পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন: সন্ত্রাস ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়

নন্দন রায়

 


বামপন্থীরা বুঝেছেন এবারে লড়তে হবে নিজেদের জোরে, কেন্দ্রীয় বাহিনি অথবা বিচারব্যবস্থার থেকে মানুষের দলগত সংহতি ও প্রতিরোধ আরও বেশি কার্যকর। গত বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে গণতন্ত্রের ব্যাপক প্রসারই হচ্ছে সেই গ্যারান্টি যা সুনিশ্চিত করতে পারে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিসরে তাদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা এবং প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকলে তবেই না প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে

 

পরিকল্পিত নৈরাজ্যের আবাহন

পদার্থবিদ্যায় তাপগতিবিদ্যা শাখার দ্বিতীয় সূত্রে এনট্রপি বলে একটি ধারণা রয়েছে। এনট্রপি হল অণুগুলির র‍্যান্ডম চলাচলের পরিমাপের একটি সূচক যা দিয়ে কোনও কাজ করার সময়ে প্রদত্ত তাপশক্তির কতটা পরিমাণ ওই কর্ম সম্পাদনে ব্যবহার করা যাবে না তা বোঝা যায়। অর্থাৎ, এনট্রপি হচ্ছে বিশৃঙ্খলার সূচক। আরও বলা আছে মহাবিশ্বে এনট্রপির প্রবণতা হচ্ছে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছনো— entropy tends to maximum। অর্থাৎ ম্যাক্সিমাম বিশৃঙ্খলা।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি বুঝতে তাপগতিবিদ্যার এই সূত্রটিকে কাজে লাগতে পারে। ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠান করার পর বঙ্গের রাজনীতিকে, সমাজ ও অর্থনীতিকে শাসক দল চূড়ান্ত নৈরাজ্যে নিমজ্জিত করতে বদ্ধপরিকর। এই নৈরাজ্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটছে না। এটা একটা ডিজাইন, সচেতনভাবে এই নৈরাজ্যের আমদানি করা হচ্ছে। এর কারণটাও প্রাঞ্জল। বাংলায় একটি স্থূল প্রবাদ আছে যেটা সুশীল সমাজ সচরাচর ব্যবহার করেন না দুটি কারণে— প্রথমত, প্রবাদটি ভদ্রলোকের সমাজে ব্যবহৃত হয় না তার স্থূল কুরুচির কারণে; দ্বিতীয়ত, নিজেদের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে। নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ‘যাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তারা সমাজের একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী।’ বর্তমান জমানায় ‘সুবিধা’ মানে হচ্ছে কিছু অর্থমূল্য, সরকারি কোনও সংস্কৃতি-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে কোনও শীর্ষ পদ এবং ‘বঙ্গশ্রী’ গোছের কোনও উপাধি। অলিখিত শর্ত হচ্ছে সরকারের মৃদু বায়বীয় সমালোচনা করুন, কিন্তু  সেসবই মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনার জন্যে। আর হ্যাঁ, কথার ফাঁকে ফাঁকে দশক-বিগত চৌত্রিশ বছরের আবেগমণ্ডিত সমালোচনা করতে ভুললে চলবে না কিন্তু।

প্রবাদ বাক্যটি হল, ‘গোলমাল করে দে মা, লুটেপুটে খাই’। বর্তমান শাসনের নৈরাজ্যের পরিকল্পনা এই প্রবাদের সবচেয়ে সফল রূপায়ণ, যার থেকে চমস্কি কথিত ভদ্রলোকেরাও বাদ নেই।

