এ সি ফর আস; এ সি এগেইন্সট আস— রিফিউজি সপ্তাহ (১৮-২৪ জুন) শেষ হল…

অয়নেশ দাস

 



২০১৪ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়ে রিফিউজি মৃত্যুর সংখ্যা ২৭০০০। টাইটানিকের মৃত্যুসংখ্যার ১৪ গুণ বেশি। শুধু এই বছরেরই মৃত্যুসংখ্যা ১১০০-র বেশি। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে নামহীন মানুষ; পালাচ্ছে আর মরছে। না, তাদের নাম আপনি জানতে পারবেন না। কারণ তাদের নাম নেই। তারা পৃথিবীর অদরকারি নামহীন জীবন। তাদের সামনে সমুদ্র আছে, আছে দগদগে মরুভূমি। আর পিছনে আছে ধ্বংস-মৃত্যু-ক্ষুধার এক রক্তাক্ত উপত্যকা যেখান থেকে না পালিয়ে উপায় নেই। পালাচ্ছে নামহীন মানুষ। স্রোতের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ। উপকূলে ভেসে উঠছে কিছু অর্ধমৃত শরীর। নামহীন। সমুদ্র খেয়ে নিয়েছে নামহীন মানুষের ঝাঁক

 

How do we overcome war and poverty only to drown in your sea?[1]

তার কোনও নাম নেই। তার আশেপাশেও যারা গা ঘেঁষে ছিল, তাদেরও কোনও নাম ছিল না। নামহীন, গোত্রহীন একগুচ্ছ মানুষ… এই পৃথিবীর। একগুচ্ছ মানুষ, কিলবিল করে, যেন বহু শতাব্দী ধরে নামহীন, দেশহীন; পৃথিবীর নীল সমুদ্রের ঢেউয়ে, ভূমধ্যসাগরীয় ঝঞ্ঝায়। একদিকে পাঁচ হাজার বছর পুরনো পিরামিডের গায়ে, আরেকদিকে আড়াই হাজার বছর পুরনো অ্যাথেনার মন্দিরে পাক খেয়ে নোনা হাওয়ার ঘূর্ণিতে নামহীন মানুষের দঙ্গল মেছো ট্রলারের ডেকে আগেই লুটিয়ে পড়েছিল তৃষ্ণায়। জলের তোড়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে নিচের হোল্ডে নামহীন মায়েরা, নামহীন বাবারা নামহীন শিশুদের তখনও বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। ভিড়ের মধ্যে সেও ছিল। উদ্বাস্তুবোঝাই ট্রলারের কোনও নাম ছিল না। থাকে না। উদ্বাস্তুবোঝাই ট্রলার ডুবছিল। শিশুরাও। দেশের নাম থাকে। সমুদ্রের নাম থাকে। থাকে ঝড়েরও গালভরা নাম। সমুদ্রতটের নাম থাকে। থাকে তটরক্ষীদের বাহিনিরও নাম। নামওলাদের কিছু যায় আসে না। নামহীন উদ্বাস্তুদের নিয়ে ডুবে গেল উদ্বাস্তু জাহাজ। বাড়ির থেকে অনেক দূরে; পিঠে পৃথিবীর মানচিত্র।

 

