অনুবাদে সমৃদ্ধি ও ক্ষতিসাধন

অভিজিৎ মুখার্জি

 


অনুবাদক যখন মূল টেক্সটটিকে অনুধাবন করছেন, সেই ‘আভ্যন্তরীণ’ প্রক্রিয়াটির সময় একবার ‘test of foreign’-এর অবকাশ থাকছে, আবার যখন তিনি নিজের ভাষায় কথা বলা পাঠকবর্গের কাছে অনূদিত টেক্সটটি পেশ করছেন, তখন সেই ‘বাহ্যিক’ প্রক্রিয়ার সময়ও একবার অনুবাদককে বিবেচনা করতে হচ্ছে পাঠকবর্গ এই ‘test of foreign’-এর জন্য কতখানি প্রস্তুত। এবার যদি প্রক্রিয়াটি এমন হয় যে রুশ কিংবা জাপানি কিংবা স্প্যানিশ ভাষা থেকে এক ইংরেজিভাষী ব্যক্তি ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন, তারপর আবার সেই অনূদিত বয়ানটিকে কেউ বাংলায় অনুবাদ করছেন, তবে কতবার মূল টেক্সটটির অঙ্গহানি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়?

 

বোর্হেস আমার খুব প্রিয় লেখকদের একজন। প্রাচ্যের সভ্যতার সঙ্গে তাঁর যোগের প্রসঙ্গ উঠলে, আসবে দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের নাম। নানা সূত্রে উনি সরাসরি জানিয়েছেন শোপেনহাওয়ারের দর্শনে ওঁর আস্থার কথা, ওঁর লেখাতেও তার নিদর্শন আছে। ওদিকে শোপেনহাওয়ারের দর্শনে ভারতীয় উপনিষদের প্রভাব খুব সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। এর বাইরে কিন্তু প্রাচ্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলাদা করে আলোচনা বোর্হেসের লেখায় আমার চোখে পড়েনি। এর তাৎপর্য আমরা আলোচনায় আনব অনুবাদ প্রসঙ্গে বোর্হেসের একটি নির্দিষ্ট অবস্থান প্রসঙ্গে।

ইংরেজি তর্জমায় Two Ways to Translate[1] নামের একটি প্রবন্ধে, কোনওরকম আপসের সুযোগ না রেখে বোর্হেস লিখেছিলেন,

Universally, I suppose there are two types of translations: one is the practice of literality, the other, paraphrase. The former corresponds to the Romantic mentality, the second to the classical…. Romantics never seek the work of art, but rather the man himself…. That reverence for the I, for the irreplaceable human difference that is any I, justifies literal translation. Besides, the faraway, the foreign, is always beautiful…. The announced purpose of truth makes the translator a charlatan, since to maintain the strangeness of what he’s translating, he finds himself obliged to thicken the local color…

[জগৎ জুড়েই, দু-রকম অনুবাদের চল আছে বলে আমার ধারণা: একটি হচ্ছে আক্ষরিকতা বজায় রেখে, আর অন্যটি ভাবানুবাদের স্বাধীনতা নিয়ে। প্রথমটি করা হয় রোম্যান্টিক মানসিকতার সূত্রে, আর দ্বিতীয়টি ধ্রুপদী… রোম্যান্টিকরা শৈল্পিক দিকটি নিয়ে উদাসীন, বরং স্বয়ং স্রষ্টাই তাঁদের কাছে মূল আকর্ষণ… স্রষ্টার ‘আমি’টিকে গুরুত্ব দেওয়া, ‘আমি’-র মধ্যে যে নির্বিকল্প মানুষী স্বাতন্ত্র, এগুলোই আক্ষরিক অনুবাদের যাথার্থ্য। এছাড়াও, যা কিছু সুদূরের, পরিচিতির গণ্ডির বাইরের, তা সর্বদাই মনোহরণ… সত্যে অবিচল থাকার ঘোষণাই অনুবাদককে দিয়ে তঞ্চকতা করায়, কারণ, যা সে অনুবাদ করছে, তার বিস্ময়করতা বজায় রাখতে গিয়ে অনুবাদকের দায় জন্মায় জিনিসটার স্থানিকতাকে গাঢ়তর করে তোলার…]

বোর্হেস

এ-ব্যাপারে, ফরাসি কবি র‍্যাঁবো-র রচনাসমগ্রের প্রখ্যাত অনুবাদক Wyatt Mason, রচনাসমগ্রের ভূমিকায়[2] লিখছেন:

কুন্দেরা, নবোকভ, এঁরা আক্ষরিক অনুবাদের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। এঁদের তাত্ত্বিক অবস্থানের ভিত্তিতে রয়েছে এরকম একটি ধারণা যে বিভিন্ন ভাষাতে, একই কথার খুব কাছাকাছি, সঠিক তুল্যমূল্য কিছু থাকে। অনুবাদকের কাজ হচ্ছে, মূল লেখকের অভিব্যক্তির যে ধারা, যথাসম্ভব তার নিকটবর্তী একটি ধারায় স্থিত থেকে, সেটিকে খুঁজে বের করা। এবং অবশ্যই অজ্ঞতাপূর্ণ বিশ্বস্ততার ফলে উদ্ভূত হাস্যকর ভুলভ্রান্তি এড়াতে সমর্থ হওয়া।

[…]

আক্ষরিকতা-পন্থীরা বলছেন যে অনুবাদকদের প্রবণতাই হয় মূল টেক্সটটা থেকে সরে এসে, লেখককে তাঁর মর্যাদা না দিয়ে বরং নিজেদের নানা আবিষ্কারকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এটা তারা করে মুখ্যত যাতে কোনও কিছুকেই উদ্ভট বলে মনে না হয়, অথচ অত্যন্ত সনিষ্ঠভাবে বিশ্বস্ত থাকতে গেলে উদ্ভটত্বের সৃষ্টি হতেই পারে, আর সেই উদ্ভটত্বের দরুন সমালোচকরা অবধারিতভাবে ধরেই নেয় যে অনুবাদটি নিচুমানের…

আক্ষরিকতা-পন্থীদের আদর্শ অনুসারে অনুবাদ সুখশ্রাব্যতার বদলে গুরুত্ব দেবে অন্তর্নিহিত অর্থটিতে, নিজেই নিজেকে শিল্পকৃতি বলে প্রতিষ্ঠা দিতে চায় এমন কিছু তৈরি না করে, বরং যা প্রকৃতপক্ষে লেখা হয়েছে সেটিকে পেশ করে একটি শিল্পকৃতির সেবায় নিযুক্ত হবে। মূল লেখাটি কী কী আভাস, ইঙ্গিত বা অনুভূতি বহন করছে বলে অনুবাদক মনে করছেন, সেসব পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দরকার নেই।

Wyatt Mason এর ঠিক পরের লাইনেই উল্লেখ করছেন যে বোর্হেস, এই বিতর্কে আরেকজন হেভিওয়েট, অবশ্য এর বিপরীত মত পোষণ করেন।

Mason যে দিকগুলোর কথা উল্লেখ করলেন, সেগুলোর সমর্থন আমরা পাচ্ছি, অনুবাদ প্রসঙ্গে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের কথায়[3]

প্রথমত, সেক্ষেত্রে, অনুবাদককে মূল টেক্সটটির কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে … অনুবাদ হচ্ছে মূল টেক্সটের নিবিষ্টতম এবং ঘনিষ্ঠতম পাঠ। অনুবাদক যদি ঘনিষ্ঠ পাঠক হয়ে ওঠার অধিকার অর্জন না করেন, তিনি টেক্সটটার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারবেন না, টেক্সটটার যে বিশেষ আবেদন, সেটাতে সাড়া দিয়ে উঠতে পারবেন না…

…এভাবে টেক্সটের কাছে আত্মসমর্পণের অর্থ হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, আক্ষরিকতা বজায় রাখা।

 

দেখা যাচ্ছে, বোর্হেস ব্যতিক্রম হলেও অনুবাদ বিষয়ে যাঁদের মত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, তাঁরা প্রায় সকলেই আক্ষরিক (মূলানুগ) অনুবাদের পক্ষেই জোরালো সওয়াল করছেন। তবে এই অবস্থানের ভিত্তি কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। কেন আক্ষরিক অনুবাদের কোনও বিকল্প হতে পারে না, তার অত্যন্ত স্পষ্ট ও দূরদর্শী যুক্তির অবতারণা কিন্তু করলেন ফরাসি তাত্ত্বিক Paul Ricoeur (উচ্চারণ সম্ভবত পল রিকার)। অনুবাদ-তত্ত্বের এই বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত, অনেক বিস্তৃত পরিসরে আক্ষরিক অনুবাদ কীভাবে তার উপযোগিতাকে ব্যাপ্ত করতে পারে, তার ব্যাখ্যা দিলেন।

অনুবাদ বিষয়ে Paul Ricoeur-এর বইয়ের ইংরিজি তর্জমা ‘On Translation’ বইটির ভূমিকায় Ricoeur’s philosophy of translation শিরোনাম দিয়ে Richard Kearney লিখলেন[4]:

ভাষা ব্যাপারটা যদিও একটাই ব্যাপার, ভাষার সংখ্যা কিন্তু বহু। এই বৈশিষ্টের কারণেই একেবারে আদিকাল থেকে অনুবাদ জিনিসটার প্রয়োজন পড়েছে। সব ভাষার মধ্যেই যেটা পাওয়া যায়, সেটা হল, একজন কথা বলা মানুষ আর উদ্দিষ্ট অর্থের (প্রকৃত ও সম্ভাব্য) একটা পুরো জগতের মধ্যে মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা। কিন্তু যদি এমন হতে হয় যে এই মধ্যস্থতার মাধ্যমেই ভাষা একতা আনে, তাহলে এই যে এতগুলো ভাষা রয়েছে, জীবিত ও মৃত, এর অর্থই হল যে আমাদের দুবার করে অনুবাদ করতে হয়, একবার আভ্যন্তরীণ, আর, একবার বাহ্যিক।

[…]

Ricoeur-এর বক্তব্য হল যে ভাল অনুবাদের জন্য প্রয়োজন, ভিন্নতাকেও খানিকটা স্থান করে দেওয়া। উনি পরামর্শই দিচ্ছেন, আমরা যেন নিজেদের ভাষার স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকি— যে দাবি একেকসময় চরম পর্যায়ে পৌঁছে জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে এবং উন্নাসিকতায় উপনীত হয়— যাতে পরিচিতির গণ্ডির বাইরের জিনিসকেও আমন্ত্রণ জানাতে পারি।

অনুবাদ জিনিসটার সুদূরপ্রসারী সাফল্য যদি হয় একধরনের বিশ্বজনীনতা[5], তবে সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে গিয়ে অনুবাদকের উৎকন্ঠা সম্বন্ধে Ricoeur বলছেন,

পাঠকের তরফ থেকে যেসব প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়, সেও কম নয়। স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভাণ, কিংবা যা কিছু পরিচিত গণ্ডির বাইরের তাকে কোনওভাবেই মধ্যস্থতা করতে না দেওয়া, এই সবই চুপিসারে অজস্র ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতাকে পুষ্টি জুগিয়ে এসেছে, এবং যেটা আরও উদ্বেগের, সেইসব সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকেও, যেগুলো আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ‘অ্যান্টিকুইটি’-র শেষ পর্যায়টা থেকে মধ্যযুগের অন্ত পর্যন্ত এবং এমনকি রেনেসাঁর পরেও, লাতিনের ক্ষেত্রে, ধ্রুপদী যুগে ফরাসি ভাষার ক্ষেত্রে, এবং আজকের যুগে ইংরেজির ক্ষেত্রে। যে ভাষাতে অনূদিত হচ্ছে, পরিচিত গণ্ডির বাইরের কিছুর মুখোমুখি ফেলে তাকে পরীক্ষায় ফেলার প্রতি যে একধরনের চতুর অনীহা, সেটাকে বোঝাতেই আমি মনোবৈজ্ঞানিক পরিভাষার ‘প্রতিরোধ’ কথাটা ব্যবহার করছি।

 

বোর্হেসের তরফে মুখ্যত ইউরোপ তথা পশ্চিমকেন্দ্রিকতার যে একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়, সেটার ইঙ্গিত দিতেই আমি এই লেখাটা ওভাবে শুরু করেছি। প্রাচ্যের সাহিত্য নিয়ে সুনির্দিষ্টরকম উৎসাহ থাকলে, ‘যা কিছু পরিচিত গণ্ডি’র বাইরের, তার মুখে পড়ে অনুবাদের ভাষা হিসেবে পশ্চিমি ভাষার যে ‘প্রতিরোধ’, সেটা সম্বন্ধে বেশ খানিকটা সজাগ উনি হতেনই, অনুবাদগুলো দেখলে। এই প্রতিরোধ, পশ্চিমি সমাজে অধিকাংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের এবং নিজেদের চেতনার স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিভ্রমের কারণেই। আক্ষরিকতার দায়কে বর্জন করলেই আর এই প্রবণতাগুলোর দিকে তেমনভাবে দৃষ্টি যায় না। সেই খামতিটুকুর কারণেই হয়তো আক্ষরিক অনুবাদের বিরুদ্ধে বোর্হেসের এহেন আপসহীন উচ্চারণ!

