দেশ, কাল, ধর্ম ও আইন

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

 


আইনি অভিন্নতা সকল সময়ে সমতার গ্যারান্টি নয়। একদিকে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিচয়ের ওপর ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অভিন্ন সিভিল কোডের দাবি এর উদ্দেশ্য বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক করে। যাঁরা ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা আজ বলছেন তাঁরা সকল ধর্মের মধ্যেই যেসব ফাঁক আছে তা নিয়ে টুঁ শব্দ করছেন না। এই প্রচার শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভেদের আগুন জ্বালাতেই ব্যাবহার করা হচ্ছে, এরকম ভাবনা ভুল নয়

 

হয়তো আপনি ঈশ্বরবিশ্বাসী, হয়তো নন। হয়তো আপনি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, নতুবা বহু ঈশ্বরবাদী। আপনি অজ্ঞেয়বাদী হতে পারেন বা প্রকৃতিপূজারী। অথবা শুধুই মানবধর্মে বিশ্বাসী, বিজ্ঞানে আস্থাশীল, এক শহুরে বাঙালি।

তাই কি আপনার অধিকার জন্মেছে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের নিয়ে উপহাস করবার? হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুত্ববাদ কি এক? ইসলাম বা ইসলামিক মৌলবাদ, জুডাইজম ও জিওনিজমকে কি এক তুলিতে আঁকা যায়?

আমাদের চারিদিকের বলয়ে অধিকাংশ মানুষ আছেন, যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী, দলবদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। এই ভারতবর্ষে পিউ রিসার্চ-এর তথ্য অনুসারে ৯৬ শতাংশ মানুষ মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভারতবর্ষের ৭৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যেক দিন ঈশ্বরের প্রার্থনা করেন। ভারতবর্ষের ৯৫ শতাংশ হিন্দু এখনও নিজের জাতের মধ্যেই বিয়ে করেন। আবার মুসলমানরাও নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিয়ে করতে পছন্দ করেন।

ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাবে তা নির্ধারিত হচ্ছে দেশের আইনকানুন ও তার প্রয়োগে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারবাণীর মাধ্যমে, মানুষের অধিকারের সুরক্ষার মধ্যে দিয়ে। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে। দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যে সীমাহীন প্রভেদ আছে তা আগামী দশকে কমবে তো?

যারা শহুরে, শিক্ষিত এবং দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না, তারা হিন্দুত্ববাদকে বিচ্ছিন্ন করতে না পেরে, উপহাস করে হিন্দু ধর্মের আচারকে, ঠাট্টা করে হিন্দু ধর্মের খাদ্য বিধানকে। আর এই করে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সমাজ থেকে, দেশের অধিকাংশ মানুষের থেকে।

সাম্প্রদায়িকতাকে বিরোধিতা করতে হবে, সব ধরনের মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বিষয়টা সহজ নয়, কৌতুকের বিষয় নয়। যত আমরা এইসব নিয়ে কৌতুক করব তত নিজেদের বিচ্ছিন্ন করব বৃহত্তর সমাজ থেকে।

জানি, অনেকে ভাবছেন, তাহলে ইতিহাস বলব না! এক সময়ে ইন্দো-ইউরোপীয়রা গরু খেত, এ-কথা বলব না!

এ-কথা বলব। কিন্তু কেউ গরুর মাংস না খেলে হাসব না। যেমন কেউ শুয়োর বা কচ্ছপ বা চিংড়ি না খেলে তা নিয়ে হাসাহাসি করি না।

বিষয়টা জটিল ও গভীর— কোনও তাৎক্ষণিক আবেগ বা পরিহাস দিয়ে সমাধান করা যাবে না। মানুষ এই মুহূর্তে নিজ ধর্ম নিয়ে ভয়ঙ্কর সংবেদনশীল। আমরা জেনেশুনে কি ধর্মীয় আইকনদের উপহাস করে ধর্মের নামে রাজনীতির লড়াইকে মদত দিয়ে ফেলছি না?

