এই সংবৃত আঁধারে আলোকে

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

 

যে শ্রমণ যতকিঞ্চিৎ প্রাপ্তির পরেও সে বিষয়ে মনে অপূর্ণতা বা ক্ষোভ রাখে না, সেই প্রাপ্তিকে অবজ্ঞা করে না— ঈশ্বরও সেই শ্রমণের পবিত্র এবং নিরলস যাপনের প্রশংসা করেন।

—ভিক্‌খুবগ্‌গ। জেতবন (ধম্মপদ)

ঠিক দুপুরবেলা, যখন রাস্তা নির্জন; যখন রক্তস্রোত ধীরে ধীরে মাথা থেকে পেটের দিকে নেমে আসে; যখন একটা ঠুনকো ধাতব শব্দও বেশ তীক্ষ্ণভাবে কানে এসে বাজে… তখনই রাস্তায় সেই লোকটিকে দেখা যায়। লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়… রোগাও নয়, মোটাও নয়… ফর্সাও নয়, কালোও নয়। যে তামাটে রং, তাও আসল না রোদে জ্বলা বোঝা যায় না। চোখের তলায় গভীর ছায়া। সরু ছোট নাক… পায়রার ঠোঁটের মতো। চিবুকের মাঝামাঝি একটা টোল, যেন কেউ বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে দিয়েছে। মাথার চুলগুলো খুব ছোট, ন্যাড়া মাথায় চুল গজালে যেমন হয়। আর মাথাটা অমন বলেই, বাইরে ছড়িয়ে থাকা কান দুটো আরও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ। গায়ে মেরুন রঙের একটা কাপড়, শাড়ির মতোই কুঁচি দিয়ে পরা। বস্ত্র একটিই। আঁচলটা ফেলে দেওয়া কাঁধের ওপর। ডানদিকের কাঁধ অনাবৃত।

লোকটা এক-ধার দিয়ে হেঁটে চলে যায়। ধীরেও নয়, দ্রুতও নয়। মাঝেমাঝে পথের ধারে এক-একটি বাড়ির দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। সদর দরজার কাছে এগিয়ে এসে ঠক ঠক করে টোকা দেয়, অথবা কড়া নাড়ে। ডোর-বেল থাকলেও তা ব্যবহার করে না। কড়া নাড়ে, অথবা টোকা দেয়। তৃতীয়বারের চেষ্টাতেও সাড়া না পেলে চলে যায়। গলা দিয়ে কোনও শব্দ করে না, ডাকাডাকি করে না। কেউ দরজা খুললে ভিক্ষা চায়। গৃহস্থপাড়ায় আজকাল কেউ দরজায় দরজায় হাত-পেতে ভিক্ষে চাওয়া ভিখিরি দেখতে অভ্যস্ত নয়। কেউ বিশেষ কারণে সাহায্য চাইতে এলে এমনিতেই দরজা বন্ধ করে দেয় অনেকে… পুরো কথা শোনার আগেই।

মাধুকরী শব্দের অর্থ আলাদা করে কে বুঝবে? তাই ভিক্ষে বলাই ভাল। লোকটা কাপড়ের ঝোলা সামনে এগিয়ে দিয়ে মাথা নত করে ভিক্ষে চায়। যারা দরজা খোলে না, তাদের কথা আলাদা… কিন্তু যে খোলে, সে কখনও ওই নতমস্তক মানুষটাকে খালি হাতে ফেরাতে পারে না। ঠিক কিছু না কিছু রেখে দেয় ওই কাপড়ের ঝোলার ভেতরে… যেমন সামর্থ্য। লোকটাও ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে হাতের মুঠোয় কিছু একটা বার করে নিয়ে আসে, তারপর সেই গৃহস্থের হাতে দিয়ে চলে যায়। দেখে বেছে নেয় না, হাতে যা উঠে আসে… তাই-ই। বিশেষ কিছু না, চমৎকারিও নয়… স্বাভাবিক, যৎকিঞ্চিৎ। কোনও কোনও গৃহস্থ ভাবে আশীর্বাদ, কেউ ভাবে প্রসাদ, কেউ ভাবে ‘বেশ যত্ন করে রেখে দিতে হবে, কী জানি কী হয়!’ মাথায় ঠেকিয়ে ঘরের দরজা সন্তর্পণে বন্ধ করে দেয় ভেতর থেকে। আদৌ কী ভাবল— কাউকে কাউকে দেখে বোঝা সম্ভব হয় না। মাঝেমাঝে, দু-একজন জিজ্ঞেস করে— এটা কী? কেন দিচ্ছেন? তাকে তার ভাষাতেই সেই স্মিতহাস্য মুখে লোকটি উত্তর দেয়—

—স্মৃতি। যা আছে, বা ছিল, তার স্মৃতি। কিংবা এই মুহূর্তটুকুরই স্মৃতি।  কত দিন থাকে… যত দিন থাকে… তত দিন থাকে।

মাঝে মাঝে, নির্জন দুপুরে… যেদিন একটু বেশি-ই প্রখর হয়ে ওঠে সূর্যের তেজ; সেই লোকটা এভাবেই মাধুকরীর বিনিময়ে একটুকরো স্মৃতি দিয়ে চলে যায় কোনও অঞ্চলের এক বা একাধিক ব্যক্তিকে… অযাচিতভাবেই। তারাই পায়, যারা ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসে অভ্যন্তর থেকে।

তারপর লোকটা চলে যায়। ভিক্ষুকের মুখ ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে কেউ দেখতে বা খুঁজতে চায় না। আর, শ্রমণের সাক্ষাৎ শহরের ভিড়ে ব্যস্ততায় কেউ প্রত্যাশাও করে না। তা দৈবাৎই ঘটে।

এমন অসময়ে দরজা ঠক ঠক কেবল সেল্‌সম্যান আর সাহায্য চাইতে আসা লোকজনই করে। দুবার ঠক ঠক শুনে একটা ‘মিচ’ করে জিভ দিয়ে চাপা শব্দ বেরিয়ে এল, উঠে বসল বিছানায় উজ্জয়িনী। সামাজিক উপন্যাসে এমন ছেদ মানসিক কষ্ট দেয়। সবাই বোঝে না। বইটা উপুর করে রেখে আঁচলটা টেনে কাঁধের ওপর ফেলতে ফেলতে জানলার পাশে এসে দাঁড়াল, যেখান থেকে দরজার ওপারে কে আছে তা দেখা যায়। একটা মেরুনরঙের কাপড় পরা, ন্যাড়া মাথার লোক— কেমন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মতো। দেখতে দেখতেই তৃতীয়বার টোকা দিল সে দরজায়। অন্য সময় হলে ‘ভিখিরির উৎপাত’ ভেবেই আর পাত্তা দিত না উজ্জয়িনী। তা ছাড়া এমন অবেলায় একা কেউ বাড়িতে আছে জেনে, কতরকম সন্ধানী লোক আসে… কত কিছু ঘটে যায় আজকাল!

কিন্তু আজ মনটা কেমন অন্যরকম সায় দিল। লোকটাকে দেখে কি না, কে জানে? মনে হল— এখন কাউকে কিছু দেওয়ার সময়। দরজাটা খুলতেই লোকটা মাথা নিচু করে কাপড়ের ঝোলা ব্যাগটা সামনের দিকে এগিয়ে দিল। একটু অপেক্ষা করুন, বলে দরজার পাল্লাটা আলগা ভিজিয়ে ভেতরে চলে গেল উজ্জয়িনী। তারপর ফিরে এল এক থালা চাল, দুটো আলু, একটা আপেল, একশো টাকার নোট আর এক টাকার একটা কয়েন নিয়ে। ছোটবেলা এইভাবেই মাকে দেখেছে বোষ্টমকে ফাল্গুন মাসে ভিক্ষে দিতে। কিছু চাল, ডাল, সবজি আর একান্ন টাকা। অনেক বছর পর ঠিক সেইভাবেই কাউকে সাজিয়ে দিল থালায়। সবটা ঢেলে দিল তার ঝুলিতে। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল তারপর ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে মুঠোয় সামান্য চাল বার করে এনে রেখে দিল উজ্জয়িনীর হাতের ওই শূন্য থালার ওপর। উজ্জয়িনী এর আগে কোনও ভিখিরিকে এমন কিছু করতে দেখেনি। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে, কিছু বলতে পারল না। লোকটার পাতলা ঠোঁটে হালকা টান পড়ল, সামান্য হেসে বলল—

—স্মৃতি…  কখনও ফুরোয় না। সবটা ফেলেও দেওয়া যায় না, দিয়েও দেওয়া যায় না। মানুষ যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন তার সঙ্গে বেঁচে থাকে। যখন থাকে না, মানুষটাই অন্য কারও স্মৃতি হয়ে যায়। এ-ই বিনিময় মুদ্রা। এ-ই অর্জন।

আর একবার সামনে মাথা ঝুঁকল লোকটা। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল… চলে গেল হাঁটতে হাঁটতে। আর একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। এমন সুঠাম পিঠ নিয়ে ঘাড় সোজা রেখে অনেকদিন কাউকে হাঁটতে দেখেনি উজ্জয়িনী। থালায় ফেরত রেখে যাওয়া সেই স্মৃতিকণিকাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দরজার পাল্লা ঠেলে বন্ধ করে দিল অন্য হাত দিয়ে। সামান্যই, চাইলে গোনাও যাবে হয়তো। তাও— চাল রাখার জায়গায় ফিরিয়ে দিতে পারল না, পাখিদের খেতে দেওয়ার ছলে ফেলেও দিতে পারল না। একটা অন্য চিন্তা মাথায় এল—

“কোথায় রাখি এদের? ওই যে বলে গেল… স্মৃতি! অর্জন!”

***

 

I have had to experience so much stupidity, so many vices, so much error, so much nausea, disillusionment and sorrow, just in order to become a child again and begin anew. I had to experience despair, I had to sink to the greatest mental depths, to thoughts of suicide, in order to experience grace.