এই যে, যা কিছুর সঙ্গে আমি বা আমরা সাংস্কৃতিকভাবে পরিচিত, তার বাইরের কিছু হলেই সেটাকে আমার নিজের ভাষায় অনুবাদের সময় গ্রহণ না করে উপেক্ষা করার প্রবণতা, বর্তমানেও নানা অন্যান্য ভাষার থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় যা প্রায়শই লক্ষ করা যায়, এটাকেই বলা হচ্ছে ‘প্রতিরোধ’। আর, প্রতিরোধ না করে একে গ্রহণ করার ক্ষমতা বা মানসিকতা যাচাই করাকে বলা হচ্ছে, ‘the test of foreign’। এবং এই পরীক্ষারও দুটো ধাপ, অনুবাদকের ক্ষেত্রে ‘আভ্যন্তরীণ’, তারপর পাঠকের পক্ষপাতকে বিবেচনা করলে ‘বাহ্যিক’।

Ricoeur

Ricoeur আমাদের আশ্বাস দিয়ে বলছেন যে ‘ভিনদেশি’ মানে কিন্তু কখনওই ‘আজব’ নয়। বলা হচ্ছে যে অনুবাদকদের দায়িত্ব হল পাঠককে এই ‘ভিনদেশি’-র সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে, এবং সেটির ব্যাপারে অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা। এ-ব্যাপারে সাফল্য পাওয়া গেলে কী ঘটবে, সেটা ভারি সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন উনি:

বিশ্বজনীনতা[6] পুনরায় অর্জন করতে পারলে, সেটা তখন চেষ্টা করবে ‘ভিনদেশি’ বলে চিহ্নিত করার অভ্যাসের যে স্মৃতি, তার অবলুপ্তি ঘটানোর, তারসঙ্গে সম্ভবত, নিজের ভাষার ব্যবহারের যেদিকগুলো গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট, সেগুলোর প্রতি বিরাগ তৈরি হয়ে নিজের ভাষার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসারও অবলুপ্তি ঘটাবে। সেই একই বিশ্বজনীনতা, তার এতদিনের একপেশে ইতিহাসকে মুছে ফেলে, যা কিছু এতদিন ‘ভিনদেশি’ বলে চিহ্নিত হত, সেগুলোকে ভাষাগত রাষ্ট্রপরিচয় থেকে মুক্ত নাগরিকে রূপান্তরীত করবে, স্বদেশচ্যুত, কিন্তু কোনও গ্রহীতা ভাষার কাছে আশ্রয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে না। এককথায় ভবঘুরে যাযাবর।”

 

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে অনুবাদক যখন মূল টেক্সটটিকে অনুধাবন করছেন, সেই ‘আভ্যন্তরীণ’ প্রক্রিয়াটির সময় একবার ‘test of foreign’-এর অবকাশ থাকছে, আবার যখন তিনি নিজের ভাষায় কথা বলা পাঠকবর্গের কাছে অনূদিত টেক্সটটি পেশ করছেন, তখন সেই ‘বাহ্যিক’ প্রক্রিয়ার সময়ও একবার অনুবাদককে বিবেচনা করতে হচ্ছে পাঠকবর্গ এই ‘test of foreign’-এর জন্য কতখানি প্রস্তুত। এবং এবার ভাবুন তো, যদি প্রক্রিয়াটি এমন হয় যে রুশ কিংবা জাপানি কিংবা স্প্যানিশ ভাষা থেকে এক ইংরেজিভাষী ব্যক্তি ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন, তারপর আবার সেই অনূদিত বয়ানটিকে কেউ বাংলায় অনুবাদ করছেন, তবে কতবার মূল টেক্সটটির অঙ্গহানি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়? সাহিত্য তো শুধু স্টোরি-লাইন বা কাহিনিটুকু নয়। এখানে আসলে বিপত্তির উৎস মূলত দুটি। একটি হল তৃতীয় ভাষার বা ফিলটার ল্যাঙ্গুয়েজের সাহায্য নেওয়া, আর অন্যটি, এই ফিলটার ল্যাঙ্গুয়েজটি যে ইংরেজি, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ যে ভাষার সূত্রে নিশ্চিতভাবে অন্তঃসলিলা। পরপর চারটি ধাপে ‘test of foreign’-এর মুখোমুখি হয়ে, যা অতঃপর বাংলা অনুবাদের পাঠকের কাছে এসে পৌঁছোয়, তার যে কতবার অঙ্গহানি হয়েছে, সে সহজেই অনুমেয়। জাপানি থেকে বাংলায় অনুবাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, ভয়াল সব বিপর্যয় ঘটতে দেখেছি একেবারে প্রায় নিয়ম করে, এ-সমস্ত ক্ষেত্রে। বাংলা অনুবাদের সরলমতি পাঠক জানলেনই না এই চার ধাপের মধ্যে দিয়ে গলে আসতে গিয়ে কতবার যে ভগবান ভূত হয়েছেন!

