বাবার বন্ধুরা

বাবার বন্ধুরা | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 

দীনুকাকা চলে গেলেন।

তখন বিকেল। অন্যদিনের মতো বাবা বসেছিলেন ইজিচেয়ারে, একতলার শোওয়ার ঘরের পশ্চিমদিকের জানালার সামনে। এই ইজিচেয়ারটা আমার ঠাকুর্দা কোনও এক আইরিশ সাহেবের কাছ থেকে কিনেছিলেন। আমার বাবার অনেক মন্থর অপরাহ্নের স্মৃতি জড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রবীণ এই চেয়ারের সঙ্গে। সে-সব হলদেটে স্মৃতির ভারে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি যেন মানুষ নন, ফেংশুইয়ের সবুজ ব্যাং। পড়ন্ত রোদ জানালার গরাদ ছুঁয়ে এসে পড়ছিল তাঁর গালে। দৃঢ় চিবুকে। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।

দীনুটা বড় ডানপিটে ছিল। নির্বাক অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর স্বগতসংলাপে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া আমার বাবার। চিরকাল হাতের তাস লুকিয়ে রেখে ফাঁকা আওয়াজ দিত। ওর ফলস কলে আমরা সবাই খুব ভয় পেতাম। সদ্যোপ্রয়াত বন্ধুর প্রসঙ্গে বাবার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় তিনি যেন কোনও মায়াবী দেশের লোক, যে দেশ অনেকদিন আগে হারিয়ে গেছে পুরনো বাতিল ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা ফোন নম্বরের সঙ্গে। বাবা পুনরায় নিশ্চুপ হলেন। বলে, তোমাদের বাসভূমি ভালবাসা, যত্ন, সহমর্মিতা প্রত্যাশা করে। তাঁর বুকের দীর্ঘশ্বাস পাতা খসায়, বল্কল খসায়। পৃথিবীর উপর খুব দ্রুত নেমে আসতে থাকে বিষণ্ণ সন্ধে।

আমার বাবারা ছিলেন চার বন্ধু। অনিল, বটুক (আমার বাবা), চিনু এবং দীনু। হরতন, চিড়িতন, রুইতন ও ইশকাপনের টেক্কা। সংক্ষেপে এ-বি-সি-ডি। আমাদের লড়ঝড়ে দোতলা হলুদ বাড়ির একতলার বাইরের ঘরে হরদিন সন্ধেবেলায় বসত তাঁদের তাসের আসর। একটা গোল কাঠের টেবিল ঘিরে বসতেন চার ইয়ার। তীক্ষ্ণ মাছরাঙা দৃষ্টিতে প্রতিপক্ষের প্রতিটি চাল মেপে নিতে নিতে যখন তাঁরা আনমনে চুমুক দিতেন গরম চায়ের কাপে সচেতন জিভের ব্যবহারে, তখন আরব্য রজনীর দৈত্যদের মতো নিস্তব্ধতা ঘিরে নিত তাঁদের ভুবন। ঝুলকালি মাখা হলদেটে ডুমের নিচে, কালো টেবিলের ওপর তাঁরা নিঃশব্দে মেলে দিতেন হাতের তালুতে লুকোনো এক-একটি মহার্ঘ্য তাস। মেলে দিতেন জীবনের ছোট ছোট সুখ কিংবা দুঃখগুলোকে বন্ধুদের কাছে। উন্মুক্ত করতেন হর্ষ, বিষাদ। আমাদের একতলার বাইরের ঘর বাড়ির একটি অংশ হয়েও যেন আমাদের ছিল না। বহিরাগতদের উষ্ণ নিঃশ্বাস সে ঘরে অনুভব করা যেত। শৈশবে এই ঘরে প্রবেশ-অনুমতি ছিল না আমাদের। এই নিয়ে আমরা কোনওদিন অভিযোগ করার সাহস পাইনি। আমি অনেকদিন সন্ধের সময় চুপিচুপি উঁকি মারতাম নিষিদ্ধ বাইরের ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে। দরজার বাঁদিকে বসেছেন আমার বাবা। বিকেলের ইউনিফর্ম, বুকখোলা পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গিতে তিনি উজ্জ্বল। চোখে তাঁর চাপা উত্তেজনার চিহ্ন। বাবার বাঁদিকের চেয়ারে বসেছেন অনিলজ্যাঠা। অনিলজ্যাঠার পেশা ওকালতি। তাই এই দলটার অঘোষিত নেতা হিসেবে তাঁকেই মানা হয়। তাসের আড্ডায় ফর্মাল পোশাক তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। এই আলাদা থাকাটা তিনি হয়তো পছন্দ করেন। অনিলজ্যাঠার উল্টোদিকে দীনুকাকা আর বাবার উল্টোদিকে চিনুকাকা। দীনুকাকা আর চিনুকাকা যেন যমজ ভাই। সাদা ফতুয়া, সবুজ-সাদা লুঙ্গিতে মাণিকজোড়। অনিলজ্যাঠা কিংসাইজ সিগারেট টানতেন। চিনুকাকারা বেশিরভাগ সময় বিড়ি। আমার বাবা নস্যি নিতেন, এনসি নস্য। খুঁটিয়ে লক্ষ করলে বোঝা যায় চার বন্ধুর স্বভাব চার রকমের হলেও তাসের দেশে তাঁরা সবাই রাজা।

