প্রসঙ্গ: বাংলা অনুবাদ

জি এইচ হাবীব

 


আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে অনুবাদ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল পার করছে বলে মনে হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে একদিকে যেমন প্রচুর বই বা টেক্সট বাংলায় অনূদিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে আবার বেশ অল্প হলেও বাংলা থেকে ইংরেজিতেও ভাষান্তরিত হচ্ছে কিছু বই, মূলত ফিকশন; চেষ্টা চলছে মূল প্রকাশকের অনুমতি নিয়ে অনুবাদ প্রকাশের, বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে কয়েকটি অনুবাদ পত্রিকা। কিন্তু অনুবাদের উৎস ভাষা বরাবরের মতোই ৯৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ইংরেজিই রয়ে গেছে। এবং লেখার জগতের যে বিভিন্ন ও বিচিত্র শাখা-প্রশাখা রয়েছে যার একটি বড় অংশ নন-ফিকশন নামে পরিচিত তার অনুবাদ বেশ অবহেলিত; বিশেষ করে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সঙ্গীত, পরিবেশবিজ্ঞান ইত্যাদি

 

বাংলা অনুবাদের দৃশ্যপট

প্রথম কথা, চুলচেরা বিচারে, অনুবাদ অসম্ভব। ধ্বনিতাত্ত্বিকেরা বলে থাকেন, আমরা মুখ থেকে যে-ধ্বনি নির্গত করি তার প্রতিটি-ই অনন্য। এক নদীতে যেমন দুবার গোসল করা যায় না, একইভাবে ঠিক একইরকমের ধ্বনি কোনও ব্যক্তি, চুলচেরা বিচারে, দুবার উচ্চারণ করতে পারেন না, কিছু-না-কিছু ফারাক রয়েই যায়।  সাহিত্যের নানান ‘জনরার’ অনুবাদ, বিশেষ করে কবিতার অনুবাদও, সেই অর্থে অসম্ভব। এমন কি তথাকথিত কঠোর মূলানুগ অনুবাদেও অনেক কিছু হারায়। ঠিক কতটুকু হারায় তার কোনও পরিমাপক নেই। তাই বলা যায়, অনুবাদ মানে আপস। আবার, স্বাধীনতা নেওয়া বা কম নেওয়া বা বেশি নেওয়া, এ-বিষয়েও কোনও সর্বজনসম্মত ঐকমত্য যেমন কোনওকালে গড়ে ওঠেনি, তেমনি অনুবাদ পদ্ধতি সম্পর্কিত মত বা ধ্যান-ধারণাও স্থান-কালভেদে বদলেছে। মধ্যযুগে মৌলিকতার ধারণাটিই অলীক ছিল। তখন অনুবাদ বলতে অ্যাডাপ্টেশনই বোঝাত মূলত। অনুবাদকেরা এমন অনেক কিছু তাঁদের অনুবাদে ঢোকাতেন যা মূলে ছিল না। এক্ষেত্রে দ্বাদশ শতকের ফরাসি কবি ক্রিচিয়ান দি ত্রোয়ার কথা বলা যেতে পারে, যিনি ওভিদের মেটামরফসিস অনুবাদে এমন সব পরিবর্তন করেছেন যাতে করে, তাঁর বিবেচনায়, অনুবাদটি আরও মজার ও উপভোগ্য হয়। এ-প্রসঙ্গে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের স্টুয়ার্ট মেরিল ও এজরা পাউন্ডের কথাও বলা যায়। আর এ-ধরনের অনুবাদের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য উদাহরণটি বোধ হয় ২০১৬ সালে ম্যান বুকার প্রাপ্ত উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান-এর ডেবোরাহ স্মিথের অনুবাদটি, যা মূল কাজটির সঙ্গে পুরস্কৃত হয়েছে, এবং অনুবাদক পুরস্কারের মোট অর্থমূল্যের অর্ধেক লাভ করেছেন। কেতকী কুশারী ডাইসন কথিত ‘অনুবাদ মৌলবাদী’রা খুবই হতাশ হয়েছেন এই অনুবাদটি দেখে; বিশেষ করে এটিকে এমনভাবে সংবর্ধিত ও পুরস্কৃত হতে দেখে। তার কারণ এই অনুবাদে এমন অনেক কিছুই আছে, ছত্রে ছত্রে, যা মূল বইটিতে নেই। এ-যেন সেই মধ্যযুগীয় অ্যাডাপ্টেশন ধরনের অনুবাদের প্রত্যাবর্তন। কাজেই, আমি মনে করি, প্রথমত, একজন অনুবাদক কীভাবে অনুবাদ করবেন সেটা তাঁর ব্যাপার; এ-বিষয়ে কোনও ধরনের খবরদারি বা নজরদারি চালানো মুশকিল।

