অনুবাদানুবাদ

দত্তাত্রেয় দত্ত

 


গল্প বা প্রবন্ধ অনুবাদ করার ব্যাপারে আমার অনীহার কারণ আমি বুঝি। আদর্শত গদ্যে অনুক্ত কিছু থাকার কথা নয়; কাজেই লড়াই সেখানে শব্দার্থগত, নইলে অন্বয়গত। পাঠের মধ্যে অনুক্ত কিছু থাকলেই গদ্য কাব্যধর্ম অবলম্বন করে ফেলে। কবিতা যেটুকু বলে, তার চাইতে বেশি বোঝায়। সেই তাৎপর্য বা দ্যোতনাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় নিয়ে যাওয়া পরিশ্রমসাধ্য একটা কাজ: সেইখানে একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। কবিতার মিল-ছন্দ-স্তবকছক ইত্যাদিও সেই দ্যোতনারই অঙ্গ

 

কেন করি অনুবাদ? অনুবাদে আমার অধিকার উত্তরাধিকারসূত্রে। বাবা বেশ কিছুকাল কাজ করেছিলেন ‘যুগান্তর’ পত্রিকার অনুবাদ বিভাগে। নিউজ এজেন্সি থেকে যেসব ইংরেজি খবর আসত, আবার বিজ্ঞাপন, নোটিস, ছবির ক্যাপশন, ইত্যাদিও— ওখানে টেবিলে বসে বাংলা করা হত। সেখানে বেশ একটা আড্ডার পরিবেশও ছিল। বাবা সহজ অনুবাদই করতেন, কারণ ইংরেজিতে চোখ রাখলেই বাবার কলম থেকে বাংলা বেরোত। কিন্তু একজনের বঙ্গানুবাদ প্রায়ই খুব চমকপ্রদ হত। যেমন একবার প্রুফ এল: “রেলপথ হইতে মাছের থালা অপহরণ”। চমৎকৃত সঙ্গীরা ফাইল ঘেঁটে ইংরেজিটা বার করলেন: Fishplates stolen from railway tracks। আবার, লরেল-হার্ডির Bonnie Scotland সিনেমা সম্বন্ধে জানা গেল ও-ফিল্মে নাকি “স্কচদেশীয় নলের অপেক্ষা অধিকতর পদাঘাত” আছে। বিপুল ধাঁধাঁয় পড়ে আবার মূল বিজ্ঞাপনে ফিরে গিয়ে আবিষ্কার হল: More Kick than in a Barrel of Scotch! এই ভদ্রলোক ছিলেন পূর্ববঙ্গীয়। একবার এক নোটিস দেখে তিনি হেসেই খুন: “দ্যাহেন দ্যাহেন, পিয়াz-এরে পিয়াz-ই লিখে দিসে!” বাবা সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিটা নিয়ে দেখেন নিলামের একটা টেন্ডার নোটিস: For sale: Ten sacks of peas। ইদানীং অবশ্য গুগুলানুবাদের কল্যাণে এসব ব্যাপার গা-সওয়া হয়ে গেছে।

ফলে কম বয়স থেকেই হাসতে হাসতে অনুবাদকর্ম সম্বন্ধে বিশেষ সমীহ মনে গজাতে পায়নি। আর ইতিমধ্যে স্কুলের পাঠক্রমের শাসনে মেলা ‘বেঙ্গলি টু ইংলিশ’-ও আমাদের করতে হয়েছে— বিখ্যাত সেই রসময় মিত্রের বই থেকে— বিভূতিভূষণের গদ্যের ইংরেজিকরণের সর্বনেশে লড়াই: ‘রাণীর চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, বলিল— তুই যে বলিস নিশ্চিন্দিপুর আমাদের বড় ভাল গাঁ, এমন নদী, এমন মাঠ কোথাও নেই— সে গাঁ ছেড়ে তুই যাবি কী করে?’ সে-লড়াই কি ক্লাস নাইনের ছেলের পোষায়? ইংরেজি-বাংলা-সংস্কৃত এই তিন ভাষার মধ্যেই অনুবাদাবাদি বাধ্যতামূলক ছিল সেকালের ইস্কুলে। ফলে ‘করে দেব translation— কাটলে কাটবে নম্বর— কী আর হবে’— এই বেপরোয়া ভাবটা এখনও মনে রয়ে গেছে। আজও টের পাই, শত বন্ধনের মধ্যেও শিল্পীর এই মুক্তিটা খুব দরকার।

ক্রমে যখন সাহিত্য হিসেবে ইংরেজির সঙ্গে পরিচয় হল, তখন কিছু কবিতা আমার প্রিয়ও হল; কিন্তু সে-সময়ে কবিতা অনুবাদ করার কথা ভাবিনি। ওইসময়েই সুধীন্দ্রনাথের অনুবাদকর্ম দেখে হতবাক্‌ হয়ে বুঝলুম, মূল রচনার রূপকে অবিকৃত রেখে অনুবাদের যে চ্যালেঞ্জ, সেটার মোকাবিলা করা অনুবাদকের অন্যতম দায়। শুধু ভাব নয়— রূপও কবিতা। যুক্তি বলল কবিতার রূপকেই যদি বিগড়ে ফেলি তো সনেটকে গদ্যরূপে অনুবাদ করলেই হয়! তাহলে নোটবইয়ের বাংলাই বা কী অপরাধ করল? তখন ছোটখাটো— যেমন য়েটসের He Reproves the Curlew-এর মতন— কবিতা অনুবাদ করে দেখলুম, বড় জুৎসই হচ্ছে না। খুব ভাল লাগল সীগফ্রীড স্যসূনের The Child at the Window; কিন্তু ‘The world one map of wastening war unrolled’— এ-চিত্রকল্পের দ্যোতনা কিছুতেই বাংলায় আনা গেল না। এম্পসনের ভিলানেল Missing Dates অনুবাদ করতে গিয়ে পরিপূর্ণরূপে পরাস্ত হলুম।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

গল্প বা প্রবন্ধ অনুবাদ করার ব্যাপারে আমার অনীহার কারণ আমি বুঝি। আদর্শত গদ্যে অনুক্ত কিছু থাকার কথা নয়; কাজেই লড়াই সেখানে শব্দার্থগত, নইলে অন্বয়গত। পাঠের মধ্যে অনুক্ত কিছু থাকলেই গদ্য কাব্যধর্ম অবলম্বন করে ফেলে। কবিতা যেটুকু বলে, তার চাইতে বেশি বোঝায়। সেই তাৎপর্য বা দ্যোতনাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় নিয়ে যাওয়া পরিশ্রমসাধ্য একটা কাজ: সেইখানে একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। কবিতার মিল-ছন্দ-স্তবকছক ইত্যাদিও সেই দ্যোতনারই অঙ্গ। কবিরা যে Blank verse কিংবা Terza Rima, Spenserian stanza, কি Free verse, ইত্যাদি রচনারূপ অবলম্বন করেন, সেটা কেন? কবিতার বক্তব্যকে ওইসব রূপের ছাঁচে ঢালাই করে নিশ্চয় তাঁরা বিশিষ্ট কোনও অভিঘাত সৃষ্টি করতে চান পাঠকের মনে। নইলে এসব খাটনির তো কোনও অর্থই নেই— ছড়ার ছন্দে মেঘনাদবধ কাব্য লিখলেই চলে।

আরও একটা কথা থাকে। যে-কোনও বক্তব্যের অনুবাদের সম্ভাবনা অনন্ত: প্রত্যেক শব্দের বহু প্রতিশব্দ আছে এবং তাদের বহু রকমে সাজানো সম্ভব। কিন্তু ছন্দ-মিল-স্তবকের কাঠামো নির্দেশ করে দেয় কোন্‌ কোন্‌ শব্দ এবং তাদের কেমনতরো সজ্জা অনুবাদে প্রবেশাধিকার পাবে। অর্থাৎ এখানে অনুবাদক একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড পান, যার ভিত্তিতে তিনি নিজের কাছে নিজের করা অনুবাদের ন্যায্যতা দেখাতে পারেন; আর শব্দ-বাক্য ইত্যাদিরাও একটা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবেই অনুবাদে প্রবেশাধিকার পায়। বলা যায়, তখন অনূদিত রূপে একধরনের একটা অনিবার্যতা আসে।

 

এতসব ধোঁয়াটে কথাবার্তা না বলে একটা বাস্তব উদাহরণ নিই। রবার্ট ফ্রস্টের এই বিখ্যাত লাইনদুটো:

And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.