 

আজকের খেলায় বাবারা ঠিক সুবিধা করতে পারছেন না হয়তো। বাবা কি হতাশ নিজের ওপর? সঙ্গীর ওপর? চিনুকাকা নাক কুঁচকে, ঠোঁট বেঁকিয়ে বাবাকে ইশারায় কিছু বলতে চাইছেন, বাবা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন বন্ধুর নির্বাক সমীকরণ। নির্বাক ভাষাবিনিময়ে তাঁরা দুজনেই বুঝে নিতে চাইছেন হয়তো প্রতিপক্ষের তালুবন্দি তাসরহস্য। বাবা আর চিনুকাকার দিকে উকিলি নজরদারি অনিলজ্যাঠার। আমি নিশ্চিত, এই পিঠটা পেয়ে গেলে অনিলজ্যাঠা মুচকি হেসে উড়িয়ে দেবেন বাবা আর চিনুকাকার অশুভ আঁতাত। আর যদি হেরে যান? তাহলে নির্ঘাত চিল্লে উঠবেন, ধ্যুত খেলব না! যত্তসব চোট্টার দল। হাতের তাসগুলো টেবিলে ফেলে দেন তিনি।

—এটা কী হল অনিলদা? তুমি খেলাটাকে ভণ্ডুল করে দিলে! সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবার চার্জ।
—বেশ করেছি। তুই চিনুর সঙ্গে কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস আমি দেখিনি?
—বাজে কথা বোলো না অনিলদা, তুমি হেরে গিয়ে অন্যের ওপর দোষ দিচ্ছ।
—স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নেই? ঝাঁঝিয়ে ওঠেন চিনুকাকা।
—আহা অনিলদা, এটা কী করলে! সলিড চারটে ট্রাম্প কার্ড নিয়ে বসে আছি, দিলে তো খেলাটা মাটি করে? বন্ধুদের ঝগড়ার মধ্যে দীনুকাকা তাঁর হাতের ব্রহ্মাস্ত্র, পাশুপত সব উপুড় করে দিলেন গোলটেবিলের ওপর।
—দেখ বটুক, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না। প্রথম থেকে তুই আর চিনু দুনম্বরি করছিস। দুটো জেনুইন পিঠ তুই পাশিয়ে গেলি। আমি কি অন্ধ? উত্তেজনায় অনিলজ্যাঠা কাঁপছেন।
—ও আমরা চোরামি করছি, না? আর তোমার পার্টনার যে ফলস কল করে সব গুবলেট করে দিচ্ছে, তখন? চিনুকাকা অনিলজ্যাঠার ওপর জাতক্রোধ উগড়ে দেন।
—খেলার কিছু বুঝিস? ফলস কল আবার কী? ঠিকঠাক কল করাটাও একটা আর্ট। দীনুকাকার রগরগে ডায়লগ।
—আজকের মতো খেলা শেষ। আমরা যখন খেলা বুঝি না তখন আমাদের সঙ্গে খেলার দরকারটা কী? আমার মনে হল খেলাটা ভণ্ডুল করার এমন মোক্ষম সুযোগ বাবা ছাড়তে নারাজ।
—এ তোর রাগের কথা হয়ে গেল বটুক। খেলার মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়, তা বলে খেলা ছেড়ে উঠে যাব? বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন দীনুকাকা। ঠিক আছে, আমি আর ফলস কল দেব না। অনিলদা তাস বাঁটো।