—Hermann Hesse, Siddhartha

একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গ দুপুর সমস্যা নয়, উজ্জয়িনী খুবই স্বচ্ছন্দ এভাবে থাকতে। শহরে এসে শুধু ওরা দুজনেই আছে এই একতলা ভাড়াবাড়িতে। থাকতে হয়, ওর স্বামী মৃন্ময়ের চাকরি এখানে। শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামের বাড়িতেই থাকেন, মুর্শিদাবাদে। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বরের সঙ্গে শহরে গিয়ে থাকা নিয়ে তাঁদের আপত্তি উজ্জয়িনী গ্রাহ্য করেনি। ও বহরমপুরের মেয়ে, কলেজে পড়ার সময়ে কলকাতায় এসেও থেকেছে। সেই থেকেই ইচ্ছে ছিল এই শহরে আবার ফিরে আসতে। হয়তো মৃন্ময়কে বিয়ে করতে রাজি হওয়ারও একটা বড় কারণ ছিল কলকাতায় চাকরি, স্থায়ী জীবিকা।

ভালবাসা তো বলে না। বলে প্রেম। না… প্রেম-টেমের ব্যাপার নয়। দু-বাড়ি থেকে কথাবার্তার পর দুজনে মাস তিনেক ফোনাফুনি আর দেখাসাক্ষাৎ করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়… বিয়েটা করাই যায়। সম্পর্ক বা গভীরতার কথা আলাদা। সেসব একসময়ে মনে হত। মিলনান্তক হিন্দি সিনেমা আর পাখির ঠোঁটের মতো নাক ঘষাঘষি করা মিষ্টি সম্পর্ক দেখতে দেখতে ইচ্ছে হত এইভাবেই এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে নেপথ্যে স্যাক্সোফন আর ভায়োলিনের আবহসঙ্গীত নিয়ে। কিন্তু এত বাহ্যিক উদযাপনের মধ্যেই একটা জিনিস আড়ালে চলে যায়। ওটা রহস্য, ওটা গোপনীয়, ওটা একান্ত ব্যক্তিগত, ওটা টুকি…

একদিন গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, তারপর ইচ্ছে করল হাইমেনের ভেতর একটু একটু করে মধ্যমা ঢুকিয়ে দিতে। চিৎ হয়ে শুয়ে এক গভীর তৃপ্তির মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতেই সিদ্ধার্থের মতো জীবনের চারটে সত্য দেখতে পেল উজ্জয়িনী। তখন সবে সতেরোয় পা। আর সত্য… প্রত্যেকটা মানুষের তার নিজের নিজের ভার্শন অফ ট্রুথ থাকে। উজ্জয়িনীর কাছে ছিল দর্শন।

১) সম্পর্ক মাত্রেই টানটান… অথচ চরম তৃপ্তির পর শিথিল হয়ে আসে। আবার অপেক্ষা করতে হয়, কবে… কোথায়… কখন… আবার টানটান হয়ে বড়শির মতো টান মারবে।

২) কে কী দেখে ভালবাসে, বলতে পারে না। আসলে ভয় পায়। বুক, ঠোঁট… বাইরে থাকা আর যা কিছুর আভাস পাওয়া যায়… সেসবের কথা বলে প্রেম নিবেদন করতে ইতস্তত বোধ করে। নাহলে একটা মেয়ে ‘হ্যাঁ’ বলার পরেই বার বার ছুঁতে চায় কেন? এতই উপোসী?

৩) মানুষকে ভালবাসতে গেলে আগে চেনার চেষ্টা করতে হয়। আর চেনাটাই জীবনের এক বহুমাত্রিক রহস্য। এর কোনও অ্যাবসোলিউট পদ্ধতি নেই। যেখানে দুটো মন একে অপরের অচেনা… সেখানে পার্থিব সুখ, আর শারীরিক তৃপ্তি দিয়ে সব কিছু ব্যালেন্স করা থাকে। ওতেও মানুষ সুখী হয়, কিন্তু যখনই এই ‘অচেনা’ বোধটা জেগে ওঠে, অসাম্যটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৪) ভালবাসাকে শরীর খেয়ে নিলে ভালবাসা মরে যাবে। ভালবাসাকে সংসার খেয়ে নিলে ভালবাসা মরে যাবে। ভালবাসা অর্কিডের মতো। কিছুদিন পর এমনিই মরে যাবে। প্রথম অর্কিডের ফুল বা গাছ… সেই উদ্ভিদ দীর্ঘস্থায়ী নয়। কিন্তু সেই প্রিয় প্রজাতির অন্য কোনও উদ্ভিদ, তারই বংশধারার কেউ… যত্নে লালিত হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় নেই? বিকল্প নেই? আছে… এমন উদ্ভিদ… যে মহীরুহ। যে মানুষের মৃত্যুর পরেও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবে। তবে… তেমন ভালবাসা চিনতে, তাকে খুঁজতে, তাকে পেতে… পথে নামতে হয়। সেই অন্বেষণও এক সন্ন্যাসজীবন।

সপ্তদশী এক কিশোরী, আত্মতৃপ্তির বাসনা আর চাপা শীৎকার সামলানোর পর নিজেকে ধুয়ে মুছে ঘুমনোর বদলে এত কিছু ভাবে? উজ্জয়িনীর কিন্তু সত্যিই পর পর এই চারটে কথা মাথায় এসেছিল! একটা অবচেতন আচ্ছন্নতার মধ্যে, পর পর জড়ানো জড়ানো শব্দের মতো একে অপরের গায়ে জড়িয়ে-লেপটে থেকে চিন্তাগুলো এক এক করে এল… চারটি দর্শন— চরম সত্যের মতো। এক অলৌকিক অশরীরী প্রকাশ্যের মতো এসে ভীষণ একা এবং বিপন্ন করে দিয়ে গেল।

পরদিন সকালে উঠে মনে হল স্বপ্ন। এরপরেও  হস্তমৈথুন করেছে অনেকবার… তৃপ্তি পেয়েছে… আচ্ছন্নতাও এসেছে মৃদু সুখের ডানায় ভর করে। কিন্তু সেইরকম পর পর দৃশ্য-চিন্তা আর আসেনি। যতটা মনে ছিল, একটা ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছিল উজ্জয়িনী। ঠিক এতটাই ও দেখেছিল বা ভেবেছিল সেই রাতে… নাকি, পরে ডায়েরিতে লিখতে বসে নিজে ভেবে চিনতে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে লিখেছিল— এই প্রশ্ন যথাযথ। অবশ্য গুছিয়ে নিলেও, তা ওরই অনুভূতি, ওরই চেতনা।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দু-তিনটে প্রেমমাখা এসএমএস দেখেই হা হা হা করে হেসে উঠেছিল উজ্জয়িনী। পাশের ঘর থেকে মা কী হয়েছে রে? বলে চেঁচাতে বলেছিল— ও কিছু না… টিনা জোকস পাঠিয়েছে! তারপর এক এক করে সব ডিলিট করে দিল। স-অ-ব… যত প্রেম-মাখা, প্রেমগন্ধ মেসেজ ছিল। মনে হচ্ছিল— খাবার ফ্রিজে বেশিদিন রাখলে যেমন হয়— তেমন নষ্ট হয়ে গেছে। ফেলে দিতে হবে।

এই ফেলে দেওয়াটা একটা নেশার মতো ধরে গেল। যেমন কারও কারও জিনিসপত্র বেচে দেওয়ার স্বভাব হয়ে যায়। এসএমএস-এর পরে মনে পড়ল জমে থাকা গ্রিটিংস কার্ডগুলোর কথা। সেই ক্লাস এইট থেকে জমছে। সেই কার্ডগুলো নিয়ে সকালে আর বসা হয়নি। গভীর রাতে, টেবিল ল্যাম্পের গোপন হলুদ আলোর আশ্রয়ে তাদের ডেকে নিল। যত সহজে মেসেজগুলো ফোন থেকে ডিলিট করতে পেরেছিল, কার্ডগুলো ফেলা ততটা সহজ হল না। এভাবেই পার্থিব জড়বস্তুর ভেতরে স্মৃতি আর অনুভূতির শেকড় গজিয়ে ওঠে, গভীরে চলে যায়। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।  কতগুলো কার্ড একবার দেখেই পায়ের কাছে ফেলে দিল, চার পাক খেয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়ল সেগুলো। কেউ কেউ আলোর ক্ষীণ বৃত্তের বাইরে ভেসে গেল। কিন্তু কিছু কার্ড অত সহজে ফেলে দিতে পারল না উজ্জয়িনী। তাদের হাতে নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল— কখনও আলোর দিকে, কখনও কার্ডের ওপর লেখাগুলোর দিকে, কখনও জানলার বাইরে। চিবুক শক্ত করে, লেখাগুলোর ওপর আঙুল বুলিয়ে গেল অনেকক্ষণ। যারা লিখেছিল, তাদের স্পর্শের স্মৃতি। এগুলো একসময়ে ট্রফি মনে হত। তারা সব কিছু উজার করে দিতে চেয়েছিল, পায়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিল— ক্রীতদাসের মতো।

উজ্জয়িনী বেশ উপভোগ করত… ব্যস, উপভোগই। কেমন উৎসাহ নিয়ে কেউ দিনের পর দিন লেগে থাকত, কেউ কেউ একদিনেই বিমর্ষ হয়ে হার মেনে নিত। আওয়াজ খেত অন্য ছেলেদের কাছে। মারও খেয়েছে কেউ কেউ। যারা নিজেরা এগিয়ে এসে বলতে পারে না, তারা অন্যদের সাহসও সহ্য করতে পারে না… নিয়ম। ভবিষ্যৎ নেই… তখনই জানত। কিন্তু প্রেমনিবেদন পেতে, বাড়তি মনোযোগ পেতে, মন কাড়তে, কারও গোপন আসক্তি হয়ে উঠতে… কার না ইচ্ছে হয়? “আমি বাড়তি গুরুত্ব না দিলেও, একজন আছে… যার কাছে আমিই সব”— এটা মনে মনে জেনেও তাকে দূরে রেখে দেওয়া, ভালবাসা-ভরা বোকাবোকা চোখগুলোর দূর থেকে তাকিয়ে দেখা; সে এক অন্যরকম তৃপ্তি। স্যাডিস্ট মনে হতে পারে। কিন্তু তৃপ্তি যার, তারই। আত্মগরিমাও বটে। যে কারণে, উজ্জয়িনীকে নিয়ে ডজন খানেক কবিতা লেখা হলেও, উজ্জয়িনী কাউকে নিয়ে কখনও কবিতা লিখতে বসেনি।

কার্ডগুলো আর চিঠিগুলো নিয়ে কী করবে স্থির করতে পারছিল না। ছিঁড়ে দেওয়া বা পুড়িয়ে দেওয়া এক অদ্ভুত অতিনাটকীয়তা। কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই যেন অদ্ভুতরকম ভারী হয়ে বুকের ওপর চেপে বসছিল ওগুলো।  কেন যে এগুলোকে আঁকড়ে রেখে দিয়েছে! আরও কত এমন আসবে, আসতেই পারে… তাদেরও রেখে দিতে হবে? যখন সিদ্ধান্ত নিল, ততক্ষণে কাকগুলোর ঘুম ভেঙে গেছে। সলিলসমাধি— এটাই ভাল নিবৃত্তিপথ। প্রতিটা চিঠিকে কাগজের নৌকো করে ভাসিয়ে দেবে জলে। কার্ডগুলোকে এমনিই ভাসিয়ে দেবে। সবার পরিশ্রম ‘জলে গেল’। শ্রাদ্ধ-শান্তির সময়ে অনেকে নদীর জলে অনেক কিছু ভাসিয়ে দেয়, এক-কোমর জলে নেমে— উজ্জয়িনী দেখেছে। ভাগীরথীর অনেকগুলো ছোটবড় ঘাট, ধাপে ধাপে সিঁড়ি… কোথাও একটা ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

আর কী কী ফেলা যায় ভাবতে ভাবতে এর পরে এসেছিল উপহারের কথা। তেমন কিছু নেই, নরম পুতুলগুলো দিয়ে দিল রাস্তার ধারে খেলা বাচ্চা মেয়েগুলোকে। অযত্নে তামাটে হয়ে যাওয়া চুল নিয়ে মেয়েগুলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল এক প্যাকেট পুতুল দেখে। ওদের মা-রা কেউ ছিল না কাছাকাছি, থাকলে হয়তো সন্দেহ করত। উজ্জয়িনী পালিয়ে এসেছিল… তারপর সেখান থেকে সোজা কোচিং ক্লাস।