এটি শ্রী স্বপন ভট্টাচার্য অনুবাদ করেছেন:

ঘুমিয়ে পড়ার আগে বাকি আছে বহু পথ পেরোবার,
ঘুমিয়ে পড়ার আগে বাকি আছে বহু পথ পেরোবার।

চমৎকার; কিন্তু স্বপনবাবু অবলম্বন করেছেন মাত্রাবৃত্ত, যেটা তিনের ছন্দে চলে। সে-ছন্দের বাঁধন তুলনায় ঢিলেঢালা। আমার অনুবাদে এটি দাঁড়িয়েছিল:

যোজন পেরোতে হবে ঘুমোবার আগে
যোজন পেরোতে হবে ঘুমোবার আগে।

এর কারণ, And miles | to go | before | I sleep— আইয়াম্বিক ছন্দের এ-লাইনের চলনটা দুইয়ের চলন। বাংলা অক্ষরবৃত্ত (4n+2) জোড়-সংখ্যাভিত্তিক ছন্দ বলে তারও চলনও দুইয়ের ছন্দে বাঁধা বলতে হয়। আইয়াম্বিক কথ্যছন্দ, বাংলা অক্ষরবৃত্তও তাই। চারটি আঘাতে (বা মাত্রায়) ইংরেজি পংক্তি সম্পূর্ণ, অনুবাদেও তাই: যোজ ন পে | রোতে হবে | ঘুমো বার | আগে । আমি সেইসব যুক্তিতে চতুর্মাত্রিক অক্ষরবৃত্তে অনুবাদ করেছি; iambic tetrameter-এর মিতভাষণের জোরটা বেশি করে ধরতে চেয়েছি। পুরো কবিতাটির অনুবাদে স্বপনবাবুর সিদ্ধি প্রশ্নাতীত; কিন্তু ধ্বনিপ্রভাবের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় অনুবাদটি কবিতায় বলা ঘোড়াটার চলনের কথা বেশি মনে পড়ায় । আমার মতে সেটা এ-কবিতার ছন্দের একটা নিহিত কাব্যগত প্রভাব— এর চলনটাও এর বক্তব্যের অঙ্গ। মূল কবিতাটা ত্রিমাত্রিক anapaest অথবা dactyl ছন্দে লেখা হলে বোধহয় মাত্রাবৃত্তই চেষ্টা করতুম, অথবা সাত মাত্রার ছন্দ।

এছাড়া শব্দের অনুষঙ্গের প্রসঙ্গ আছে: ‘মাইল’ শব্দটা বাংলায় খুব চালু; কিন্তু ‘যোজন’ শব্দটা বেশি ভারতীয়। ‘মাইল’ বড় বেশি নির্দিষ্ট মাপা পথের প্রভাব সৃষ্টি করে; কিন্তু যোজন আমাদের কাছে একটা অনির্দিষ্ট সুদীর্ঘ পথের পরিমাপ— যেমন বহুবচনে ‘miles’ একটা অনির্দিষ্ট দূরত্ব ইঙ্গিত করে, তেমনই। (বাংলায় ‘মাইলগুলি’ লেখা যেত না নিশ্চয়)। আবার, miles শব্দে দীর্ঘ স্বরটা ‘যোজন’ শব্দের মধ্যেও কিছুটা পাওয়া যাবে। মোটের ওপর, আনুষঙ্গিক অর্থের দিকে এবং পারতপক্ষে ধ্বনিগুণের দিকেও নজর রাখাটা দরকারি বলে আমার মনে হয়।

তবে সব সময়ে বাঙালি অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায় না। রবার্ট গ্রেভসের Ulysses একটি অসাধারণ কবিতা; কিন্তু তাতে উল্লিখিত ইউলিসিস, পেনিলোপি, কির্কে, সাইরেন, স্কুল্লা, কারিবদিস, সিমপ্লিগাদেস, ইত্যাদি গ্রিক পৌরাণিক প্রসঙ্গ কখনওই বাংলায় ধরা যাবে না (Christmas-কে ‘জন্মাষ্টমী’ বানানোটা যেমন বিসদৃশ লাগে, তেমনই)। তবু, শুধুমাত্র লড়াই হিসেবে সে-কবিতার সঙ্গেও লড়া যায়, ওর মেজাজ ও স্তবকছক বাংলায় কতদূর আনা যায়, তারই পরীক্ষা হিসেবে:

His wiles were witty and his fame far known,

Every king’s daughter sought him for her own,

Yet he was nothing to be won or lost.
All lands to him were Ithaca: love-tossed

He loathed the fraud, yet would not bed alone.

কৌশলী, চতুর, তার খ্যাতি ছিল জগতে বিস্তৃত,

সব রাজকন্যা তাকে চিরসঙ্গী করেছে কামনা,

কিন্তু জেতা-হারানোর সামগ্রী তো নয় সে; বস্তুত
সব দেশই তার কাছে ইথাকা। সে কামনামর্দিত

ঘৃণা করত এ-ছলনা, একা তবু শয্যায় যেত না।

আমার মতে, এভাবে line for line অনুবাদ করাটাও মূলের প্রতি বিশ্বস্ততার একটা নিদর্শন। তাছাড়া এইখানে বলি, গ্রেভস্‌ abaab— এই মূল মিলের ছকে কবিতাটি লিখেছিলেন বটে, কিন্তু মাঝেসাজে ছক-ভ্রষ্টও হয়েছেন। অনুবাদে আমি সে-সব ব্যত্যয়গুলোকে অনুসরণ না-করে প্রধান ছকটাকেই আদ্যোপান্ত অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছিলুম। এ-অনুবাদ করার কারণ, আমার মনে হয়েছিল গ্রিক পুরাণ সবাই জানি বা না-জানি, এ-কবিতায় আধারিত মানসিক অবস্থান মোটের ওপর পুরুষজাতিরই একটা সমস্যা।

 

এ-কথা লিখে হঠাৎ টের পেলুম যে নতুন কোনও ভাবনা নয়, যে-সব ভাব আমার মনে ইতিমধ্যেই আছে, সেগুলো ছাড়া অন্য কিছুর অনুবাদ আমার মন টানে না। পেশাদারি অনুবাদ যে অনেকের জীবিকাও বটে, এ-তথ্যটা বহুকাল জানতুম না; Kyklos নামক গ্রিক-ভাষা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা বহুভাষাবিদ্‌ অসিত চক্রবর্তী মশায়ের মুখেই কথাটা প্রথম খুব জোরের সঙ্গে শুনি— অনুবাদ-সংক্রান্ত একটি সভাতেই। অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্যর শেক্সপিয়র-সনেটের অনুবাদ শোনাবার জন্য একদা সে-সভাটি করা হয়েছিল বালিগঞ্জের দিকে কোনও একটি হলে। সেখানে তাঁর মুখে লম্বা ফর্দর মতো সরু সরু পদ্য শুনে তাজ্জব হয়ে আমি প্রশ্ন করি যে এ-লাইনগুলোকে কিছু না হোক খানিকটা চওড়া করে লেখাগুলোকে চোদ্দ লাইনে আঁটানো হল না কেন, আর মূল সনেটের বক্তব্যের মধ্যে এতসব নতুন মশলা মিশল কোত্থেকে? সুধীন্দ্রনাথের কথাও বলেছিলুম। জ্যোতিবাবু উত্তরে বলেছিলেন যে তাঁর ওই ‘অনুবাদ’-গুলো হল শেক্সপিয়র-অবলম্বনে তাঁর নিজস্ব কাব্যিক বিস্তার। কিন্তু ব্যাপারগুলোকে ‘অনুবাদ’ হিসেবেই রটানো হয়েছিল।

সে-কথা যাক, প্রথম যে ইংরেজি কবিতাটা পড়ে আমার মনে হল যে এটা আসলে একটা বাংলা কবিতা— আমায় কেবল ইংরেজি খোলসের ভেতর থেকে মূল বাংলাটা বার করে আনতে হবে, সেটা হল রবার্ট গ্রেভসের Here Live Your Life Out। অনুবাদটা শুনে আমার অধ্যাপক সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ বললেন: এটা তো একেবারেই বাংলা কবিতা মনে হচ্ছে।

সেই প্রেরণা পেয়ে কী কবিতায়, কী নাটকে, আমার আদর্শ হয়ে দাঁড়াল তেমন অনুবাদ, যা অনুবাদ বলে মনে হবে না। সর্বদা সার্থক হওয়া যায় না; হওয়া যায়ওনি: তবে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। সেই সময়েই গ্রেভসের কবিতার প্রতি আমার ঝোঁকটা তৈরি হয়েছিল। বিশ শতকের পুরোধা সাহিত্যিক গ্রেভসকে অনেকে একটু উৎকেন্দ্রিক বলে ভাবেন। কিন্তু তাঁর প্রচুর কবিতা নিতান্ত ব্যক্তিগত উচ্চারণ হলেও তাতে আধারিত বোধ বা অনুভব খুব সর্বজনীন। আমার মনে হয় অনুবাদে এইটে সবচেয়ে বেশি দরকার। মূল কবিতার বোধের কোনও সর্বজনীনতা যদি না-থাকে, তবে তাকে অনুবাদে আনা কঠিনও বটে, পণ্ডশ্রমও বটে। কারণ কবিতার আসল আবেদন তো পাঠকের মাথার ভিতরে যে ‘বোধ’ কাজ করে, তারই কাছে। মূল কবিতা কি আমার উদ্দিষ্ট পাঠকের বোধের জমির কোনও অংশের শরিক? সহজ কথায়: বিদেশি কবিতাটিতে আধারিত বোধ কি আমার বাঙালি বোধে অনুরণন তুলছে? না যদি তোলে, তবে আমি সে-কবিতা বাংলায় অনুবাদ করব কেন?