অনিলজ্যাঠা থম মেরে বসেছিলেন, চিনুকাকা জ্যাঠার প্যাকেট থেকে না বলে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন। কড়া দৃষ্টিতে চিনুকাকাকে আপাদমস্তক মেপে অনিলজ্যাঠা নতুন করে তাস শাফল করলেন। আবার খেলা শুরু হল। এবার নিঃশব্দে একে অন্যের আচরণ টিকটিকির মতো নজরদারি করতে শুরু করলেন সবাই। ঝিম আলোর নিচে আবার মেলে ধরা নিজেদের সফলতা, ব্যর্থতা। হঠাৎ হু হু করে হাওয়া বইতে শুরু করল, এক ঝটকায় খুলে গেল নিষিদ্ধ ঘরের বন্ধ দরজা। আমি বিনা আহ্বানে, বিনা প্ররোচনায় অতীতের সেই ঘরে ঢুকে দেখি, বিশ্বস্ত গোলটেবিলটা পড়ে আছে একপাশে জঞ্জালের স্তূপের মতো, চারটে চেয়ার পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন, অবিন্যস্ত। এখন উজ্জ্বল আলোর নিচে এসে দাঁড়িয়েছি সাবালক আমি। পাক্কা তিরিশ বছর পর। কানে ভেসে আসছে বাতাসে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসেল শব্দ।

 

দীনুকাকা চলে গেলেন। বছর তিনেক আগে অনিলজ্যাঠা ক্যান্সারে মারা যান। দামি সিগারেটের ধোঁয়া তাঁর ফুসফুসের কষ্ট কমাতে পারেনি। চিনুকাকা পৈতৃক ঘরবাড়ি বেচে কুরুক্ষেত্রে ছেলের কাছে চলে গেছেন। অনেকদিন তাঁর কোনও খবর পাই না। গত দশ-বিশ বছরে একে একে অনেক পুরনো মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। দু-একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ বাদুরের মতো সংসারের এক কোণে মৃত্যু-অপেক্ষায়। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে আমার বাবা কিছুটা সবল ছিলেন। মা চলে যাওয়ার পর এখন গভীর জঙ্গলে শতাব্দীপ্রাচীন বনস্পতির মতো নিজেকেই নিজে ছায়া দেন। একতলার শোওয়ার ঘরে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনযাপন। যোগাযোগের সঙ্গী আমার ছেলে ব্রত। কখনও-সখনও বিকেলবেলায়, বিশেষত বৃষ্টিহীন বিকেলবেলায় বাবা গঙ্গার ধারে হাঁটেন। ব্রতর টিউশন না থাকলে দাদুর পায়ের সঙ্গে পা মেলায়। দুজনে নির্জন ঘাটে বসে পা ডুবিয়ে দেয় নদীর জলে।