এই গোটা ব্যাপারটা ঘটতে দিন তিনেক লেগেছিল। এর মাঝে অভ্র বলে যে ছেলেটা একটু বেশিই আগ্রহ দেখাচ্ছিল, তার মেসেজগুলো রিপ্লাই করত না। অভ্র তাও মেসেজ পাঠিয়ে যেত। অভ্রকে পাত্তা দিতে ভালই লাগত উজ্জয়িনীর। দেখতে-শুনতে খারাপ না, ভাল বাড়ির ছেলে। নিজের সাইকেল আছে। একটা ওয়ালেটও সঙ্গে রাখে। কোচিং ক্লাস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাইকেল পাশে রেখে অনেকটা যাওয়া যায়। ছুঁতে চাওয়ার জন্যও তাড়াহুড়ো করে না।

চারদিনের দিন কোচিং থেকে ফেরার পথে অভ্রই উজ্জয়িনীকে ডেকে জিজ্ঞেস করল—

—তোর কী হয়েছে বল তো?
—কেন?
—মেসেজের উত্তর দিচ্ছিস না। ফোন রিসিভ করছিস না…
—তো?
—আরে কী হয়েছে বলবি তো…
—সব সময় কিছু হওয়া কি জরুরি?… ইচ্ছে হচ্ছিল না। সিম্পল…
—ফাইন। তাহলে ইচ্ছে হলে জানাস… তখনই টেক্সট করব। আমারও সময়ের দাম আছে।
—তিনদিনেই সময়ের দাম মনে পড়ে গেল? নাইস!
—হ্যাঁ পড়ল… আমরা ভাল বন্ধু। কিন্তু জাস্ট বন্ধু নই। অন্তত আমার কাছে… আই কেয়ার ফর ইউ… আই…
—কী? ভাল বন্ধুর থেকে বেশি কিছু? আমরা তাহলে কী অভ্র? লাভারস?

অভ্র কী বলবে বুঝতে পারছিল না। সাইকেলের হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে উজ্জয়িনীর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল পথ চলতি দু-তিনজন কাকু ‘লাভারস’ শব্দটা শুনে ওদের দিকে দেখতে দেখতে চলে গেল। উজ্জয়িনী আবার জিজ্ঞেস করে উঠল—

—কী রে? বল? কী আমরা?
—তাহলে আমরা কিছুই না? জাস্ট ফ্রেন্ডস? নাথিং মোর দ্যান দ্যাট?
—দেখ… আমার এমনিতেই ভীষণ মাথাব্যথা করছে। সাইনাসের প্রবলেম। এত এক্সপ্লেন করতে পারছি না। সামনে একজাম। প্লিজ… গ্রো আপ!

উজ্জয়িনী একাই এগিয়ে গেল, অভ্র আর গেল না ওর সঙ্গে। একটা ঠকে যাওয়া, হেরে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু দূর এগিয়ে উজ্জয়িনী একবার থামল, তারপর পেছন ফিরে বলল, আর শোন… বার বার মেসেজ করে বিরক্ত করিস না। রিকোয়েস্ট করছি।

আসলে যেটা বলতে চেয়েছিল, ‘শোন’ বলার পর সামনাসামনি সেটা বলে উঠতে পারেনি। ঘরে ফিরে অনেক রাত অবধি সামলে অবশেষে টেক্সট করল—

—দুবার চুমু খেয়েছিস, দুবার টি-শার্টে হাত ঢুকিয়েছিস আর রোজ দুবেলা গুড মর্নিং গুড নাইট পাঠাস বলে কোনও মেয়েকে বাপের সম্পত্তি ভাবা বন্ধ কর। নাহলে নিজেই ভুগবি। আমার নাটক আসে না। যেটা বলার, সেটাই স্পষ্ট বললাম।

তারপর ফোনটা সুইচ অফ করে দিল। অভ্রর উত্তর আর জানার নেই।

অভ্রকে সহজেই এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। ফোন না-ধরা, বা মেসেজের উত্তর না-দেওয়াটা কোনও কঠিন কাজ নয়। আর রাস্তায় দেখা করার কোনও চেষ্টাকেই প্রশ্রয় দেয়নি উজ্জয়িনী। ছেলেরা এইভাবে প্রত্যাখ্যাত হলে প্রথম কিছুদিন ঘ্যানঘ্যান করে… তারপরে গুমরোয় মনে মনে… আর শেষে মেয়েটা খানকি হয়ে যায়। উজ্জয়িনী খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল… ঠিক কতদিন লাগে ওর ‘খানকি মাগী’ হয়ে উঠতে। পরের সপ্তাহে কোচিং ক্লাসে অভ্রর সঙ্গে চোখাচুখি হল… কিন্তু কথা হল না। তার পরের সপ্তাহে উজ্জয়িনীর পেছন পেছন সাইকেল করে আসছিল, উজ্জয়িনী ইচ্ছে করেই গতি কমিয়ে দিয়েছিল… কিন্তু থামে না। অভ্র একসময়ে গতি বাড়িয়ে ওর কাছাকাছি এসে বলল— আর ডিস্টার্ব করব না… নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছি। ভাল থাকিস। উজ্জয়িনী শুধু বলেছিল— থ্যাঙ্কস্‌!

এর ঠিক তিনদিন পর, রাতে উজ্জয়িনীর ঘুম আসছিল না কিছুতেই। ও তো অভ্রর নাম্বার ডিলিট করেনি। অনেক ভেবে একটা মেসেজ করল— মেয়েদের পিরিয়ডের সময়ে মুড সুইং হয়… জানিস তো?

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনও উত্তর এল না। অভ্র এত তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না। আবার একটা এসএমএস পাঠাল উজ্জয়িনী— মেয়েদের মুড সুইং সামলাতে না জানলে গার্লফ্রেন্ড না থাকাই ভাল।

এর পনেরো মিনিট পর জ্বলে উঠল মোবাইল ফোনের নীল পর্দা। অভ্র উত্তর দিয়েছে— ওকে… মনে থাকবে।

উজ্জয়িনী এবারে ঠোঁট টিপে হেসে টাইপ করল— আমার নামে খিস্তি করছিলি অন্যদের কাছে?

আদৌ উজ্জয়িনীর পিরিয়ড চলছিল কি না, অভ্র জানত না; অভ্র এটাও জানত না যে সেদিন উজ্জয়িনীর ব্যবহারের কতটা মুড সুইং ছিল, আর কতটা মনের কথা। কিন্তু উজ্জয়িনী যেমন ভেবেছিল, ঠিক তেমনই হল। সামান্য কয়েক দিনের ব্যবধানে… একটু নরম হতেই অভ্র আবার গলে গেল। উজ্জয়িনীরও সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার সেই প্রবল ইচ্ছেটা দিন দশেক পরে আস্তে আস্তে অনেকটাই কমে গেল। তাও সেই উপলব্ধিগুলোকে একেবারে অস্বীকার করতে পারত না। ওগুলো যেন একটা অন্য স্তরে সচেতন অবস্থান। সেই সব ‘ফেলে দেওয়া’গুলো নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই… হালকা লাগছিল নিজেকে। হয়তো সেই কারণেই এত সহজে অভ্রর সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক কেমন… তা ঠিক করতে পেরেছিল। কমিটমেন্টের মতো দমবন্ধ করা একটা ব্যাপার, একটা ছেলের বান্ধবী মানে তার অলিখিত সম্পত্তি… এইসব কিছু থেকে এক ঝটকায় নিজেকে বার করে আনতে পেরেছিল উজ্জয়িনী। কোনও সম্পর্ককেই আর  বোঝা হতে দেয়নি।

***

 

Then the cold rains kept on and killed the spring, it was as though a young person had died for no reason. In those days, though, the spring always came finally; but it was frightening that it had nearly failed.

—Ernest Hemingway, A Moveable Feast

আজ, এত বছর পর  হঠাৎই অভ্রর মুখটা মনে পড়ে গেল। বোকা, কিছুটা আত্মকেন্দ্রিকও। এই ছেলেগুলো কেবল একজন বান্ধবী, এবং পরে সুন্দরী বউ জোটাতে পারলে নিজেদের বিশাল কিছু ভেবে ফেলে। একটু ঝকঝকে চেহারা, একটা বাইক… ‘মেয়ে তোলা’ যেন এদের বাঁ-হাতের খেলা। আসলে কতটা গাধা, আর অযোগ্য তা কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই ইগো হার্ট হয়ে যায়। নিজেদের আর সামলে রাখতে পারে না। এই গাধাগুলোকে ব্যবহারই করতে হয়। এদের ব্যবহার করার মধ্যে একটা আলাদা মজা আছে। যে ভাবে “দুনিয়া আমার পায়ের তলায়”, তাকে পায়ের তলায় ফেলে দেখিয়ে দিতে হয় আসল জায়গাটা। উজ্জয়িনী রীতিমতো এনজয় করত। তৃপ্তি পেত অভ্রকে আর অভ্রর মতো ছেলেগুলোকে তাদের আসল জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে।

কিন্তু কেন মনে পড়ল? অভ্রর কথাই কেন মনে পড়ল হঠাৎ? সেই চালের দানাগুলো হাতের তালুতে বন্দি করে ভাবছিল উজ্জয়িনী। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী চলে গেল, এই দানাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে। এগুলো উজ্জয়িনীরই দেওয়া চাল থেকে নেওয়া, না লোকটার ঝুলিতে আগেও কিছু ছিল? ওগুলো ফেলে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলতে পারত, কিন্তু পারল না। চালগুলো হাতের মুঠোয় চেপে ধরতেই অভ্রর মুখটা মনে পড়ে গেল… সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল এত বছর পর। সিনেমার দৃশ্যের মতো পর পর ভেসে উঠল চোখের সামনে। রান্নাঘরে এদিক ওদিক খুঁজে একটা গোলমরিচ রাখার ছোট খালি শিশি পেল উজ্জয়িনী। তার ঢাকনা খুলে, ভেতরে চালের দানাগুলো রেখে দিল। আর শিশিটা নিয়ে রেখে দিল আলমারির ভেতরে, পাট করা শাড়ির আড়ালে। আলমারির পাল্লা বন্ধ করতেই কেউ যেন ভেতরে ফিসফিস করে বলে উঠল ‘ঠিক এভাবেই সামলে রাখে অনেকে!’ নিজের দীর্ঘশ্বাসের শব্দে নিজেরই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল উজ্জয়িনীর।

দুপুরবেলা ইচ্ছে করেই ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখে উজ্জয়িনী। লোন আর ক্রেডিট কার্ড অফারের ফালতু ফোন আসে। অস্বস্তিকর! আর ফোন করারও তেমন কেউ নেই। মৃন্ময় দুপুরে ফোন করে না। শাশুড়ি শুধু ছেলের নম্বরে ফোন করে। নিজের কিছু বলার থাকলে ছেলেকে বলে বউমাকে ফোন দিতে। আর উজ্জয়িনীর নিজের বাড়ির কেউ রোজ রোজ ফোন করে না। সপ্তাহে দু-তিনবার কথা হয়। বোকা বোকা মেসেজ আর বর বা বন্ধুদের পাঠানো দুষ্টু জোকস ছাড়া দুপুরবেলা মোবাইলে আর দেখার কিচ্ছু নেই। মৃন্ময় আজ অবধি মুখে এইসব জোকস বলেনি… বলতে পারবেই না। অথচ বন্ধুদের পাঠানো যতরকম রসালো জোক্‌স আর মিম অনায়াসে উজ্জয়িনীকে ফরোয়ার্ড করে দেয়। মাঝে মাঝে আবার চোখ মারার ইমোজি থাকে সঙ্গে। উজ্জয়িনী হাসে— হা হা হা। একগাদা হাসির ইমোজি পাঠায়। একবার  রাতে মৃন্ময়ের কাঁধে মাথা রেখে উজ্জয়িনী বলেছিল— একটা জোক শোনাও। মৃন্ময় টিভির দিকে তাকিয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখছিল, হঠাৎ এমন আবদার প্রত্যাশা করেনি। একটু অবাক হয়ে বলল— হঠাৎ?