একশো এগারো বছর আগে ডুবেছিল খ্যাতনামা এক জাহাজ। টাইটানিক। একটা পৃথিবীর অন্যতম সেরা আ লা কার্টে রেস্তোরাঁ, একটা সুপার লাক্সারি লাউঞ্জ আর একটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্র্যান্ড স্টেয়ারকেস নিয়ে উত্তর আটলান্টিকে ডুবে গিয়েছিল আনসিঙ্কেবল টাইটানিক। একই সঙ্গে ডুবেছিল ভারি কিছু নাম— মিলিয়নেয়ার জন জ্যাকব অ্যাস্টর, রেলরোড এক্সিকিউটিভ জন থেয়ার, মাইনিং ম্যাগনেট বেঞ্জামিন গাগেনহ্যাম, স্টিল ম্যাগনেট জর্জ উইক… ২২০০ যাত্রীর ১৫০০-র সলিলসমাধি হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল এই হতভাগ্যদের নাম। অসংখ্য শোকগাথায় ভেসে গিয়েছে পৃথিবী। লক্ষ এলিজিতে দ্রব হয়ে থেকেছে ভারি ভারি নাম। জেমস ক্যামেরনের ক্যামেরায় যখন জলের স্রোতে যুগলে ভেসে যাচ্ছেন ধনকুবের ইসিডর আর ইদা স্ট্রাউস; তখন কলকাতার গ্লোব সিনেমায় আমারই পাশের সিটে বসে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ছে সহদর্শক বাঙালি তরুণ। তবে তার অনেক আগেই বন্ধ খোলের মধ্যে ছটফট করতে করতে শেষ হয়ে গিয়েছে তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীরা। না, তাদের নাম নেই। নামহীন আইরিশ উদ্বাস্তুর দঙ্গল। ক্যামেরন কয়েকটি নাম দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সে তো তাঁরই দেওয়া নাম। আসলে কি আর ওদের নাম হয়! তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ শতাংশ, আরও ভেঙে বললে তৃতীয় শ্রেণির ৯৮ শতাংশ পুরুষের সলিল সমাধি হয় টাইটানিকের সঙ্গে। তাদের নাম আটলান্টিকও এখনও জেনে উঠতে পারেনি। ক্যামেরন তো কোন ছাড়। ইদার মতো মাত্র ৩ শতাংশ প্রথম শ্রেণির মহিলা যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। তাদের তো নাম ছিল। ভারি ভারি নাম। প্রতিটি জীবনই অত্যন্ত মূল্যবান। তবে এই পৃথিবীতে উচ্চকোটির জীবন অনেক বেশি মূল্যবান— এ এক নগ্ন সত্য।

