেন না, নিজে বেশ কয়েকটি দাসের মালিকও ছিলেন; এবং দাসপ্রথার সপক্ষে যুক্তি খুঁজে পেতেন বাইবেলে। যতক্ষণ না বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্ব বা তথ্য বাইবেলের বিরুদ্ধে যচ্ছে, ততক্ষণ বিজ্ঞান নিয়ে, এমনকী বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নিয়ে তাঁর কোনও আপত্তি তো ছিলই না, বরং সমর্থন ছিল। মুশকিল হচ্ছে, বিবর্তন-তত্ত্ব, বিশেষ করে প্রাকৃতিক চয়ন বা নির্বাচনের ধারণা, সরাসরি বাইবেলের সেই কর্তৃত্বকেই আঘাত করল।

আদিতে প্রিন্সটন কলেজ তৈরি হয়েছিল প্রেসবিটারিয়ান সম্প্রদায়ের পাদ্রিদের প্রশিক্ষণের জন্য। কিন্তু কিছুকাল পরে যখন দেখা গেল, খাঁটি ধর্মীয় মতাদর্শ থেকে কলেজ সরে যাচ্ছে, তখন কট্টর প্রেসবিটারিয়ান-পন্থীরা প্রিন্সটন ধর্মমহাবিদ্যালয় (সেমিনারি) নামে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেন। প্রিন্সটন কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে বেরোনো মাত্রই ১৮১৬য় হজ সেই মহাবিদ্যালয়ে যোগ দিলেন। পরে ওই মহাবিদ্যালয়েই অধ্যাপক হন। ইউরোপের বহু দেশ ভ্রমণ করেন, হয়ে ওঠেন ‘প্রিন্সটনীয় ধর্মতত্ত্বে’র মুখ্য প্রবক্তা।

চার্লস হজের বইয়ের প্রচ্ছদ

১৮৭৪ সালে, ড্রেপারের বইয়ের প্রায় সমসময়ে হজ লিখলেন What is Darwinism? তাঁর মতে ডারউইনবাদ ঐশ্বরিক পূর্বপরিকল্পনা স্বীকার করে না, সুতরাং তা নিরীশ্বরবাদী, সুতরাং বর্জনীয়। কলেজে কলেজে যেভাবে ডারউইনের মতবাদ প্রভাব বিস্তার করছে সেটা দেখে তিনি আতঙ্কিত হলেন। ঠিক এই সময়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি জন ম্যাকলিন-ও বিবর্তনবাদকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে হজ-এর হাত কিছুটা শক্ত হল। সেমিনারি আর কলেজ উভয়েই হয়ে উঠল বিবর্তনবাদ-বিরোধী, কট্টর বাইবেল-পন্থী।

ম্যাক্‌কশ-এর বইয়ের প্রচ্ছদ

কিন্তু ১৮৬৮ সালে ম্যাকলিন অবসর নেওয়ার পর স্কটিশ দার্শনিক জেমস ম্যাক্‌কশ হলেন প্রিন্সটন কলেজের সভাপতি। তিনি ডারউইনবাদের সঙ্গে ঐশ্বরিক পূর্বপরিকল্পনার একটা আপসরফার উদ্যোগ নিলেন। তাঁর যুক্তি, ডারউইনের আবিষ্কারই তো প্রমাণ করে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূলে আছে এক প্রাক-পরিকল্পনা, এক বিশেষ দক্ষতা আর উদ্দেশ্যমুখিতা। তা যদি হয়, ডারউইনবাদকে কেন নিরীশ্বরবাদী বলা হবে? বাইবেলের সঙ্গে সে-তত্ত্বের যেটুকু দ্বন্দ্ব তা অসমাধেয় নয়, মোটেই বৈরিতামূলক নয়। ম্যাক্‌কশ-এর আপত্তি বিবর্তনবাদ নিয়ে নয়, প্রাকৃতিক চয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে।