ডেবোরা স্মিথ ও হ্যান কাং

একটি বিশেষ যুগের পাঠক-সমালোচক অনেকভাবেই সেটি নিতে পারেন; কিন্তু শেষকথা বলার কেউ নেই। একই কাজ আজ সমাদৃত না-হলেও বা হলেও কাল যে সেটি তা হবে না বা হবে তা বলা মুশকিল। নাবোকভ যে বলেছিলেন, ‘The clumsiest literal translation is  thousand times more useful than the prettiest paraphrase’, এমন ফতোয়া যেমন অনুবাদকের প্রাতিস্বিক বিবেচনায় খারিজ হয়ে যেতে পারে, তেমনি পারে মধ্যযুগীয় অ্যাডাপ্টেশন ধরনের অনুবাদের ধারণাও। তিনি বেছে নিতে পারেন মধ্যবর্তী কোনও পন্থা। তবে একটি কথা এখানে উল্লেখযোগ্য, আর তা হল, প্রত্যেক কালেরই বিশেষ যুগধর্ম থাকে যা সেই কালের অর্থনীতি-সমজ-রাজনীতি ইত্যাদির দ্বারা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। সাহিত্য, অনুবাদ-ও এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। কাজেই অনুবাদকের প্রাতিস্বিক বিবেচনাও যে এসব উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হবে না তা বলা মুশকিল। তবে আমার বিবেচনায়, যে-ভাষায় একটি রচনা অনূদিত হচ্ছে সে-ভাষায় যেন অনুবাদটি পাঠযোগ্য হয় সে-ব্যাপারে অনুবাদকের লক্ষ রাখা উচিত।

মূলের কোনও অতিভক্ত পাঠকের জন্য আমার পরামর্শ এই যে, তিনি যেন মূল ভাষাতেই সেটি পাঠ করে মূলের রস গ্রহণ করেন। কারণ মূলানুগত্যের দোহাই-পাড়া অনেক অপাঠ্য অনুবাদ আমরা পেয়েছি। একটু উদাহরণ দিয়ে বলি: ধরুন, একটি উপন্যাস প্রথমে ফরাসিতে রচিত হয়েছে। সেটা ফরাসি থেকে কেউ বাংলায় অনুবাদ করলেন। দেখা গেল খুব খটমট হয়েছে, পড়া যাচ্ছে না, বাংলাটাকে বাংলা বলে মনে হচ্ছে না। অনুবাদক মূলানুগত্যের দোহাই পাড়লেন। বললেন যে, মূলের স্বাদ বজায় রাখতে গিয়ে এটা হয়েছে। বেশ। কিন্তু এখন সেই উপন্যাসেরই একটি ভাল ইংরেজি অনুবাদ হাতে নিন। দেখা যাবে বিশ্বস্ত সেই অনুবাদ পড়তে আপনার তেমন অসুবিধা হচ্ছে না, ইংরেজিটাকে ইংরেজি বলেই মনে হচ্ছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? দুটো অনুবাদই তো মূল ভাষা থেকে করা হয়েছে? তাহলে বাংলাটা বা বিশেষ একটা ভাষা পড়া যাচ্ছে না কেন? অথচ হয়তো সেই একই ফরাসি উপন্যাসের আরেকটি বাংলা অনুবাদ মূল থেকে করা হয়নি, তৃতীয় একটি ভাষা ইংরেজি থেকে করা হয়েছে, কিন্তু সেটি দিব্যি পড়া যাচ্ছে। আবার ধরুন, এমন কোনও রচনা অনুবাদ করা হল, মূল থেকেই, যেটি মূল ভাষাতেই বেশ খটমট, দুর্বোধ্য; যেমন, জেমস জয়েসের ইউলিসিস বা ফিনেগানস ওয়েক, বা আমোস তুতুওলার দ্য পাম ওয়াইন ড্রিঙ্কার্ড। এখন, এই তিনটি রচনার অনুবাদ কি তরতরিয়ে পড়ে যাওয়ার মতো সুখপাঠ্য হওয়ার কথা, তা সে যে ভাষাতেই হোক?