অবশ্য ‘আমার বাঙালি বোধ’ কথাটা সমস্যাকীর্ণ— অন্তত এই প্রসঙ্গে। আমি বিদেশি সাহিত্য তারিফ করতে পারি মানেই আমার বোধে বিদেশি বোধের অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। সে-প্রেক্ষণেও অবশ্য ‘আমি’ ব্যক্তিটির বোধের একটা সীমানা আছে, যা কবির চাইতে সঙ্কীর্ণ হওয়াই সম্ভব (নাহলে তিনি ‘কবি’ আর আমি ‘অনুবাদক’ হতুম না)। আমার ক্ষুদ্রতর বোধ দিয়ে কবির মহত্তর বোধকে ধরবার চেষ্টাটাই তো পণ্ডশ্রম। তবে জোর পাই রুবাইয়াত-খ্যাত ফিট্‌সজেরাল্ডের এই উক্তিটা মনে করে যে অনুবাদকের জীবনবোধ মূল কবির চাইতে নিম্নমার্গের হলেও তা অনুবাদের মধ্যে অন্তর্লীন থাকতেই হবে; নাহলে অনুবাদ মরে যাবে: খড়ে-ঠাসা সাজানো ঈগলের চাইতে জ্যান্ত চড়ুইপাখি ঢের ভাল। সেই কারণেই ফিট্‌সজেরাল্ডের রুবাইয়াত আক্ষরিক অর্থে আদ্যন্ত ভুলে পরিকীর্ণ হলেও তা কাব্যানুবাদ হিসেবে আজও জীবন্ত, হৃদয়সংবাদী। আমার কিছুটা রক্ত কবিতার রক্তে না মিশলে অনুবাদ হবে না; কারণ আমার পাঠক বাঙালি। তার বাঙালি sensibility বা চেতনার দ্বারে নাড়া দিতে না-পারলে বাংলায় অনুবাদ অর্থহীন।

কিন্তু কতটা রক্ত? রুশীয় উপন্যাসের কনস্ট্যান্স গার্নেট-কৃত ইংরেজি অনুবাদ সম্বন্ধে কালক্রমে নানা অভিযোগ গজিয়েছে: ভিন্ন ভিন্ন লেখকের ভাষাপ্রয়োগের বিভিন্নতা তাঁর অনুবাদে ধরা পড়েনি; অনেক কঠিন পাঠাংশ তিনি তরল করে ফেলেছেন; তিনি বড় বেশি ‘ভিক্টোরীয়’ পাঠকের উপযুক্ত অনুবাদ করেছেন, ইত্যাদি। এসব সত্যি হতে পারে; তবে এর শেষ অভিযোগটা বিচার্য: অনুবাদক কি অনুবাদ করবেন তাঁর যুগের সাধারণ পাঠককুলের উপযুক্ত করে, নাকি মুষ্টিমেয় বিভাষা-বিশেষজ্ঞদের পৃষ্ঠপুষ্ট হওয়ার জন্য? মুষ্টিমেয়রা তো মূল লেখা পড়েই ফেলেছেন। তাহলে অনুবাদের আদৌ কী প্রয়োজন? সমাজে তার উপযোগটা কী? মূল রচনাকে সাধারণ পাঠককুলের হৃদয়সংবাদী করে তোলাও কি অনুবাদকের দায়িত্ব নয়?

এছাড়া নাবোকভের একটা আশ্চর্য আপত্তি আছে: গার্নেট যেহেতু মহিলা, অতএব তাঁর পক্ষে অনুবাদ করা সম্ভব নয়: অন্তত ডস্টয়েভস্কির পুরুষালি ভাষা তাঁর ব্রীড়াময়ী ভাষায় অনুবাদ করা সম্ভব নয়। (বিপরীতে আছে এক অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব: অনুবাদ কাজটাই নাকি ‘রমণী-য়’।) তাছাড়া নারীবাদীদেরও একটা কথা শুনেছি: নারীর রচনা পুরুষের পক্ষে অনুবাদ করা অসম্ভব। কিন্তু কেন? যদি এমন হয় যে নারীরা পুরুষের কথার মর্ম বুঝতে পারেন না, এবং পুরুষরা নারীদের, তাহলে পড়ুয়াদের মধ্যে পুরুষরা নারীদের কাব্যকে জানতে যাবেন কেন, এবং নারীরা পুরুষদের— অনুবাদে কিংবা মূলে? নারীর করা অনুবাদটাই বা পুরুষ পাঠক বুঝবেন কী করে? তাহলে কি দু-পক্ষই কেবল স্বলিঙ্গের কবিতা শুধুমাত্র স্বলিঙ্গের পড়ুয়াদের জন্য অনুবাদ করবেন, এবং বিচ্ছিন্ন দুই পাঠককুল তৈরি হবে, যারা কেউ কারও অনুভব কোনওদিন বুঝতে পারবে না? তেমন হলে একজন ইংরেজের পক্ষেই বা ফরাসি কবিতার মধ্যে প্রবেশ করা সম্ভব হবে কেন— অনুবাদক কিংবা পাঠক যে-চরিত্রে হোক? কারণ অনুবাদক তো গোড়ায় একজন পাঠকই বটেন!

ফলে এই সূত্রে সেই ভাষান্তর আর দেশীয়করণের তফাতের সমস্যাটা ওঠে। আমি একটি সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপটে লেখা রচনাকে ভিন্ন একটি সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপটে অন্তরিত করছি। মূল ভাষায় ব্যবহৃত শব্দরাজির সমান্তর শব্দ নিশানা-ভাষায় থাকতেই পারে। কিন্তু শব্দের দ্যোতনা নির্ভর করে তার অনুষঙ্গের ওপর। শব্দের আভিধানিক অর্থকে ঘিরে থাকে তার আনুষঙ্গিক অর্থ, যা শব্দের সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপটের ওপর নির্ভরশীল। এই কারণে ‘transculturization’ কথাটা ইদানীং চালু হয়েছে। খুব চড়া একটা উদাহরণ নেওয়া যায়: এলিয়টের The Hollow Men-এর শীর্ষোদ্ধৃতিতে কনরাডের Heart of Darkness থেকে উদ্ধৃতি ‘Mistah Kurtz— he dead’ বাংলায় অর্থহীন শোনাবে। অন্যদিকে নিশ্চয় করে বলা যায় যে ‘A penny for the Old Guy’ যদি বিষ্ণু দে-র কলমে ‘বুড়ো মোড়লকে কানাকড়ি’ হয়ে দাঁড়ায়, তবে সে-অনুবাদকে “স্কচদেশীয় নলের অপেক্ষা অধিকতর পদাঘাত” বললে যথোপযুক্ত মন্তব্যই হয়।

কোলরিজ বলেছিলেন কবিতার কাজ হল পাঠকের কল্পনাশক্তি উদ্দীপ্ত করা। পাঠকের কল্পনা বিস্তারলাভ করে কাব্যের জগৎকে নিজেই সৃষ্টি করে নেবে। প্রশ্ন: অনুবাদের ক্ষেত্রে পাঠকের এই কল্পনাশক্তি কোন্‌ পথ বেয়ে বিস্তারলাভ করবে? তার অবলম্বন নিশ্চয় হতে হবে কিছু পরিচিত ধারণা; এমনকি অর্থময় কিছু প্রতিষ্ঠিত অভিব্যক্তিও। সমর সেনের

ওরা কাজ করে
দুমুঠো তোলে ঘরে
তবে দু’বেলা মুখে নয়,
রোজ ভাত ভালো নয়,
ভালো নয় পাঁচশালায় বৃথা অপচয়।

কেটেছে বিশ বছর,
রাত কত হল, এ-প্রশ্নের মেলেনি উত্তর।
অনেকের দেহ মেদোচ্ছল,
অনেকের মনে পড়েছে কড়া
ভারা ভারা ধান কাটা হয়নি সারা।

