অস্তিত্ববাদ ও ঠাট্টা: মিলান কুন্দেরার সাহিত্যকর্ম

সায়ন্তন দত্ত

 


কুন্দেরার সাহিত্যকর্মকে পাশ্চাত্য দর্শনের যে স্কুলটির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি একাত্ম করে পড়া হয়, আমরা জানি, তা অস্তিত্ববাদ (existentialism)। এই ধরনের যে মুহূর্তগুলির কথা আমরা বলছি, অস্তিত্ববাদের প্রাথমিক কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে তা খুব সহজেই এক করে দেখা যায়। কিন্তু অস্তিত্ববাদী বক্তব্যের সঙ্গে এই ঘটনাগুলির এতটাই মিল— তাই একটু তলিয়ে ভাবতে গেলেই মনে হয় কুন্দেরা কি অস্তিত্ববাদের উদাহরণ দেওয়ার জন্য উপন্যাস লিখেছিলেন!

 

মিলান কুন্দেরা-কে নিয়ে যতরকম আলোচনা-সমালোচনা-র বই লেখা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় কানাডিয়ান লেখক এবং অধ্যাপক ফ্রাঁসোয়া রিকার্ডের Agnes’s Final Afternoon বইটি। কুন্দেরা স্বয়ং যেভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাতটা অধ্যায়ে তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাস বিস্তৃত করতেন, এমনকি গল্প বা প্রবন্ধের বইয়ের ক্ষেত্রেও সাতটি ছোটগল্প বা প্রবন্ধ নিয়ে একটি বই নির্মাণ করেছেন— রিকার্ডও তাঁর এই বইটি কুন্দেরার এই সাতটি অধ্যায়ের কাঠামোয় তৈরি করেন। বইটির নাম কুন্দেরার ইমমর্টালিটি উপন্যাসের একটি চরিত্র আগ্নেসকে নিয়ে— বইটি শুরুও হয় আগ্নেসের জীবনের নির্দিষ্ট একটি ঘটনা দিয়ে। সুইৎজারল্যান্ডের পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে আগ্নেস ফেরার সময় বিকেল থেকে সন্ধে পড়ে আসার সময় হঠাৎ ঠিক করে, গাড়ি থামিয়ে সে কিছুটা পথ একা একা ঘুরবে। এর আগেই লেখক আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, পাহাড়ি রাস্তায় রাত্রিবেলা গাড়ি চালানো খুব একটা নিরাপদ নয়, আগ্নেস নিজেও অন্ধকার নামার আগেই সমতলে, প্যারিসে নিজের বাসস্থানে ফিরে আসার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও, ফ্রাঁসোয়া রিকার্ডের ভাষায় “entirely unmotivated, even illogical” এই ঘটনাটি ঘটতে দেখা যায়— আগ্নেস প্রায় যেন ভূতগ্রস্ত হয়ে পাহাড়ের রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কুন্দেরা লেখেন, “প্রেমাস্পদ যেভাবে মনে থেকে যাওয়া সমস্ত কথা কিছুতেই বলে উঠতে পারে না, সেভাবেই চারপাশের প্রকৃতি যেন আগ্নেসকে চলে যেতে সক্রিয় ভাবে বাধা দেয়।” উপন্যাসটিতে আমরা এরপর দেখব, এই সিদ্ধান্তের ফলেই আগ্নেস শেষমেশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে।