সুখপাঠ্য হলেই তো বরং তা তেমন যথাযথভাবে অনুবাদ হয়নি বলে মনে করব আমরা। কারণ, মূল ভাষাতেই সেটি ইচ্ছাকৃতভাবেই সুখপাঠ্য করা হয়নি। তার মানে, আসল কথা হচ্ছে যিনি অনুবাদ করছেন তাঁকে যে-ভাষায় অনুবাদটি করা হচ্ছে সে-ভাষায় ভাল দক্ষ হতে হবে, এবং কেতকী কুশারী ডাইসন কথিত ‘অনুবাদের মৌলবাদিত্ব’ পরিহার করতে হবে। আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা যাতে না হয় সেজন্য পরিষ্কার করে বলছি যে, অনুবাদ মূল ভাষা থেকেই করা ভাল। সে-ভাষা না জানা থাকলে তৃতীয় কোনও ভাষা থেকে করা ভাল। কিন্তু মূল ভাষা থেকে করলেই যে ভাল অনুবাদ হবে তার গ্যারান্টি দেয়া যায় না। বাংলায় অন্তত এর কিছু উদাহরণ আছে। যা বলতে চাই তা হচ্ছে, প্রতিটি ‘মৌলিক’ রচনার মতো প্রতিটি অনুবাদও একটি টেক্সট, একটি সৃজন। সেখানে আমরা কী পেলাম, সেটাই বরং যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে পারে, বাকির খাতা শূন্য রেখে।

আবার ধরুন, একজন পাঠক মূল রচনাই পড়ছেন। লেখক যে-অভিজ্ঞতার আলোকে, অনুভবের অভিঘাতে যেভাবে লিখেছেন তার সব কি একজন পাঠক ধরতে পারেন? সেই পাঠে কি কিছু হারায় না? লেখক যখন লেখেন তখন সে-সব অভিজ্ঞতার, অনুভবের সব কি তুলে আনতে পারেন তাঁর লেখায়? এই ‘লস্ট ইন ক্রিয়েশন’ নিয়ে মাথা ঘামাই না কেন আমরা? আমরা তো তাঁর সেই সৃষ্টিটি পেয়েই খুশি। তাহলে ‘লস্ট ইন ট্রান্সেলেশন’ নিয়ে এত মাথাব্যথা, এত হইচই কেন আমাদের? আমাদের সামনে মূল রচনাটি রয়েছে বলে? আর সেটার প্রতিতুলনায় অনুবাদটিকে মাপতে পারি বলে? কিন্তু যিনি মাপছেন তাঁর মাপ বা মাপকাঠি যে সঠিক তা কে বলল? বা, সেই বলায় সারবস্তু কতটা? প্রতিটি অনুবাদই একটি নতুন সৃষ্টি। সেখানে যদি কিছু হারায়ও, আমরা যে নতুন কিছু পাই না তা তো নয়। সেটার দিকেই বরং বেশি নজর দেওয়া উচিত আমাদের। তার মানে এই নয় যে, আমরা অনুবাদে বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করব না। করব। কিন্তু সেই বিশ্বস্ততা কতটুকু হবে না-হবে সে-ব্যাপারে ফতোয়া দেওয়া যায় না। সবাই সেসব ফতোয়ার সঙ্গে একমত হবেন না। এবং অনুবাদের পদ্ধতি দেশ-কাল-পাত্রভেদে বদলেছে, বদলাবে। সেটাই স্বাভাবিক। সেসব বদলের পেছনে সঙ্গত আর্থ-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে।