—এর মধ্যে রাবীন্দ্রিক ভাবনার যে-বিশাল পশ্চাৎপট, যে-যুগবিবর্তন, স্বপ্নভঙ্গ, মূল্যবোধের ক্ষয়, রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাত, প্রভৃতির প্রেক্ষিত নিহিত আছে, তা কোনও বিদেশি অনুবাদে আনা যাবে না: অন্তত বাংলা না-জানা বিদেশি পাঠকের কাছে এমন কবিতার বহুস্তরায়িত জটিল তাৎপর্য পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব বলে মনে হয়। কাজেই অনুবাদের জন্য আমাকে তেমন রচনাই নির্বাচন করতে হবে, যা বাঙালি পাঠকের সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপটের সঙ্গে অন্তত কিছু পরিমাণে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। তবেই অনুবাদ সংযোগসম্ভাবী হবে।

 

প্রসঙ্গটা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে নাটক অনুবাদের ক্ষেত্রে। নাটক লেখা হয় দৃশ্যশ্রব্য উপভোগের জন্য; দর্শকের ‘পড়ে নেওয়ার’ জন্য নয়— নাট্যঘটনার সাক্ষী থাকবার জন্য। কবিতা কি গল্প ঘুরেফিরে ‘পড়ে নেওয়া’ যায়; কিন্তু নাটকের উপভোগ তন্মুহূর্ত ইন্দ্রিয়গত উপভোগ। তার আবেদন তাৎক্ষণিক এবং সে-আবেদন দর্শকের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক চৈতন্যের কাছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল: শেক্সপিয়রের নাটকের বাংলা অনুবাদের উদ্দিষ্ট দর্শক কে? ষোলো-সতেরো শতকের ইংরেজ দর্শক, নাকি বিশ-একুশ শতকের বাঙালি দর্শক? উদ্দিষ্ট দর্শকের একটা নাট্যপ্রত্যাশা আছে, যেটা শেক্সপিয়র নিজের যুগে মিটিয়েছেন। এযুগে আমরা সেটা না-মেটালে যেমন অনুবাদ ব্যর্থ; তেমনই মূল পাঠের প্রতি যথাসাধ্য বিশ্বস্ত না-থাকলেও অনুবাদ জাতিভ্রষ্ট।

এই সমস্যার সূত্রে বরং ইংরেজি ‘ম্যাকবেথ’-এর একটা অংশ একটু দেখি:

If it were done, when it’s done, then it were well
It were done quickly: if th’ assassination
Could trammel up the consequence, and catch,
With his surcease, success; that this blow
Might be the be-all and end-all… here,
But here, upon this bank and shoal of time,
We’ld jump the life to come. But in these cases
We still have judgement here— that we but teach
Bloody instructions, which being taught return
To plague th’inventor: this even-handed justice
Commends th’ingredience of our poisoned chalice
To our own lips.

ঊনিশ-বিশ শতকের সঙ্গমে দাঁড়িয়ে গিরিশচন্দ্র ম্যাকবেথ অনুবাদ করেছিলেন তাঁর যুগের দর্শকের নাট্যপ্রত্যাশা অনুযায়ী: একটু অতিকৃত অভিনয়ের ধাঁচে:

এ কঠিন ব্রত যদি উদযাপনে হ’ত উদ্যাপন
শ্রেয়ঃ তবে শীঘ্র সমাধান;
লব্ধকাম হত্যা যদি বারিতে পারিত পরিণাম,
অস্ত্রাঘাতে ফুরা’ত সকলি,
ভুঞ্জিতে না হ’ত যদি ফল ইহকালে।
সংকীর্ণ এ ভব-কূলে দাঁড়ায়ে নির্ভয়ে,
করিতাম অবহেলা পরলোকে।
কিন্তু এই গুরু-পাপে দণ্ড ইহলোকে!
অন্যে শিখে এ-শোণিত খেলা,
শিক্ষকে দেখায় সেই খেলা প্রাণনাশী।
বিষম অপক্ষপাতী বিধির নিয়ম!
যার বিষপাত্র, আনি ধরে তার মুখে।

সে-যুগে শেক্সপিয়র ছিলেন ‘মহাকবি’। কাজেই মহাকাব্যীয় ধাঁচে তাঁর অনুবাদ কিছু অন্যায় হয়নি। কিন্তু দর্শককুল এ-নাটক নেয়নি, কারণ এর কাব্যগুণ ও আবেগের প্রবাহ বজায় রাখতে গিয়ে গিরিশচন্দ্র সংলাপটার নাট্যগুণ প্রায় অগ্রাহ্যই করে গেছেন; যদিও ওটা আসলে একটা অভ্যন্তরীণ বিতর্ক: দুজন ম্যাকবেথ যুক্তি সাজাচ্ছে— যে-সজ্জা পুরো সংলাপটাকে একটা পূর্ণাঙ্গ নাটকের তুল্য গঠন দেবে। কিন্তু তিনি অন্তত লাইনগুলো ভেঙেছেন অর্থময় এককে, শ্বাস নেওয়ার বিরতি দিয়ে, অর্থাৎ মঞ্চাভিনয়ের উপযুক্ত করে। এর অর্ধশতক পরে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত অনুবাদ করলেন এক ‘পাঠ্য’ ম্যাকবেথ:

করিলেই হোত যদি কর্মের সমাপ্তি
দ্রুত কোরে ফেলা হোত ভাল।
এই হত্যা যদি জাল ফেলে তুলিত পারিত
টানি সর্ব পরিণতি তার নিরাপদ
সাফল্যের তীরে। একটি আঘাতই যদি
হোত শেষ কথা জীবনের ক্ষুদ্র এই বালুর চরায়,
ওপারের অসীমে যা হবার তা হোত।
কিন্তু, এই সব পাপে এপারেও
আছে যে বিচার। রক্তপাত যে শিক্ষা
ছড়ায় চারিদিকে, তা হোতে ত
শিক্ষকেরও পরিত্রাণ নাই।
যে বিষ মিশাই মোরা অপরের তরে
অতি সূক্ষ্ম ন্যায়ের বিচার
সেই বিষ তুলে ধরে মোদের অধরে।

এ-অনুবাদ কাব্যপাঠকের জন্য অনুবাদ। ১৯৫৪ সালের বাঙালি দর্শক এ-সংলাপকে বড়জোর প্রাচীন কবিতার বঙ্গায়ন বলে ভাববে; মঞ্চে শোনার সংলাপ বলে কিছুতেই মানবে না। সাধু ক্রিয়াপদ ও ‘মো্রা’, ‘তরে’ প্রভৃতি শব্দপ্রয়োগ এযুগে অচল; গিরিশচন্দ্রের ‘উদ্যাপন’, ‘শ্রেয়ঃ’, ‘ভুঞ্জিতে’, ‘বারিতে’, ইত্যাদি শব্দ যতীন্দ্রনাথ এড়িয়েছেন; কিন্তু তাঁর ছন্দের গতি অত্যন্ত অসমান। এ-অনুবাদ এক শক্তিমান কবির করা সমকালেই অচল এক কাব্যরূপের স্বীকৃতিটুকু মাত্র পাবে। শেক্সপিয়র এক বিগত যুগের কবি— এমন একটা ধারণা যতীন্দ্রনাথ আমাদের মনে বিঁধিয়ে দিচ্ছেন।

অথচ শেক্সপিয়র লিখেছিলেন মঞ্চের জন্য; ম্যাকবেথ এখনও তাঁর অন্যতম মঞ্চসিদ্ধ নাটক; পাঠ্য কাব্য নয়। তবে আজ আমাদের কানে যা ভারি বা অচলিত শব্দ বলে ঠেকে— assassination, trammel, surcease, ingredience ইত্যাদি— সেসব কথা তাঁর যুগেও সাধারণ্যে খুব চালু ছিল না। তবু তিনি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে গেছেন। কাব্যময় হলেও তাঁর ভাষা ‘কাব্যিক’ ভাষা নয়, আবার বাস্তববাদী আটপৌরে ভাষাও নয়: কাব্য ও নাট্যের এক তুমুল প্রয়াগ। ১৯৭৫ সালে বাংলার মঞ্চসিদ্ধ নাট্যপুরুষ উৎপল দত্ত এ-নাটক বাংলা ভাষায় মঞ্চস্থ করেছিলেন। তার পাঠ একটি বাংলা বইয়ে ‘translation’, ‘ভাষান্তর’, ‘ভাবানুবাদ’, ইত্যাদি রকমারি পরিচয়ে ২০০৬ সালে ছাপা হয়েছে। তাতে এই অংশটা পাই:

কার্যশেষেই যদি হত সব শেষ, তাহলে অতিদ্রুত
কার্যশেষই হত কাম্য।
হত্যার আলিঙ্গনে যদি ফলাফল হত বিলীন,
হত্যার অন্তিমেই যদি অনাগত দিন হত স্তব্ধগতি,
এই ধরাতলে, কালস্রোতের এই ক্ষণিকের উপকূলে
ছুরিকাঘাতই যদি হত পূর্বাপর-বাহিত কোনও চরম রূপরস,
তবে পরকালের আশঙ্কাকে করতাম তুচ্ছ।
কিন্তু ইহলোকেই যে এ-পাপের বিচার নির্ধারিত—
রক্তপাতের প্রতি দৃষ্টান্তের প্রত্যাবর্তন
দুঃসহ স্মৃতির রূপে হত্যাকারীর মনে।
পক্ষপাতহীন সে অন্ধ দেবতা— অপরের তরে প্রস্তুত বিষপাত্র
তুলে ধরে আমাদেরই মুখে।

ভেঙেচুরে বারোটা লাইনে সাজালেও এ এক দুরুচ্চার্য গদ্য বই আর কিছুই নয়। ‘আলিঙ্গন’, ‘বিলীন’, ‘অনাগত দিনের স্তব্ধগতি’, ‘পূর্বাপরবাহিত চরম রূপরস’, ‘দুঃসহ স্মৃতি’, ‘অন্ধ দেবতা’ ইত্যাদি কথার কোনও সমান্তর মূল পাঠে খুঁজে পাওয়া যায় না। Blank Verse-এর কাব্যছন্দ এখানে বেমালুম লোপ পেয়েছে তো বটেই, উপরন্তু এ-ভাষা অভিনয়যোগ্য ভাষাও নয়, সরল গদ্যও নয়— কেবলমাত্র বাক্যের স্বাভাবিক অন্বয় বিগড়ে দিয়ে (‘হতো’ ক্রিয়াপদটাকে ক্লান্তিকরভাবে ক্রমাগত অস্থানে স্থাপন করে) এতে কাব্যমহিমা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। অভিনেয় ভাষা হিসেবে ১৯৭৫ সালে এ-ভাষা একেবারেই অচল। বিশেষত বলতে হয়— ‘…we but teach/ Bloody instructions, which being taught return/ To plague th’inventor’-এর অনুবাদ হিসেবে ‘রক্তপাতের প্রতি দৃষ্টান্তের প্রত্যাবর্তন/ দুঃসহ স্মৃতির রূপে হত্যাকারীর মনে।’— শুধু ভ্রান্ত নয়, একেবারেই উদ্‌ভ্রান্ত ভাষান্তর। এমন অনুবাদে আমাদের মনে এই ধারণা গজায় যে মূল ‘ম্যাকবেথ’ কোনও অভিনেয় পাঠই ছিল না। পূর্বোক্ত তিন অনুবাদকের প্রত্যেকেই এ-ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করে গেছেন যে এলিজাবেথীয় মঞ্চে অভিনেতাদের আপনমনে ভাবুকতা করার কোনও সুযোগ ছিল না। এ-সমস্ত একোক্তি তাঁদের বলতে হত এপ্রন-স্টেজে দাঁড়িয়ে, দ্বিপাক্ষিক যুক্তির মতো, কথ্যভঙ্গিমায়, তিন দিক ঘিরে-থাকা দর্শকদের উদ্দেশে। সেই কারণে এগুলোর দ্বান্দ্বিক চেহারাটা এত স্পষ্ট; সেই কারণে রাজপুত্র হ্যামলেট তার বিখ্যাত একোক্তিতে এপ্রন-স্টেজ ঘিরে দাঁড়িয়ে-থাকা গরিবদের সামনে নিচুতলার মানুষদের দুর্ভোগের কথা বলে। এসব সংলাপের আবেদন দর্শকের আবেগের কাছে ততটা নয়, যতটা যুক্তিবোধের কাছে। কিন্তু খুব গোলমেলে ভাষায় বুদ্ধির কাছে আবেদন রাখা সম্ভব নয়— যথাসাধ্য সরাসরিই রাখতে হয়। আমাদের আক্ষেপ এই যে মঞ্চভাষার জাদুকর উৎপল দত্ত শেক্সপিয়রের সমাজচেতনা নিয়ে যতটা ব্যাপৃত রইলেন, শেক্সপিয়রের মঞ্চচেতনা নিয়ে ততটা সন্ধিৎসু হলেন না। কাজেই এ-সবেরও বছর তিরিশ পরে কাব্য ও কথ্যের সমন্বয় ঘটাবার চেষ্টা করা গেল নতুন এক অনুবাদে:

সমাধা হলেই যদি সমাধান হতো, তবে দ্রুত
সমাধাই ভালো ছিল। এই হত্যা যদি জালে বেঁধে
ফলাফল অনিঃশেষে হাতে তুলে দেয়, যদি তার
মৃত্যু সিদ্ধি আনে, এই একটি আঘাতই
সর্বসত্য, শেষ সত্য হয়, তবে এপারে এখন
কালের এ বালুতটে শীর্ণ জলে পা গেঁথে আমরা
ওপারের কথা ভুলে যাব। … কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তো
এপারেও ধর্ম থাকে। রক্তপাতে এই দীক্ষাদান
শেখানো সম্পূর্ণ হলে ফিরে এসে প্রতিমুখী স্রোতে
রক্তস্রোতে গুরুকে ডোবায়। এক নিরপেক্ষ ধর্ম আমাদের
বিষ-ঢালা পানপাত্র তুলে দেয় আমাদেরই মুখে।

এ-অনুবাদও কালক্রমে অতিক্রান্ত হবে; কিন্তু এখানে শেক্সপিয়রের Blank Verse, দুরূহ শব্দপ্রয়োগ, যুক্তিবিন্যাস, এবং কথ্যভঙ্গিমার সমন্বয়টুকু অন্তত পাওয়া যায়।

এইখানে একটা প্রায়-প্রাসঙ্গিক কথা বলতে হয়। সাহিত্যজীবীদের কৃপায় এ-স্বগতোক্তির সবচাইতে কাব্যময় যে-অংশটার মায়ায় আমরা বহুকাল ধরে পড়ে আছি— here, upon this bank and shoal of time, We’ld jump the life to come— সেটার অর্থ কিন্তু বেবাক ভুল বুঝেই আমরা মোহগ্রস্ত হই। শেক্সপিয়র খামোখা কাব্য করার পাত্র ছিলেন না। এলিজাবেথান ইংরেজিতে bench শব্দটা ‘bank’ বানানে এবং school শব্দটা ‘shoal’ বানানেও লেখা হত। কাজেই মূল অর্থটা ছিল: here, upon this bench and school of time … we but teach Bloody instructions, which being taught return To plague th’inventor: অর্থাৎ কালের এ-পাঠশালের পিঁড়িতে বসে এখন আমরা পরকালের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, ইহকালের ধর্মই গুরুর মেশানো বিষ গুরুকে খাওয়ায়; রক্তপাতের যে-শিক্ষা আমরা দিই, শিক্ষান্তে তা ফিরে এসে শিক্ষকেরই সর্বনাশ করে। সংলাপটা এই রূপে শুনলেই এর স্কুলের অভিজ্ঞতাভিত্তিক চিত্রকল্পটা বক্তব্যের সম্যক্‌ চিত্রণ হয়ে ওঠে (এদেশে গুরুমুখী বিদ্যা ও গুরু-মারা বিদ্যের অনুষঙ্গ মনে আনে)। সেটা কিন্তু গৃহীত পাঠের ‘কালসমুদ্রতটের অগভীর জলের’ কাব্যিক ছবিটার বেলায় ঘটে না, কারণ শিক্ষাদানের সঙ্গে কালসাগরের জলের কোনও সরাসরি যোগ নেই। শেক্সপিয়রের কবিখ্যাতি প্রায়ই আমাদের এ-কথা ভাবতে দেয় না যে মঞ্চায়িত সংলাপের প্রধানতম গুণ হল তার তাৎক্ষণিক সংযোগসাধনের ক্ষমতা: মূল অর্থে ফিরে গিয়ে অনুবাদ করলে গোঁড়া সাহিত্যজীবীরা রাগ করতেন বলে আমি এখানে অর্থময় পাঠে ফিরিনি।

 

এহ বাহ্য। স্যসুনের কবিতার ‘wastening’ এবং ‘unrolled’ শব্দের বিভাব, কিম্বা এম্পসনের ভিলানেলের ‘the waste remains and kills’-এর শেষ শব্দটিতে হননের নৈর্ব্যক্তিকতা যেমন বাংলা অনুবাদে আনা দুঃসাধ্য, তেমনই শেক্সপিয়রেও এমন অংশ পদে পদেই মেলে, বিশেষত কমেডিতে, যা বাংলা অনুবাদে মঞ্চে অর্থহীন শোনাবে। হাসি বড়ই সংস্কৃতিনির্দিষ্ট; এমনকি ইতিহাসনির্দিষ্টও বটে। ট্র্যাজেডিতেও, ম্যাকবেথেরই পোর্টার-দৃশ্যে আমরা শুনি:

Faith, here’s an equivocator, that could swear in both the scales against either scale; who committed treason enough for God’s sake, yet could not equivocate to heaven: O, come in, equivocator.

