পঞ্চায়েত নির্বাচন: ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক

প্রতীক

 

 


ভোটারদের সরাসরি নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার সুযোগ দেয়, শাসক দলের দলীয় সিদ্ধান্তকেও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেয় যে ব্যবস্থা, তারই নাম পঞ্চায়েত নির্বাচন। আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের স্বাদ দেয় এই নির্বাচন। যদি এই সুযোগ হারিয়ে যায়, সে ক্ষতি অপূরণীয়

 

প্রত্যেকবার পঞ্চায়েত নির্বাচন এসে পড়লেই খবরের কাগজে এবং খবরের চ্যানেলে বেশকিছু খবর দেখে আমার বেজায় হাসি পায়। যখন কাগজে কাজ করতাম তখনও পেত, এখনও পায়। কারণ আজন্ম পঞ্চায়েত এলাকায় বসবাস করার কারণে খবরগুলো দেখেই বুঝতে পারি, এগুলোকে যাঁরা প্রকাশযোগ্য খবর বলে চিহ্নিত করেন তাঁদের পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম এবং পঞ্চায়েত ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারণা শূন্যের কাছাকাছি। যতদিন কলকাতার কাগজে কাজ করেছি, বরাবরই খেলার পাতায় কাজ করতাম। ফলে ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। তার উপর সাংবাদিকরা কোনও বিষয়ে জানেন না বা ভুল জানেন, একথা মুখোমুখি বলার মত ভুল জগতে কমই আছে। তার চেয়ে জঙ্গলের মধ্যে বাঘের সামনে পড়ে গিয়ে দাঁত খিঁচানো বুদ্ধিমানের কাজ। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি যত কমই হোক, ওই ভুল বারবার করতে যাওয়ার মতো কম নয়। তাই গোদা বাংলায় যাকে বলে ‘চেপে যাওয়া’, সেটাই করে গেছি। এবারেও তেমনই করতাম, কিন্তু উস্কে দিলেন চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলী। বললেন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে একটা লেখা চাই। বললে বিশ্বাস করবেন না, এড়িয়ে যাওয়ার একটা শেষ চেষ্টাও করেছিলাম। চার নম্বর থেকে যিনি ফোন করেছিলেন তাঁকে সাবধান করে দেওয়ার ঢঙে বলেছিলাম “লেখাটা হার্ডকোর পলিটিক্স হবে না কিন্তু”। তিনি “তা চাইছিও না” বলে বলটা রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ডেড ব্যাটে থামিয়ে দিলেন। তা ভাবলাম চাকরি যাওয়ার ভয় যখন আর নেই, তখন লিখেই ফেলি চেপে রাখা কথাগুলো।

পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন আমার কাছে রীতিমতো ব্যক্তিগত ব্যাপার, ফলে এই লেখাটাও অনেকখানি ব্যক্তিগত হবে। আজকাল তো বলাই হয় “The personal is political”, যা ব্যক্তিগত তা রাজনৈতিকই। এই যে প্রাক-নির্বাচনী হিংসার খবরের প্রাচুর্য সত্ত্বেও কিছু খবর পড়ে আমার হাসি পায়, সে তো পঞ্চায়েত এলাকায় জীবন কাটানো এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকার কারণেই। সে অভিজ্ঞতা ভুলে লিখলে শহুরে সাংবাদিকদের ভুলভুলাইয়াতেই আমাকেও ঘুরে মরতে হবে।