বাংলা অনুবাদের সমস্যার ব্যাপারে যা বলবার, তা হচ্ছে, এখনও এদেশে জনসাধারণের মধ্যে তো বটেই, এমন কি সারস্বত মহলে, সাহিত্যের অনেক শিক্ষকের মধ্যেও, অনুবাদকে একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কাজ বলে দেখা হয়। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে এই মানসিকতাকে একটা বড় সমস্যা বলে মনে হয়। না হলে নানান জ্ঞানকাণ্ডের অনেক ক্লাসিক ও ভাল লেখা, ফিকশন, নন-ফিকশন  বাংলায় অনূদিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকত না— ইদানিং দেশে অনুবাদের যে একটা জোয়ারের মতো এসেছে সেকথা মাথায় রেখেও একথা বলা যায়। আর, লেখকরাও যে অনুবাদকদের খুব একটা সমীহের চোখে দেখেন তা নয়, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়; যদিও তাঁদের বই অনুবাদ হলে তাঁরা বেশ গর্বের সঙ্গে সে-কথা ঘোষণা করে থাকেন। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। আর, আমাদের দেশে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষা থেকে কালে-ভদ্রে অনুবাদ হয়। জর্মন, হিস্পানি, ফরাসি, রুশ, আরবি, ইতালীয়, ওলন্দাজ, ফারসি, ইত্যাদি ভাষা থেকে অনুবাদ হয় না বললেই চলে। এ-ব্যাপারে সে-রকম কোনও মাথাব্যথাও নেই আমাদের। আর, আগেই উল্লেখ করেছি, সৃজনশীল রচনার পাশাপাশি মননশীল রচনা তথা নন-ফিকশন অনুবাদের দিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত, যে-কাজটা খুব কম হচ্ছে। তারপরেও এটা আনন্দের বিষয়, দেশে এখন নানান বই অনুবাদ হচ্ছে। আর তার মান যে খুব খারাপ তা বোধহয় বলা যাবে না।

অনুবাদের পাঠযোগ্যতার সূত্রে আরেকটি কথা না বললেই নয়। পাঠকভেদে বিষয়টির তারতম্য হতে পারে কিন্তু তারপরেও সাধারণ বিচারে সহজ সরল বোধগম্য অনুবাদই পাঠকের পছন্দ। মুশকিল হচ্ছে, সব লেখক একইভাবে লেখেন না। সবার রচনাশৈলী একরকম নয়। এখন, সবার লেখা পাঠকের সুবিধার্থে সহজবোধ্য করে অনুবাদ করলে, দীর্ঘ বাক্যগুলো [অপ্রয়োজনে] ভেঙে ভেঙে, কারও ব্যবহৃত [আপাত] কঠিন শব্দের সহজবোধ্য বাংলা শব্দ ব্যবহার করলে, এক লেখক থেকে আরেক লেখককে আলাদা করা যায় না। অবশ্যই, কথাটি মূলত ফিকশন অনুবাদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে। নন-ফিকশন অনুবাদের বেলায় কথাটা ততটা খাটে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানে তত্ত্ব ও তথ্য অবিকৃত বা অবিকল রেখে অনুবাদটি যতটা সম্ভব সহজবোধ্য বা সহজপাঠ্য করে পাঠকের সামনে পরিবেশন করাটাই বোধহয় মুখ্য বিষয়। ফিকশনের বেলাতে, উৎস-ভাষার লেখকের রচনাশৈলীর আস্বাদ লক্ষ্য ভাষার পাঠককে যতদূর সম্ভব দিতে হলে অনুবাদককে মাঝেমধ্যে খানিকটা আড়ষ্ট অনুবাদের দায় নিতে হতে পারে। সে দায় কোনও অনুবাদক নেবেন কিনা সাহসভরে, তা সংশ্লিষ্ট অনুবাদকের ব্যাপার।

বাংলা অনুবাদে পরিভাষার সমস্যা আরেকটি বড় বাধা। বাংলা একাডেমি একসময় কিছু পরিভাষার বই বের করেছিল। সেসব এখন দুষ্প্রাপ্য। ভাল অভিধানেরও অভাব প্রকট। ভালো ইংরেজি-বাংলা অভিধানের অপ্রতুলতার কথা ভুক্তভোগী মাত্রই অবগত আছেন। একটি শব্দের একাধিক মানে থাকে। কনটেক্সট অনুযায়ী সেসব শব্দের যথাযথ মানে না বুঝতে পারলে অনুবাদ অনেক সময় হাস্যকর বা বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভাল অভিধানের বিকল্প নেই।

অন্য সব ক্ষেত্রের মতো অনুবাদেও পেশাদারিত্বের ভূমিকা অসীম। কিছু ব্যাপার নিশ্চিত করা গেলে আমাদের দেশের অনুবাদের দৃশ্যপটই পাল্টে যেতে পারে। প্রথমত অনুবাদের প্রতি ভালবাসা, উৎস ও লক্ষ্য, ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখা। দ্বিতীয়ত, [বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে] একটি কাজের মোটামুটি ভাল বাংলা অনুবাদ থাকলে সেটা আর অনুবাদ না করা [যদি না রচনাটি অনুবাদকের খুব প্রিয় হয়, কারণ অনেক প্রয়োজনীয় কাজ এখনও বাংলায় অনূদিত হওয়ার জন্য পড়ে আছে]। তৃতীয়ত, অনুবাদকের উপযুক্ত সম্মানী ও কাজগুলোর প্রচার নিশ্চিত করা। চতুর্থত, কেবল ইংরেজি নির্ভর না হয়ে অন্যান্য ভাষা থেকেও অনুবাদ করা [সেজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, আনুকূল্য খুব জরুরি]। পঞ্চমত, পাঠ সংস্কৃতি ও গ্রন্থাগার-ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতিসহ নানা পদক্ষেপই পাল্টে দিতে পারে বাংলা অনুবাদের দৃশ্যপট।