মূলে এটা ছিল বিশপ গার্নেটকে নিয়ে একটা রগড়— যে-বিশপ Gunpowder Plot-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, ক্যাথলিক ধর্মের নামে প্রোটেস্ট্যান্ট রাজাকে উচ্ছিন্ন করতে গিয়েছিলেন, এবং জেরার মুখে শপথ নিয়ে মিথ্যে কথা বলেছিলেন। ধরা পড়ে গিয়ে তিনি বলেন যে তিনি যা ‘বলেছিলেন’, তা ‘বোঝাননি’, এবং প্রাণরক্ষার খাতিরে মিথ্যে বললে পাপ হয় না। অতএব নাটকে বিশপকে পোর্টারের মানসনরকে আসতে হয়েছে। এই দ্ব্যর্থবাচন ব্যাপারটা এ-নাটকের একটা অন্তর্লীন ভাবসূত্র। এই equivocator–কে বাংলায় কী বলব? গিরিশচন্দ্রের সেই ‘বব্বুলে’, যে ‘খোদার নাম নিয়ে বদিয়াতি’ করেছিল, যতীন্দ্রনাথের ‘আদালতের দু-মুখো সাক্ষী’, নাকি উৎপল দত্তর ‘তর্কবাগীশমশাই’? এরা ঠিক কী নিয়ে equivocate করেছিল? তার কোনও ইতিহাস না-থাকলে বাঙালি দর্শক কী করে এদের সনাক্ত করবে? এসব কষ্টকৃত ভারতীয়করণে নাটকে-দর্শকে যোগাযোগটা ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হয়েছিল বলে আমার বাংলায় এটা হয়েছে:

ওরে! এ যে ‘ইতি গজ’র যুইষ্টির! অ্যাঁ! বলি, ধম্মের দু-পাল্লায় এত ভাঁড়াভাঁড়ি করে, ধম্মটুকু বাঁচিয়ে অধম্ম করে, শেষে সগ্‌গটুকু ভাঁড়িয়ে হল না? এসো বাবা, দুমুখো ধাম্মিক।

এমন অনুবাদের কারণ, প্রথমত যুধিষ্ঠির আমাদের নীতিজগতের এক অতিপরিচিত প্রধান পুরুষ; দ্বিতীয়ত তিনি ধর্মের নামে রাজা দুর্যোধনকে উচ্ছেদ করতে গিয়েছিলেন; তৃতীয়ত তিনি শ্রীকৃষ্ণের এই পরামর্শ মেনে নেন যে প্রাণরক্ষার জন্য মিথ্যে বললে পাপ হয় না; চতুর্থত তিনি বলেছিলেন ‘অশ্বত্থামা ইতি কুঞ্জরঃ’, কিন্তু বুঝিয়েছিলেন ‘অশ্বত্থামা ইতি দ্রৌণী’; আর অন্তিমত, এই মিথ্যাভাষণের জন্য তাঁকে নরকদর্শন করতে হয়েছিল (পোর্টার তার প্রমত্ত কল্পনায় নরকেরই ফটকবরদার)। অর্থাৎ যে-জটিল বহুমুখী পরিস্থিতি ওই equivocator-এর উল্লেখে রূপায়িত হয়েছে, ‘যুধিষ্ঠির’-এ সেইটের বঙ্গায়ন হল; কিন্তু ইংরেজিটা আক্ষরিক অর্থে ‘অনুবাদ’ করা গেল না।

বস্তুত এমন বিদঘুটে সমস্যা প্রায়ই দেখা দেয়। যেমন টুয়েলফথ্‌ নাইটে সার টোবির এই সংলাপটা:

Why dost thou not go to church in a galliard and come home in a coranto? My very walk should be a jig. I would not so much as make water but in a sink-a-pace.

তুমি গ্যালিয়ার্ড নেচে গির্জেয় গিয়ে কর‍্যান্টো নেচে বাড়ি ফেরো না কেন? আমার হাঁটাটাই তো একটা জিগ্‌ নাচ হয়ে যেত! আমি সিঙ্কআপেস ছাড়া পেচ্ছাপ পর্যন্ত করতাম না!

নাটকের সংলাপ হিসেবে এমন অনুবাদ পূর্বোক্ত কারণেই অচল। একটু ভেঙে দেখি: ‘গ্যালিয়ার্ড নেচে গির্জেয় গিয়ে কর‍্যান্টো নেচে বাড়ি ফেরা’— এমন কথা বাঙালি দর্শকের কানে কতটা অর্থময় শোনাবে? তারপরে আছে ‘জিগ্‌’ নাচের কথা। গ্যালিয়ার্ড বেশ বীররসাত্মক নাচ, যাতে প্রচুর লম্ফঝম্প থাকত। কর‍্যান্টোতে দৌড় ও উদ্দীপনা প্রচুর। আর জিগ্‌ নাচে থাকত নানান তালে পায়ের খেলা। অর্থাৎ এক এক মেজাজের নাচের কথা এখানে বলা আছে। একেবারে শেষে আছে sink-a-pace শব্দটা, যেটা আসলে cinquepace নামে পাঁচ-মাত্রার ছন্দের নাচের নামের ওপর একটা উৎকট শ্লেষ বা punning। মূল নামটাকে ভেঙে ‘নর্দমা/urinal থেকে এক-পা তফাতে’ এই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু নাচের নামগুলো মোটেই যথেচ্ছ নয়— প্রত্যেকটা হাস্যোদ্দীপক। সেটা এই অনুবাদ বা বঙ্গায়নে ধরা যাবে:

আরে, তোমার তো ছৌ নাচতে নাচতে গির্জেয় গিয়ে ভাংরা নাচতে নাচতে ঘরে ফেরা উচিত হে! আমি হলে তো সারাটা জীবন কত্থকের তালে তালে ফিরতাম! ঝাঁপতাল ছাড়া নাইতাম না, এক তাল না হলে হাগতাম না!

ছৌ নাচের বীররস ও ভাংরার উদ্দীপনা এখানে রইল— ধার্মিকতার সঙ্গে তাদের বেখাপ্পা উপস্থিতিসুদ্ধু। তালের খেলাও বাদ পড়ল না, আবার পাঁচমাত্রা-ভিত্তিক ঝাঁপতাল (তালাও-এ ঝাঁপ) এবং এক তাল (একতালের ওপর শ্লেষসুদ্ধু) তার scatalogical humour নিয়ে ঠাঁই পেল। সামান্য সংযোজন থাকলেও আমি একে অনুবাদই বলব; অপরে যা বলেন বলুন। আর কিছু না হোক, শেক্সপিয়র মঞ্চে হুল্লুড়ে ফুর্তির যে-মেজাজটা আনতে চেয়েছিলেন, সেটা নিশ্চয় অনূদিত হয়েছে?

 

আরেক প্রশ্ন, গানের অনুবাদ যদি করি তো তাতে কোনটা প্রধান অবলম্বন হবে— কথা, না সুর? রঞ্জন প্রসাদের বাংলায় জনপ্রিয় Jamaica Farewell-এর একটি উপস্থাপনা অন্তর্জালে পাওয়া যায়। সেটি মূল গানের সুরে গাওয়াও যায় ভারি সুন্দর। তার শুরুটা এইরকম—

আহা    পথের প্রান্তে        ওই সুদূর গাঁয়
যেথা    সময় থম্‌কে        থামে বটের ছায়ে
আহা    সন্ধ্যাদীপ জ্বালে     তারার টিপ
কত    ফুলের গন্ধে মোর    মন মাতায়

হায়     কোন্‌ সুদূর         সেই স্বপ্নপুর
মোর    মন যে গায়        ঘরে ফেরার সুর
মোর    পথ চেয়ে          আজও সেই মেয়ে
বুঝি    স্বপ্নজাল            বোনে গান গেয়ে

কিন্তু এ যেন পরের সুরে গাওয়া একটি মন-কাড়া বাংলা গান, যার লিরিকের সঙ্গে মূল গানের লিরিকের কোনও সম্পর্ক নেই, অনুভূতির মাধুর্যটুকু ছাড়া। বরং ওই একই সুরে যদি এমন একটা লিরিক গাওয়া হয়—

যে-পথে রাত ভরা সঙ্গীতে

আর        দিগন্ত জোড়া সূর্যোদয়

যাচ্ছি সেইখানে নৌকা বেয়ে

মোর       যাত্রা থেমে গেল এ-বাংলায়।

 

ছেড়ে       যাচ্ছি হায়, তাই মন দুখায়

কী জানি কবে ফেরা হবে হেথায়

নিয়ে       হৃদয়ে ভার ফিরে দেখি আবার
পিছে       সে-মেয়েকে ফেলে রেখে যাচ্ছি হায়।