ব্যাপারটা একটু আশ্চর্যের মনে হলেও ব্যাখ্যাতীত নয়। আজ আমাদের কাছে বিবর্তনতত্ত্ব আর প্রাকৃতিক চয়ন একাত্ম, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির কথা আমরা ভাবতেই পারি না। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, বিবর্তনের ধারণা আর প্রাকৃতিক চয়নের ধারণা এক নয়। বিবর্তন মানে ক্রমিক বা ধাপেধাপে পরিবর্তন; আর প্রাকৃতিক চয়ন হল সেই ধীরগতি পরিবর্তন কী করে ঘটে সেই প্রক্রিয়াটির ব্যাখ্যা। বিশ্বজগৎ যে পরিবর্তনশীল, এটা এতই প্রত্যক্ষ এবং স্বয়ংসিদ্ধ একটা ব্যাপার যে মতান্ধরা ছাড়া আর সকলেই এটা মানতে বাধ্য। খ্রিস্টধর্মের কয়েকটি শাখা অবশ্য আজও মনে করে, ঈশ্বর হাজার ছয়েক বছর আগে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি করে ঠিক আজকের রূপেই প্রাণীদের বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন; তারপর থেকে তারা চরে-বড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যেকোনও মানুষই, খ্রিস্টধর্মের অধিকাংশ শাখা সমেত, মানেন যে এঁদের এই ছেলেমানুষি কথায় গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না। ধীরগতিতে পরিবর্তন যে হয়েছে, হচ্ছে, হবে, এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সুতরাং ম্যাক্‌কশ-এর ব্যাখ্যাটা দাঁড়াল এইরকম: যেহেতু ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনও কিছুই ঘটতে পারে না, অতএব ঈশ্বরই নিশ্চয়ই সেইসব ধীরগতি পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কিন্তু সেটা মানলে তো ডারউইনের তত্ত্ব মিথ্যা হয়ে যায়। ডারউইন তো এটাই দেখিয়েছিলেন যে, বিবর্তন ঘটে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে, ঈশ্বর নামক কোনও এজেন্সির সেখানে কোনও ভূমিকা নেই। অজস্র তথ্যপ্রমাণ সহযোগে তিনি দেখিয়েছিলেন, সেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ারই নাম ন্যাচরাল সিলেকশন। পরিবর্তনশীল প্রতিবেশের সঙ্গে যে মানিয়ে নিতে পারবে, প্রকৃতি তাকেই যোগ্য বলে বেছে নেবে, সে-ই টিকে যাবে, তাদের বংশধররাই সংখ্যায় বাড়বে। যারা মানাতে পারল না, তারা প্রকৃতির বাছাই-পরীক্ষায় অকৃতকার্য হল। কাজেই বিবর্তনের ধারণা আর ঈশ্বরের ধারণা সহাবস্থান করতে পারে; কিন্তু প্রাকৃতিক চয়ন আর স্রষ্টা ঈশ্বরের ধারণা কখনও সহাবস্থান করতে পারে না। তাই শ্যাম এবং কুল— ঈশ্বর এবং বিবর্তন— দুদিকই বজায় রাখবার জন্য ম্যাক্‌কশ বললেন, বিবর্তন নিশ্চয়ই একটা বাস্তব ঘটনা, কিন্তু প্রাকৃতিক চয়ন ডারউইনের কপোলকল্পিত একটা গালগল্প ছাড়া আর কিছুই না। এই সুবিধাবাদী অবস্থানের ফলে বিবর্তন নিয়ে গবেষণা চালাতে কোনও অসুবিধা হল না, অপরদিকে স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিও অচলা রইল।

এইভাবে প্রিন্সটন থেকেই বিবর্তনবাদ সম্পর্কে দুটি ঘরানার উদ্ভব হল। প্রিন্সটন সেমিনারি হজ-এর কট্টর বিবর্তনবাদ-বিরোধী অবস্থান আঁকড়ে রইল (পরে ১৯২৯ সালে তাঁর সমর্থকরা অবশ্য সেখান থেকে উৎখাত হয়ে গিয়েছিলেন)। অন্যদিকে বাইবেল আর বিবর্তনের নির্বিরোধী সহাবস্থান-তত্ত্বের সুবাদে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমে হয়ে উঠল বিবর্তনী জীববিজ্ঞানের এক বিশ্বমানের চর্চাকেন্দ্র। জিতল কিন্তু আপসপন্থাই; অর্থাৎ বিবর্তনবাদ নিরীশ্বরবাদী নয়, বরং বিবর্তনবাদ বাইবেল-কথিত সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গত— এই মতবাদ।