 

আমাদের অনুবাদ ও প্রাসঙ্গিক কথা

কথাটা নিশ্চয়ই আগেও বলেছেন অনেকে। অনুবাদ হচ্ছে বাতাসের মতো। এর মধ্যেই আমরা বাস করি, কিন্তু দেখি না, যদিও মাঝে মাঝে টের পাই সেটার উপস্থিতি; যখন ভাল বা খারাপ কোনও অনুবাদ আমাদের অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে আসে, ভাল অনুবাদ সুবাতাসের মতো আমাদের মন ভরিয়ে দেয়, আমাদের মন-প্রাণ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে; আবার বাজে কোনও অনুবাদ আমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে অনুবাদ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল পার করছে বলে মনে হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে একদিকে যেমন প্রচুর বই বা টেক্সট বাংলায় অনূদিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে আবার বেশ অল্প হলেও বাংলা থেকে ইংরেজিতেও ভাষান্তরিত হচ্ছে কিছু বই, মূলত ফিকশন; চেষ্টা চলছে মূল প্রকাশকের অনুমতি নিয়ে অনুবাদ প্রকাশের, বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে কয়েকটি অনুবাদ পত্রিকা। বছর দুয়েক আগে একটি প্রকাশনা সংস্থা ও একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছিল দু-মাসব্যাপী অনুবাদ কর্মশালা (অংশগ্রহণেচ্ছুদের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। আশা করা গিয়েছিল দ্বিতীয় একটি কর্মশালাও আয়োজন করা সম্ভব হবে। কিন্তু করোনা মহামারি এসে সে সম্ভাবনার বিনাশ ঘটায়)। নিয়মিত বিরতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দিনব্যাপী সম্পাদনা বিষয়ক কর্মশালা বা অনুষ্ঠান, যেখানে অনুবাদ, অনুবাদ সম্পাদনা নিয়েও পাঠ দান করা হয়।

এসব যেমন আশার কথা, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিত্রটি এখনও বেশ আগের মতোই আছে। যেমন, অনুবাদের উৎস ভাষা বরাবরের মতোই ৯৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ইংরেজিই রয়ে গেছে। অন্য যে তিনটি ভাষা থেকে অল্প-বিস্তর অনুবাদ হচ্ছে তা হল উর্দু, আরবি ও হিস্পানি। একেবারে আণুবীক্ষণিক স্তরে আছে রুশ, ফরাসি ও জার্মান। মূলত ইংরেজি বই, অথবা অন্য ভাষায় লেখা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ থেকেই বাংলা তরজমাগুলো হচ্ছে। অনুবাদ মূল ভাষা থেকেই হওয়া বেহতর, যদিও এ-ব্যাপারে সব সময় নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না যে মূল ভাষা থেকে ভাষান্তর হলেই কাজটি ভাল হবে। তবে, অন্তত দর্শন বা সাহিত্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে মূল ভাষা থেকে অনুবাদ হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। এসব ‘জটিল’ বিষয় হাতফেরতা হয়ে অনূদিত হলে সে-অনুবাদ দুর্বোধ্য হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে এসব অনুবাদের একটি বড় অংশই সেরকম কোনও সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদনা খুবই দায়িত্বপূর্ণ, সময়সাপেক্ষ ও জটিল একটি কাজ। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য দক্ষ লোক পাওয়া এমনতেই কঠিন; যদি-বা পাওয়া যায়, ভাল পারিশ্রমিক ছাড়া সেই অঙ্গুলিমেয় যোগ্য লোকজন সাড়া দেবেন না তা ধরেই নেওয়া যায়। একেই তো আমাদের প্রকাশনাজগতে এই সম্পাদনার সংস্কৃতি প্রায় অনুপস্থিত, তার ওপর রয়েছে সম্পাদনার খরচের গুরুভার। ফলে, এ-বালাই থেকে দূরেই থাকতে চান অধিকাংশ প্রকাশক। তাই অনুবাদের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এবার, অনূদিত বইগুলোর বিষয়বস্তুর দিকে যদি নজর দিই তাহলে দেখব থ্রিলার, রহস্য ও গোয়েন্দা কাহিনি, কল্পবিজ্ঞান তথা জনরা সাহিত্য আর অনুপ্রেরণামূলক বই-পত্তরের সংখ্যাই সেখানে বেশি। জনরা সাহিত্য নিয়ে মোটেই শুচিবাই নেই এই লেখকের; সবাই সব বই পড়বে না, এবং জনরা সাহিত্যের বিপুল এক পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে। কথা হচ্ছে, অন্য ধারার যেসব রচনা রয়েছে, লেখার জগতের যে বিভিন্ন ও বিচিত্র শাখা-প্রশাখা রয়েছে যার একটি বড় অংশ নন-ফিকশন নামে পরিচিত তার অনুবাদ বেশ অবহেলিত; বিশেষ করে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সঙ্গীত, পরিবেশবিজ্ঞান ইত্যাদি। ইতিহাস ও বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের অনুবাদ যে একেবারেই প্রকাশিত হচ্ছে না তা অবশ্যই নয়; কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় তা মোটেই যথেষ্ট নয়। আমাদের জ্ঞানচর্চার জগতে বিশেষ করে বাংলায় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই তরজমাগুলো যত বেশি হবে ততই আমরা কূপমণ্ডূকতার হাত থেকে রক্ষা পাব। ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক বই ছাড়া মূল আরবি থেকে কিছু ধর্মীয় বইও অনুবাদ হচ্ছে।

বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার অনুবাদের ক্ষেত্রে যে কথাটি আবারও বলতেই হয় তা হলো, আমাদের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে বড় বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করা অর্থাভাবের কারণে প্রায় অসম্ভব। অবশ্য বর্তমান জমানায় এককভাবে আর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয় না বললেই চলে। কিন্তু সে কারণে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞান বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি, গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হওয়া রিপোর্ট, গবেষণা সন্দর্ভ, প্রভৃতি সংগ্রহ করে বাংলায় অনুবাদের বা ভাবানুবাদের ব্যবস্থা করতে পারি— হতে পারে সে-সবের যতদূর সম্ভব সহজ-সরল পরিবেশনা— তাহলে বিজ্ঞান গবেষণার ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দেশের রাষ্ট্রীয় বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দায়িত্ব পালন করা উচিত। সবচেয়ে ভাল হয় এ-ধরনের কাজের জন্য যদি আলাদা কোনও অনুবাদ প্রতিষ্ঠান থাকে, যার কাজই হবে এসব রচনা অনুবাদ করা। চিন, জাপান, কোরিয়া, ইরানসহ আরও কিছু দেশে দেখা যায় তারা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ বই বের হওয়া মাত্র সেগুলো অল্প কিছুদিনের মধ্যে অনুবাদ করে ফেলে, সেসব বই চলে যায় নানান গ্রন্থাগারে, পুস্তক বিপণিতে। এ-কাজের সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন, কারণ এ ধরনের কাজের জন্য উপযুক্ত অনুবাদক রাতারাতি তৈরি হয় না। দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট আছে, ইংরেজি বিভাগ আছে, সেখানের শিক্ষার্থীরা আছে, তা আমাদের ব্যবহার করতে হবে। অনুবাদের মতো আপাত একঘেয়ে জটিল কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কাজটি একটু আগেভাগেই শুরু করা যেতে পারে শিক্ষার্থীদের এ-কাজে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে। কিন্তু তার আগে চাই তরজমাপ্রেমী শিক্ষক।

অনূদিত বইগুলোর বিতরণের প্রসঙ্গেই চলে আসে আমাদের গ্রন্থাগারগুলোর দৈন্যদশার কথা। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আমাদের দেশের গ্রন্থাগারের সংখ্যা ১৫০০-ও হবে না, যা এদেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষের জন্য হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক গ্রন্থাগারেও যদি নিয়মিতভাবে প্রতি বছর প্রকাশিত দেশের ভাল ভাল বই, ভাল ভাল অনুবাদ কেনার ব্যবস্থা করা যেত, পাঠসংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটিয়ে সেসব বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ জাগানো যেত, তাহলেও একটা কাজের কাজ হত।