এই যে এত চুরি-জোচ্চুরি, তোলাবাজি, চাকরি বেচে টাকা তোলা, রেগার কাজে ভুয়ো মাস্টার রোল, তিনতলা বাড়ির মালিকের নাম আবাস যোজনায় গৃহহীন বলে দেখানো, কয়লা বালি পাথর মাটি ইত্যাদি দেদার চুরি এবং যা কল্পনা করা যায় না এমন পদ্ধতিতে টাকা কামানো, এসব সম্ভব হচ্ছে তার কারণ এক পরিকল্পিত নৈরাজ্য সারা রাজ্যে পরিব্যাপ্ত রয়েছে বলেই। এই টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা কীভাবে হবে সেই পদ্ধতিতে কিন্তু কোনও নৈরাজ্য নেই। এক কঠোর সামরিক শৃঙ্খলায় নিম্নতম স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত টাকার গতিপথ। পরিকল্পিত নৈরাজ্যে এটাই প্রাথমিক দস্তুর। জলের ধর্ম নিচের দিকে প্রবাহিত হওয়ার, কিন্তু টাকার ধর্ম ঠিক তার বিপরীতমুখী। এটা একটা তৃণমূলীয় বৈশিষ্ট্য।

নৈরাজ্যের শয্যাসঙ্গী হল অপরাধপ্রবণতা। একটি প্রশাসন ঠিকমতো চালানোর জন্য যতরকমের আইন আছে, অপরিমিত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেসবের প্রত্যহ উল্লঙ্ঘন এই জমানার দ্বিতীয় দস্তুর। এ-কথা আমরা বলছি না যে তৃণমূলের সবাই অপরাধী, কিন্তু একথা আমরা অবশ্যই বলছি যে প্রায় সমস্ত অপরাধীর নিশ্চিন্ত আশ্রয় ঘাসফুল-লাঞ্ছিত পতাকাতলে। অপরাধের গতিমুখ কিন্তু উপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত— সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে বড় অপরাধীরা আর নিম্নতম স্তরে যে বিপুল লুম্পেন পদাতিক রয়েছে, যারা বাজার থেকে দোকানে দোকানে হপ্তা তোলে, অটোর লাইন থেকে মাসোহারা পায়, তারা তুলনায় কম অপরাধী। তারাই কিন্তু তৃণমূলের মূল সামাজিক ভিত্তি। এরাই ধর্মঘট ভাঙে, বিরোধীদের মাথা ফাটায়, মনোনয়ন তুলতে বিরোধীদের বাধা দেয়, মনোনয়ন প্রত্যাহার করায়, বুথ জ্যাম করে এবং অবাধে ছাপ্পা দেয়। এরাই ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন জয়লাভ’-এর আসল কারিগর। এভাবেই এদের গ্রাসাচ্ছাদন এবং সংসার প্রতিপালন চলে।

পথভ্রান্ত পাঠক যদি জিজ্ঞাসা করেন, এই বিপুল ফিরিস্তির মধ্যে তৃণমূলের প্রধান অপরাধ কোনটি? আমাদের উত্তর, এর মধ্যে কোনওটাই তৃণমূলের প্রধান পাপ নয়। তৃণমূলের প্রধান পাপ হল সমাজের প্রতিটি স্তরকে তাদের অধিকারবোধ সম্বন্ধে ধারণা গুলিয়ে দিয়ে অনুগ্রহ-প্রত্যাশী করে তোলার অবিরাম প্রচেষ্টায়। বিশেষ করে পুলিশ ও আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলায় তারা পুরোপুরি সফল হয়েছে চুরির টাকার হিস্যাদারে পরিণত করতে। ফলে তাদের উপরি আয় প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। এই কারণেই গণপ্রতিরোধে লুম্পেনবাহিনি যখন পিছিয়ে আসে, তখন কাজে নামে পুলিশ ও আমলাবাহিনি। বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে পুলিশ বাধা দেয়, রাতের অন্ধকারে প্রার্থীর বাড়িতে গিয়ে মিখ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করায়, বিডিও ডিএম-এর নির্দেশে বৈধ মনোনয়ন কলমে খোঁচায় বাতিল করে এবং ইত্যাদি।

মোটকথা, নৈরাজ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ততা যত বৃদ্ধি পায় ততই দল দুর্বল হয়ে পড়ে। ততই দল আমলা ও পুলিশের ওপরে নির্ভরশীল হতে থাকে, নেত্রীর গলা ফাটিয়ে চিৎকার সত্ত্বেও ততই তৃণমূল ক্রমশ ‘বিজেপি’ হয়ে পড়ে। আর গণতন্ত্র? সে তো কবেই তার গঙ্গাযাত্রা সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে!