 

ক্রিয়েশন মিউজিয়াম[1]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকায় কর্মরত নানা দেশের বিজ্ঞানীদের বিপুল সাফল্য আমেরিকার সাধারণ মানুষের মন থেকে জাল-বিজ্ঞানের প্রতি দুর্মর আকর্ষণকে মুছে দিতে পারেনি এই একুশ শতকেও। তার অজস্র প্রমাণের মধ্যে অন্তত একটা হল তামাম আমেরিকা জুড়ে অনেক টাকা খরচ করে ক্রিয়েশন মিউজিয়াম স্থাপন এবং তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সবচেয়ে বড়টি সম্ভবত কেনটাকির পিটার্সবার্গে। এটি নিয়ে সামান্য কিছু তথ্য সামনে রাখলেই আম-আমেরিকাবাসীর অপবিজ্ঞান-প্রেম এবং তা থেকে পুঁজিপতিদের সুসংগঠিত মুনাফা-লুণ্ঠনের একটা ছবি ফুটে উঠবে। মনে রাখতে হবে, শুধু কেনটাকিতেই নয়, ক্রিয়েশনিস্টদের মিউজিয়ামগুলো ছড়িয়ে রয়েছে সারা আমেরিকা জুড়ে: ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, ইডাহো, মানটানা, নিউ ইয়র্ক, নর্থ ক্যরোলাইনা, ওহায়ো, সাউথ ডাকোটা, টেনেসি, টেক্সাস, ওয়াশিংটন। বিজ্ঞানের আলো আর অপবিজ্ঞানের অন্ধকারের এই সহাবস্থান আমাদের অনেক কিছু শেখায়।

‘আন্‌সার্স ইন জেনেসিস’ (সব উত্তরই জেনেসিসে আছে) নামক সংস্থার অধীনে ২০০৭ সালে ২৭ কোটি ডলার খরচ করে কেনটাকির পিটার্সবার্গে ৭৫০০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে স্থাপিত হয় ক্রিয়েশন মিউজিয়াম। এখানে ‘ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট’ নামক গোষ্ঠী বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ের আক্ষরিক ব্যাখ্যার (ছে-দিনকা খেল!) ভিত্তিতে বিশ্বসৃষ্টির বিবরণ তুলে ধরে। এই মিউজিয়ামে আছে আধুনিক বিজ্ঞানের নানা উপচার, যথা বিশেষ জাদুক্রিয়া প্রদর্শনের প্রেক্ষাগৃহ, নিজস্ব প্ল্যানেটারিয়াম, বিশাল এক পতঙ্গ-প্রদর্শশালা প্রভৃতি। এ মিউজিয়ামের স্থায়ী কর্মীদের শপথ নিতে হয় যে তাঁরা মালিক সংস্থার নীতিতে বিশ্বাসী। এখানে দেখানো হয়, বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল হাজার ছয়েক বছর আগে, সে-বিশ্বে ডাইনোসর আর মানুষ সহাবস্থান করত। আমেরিকার বিজ্ঞানীমহল শুধু নয়, মিউজিয়াম-বিশেষজ্ঞরা, এমনকী কোনও কোনও খ্রিস্টীয় মহল পর্যন্ত এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তাতে এঁদের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধিই পেয়েছে। হিসেব বলছে, ২০০৭ থেকে মধ্য-২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ২৪ কোটি লোক টিকিট কেটে এই মিউজিয়াম দেখেছে, তার মধ্যে অনেকেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পরিচালকরা আরও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে আরও বিশাল আকারে চতুর্মাত্রিক প্রেক্ষাগৃহযুক্ত মিউজিয়াম বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন।