—তাহলে মনে হয় শত বঙ্গীকরণ সত্ত্বেও— এমনকি ‘Though I’ve been from Maine to Mexico’ লাইনটাকে ‘গেছি যদিও পুরী থেকে বিন্ধ্যাচল’ বানালেও— ব্যাপারটা গীতি-অনুবাদের কাছাকাছি আসে। প্রশ্নটা হচ্ছে, ভাষান্তরের প্রক্রিয়ায় মূল কথাগুলোকে কতদূর মুচড়ে নেওয়ার স্বাধীনতা অনুবাদকের আছে? বাঙালির কানে গানের মধ্যে ‘শেষে থেমে গেলাম এসে জেমাইকায়’— এমন কথা কেমন লাগে? কজন বাঙালিই বা জেমাইকা দেখেছেন, আর জাহাজে সমুদ্র গেছেনই বা কজন? কিন্তু বঙ্গদেশ নদী-নৌকোর দেশ; পার্বত্য দেশ নয়; আর এখানে সূর্য ঝলসায় সরল দিগন্তে বিস্তৃত সমতল ব্যেপে। আর

যে-পথে রাত ভরা ফুর্তিতে

আর        পাহাড়-চূড়ে সূর্য ঝলসায়

চলেছি জাহাজেতে পাল তুলে

শেষে       থেমে গেলাম এসে জেমাইকায়।

সর্বাঙ্গে অনুবাদের গন্ধ মেখে থাকা এমন গান ঠিক বাংলা গান হিসেবে আমার হার্দ্য লাগে না।

প্রসঙ্গটা আনা আরও এই জন্য যে ছন্দের মতো সুরও অনুবাদকের কাছে একটা বন্ধন, তথা ভাষাপ্রয়োগের একটা নির্দেশিকা হতে পারে বলে আমি মনে করি। কিন্তু তেমন অনুবাদে শুধু কথা ও মিল-ছন্দ নয়, সুরটাও আমার জানা চাই। যেমন, শেক্সপিয়রের নাট্যসঙ্গীতের তৎকালীন সুরগুলো আমাদের সময়ে দুষ্প্রাপ্য ছিল। স্বরলিপি জোগাড় করে তার staff notation সুরে রূপান্তরিত করার পরিশ্রমও সকলে করতেন না। ফলে শেক্সপিয়র-অনুবাদে নাটকের মেজাজের মতোই, গানের মেজাজও অক্ষুণ্ণ থাকত না। যেমন যতীন্দ্রনাথ ওথেলো নাটকে ইয়াগোর গানের অনুবাদ করেছিলেন:

রাজার মতো রাজা ছিল স্টিফেন মহারাজ
পায়জামা সে পরত, মোটে পাঁচসিকে তার দাম।
কার হুকুমে করলি বেটা দেড় টাকার এই কাজ?
তোর মত খলিফায় নাই হ্যায় কুছ কাম।

স্টিফেন রাজা সবাই জানে, সবাই মানে তারে
তার কাছে তুই কোথায় লাগিস ওরে হতচ্ছাড়া?
দেশটা যে উচ্ছন্নে গেল তোদের অহঙ্কারে,
হলই বা তোর ছেঁড়া পিরেন, সেইটে গায়ে চড়া।

মূল পাঠ ছিল:

King   Stephen was a            worthy peer
His     breeches cost    him    but a crown.
He     held them six pence     all too dear
With   that he call’d    the     tailor lown.

He     was a wight      of      high renown.
And    thou art but of          low degree.
’Tis    pride that pulls the     country down
Then  take thine auld          cloak about thee.

এর ভাষাগত ছন্দ এবং গানের মূল সুর ও তাল বজায় রেখে যে অনুবাদ হয়েছিল, সেটা মোটেই আক্ষরিক নয়, কিন্তু মাতালের গান হিসেবে এদেশে হৃদয়সংবাদী হয়েছিল; লোকে খুশি হয়ে শুনত:

ছিল    নবাব এক     তার      পয়সা ঢের
তার    লুঙ্গির দাম     ঠিক      এক মোহর
বলে    চার পয়সা     দাম      বাড়তি এর
ডাক    দর্জিকে        ব্যাটা     কী জোচ্চোর!

দ্যাখ    রাজার মান     মোর     কী খানদান
আর     দর্জি তুই       নে-      হাৎ ওঁচা
দাম     বেড়েই দে-     শের     এমনি হাল
তুই     যা, তোর লুং-   গি       পরব না।

বলা ভাল যে ইংরেজি পাঠের pride/price পাঠান্তরের দ্বিতীয়টিই আমি বেছেছিলুম, কারণ শেক্সপিয়রের যুগেও মূল্যবৃদ্ধি আজকের মতো একটা সাধারণ অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উপরন্তু নবাবের লুঙ্গির দাম চার পয়সা চড়া হওয়ার সঙ্গে তার একটা অর্থগত যোগও আছে।

 

‘অনুবাদ’ বলতে বাংলা লেখার ইংরেজি অনুবাদের কথাও আসে; যদিও সাহেবি অনুভবের দীনতাবশত আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করিই না; আর নিজে বাংলা পড়তে পারি বলে তেমন কাজে আমার আগ্রহও নেই। কিন্তু সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এর কবিতার যেসব ইংরেজি অনুবাদ সুকান্ত চৌধুরী এবং সম্পূর্ণা চ্যাটার্জী করেছেন, তা যে-কোনও বাঙালিরই সমীহ জাগাবে। দুজনেই স্বকীয় বিবেচনা অনুযায়ী প্রচুর স্বাধীনতা নিয়েছেন; এবং তাঁদের সার্বিক সিদ্ধি এইটে প্রমাণ করে যে অনুবাদকের একটা নিজস্ব স্বাধীনতা থাকা দরকার। নইলে— অনুবাদ একটা শিল্প বলেই— কাজটা রসোত্তীর্ণ হয় না। তবে এমন অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখানে বোধহয় সদর্থে ভাষান্তর সম্ভবই নয়। যেমন হুতোমে:

বারোইয়ারি প্রতিমেখানি প্রায় বিশহাত উঁচু— ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডার গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফুল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী মূর্ত্তি— সিঙ্গির গায় রুপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া। ঠাকুরুণের বিবিয়ানা মুখ, রঙ ও গড়ন আসল ইহুদী ও আরমানী কেতা; ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত করে স্তব কচ্চেন। প্রতিমের উপরে ছোট ছোট বিলাতী পরীরা ভেঁপু বাজাচ্ছে— হাতে বাদশাই নিশেন ও মাঝে ঘোড়াসিঙ্গিওয়ালা কুইনের ইউনিফরম ও ক্রেস্ট!

এই যে বর্ণনা, এর বিষয়টা নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পশ্চাৎপটটাই মূল ব্যাপার। ‘বারোইয়ারি’, ‘হাইল্যান্ডার গোরা’, ‘বিবি’, ‘পরী’, ‘নানাবিধ চিড়িয়া’, ‘শোলার ফুল’, ‘ভগবতী’, ‘জগদ্ধাত্রী’, ‘ঠাকুরুণের বিবিয়ানা মুখ’— এসবের এমন কী অনুবাদ হতে পারে, যার সামাজিক ও ইতিহাসগত তাৎপর্য বিদেশির হৃদয়সংবাদী হবে? এ-বর্ণনার বানানে উচ্চারণের বিকৃতি ও কথার ব্যঙ্গাত্মক সুরও এর তাৎপর্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ কোনও অনুবাদে ধরা যাবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। ‘চিরকুমার-সভা’ থেকে এ-নমুনাটাও দেখা যায়:

রসিক || কিন্তু ভাই, শ্রীমতী শৈলবালার উত্তর চাপকান প্রত্যয় করলেই কি ব্যাকরণ রক্ষে হয়?
অক্ষয় || নতুন মুগ্ধবোধে তাই লেখে। আমি লিখে-পড়ে দিতে পারি, চিরকুমার-সভার মুগ্ধদের কাছে শৈল যেমন প্রত্যয় করাবে, তাঁরা তেমনি প্রত্যয় যাবেন। কুমারদের ধাতু আমি জানি কিনা!