এবার আসল কথা বলি। কোন খবরে আমার হাসি পায়? দেখবেন সব কাগজেই এই মর্মে খবর বেরোয়, যে অমুক বাড়ির দুই জা দুই পার্টির প্রার্থী হয়েছেন। কাগজের তৎপর আলোকচিত্রী বা চ্যানেলের চিত্রগ্রহণকারী দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে (ক্ষেত্রবিশেষে দুজনের হাতে নিজ নিজ দলের পতাকা ধরিয়ে) ছবিও তোলেন। শহরের মানুষ এ ধরনের খবর যত বড় হাঁ করে গেলেন তার মধ্যে দিয়ে ভারতের সমস্ত বিরোধী দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা বিজেপিতে গিয়ে শুদ্ধ হয়ে যেতে পারেন। এই খবরগুলোতে সূক্ষ্ম বা স্থূলভাবে ইঙ্গিত থাকে, যে আসলে দুই দলের তলায় তলায় আঁতাত হয়েছে। একই পরিবারের দুজনের দুই দলের হয়ে ভোটে দাঁড়ানো তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। এ জাতীয় খবর দুই জা, দুই ভাই, কাকা-ভাইপো, মামা-ভাগ্নে— নানারকম সম্পর্কের প্রার্থীদের নিয়েই ছাপা হয়। সাংবাদিকতার ক্লাসে প্রথমেই শেখানো হয়, কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা খবর নয়। মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তবেই খবর। অস্যার্থ, যা ঘটেই থাকে তা খবর নয়। যা সচরাচর ঘটে না তা ঘটলেই খবর। স্রেফ সেই যুক্তিতেই এই খবরগুলোকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়ার কথা। কিন্তু যে সম্পাদকরা হাওড়া ব্রিজের ওপারটা কখনও স্বচক্ষে দেখেননি, তাঁরা ফেলেন না। বছরের পর বছর এইসব খবর দেখে শহুরে পাঠক/দর্শকেরও বিশ্বাস জন্মে যায়, অন্য কিছু নয়, এইটেই দুটো দলের আঁতাতের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

তাঁদের কে বোঝাবে যে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৈরি করার উদ্দেশ্যই ছিল গ্রামের মানুষের শাসনভার তাদের হাতেই তুলে দেওয়া। নিজের বাড়ির সামনের রাস্তাটা খারাপ হলে সেটা সারানোর দায়িত্ব যেন মানুষ নিজেই নিতে পারেন— এমন ব্যবস্থা করাই পঞ্চায়েতি রাজের লক্ষ্য। কীভাবে তা করা যায় তা নিয়ে দুই ভাই, দুই জা, এমনকি বাপ-ছেলেরও মতভেদ থাকতে পারে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিধান হল, ভোটে দাঁড়িয়ে পড়ো। এলাকার লোক যাকে জেতাবে সে ঠিক করবে কীভাবে কী হবে। একই পরিবারের দুজন দুরকম পথ নিচ্ছেন, এটা নীতিহীনতার প্রমাণ হতেও পারে, না-ও হতে পারে। বরং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গণতান্ত্রিকতার নিদর্শন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মত ঘোর রাজনীতি সচেতন সমাজে এমনটা হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