অধিকাংশ মানুষ নিজ ধর্ম পালন করেন মনের শান্তির জন্য; একলা মানুষ আশ্রয় খোঁজেন ধর্মের মধ্যে। তাই এই মুহূর্তে আমাদের লড়াই ধর্মের বিরুদ্ধে নয়— রাষ্ট্রশক্তির ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে। এই মুহূর্তে আমাদের লড়াই এই বিভাজনের মাধ্যমে ভোটে ফয়দা তোলার লড়াইয়ের বিরুদ্ধে। মানুষের মধ্যে প্রাচীর তৈরির বিরুদ্ধে।

আজকে ভারতবর্ষ এক ক্রান্তিকালীন অবস্থায় চলেছে। আমাদের কৈশোরে যা কল্পনা করতে পারিনি, আজকে সারা দেশ জুড়ে ধর্মের নামে অন্য ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করছে কিছু উন্মত্ত মানুষ। এই অবস্থায় পাকিস্তানের সমাজ বহু আগেই চলে গেছে।

 

পর্ব ২

হিন্দু ধর্ম যাঁরা পালন করেন তাঁরা অঞ্চলবিশেষে নিজের দেবতাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। এমনকী কয়েক শতাব্দী আগেও অঞ্চলভিত্তিতেই ছিল তাঁদের ব্যক্তিগত আইন (পার্সোনাল ল), যাকে আইনি পরিভাষায় বলা হয় দেওয়ানি আইন বা সিভিল ল।

সেই প্রাচীনকাল থেকে ধর্ম বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এই বিষয়ে রামায়ণ, মহাভারত, বৌদ্ধশাস্ত্র গ্রন্থাদি, অর্থশাস্ত্র, অশোকের শীলানুশাসন ও স্তম্ভানুশাসন এবং মনুস্মৃতিতে সময়কাল অনুযায়ী বিভিন্ন বিধিবিধানের কথা বলা হয়েছে। তাতে ফৌজদারি বিষয় যেমন এসেছে তেমনই ব্যক্তিজীবনে পালনীয় ধর্মীয় রীতিনীতিও আছে। তবে সেইসব রীতি ও নীতি এই দেশে বসবাসকারী সমস্ত যুগের সব মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক এমনটা বলা যায় না। অনেক বিধিনিষেধে অসঙ্গতি ছিল, ছিল পরস্পরবিরোধিতাও।

সুলতানি ও মুঘল যুগে ফৌজদারি আইন ছিল মূলত কোরান ও হাদিস অনুযায়ী। করবিন্যাস ছিল ইসলামিক নিয়ম অনুযায়ী। তবে ব্যক্তিগত আইন তৈরি, তার প্রয়োগ ও ব্যবহারে নিজ ধর্ম ও অঞ্চলবিধি গুরুত্ব পেত। বিধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে গ্রামের পঞ্চায়েত ও সরপঞ্চের ভূমিকা ছিল। খেয়াল রাখতে হবে, মুঘল যুগেও ছিল বহু স্বাধীন হিন্দু ও সুলতানি রাজ্য। বিভিন্ন রাজ্যে তাদের অঞ্চল, ধর্ম অনুযায়ী কিছু ‘সাধারণ আইন’ ছিল। দেশের দেওয়ানি আইন, হিন্দুদের মধ্যে, এই সেদিন পর্যন্ত ছিল খুবই অগোছালো। এমনকি বর্ণপ্রথাও বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।

আবার সেই বৈদিক যুগ থেকেই, জনজাতিদের মূল ধর্মগোষ্ঠী এবং সমাজের নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের বাইরে, প্রান্তবাসী করে রাখা হয়েছিল। জনজাতিরাও নিজেদের নিয়মনীতি নিয়ে সেভাবেই থাকতে চেয়েছেন। সেই জন্যই আজও ভারতবর্ষে দেখা যায় প্রায় অবিমিশ্র কিছু মানুষ, আন্দামান নিকোবরের বিভিন্ন জনজাতি, যাদের মধ্যে শেষ ৩৫ হাজার বছরে মূল ভূখণ্ডের অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনও মিশ্রণ হয়নি। উল্টোদিকে দেখুন, সারা পৃথিবীতে আফ্রিকা, আমাজনের গহীন অরণ্য এবং ভারতবর্ষের বাইরে আজ প্রায় সর্বত্র জনজাতিরা লুপ্ত হতে বসেছে।

 