কুন্দেরার উপন্যাস থেকেই আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। The Unberabale Lightness of Being উপন্যাসের শুরুতেই যে যুগলকে আমরা দেখি— টমাস আর টেরেজা— তাদের জীবনের বিশেষ একটি মুহূর্ত। বৈবাহিক জীবনের নানান ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে টমাস আর টেরেজা যখন সোভিয়েত দ্বারা প্রাগ অক্যুপেশনের সময় জুরিখে গিয়ে ঘর বেঁধেছে, ক্রমশ দেশের বাইরে অন্য এক দেশে অচেনা মানুষজনদের মধ্যে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তখনই হঠাৎ একদিন কোনও কথাবার্তা না বলেই টেরেজা জুরিখ ছেড়ে হঠাৎ প্রাগে ফিরে চলে যায়। রোজকারের মতো হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে টমাস (সে পেশায় ডাক্তার) একদিন দেখে, টেরেজা তাদের বাড়িতে আর নেই, শুধু টেরেজার ফিরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে একটা চিঠি পড়ে আছে। প্রথমে প্রচণ্ড ভেঙে পড়লেও টমাস ক্রমশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকে, এমনকি এমনটাও ভেবে নেয়, “তাদের গল্পের এর চেয়ে কোনও সুন্দর পরিসমাপ্তি হয়তো সম্ভবই ছিল না।” অস্তিত্বের ফুরফুরে আলগা মেজাজ— যা নিয়ে এই উপন্যাসটি একদম প্রথম পাতা থেকেই দার্শনিক স্তরে আগ্রহী— টমাস সেই মুহূর্তে যেন সেই আলগা স্তরে— lightness— সেখানে বিচরণ করতে থাকে। কিন্তু টমাসের এই অনুভব দীর্ঘস্থায়ী হয় না— খুব দ্রুত টেরেজার স্মৃতি এসে ভিড় করে তার দৈনন্দিনতাকে অসহনীয় করে তোলে। ঘরের প্রতিটি কোণে, বাড়ির সামনের রাস্তায়, তাদের একসঙ্গে কাটানো জায়গায় তো বটেই— এমনকি টেরেজা চলে যাওয়ার সময় কোথায় বসে চিঠি লিখছিল, সেটাও যেন টমাস স্পষ্ট দেখতে পায়। তার এই বিচ্ছেদযন্ত্রণা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে রোগী দেখার সময়ও টমাস যেন সবার মুখে শুধু টেরেসার মুখই দেখতে থাকে। তার দুদিন আগের অস্তিত্বের lightness-এর সঙ্গে কুন্দেরা এবার এই অসহনীয় ভারকে তুলনা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে টমাসের মনে হয়, “The tons of steel of the Russian tanks were nothing compared with it.”

যথারীতি টমাস আর সামলাতে পারে না, জুরিখ ছেড়ে, তাদের স্বপ্নের জীবন ছেড়ে গাড়ি চালিয়ে প্রাগে সোভিয়েত মিলিটারি অক্যুপেশনের মধ্যেই তাকে ফিরে আসতে হয়। গাড়ি চালাতে চালাতেও টেরেজার দুই বাহুর আলিঙ্গনে থাকার যে স্বপ্ন সে দেখছিল, হঠাৎই, মিলিটারি ট্যাঙ্ক পেরিয়ে প্রাগে তার ফ্ল্যাটের সামনে এসে টমাসের সব কিছু গোলমাল লাগতে শুরু করে। দরজা খুলে টেরেজাকে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনে হয়, তারা যেন বিশাল কোনও পার্বত্য গিরিখাদের পাশে দাঁড়িয়ে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। রাতে বিছানায় শুয়ে টমাস তার এই ফিরে আসাকে খুবই আফসোসের চোখে দেখতে শুরু করে।

 

দুই.

মিলান কুন্দেরার উপন্যাস বা গল্প ঘাঁটলেই উপরের ঘটনাগুলির মতো অজস্র মুহূর্ত দেখতে পাওয়া যাবে। এই ছোট পরিসরে দুটি মুহূর্তের বাইরে খুব বেশি অংশ আমরা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করতে পারব না, তবে এই দুটি মুহূর্ত খানিক বিশদে উল্লেখ করা থেকেই পাঠক আশা করি বুঝতে পারছেন ঠিক কী ধরনের উদাহরণ আমরা আলোচনা করতে চাইছি। প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক— এই হঠাৎ কোনও আনকনভেনশনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া এই চরিত্রগুলোকে কি রোম্যান্টিসাইজ করার উদ্দেশ্যে কুন্দেরা এই উপন্যাস লিখেছেন? মুহূর্তগুলো কি কোনও ধরনের উইশ-ফুলফিলমেন্ট, যেখানে বাস্তবজীবনে ইচ্ছে থাকলেও আমরা হঠাৎ হঠাৎ জীবনের পথে এরকম ঝাঁপ দিতে পারি না, সেখানে সেটা দিলে কী হয়, তাকে যাচাই করার জন্যই কুন্দেরা এরকম মুহূর্ত নির্মাণ করেছেন? এরকম মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ এই পূর্ব-আলোচিত উপন্যাসেরই একজায়গায় কুন্দেরা ফিজিক্স ল্যাবের পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে জীবনের তুলনা করেন— বলা ভাল, কেন সেই তুলনা করা সম্ভব নয় তাই নিয়ে চমৎকার একটি মন্তব্য করেন—

How could he have known? How could he have gauged it? Any schoolboy can do experiments in the physics laboratory to test various scientific hypotheses. But man, because he has only one life to live, cannot conduct experiments to test whether to follow his passion (compassion) or not.