একশো এগারো বছর ধরে আটলান্টিকের ৩৮০০ মিটার গভীরে শুয়ে আছে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ। সমুদ্রশ্যাওলায় ঢাকতে ঢাকতে সে রেলিক আজ হয়ে উঠেছে ২৫০,০০০ ডলারের টিকিট। ভুমধ্যসাগরে যখন দেশহীন, নামহীন, খাদ্য-পানীয়হীন উদ্বাস্তু ভরা ট্রলারটি ডুবছিল তখন নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জনস থেকে ছেড়ে আটলান্টিকের ৩৮০০ মিটার গভীরে পাঁচ ধনকুবেরের থ্রিলিং অ্যাডভেঞ্চারের এক্সট্যাসি হয়ে নেমে চলছিল টাইটান। ওশেনগেট কোম্পানির মহার্ঘ্য সাবমারসিবল। জেফ বেজোস, মাস্ক, ব্র্যান্সনের স্পেস টুরিজম-এর মতোই ওশেনগেটের গভীর সমুদ্র ওডিসি। এক্সট্রিম টুরিজম। কনজিউমারিজম যখন মহাকাশ ছুঁচ্ছে তখন গভীরতম সমুদ্র তলদেশও ছোঁবে; এ আর আশ্চর্য কী! টাইটান যখন হারিয়ে গেল, তখন কিন্তু হারিয়ে গেল শুধু পাঁচটি মানুষ নয়। পাঁচটি উচ্চকোটির নাম। ভারি ভারি। ওশেনগেট এক্সপিডিশনের সিইও স্টকটন রাশ, ব্রিটিশ বিলিয়নেয়ার হামিশ হার্ডিং, ফরাসি অভিযাত্রী ও গভীর সমুদ্র বিশেষজ্ঞ পল-অঁরি নারজুলে, ব্রিটিশ-পাকিস্তানি মাল্টি-মিলিয়নেয়ার শাহাজাদা দাউদ এবং তাঁর পুত্র সুলেমান। ভারি ভারি নাম। সারা পৃথিবীর সেরা মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল। পৃথিবীর অত্যন্ত দামী মানুষদের কতটা কষ্ট পেতে হচ্ছে তাই নিয়ে পৃথিবী ভেসে গেল। স্পেকুলেশন আর স্পেকুলেশন। টাইটানে অক্সিজেন ক্যাপাসিটি; আর কতক্ষন অক্সিজেনের সরবরাহ; সবকিছুর কাউন্টডাউন। অ্যাসফিক্সিয়ন, হাইপোথারমিয়া আর কোমার যে যে পর্যায়ের মধ্য দিয়ে হতভাগ্য পাঁচ যাত্রীকে যেতে হবে, তার বিবরণও পৃথিবীবাসী পেয়ে গেল। ইমানুয়েল মাকরঁর হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার বিবরণ শোনামাত্র তাঁর নির্দেশে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এল’আতলান্তে নামের ২৭৯ ফুটের ফরাসি রিসার্চ ভেসেল (যা কিনা সমুদ্রের ২০০০০ ফুট গভীরে নামতে সক্ষম) আটলান্টিক তোলপাড় করে ৪০০০ কিলোমিটার দৌড়ে দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে গেল। বিভিন্ন গভর্নমেন্ট, নেভি, কোস্টগার্ড আর কর্পোরেট সংস্থারা ঝাঁপিয়ে পড়ল উদ্ধারকাজে। একটি ইউনিফায়েড কম্যান্ড তৈরি করা হল ইউএস নেভি, ইউএস কোস্টগার্ড আর কানাডিয়ান কোস্টগার্ডকে নিয়ে। অজস্র নৌ-বিশেষজ্ঞ আর গভীর সমুদ্র-বিশেষজ্ঞদের এনে হাজির করা হল। প্রযুক্ত হল ৩টি কানাডিয়ান কোস্টগার্ড ভেসেল, ১টি কানাডার নেভি ডিফেন্স ভেসেল, ২টি উচ্চ প্রযুক্তির রিসার্চ ভেসেল, ২টি উচ্চ প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ভেসেল, ৬খানা ইউএস মিলিটারি এয়ারক্র্যাফট, ২টি কানাডিয়ান মিলিটারি এয়ারক্র্যাফট আর অগুনতি উচ্চ প্রযুক্তির রিমোটচালিত জলযান (ROV)। যখন বিশেষজ্ঞরা সবাই জানত যে ওই পাঁচজনের বেঁচে থাকার আর কোনওই আশা নেই, তবুও প্রথম বিশ্ব জান লড়িয়ে দিয়েছিল। বিবিসির রিপোর্টাররা কেপ কড থেকে লাইভ রিপোর্ট করছিল। তাদের অন্তরাত্মাকেও ঢেকে ফেলেছিল কেপ কডের ‘mournful fog’। জীবন বড় দামী। সন্দেহ নেই।

 

তবে কিছু জীবন যে কখনওই দামী নয়! ১৩ জুন সকাল ১১টা থেকে বিপদসঙ্কেত পাঠাচ্ছিল গ্রিসের উপকূলবর্তী সমুদ্রে বিপদে পড়া, লিবিয়া থেকে ছেড়ে আসা নামহীন উদ্বাস্তুর ঝাঁকে হাবুডুবু নামহীন ফিশিং ট্রলারটি। এগারো ঘন্টা কেটে গেলেও একটি সাহায্য আসেনি। ডুবতে থাকা ট্রলারটি গ্রিক উপকূলের শহর পাইলোস থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে ছিল। দুই দিকে দুই প্রাচীন সভ্যতা। সামনে আধুনিক সভ্যতার মিথ। সামনে বেঁচে থাকার, বেঁচে যাওয়ার মিথ। না, বিপদসঙ্কেত দীর্ঘ এগারো ঘন্টা ধরে বাজলেও… কেউ আসেনি।

We journey towards a home that does not halo our heads with a special sun.
Mythical women applaud us. A sea for us, a sea against us.[2]

ফিশিং ট্রলারটিতে ৭৫০-এর বেশি মানুষ অনবোর্ড ছিল। তিল ধারণেরও জায়গা ছিল না। ছিল অসংখ্য শিশুও। সবাই উদ্বাস্তু। কারা এরা? নামহীন সামান্য অস্তিত্বের ঝাঁক। বাদামি এবং কৃষ্ণাঙ্গ। কোথা থেকে এরা আসে? পাক-অধিকৃত কাশ্মির, বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সোমালিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া, সাবসাহারা…।