প্রসঙ্গত, একটা সঙ্গত বিতর্কের উল্লেখ এইখানে করা যায়: ইংরেজিতে অনূদিত রচনার বাংলা করা হলে সেটাকে সদর্থে ‘অনুবাদ’ বলা যাবে কিনা। সেটা অনুবাদ বটে; কিন্তু বিশ্বস্ত অনুবাদ নিশ্চয় নয়; কারণ ইংরেজি রূপটা মূলের প্রতি কতটা বিশ্বস্ত ছিল, তা জানবার কোনও উপায় আমাদের হাতে নেই। অপরান্তে, প্রাচীন গ্রিক নাটকের ‘বিশ্বস্ত’ অনুবাদ কেমন শোনাতে পারে, তার একটা নমুনা পেশ করেছেন হাউসম্যান: ‘হে সুচর্মপাদুকাবৃত ব্রাজকের শির, তুমি কি অশ্বপৃষ্ঠের নাবিক, নাকি পদদ্বয়ে বৈঠা বেয়ে এলে?’ (বাংলাটা হাউসম্যানের ইংরেজি বার্লেস্ক থেকে বাংলা করা)। এমন কৌতুক না-করেও বলা যায় যে, হোমার যে ভীমযোদ্ধা আইয়াসকে গাধার সঙ্গে তুলনা করে স্তুতি করেছেন, সেটা আক্ষরিক অনুবাদে ইংরেজি বা বাংলা কোনও ভাষাতেই ঠিক মূলের উদ্দিষ্ট আবেগ জাগাতে পারে না। আমরা হোমারের শ্রোতাদের মতো গর্বিত বিস্ময় বোধ করি না; এইটুকু মাত্র টের পাই যে হোমারের আমলে গাধার সঙ্গে তুলনা করাটা কোনও হীনায়ন ছিল না। অর্থাৎ আমাদের মূল্যবোধের জায়গাটা যায় হারিয়ে। ফলে বলতে হয়, অনুবাদের অনুবাদ যদি আমাদের মনে কাব্যরস সঞ্চারিত করতে পারে, তবে সেইটুকু নিয়েই আমাদের খুশি থাকতে হবে; তার অনুবাদ-রস থাকুক বিশেষজ্ঞদের বিচারের আওতায়। ওপরে উদ্ধৃত হুতোমের ওই কথাগুলোর কোনও জার্মান অনুবাদ থেকে যদি কেউ জাপানি অনুবাদ করেন তো সেটা পাঠকের কাছে হুতোমকে কতটুকু পৌঁছে দেবে, সে এমন এক বিচার যার কোনও সুরাহা বোধহয় হয় না।

 

আজকাল একটা নতুন হুজুগ উঠেছে: অনুবাদক কোনওমতেই অনুবাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করবেন না— নাহলেই মূলের তাৎপর্য নাকি বিগড়ে যাবে। অর্থাৎ মূল পাঠটিকে অনুবাদক যেমন বুঝছেন, তেমনভাবে অনুবাদ করার স্বাধীনতা তাঁর নেই। এ একটা অদ্ভুত প্রস্তাব, যার অর্থ হল: একটি রচনার একটিই মাত্র অনুবাদ থাকা সম্ভব; দুজনের হাতে দুটি অনুবাদে তিলমাত্র পার্থক্য থাকলেই ধরতে হবে অনুবাদকরা তাঁদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে অনুপ্রবেশ করছেন। অথচ ‘পোয়েটিক্স’ বইটা বাইওয়াটার, বুচার, ফাইফ, পটস্‌, কুপার, হোয়্যালি, কাসেল, ন্যাগি, প্রমুখ অগণ্য অনুবাদকের অনুবাদে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কোনটি সেই সঠিক অনুবাদ, এবং কেন? এর সমান্তর আর একটা দাবিতেও আমরা ভুগি: প্রত্যেক প্রকাশকের পেটোয়া কিছু বানান থাকবে; আর সেই সব বানান— ভুল-ঠিক নির্বিশেষে— লেখককে মানতেই হবে। এবং এ-সব বানানে প্রকাশকে-প্রকাশকে পার্থক্যও থাকবে আর লেখককে সেই অনুযায়ী নিজের লেখার বানান পাল্টে পাল্টে চলতে হবে। এর মূল ধারণাটা এই যে লেখক হলেন প্রকাশকের আপিসের বেয়ারা: যখন যে-মালিকের দোরের পাশের টুলে বসবেন, তখন সেই মালিকের উর্দি তাঁকে পরতে হবে।

এ-সবের কারণ বাজার। অনুবাদ-সাহিত্য নিয়ে বইয়ের একটা ব্যবসা আছে; এবং সে-ব্যবসাতে যত বেশি অনুবাদক মজুর হিসেবে ঢোকেন, ব্যবসায়ীরা ততই সস্তায় অনুবাদকর্ম হাতে পান। কিন্তু একই বইয়ের একাধিক অনুবাদ ছাপিয়ে তেমন মুনাফা হয় না তো— সাধারণ পাঠক যে-কোনও একটা অনুবাদ পড়েই ক্ষান্ত হন। কাজেই যাহোক একটা সস্তা শব্দান্তরে বাজার ভরে দিলেই ব্যবসাদারের প্রয়োজন মেটে। তবে সেই সূত্রে তত্ত্বগতভাবে একাধিক অনুবাদের সম্ভাবনাটাকে লোপ পাইয়ে দেওয়ার উদ্যোগও নিতে হয়। সেই প্রক্রিয়াটা চালু করবার জন্য এদান্তি ম্যালা Translation Theories-ও তৈরি হচ্ছে (যেগুলো জেনে অনুবাদকর্মে কারও কোনও সুবিধে হয়েছে বলে এখনও শুনিনি)। এর আসল ধান্ধাটা হল করণিক দিয়ে শিল্পীর কাজ করিয়ে নেওয়ার। অর্থাৎ অনুবাদে বিচার-বুদ্ধি-সংবেদনশীলতার কোনও প্রয়োজন নেই; গুগুল স্যার যা-যা বলবেন, সেগুলো টুকে-সেঁটে দিলেই দায় শেষ।

এই প্রক্রিয়ার ফসল সম্বন্ধে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ-বিষয়ক ক্লাসে একদা একটি পোলিশ ছাত্রী এসে হাজির: সে নাকি পোলিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করবে! বিস্মিত একটু হয়েছিলুম, কারণ নিষ্প্রাণ মুখ ও নির্বোধ দৃষ্টির ওইরকম সমাহার আমি ইতিপূর্বে কখনও দেখিনি। সে যাহোক, ক্লাসে আমি কাজ করাতুম; সে তাকিয়ে থাকত। কোর্সের একেবারে শেষে আমি একটা হোমটাস্ক দিয়েছিলুম— কবিতা থেকে কবিতায় অনুবাদ— সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রস্তাব’ কবিতাটা। কেউ পারবে বলে আশা করিনি; বেশি কেউ চেষ্টাও করেনি। পরের সপ্তাহে আমি অনুবাদের পুরো প্রক্রিয়াটা ছাপিয়ে নিয়ে গিয়ে দেখাই যে কীভাবে তিন ধাপে গোড়ায় বাক্যানুবাদ, তারপরে আনুষঙ্গিক রদবদল, ও শেষে মিল-ছন্দে বাঁধার কাজ করা হয়েছে। তার অন্তিম রূপটা ছিল এইরকম:

A PROPOSAL

Master, if you say, there’s a king to be fought
We won’t demur, but hone our arrow-tips;
Poor jobless we, for death we care nought
If the body fails— there is your flailing whip.

Homeless we— ever sheltered by the sky,
O Lord, you taught us life’s but a dream
We all are initiates in a fasting rite.
Greedless, we stack your garner to the brim.

O Merchant, the army, police— yours all
Be gracious, preach the cant of piousness
And after that — Lord, let your mercy fall:
Put shackles on the voice of the populace!

We had no arms— so hummed a tune till now.
As boys we used to play at Indian Braves
If the enemy jumps us with a canon-shot
We’ll shout: ‘Boys, civilization must be saved!’

And turn our ears to a cuckoo’s song.

বলেই দিয়েছিলুম যে এটা কোনও আদর্শ অনুবাদ নয়; পদ্ধতি বোঝাবার নমুনা মাত্র। কিন্তু সেই বিদেশিনী বললে: ‘এটা তো ঠিক হয়নি।’ ঠিক যে তখনও হয়নি, সে-কথা আমিও জানতুম; কিন্তু বিদেশিনী বলল ওই প্রথম খসড়ার গদ্য-বাক্যানুবাদটাই যথার্থ অনুবাদ হয়েছে; পরের দুটো বিকৃতি। তাহলে মূল কবিতার ছন্দ-মিল এগুলো কীভাবে অনুবাদে আনা হবে, এ-কথা শুধোতে সে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। রবীন্দ্রনাথের পোলিশ পরিণতির কথা ভেবে মনে বেশ একটু কষ্ট পেয়েছিলুম। তবে নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. পড়ে ফেললাম। লেখকের এই দৃষ্টিভঙ্গিটা জানা। বহু জায়গায় সহমত, হয়তো বা সবক্ষেত্রে নয়, কিন্তু অনমনীয় বৌদ্ধিক ঋজুতায় অবিচল থেকে প্রবন্ধ লেখা বাংলায় যখন ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে, তখন এ লেখাটি একটি বাতিস্তম্ভের মতো।

আপনার মতামত...