আব্রাহামিক ধর্ম

এবার একটু বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকান যাক।

আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মধ্যে আদিতম হল ইহুদি ধর্মমত। ইহুদি ধর্মমত কি শুধু ব্যক্তির ধর্ম বিষয়? ১৭৮৭ সালে আমেরিকার সংবিধান গ্রহণের সময়ে বেশ ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ অর্থোডক্স ইহুদিরা মনে করে ইহুদি ধর্মমত শুধু ধর্ম নয়, এটা একটা জীবনচর্যা। ধর্ম, ভাষা, জাতিসত্তা, নিজেদের আইন, সবকিছু মিলিয়ে হল ইহুদি ধর্মমত। এইসব নিয়ে তারা দীর্ঘদিন বিভিন্ন দেশে নিতান্ত সংখ্যালঘু হয়ে কাটিয়েছে। সে-সব দেশের রাজারা করের টাকা পেলেই সন্তুষ্ট ছিল। সামান্য সংখ্যক ইহুদিরা নিজেদের মধ্যে কীভাবে থাকছে তা নিয়ে কোনও কৌতূহল রাষ্ট্রের ছিল না। গোঁড়া ও সনাতন (অর্থোডক্স) ইহুদিরা মনে করেন, ইহুদিদের ধর্মমত ও সভ্যতা শুধু ধর্ম নয়, এটা একটা জীবনচর্যা।

ইহুদিদের ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ইসলামেও এই বিশ্বাস আছে। ইসলাম একটি জীবনচর্যা। আজও বিভিন্ন ইসলামিক দেশে কোরান ও হাদিস অনুযায়ী দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন টিকে আছে। ইসলামের আইনি বিধিতে মুসলমান পুরুষদের মধ্যে সাধারণভাবে অসাম্য নেই। তাই ইতিহাসে দেখা যায় দাসদের অধিক স্বাধীনতা ছিল মুসলিম দেশগুলোতে। কিন্তু নারীদের এবং অমুসলমান পুরুষের জন্য আইন মুসলমান পুরুষের সমতুল্য ছিল না। এখনও নেই।

খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে ক্যাথলিক চার্চ মনে করত রোমান পোপ বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক চার্চের প্রধান— বকলমে তারাই ধর্ম। তাদের নিয়মে শুধু পৃথিবী নয়, সূর্যকেও চলতে হয়। তারা বলে দেন সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয় কিন্তু— এখনও ৫০০ বছর হয়নি।

হিন্দুদের কোনও একটি গ্রন্থ পবিত্রতম গ্রন্থ নয়, বা কোনও একজন নবী এই ধর্ম শুরু করেছেন এমনটা বলা যায় না। এই ধর্ম প্রাচীন এবং তার শিকড় ছাড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন অংশে। ধর্মীয় আদেশ বিনা মানুষ সবসময়েই সহজলভ্য, আয়ত্তগত ও সুস্বাদু খাবার পছন্দ করে। তাই আদিবাসীদের পছন্দ ছিল জঙ্গলে শিকারে লভ্য বিভিন্ন ধরনের মাংস, ফলফলাদি। আর নদীনালা, খালবিলে আচ্ছাদিত পূর্ব ভারতের সমভূমির মানুষ, হিন্দু, খ্রিস্টান ও মুসলমান সবাই, ভালবেসেছেন মাছ খেতে। তাই বাঙালিদের মধ্যে নিরামিষাশী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সারা ভারতে ব্রাহ্মণরা সাধারণভাবে নিরামিষাশী। উত্তর ভারতের বর্ণহিন্দুরাও আমিষ খাবার খান না। তবে পূর্বভারতে কিন্তু তা নয়।

আবার ভারতবর্ষে যেমন বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও জাতি মিশ্রিত হয়েছে, ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে তা হয়েছে তুলনায় কম। আজকের জিনবিদ্যা প্রমাণ করেছে আফ্রিকার বাইরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সবচাইতে বেশি মিশ্রণ হয়েছে ভারতবর্ষে। আবার ভারতবর্ষে যেমন বহু ধর্মের মানুষ থেকেছে, নিজেদের মধ্যে গুরুতর দাঙ্গা করেছে, তবুও টিকে থেকেছে— ইউরোপ, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে এই বিভিন্নতা আর নেই। ভিন্ন ধর্মের মানুষ আর টিকে নেই।

পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের থেকে ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্ন। তবুও এমনকি আব্রাহামিক ধর্মমতগুলোও প্রতিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে কিছু রীতিনীতি আয়ত্ত করে। ভারত-বাংলাদেশের মুসলমানরা বিয়েতে গায়ে হলুদ আচার অনুষ্ঠান করে, আরব দুনিয়াতে তা দেখা যায় না।

ইংল্যান্ডে ১১০০ শতাব্দীর শেষের দিকে রাজকীয় ন্যায়বিচারের যে প্রসারিত ভাবনার আবির্ভাব হয়েছিল এবং যে নিয়ম বজায় রেখেছিল তাকে ‘সাধারণ আইন’ বা কমন ল বলা হয়। কমন ল অনেকটা আমাদের দেওয়ানি আইনের মতো। তবে তাতে আইনের সঙ্গে বিচারকের মতামতেরও গুরুত্ব রয়েছে, সেখানে আমাদের দেওয়ানি আইনব্যবস্থায় লিখিত আইন প্রাধান্য পায়। এর প্রাথমিক অর্থ ছিল এই আইন সারা দেশে এক বা ‘সাধারণ’। আঞ্চলিক বা স্থানীয় আইনের বৈচিত্র্যের বিপরীতে ছিল এই আইন। তবুও আইনি নিয়ম পরিবর্তন করা সহজ হয়নি। তাই তখন ‘সাধারণ আইন’ পরিবার, সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার আইনের অনেক প্রথাগত নিয়মকে আমূল পরিবর্তন ছাড়াই অন্তর্ভুক্ত করে। সাধারণ আইন নমনীয় ছিল, তবে পদ্ধতির দিক থেকে এটি লিখিত দলিল রচনার (ডকুমেন্টেশনের) ওপর জোর দিয়েছিল; একে বলে রাজকীয় ‘রিট’। এছাড়াও বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য, আইন প্রতিষ্ঠার জন্য, স্থানীয় বিচারকদের ব্যবহার করার ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতকে যখন আমাদের দেশে উইলিয়াম জোন্স ইত্যাদিরা দেশীয় নিয়ম, প্রথা, আইন ইত্যাদিকে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করলেন তা তাদের দেশের কমন ল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছিলেন। ভারতবর্ষে ধর্ম সম্প্রদায়গুলোর জন্য কোনও রাজকীয় রিট ছিল না।

যাইহোক, মুঘল শাসকদের সময়ে ব্যক্তিগত আইনগুলি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। ব্যক্তিগত আইন (পার্সোনাল ল), নাগরিকদের জন্য বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, এবং অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকার, যৌথ পরিবার এবং বিভাজন ইত্যাদি বিষয় বিধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই দেশে এসে ব্রিটিশরা প্রথমে ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করেনি। সেই মুঘল যুগের মতোই সব কিছু চলছিল। পরবর্তী সময়ে আধিপত্য কায়েম করবার জন্য ব্রিটিশরা বিভিন্ন ধর্মীয়, আঞ্চলিক ও জাতিগত বিধিগুলি লিপিবদ্ধ, অনুবাদ এবং পুনর্নির্মাণ করেছিল। প্রথমে ব্যক্তিগত আইন (পার্সোনাল ল) ধর্মীয় ভিত্তিতে তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসন প্রণয়নের জন্য প্রজাদের মধ্যে কিছুটা অভিন্নতা আনতে সামান্য কিছু নিয়মনীতি প্রণয়ন করতে তারা বাধ্য হয়। এবং আরও পরে ধর্মনিরপেক্ষ বিচারবিভাগ দ্বারা দেশ পরিচালিত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। এইভাবে, হিন্দু ও ইসলামিক আইনের প্রয়োগ ব্রিটিশ বিচারকদের অনুবাদ, ব্যাখ্যা এবং বিচারের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিধি-বিধান একত্রিত করার, লিপিবদ্ধ করার দরকার ছিল। কাজটা শুরু হয়েছিল সঠিক কারণেই। তবে একটা কমন ল তৈরি করতে ইংল্যান্ডেও লেগেছে বহু শতাব্দী। তার ওপরে ভারতবর্ষের বিভিন্নতার সঙ্গে তাদের তুলনাই হয় না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে, ভারতবর্ষে আগামী দিনে দেওয়ানি আইন কোন পথে যাওয়া উচিত? সেই কথায় আসবার আগে আরও কিছুটা সাম্প্রতিক ইতিহাস আলোচনা করতে হবে।