—আহা, বলোই না। তুমি একটা বলো… তারপর আমিও একটা বলব।
—এখন… জোকস?
—হ্যাঁ? অন্যসময় তো গাদা গাদা মেসেজ পাঠাও… এখন একটা বলতে পারছ না?
—ওহ… ও কি আর আমার বানানো? আসে, ফরোয়ার্ড করে দিই…
—আহ… বানাতে কে বলেছে? ওই আসা জোক শোনাও। নটি জোক!
—দুর… এখন মনে পড়ছে না। এহ… এটা হ্যান্ডবল হল?… দুর!

উজ্জয়িনী আর কিছু বলেনি। কিছু ছেলে অনেক কিছু করতে চায়, করতে পারে… কিন্তু মুখে বলতে সঙ্কোচ বোধ করে। এই পুরো ঘটনাটাই একটা জোকের মতো… তাই মৃন্ময় ‘দুর!’ বলতে জোক শোনার মতোই হেসে উঠেছিল ও।

মৃন্ময় জিজ্ঞেস করেছিল, কী হল?, উজ্জয়িনী সোফা থেকে উঠে পড়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে উত্তর দিয়েছিল, কিছুই না হাঁদু… কর্নার কিক আর ফ্রিকিক দেখো।

মৃন্ময় যে বিয়ের আগে যা কিছু করেছে… মনে পড়লে জোকস পড়ার থেকেও বেশি হাসে উজ্জয়িনী। সত্যিই হাসে, কারও মন রাখতে না। কলেজে দু-তিনটে সেয়ানা বান্ধবী বলত—

—প্রেম চুটিয়ে কর… কিন্তু বিয়ে করবি খুব সাবধানে। বাউন্ডুলে, বেপরোয়া, জেদি, দেখলেই প্রেমে পড়ে যেতে হয়… বিয়ে করতে নেই। বিয়ে করবি এমন ছেলেকে যে বোকাসোকা। জানবে, তার অওকাৎ-ই নেই তোর মতো বউ পাওয়ার। তুই যে ওর বউ হবি, এটাই বিশাল ব্যাপার। একেবারে পায়ে পড়ে থাকবে বিয়ের পর। তাই বলে… যে একেবারে বলদা টাইপ, তাও নয়। বুঝেছিস তো? একটু বোকা বোকা, বেশি মাথা চালাবে না আবার বেশি ‘ম্যা ম্যা’-ও করবে না… একটু প্র্যাকটিকালও। নাহলে আবার বাইরের লোক টুপি পরিয়ে দিয়ে চলে যাবে!

কথা শুনে মনে হত বিশাল অভিজ্ঞতা, বিস্তর গবেষণা করেছে এইসব নিয়ে। আর ওদের মতো কেউ অত বোঝে না। উজ্জয়িনী ইচ্ছে করেই এদের কথাগুলো চুপচাপ শুনত; নিজের মতামত প্রকাশ করত না। অনেক পরে যখন মৃন্ময়ের সঙ্গে দেখাশুনো চলছে বাড়ি থেকে, ফোনে কথা হচ্ছে… তখন এই কথাগুলোই এক এক করে মনে পড়ছিল। ছেলেটা তো আমার বাড়িতে এসে থাকবে না, আমাকেই ওর সঙ্গে গিয়ে থাকতে হবে। তাহলে আমিই বা বুঝে নেব না কেন?

না… মৃন্ময় ‘বলদা’ নয়। লেখাপড়ায় ভাল ছিল, কর্মঠ… মোটামুটি উন্নতি করারও ইচ্ছে আছে। কিন্তু উজ্জয়িনী যেটা সব থেকে বেশি অনুভব করে তা হল ‘গভীরতার অভাব’। এর ব্যাখ্যা উজ্জয়িনী নিজেও করতে পারবে না। কিন্তু ও জানে, উজ্জয়িনী কী ভাবছে… উজ্জয়িনী কী চাইছে— এসব কিছুই মৃন্ময় বুঝতে পারে না। ভাবার বা বোঝারও চেষ্টাও করে না সবসময়ে… পেরেও ওঠে না।

এর একটা সুবিধেও আছে। উজ্জয়িনী চাইলেই নিজেকে একদম নিভৃতে সরিয়ে নিতে পারে। মৃন্ময় ঘ্যান ঘ্যান করে না। বিছানায় টানাটানি করে না। উজ্জয়িনী একা সরে থাকলে, একাই থাকতে দেয়। নিজেও থেকে যায় একা। রাতের পর রাত একা থেকে যেতে পারে!

***

 

I’m wearying to escape into that glorious world, and to be always there: not seeing it dimly through tears, and yearning for it through the walls of an aching heart: but really with it, and in it.

—Emily Brontë, Wuthering Heights

ওই চালের দানাগুলো একরকম নেশার মতো। হাতের মুঠোয় নিয়ে বসলে আসতে আসতে চারপাশটা কেমন শূন্যে মিলিয়ে যায়। একটা থিয়েটার হলের সব আলো নিভে যাওয়ার মতো। শুধু এক বিস্তৃত পর্দা আর উজ্জয়িনী একা। দু-তিন দিন পর, আবার ভেতর থেকে একটা তেষ্টা জেগে উঠল। একটা অবসেশন। আবার একবার চালের দানাগুলো মুঠোয় ধরার জন্য শরীরটা কেমন করে উঠছিল। যেমন ড্রাগ অ্যাডিক্টদের হয়, শরীর অস্থির করে রক্তে ওই নেশার পদার্থ একটু না মিশলে।

দুপুরবেলা হলেই কেমন একটা অন্যমনস্কতা চেপে ধরছে উজ্জয়িনীকে। বইয়ের পাতা উলটোয়, গল্প-উপন্যাসে চোখ বুলোয়ে। টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেতরে একটা অন্যরকম বিচলন। যেমন, হঠাৎ অসময়ে কাউকে ভীষণ জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হল… অথচ তেমন কেউ নেই! মনে হচ্ছে ওই চালের দানাগুলোই যেন এর প্রতিষেধক। ওগুলো হাতের মুঠোয় ধরে বসে থাকলেই এই অস্বস্তি কেটে যাবে। সেই বৌদ্ধ ভিক্ষু যেন পরিকল্পনা করেই এসেছিল, উজ্জয়িনীকে সাময়িক নিরাময়ের প্রতিষেধক দিয়ে যেতে।

কানের কাছে, ঘাড়ের কাছে, গলা আর বুকের মাঝে… উত্তাপ বেড়ে যায়। ঠান্ডা জলের ঝাপটা নিয়ে কিছুক্ষণ ফ্যান চালিয়ে বসল উজ্জয়িনী। তারপর এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। ছোট শিশিটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরতেই যেন মনটা শান্ত হয়ে গেল। কটা চালের দানা হাতে নিয়ে খাটে বসল। তারপর শুয়ে পড়ল আসতে আসতে। চোখটা বন্ধ করে চুপ করে শুয়ে রইল… মুঠো বন্ধ হাত বুকের কাছে ধরে। মুঠের ভেতর সেই চালের দানাগুলো। বুকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা আর তালে তালে লাব-ডুব।

জীবন আপাতভাবে অদ্ভুত সহজ, জটিলতাহীন— এভাবেই দ্রুত জাজমেন্টাল হয়ে যায় অনেকেই। নিজের অসংগতি, সমস্যা, টানাপোড়েন… এগুলো কাউকে বোঝাতে পারে না উজ্জয়িনী। বলার আর ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছেও শাখানদীর মতো ক্রমে শুকিয়ে গেছে। পৃথিবীতে শোনার লোকের খুব অভাব। মৃন্ময় যতটা ওর বাবা-মাকে ভালবাসে, উজ্জয়িনী অতটা ভালবাসা নিজের মা-বাবার প্রতি ধরে রাখতে পারেনি। যা রয়ে গেছে, তা কর্তব্যবোধ। এখন মনে হয়— বিয়ে না হলেও, একদিন উজ্জয়িনী আর মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পারত না। থাকা হত না ওর। অসহ্যকর হয়ে উঠত একে অপরের কাছে। এই দূরত্ব, এই নির্বাসন… এক প্রকার আশীর্বাদ। সার্ভাইভিং উইথ আ প্রিভেইলিং সেন্স অফ ব্যালেন্সড ডিট্যাচমেন্ট।

—আখতার, তুই আজ মুর্শিদাবাদ ফিরবি না?

ভুরুর ওপর একটা ছোট্ট কাটা দাগ, রুক্ষ দাড়ি। ফুটবল দলের সেন্টারব্যাকে খেলা আখতার। সিলাহদারদের মতো চেহারা। ছ ফিটের ওপর উচ্চতা, চওড়া কাঁধ, বাঘের থাবার মতো হাতের তালু। অথচ শিশুর মতো মিষ্টি হাসি ছিল ছেলেটার। হাসলে চোখগুলো ছোট হয়ে যেত।

জঙ্গিপুরের ছেলে আখতার, উজ্জয়িনী বহরমপুরের মেয়ে জেনে একটা প্রতিবেশী-পরিচিত এমন সৌজন্য দেখাত। অন্য ডিপার্টমেন্ট। তাও দেখা হত, কথা হত। ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল সময়ের সঙ্গে। এক বছরের সিনিয়র ছিল,  দাদা ডাকটা ছেড়ে দিল উজ্জয়িনী কদিনের মধ্যেই। সিলাহদারই বটে… আখতারের সঙ্গে থাকলে মনে হত একজন দেওয়ালের মতো দেহরক্ষীর সঙ্গে আছে। কখনও নিরাপত্তাহীন মনে হত না। অন্য কোনও ছেলে কোনওভাবে সুযোগ নেওয়ার কথা মাথায় আনতে দুবার ভাবত। স্বাভাবিকভাবেই, পরিচিত ছেলে-মেয়ে দুপক্ষেরই ধারণা ছিল— নিজেকে সেফ রাখার জন্য আখতারকে হাতে রেখেছে। আর সব ঢপ। আসলে, এমন অনেক মেয়েকেই দেখেছে যারা কোনও অন্য পুরুষের নাম করে বলত তারা কমিটেড, কেবলমাত্র অন্য ছেলেদের দূরে রাখার জন্য। এটা হয়… কিন্তু উজ্জয়িনীর জন্য আখতার তেমন কেউ ছিল না। এটা কাউকে ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছে করত না ওর। নিজেকে মধ্যযুগীর রাজ-নন্দিনীর মতো লাগত আখতারের সঙ্গে বসে থাকলে, বা ওর সঙ্গে কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে। ওর চোখের ইশারায় কারও মাথা নামিয়ে দিতে পারে নাইট আখতার।