Alexandria, Egypt
Habeebi, just take the boat.
Behind you Aleppo and Asmara, barrel bombs and Kalashnikovs.
In front of you a little bit of hope.
Your Sea, Mare, Bahr. Our war, our Harb.[3]

 

২০১৪ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়ে রিফিউজি মৃত্যুর সংখ্যা ২৭০০০। হ্যাঁ ২৭০০০। টাইটানিকের মৃত্যুসংখ্যার ১৪ গুণ বেশি। শুধু এই বছরেরই মৃত্যুসংখ্যা ১১০০-র বেশি। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে নামহীন মানুষ; পালাচ্ছে আর মরছে। না, তাদের নাম আপনি জানতে পারবেন না। কারণ তাদের নাম নেই। তারা পৃথিবীর অদরকারি নামহীন জীবন। তাদের সামনে সমুদ্র আছে, আছে দগদগে মরুভূমি। আর পিছনে আছে ধ্বংস-মৃত্যু-ক্ষুধার এক রক্তাক্ত উপত্যকা যেখান থেকে না পালিয়ে উপায় নেই। সামনে আছে গ্রিস, স্পেন, ইতালির উপকূল। ইউরোপ। স্বর্গরাজ্য। পালাচ্ছে নামহীন মানুষ। স্রোতের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ। উপকূলে ভেসে উঠছে কিছু অর্ধমৃত শরীর। নামহীন। সমুদ্র খেয়ে নিয়েছে নামহীন মানুষের ঝাঁক।

Augusta, Italy
Where is the interpreter?
This is my family.
Baba, mama, baby all washed up on the shore. This is 28 shoeless survivors and thousands of bodies.
Bodies Syrian, Bodies Somali, Bodies Afghan, Bodies Ethiopian, Bodies Eritrean.
Bodies Palestinian.
Your Sea, Mare, Bahr. Our war, our Harb.[4]

কেউ মনে রাখে না। নামহীন, গোত্রহীন; এক অপ্রয়োজনীয় সমষ্টি মাত্র— তাদের কেউ মনে রাখে না। আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম মিছিল হল শিকড় থেকে উৎপাটিত বাস্তুহারার মিছিল। পিঁপড়ের সারির মতো— দীর্ঘতম লাইন চলে তো চলেই== মরুভূমির বালিয়াড়ি ভেঙে— অলিভ ঝোপের আড়াল দিয়ে বিরামহীন কাঁটাতারের আঁকাবাঁকা বুনোট ধরে— ফেনায়িত উপকূলের সূর্যাস্ত ধরে— দেশ ছেড়ে, শহর ছেড়ে, ঘর ছেড়ে কেনই বা চলছে এরা? গুলি খেয়ে, জলে ডুবে, ক্যাম্পে পচে-হেজে মরতে?

no one leaves home unless
home is the mouth of a shark
you only run for the border
when you see the whole city running as well
your neighbors running faster than you
breath bloody in their throats
the boy you went to school with
who kissed you dizzy behind the old tin factory
is holding a gun bigger than his body
you only leave home
when home won’t let you stay.[5]

 