 

বামপন্থী জমানা ও তস্করবৃত্তির জমানা

১৯৭৮ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেন এবং সফল নির্বাচনের পরে মহাকরণের অলিন্দ থেকে ঘোষণা করলেন যে তাঁর সরকার মহাকরণ থেকে গ্রামের শাসন চালাবে না, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে গ্রামের মানুষ নিজেরাই তাদের নিজেদের শাসন চালাবেন। এই ঘোষণাটির তাৎপর্য অসীম। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টের সন্ধিক্ষণে গভীর রাত্রে জওহরলাল নেহরু যে বিখ্যাত ‘ভাগ্যের সঙ্গে অভিসার’-এর বক্তৃতা দিয়েছিলেন, জ্যোতি বসুর বক্তৃতা তার চেয়ে গুরুত্বে কম কিছু নয়। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মানে হচ্ছে নিজের হাতে নিজের ভাগ্য গড়ে তোলার ভার, অর্থাৎ তৃণমূল স্তর পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিস্তার।

গণতন্ত্রের মানে কী? খুব সোজা কথায় এর মানে হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যা গড়ে উঠবে অবাধ, শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ এক নির্বাচনের মাধ্যমে, যেখানে এক লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে সব দলই সমান সুবিধা পাবে এবং গরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হবে পঞ্চায়েত। সে পঞ্চায়েতের যাবতীয় কাজের মধ্যে গোপনীয়তার কোনও বালাই থাকবে না, সব কাজই হবে প্রকাশ্যে জনতার চোখের সামনে, গ্রামসভার মিটিংয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অনুসারে। একে বলা হয় স্বচ্ছতা। কোনও কাজ করতে গেলে পঞ্চায়েত আধিকারীদের মধ্যে থাকতে হবে দায়বদ্ধতা, সে দায়বদ্ধতা প্রধান অথবা সভাপতির প্রতি নয়, কাজ নির্বাহ করার নিয়মের প্রতি, আইনের প্রতি। যত বেশি স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার অনুশীলন হবে তত বেশি দুর্নীতির অবসান ঘটবে। পরস্পরবিরোধী দলগুলির একে অন্যকে রাজনৈতিক আক্রমণের অধিকার অবশ্যই থাকবে কিন্তু কেউ কাউকে চোর বলার সুযোগ পাবে না।

আজকে এই কথাগুলি শুনলে কেমন যেন ‘সোনার পাথরবাটি’র মতো অলীক মনে হয়। অথচ পঞ্চায়েত সংক্রান্ত আইনগুলিতে এসব কথাই বলা আছে, এবং আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, এই আইনগুলি প্রতিবিপ্লবী পরিবর্তনের পরেও পরিবর্তিত হয়নি। মনে রাখা দরকার যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গঠন কোনও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নয়। প্রতিষ্ঠিত উদারবাদী বুর্জোয়া কাঠামোর মধ্যেই এই আইন পাশ হয়েছিল সিদ্ধার্থ রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে, কিন্তু সেই সময়ে এই আইন প্রয়োগ করা হয়নি। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার এসে এই আইনের উপযুক্ত সংশোধন করে এর প্রথম রূপায়ণ করে যাতে আমাদের রাজ্যে গণতন্ত্র তৃণমূল স্তর অবধি প্রসারিত হয়। গণতন্ত্র প্রসারে মানুষের যেমন স্বার্থ আছে, তেমনি বামপন্থীদেরও স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু তৃণমূল অথবা বিজেপির স্বার্থের থেকে বামপন্থীদের স্বার্থের চরিত্র একেবারেই আলাদা। তৃণমূলের স্বার্থ ব্যক্তিগত ও দলগত ক্ষমতার বিস্তার যাতে তারা সংঘবদ্ধ লুঠ চালাতে পারে, আর বিজেপির স্বার্থের অন্তঃস্থলে রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতাদর্শের রূপায়ণ। একমাত্র বামপন্থীদেরই কোনও শিলীভূত (hardened) দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। সমাজের গরিষ্ঠ অংশের মানুষের, অর্থাৎ কারখানায় অথবা চাষের মাঠে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থই তাদের স্বার্থ। এই স্বার্থের সেবা সবচেয়ে ভালভাবে করা যায় মুক্ত গণতান্ত্রিক পরি্বেশে। তাই সন্ত্রাসবিদ্ধ পরিবেশে নয়, বামপন্থার  সবচেয়ে ভালমতো বিকাশ হতে পারে একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশেই। সেইজন্য বামপন্থীরা হচ্ছে সবচেয়ে আপসহীন গণতন্ত্রী।