নাইট আখতার… আজ লালগোলায় খুব ভিড় হবে… বলে শিশুর মতো চোখ বন্ধ করে হাসছে। যেন হাত বাড়িয়ে দিলে গালটা পেতে দেবে সেই হাতের ওপর। কপালের কাটা দাগ, খড়খড়ে দাড়ি, রোমশ বুকে পুরুষালি স্বেদ-গন্ধ… চোখ বন্ধ করে শিউরে উঠল উজ্জয়িনী। ও কখনও ঘোড়ায় চড়েনি, দেখেছে দূর থেকে। খয়েরী রঙের, কালো রঙের, বাদামী রঙের পেশিবহুল ঘোড়া। শুনেছে প্রাণীদের মধ্যে ঘোড়ারও ঘামের গন্ধ হয়। আখতারকে মাঝে মাঝে মনে হত তেমনই বাদামী রঙের তেজি ঘোড়া। না, ঘোড়া না— সেনটর। কাউকে দেখে সুন্দর কিছু কল্পনা করতে ইচ্ছে হলে, তা ভাল করেই করা উচিত। নাইট আখতার উজ্জয়িনীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেত কলেজপাড়া দিয়ে। আর সেন্টর আখতার হেঁটে বেড়াত উজ্জয়িনীর ঘরে, সিঙ্গল বেড বিছানাকে প্রদক্ষিণ করে। গভীর রাতে যখন উইমেনস পিজির প্রায় সবাই আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, উজ্জয়িনীরও ঘর অন্ধকার। তখনই ঘড়ির কাঁটার মতো খুরের চাপা শব্দ তুলে ঘুরে বেড়াত সেন্টর। তার পেশিবহুল শরীর সেই আবছা অন্ধকারেও দেখতে পেত উজ্জয়িনী। বন্ধ ঘরে হঠাৎই জেগে উঠত অশ্বের স্বেদবিন্দুরা, তার ঘ্রাণ, তার শ্বাস-প্রশ্বাস।

কোনও মিথোজীবী সম্পর্ক ছাড়াই একটা সম্পদ ছিল আখতারের সান্নিধ্য। অথচ ছেলেটা যে মেয়েদের দেখতে ঘুরঘুর করত এমন না। কখনও উজ্জয়িনীর থেকেও কোনও সুযোগ প্রত্যাশা করেছে— এমনও হয়নি। আসলে আখতার ঠিক কী চাইত, আদৌ কিছু চাইত কি না— এটাই বুঝতে পারত না উজ্জয়িনী। আর নিজে যে এত কিছু চাইত, সেটাও প্রকাশ করত না। সে এক ব্যক্তিগত অবরোধ অথবা দ্বিধা প্রণালী।

আবেগ বললে আবেগ, ফ্যাসিনেশন বলে ফ্যাসিনেশন, ফেটিশ বললে ফেটিশ। সিনেমায় বা গল্পে-উপন্যাসে চরিত্রদের হঠাৎ কোথাও একটা রাত আটকে পড়ার দৃশ্য এলেই আফসোস হত। কত কিছু তো হয়… আখতারের সঙ্গে একটা রাতও কি কোথাও এভাবে আটকা পড়া যায় না? কে কী দেখে ভালবাসে, বলতে পারে না। আসলে ভয় পায়’— সেই রাতের দর্শন মনে পড়ে যায়। আখতারকে হঠাৎ করে কিছু বলে বসলে অনেক কিছুই হয়তো বদলে যাবে চিরকালের মতো। অনেক কিছুই ফুরিয়ে যাবে। মোহভঙ্গ… সেও এক অনিবার্য বেদনার অভিজ্ঞতা বটে!

অনেকেই পরিণতিহীন ভবিষ্যতের কথা ভাবে, কেন এটা স্থিতিশীল সম্পর্ক হতে পারে না— সেই যুক্তিগুলি ভাবে। আখতারের নামের আড়ালে যে ধর্মের ইঙ্গিত— উজ্জয়িনীর কাছে এর চেয়ে ভাল যুক্তি কিছু হতেই পারে না। কিন্তু উজ্জয়িনী এসবের দিকে পা-ই বাড়ায়নি। ও নিজের চিন্তা আর চাহিদার কাছে সৎ ছিল। এসব কিচ্ছু না, ও শুধু চেয়েছিল ওর নাইটের সঙ্গে কিছুটা একাকিত্বের মুহূর্ত। ওর সেন্টরের পিঠে উঠে একবার ঘুরে দেখতে গভীর অরণ্যে হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা সেই তৃণভূমি। যা বারবার স্বপ্নে এসে অধরা থেকে গেছে। যেখানে বিশাল আকৃতির শম্বর-মিথুন চন্দ্রালোকে দৈব হয়ে ওঠে। যেখানে অসংবৃত মর্মতন্তু আর অনুভূতি ইচ্ছেরা জোনাকি হয়ে উড়ে বেড়ায়। পৃথিবীর প্রবল প্রতাপী সেন্টর নতজানু হয় কেবল একটি মাত্র মানবীর কাছে। যার কাছে তার নতজানু হওয়া সাজে। তাদের একটা আলাদা লোককথা অথবা পৌরাণিক অধ্যায় কি প্রাপ্য ছিল না? তাদের পুত্রের বীরত্ব, কন্যার লাবণ্য অথবা করুণ বিরহের গাথা নিয়েই কি হোমারের মতো কেউ একটা নাটক লিখে যেতে পারতেন না? কত কিছুই তো হয়!… কত কিছুই তো ঘটে যায় আপাত অবাস্তব, অপরিকল্পিত।

কলেজের দিন ফুরিয়ে গেল, আখতারকে ব্যক্তিগত জ্যোৎস্নায় একটা চুমুও খেতে পারল না… ওর আগেই কলেজের অন্তর্দশা কাটিয়ে চলে গেল আখতার। ভৌগোলিক দূরত্বকে ছাপিয়ে বেড়ে গেলে মানসিক দূরত্ব! সেন্টরের খুরের শব্দ, ঘামের গন্ধ… একটু একটু করে ফিকে হয়ে গেল। একসময়ে আর ফোনও করত না ছেলেটা। সামনাসামনি দেখা না হলেও… মনে হত, কেমন বদলে যাচ্ছে হঠাৎ। শেষ কথা, জানল দুবাই চলে যাচ্ছে চাকরি নিয়ে। ভাল চাকরি, অনেক মাইনে। মনে হল আরব সাগর পার করে মরুভূমির বালি উড়িয়ে চলে যাচ্ছে সেন্টর। পেছনে ফিরেও তাকাল না একবারের জন্য। পিছু ডাকতেও ইচ্ছে হল না।

কাকে কীভাবে আঁকড়ে রাখা যায়… আমি জানি না! আমি জানি— কিছুই শেষমেশ আঁকড়ে রাখা যায় না। যা থেকে যায়, তা প্রাপ্য। অথবা অর্জন। থেকে যায়…

অস্ফুটেই কথাগুলো বলতে বলতে চোখের কোণ দিয়ে উষ্ণ একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে বদলে গেল জ্যোৎস্না-স্নাত সেই তৃণভূমির রূপ, যেখানে এক লোককথার ভ্রূণ বেড়ে উঠেছিল অনেক দিন আগে। উজ্জয়িনী বুঝতে পারল জানলা দিয়ে অবেলার রোদ এসে চোখ জ্বালা করছে। হাতের মুঠো ঘামে ভিজে গেছে। ঘামে ভিজে গেছে চালের দানাগুলো। হাতে ময়েসচারাইজারের গন্ধ, ছাপিয়ে সেন্টরের শ্বেদ-পরিমল ছড়িয়ে আছে ঘরে। মনের ভুলকে অতিক্রম করে অপ্রত্যাশিত আরও কিছু ছড়িয়ে আছে এই অবেলায়।

***

 

Here I am, a bundle of past recollections and future dreams, knotted up in a reasonably attractive bundle of flesh. I remember what this flesh has gone through; I dream of what it may go through.

—Sylvia Plath, The Unabridged Journals of Sylvia Plath

পরিচিত মুখগুলো একে একে আসে, তাকিয়ে দেখে। কথা না বলেই চলে যায়। প্রত্যেকেই যেন নিজের মতো করে কিছু পর্যবেক্ষণ করে চলে গেল। কারও কারও মুখে অদ্ভুত হাসি। তা শুধুই সৌজন্যের না বিদ্রূপের বোঝা মুশকিল। অনেকদিন পর কোনও নিমন্ত্রণ বাড়িতে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে তো এভাবেই হাসে মানুষ। কিন্তু শুধুই কি হাসে? কথাও তো হয়। একটু খোঁজ-খবরও তো নেওয়া হয়! এরা কেউই কথা বলছে না, দেখে চলে যাচ্ছে… হেসে চলে যাচ্ছে। কেমন জলের ওপর প্রতিবিম্বের মতো দুলে দুলে উঠছে মাঝে মাঝে। তখনই, অদ্ভুত লাগছে খুব। নিজের আর তাদের এই অস্তিত্ব, উপস্থিতি— খুব অদ্ভুত লাগছে! সজলদা চলে গেল, মিনতিমাসি চলে গেল, দিদুন চলে গেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে। দাদুভাই পাশ দিয়ে চলে গেলেন না তাকিয়েই। ছোটবেলা থেকে দেখা কত চেনা মানুষজন সব। কেউ বাড়িতে কাজ করত। কেউ পাড়ার দোকানের কাকু। কারও দোকানে রোজ চা খেতে যেত বন্ধুদের সঙ্গে। অনেকের কথা তো খেয়ালই ছিল না এত বছর পর… তারা কে কোথায় আছে, কেমন আছে— কিছুই জানে না। জানার কথাও না। তারাও কি কেউ মনে রেখেছে উজ্জয়িনীকে? রাখার কথা? অথচ কেমন জলের মৃদু তরঙ্গে অবয়বের মতো কম্পনে কম্পনে দেখে, ভেবে, হেসে চলে যাচ্ছে। কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করলেও ডাকতে পারছে না। স্পর্শ করতে ইচ্ছে করলেও ছুঁতে পাচ্ছে না।

হঠাৎ উপলব্ধি হল— আসলে জলই! জলের একটা স্তরের ওপারে ওরা সবাই আর এপারে উজ্জয়িনী একা। হঠাৎই মনে হল, সবাই ক্রমে দূরে চলে যাচ্ছে। ঝাপসা হয়ে আসছে। না, তারা দূরে যাচ্ছে না। ও নিজেই তলিয়ে যাচ্ছে জলের গভীরে। ক্রমশে অনেক ওপরে চলে যাচ্ছে যা কিছু দৃশ্যমান, আলোকরশ্মিরা। সব কিছু মিশে যাচ্ছে জলতরঙ্গে, আর ছড়িয়ে থাকা মায়াবী সাগর-সবুজ আলোয়ে। মনে হল, বুকে একটা চাপ পড়ছে। চাপটা বাড়ছে ক্রমাগত। জলতলের নিচে, এত গভীরে আর নিঃশ্বাস ধরে রাখতে পারছে না। শ্বাস নেওয়াও সম্ভব নয়!