—তোমার মতো বয়সে আমরা এই ভরা গঙ্গা সাঁতরে পার হতাম।
—তোমার ভয় করত না! ব্রত অবাক হয়।
—ভয় কেন করবে? তোমার বাবারা স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে সাঁতার শিখত।
—এই নোংরা জলে সাঁতার কাটতে তোমাদের ঘেন্না করত না? পা দুটো জোয়ারের টানে ছেড়ে দিয়ে নাতির বিস্মিত প্রশ্ন।
—দাদুভাই, আমাদের তো তোমার মতো বাথরুমে শাওয়ার চালিয়ে স্নানের নামে জল অপচয়ের স্বাধীনতা ছিল না। দিনের অনেকটা সময় আমাদের কাটত জল সঞ্চয় করে। তখন কোথায় শাওয়ার? কোথায় স্নানের গোপনীয়তা?

দাদু আর নাতির মধ্যে সময়ের অনেকটা অন্তর ঘটে গেছে। ব্রতর মনে হয় এসব রূপকথার গল্প বাস্তবে যা কখনও ছিল না। দুই অসমবয়সি মানুষ নদীর স্রোতের সঙ্গে আলাপচারিতায়, উল্টোদিকের বেলুড় মঠের পেছনে তখন সূর্য ডোবার ক্ষণটি রক্তবর্ণ।

 

আমাদের পাড়াটা পুরনো। বেশ পুরনো। এককালে এখানে ডাচদের কলোনি ছিল। গঙ্গার ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত বাঙালিপাড়া। তিন, সাড়ে তিন দশক আগে আমাদের এখানকার আকাশ এতটা ঘোলাটে ছিল না। তখন কুঠিঘাটের ভিক্টোরিয়া হাইস্কুল গমগম করত ছাত্রদের বকবকমে। বিকেলবেলায় ত্রয়ী ক্লাবের ব্যাগপাইপার আর ক্রেডেলের যৌথ সুর ছুঁয়ে যেত ল্যাম্পপোস্টে লটকে থাকা ঘুড়ির কঙ্কাল। এখনকার ঘুপচি ফ্ল্যাট-সর্বস্ব উদাসীন জয়নারায়ণ ব্যানার্জি লেন সে-সব উজ্জ্বল সময়ের ফসিল মাত্র। এ-পাড়ার দু-একটা প্রাগৈতিহাসিক বাড়ির মধ্যে আমাদের হলদে ছাতা পড়া দোতলা বাড়িটা অন্যতম অনুজ্জ্বল দ্রষ্টব্য। আমার বাবার তীব্র আপত্তিতে আমরা এখনও ততটা আধুনিক হতে পারিনি। আমাদের দোতলা বাড়িটা ঠিক সেই আগের মতো এখনও একটেরে, বিসদৃশ রয়ে গেছে।

দীনুকাকার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছিল না। সংবাদ সাপ্তাহিকী উঠে যাওয়ার পরে দেনার দায়ে প্রেসটা বিক্রি করে দেন। মাস তিনেক আগে রাতে বাথরুমে পড়ে কোমর ভেঙে বরাবরের জন্য বিছানা নিয়েছিলেন। আমার বাবা অন্য বন্ধুদের চেয়ে দীনুকাকার উপর বেশি ভরসা করতেন। অন্যদের মতো বাড়ির বাইরে নয়, রান্নাঘর পর্যন্ত ছিল তাঁর গতায়াত। মাঝেমাঝে জমি জরিপের কাজে বাবা যখন কলকাতার বাইরে যেতেন, তখন আমাদের অঘোষিত অভিভাবক হতেন দীনুকাকা। আমার মায়ের সঙ্গে ছিল তাঁর বিশেষ সখ্য। সত্যি বলতে শৈশবে দীনুকাকাকে আমরা নিজের কাকার মতোই শ্রদ্ধা করতাম। দীনুকাকার কাছে আমরা তিন ভাইবোন নিজের ছেলেদের চেয়ে কম আদরের ছিলাম না।

 