১৯৭৮ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়, তখন আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু সেবার পঞ্চায়েত সমিতিতে সিপিএম প্রার্থী ছিলেন আমার বাবা। যে নিকটতম কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে তিনি নির্বাচিত হন, তিনি আমার বাবারই কাকিমার আপন ভাই। আমাদের নবগ্রাম বস্তুত পূর্ববাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর জঙ্গল সাফ করে গড়ে তোলা বসতি। সে কারণেই নাম— নতুন গ্রাম। আমাদের পরিবার এই লোকালয়ে এসেছে দেশভাগের অনেক পরে, কারণ আমার ঠাকুর্দা রেলের চাকুরে ছিলেন বলে গোটা পরিবার ছিল ভ্রাম্যমান। বাবাদের নয় ভাইবোনের একেকজনের জন্ম ভারতের একেক জায়গায়। তার কোনও কোনও জায়গা দেশভাগের পর আর ভারতে নেই। ঠাকুর্দা যতদিনে অবসর নিলেন ততদিনে তাঁর আদি বাড়ি হয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তান, সেখানে আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তাহলে অত বড় পরিবার নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাবেন কোথায়? যাঁকে আমার বাবা আটাত্তরের ভোটে হারালেন, বস্তুত তাঁদের পরিবারের ভরসাতেই ঠাকুর্দা এসে বাড়ি করেন হুগলি জেলার নবগ্রামে। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন আমাদের বাড়ি তৈরি তদারক করছেন বাবার সেই মামাটি, তখন কি আর জানতেন এ বাড়ির ছোট ছেলে হয়ে যাবে কমিউনিস্ট আর ভোটে দাঁড়াবে তাঁরই বিপরীতে? এসব গল্প হলেও সত্যি এবং শুধু আটাত্তর সালে সত্যি ছিল তা নয়, রাজ্যের যে কোনও পঞ্চায়েত এলাকায় আজও সত্যি। বাবার সেই মামাটি আজীবন কংগ্রেসিই ছিলেন, বাবাও আমৃত্যু সিপিএম। কেউ কারও সঙ্গে কথা বন্ধ করেননি, আবার একে অপরের দলেও যোগ দেননি। দুই পরিবারের আত্মীয়তাও এখনও অটুট। শহুরে সংবাদমাধ্যম আপনাকে বোঝাবে, এটা সেই সাতের দশক থেকেই কংগ্রেসের সিপিএমের বি টিম হওয়ার লক্ষণ। কিন্তু সত্যিটা জানতে হলে আপনাকে গ্রামে যেতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম আবার একরকম নয়। যেমন ধরুন আমাদের নবগ্রামে আজ এসে দাঁড়ালে আপনি বিশ্বাসই করবেন না এটা পঞ্চায়েত এলাকা। কারণ রেলস্টেশনের বাইরে দু পা বাড়াতেই আপনার চোখে পড়বে যানজট, যার মধ্যে আটকে আছে গোটা দুয়েক রীতিমত দামি গাড়ি। তাছাড়া গ্লো সাইন, বাহারি কনফেকশনারি, কাবাবের দোকান, বাতানুকূল কেক-পেস্ট্রির দোকান, অটো, টোটো, সাইকেল রিকশা। এমনকি স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে যত এগোবেন তত চোখে পড়বে ছোটবড় রেস্তোরাঁ, এদিকে ওদিকে সম্পূর্ণ এবং নির্মীয়মাণ বহুতল। একটি বহুতলের দোতলায় সুবিখ্যাত হাবিবসের বিউটি পার্লার। অলিগলি দিয়ে হাঁটলেই দেখা যাবে, শুধু ৫০-৬০ বছরের বাড়ি নয়, ভাঙা পড়ছে মাত্র বছর পনেরো আগে তৈরি হওয়া কারও সাধের বাড়িও। একের পর এক ফ্ল্যাটবাড়ি মাথা তুলছে। শান্ত জনপদ নবগ্রাম, যেখানে বছর দশেক আগেও রাত সাড়ে নটার পর রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত, সেখানে আলো চুঁইয়ে পড়ছে সর্বক্ষণ। ভিটেমাটি খোয়ানো বাঙালদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অবাঙালি মানুষের স্রোত, নয়ের দশকেও যা ছিল একশো শতাংশ হিন্দু এলাকা, সেখানে এখন তবু দু-চারটে মুসলমান পরিবার দেখা যায়। এই গ্রামের সঙ্গে কোনওভাবেই মিলবে না সুন্দরবন এলাকার কোনও গ্রাম অথবা আলিপুরদুয়ারের কোনও গ্রামের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পঞ্চায়েত সদস্যদের কাছে দাবিদাওয়ার তালিকা।

২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আর শোনা যায় না, কিন্তু বামফ্রন্ট আমলের শেষদিকে প্রত্যেক পঞ্চায়েত নির্বাচনেই বাম দলের কর্মীরা প্রচারে বেরোলে ভোটাররা একটি প্রশ্ন অবশ্যই করতেন, “আমরা কবে মিউনিসিপ্যালিটি হব?” তাঁরা প্রতিবারই বলতেন “আগামীবার”। কিন্তু সে আগামীবার এসে পৌঁছবার আগেই বামফ্রন্ট সরকারের পতন হয়। এই প্রশ্ন নিশ্চিতভাবেই পূর্ব মেদিনীপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের ভোটাররা করেন না। এই বৈচিত্র্য বুঝতে পারে এ রাজ্যের কটা সংবাদমাধ্যম? বোঝাতে পারেন কতজন শহুরে মানুষকে? জানি না। মুখরোচক হওয়ায় পঞ্চায়েত বলতেই তুলে ধরা হয় খুনোখুনি আর আঁতাতের গল্প।