কমিউনিস্ট মানেই অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা আর হিংস্র সশস্ত্র বিপ্লব, এসব নেহাতই দক্ষিণপন্থীদের প্রচার। পৃথিবীর ইতিহাস বলছে কমিউনিস্টদের ওপরে হিংস্রতা চাপিয়ে দিলে একমাত্র তখনই কমিউনিস্টরা অস্ত্র ধারণ করে।

 

গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র

২০১১ সালের তৃণমূলের উত্থান আধারিত ছিল এক একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের জঠরে এবং তার উদ্দেশ্য ছিল বামপন্থার ভেক ধরা পশ্চাদপদ এক সামাজিক ব্যবস্থা, যাকে পরাজিত করে বামপন্থার উত্থান ঘটেছিল, তাকে পুণঃপ্রতিষ্ঠা করা। তাই ৩৪ বছরে বামপন্থীদের যা কিছু অর্জন তার ধ্বংসসাধন করাটা ছিল প্রাথমিক কাজ। স্বৈরতন্ত্রের মানে হচ্ছে গণতন্ত্রের পিছু হঠা। আমরা এর বেশি ব্যাখ্যায় যাব না, বরং দৃষ্টি নিবদ্ধ করব গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের যে ব্যবস্থা বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠা করেছিল, কীভাবে সে ব্যবস্থাকে তারা প্রহসনে পরিণত করেছে। এইরূপ স্বায়ত্তশাসন যেহেতু কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বিভাজন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সামাজিক ও প্রশাসনের কায়েমি স্বার্থের ক্ষমতার ও অন্যান্য সুবিধের অনেকটাই ছাঁটাই করতে হয়েছিল। তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিল তো বটেই। আমলাতন্ত্রের এবং গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থের ষড়যন্ত্রকে সাময়িকভাবে পরাজিত করা গিয়েছিল গ্রামীণ জনতার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তাই বাম-জমানায় অনুষ্ঠিত প্রাথমিক পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলি ছিল প্রকৃতই গণতন্ত্রের উৎসব। পরবর্তীকালে বামপন্থীদের পতনের পেছনে এই গ্রামের মানুষদের অসহযোগিতা একটি বড় কারণ হিসাবে কাজ করেছে।

মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় এলেন এক রামধনু জোটের নেত্রী হয়ে। জোট রাজনীতি কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ ছাড়া কার্যকর হয় না। অমর্ত্য সেন একে বলেছেন Government by Discussion। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রে এসব চলে না। ক্ষমতার ভাগাভাগি তার মোটেই পছন্দ নয়। তাই একাধারে বামপন্থীদের নিকেশ করার সঙ্গে সঙ্গে জোটসঙ্গীদেরও নিকেশ করা শুরু হল। প্রথমে মাওবাদীদের, যারা তৃণমূলিদের সমভিব্যাহারে জঙ্গলমহলে কয়েকশো বামপন্থী কর্মীদের মৃতদেহ নেত্রীকে উপহার দিয়েছিল। তারপর কংগ্রেস এসইউসিআই প্রভৃতি দলগুলিকে। এবারে তার নজর পড়ল পঞ্চায়েতের দিকে। ২০১১ সালে যখন তৃণমূল ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করল, তখন চারটি বাদে বাকি সব জেলা পরিষদ এবং অর্ধেকের সামান্য বেশি পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত ছিল বামপন্থীদের দখলে। ক্ষমতায় আসার ছ-মাসের মধ্যেই সরকারি আদেশবলে পঞ্চায়েতের হাত থেকে উন্নয়নমূলক যাবতীয় কাজকর্ম কেড়ে নিয়ে তার দায়িত্ব অর্পিত হল ডিএম, এসডিও এবং বিডিওদের হাতে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গ্রামের জনপ্রতিনিধিদের পঙ্গু করে দেওয়ার এই হল আনুষ্ঠানিক সূচনা। রাজ্য এবং পঞ্চায়েত একই দলের দ্বারা পরিচালিত হবে এটাই ছিল নেত্রীর নির্দেশ। যেখানে তা হবে না সেখানকার মানুষ তাদের কৃতকর্মের ফলভোগ করবে। এমনকি অর্থ কমিশনের যে টাকা সাংবিধানিকভাবে পঞ্চায়েতের প্রাপ্য, সেই টাকাও দেওয়া হল না। তখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে। তাকে সংবিধান লঙ্ঘনের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিল কে? আজ যখন মোদির ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’-এর ধারণাকে নিন্দা করে মুখ্যমন্ত্রী গলা চড়িয়ে মঞ্চ প্রকম্পিত করেন, তখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত নয় কি যে খোদ তিনিই প্রথম এই ‘ডবল ইঞ্জিনের’ ধারণাটি আমদানি করেছিলেন?

 

বাম জমানার অস্ত এবং নয়া জমানার উত্থান

বামফ্রন্টের আমলে সাতবার পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল। এমন কখনও হয়নি যে অন্তত ৪০ শতাংশের মতো গ্রাম পঞ্চায়েত বিরোধীদের দখলে যায়নি। ওইসব পঞ্চায়েতের সঙ্গে রাজ্য সরকা্রের পক্ষ থেকে অসহযোগিতা করা হয়েছে অথবা প্রাপ্য অনুদান দেওয়া হয়নি এমন কোনও কথা বিরোধীদের মুখে শোনা যায়নি।

আরও কথা আছে। বাম আমলের সাতবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যে পাঁচবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসন জয় সীমাবদ্ধ ছিল ০.৭ থেকে সাড়ে পাঁচ শতাংশের মধ্যে। ১৯৮৮ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসনের পরিমাণ ছিল ৮ শতাংশ। কিন্তু তখনও মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ বিরোধীরা করেনি। এই বৃদ্ধির পেছনে বামপন্থীদের যেমন গা-জোয়ারি আছে তেমনি কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্কলহ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। বামফ্রন্টের আমলে একবারই সিরিয়াস অভিযোগ উঠেছিল ২০০৩ সালে। সেবার ১১ শতাংশ আসনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বামপ্রার্থীরা জয়লাভ করেছিল মূলত হুগলি ও মেদিনীপুর সংলগ্ন এলাকায়। নেতৃত্ব দলের অভ্যন্তরে এই গা-জোয়ারির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এটি খুবই নিন্দার্হ বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে পূর্বতন সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া একটি অপকর্মকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করে বর্তমান সরকারের আমলে ঘটে চলা হাজার অপকর্মের নায্যতা প্রতিষ্ঠা করা চলে না। যাই হোক, সেইসময় এই অপকর্মের প্রতিষেধক হিসাবে দুটি পদক্ষেপ নেওয়া হল— তখনই পঞ্চায়েত নির্বাচনী আইন সংশোধন করে মহকুমা অফিসেও মনোনয়ন গ্রহণ করার বিধি সংযুক্ত করা হল এবং আঞ্চলিক দলীয় নেতৃত্বের দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কার করা হল।

বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে থেকে এবং বুর্জোয়া হিগেমনি (hegemony) বা বুর্জোয়া প্রভাব-বলয়ের মধ্যে থেকেও বামপন্থীরা গণউদ্যোগ বিকশিত করার প্রচেষ্টা নিলে গণতন্ত্রের শিকড় পরিব্যাপ্ত হয়। কিন্তু পার্টি উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা নিলে গণউদ্যোগ ব্যহত হয়। সুতরাং বামপন্থীদের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত? উচিত এটাই যে গণউদ্যোগ কোনওভাবেই খর্ব না করে পার্টিকে তার আদর্শগত নেতৃত্বকে কায়েম করতে হয়— যুদ্ধটা হিগেমনি বা প্রভাব-বলয় বিস্তারের লড়াই, পার্টি লাইন ‘নামিয়ে’ দেওয়ার যুদ্ধ এটা নয়। যুদ্ধটাকে এইভাবে দেখলে, অর্থাৎ দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসাবে দেখলে ‘পার্টি লাইন’ জেতে কিন্তু পার্টি হেরে যায় প্রভাব-বলয়ের বিস্তারের লড়াই-এ। শ্রমজীবী জনতার স্বার্থই বামপন্থীদের স্বার্থ, এই স্বার্থ ব্যতিরেকে তাদের কোনও hardened দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই একথা আমরা আগেই বলেছি। এই জন্যেই তারা তৃণমূল অথবা বিজেপির মতো ক্ষমতাপ্রিয় বা দুর্নীতিপ্রবণ নয়।

বাম আমলে লাইন দিয়ে যেসব মানুষ প্রতি সন্ধ্যায় দলীয় অফিসে ভিড় করে নানা সমস্যা সুরাহার আশায়, সেই মানুষই নিঃশব্দে সরে পড়েন দল সঙ্কটে পড়লে। কারণ বামপন্থী মতাদর্শের প্রভাব-বলয়ে আকৃষ্ট হয়ে তারা আসেনি। তা-ই যদি হত, যদি নিজের অবস্থার সামান্য উন্নতির সঙ্গে তারা বাম মতাদর্শের যোগসূত্রটির সঙ্গতি আবিষ্কার করতে পারত, তবেই একমাত্র তারা সেই মতাদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করত, যা এমন পলকে মিলিয়ে যেতে পারত না।

বহু দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের পুনরাবিষ্কার করে, বহু প্রত্যাখানের অপমান সয়ে, বহু রক্ত অঞ্জলি দিয়ে বামপন্থীরা মনে হয় এই উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছেন।

২০১৩ সালে নতুন জমানার প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন। তখনও তৃণমূলের থিঙ্কট্যাঙ্ক ঠিক করে উঠতে পারেনি কোন কৌশলে নেত্রীর ইচ্ছেমতো বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনের পরিসর থেকে হঠানো যায়। কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও ২৭ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় হাসিল হল। ২০১৮ সালে আরও নিখুঁত পরিকল্পনার ফলে প্রায় ৩৩০০০ প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার সুনিশ্চিত হল এবং ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নেওয়া গেল। বাকিটা পাওয়া গেল ছাপ্পার দৌলতে।

 

এবার অন্য লড়াই

কিন্তু এখন প্রমাণিত হয়েছে ২০২৩ কিন্তু ২০১৮ নয়। বামপন্থীরা বুঝেছেন এবারে লড়তে হবে নিজেদের জোরে, কেন্দ্রীয় বাহিনি অথবা বিচারব্যবস্থার থেকে মানুষের দলগত সংহতি ও প্রতিরোধ আরও বেশি কার্যকর।