একদিন মাঝরাতে বাবার হিসহিস গলার স্বর আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। সেদিন বাবা সম্ভবত দীনুকাকাদের কাছে গো-হারান হেরেছিলেন।

—দীনুকে অত লাই দেওয়ার কী আছে? বাবার গলার ঝাঁঝ আমি পাশের ঘর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারি। তুমি উচিত কাজ করোনি রমা। সবার সামনে তুমি আমার হাতটা দেখে ওকে ইশারা করে আমায় অপমান করলে!
—আমি কী বলেছি দীনুঠাকুরপোকে? বরং তুমি আর চিনুঠাকুরপো জোচ্চুরি করছিলে! আমার মা একটু যেন কৌতুক করেন। খেলাতে হারজিত আছে, তা বলে চোরামি করবে?
—কী, আমি চোর? এতখানি আস্পর্ধা আমাকে চোর বলছ!!

বাবার গলার পারদ চড়ছে। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাই। আমি জানি আমার বাবার রাগ কী সাংঘাতিক। এক্ষুনি ফুঁসে উঠবেন, দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে মায়ের মাথাটা সজোরে ঠুকে দেবেন দেওয়ালে। মা কঁকিয়ে উঠবেন, আর পাশের অন্ধকার ঘরে আমরা তিন ভাইবোন ঝুলমাখা মশারির ভেতর নিজেদের জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপব।

—তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? সত্যি বলছি, আমি তোমার হাত দেখিনি। দীনুঠাকুরপো একটা হাত ভুল চাল দিচ্ছিল, সহ্য করতে না-পেরে ঠিক করে দিয়েছি। মা সংঘাত এড়াতে ভালবাসেন।
—তুমি কি তাস খেলার পণ্ডিত? বাবার গলার স্বরে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে।
—এর মধ্যে ভুলে গেলে বিয়ের পরপর তাস খেলায় কতবার আমার কাছে তুমি হেরেছ? তারপর না বন্ধুদের নিয়ে শুরু করলে তাসের আড্ডা! মা তাঁর হাতের লুকোনো ট্রাম্প কার্ডটা ফেলেন।

এ-ঘর থেকে আমি বাবার অবস্থা অনুভব করতে পারি। মায়ের অপমান বাবাকে মোক্ষম বিঁধেছে। পরাজিত বাবা আর কোনও কথা না বলে খুট করে নিভিয়ে দিলেন শোওয়ার ঘরের আলো। হয়তো লজ্জা ঢাকতে। এরপর উৎকণ্ঠা আর মায়ের শীৎকার মিলেমিশে ঘুম ঘুম ঘোর নেমে আসে আমার চোখে। সবকিছু বুঝতে অসমর্থ হই। অথচ, মগজে তীব্র কৌতূহল। ঘুমোতে ঘুমোতে আমি চেতনায় বুঝতে পারি পাশের ঘরে এখন ঝগড়া নয়, আপাতত সন্ধিপ্রস্তাব।

 

সন্ধে নেমে গেছে অনেক আগেই, বাবার ঘর অন্ধকার। এখন তাঁর আলো জ্বালানোর হয়তো প্রয়োজন নেই। আবছা অন্ধকার তাঁর কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। বিকেল থেকে বাবা একইরকমভাবে ইজিচেয়ারে আধশোয়া। আমি আলো জ্বালিয়ে বাবাকে ডাকি। বাবা চোখ মেলেন। ঘোলাটে দৃষ্টিতে আমাকে বহুদূর থেকে দেখেন। দৃষ্টিতে প্রশ্ন।

—বাবা, আমি শ্মশানে যাচ্ছি। তোমার বৌমা এখনও অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে পারেনি। আসতে রাত হবে। ব্রত ওপরে আছে, ওর স্যার এসেছেন। তুমি সাবধানে থাকবে, দরকার হলে ব্রতকে ডেকে নেবে।