আর, জল ঠেলে ওপরেও উঠে আসতে পারছে না…

—হা-আ-আ-আ-ক!

অন্ধকার ঘরে উঠে বসে হাঁফাতে লাগল উজ্জয়িনী। নিঃশ্বাস একেবারে বন্ধ হয়ে গেছিল, জলের মধ্যে অনেকক্ষণ ডুবে থাকলে যেমন লাগে। ও কখনও বাথটাবে স্নান করেনি, সুইমিং পুলেও ডুবে দেখেনি যে জলতলের নিচ থেকে ওপরটা কেমন লাগে। তাও কেমন স্পষ্ট এই অনুভূতি। স্বপ্নের মধ্যেই তলিয়ে যেতে যেতে দমবন্ধ হয়ে গেল! হাত বাড়িয়ে জল খাওয়ার জন্যেও একটা শারীরিক ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। সেই শক্তি ভেতরে পুঞ্জীভূত করতে করতে ও তাকাল ঘরের চারপাশে। মনটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। সিলিং ফ্যান ঘোরার শব্দ হচ্ছে। জানলার পর্দা ভেদ করেই ঘরের মেঝেতে এসে পড়ছে রাস্তার আলো। হাতকাটা গেঞ্জি করে উপুর হয়ে ঘুমোচ্ছে মৃন্ময়।

মৃন্ময় বা শ্বশুরবাড়ির কাউকেই স্বপ্নে দেখেনি উজ্জয়িনী। মৃন্ময়কে এর আগেও কখনও কোনও স্বপ্নে দেখেছে বলে মনে পড়ল না। দেখেছে কি?

গভীর রাতে মৃন্ময়কে এভাবে উপুর হয়ে ঘুমোতে দেখলে শিশুর মতো মনে হয়। হয়তো, অনেককেই ঘুমের মধ্যে এমন নিষ্পাপ দেখতে লাগে। কিন্তু মৃন্ময়কে যেন একটু বেশি ভালনারেবল লাগে। সত্যিই তো, না কোনও জোর খাটাতে চায়… না দাবি। এমনকি যে পুরুষোচিত ইগো খুব স্বাভাবিকভাবেই ছেলেদের মধ্যে এসে যায়, তারও তেমন বহিঃপ্রকাশ নেই। মানুষ সময়ের সঙ্গে, বয়সের সঙ্গে বদলে যায়। একে অপরের সম্বন্ধে ধারণাও বদলে যায়, একসঙ্গে অনেকগুলো বছর থাকতে থাকতে। কবছর পর কেমন হয়ে যাবে কে জানে! এমন বালকের মতো ঘুমন্ত মৃন্ময়ের মাথায় আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করে উজ্জয়িনীর। চুপচাপ তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে অল্প আলোয়। সম্ববত এইটাই সেই সময়, যখন মৃন্ময়কে সব থেকে সুন্দর লাগে উজ্জয়িনীর। ভালবাসতে ইচ্ছে করে। সম্ভোগবাসনাকে বহুমাত্রায় ছাপিয়ে যায় স্নেহ।

সাবধানে কয়েক ঢোক জল খেল নীল রঙের কাচের বোতল থেকে। একটু জল নিয়ে চোখে আর ঘাড়েও দিল। আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক লাগছিল উজ্জয়িনীর। কিন্তু ঘুমটা ফিরে আসতে চাইছে না আর আগের মতো। মাথা ভারী লাগলেও, চোখের পাতা বন্ধ হতে চাইছে না নিশ্চিন্তে। স্বপ্নে দেখা পরিচিত মুখগুলো একে একে ভেসে উঠছে ফ্ল্যাশকার্ডের মতো। অনেক রাত, আর পাড়াটাও নিঝুম। নাহলে একটু বারান্দায় গিয়ে বসলে হয়তো এই অবস্থাটা কেটে যেত।

এই পাড়াটা খুব একটা ভাল লাগে না রাতের দিকে। বাইকের শব্দ করে অল্পবয়সী ছেলেরা যাওয়া আসা করে। কুৎসিত শব্দ করে চেঁচিয়ে ওঠে। এদের অ্যাডরেনালিন রাশ এমন কুঃস্বর আর অসভ্যতায় এসে ঠেকেছে। কেউ কিছু বলবে না, কারও সাহস নেই ওদের থামানোর বা উচিত শিক্ষা দেওয়ার— এই বিশ্বাসটাই একটা আলাদা শক্তি এদের। পদে পদে প্রমাণিতও হয়— ওদের এই বিশ্বাস কতটা অভ্রান্ত। মৃন্ময় বারণ করে, উজ্জয়িনীও অনুভব করে— আসলে ওরা কতটা দুর্বল এখানে, এদের কাছে… এইসব কিছুর কাছে। দুর্বল হওয়া দোষের নয়। যারা জ্ঞান দেয়, তাদেরও পাওয়া যায় না বিপন্নতা গ্রাস করলে। আগে জ্ঞান আর পরে আহা— সেই সময়ে শুধু শূন্যতা, অসহায়তা আর একাকিত্ব। এরকম ভয়ে ভয়ে থাকিস কেন ওখানে?… জিজ্ঞেস করে কেউ কেউ। মাঝেমাঝে নিজেকেও জিজ্ঞেস করে, মৃন্ময়ের দিকে তাকায় কিছু জিজ্ঞেস না করেও। ভেতর থেকে আর মৃন্ময়ের নীরবে আত্মসমর্পণ করা দৃষ্টি থেকে একটাই উত্তর আসে— কোথায় যাবে? যাবে কোথায় এসব থেকে পালিয়ে?

…এইসব চিন্তা মুখগুলোকে থিতিয়ে দিতে বা স্বপ্নের দৃশ্যগুলো অন্তরালে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। একটা একটা করে মুখগুলো রিভলভিং স্টেজে ঘুরতে ঘুরতে এসে চলে যাওয়ার পরেও একটা মুখ গেল না। একটা মুখ বার বার ঘুরে ফিরে আসছে— বিদিশা!

মাস্টার্সের সময়ে যে উইমেন্স হস্টেলে থাকত, তার রুমমেট ছিল বিদিশা। ওরই বয়সী… অন্য কলেজের ছাত্রী। ইংরেজি কবিতা পড়তে ভালবাসত। বিশেষ করে নারী সাহিত্যিকদের। এমন অনেক কবি আছেন, যাঁদের নাম ওর থেকেই প্রথম শুনেছে উজ্জয়িনী। তাঁদের কবিতা পড়ার আগ্রহ আগে না থাকলেও, বিদিশার মুখে সেসব কবিতা শুনতে ভাল লাগত। বিদিশা কেমন গল্প আর ইতিহাসের মতো বলে শোনাত সেই সব কবিদের জীবনের কথা। কবিতাগুলো মনে হত তাঁদের নিজেদেরই কথা। কেন মনে হত জানে না, অত ব্যাখ্যাও মনে নেই। কিন্তু মনে হত। বিশেষ করে বুকে ভারী পাথরের মতো চেপে বসত তাঁদের ছবি আর তাঁদের কবিতাগুলো— যাঁরা আত্মঘাতী।

বিদিশা কেন ওভাবে এক-একজন কবির আত্মঘাতী হওয়ার প্রসঙ্গে এত আগ্রহী হয়ে উঠত, বুঝতে পারত না। অস্বস্তি হত। ঘরের পরিবেশটাই অন্যরকম হয়ে যেত গভীর রাতে কোনও আত্মঘাতিনীর শেষ কবিতা, শেষ চিঠি… এইসব শুনতে শুনতে। বিদিশা যে খুব চাপা স্বভাবের ছিল এমন না। কিন্তু খুব একটা হাহা-হিহি করত না, মনে হত— সকলের সঙ্গে সমানভাবে মিশতও না। গানপাগল, কবিতাপাগল মেয়ে। একা একা চোখের জল ফেলত গান শুনতে শুনতে। উজ্জয়িনী ইচ্ছে করেই তখন কিছু জিজ্ঞেস করত না। কাঁদতে দিত ওকে। মানুষ নিভৃতে কাঁদলে তাকে প্রশ্ন করে বিব্রত অথবা আহত করতে নেই। উজ্জয়িনীর নিজেরও কষ্ট হয়, তাই বুঝত। মনে মনে ধন্যবাদ জানাত ঈশ্বরকে… যে বিদিশার মতো সেনসিটিভ কাউকে পেয়েছে রুমমেট হিসেবে। এ যেন এক অদ্ভুত প্রাপ্তি। একটা মন-খারাপ আর একটা মন-খারাপকে জড়িয়ে একের পর এক মরশুম কাটিয়ে দিচ্ছে। অভিযোগহীন, দ্বন্দ্বমুক্ত। এক-একদিন কোনও কথাই হত না একই ঘরে থেকেও। আবার এক-একদিন সারা-রাত জেগে কত কথা… যতক্ষণ না বৃষ্টি ধরছে আকাশে।

—হাত-টা একবার দে দেখি এদিকে…

খয়েরী রঙের কাপড়ের ওপর হলুদ-নীল সুতোর কাজ করা একটা রাখীর মতো বেঁধে দিল। আসলে কাপড়ের ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডই মনে হবে। কিন্তু ফিতে দিয়ে বাঁধা। সেদিন রাখীপূর্ণিমা ছিল। সারা দিন ব্যস্ততায় কেটে গেছে। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। ঘরের আলোও নেভানো হয়ে গেছে। দেওয়ালে নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে শুধু। নিজের  বিছানার চাদর পরিষ্কার করে টানটান করে পেতে উপুর হয়ে শুয়েছিল উজ্জয়িনী। জানলার বাইরে তাকিয়ে ইয়ারফোনে গান শুনছিল। হঠাৎই গানের সুর পেরিয়ে বিদিশার গলার আওয়াজ পেল… ওকে ডাকছে।

উজ্জয়িনী ওর দিকে চুপ করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। বন্ধুদের কাছ থেকে ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বা রাখী পাওয়ার অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনও বিস্ময় বা অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়ার অনুভূতি জাগেনি উজ্জয়িনীর কখনও। কিন্তু বিদিশা যেন সারাদিন অপেক্ষা করেছিল… শুধু এইটুকুর জন্যই। যেন এই মুহূর্তটাকেই বেছে নিয়েছিল… কেন বেছে নিয়েছিল?