২০১৪ সাল থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ফোর্ট্রেস ইউরোপ পলিসি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে কার্যকর করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বহির্সীমা আর ইইউ/শেঙ্গেন এলাকা মিলিয়ে দুর্ভেদ্য কাঁটাতারে ঘেরা সীমানা ৩১৫ কিমি থেকে বেড়ে ২০৪৮ কিমি ছুঁয়েছে। তেমনি বেড়েছে পুশব্যাকের নিষ্ঠুরতা। ইউরোপের দেশে দেশে যতই দক্ষিণপন্থী হাওয়া মজবুত হচ্ছে, ততই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে উদ্বাস্তুদের প্রতি উদগ্র রেসিস্ট নিষ্ঠুরতা। স্পেন, ইতালি এবং গ্রিসের জলসীমানা তাই আরও দুর্ভেদ্য এবং একই সঙ্গে অমানবিক হয়ে চলেছে প্রতিটি দিন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মন্ত্রণায় এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলিতে গ্রিসের সাইরিজা সরকারের উদ্যোগে তৈরি হয় উদ্বাস্তু ডিটেনশন ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলির কাজ ছিল উদ্বাস্তুদের পাকড়াও করা, আর দ্রুততার সঙ্গে ফেলে আসা যুদ্ধবিদ্ধস্ত, ক্ষুধাক্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানো। এদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল মোরিয়া ক্যাম্প। কীরকম ছিল মোরিয়া? ইউএন হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের এক্সপার্ট কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান জিন জিগলার মোরিয়াকে ইউরোপের মাটিতে সর্বার্থে একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। গত মাসেই গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কাইরিয়াকোস মিতসোতাকিস বুক ফুলিয়ে বলেছেন— We protected our country’s borders both on land and at sea, and reduced irregular arrivals by 90 percent. We proved that the sea has borders, and those borders can and must be guarded. সমুদ্রেরও বর্ডার আছে। নামহীন মানুষের দঙ্গল কি জানে না? বর্ডার রক্ষা করার জন্য আছে সভ্য দেশের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সভ্য সীমারক্ষী বাহিনি। এছাড়াও আছে ফ্রন্টেক্স-এর মত বেসরকারি বাহিনি। ধরা পড়লে আছে মোরিয়ার মতো ক্যাম্প। তারপরেও ওরা কেন আসে?

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেরও গালভরা নাম থাকে। না তার কোনও নাম ছিল না। তার আশপাশেরও কারও না। উদ্বাস্ত ছাড়া তাদের কোনও পরিচয় ছিল না। তাদের কোনও দেশ নেই। তাদের কোনও নাম নেই। ফিশিং ট্রলারটির যাত্রা শুরু করবার চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে বেশ কিছু মানুষ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় প্রাণ হারায়। চতুর্থ দিন থেকে সমস্ত যাত্রী ইঞ্জিনের জল খেতে শুরু করে। মাঝখানে একটি লাক্সারি ইয়ট চারটি জলের বাক্স ছুড়ে দিয়ে যায় ওদের দিকে। প্রতিটি বাক্সে ছিল ছয়টি করে বোতল। ৭৫০টি মানুষ কুকুর হয়ে যায় চারটি জলের বাক্সের জন্য। কাইলোস উপকূল থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে একটানা সাত ঘন্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল ফিশিং ট্রলারটি সাহায্যের অপেক্ষায়। তারপর আসে এক বিরাট বাণিজ্য জাহাজ। তারা চিৎকার করতে থাকে— আমাদের সাহায্য করো… আমাদের সাহায্য করো… এই দ্যাখো ডেকে পড়ে আছে অভুক্তদের মৃতদেহ। মিসাইলের মতো কতগুলি জলের বোতল ছুড়ে দিয়ে নির্বিকারে চলে যায় সেই বিশাল বাণিজ্যপোত। সূর্যাস্তের পরে আসে গ্রিক কোস্টগার্ড। তারপর গ্রিক কোস্টগার্ডের ভেসেল দড়ি দিয়ে টেনে জোর করে ট্রলারটিকে ইতালির জলসীমায় ঢুকিয়ে দিতে চায়। গরুবোঝাই-এর মতো নামহীন উদ্বাস্তু ভর্তি ছোট ট্রলারটি ভারসাম্য হারায় ও তারপর ডুবে যায়। সমস্ত নামহীন মানুষ জলে ডুবছিল। মানুষ ক্রমাগত ডুবছিল আর আকাশ বাতাস আর্তনাদে ভরে উঠেছিল। গ্রিক কোস্টগার্ড আরও আধঘন্টা সেখানেই ছিল। না, তারা এই অপ্রয়োজনীয় নামহীন, দেশহীন মানুষগুলোকে বাঁচানো দরকার বলে মনে করেনি। নামহীন মানুষেরা ডুবে যাচ্ছিল। শিশুরা সবার আগেই। এটাই তো ছিল লাস্ট প্যাসেজ।