ব্রতর বয়স দশ বছর। আজকাল পড়াশোনার চাপ বাড়ছে, তাই বিশেষ সময় পায় না দাদুকে সঙ্গ দেওয়ার। বাবাও জানেন সময় হলে নিজের আত্মজদের নিজস্ব স্পেস ছেড়ে দিতে হয়। তার জন্য দুঃখ করতে নেই।

—ছোট আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে যা।

চোখের উপর হাতের আড়াল দিয়ে নিজেকে যেন লুকোতে চাইলেন আমার বাবা।

সন্ধের পর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় লোকজন বিশেষ নেই। ল্যাম্পপোস্টের মরাটে আলোর নিচে একটা গরু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমি বড়ালপাড়ার ভিতর দিয়ে শর্টকার্ট করি। বহুদিন পরে আবার এই গলিতে ঢুঁ মারা। একসময়ে প্রতিদিন এই রাস্তা ধরে পড়তে যেতাম কল্যাণস্যারের বাড়ি। চেনা রাস্তায় অচেনা ফ্ল্যাটবাড়িগুলো প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বড়ালপাড়ার এই ভূতুড়ে গলির ভেতর একদিন সন্ধেবেলায় অশ্বিনীকাকুকে কারা যেন খুন করেছিল। তখন ব্ল্যাক আউটের রাত, স্কুল-কলেজ পোড়ানোর সন্ত্রস্ত বেঁচে থাকা। চার দশক পেরিয়ে এসেও সেই বদনাম এখনও বুঝি ঘোচেনি। ঝুলকালির অন্ধকারে ভোট দিন, ভোট দিন দেওয়াললিখন এখন অন্য এক সন্ত্রাসের ইঙ্গিত দেয়। এইখানে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে ঝিম ধরা আলোর নিচে এখন নিজেকে কেমন বিদেশি মনে হচ্ছে।

দেখতে দেখতে শ্মশানে পৌঁছে যাই। কাঠের চুল্লির সামনে কংক্রিটের স্ট্রাকচারে ইলেকট্রিক চুল্লি। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এক ঝলকে দেখতে খারাপ লাগে না। ইলেকট্রিক চুল্লিটা গঙ্গাকে আড়াল করেছে, তাই রাস্তা থেকে গঙ্গাটা এখন অনেকটা দূরে। শেডের ভেতরে দীনুকাকার মৃতদেহ রাখা আছে। দীনুকাকার ছোট ছেলে বুবাই বাবার দেহ ছুঁয়ে বসে। দীনুকাকার বড় ছেলে বাবুদা বাইরে থাকে, আজ নাও আসতে পারে। একসময় আমাদের পাড়ায় অনেক বাবু ছিল। ফর্সা বাবু, বেঁটে বাবু, লম্বা বাবু, কেলে বাবু। দীনুকাকার বড় ছেলেকে আমরা বড় বাবুদা বলেই ডাকতাম। পাড়ার দু-একজনকে দেখলাম চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু অনেকদিন পরে দেখায় মুখের ভূগোল পালটে গেছে। নামও মনে করতে পারছি না।

—বাবা কেমন আছে?

আমার কানের কাছে সস্নেহে কে যেন ফিসফিস করেন। মুখ ফিরিয়ে দেখি আবছা চেনা চেনা একজন বৃদ্ধ।

—চিনতে পারলে না তো? আমি তোমাদের শান্তজেঠু। বৃদ্ধের দৃষ্টিতে উপচে ওঠা কৌতুক।

শান্তজেঠু! প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে আমাদের পাড়া ছেড়েছেন। ত্রয়ী ক্লাবের বাৎসরিক নাটকের পরিচালক। একসময় রহস্যময় কারণে নিজেকে ভিড় থেকে আলাদা রাখতেন। সেই রহস্যময় মানুষটা এখন সাদামাটা, ম্যাড়ম্যাড়ে। বয়স কেড়ে নিয়েছে তাঁর ব্যারিটোন গলার স্বর। শারীরিক ঋজুতা। আমি প্রণাম করি।

—আপনি কেমন আছেন জেঠু?