চাঁদের জ্যোৎস্না পুরনো বাড়ির জানলার গরাদ ছুঁয়ে মেঝেতে এসে লুটিয়েছিল। পুরনো ঘর, পুরনো চুন খসা দেওয়াল নাইট ল্যাম্পের আলোয় অন্যরকম লাগে মাঝে মাঝে। এমন চাঁদের আলো এসে পড়লে আরওই অন্যরকম লাগত। খরগোশের মতো হাত বুলোতে ইচ্ছে করছিল দিনের শেষে পাওয়া এই ভাললাগার কপালে আর পিঠে। কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারছিল না। মুখ ফসকে বলে ফেলল— কিন্তু আমি?… আমার কাছে আজ…

বিদিশা বাধা দিয়ে বলল, থাক। তুই আবার আমাকে কী দিবি? তারপর হাসল… হাত বাড়িয়ে বলল, ইয়ারফোনটা দে… এবার আমি শুনি।

ওর ইয়ারফোন আছে, তাও বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজের ইয়ারফোনটা রেখে দিল উজ্জয়িনী। হাতে রাখীটা পরেই শুয়ে পড়ল আবার। মনে হচ্ছিল বিদিশাই ওর হাতটা ধরে আছে। আশ্চর্য, বিদিশা আর একটা কথাও বলল না। কানে ইয়ারফোন দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।

—যখন একা হয়ে যাই, তখন— যে পাশে থাকে… সে পাশে থাকে। যে পাশে থাকে… সে কি হাতের পাঁচ?

জ্বরের মধ্যেই কথাগুলো বলেছিল বিদিশা। কেন হঠাৎ বলে উঠল বুঝতে পারেনি উজ্জয়িনী। ভুলতেও পারেনি। কিন্তু মনে হচ্ছিল দুটো সিঙ্গল বেডের মাঝে যে দূরত্ব তাতে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিস্তৃতি। এত দূরে থাকলে এমনিতেই দুজনে একা হয়ে যাবে আরও বেশি। সেদিন জ্বর না কমা অবধি বিদিশার খাটে বসেছিল উজ্জয়িনী। হস্টেলে মশা হত খুব, মশারি টাঙাতে হত। মশারির ভেতরেই বসে ছিল ওকে ছুঁয়ে। জলপটি রাখতে দিচ্ছিল না বিদিশা, কাৎ হয়ে ফেলে দিচ্ছিল কপাল থেকে ভিজে কাপড়ের টুকরো। একটু জোর করতে হচ্ছিল মাঝে মাঝে। ডিলিরিয়ামের মধ্যে ছিল। গা পুড়ে যাচ্ছে, ১০৩ ফারেনহাইট, কমে ১০১ অবধি নেমে আবার উঠে যাচ্ছে। ওকে বুকের কাছে রেখে আধশোয়া হয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল একটা রাত। ভোরের দিকে চোখ লেগে গেছিল, যখন ঘুম ভাঙল… শিশুর মতো ওর বুকে মাথা গুঁজে ঘুমোচ্ছে বিদিশা… কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

ওই ঘরটার ছিটকিনি তুলে দেওয়ার পর ওদের যে জগৎটা জেগে উঠত, তার সম্পর্কে বাইরের জগৎ কোনওদিনই কিছু জানতে পারল না। ওদের মধ্যে কীভাবে কয়েক লাইনের চিঠি লেখা হত, কোন ঠিকানায় যেত সেই সব চিঠি, কেমন উত্তর আসত— কিচ্ছু না। কীভাবে সেই সাধারণ পুরনো মশারি হয়ে উঠত জঙ্গল বা পাহাড়ি নদীর ধারে অস্থায়ী ক্যাম্প— তাও না। সেই জগতের নিজস্ব ভাষা, প্রকৃতি, সঙ্গীত, উপকথা, লোকাচার, খাদ্য, মাদক, সঙ্গমরীতি— সব কিছুই একেবারে অজানা অদৃষ্ট হয়ে থেকে গেল। এবং এই যে অজানা থেকে গেল, তা আরও বেশি করে এখন বিশ্বাস করার কারণ যে— যা ঘটে, ভালর জন্যই ঘটে।

দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, অথবা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নিয়ে কিছুই মনে হয় না আর আলাদা করে। ওরা দুজনেই সচেতনভাবে সরে গেছে দুজনের গতিপথ থেকে। কোনও অভিযোগ এবং ক্ষোভ ছাড়াই। অন্তত উজ্জয়িনীর মনে কোনও ক্ষোভ নেই। অভিমান? তার ওপর আর কার নিয়ন্ত্রণ থাকে?

‘নির্জন সৈকতে’ দেখতে দেখতে রেণুকা রায় আর কোনারকের জ্যোৎস্নার দৃশ্য এলে হস্টেলের জানলাটা মনে পড়ে যায়— শুধু মুখে বলেছি বলেই এই?

পরিণতি আর প্রত্যাশার কিছু দূরে ভাল থাকারও একটা ইচ্ছে থাকে। সব সময়ে এদের মধ্যে মতের মিল হয় না। ওরা দুজনেই ভাল থাকতে চেয়েছিল, নিজের মতো করে। ওদের নির্মিত জগৎটা ওই ঘরের থেকে বেশি সুখী আর কোথাও থাকতে পারত না। উজ্জয়িনী এগুলো নিজেকে সচেতনভাবেই বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পুরনো কথা মনে পড়লে।

বিদিশাই বা অন্যদের থেকে আলাদা কেন হবে? শুধু মেয়ে বলে?

Point of Eden, next the new moon’s curve.
Go, ghost of our mother and father, ghost of us,
And ghost of our dreams’ children, in those sheets
Which signify our origin and end,
To the cloud-cuckoo land of color wheels

জ্বরের ঘোরে বকে যাচ্ছে বিদিশা, উজ্জয়িনী কিছুই বুঝতে পারছে না… অস্পষ্ট শব্দগুলো ছাড়া।

পরে জেনেছে খুঁজে খুঁজে। একা।

মুখগুলো জলে টলমল করা প্রতিবিম্বর মতোই দুলছে আবার। বিদিশা, হস্টেলের অন্যরা, সেই ঘরটা, জানলা, চুন খসা দেওয়াল…

চালের পাহাড়, মরুভূমিতে জেগে থাকা একের পর এক ডিউনের মতো। তার ওপর জানলার গরাদের দীর্ঘ ছায়া বুকে নিয়ে এসে লুটিয়ে পড়ছে জ্যোৎস্নার আলো। খুব পরিচিত সেই জ্যোৎস্নার ছবি।

চাল সরিয়ে সরিয়ে বিদিশার মুখটা উঠে আসছে জানলার খোঁজে,  তাকিয়ে আছে সহস্রাব্দ অতিক্রম করা আকুতি আর অপেক্ষা নিয়ে। লোকসঙ্গীতের সুর বেজে উঠছে রাওয়ানহত্তার তারে তারে।

জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি…

***

 

Something in the air revealed the presence of an invisible person who was smiling in the darkness. Good Lord, I thought then, confused by the mixup in time. It wouldn’t surprise me now if they were coming to call me to go to last Sunday’s mass.

—Gabriel Garcia Margquez, Monologue of Isabel Watching It Rain in Macondo

ক্রমানুসারে বেশ কয়েকটি শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ অতিক্রান্ত হল। এখন বাহ্যিক এবং আপাত প্রয়োজনীয় সংসারযাপনের মাঝেই উজ্জয়িনীকে ঘিরে থাকে অভ্রের মতো উজ্জ্বল ভাসমান স্মৃতিকণিকা, অর্জনের পরাগরেণু। এখন আর আলাদা করে চালের দানাগুলো হাতের মুঠোয় নিয়েও বসে থাকতে হয় না উজ্জয়িনীকে। খুব স্পষ্টভাবেই অনেক কিছু বুঝতে পারে, গুরুত্বপূর্ণ আর গুরুত্বহীন সম্পর্কে আগে যে সব ধারণা থেকে সাময়িক বিহ্বলতা আর দ্বিধা জন্ম নিত, আর আগের মতো বিব্রত করে না। দু-একবার ভেবেছে এর মাঝে, এইবার এইসব চালের দানা… এও বিসর্জন দিতে হবে। দেওয়া প্রয়োজন, ঠিক যেভাবে প্রাক-যৌবনকালে কিছু অঞ্জলি দিয়েছিল ভাগীরথী-স্রোতে। কিন্তু কী করলে উপযুক্ত বিধি পালন হয়, বুঝে উঠতে পারে না। একবার এক চমৎকার পন্থা মনে এসেছিল— সেই চাল দিয়ে পায়েস রান্না করবে। কিন্তু সেই পথেও অবরোধ এল। দুধ জাল দিতে দিতে ঘন হয়ে গেল, কিন্তু চাল সেদ্ধ হল না। কী আশ্চর্য! এমন এর আগে কখনও হতে দেখেনি উজ্জয়িনী। সব চাল আলাদা করে রেখে দিল আবার, ফিরিয়ে দিল সেই গোলমরিচের কৌটোয়। এর পর থেকে চালের দানাগুলি হাতে নিলেই ঘরে এক অদ্ভুত গন্ধে ম ম করত… পরমান্নের সুবাস।

এই স্মৃতি-কণিকাদের বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ নেই, ভীতিও নেই যে এদের হাত থেকে যে কোনও উপায়ে পরিত্রাণ পেতে হবে। কিন্তু ক্রমেই মনে হতে লাগল এরা এই ক্ষুদ্র কৌটোয় ততটাই আবদ্ধ, যতটা উজ্জয়িনী এই ঘরে। আর এদেরও কোথাও একটা কোনওভাবে ফেলে দেওয়া যায় না, যেমন নিজেকেও বিলিয়ে দেওয়া যায় না যে-কোনও হাতে। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে হয়, অপেক্ষা করতে হয় উপযুক্ত মার্গের। অথচ সেই শ্রমণের আর এই অঞ্চলে বা কাছে-দূরে কোথাও দ্বিতীয়বার দর্শন পেল না উজ্জয়িনী।

দিব্যালোকে করুণা অথবা স্মিতহাস্য নিয়ে কেউ তাঁর অমোঘ উপস্থিতি প্রকাশ করছে— এমন কল্পনা দ্রুত মনে আসে। অথচ ভীষণ অন্ধকারেও যে কারও করুণা অথবা কৃপাস্পর্শ অনুভূত হতে পারে, এ ধারণা সহজে জন্মায় না। প্রত্যশাধারণ আর প্রত্যাশাপূরণের মাঝেও অনেকটা অন্তর থাকে। অন্য ব্যক্তিদের প্রত্যাশা জগদ্দল হয়ে বুকের ওপর চেপে বসে। সিসিফাসের মতো সে পাথর ঠেলেঠেলে আজীবন চড়াই বেয়ে উঠে যাওয়ার ইচ্ছে কেন হবে সকলের? কেন নত থাকবে এমন দায়ভার বহনের ইচ্ছের কাছে? সন্তানধারণ করার সময় ক্রমেই আসন্ন হবে… অদূর ভবিষ্যতে— এই প্রসঙ্গে চিন্তা এলেই এই প্রত্যাশাবলয়ের বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হয়। কিন্তু কাউকে দোষও দেওয়ার নেই, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগও করার নেই।

দুপুরের খাওয়া শেষ হলে গর্ভবতী মা-বেড়ালকে কিছুটা মাছ সহ ভাত দিয়েছিল একদিন। পরদিন খাওয়ার সময়ে পাঁচিলে এসে বসে রইল সে। এবং তারপর নিয়মিতই এসে বসে থাকে, নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই। তার সন্তানেরা পৃথিবীতে এলে, তাদেরও কাছাকাছিই রাখতে চাইবে… এবং খাওয়ার সময়ে তাদের নিয়েই আসবে। ওর ক্রমে প্রস্তুত হয়ে ওঠা গর্ভের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উজ্জয়িনী অনুভব করে আবারও— মোহ আর মোক্ষ, কীভাবে একে অপরের কাছাকাছি বয়ে যেতে যেতে দূরত্ব নির্মাণ করে নেয়। বেড়ালের শরীরের ভেতর নিজেকে কল্পনা করে। অবচেতনেই, জরায়ুতে অনুভব করে কারও নড়াচড়া।

জড়িয়ে পড়তে পড়তে, ডুবে যেতে যেতে, হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে উদ্ধার করে নেওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছার সঞ্চার হয়। কিন্তু কীসের থেকে, কাদের থেকে বুঝতে পারে না। বাবা-মা, স্বামী-সংসার, নিজস্ব পরিচিত বৃত্তে এই জীবন— এর মধ্যে তো এমন কিছু জটিলতা অথবা সঙ্কট নেই! তাহলে এই আকস্মিক অপূর্ণতার হেতু কী? এই দুঃখ-সচেতনতাই বা কীসের? অলস সময়ের বিলাসিতা?