প্রকাশ্য বা গোপন আঁতাতের গল্প একেবারেই মিথ্যে নয়। গোটা দেশের রাজনীতি থেকেই নীতি দৌড়ে পালাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সে নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে না। কিন্তু যেসব ঘটনাকে আঁতাতের নিদর্শন বলে তুলে ধরা হয়, সেগুলো দেখে আমাদের মত পঞ্চায়েতবাসীর না হেসে উপায় থাকে না। আরও বেশি হাসি পায়, যখন অন্য দল করে বলে একই পরিবারের দুজন সদস্যের মধ্যে মারামারি, এমনকি খুনোখুনির খবর দেখিয়ে সুটবুট পরা অ্যাঙ্কররা মুখে বেদনা ফুটিয়ে বলেন “কোথায় চলেছি আমরা! সামান্য রাজনীতির জন্যে মানুষ নিজের আত্মীয়কে খুন করবে?” তারপর তুলে আনেন সংসদীয় রাজনীতির সৌজন্যের নানা দৃষ্টান্ত, সবই বিধানসভা বা লোকসভার গল্প। অর্থাৎ তখন আর মনে থাকে না, যে একই পরিবারের দুজন দুই দলের লোক হওয়ার অর্থ অশুভ আঁতাত।

আসলে সেই ১৯৭৮ থেকে এ রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে চললেও গ্রামসভাকে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাঙালি আজও বিধানসভা, লোকসভার সমান বলে ভাবতে শেখেনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে বা টিভি চ্যানেলের আলোচনায় ‘local self-government’ কথাটা শুনতে চমৎকার লাগে। কিন্তু পঞ্চায়েতকে স্থানীয় সরকার বলে ভাবতে গেলেই মনে হয়, গাঁয়ের চাষাভুষো আবার সরকার চালাবে কী? তাই বিভিন্ন জেলার পৌরসভা নির্বাচনে বা কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে গোলাগুলি চললে যা শোনা যায় না, সে কথাই অনায়াসে বলা হয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের বেলায়— “এত খুনোখুনি হলে এরকম নির্বাচনের দরকার কী?” যে এলাকা যত নগরায়িত হচ্ছে, সেই এলাকার মানুষ এই বক্তব্যের সঙ্গে তত একমত হচ্ছেন। আমাদের নবগ্রামেও আজকাল অনেককে এরকম বলতে শোনা যায়। কারণ অধিকার যত সহজে পাওয়া যায়, তত তার গুরুত্ব ভুলে যাওয়াই বোধহয় আমাদের চরিত্র। তাই সেইসব পঞ্চায়েতেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার অধিকার ফেরত পেতে, ভোট দেওয়ার অধিকার ফিরে পেতে রক্তাক্ত লড়াই হয় যেখানে গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতল শাসক দল এবং চক্ষুলজ্জা থাকলে অস্বীকার করা যায় না এমন হিংসার ছবি উঠে এল সমস্ত সংবাদমাধ্যমে। আমি তখনও একটি কাগজের চাকুরে সাংবাদিক। মনে আছে আমার হিন্দি বলয় থেকে আসা সহকর্মীরা কাণ্ড দেখে হাসাহাসি করতেন এবং বলতেন “আপনাদের এখানে সামান্য পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এত মারামারি হয় কেন? আমাদের ওখানে তো এসব হয় না! আমরা তো আগে থেকেই ঠিক করে রাখি কে কী হবে না হবে। পঞ্চায়েতটা এমন কী ব্যাপার যে এর জন্যে এত লড়তে হবে?” সিনিয়র বাঙালি সাংবাদিকরা তাঁদের সঙ্গে একমত হয়ে স্বীকার করতেন যে ব্যাপারটা সত্যিই খুব লজ্জার। কাউকে দেখিনি বুঝিয়ে বলতে, যে আপনাদের ওখানে যেটা হয় সেটা গণতন্ত্র নয়। পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে নামেই, তাই মুখিয়ার ছেলেই মুখিয়া হয়। মতান্তর নেই, মনান্তরও নেই। কারণ পঞ্চায়েতের হাতে তেমন ক্ষমতাই নেই। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত এসেছে ভূমিসংস্কারের হাত ধরে। সে সংস্কার মধ্যচাষি পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে কিনা তা অন্য আলোচনার বিষয়, কিন্তু এ রাজ্যের পঞ্চায়েত সত্যিই গ্রামের চিরকালীন ক্ষমতার কাঠামো ভেঙে দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে হেলাশ্রদ্ধার পাত্রদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই অধিকার ছিনিয়ে নিতে এক দল সদা সচেষ্ট, অন্য দল অধিকার বজায় রাখতে মরিয়া। তাই লড়াই অবশ্যম্ভাবী। আপনাদের শান্তি শ্মশানের শান্তি, ওর চেয়ে অশান্তি ভাল। বোধহয় নিজেরা বোঝেন না বলেই বোঝাতে পারতেন না। এ বছরের নির্বাচনী সাংবাদিকতা দেখে বোধ হচ্ছে, আজও বোঝেন না।