শান্তজেঠু সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলেন। বুঝতে পারছি গ্ল্যামার জগতের মানুষ স্বভাবত অসুখের কথা প্রকাশে কুন্ঠিত। দীনুকে নিয়ে আমার খুব ঝামেলা হত। ওর জন্য প্রতিবার চাকরের চরিত্রওলা নাটক নির্বাচন করতে নাজেহাল হতাম। শান্ত জেঠুর গলার স্বর কেমন ফ্যাসফ্যাসে। তবুও ‘নির্বাচন’ শব্দটি ব্যবহারের সময় কণ্ঠে নাটকীয়তা ছুঁয়ে যায়। তোমার বাবাকে দিয়ে কখনও অভিনয় করানো গেল না। বটুকের চেহারা এত সুন্দর, অথচ অভিনয়ের সময় কেমন ক্যাবলা হয়ে যেত। পুরনো দিনের কথা বলতে বলতে শান্তজেঠু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।

—আজকাল নাটক করেন না?

বোকার মত প্রশ্ন করে আমি অস্বস্তি বোধ করি। শান্তজেঠু বিষণ্ণ হাসেন। না বাবা, আজকাল কার সময় আছে ক্যারিয়ার ছেড়ে শখের সময় নষ্ট করবে। তাছাড়া নিজের পাড়া একরকম, অন্য জায়গায় কে কাকে চেনে? সময়টা পাল্টে গেছে। শান্তজেঠুর কন্ঠে রাজা অয়দিপাউসের বিষাদ। দুই চোখ অন্ধ করে কিথাইরনের জঙ্গলে অভিশপ্ত রাজা যেন তার পিতৃহত্যার ঋণ শোধ করছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে দীনুকাকার মৃতদেহ ইলেকট্রিক চুল্লিতে দেওয়ার ডাক এসে গেলে আমরা এসে দাঁড়ালাম দীনুকাকার সামনে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সংক্ষিপ্ত পারলৌকিক কাজ শেষ হলে বুবাই আর তার কয়েকজন বন্ধু মিলে দীনুকাকাকে কোলাপসিবল গেট পেরিয়ে ঢুকিয়ে দিল লাল গনগনে চুল্লিটার গহ্বরে। এখান থেকে দীনুকাকাকে একা পথ চলতে হবে। এখন তাঁর হাতের তালুতে লুকোনো নেই কোনও অলৌকিক ট্রাম্প কার্ড।

শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতে আমার বেশ রাত হয়ে গেল। তখন আকাশ কাঁপিয়ে অঝোর ধারা নেমে আসছে মাটির ওপর। ঘন কুয়াশার মধ্যে বৃষ্টিকণা বর্শাফলকে বিঁধছে আমার শরীর। আমার মনটা পাথরের মত ভারী হয়ে আছে। বাবার বন্ধুকে ওইভাবে আগুনে মিশে যেতে দেখে বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এইভাবে উদ্ভিদজীবনে একা একা বেঁচে থেকে, একাকী মিলনের শ্বাসরোধী স্মৃতি রোমন্থন করার চেয়ে প্রস্তরীভূত হয়ে যাওয়া অনেক ভাল।