Earth is pressing against us, trapping us in the final passage.
To pass through, we pull off our limbs.
Earth is squeezing us.  If only we were its wheat, we might die and yet live.
If only it were our mother so that she might temper us with mercy.
If only we were pictures of rocks held in our dreams like mirrors.
We glimpse faces in their final battle for the soul, of those who will be killed
by the last living among us. We mourn their children’s feast.
We saw the faces of those who would throw our children out of the windows
of this last space. A star to burnish our mirrors.[6]

তবুও নামহীন ওরা আসে। পঙ্গপালের মতো। মরতে? আর কী মরবে ওরা! আর কতটা মরবে ওরা! হ্যাঁ, সবাই বলে শুনি, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। সত্যি কি তাই? সত্যিটা তো তা নয়! নামহীন বাস্তুহারার দল কি তা জানে না? কেন আসে তাহলে এভাবে? সভ্যতায় কালিমা ছেটাতে? ইজরায়েলি বুটের নিচে রোজ পিষ্ট হতে হতে বেঁচে যাওয়া সিরিয়ার এক ছোট্ট উদ্বাস্তু কিশোরী কী চেয়েছিল?

Syrian doves croon above my head
their call cries in my eyes.
I’m trying to design a country
that will go with my poetry
and not get in the way when I’m thinking,
where soldiers don’t walk over my face.
I’m trying to design a country
which will be worthy of me if I’m ever a poet
and make allowances if I burst into tears.
I’m trying to design a City
of Love, Peace, Concord and Virtue,
free of mess, war, wreckage and misery.[7]

 

একটুকু শান্তির ঘর। সবার অধিকার। অথচ তুমি তো বলো— আমি ইউরোপ। ওরা পঙ্গপালের মতো আসছে আমায় নষ্ট করবে বলে। আমার নিজের মানুষের কাজ নিয়ে নেবে বলে। জায়গা দখল করে নেবে বলে। ইউরোপ কি জানে না, একসময় ৬৫ মিলিয়ন ইউরোপীয় সেটল করেছিল পৃথিবীর আশি শতাংশ ভূভাগে! নির্বিচারে দখল করেছেল আদিম অধিবাসীদের দেশ! এখন যখন ফোর্ট্রেস ইউরোপ পলিসি এনে তুমি অসহায় বাস্তুহারাদের তাড়িয়ে পোকার মতো মারছ, তখন নিজের নির্লজ্জতায় তোমার লজ্জা করে না? তোমার কোন সভ্যতার বড়াই করো? এই যে নিষ্ঠুর শ্রেণিবিভক্ত ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়া তোমরা তৈরি করেছ, তার জন্য তোমাদের লজ্জা করে না? কার জন্য, কীসের জন্য সিরিয়া জ্বলছে? জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে আফ্রিকা, আফগানিস্তান, এরিট্রিয়া? উন্মত্ত মুনাফার লোভ তোমাদের কতটা নামাতে পারে? এই যে টাইটান সাবমারসিবলে পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু তার জন্য কে দায়ী? এক ওভারউইনিং হুব্রিস আর উদগ্র মুনাফার লোভ ছাড়া আর কে দায়ী? মুনাফা বাড়ানোর তাগিদে ওশেনগেটের কস্ট কাটিং-এর শিকার ওই পাঁচজন। সাবমারসিবলটি সুরক্ষিত আদৌ নয় এই রিপোর্ট করার জন্য চাকরি গিয়েছিল ওশেনগেটের নিজেরই ডিরেক্টর অফ মেরিন অপারেশন্স, ডেভিড লকরিজের। তোমাদের লজ্জা করে না?