শুরু করেছিলাম আমার জন্মের আগের এক পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘটনা দিয়ে। শেষ করি ১৯৯৮ সালের নির্বাচনের ঘটনা দিয়ে, যা পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পর্কে আমার প্রাচীনতম স্মৃতি।

আমাদের নবগ্রামের পাশের পঞ্চায়েতের নাম কানাইপুর। সেই কানাইপুরের বেশ খানিকটা এলাকা বিড়লাদের হিন্দমোটর কারখানার গায়ে। এখন সে কারখানা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে, কিন্তু তখন রমরমা ছিল। কারখানার সাইরেন শুনে ঘড়ি মেলানো চলত আমাদের এলাকায়। কারখানা সংলগ্ন আলোচ্য এলাকা দুটির নাম আদর্শনগর আর শাস্ত্রীনগর। সেখানকার বাসিন্দা মূলত কারখানার হিন্দি বলয় থেকে আসা শ্রমিকরা। পঞ্চায়েত সমিতিতে ১৯৯৩ সালে তাঁদের ভোটে জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী। তিনি পরিশ্রমী এবং এলাকায় যারপরনাই জনপ্রিয়, অনর্গল হিন্দি বলতে পারতেন। শ্রমিকদের যে-কারও বাড়িতে পাত পেড়ে বসে যেতে পারতেন যে-কোনও সময়। কিন্তু ভোটের কিছুদিন আগে সেই যুবক একটি গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের কাজ করে ফেললেন। ফলে সিপিএম তাঁকে প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত নিল। ওই কেন্দ্রের প্রার্থীর নাম ঘোষণা হওয়ার আগেই ভোটাররা জেনে ফেললেন এই সিদ্ধান্ত, কারণ রুষ্ট পার্টিকর্মী ঘোষণা করে দিলেন তিনি নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াবেন। ভোটাররা কী করলেন? দলে দলে লোক একদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এক-দেড় কিলোমিটার হেঁটে হাজির হলেন স্থানীয় সিপিএমের যে নেতাকে তাঁরা সবচেয়ে বড় নেতা মনে করেন তাঁর বাড়িতে। বক্তব্য এক লাইনের— সেই শৃঙ্খলাভঙ্গকারী পার্টিকর্মীকেই প্রার্থী না করলে “আমরা সিপিএমকে ভোট দেব না।” সিপিএম তাঁদের দাবি মেনে নেয়নি। কিন্তু ওই নির্দল প্রার্থীকে হারাতে প্রার্থী করা হয়েছিল যাঁর কাছে ওই মানুষগুলো ফরিয়াদ নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকেই।

ভোটারদের এইভাবে সরাসরি নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার সুযোগ দেয়, শাসক দলের দলীয় সিদ্ধান্তকেও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেয় যে ব্যবস্থা, তারই নাম পঞ্চায়েত নির্বাচন। আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের স্বাদ দেয় এই নির্বাচন। যদি এই সুযোগ হারিয়ে যায়, সে ক্ষতি অপূরণীয়। লোকসভা, বিধানসভায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. পঞ্চায়েত নির্বাচন: ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক - amarlikhon

আপনার মতামত...