বাড়ি ফিরে দেখি বাবার ঘর অন্ধকার। আমি বাবাকে ডাকি না, নিঃশব্দে ওপরে উঠে যাই। আমাদের ছোট সংসারটা ভেঙে অনেকগুলো টুকরো হয়ে গেছে। ভাই-বোনের যে যার আলাদা বাড়ি, আলাদা সংসার। যোগাযোগহীন। এখন একতলায় বাবা একা আর ওপরে আমাদের আড়াইজনের পৃথিবী। আমরা স্বামী-স্ত্রী চাকরি করি। সকাল থেকে সন্ধে অর্থের সন্ধানে কাটে। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর বিলাসিতা আমার নেই। এমনকি এক বাড়িতে থেকেও অনেকদিন বাবার খবর ঠিকঠাক নেওয়া হয়ে ওঠে না। আমাদের বাড়িটাও তার পুরনো দিনের স্বভাব হারিয়ে কেমন ভূতুড়ে টাইপের হয়ে গেছে। বন্ধুহীন। পড়শিহীন। আজ আমার টিভি দেখতে ইচ্ছে করছিল না, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে কীসের শব্দে যেন আমার চটকা ভাঙে। অন্ধকারে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারি না, একটু সময় নিয়ে কান পেতে শুনি শব্দটা আসছে একতলা থেকে। নিচের ঘরে বাবা ছাড়া কেউ থাকে না। তাহলে কি বাবার কিছু হল? বুকটা ধক করে কেঁপে ওঠে। দ্রুত মশারির বাইরে এসে ঘরের আলো জ্বালিয়ে নিচে নামি। একতলা ঘন অন্ধকার। বাইরের ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে বিমের মতো তীক্ষ্ণ আলো বেরিয়ে এসে জায়গাটাকে মঞ্চের মতো রহস্যময় করে তুলেছে। ঠিক আমার ছোটবেলার সন্ধেগুলোর মতো একতলার বাইরের ঘরের দরজা ভেজানো। অদ্ভুত! এত রাতে কে আলো জ্বালাল! কৌতূহলে আমার শরীরটা কেঁপে ওঠে। মূলত অভ্যাসবশত চুপিচুপি আধভেজা দরজার বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখি।

সবজে ছাতা ধরা ঘরটার ঠিক মাঝখানে কালো গোল টেবিলটাকে ঘিরে সুন্দর করে চারদিকে চারটে চেয়ার পাতা রয়েছে। বাবা এক প্যাকেট তাস শাফল করে চার ভাগে ভাগ করে প্রতিটা চেয়ারের সামনে এক একটা তাসের প্যাক রেখেছেন। তিনভাগ তাস ওল্টানো, শুধু দরজার দিকের চেয়ারটার সামনে যেখানে সাধারণত দীনুকাকা বসতেন, সেই জায়গার তাসগুলো আলোতে মেলে ধরা। ঘরে কেউ নেই, চার ইয়ারের হয়ে বাবা আজ একা একা তাস খেলছেন। তাঁর পরনে বুকখোলা পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গি। চোখে তাঁর চাপা উত্তেজনার চিহ্ন। অনেকদিন পরে আমার বাবাকে এমন উজ্জ্বল দেখছি। তিরিশটা বছর পেরিয়ে গাছে যেন নতুন করে ফুল ফুটেছে। নিভৃত নীল পদ্ম ফুটেছে ভ্রমর গুঞ্জরণের অপেক্ষায়। একবার তিনি নিজের হাতের তাস না দেখে টেবিলের ওপর ফেলেন। তারপর অনিলজ্যাঠার হয়ে তাস ফেলেন। তারপর চিনুকাকা আর শেষে দীনুকাকার হাতের উন্মুক্ত তাস। পুরনো কালো টেবিলের ওপর লাল আর কালো রঙের চার রকমের তাস উজ্জ্বল আলোর নিচে জীবনের রামধনু হয়ে গেছে। বাবা একা একা খেলতে থাকেন। কখনও ভুরু কুঁচকে, কখনও গাল ফুলিয়ে। শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে। সরীসৃপের শীতল চাহনিতে। আমি স্তব্ধ হয়ে দেখতে থাকি বাবাদের তাসের আসর, দেখতে থাকি বড়দের গোপন ক্রীড়া সেই ছোটবেলার মতো আড়াল থেকে। পাক্কা তিরিশ বছর পরে আবার কানে ভেসে আসছে বাতাসে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসেল শব্দ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...