অথচ… এখন আর চালের দানা হাতে নিতে হয় না। এমনই অনেক কিছু বুঝতে পারে। সঙ্গমকালেও বুঝতে পারে— কখন নিজেকে চরমাবস্থায় সামলে নিতে হয়। নিঃস্পৃহ অথবা নিরাসক্ত থাকতে হয় অন্তর থেকেই। পাশে পুরুষ সঙ্গমপরবর্তী ক্লান্তির ঘুমে হারিয়ে গেলে, সেই অন্ধকারেই উজ্জয়িনীয় দেখতে পায় সুড়ঙ্গপথের শেষে আলো… আলোর দিকে এগিয়ে গেলে আবার আর একটা বাঁক। পুত্র-পৌত্রাদি নিয়ে আরও পঞ্চাশ বছর এভাবে কাটিয়ে গেলেও… একটা কয়েক মুহূর্তের টাইম ক্যাপসুল হয়ে থেকে যাবে এই সবকিছুই। এইটুকুর জন্যেই আসা আর চলে যাওয়া। অথচ নিজেকে এই ব্যূহ থেকে উইদড্র করে নেওয়ার মার্গ কি থাকে না?… নিশ্চয়ই থাকে!

রাতের পর রাত, মৈনাকের পিঠের ওপর লুটিয়ে থাকে জানালা দিয়ে আসা জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নাচিত্রের দিকে তাকিয়ে থেকেছে উজ্জয়িনী। নিজের উন্মুক্ত শরীরকেও দেখেছে সেই একই আলোয়। তখনও সে শরীরে মৈনাকের গন্ধ আর রস লেগে আছে। শুভ্র জ্যোৎস্নালোক উজ্জয়িনীকে বকুলফুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। যে বকুলগাছ প্রথম যৌবনের স্নিগ্ধ বাসনাতরু, যার শাখায় প্রতি বসন্তে পূর্ণচন্দ্রের অপেক্ষায় রাত জেগে থাকে কোনও চকোর, সে বকুলফুলের গাছেরও একসময়ে আয়ুষ্কাল ফুরোয়। কিন্তু অঞ্জলি ভরে ফুল যার নিয়ে আসার কথা, সে আর আসে না। অঞ্জলি ভরে ফুল যাকে দেওয়ার কথা, সেও না। মুহূর্ত ঝরে পড়ে বকুল, চালের দানার মতো ছড়িয়ে থাকে উজ্জয়িনীর চরণতলে। অপেক্ষা করতে মানুষের শেকর আর শাখাপ্রশাখা জন্মায়। মাটির গভীরে যায়। কিন্তু গাছের ভেতর অন্য কেউ থাকে না। অন্য কারও ভেতরে গাছ থাকলেও থাকতে পারে।

কৃপাবঞ্চিতই যারা চলে গেল, যাদের কানে কানে আর মুক্তিমন্ত্র দিল না কেউ— সেই সব শরণার্থীদের ভাল থাকার কি কানাকড়ি দাম থাকবে না তবে?

টাওয়ার অব সাইলেন্স হয়ে উঠবে শোওয়ার ঘরের বিছানা, রাতের পর রাত? অথচ, মৃন্ময়েরও তো চাহিদা আর অধিকার থেকে যায়। তাকে বঞ্চিত করাও কি পাপ নয়? তার ভোগ্য হয়ে একটা দুর্লভ জীবন অতিবাহিত করা— সেও কি পাপ নয়?

নিজেকে বৃক্ষের ফলের মতো মনে হয়। নারী মাত্রই বৃক্ষ, যার জন্মই ফুল, ফল আর ছায়া দিয়ে যেতে। কখনও নিজেই ফুল অথবা ফল হয়ে যেতে। তাকে গ্রহণ অথবা ভক্ষণ করে পুরুষের তৃপ্তি।

দিক-পরিবর্তন করে উত্তর দিক থেকে ভেসে আসা হাওয়ার মতো হু-হু করে ওঠে বিগত কয়েক জন্মের আফসোস, অপূর্ণতা।

একমুঠো অর্জন নিয়ে নিজেই নিজের মাথায় হাত বুলোতে চায় উজ্জয়িনী। সান্ত্বনা নয়, স্নেহ। সমবেদনা কিছুটা। মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই গর্ভবতী বেড়াল এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে… মমতাময়ী মাতামহীর মতো। এই অলৌকিক স্মৃতিকণিকা হাতের মুঠোয় নেওয়ার পর প্রথমদিকে যেমন ভীষণভাবে অতীত আর মায়া-মুহূর্তরা ঘিরে ধরত বর্ষার মেঘের মতো, শুনতে পেত শুদ্ধ রাগ মেঘ; সেরকমই, আজকাল একটা অদ্ভুত ডিট্যাচমেন্ট অনুভব করে। পর্যাপ্ত ক্ষত দর্শন অথবা পরমান্ন আস্বাদনের পর বোধহয় এমনই ডিট্যাচমেন্ট আসে। নিষ্পৃহ মন, নিরাসক্ত শিথিল ইন্দ্রিয়বোধ।

মাঝে মাঝে সন্দেহ হত, সত্যি চালের দানা… না হাতের কারসাজিতে কোনও এলএসডির মতো মাদক দিয়ে গেল লোকটা। কিন্তু এখন আর সেসব চিন্তা আসে না মনে। এই পরিবর্তন কতটা সচেতন আর কতটা অতিপ্রাকৃত তা অনুভব করেছে উজ্জয়িনী। অনেকগুলি শুক্ল আর কৃষ্ণপক্ষ অতিক্রান্ত হল… নির্দিষ্ট মাত্রায় ক্রম পরিবর্তনের আট মাস।

অতএব, সেই শ্রাবস্তীর পথ না থাকলেও, একটি জীবন না মেনে নেওয়ার অধিকার থেকেই যায়।

সেই শ্রমণ যা দিয়ে চলে গেছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র কৌটোর আধারও বড় পার্থিব এমন জ্যোতির্ময় জোনাকিদের জন্য। এদের জানলার সামনে রেখে উড়িয়ে দিতে হয়। মুক্ত আকাশের নিচে রেখে দিলে, সকলের অজ্ঞাতে, একদিন নিশ্চয়ই জ্যোৎস্নারাতে এরা জোনাকি হয়ে উড়ে যাবে, মিশে যাবে মহাবিশ্বের মহামায়ায়।

এক সন্ধ্যায় উজ্জয়িনী একা একাই সেই মুঠোয় ভরা চাল ফিরিয়ে দিতে যায় অভ্যেসমতো, গোলমরিচের কৌটোয়। কিন্তু চমকে গিয়ে দেখে, সেই কৌটো হাতে-কাছে কোথাও নেই। চারপাশে তাকিয়ে দেখে ঘরের আসবাবও অন্যরকম ঠেকছে। পরিচিত, অথচ অন্যরকম। এই অদ্ভুত আস্তরণ কীসের, তা বুঝতে পারে না। বিছানার চাদর, জানলার পর্দা, ফ্রেমে বাঁধানো বিয়ের ছবি— সবই এক আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে। প্রবল নিরাসক্তি, হাত বাড়িয়ে তা সরিয়ে দেখারও ইচ্ছে হল না আর। খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে পর্দা উড়িয়ে… হেমন্তের বাতাস। শুধু হাতের মুঠোয় এই শ্রমণের রেখে যাওয়া স্মৃতি-কণিকাই রয়ে গেল তাহলে? আর কিচ্ছু না?

জানালা খোলা, আস্তরণে ঢাকা দরজাও খুলে গেল সামান্য চেষ্টায়। সম্মুখপথ পরিচিত। অথচ অতটাও পরিচিত নয়, যতটা মনে করে এসেছে এতকাল।

***

 

দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। ঘরে আলো জ্বলছে না… অন্ধকার।

একটু চিন্তিত হয়েই আলোটা জ্বালাল মৃন্ময়। দু-তিনবার ডাকল উজ্জয়িনীর নাম ধরে চারদিকে দেখতে দেখতে— কিন্তু কোনও সাড়া পেল না। উদ্বেগ নিয়েই প্রথমে বসার ঘরটা ভাল করে দেখল। তারপর ছুটে গেল ভেতরের ঘরে। নাহ… ঘরের কোনও জিনিসেই কেউ হাত দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। মনে এল— উজ্জয়িনী সাড়া দেয়নি। সেও নেই।

এভাবেই ফিরে আসে মৃন্ময়। উজ্জয়িনীকে নাম ধরে ডাকে। বহুবছরের জমে থাকা আস্তরণের স্তরে ঢেকে থাকা সব কিছুর মাঝে। আলোর অভাবে, তার নিজেরই এত পরিচিত সব কিছুকে মনে হয়ে প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো, সহস্রাব্দের পর খননকার্যে উদ্ধার হয়েছে। মাটি আর অতীতের গন্ধ।

একটা বেড়াল এসে তার পায়ের পাতার কাছে এসে মাথা রেখে ঘরঘর শব্দ করে।

মৃন্ময় লক্ষ করে… রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। বাথরুমেও আলো জ্বলছে। তাহলে কেউ নিশ্চয়ই আছে… কেউ না কেউ। সাড়া দেয়নি মানেই যে নেই— এমনও না।

আলো-অন্ধকারে ভেসে বেড়ায় স্মৃতিকণিকারা। পীতোজ্জ্বল খদ্যোতের মতো।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আমাদের গল্পগুলো শীতল কণার মত শীকর, মহৎ জীবনের আঁচে
    দু একটি চালের দানা, কেউ পরমান্ন, কেউ উষ্ণ ভাত, কেউ বা
    আমানির মতো সবল বিস্তার, কেউ মহাকাল মদ – ঘোর — স্বয়ম উন্নাসিক শশ্মান চণ্ডাল
    কথাগুলো গল্প হলে – যোনির্ময় লোহিত পেরিয়ে গর্ভগৃহে অবলোহিতেশ্বর
    কাহিনীর মতো নীরব বাঙময়, জীবন আসলে জীবন পেরিয়ে যে রকম !

আপনার মতামত...