মানুষ-ডাইনোসর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান

তবে আমজনতার কাছে ক্রিয়েশনিস্টদের এই কাঁচা হাতের কাজ যতই জনপ্রিয় হোক, তা পরিশীলিত ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন-পন্থীদের মোটেই পছন্দ নয়। জেনেসিস কাণ্ডের এত স্থূল ব্যাখ্যা না দিয়ে অনেক পরিশীলিত একটা রূপ তুলে ধরেন তাঁরা। এ নিয়ে অন্যত্র কিছুটা আলোচনা করেছি,[2] এখানে তার পুনরাবৃত্তি করব না। কেবল ১৯৯০ সালে সিয়্যাটেলে স্থাপিত ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন-পন্থীদের সদর ঘাঁটি ডিসকভারি ইনস্টিটিউট সম্বন্ধে দু-একটি তথ্য পেশ করে ক্ষান্ত হব। এঁদের প্রধান লক্ষ্য হল বিবর্তনবাদ-বিরোধী শিক্ষাক্রমকে আমেরিকার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে চালু করা। এর জন্য এঁরা নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এক সময় বিবর্তনবাদ-বিরোধী ডাক্তারদের একজোট করার চেষ্টা করেছিলেন। বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায় সে-চেষ্টা আইনত সফল না হওয়ায় এঁরা জেনেবুঝেই একটা ‘গোঁজ কৌশল’ প্রণয়ন করেন। যার অর্থ হল, সরাসরি বিবর্তনবাদকে ভুল এবং জেনেসিসের গল্পকে ঠিক বলে প্রচার না-করে মানুষের মনের মধ্যে বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে একটা সন্দেহের গোঁজ ঢুকিয়ে দেওয়া। যাতে আর কিছু নাহোক, অল্পবয়সীরা আর অল্প-বিজ্ঞান-জানা লোকেরা বিবর্তনবাদ সত্য কিনা তা নিয়ে সন্দেহে ভোগে এবং বিকল্প হিসেবে বাইবেলের দিকে ঝোঁকে।

 

কূট প্রশ্ন

অথচ বিজ্ঞানে আমেরিকার অনস্বীকার্য উন্নতির পিছনে একটা বড় কারণ হল, প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে সম্পূর্ণ সরিয়ে রাখা। শুধু আমেরিকাই-বা কেন, বিজ্ঞানোন্নত সব দেশেই এটা ঘটেছে। চিন, জাপান, ফ্রান্স, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ আর প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়াতে সচেতনভাবে, ইংল্যান্ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, জার্মানিতে কিছুটা সংগঠিত, কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। জার্মানির পূর্বাঞ্চল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সেকিউলার সমাজ রূপে প্রসিদ্ধ, ধর্ম সেখানে প্রাচীনকালের এক অদ্ভুত পুরাবস্তু বলে গণ্য।[3] ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে গোটা জার্মানিতে ৪২ শতাংশ লোক নিজেদের ‘ধর্মমুক্ত’ বলে মনে করে।[4]

কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে এইসব বিজ্ঞানোন্নত দেশের তফাত হচ্ছে, আমেরিকার জনমানসে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উপস্থিতি এখনও প্রবল। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চায় ব্যক্তিবিজ্ঞানীর ধর্ম-পরিচয়টা সেখানে কোনও বিবেচ্য বিষয়ই নয়। আর যদি বিবেচ্য বিষয় হয়-ও, তাহলে দেখা যাবে সেখানকার বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ হয় অজ্ঞেয়বাদী নাহয় নিরীশ্বরবাদী। তার চেয়েও বড় কথা, এমনকী ধর্মপ্রাণ বিজ্ঞানীরাও তাঁদের পেশাদারি বিজ্ঞানকর্মের সঙ্গে তাঁদের ধর্মবিশ্বাসকে মেলান না। আমেরিকার সম্মানিত বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠান আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স-এর সদস্যদের মধ্যে পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০০৯ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তা থেকে এই তথ্য বেরিয়ে আসে: ৩৩ শতাংশ বিজ্ঞানী ঈশ্বরে বিশ্বাসী, ১৮ শতাংশ কোনও একটা উচ্চতর সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, ৪৯ শতাংশ নিরীশ্বরবাদী; বিপরীতক্রমে, আমেরিকার জনসমষ্টির ৯৫ শতাংশ কোনও না কোনও ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ঈশ্বরবিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথাক্রমে ২১ শতাংশ প্রোটেস্টান্ট এবং ১০ শতাংশ ক্যাথলিক; জনসাধারণের মধ্যে সংখ্যাটা যথাক্রমে ৫১ এবং ২৪। একটা স্পষ্ট মেরুকরণের চেহারা ফুটে ওঠে।[5] সিদ্ধান্ত একটাই: আমেরিকায় জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানের পরিস্রাবণ ঘটেনি। বিজ্ঞানী আর বিজ্ঞান-অনবহিতরা যেন দুটো স্বতন্ত্র প্রজাতি। বিজ্ঞানে আমেরিকার অগ্রগতি যত ত্বরান্বিত হয়েছে ততই বেড়েছে এই মেরুকরণ। ২০১৪ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বিজ্ঞানের মধ্যে ধর্মের নাক গলানো উচিত কি না, সে প্রশ্নে আমেরিকার জনসাধারণের মধ্যে পরিষ্কার একটা বিভাজনরেখা আছে। মোটের ওপর বয়ঃপ্রাপ্ত জনসমষ্টির অর্ধেক মনে করে, চার্চগুলোর উচিত বৈজ্ঞানিক বিষয়ের পলিসি নিয়ে মত প্রকাশ করা; এঁদের মধ্যে ইভ্যানজেলিকাল প্রোটেস্টান্ট আর কৃষ্ণাঙ্গ প্রোটেস্টান্টরা প্রধান। অপরদিকে ৪৬ শতাংশের মতে চার্চগুলোর উচিত এ থেকে সরে থাকা। এঁদের মধ্যে আছেন সেইসব গোষ্ঠী যাঁদের কোনও ধর্মীয় আনুগত্য নেই।

তবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান-বিরোধিতার মূল কারণটা রাজনৈতিক। মাত্র দু-একটি ক্ষেত্রেই ধর্মীয় কারণে বিজ্ঞান-বিরোধিতা ব্যাপক রপ ধারণ করে। ধর্মীয় কারণগুলির অন্যতম হল সেই আদি ও অকৃত্রিম জেনেসিস— বিবর্তনবাদ বৈরিতা।[6] ক্রিয়েশন মিউজিয়ামগুলোতে কেন মানুষের ভিড় উপচে পড়ে, তা বোঝা যায় এইসব সমীক্ষা থেকে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিজ্ঞানবিমুখ ধর্ম-প্রীতির বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা একটু আশ্চর্যের এই কারণে যে, ইংল্যান্ড সমেত গোটা পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে, এমনকী পাশের বাড়ি কানাডাতেও, সমাজের একটা বিরাট অংশের কাছে ধর্ম— খ্রিস্টধর্ম— জিনিসটা কার্যত প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। একটা নতুন শব্দ চালু হয়েছে এসব দেশের সমাজের চরিত্র ব্যাখ্যা করার জন্য: ‘পোস্ট-ক্রিশ্চিয়ান সোসাইটি’, খ্রিস্টোত্তর সমাজ; অনেকে পোস্ট-রিলিজয়ন (ধর্মোত্তর) কথাটাও ব্যবহার করছেন। খোদ আমেরিকাতেও ঘটনাটা ঘটছে না তা নয়, সেখানেও জনসমাজে নিরীশ্বরবাদীদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চায় অগ্রগতির নিরিখে বড় বেশি শ্লথগতিতে ঘটছে সে ঘটনা।[7]

তার মানে, বিজ্ঞানে অগ্রগতি বিজ্ঞানচেতনা বিকাশের আবশ্যিক শর্ত হলেও, সেটাই যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানচেতনা বিকাশের জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হয়, নতুবা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করতেই থাকবে।


[1] Creation Museum. Wikipedia.
[2] লাহিড়ী, আশীষ। অবিরত দ্বৈরথে বিজ্ঞান। পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪২।
[3] Evers, Dirk. Religion and Science in Germany. Zygon, Journal of Religion and Science. London. 10 May 2015.
[4] Religion in Germany. Wikipedia.
[5] Scientists and Belief: Religion and Science in the United States. Report: Pew Research Centre. 5 Nov 2009.
[6] Religion and Science. Pew Research Centre. 22 Oct 2015.
[7] দ্রষ্টব্য, টীকা ২। পৃষ্ঠা ১৪৭-১৫০।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4760 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...