কুন্দেরার সাহিত্যকর্মকে পাশ্চাত্য দর্শনের যে স্কুলটির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি একাত্ম করে পড়া হয়, আমরা জানি, তা অস্তিত্ববাদ (existentialism)। এই ধরনের যে মুহূর্তগুলির কথা আমরা বলছি, অস্তিত্ববাদের প্রাথমিক কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে তা খুব সহজেই এক করে দেখা যায়। জীবনের কোনও মুহূর্তে কার্যকারণ সম্পর্ক বাদ রেখে, কী করলে কী হবে সেই দুশ্চিন্তা বাদ রেখে স্রেফ জীবনের স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে তীব্র আকাঙ্খা, তাকেই অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা, বিশেষ করে জঁ পল সার্ত্র “existence precedes essence”— এই তিন শব্দে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন। ‘এসেন্স’— অর্থাৎ কোনও কিছুর নিহিত অর্থ, সারবস্তু কিংবা গূঢ় অর্থ— এই সবকিছুই যে জীবনের অস্তিত্বের পরে আসে— অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা এই সূত্র থেকেই তাঁদের তত্ত্ব নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের কাছে আগে জীবনের অস্তিত্ব, আগে স্রেফ বেঁচে থাকা— তারপর সেই বেঁচে থাকার অর্থ, বেঁচে থাকার কারণ। ‘কেন বেঁচে আছি’, বা আমাদের বাংলা ভাষার কিংবদন্তি লেখক এই প্রশ্নটি সবচেয়ে আইকনিকভাবে লিখে গেছেন— “এ জীবন লইয়া কী করিব”— এই ধরনের প্রশ্নের সামনে অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা বলবেন, আগে তো এই বেঁচে থাকাটাকে প্রাণভরে গ্রহণ করে নিই, তারপর না হয় তার অর্থ, ‘এসেন্স’ সম্পর্কে ভাবা যাবে। সার্ত্র স্বয়ং একটি অসামান্য উদাহরণ দিয়েছিলেন— একটি কাঁচির যখন জন্ম হয়— তখন শুরু থেকেই তার কাজ (পারপাস) বা অর্থ (এসেন্স) ঠিক হয়ে যায়— সে কাগজ বা কাপড় কাটতেই পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু পৃথিবীর আর সমস্ত জড় বা সজীব বস্তুর মধ্যে মানুষ একমাত্র ব্যতিক্রম— যার জন্মের সময়ে কোনও নির্দিষ্ট কাজ বা অর্থ ঠিক হয়ে যায়নি। অর্থ যদি নির্মাণ করতেই হয়, তাহলে বেঁচে থাকার মাধ্যমেই তা নির্মাণ করতে হবে। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার রেনেসাঁর সময়কার দেকার্তের সেই বিখ্যাত উক্তি, I think, therefore I am— একেই খানিক ঘুরিয়ে বলেছিলেন, I am, therefore I think.

কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম— মিলান কুন্দেরার সাহিত্যকর্মকে কি এই সূত্রে ফেলে দিলেই উত্তর চলে আসবে? বলা বাহুল্য এই প্রশ্নের কোনও সঠিক উত্তর হয় না, আমরা নিজেদের মতো করে কুন্দেরার লেখার সঙ্গে থেকে উত্তরের পথে হাঁটতে পারি মাত্র— এই প্রবন্ধেও সীমিতভাবে যে চেষ্টা করছি। কিন্তু অধিকাংশ অস্তিত্ববাদী তকমা পড়তে পড়তে এই অস্তিত্ব বা ‘being’ নিয়ে যে দার্শনিক জিজ্ঞাসার সামনে আমরা আসতে পারি, কুন্দেরার উপন্যাসের ক্ষেত্রেও কি সেইটা হয়? একাধিকবার কুন্দেরার লেখার সামনে এসে— এই লেখার শুরুতেই যে উদাহরণগুলি দিলাম আমরা— তার সামনে এসেও আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে— কুন্দেরাকে এই শুধুমাত্র অস্তিত্ববাদী তকমায় আটকে ফেলাটা তাঁকে বোধহয় বেশ সীমাবদ্ধ করে ফেলে। তাঁর লেখার মধ্যে এই ‘being’-এর পাশাপাশি যা রয়েছে, তা এক তুরীয় রসবোধ, দুই লাইনের মাঝে লুকিয়ে রাখা তীব্র ঠাট্টা। এই লেখার বাকি অংশে তা নিয়েই আমরা সামান্য কথা বলতে চেষ্টা করব।

 

তিন.