বইয়ের The Politics of Translation চ্যাপ্টারে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক লিখছেন[7],

… the task of the translator is to surrender herself to the linguistic rhetoricity of the original text.

[অনুবাদকের দায়িত্ব হচ্ছে পাঠকের আবেগের কাছে কার্যকরীভাবে আবেদন রাখার মতো করে যে ভাষাশৈলী মূল টেক্সটে অবলম্বন করা হয়েছে, তার কাছে আত্মসমর্পণ করা।]

স্থানান্তরে,

To decide whether you are prepared enough to start translating, then, it might help if you have graduated into speaking, by choice or preference, of intimate matters in the language of the original.

[অনুবাদ করতে শুরু করার জন্য আপনি যথেষ্ট প্রস্তুত কিনা, সেটা বুঝতে সুবিধে হবে, যদি আপনি অন্তরঙ্গ বিষয়গুলোতে মূলের ভাষায়, সেরকমই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেই হোক বা পক্ষপাতিত্বের কারণেই হোক, কথা বলার মতো পারদর্শিতা ইতোমধ্যে অর্জন করে থাকেন।]

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক

অতএব মূলের ভাষাটি না জেনে, ফিলটার ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে অনুবাদ করলে চলবে না। একটা ভাষার সাহিত্যের পরিস্থিতির মান উন্নত করতে চাইলে বিদেশি সাহিত্যের ভাল এবং বহুল অনুবাদ অপরিহার্য। এবং তার জন্য নানা বিদেশি ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদের প্রয়োজন। ফিলটার ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে অনুবাদ করলে কিন্তু সেই অনুবাদকে কখনও অথরাইজড অনুবাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কারের জন্যও বিবেচনা করা হয় না। সেটাই স্বাভাবিক, ন্যায্যও।

 

সংযুক্তি

বাইবেলের জেনেসিস 11:1—9 অংশে আছে ব্যাবেল শহরের কাহিনি (কাল্পনিক):

বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম গ্রন্থে আছে ব্যাবেলের টাওয়ারের কথা। মহাপ্লাবনের পরে, নোয়া-র কয়েকজন বংশধর মিলে ঠিক করল যে তারা দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার সমতলভূমিতে এক নগরের পত্তন করবে, আর সেই নগরে থাকবে স্বর্গলোকে গিয়ে পৌঁছোনোর মতো এক সুউচ্চ টাওয়ার। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিচিতির স্বীকৃতিলাভ, এবং সেইসূত্রে একতাবদ্ধ হয়ে বাস করা। কিন্তু যখন ঈশ্বর দেখতে পেলেন তারা কী করছে, তাঁর ধারণা হল যে তারা অধিকতর শক্তিধর হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তাদের পরিকল্পনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তিনি এমন করলেন, যাতে তারা পৃথক পৃথক ভাষায় কথা বলতে থাকে। টাওয়ার গড়তে গিয়ে পরস্পরের সঙ্গে ঠিকমতো ভাব বিনিময় করতে না পেরে, তারা অগত্যা সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করে, এবং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নগরের যে অংশটি অবশিষ্ট পড়ে থাকে, তার নাম হয় ব্যাবেল।

ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে তখন থেকেই এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদের প্রচেষ্টা ও চল শুরু হয়, এবং হয়তো এই প্রত্যাশায় যে এইভাবে একদিন তারা আবার ভাষাগত দূরত্ব অতিক্রম করে, ভাবকে সুষ্ঠুভাবে বিনিময়ের মাধ্যমে বিশ্বজনীন করে তুলতে পারবে।


[1] Borges, Jorge Luis. On Writing. New York: Penguin Books. 2010. p.55.
[2] Rimbaud Complete, Vol-1. Translated, Edited: Mason, Wyatt. New York: The Modern Library. 2001. pp. xxxviii-xxxix.
[3] Chakravorty Spivak, Gayatri. Outside in the Teaching Machine. New York & London: Routledge. 1993. pp. 179–200.
[4] Ricoeur, Paul. On Translation (English Tr. Eileen Brennan). London & New York: Routledge. 2006. pp. 3-10.
[5] Steiner, George. After Babel: Aspects of Language and Translation. Oxford Peperbacks. 1998.
[6] পূর্বোক্ত।
[7] দ্রষ্টব্য, টীকা ৩।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...