গত বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার আগুনের মধ্যে দিয়ে পথ চলে চলে বামপন্থীরা বুঝতে পেরেছেন যে গণতন্ত্রের ব্যাপক প্রসারই হচ্ছে সেই গ্যারান্টি যা সুনিশ্চিত করতে পারে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিসরে তাদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা এবং প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকলে তবেই না প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। এই দুটি আবশ্যিক শর্ত পূরণ হলে নিজেদেরকে মানুষের কাছে আস্থার যোগ্য হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব। এই প্রক্রিয়াটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটবে না। একমাত্র মানুষের জীবন ও জীবিকার দাবিগুলি নিয়ে লাগাতার লড়াই করে যেতে হবে। এর কোনও শর্টকাট রাস্তা নেই। এই দাবিগুলির পেছনে কেবল শ্রমজীবী শ্রেণিগুলির সমাবেশই যথেষ্ট নয়, শাসক শক্তিগুলি ছাড়া অন্যান্য সমস্ত শক্তিগুলির, বিশেষত মধ্যবিত্তশ্রেণির সমাবেশ ঘটাতে হবে। টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি করার কেলেঙ্কারি যত উদ্ঘাটিত হয়েছে ততই মধ্যবিত্তের গা বাঁচিয়ে চলার দিন শেষ হয়ে গিয়েছে, কারণ এতে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তৃণমূল তাদের মেধার অহঙ্কার ঘুচিয়ে দিয়ে শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে বিজেপিও তো তৃণমূলের বিরোধিতা করছে। তবে বিজেপির সঙ্গে নয় কেন? বস্তুত, বামপন্থীদের তরফ থেকে এই প্রশ্নের সঠিক মোকাবিলা করতে না পারার জন্যই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এমন চমকপ্রদ সাফল্য পেয়েছিল। সেই সময়ে বামপন্থীরা যে বিজেপির থেকে ভিন্নগোত্রের রাজনীতির ধারক, সেকথা জনমনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।

এ-রাজ্যে প্রতিবিপ্লবের আক্রমণ দু-মুখো— শারীরিক আক্রমণ, খুন, জখম, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ইত্যাদির দায়িত্বভার তৃণমূলের কারণ তার হাতেই আছে রাষ্ট্রক্ষমতা। আর বিজেপির আক্রমণ মানুষের মগজে, তারা ছাড়া তৃণমূলের বিরুদ্ধে রক্ষাকর্তা কেউ নেই এই কথাটা মানুষের মগজে গেঁথে দেওয়া।

বিজেপির থেকে নিজেদের আলাদা করে দেখানোর জন্য বামপন্থীদের কয়েকটি গুণ থাকতে হবে। প্রথমত, will to sacrifice— ত্যাগ স্বীকারের ইচ্ছাশক্তি। এই ত্যাগ স্বীকার মানুষের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য। দ্বিতীয়ত, will to power— ক্ষমতা দখলের সঙ্কল্প। এই ক্ষমতা দখল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তৃতীয়ত, বামপন্থীদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে একটা জনমুখী চরিত্র থাকতে হবে। এবং চতুর্থত, যাই ঘটুক না কেন, জনগণের থেকে কখনওই বিচ্ছিন্ন না হওয়া। এগুলিই হল বামপন্থার সঞ্জীবনী। সুখের কথা, বামপন্থীরা এই পথেই দ্বিধাহীন পদক্ষেপে এগোচ্ছেন।

একথা ভেবে নিলে চলবে না যে মাফিয়া সর্দারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যে বিশাল লুম্পেন বাহিনি পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রতিটি স্তরে বামপন্থীদের ওপরে প্রতিদিন সন্ত্রাস নামিয়ে আনছে, তারা বিনাযুদ্ধে রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে যাবে। এটা তাদেরও রুটিরুজির লড়াই। আর বামপন্থীদের কাছে এই লড়াইটা হল গ্রামস্তর পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রসারের লড়াই। সন্ত্রাস আর গণতন্ত্র দুই বিপরীত শক্তি। দুটি একই সঙ্গে থাকতে পারে না। এবারে কে জয়ী হবে তা এখনও নির্ধারিত হয়নি।

বামপন্থীরা তৃণমূলি গুন্ডা ও রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণের মুখে এবারে হেরে গেলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। বিকল্প চেতনাকে অবিরাম রক্তক্ষরণের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। এই রক্তের দুটি ধারা— একটা প্রতিক্রিয়ার দুষিত রক্ত, অন্যটা ত্যাগ ও তিতিক্ষার লাল রক্ত। সাধে কি আর বামপন্থীদের ঝান্ডার রং লাল!


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...