না, জানি তোমাদের লজ্জা নেই। মুনাফার নেশা আর ক্ষমতার লোভ তোমাদের কর্নিয়া কুরে কুরে খেয়ে ফেলেছে। বিষাক্ত অক্টোপাসের মতো পৃথিবীটাকে তোমরা আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ফেলেছ। প্রতিটি শুঁড় তোমাদের ইউজেনিক্সের বিষে বিষাক্ত। এই পৃথিবীতে নরম আলোর সূর্য উঠবে শুধু প্রথম বিশ্বের ল্যান্ডস্কেপ গ্রামে। মহাকাশের সুদূর তারায়, মহাসমুদ্রের গভীরতম গিরিখাতেও একদিন পৌঁছে যাবে তোমাদের আনন্দের আস্বাদ। জানি প্রবাদবাক্যের মতো কানে বাজবে— প্রতিটি জীবনের অসীম মূল্য। সে শুধু তোমাদের জন্য। ভারি ভারি নামেদের জন্য। শোকার্ত কুয়াশায় পৃথিবী ছেয়ে যাবে সেই সব ভারি ভারি নামেদের জন্য— হামিশ হার্ডিং, শাহজাদা দাউদ… সূর্য নেমে আসবে সেইসব ভারি ভারি নামেদের জন্য— জেফ বেজোস, এলন মাস্ক, জো বাইডেন, এঞ্জেলা মর্কেল, ইমানুয়েল মাকরঁ, রাজা লিওপোল্ড…। আর অন্যদিকে নামহীন মানুষেরা ক্রমাগত অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে, পতঙ্গের মতো মরতে থাকবে এক পাহাড়প্রমাণ সংবেদনশূন্যতায়। দুই শতাব্দী আগেই ম্যালথুস নামের এক আজকের প্রথম বিশ্বের পূর্বপুরুষ ক্ষুধা, ব্যাধি আর বিপর্যয়ের ফলে যে বিপুল মানবসংহার, তার গুণকীর্তন করে গিয়েছেন। নামহীন মানুষ তো উধাও হতেই থাকবে। হু কেয়ারস! প্রমাণ চাই? ওই দ্যাখো, কাইলোস থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে সমুদ্রের তলায় পড়ে আছে একটি অর্বাচীন ফিশিং ট্রলারের লাশ। তার কোনও নাম জানা যায়নি। এখনও শ্যাওলা জমেনি তাতে। তার নিচে ক্রমাগত ঘূর্ণির জলে ঘুরপাক খাচ্ছে এক নারীর নামহীন শব। না, তার কোনও নাম ছিল না। সিরিয়ান? আফগান? পাকিস্তানি? লিবিয়ান? এরিট্রিয়ান? কী যায় আসে! দিন পনেরো আগেও সিরিয়ান কিশোরীটির মতো এক শান্তির আশ্রয়ের স্বপ্ন জাগরুক ছিল সে চোখে। সে চোখ এখন স্বপ্নহীন স্তব্ধ; তবে এখনও পুরোপুরি ডিকম্পোজ হয়নি। শুধু রাইগার মর্টিসের ফলে বুকে নামহীন, দেশহীন বাচ্চাটা আরও জাপটে এসেছে। কে জানে, হতেও পারে কয়েক বছর পরে এক্সট্রিম টুরিজমের বাণিজ্যিক সাবমারসিবলে চেপে এই রেলিক দেখতে গভীরে ডুব দেবে ভাগ্যবান ভারি ভারি নামের দল।

Where should we go after the last border? Where should birds fly after the
last sky?
Where should plants sleep after the last breath of air?
We write our names with crimson mist!
We end the hymn with our flesh.
Here we will die. Here, in the final passage.
Here or there, our blood will plant olive trees.[8]

 


[1] কবিতার নাম: No search, no rescue। কবি: Jehan Bseiso।
[2] কবিতার নাম: We Journey Towards A Home। কবি: Mahmoud Darwish।
[3] টীকা ১।
[4] পূর্বোক্ত।
[5] কবিতার নাম: Home। কবি: Warsan Shire।
[6] কবিতার নাম: Earth Presses against Us। কবি: Mahmoud Darwish।
[7] কবিতার নাম: Lament to Syria। কবি: Amineh Abou Kerech।
[8] টীকা ৬।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...