কিন্তু এদেশে এসব গ্রন্থাগারে যেসব বই কেনা হয় তার বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীর শংসামূলক রচনা, বা গ্রন্থক্রয় কমিটির সদস্যদের নিজস্ব বইপত্র। কোথাও কোথাও বইকেনার টাকা খরচ হয়ে গেলেও ভাউচার ছাড়া অন্য কোনও কিছুর দেখা মেলে না। আর, পাঠসংস্কৃতির যে বেহাল দশা তা যে কোনও সংবেদনশীল মানুষকে হতাশ করবে। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারগুলোতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজনৈতিক দলগুলোতে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইয়ের কথা বলা যেন এক গর্হিত অপরাধের মতো। কেউ পারতপক্ষে সেসবের কথা বলেন না, ছেলেমেয়েদের এসব বই পড়তে উৎসাহ দেন না। সবার একটাই লক্ষ্য— পরীক্ষার ফল ভাল করা।

যাই হোক, আবার অনুবাদ প্রসঙ্গে ফিরি। আমাদের বাংলা রচনার যেসব ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে সেগুলোর সিংহভাগই করছেন বাংলাদেশিরা বা বিদেশি বাঙালিরা বা, প্রবাসী বাঙালিরা, দু-একটি বিরল ঘটনা ছাড়া। আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে যে এসবের মধ্যে কিছু কিছু অনুবাদ হচ্ছে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে, যার ফলে সেসবের মান নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। এবং এসব অনুবাদে ফিকশনই মুখ্য। কবিতার বই যাও বা দু-চারটে হচ্ছে নন-ফিকশন বলতে গেলে শূন্য। অনূদিত এসব বইয়ের লক্ষ্য-পাঠক কারা, তাদের কাছে বিপণন কীভাবে হবে বা হচ্ছে সে-ব্যাপারে আমরা প্রায় অন্ধকারেই আছি। তাছাড়া, মাতৃভাষা ইংরেজি এমন অনুবাদকদের দিয়েও আমাদের রচনাগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস যতটা, আমাদের দেশে রচিত উন্নতমানের রচনা শো-কেসিং, বিপণন এবং অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার কেজো কোনও পরিকল্পনা গ্রহণে ও তা বাস্তবায়নে আমাদের ততটাই অনীহা। প্রতিবছর মাসব্যাপী আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়, সে-সময়ে বিদেশি ভাল ভাল প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের মেলায় আমন্ত্রণ করে আমাদের অনুবাদযোগ্য বইগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের কাজগুলোর অনুবাদ-সম্ভাবনা বাড়াতে পারতাম। কিন্তু অন্য ভাষা থেকে বাংলা অনুবাদ যেমন দীর্ঘদিনের অনুবাদচর্চার পরেও পাঠকের আস্থাভাজন হতে পারেনি, তেমনি বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদের দশাও সংখ্যা ও মানের দিক থেকে তেমন কোনও নির্ভরতার জায়গায় যেতে পারেনি।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুবাদের যে ব্যাপক ভূমিকা আছে তা অনেকেই স্বীকার করবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে এজন্য আমরা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রথম কথা হল কাজটা আমরা করতে চাই কি না। তবে, ইংরেজিতে বলা হয়, ‘দ্য রোড টু হেল ইজ পেইভড উইদ গুড ইন্টেনশন্স।’ সদিচ্ছা থাকলেই কাজ হয় না, দরকার হয় কর্মোদ্যোগ। এ-ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে পারে সে-ব্যাপারে বহুবার বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকরা যদি তাঁদের বিষয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট অনুবাদ করতেন এবং সেসব অনুবাদ তাঁদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লাগত, তাহলে আমরা বেশ কিছু ভাল টেক্সটের বাংলা পেয়ে যেতাম। এই প্রসঙ্গে চার্লস বারবারের ‘দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দ্য এইজ অফ শেক্সপিয়ার’ শিরোনামের প্রবন্ধের কথা নানান জায়গায় বলেছি। সেই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন শেক্সপিয়রের জন্মের সময় (১৫৬৪ খ্রিঃ) ইংরেজি ভাষাকে তার প্রাঞ্জলতার অভাবে, তথা ভাষাটির ভাঁড়ারে যথেষ্ট সংখ্যক শব্দ না থাকায় বর্বর বা ‘barbarous’ ভাষা বলা হত (যে-কারণে মনে করা হত ইংরেজিতে নানান জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করা যায় না, দর্শনের কথা আলাপ করা যায় না); সে-সময়ে লাতিন মহাপ্রতাপশালী আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ার কারণে সবাই তখন (নিজের সেরা) রচনাটি লাতিনে লেখার ব্যাপারে উৎসাহী থাকতেন; এবং খোদ ইংল্যান্ডেই ইংরেজি ভাষার সম্মান ছিল বেশ কম; অথচ শেক্সপিয়রের জীবনকালের শেষের দিকে ভাষাটি এই দীন দশা থেকে মুক্তিলাভ করেছিল নানানভাবে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে ও ধার নিয়ে, নানান রচনা প্রথমে অনুবাদ, পরে অ্যাডাপ্ট আর শেষে মৌলিকভাবে রচনা করে ইংরেজিভাষীরা তাঁদের ভাষার দুরবস্থা দূর করেছিলেন; সেটাকে যথেষ্ট সম্মানের আসনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কাজটি ইংরেজিভাষীরাই করেছিলেন; তাদের হয়ে জার্মান, ফরাসি, জাপানি বা চিনাভাষী কেউ এসে করে দিয়ে যায়নি। বাংলার ব্যাপারেও ইংরেজির মতো বলা হয় যে এ-ভাষার শব্দসম্ভার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান বিষয় আলাপের উপযোগী নয়, পরিভাষার দিক থেকে আমরা খুব দুর্বল। অল্প যেসব তৈরি হয়েছে সেসব-ও ব্যবহারের অভাবে তেমন প্রচলিত হতে পারেনি। আমাদের প্রবণতা রেডিমেড ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের দিকেই; এর একটি বড় কারণ সম্ভবত আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। পরিভাষার ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম অনেক শব্দকেই অপরিচিত, অজানা মনে হয়, পরে সেসব ব্যবহারে ব্যবহারে সড়গড় হয়ে আসে। একথাটা আমরা কেন যেন ভুলে গিয়ে একটু অপরিচয়ের অস্বস্তি সহ্য করতে চাই না। ফলে সেসব আর ব্যবহৃত হয় না। অথচ সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে’ লেখাটা যদি আমরা স্মরণ করি, আরেকবার পাঠ করি, তাহলে আমাদের ভাষার যে সম্পদ যে শক্তি আছে তা সম্পর্কে একটু বল-ভরসা পেতাম।