আগ্নেস বা টমাসের যে ঘটনাগুলির কথা আমরা শুরুতেই উল্লেখ করলাম— তার থেকে অস্তিত্ববাদী পাঠ নির্মাণ করাটা খুব সহজ। দুজনেই জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় কার্যকারণ সম্পর্কের অপেক্ষা না করেই ওই মুহূর্তে শুধু জীবনকে, বেঁচে থাকাকে বেছে নিয়েছে। আগ্নেস মৃত্যুর কথা না ভেবেই অচেনা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে চলে গেছে, টমাসও ফিরে এসে কী হবে না ভেবেই সুদূর দেশ পাড়ি দিয়ে প্রাগ শহরে ফিরে এসেছে। অস্তিত্ববাদী বক্তব্যের সঙ্গে এই ঘটনাগুলির এতটাই মিল— তাই একটু তলিয়ে ভাবতে গেলেই মনে হয়, এ কি বড় বেশি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না? এভাবে সরলীকরণ করতে গেলে তো বলে ফেলতে হয়, কুন্দেরা অস্তিত্ববাদের উদাহরণ দেওয়ার জন্য উপন্যাস লিখেছিলেন!

এইখানেই উপন্যাসের ঘটনা ছেড়ে আমাদের তাকাতে হবে লেখার ভাষার দিকে। শব্দের অর্থ ছেড়ে, বা বলা ভাল অতিক্রম করে আমাদের ফিরে আসতে হবে শব্দের ইঙ্গিতের দিকে। এই ঘটনাগুলি তো আমি এইখানে আমার ভাষায় বর্ণণা করেছি— কিন্তু মূল উপন্যাসটি পড়লেই, তার ভাষার ব্যবহারে এবং ইঙ্গিতে[1] যে জিনিস ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে— তা এক ধরনের ঠাট্টা এবং শ্লেষ। আগ্নেস কিংবা টমাস— এই প্রতিটি চরিত্রকেই কুন্দেরা ভাষার মাধ্যমে যেন খানিক দূর থেকে দেখেন— তাদের সঙ্গে পাঠককে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানালেও তাতে মিশে থাকে মৃদু শ্লেষ এবং প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ। লেখক তাঁর চরিত্রদের ভালবাসেন, কিন্তু প্রচ্ছন্ন স্তরে চরিত্রদের নানান কার্যকলাপে যে বিদ্রূপের আভা মিশে থাকে, তা বহু সময়েই খুঁটিয়ে না পড়লে বোঝা যায় না। জুরিখ থেকে প্রাগ শহরে ফিরে আসার পর টমাস প্রায় অকারণেই তার এতদিনকার সম্পর্ককে সন্দেহ করতে শুরু করে— তার হঠাৎ মনে হয় এই সবকিছুই ঘটেছে ‘ঘটনাসূত্রে’, টেরেসার সঙ্গে তার এই গোটা প্রেমের পর্ব যেন পুরোটাই চান্স এনকাউণ্টার। আমাদের মনে রাখতে হবে, যেকোনও মহান ঔপন্যাসিকের মতোই মিলান কুন্দেরার চরিত্ররা ভীরু মানুষ— ভীরু, সন্দিগ্ধ, প্রায়শই লম্পট অথচ প্রেমিক— আমাদের চারপাশে হেঁটে চলা আর পাঁচটা মানুষের মতোই। তিনি আদর্শ চরিত্র নির্মাণ করতে চান না, আদর্শের প্রতি তাঁর কোনও মোহ নেই। আবার বিংশ শতকের অনেক অসামান্য লেখকের মতো তাঁর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র জীবনের অন্ধকার দিকটিই নয়। বরং কান্না আর হাসিতে ভরা জীবন, ভুলে যাওয়া আর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার যে জীবন, ভার হয়ে চেপে বসা আর ফুরফুরে বাতাসের মতো যে জীবন— তাকেই সামান্য দূর থেকে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের দৃষ্টিতে দেখে যাওয়াই কুন্দেরার অভীষ্ট। যে কারণেই বোধহয়, প্রাগ ছেড়ে বহুদিন পর তিনি যখন তাঁর লেখকবন্ধুদের কথা মনে করেন, The Book of Laughter and Forgetting উপন্যাসের এক অংশে— সেই লেখকবন্ধুদের তিনি সাহিত্যের ইতিহাসের বিখ্যাত মানুষদের নামে নাম দিতে থাকেন। সেই লেখকদের অধিকাংশ লেখা তখন কমিউনিস্ট পার্টির সেন্সরশিপে আটকে যাচ্ছে, অধিকাংশেরই বই তখন ব্যান করে দেওয়া হচ্ছে। কুন্দেরা প্রাগ ছেড়ে দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে ফ্রান্সে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে বসে হঠাৎ উপলব্ধি করেন, সকালে যে সুর্য তাঁর ঘুম ভাঙাচ্ছে, সে যেমন পূর্বদিকে, তাঁর ছেড়ে চলে আসা স্বপ্নের প্রাগও সেই পূর্বদিকে। এরপরেই তিনি তাঁর বন্ধুদের নাম দিতে থাকেন— কেউ ভলতেয়ার, কেউ পেত্রার্ক, কেউ বোকাচ্চিও। আমরা বুঝতে পারি, একদিকে যেমন সেন্সরশিপের থেকে বন্ধুদের আড়াল করতে তিনি তাঁদের নাম নিচ্ছেন না, তেমনই অন্যদিকে, এই কিংবদন্তি নামে বন্ধুদের ডাকার ফলে অদ্ভুত এক মিশ্র রস সৃষ্টি হচ্ছে— ভলতেয়ার দুটো চেয়ার-পাশে গম্ভীর হয়ে কথা শুনছেন কিংবা বোকাচ্চিও সেই ঘরে বসেই পাশের লোকটির সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। ভাষার এই ইঙ্গিত, নামকরণের এই ইঙ্গিতের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এই ঠাট্টার সুরটি— এই অদ্ভুত নামকরণ কি এই লেখকদের মহান হিসেবে প্রতিপন্ন করে না বিদ্রূপ করে? কুন্দেরা স্পষ্ট করেন না।