বাংলা অনুবাদের, এবং বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের একটা ডেটাবেস, একটা হিসাব আমাদের প্রস্তুত করা খুব দরকার। পিটার ফ্রান্স সম্পাদিত ‘দ্য অক্সফোর্ড গাইড টু লিটারেচার ইন ইংলিশ ট্রান্সলেশন’ বইটির মতো, নামেই যেটার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার সময় অনুবাদের ভূমিকা নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় থাকাও দরকার মনে করি, শুধু এ-সম্পর্কে দু-একটা আলটপকা মন্তব্য নয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের খুব কম বইয়েই এমন আলোচনার দেখা মেলে; এমন কি কোনও ইংরেজি সাহিত্যের বইয়েও সে-ভাষা ও সাহিত্যের গঠনে অনুবাদের গুরুত্ব নিয়ে বিশেষ আলোচনা দেখতে পাই না।

এর কারণ বোধহয় এই যে, সাধারণ পাঠকের কাছে বাংলা অনুবাদের যা হোক একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু এদেশের অ্যাকাডেমিয়াতে তার কানাকড়িও নেই। অবশ্য এদেশের অ্যাকাডেমিয়ার মান নিয়ে কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল এখন। বাংলা বিভাগগুলোতে চতুর্থ বর্ষ বা এমএ-তে ১০০ নম্বরের একটি কোর্স থাকে যেখানে বাংলা অনুবাদে বিদেশি সাহিত্য পড়ানো হয়। সেখানে মূলত সেই টেক্সটগুলোর ভালমন্দ, চরিত্র বিশ্লেষণ, এসব নিয়েই আলোচনা করা হয়। অনুবাদের মান বা বৈশিষ্ট্য বা তত্ত্ব নিয়ে কোনও আলাপ হয় না বলেই জানি। অথচ এরকম আলাপ বা বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের ইতিহাস নিয়ে আলাপটি জরুরি ছিল, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে।

সব শেষে বলব, অনুবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সেটা উপলব্ধি করে এটার চর্চা ও প্রসারের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কাজগুলো আমরা যত দ্রুত করতে পারব ততই মঙ্গল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...