যে কোনও সার্থক শিল্পীর মতোই মিলান কুন্দেরাকেও কোনও নির্দিষ্ট তত্ত্ব বা দার্শনিকবিশ্বের মধ্যে আটকে রাখা যায় না। The Book of Laughter and Forgetting— যে উপন্যাস তার নানা অংশে বিষাদ, বিচ্ছেদ এবং মেলানকোলির তুঙ্গ মুহূর্তে উত্তীর্ণ হয়, সেই উপন্যাসই কেন শেষ হয় এরকম অদ্ভুত ইমেজ দিয়ে— “The man spoke, all the others listened with interest, and their bare genitals stared stupidly and sadly at the yellow sand.”? এ কি শুধু ইউরোপীয়ান সভ্যতা ভিতর থেকে নগ্ন— এরকম সহজ কোনও মন্তব্য? বিংশ শতকের শেষভাগে এসে পিতৃতন্ত্রের শোষণের প্রতি তীব্র শ্লেষ? নাকি সমুদ্রতীরে নগ্নতার অতি সহজ ইমেজ, যা ইউরোপ-আমেরিকার হিসেবে অতি সাধারণ, দৈনন্দিন দৃশ্য? আমরা জানি না— কুন্দেরাও কোনও সহজ ব্যাখ্যায় যেতে চান না। হয়তো গোটা উপন্যাসটির এত গভীরতার দিকে, পাঠকের উপন্যাস শেষ করার সেই আশ্চর্য অনুভবের দিকেই খানিক বিদ্রূপ ভরা হাসি ছুড়ে দিতে চান কুন্দেরা, যা পাঠক কীভাবে হজম করবেন সেটা তাঁদেরকেই ঠিক করে নিতে হবে।


[1] আমি ইংরেজি অনুবাদেই পড়েছি, চেক কিংবা ফরাসি আমার জানা নেই। তবে বিশেষ করে কুন্দেরার ক্ষেত্রে ইংরেজি অনুবাদ খুবই যত্ন সহকারে করা হয়, তিনি স্বয়ং অনুবাদের তদারকি করেন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...