 

পর্ব ৩

স্বাধীনতার পরে, সংবিধান রচনার সময়ে ধর্মের বিভিন্নতার কারণে, ব্যক্তিগত আইন (পার্সোনাল ল) অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে। এই নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং একই সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। লক্ষ করার বিষয় ধর্মের নীতিগুলোর বিধিবদ্ধ ভাষা যতই আলাদা হোক না কেন, নারীদের বৈষম্য সকল ধর্মেই ছিল যথেষ্ট পরিমাণে।

১৯৫০ সালে, ভারতবর্ষের সংবিধান আলোচনার সময়ে একটা বক্তব্য ছিল যে, রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের জন্য একটি ইউনিফর্ম সিভিল কোড (UCC) প্রতিষ্ঠা করা উচিত। উদারপন্থী জাতীয়তাবাদীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, সম্প্রদায়-ভিত্তিক ব্যক্তিগত আইনগুলি দেশের একত্রীকরণের জন্য বিপদ উপস্থিত করবে। আবার কিছু মহিলা নেত্রী ব্যক্তিগত আইনগুলোকে মহিলাদের জন্য ক্ষতিকর হিসাবে মনে করেছিলেন। UCC-এর দাবির বিরোধিতা শুধুমাত্র সংখ্যালঘুরা নয় বরং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রক্ষণশীল হিন্দুরাও করেছিলেন। তারা এটিকে রাষ্ট্রের অত্যধিক হস্তক্ষেপ মনে করতেন। তখনকার মন্ত্রিসভা ও কংগ্রেসের নেতৃত্বের অন্যতম মুখ ছিলেন রাজা গোপালাচারী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ইত্যাদি। হিন্দু আইন সংস্কার নিয়ে বিতর্ক ছিল রাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু। তবে ১৯৫২ সালের নির্বাচনী বিজয় জওহরলাল নেহরুকে শক্তি জুগিয়েছিল হিন্দু আইন সংস্কারে।

হিন্দু কোডের আগে, হিন্দু আইন মহিলাদের অধিকারের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অনেক পিছনে ছিল। মুসলিম মহিলারা কিছুটা হলেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারতেন ও পারেন, বিবাহের জন্য তাদের সম্মতি প্রয়োজন ছিল ও আছে, তারা নাবালক শিশুদের অভিভাবক হিসাবে কাজ করতে পারতেন এবং বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারতেন ও পারেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের সংবিধান রচনার সময়ে বিআর আম্বেদকরের কথা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ:

কারও এই সত্যটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই যে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা থাকলে, রাষ্ট্র অবিলম্বে সেই ক্ষমতা কার্যকর করতে বা প্রয়োগ করতে এমনভাবে এগিয়ে যাবে যা মুসলমান বা খ্রিস্টান বা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের দ্বারা আপত্তিজনক বলে মনে হতে পারে।

ব্যক্তিগত আইনের ওপর রাষ্ট্রের এক্তিয়ার সম্পর্কিত আম্বেদকরের বক্তৃতা থেকে দেখা যায় যে হিন্দু কোড বিল চূড়ান্ত করার সময়ও, বেশ কয়েকজন সদস্য সংসদীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাকে গ্রহণ করেছিলেন। আম্বেদকর UCC-র পক্ষে ছিলেন, আবার তিনি একই সঙ্গে সচেতন ছিলেন যে ভারত তখনও এত বড় সামাজিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ছিল না।

দেশভাগ, বিশেষ করে বাংলাভাগ, নিয়ে নেহরুর নীতিতে গলদ ছিল। কিন্তু এ-কথা অনস্বীকার্য হিন্দু কোড বিল হিন্দু নারীদের যুগযুগান্তরের বঞ্চনায় কিছুটা সান্ত্বনা জুগিয়েছে।

অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্ন আসে তিনি কেন নিজের নির্বাচনী বিজয়রথকে মুসলিম নারীদের দুঃখ মোছাতে ব্যবহার করলেন না। মুসলিম আইনকানুন বিষয়ে নেহরুর মূল পরামর্শদাতা ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ খ্যাতিসম্পন্ন মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিত। তিনি এবং মোহাম্মদ ইসমাইল, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ইত্যাদিরা জাতির উন্নয়নে অন্যতম প্রধান অংশগ্রহণকারী ছিলেন। ভারতীয় মুসলিম পণ্ডিতদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ, পাকিস্তানের ধারণাকে ‘অত্যধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং একটি অখণ্ড ভারত চিন্তাকে বেছে নিয়েছিলেন— তাঁরা এই দেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীল ছিলেন।

সুতরাং, আজকে মুসলমানদের ভারতীয়ত্বের অভাব সম্পর্কে চায়ের দোকান থেকে দেশের সর্বোচ্চ জায়গায় তর্ক শুরু করা এবং ব্যক্তিগত আইনকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে দাবি করা শুধু ভিত্তিহীন নয় তা দুঃখজনকও বটে।

মুসলিম লিগ এবং এর বিভাজনমূলক রাজনীতির জন্য, মৌলানা আজাদ ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ এবং মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ এটি খুব ভালভাবে জানতেন। একজন ইসলামি পণ্ডিত হিসেবে তিনি বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে বোঝানোর ক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছিলেন যে, ইসলাম জাতীয়তাবাদের বিরোধী নয়। মৌলানা আজাদ সেই লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের পক্ষে কথা বলেছিলেন যারা সচেতনভাবে ভারতবর্ষে, তাদের জন্মভূমিতে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এমনকি দারুল উলুম, দেওবন্দ খোলাখুলিভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা জাতীয়তাবাদের ধারণার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে নেহরুর সিদ্ধান্তকে বিচার করতে হবে। তিনি চেয়েছিলেন ভারতকে একটা মডেল দেশ হিসাবে দেখাতে যেখানে সংখ্যালঘু মুসলমান, খ্রিস্টান, পার্সি, বৌদ্ধ, জৈন ও সংখ্যাগুরু হিন্দুরা একত্রে থাকতে পারে।

সেইসময়ে দেশের মুসলমানদের সামনে, বিশেষ করে অভিজাতদের সামনে একটা বিকল্প ছিল। তারা এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। শেষ পর্যন্ত তারা অনেকেই যাননি। তাই জিন্নার কন্যা, ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ ইত্যাদিরা থেকে গেছেন এই দেশে। বরং পাকিস্তান থেকে এই দেশে চলে এসেছেন বামপন্থী চিন্তাবিদ, গায়ক, লেখক, গীতিকার। ইউরোপ চলে গেছেন আব্দুস সালাম, তারিখ আলি।

এসব অনেক দিন আগের কথা। তারপর দেখতে দেখতে অনেক দিন গড়িয়ে গেল।

 

পর্ব ৪

অলাভজনক সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার নভেম্বর, ২০১৯ থেকে মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত ১৭টা ভাষায় দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্যে ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে ধর্ম বিষয়ক কিছু তথ্য দিয়েছে।

আমাদের দেশে কারা নিজেদের হিন্দু মনে করেন? হিন্দুদের মাত্র ৪৯ শতাংশ মনে করেন যাঁরা ভগবানে বিশ্বাস করেন না তাঁরা হিন্দু নন। কিন্তু ৭২ শতাংশ মনে করেন যাঁরা গরুর মাংস খান তাঁরা হিন্দু নন। এই পরিসংখ্যান দেখে আশ্চর্য লাগতে পারে, তবে দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষের ধর্মবোধের জটিলতার একটা ইঙ্গিত এই ডেটা। আবার ৭৭ শতাংশ মুসলমান বলেছেন, যাঁরা শুয়োর খান তাঁরা মুসলমান নন। খাদ্যাভ্যাস এতটাই গুরুত্বপূর্ণ দেশের হিন্দু ও মুসলমানদের কাছে।

আন্তঃধর্মীয় বিবাহের প্রশ্নে, বেশিরভাগ হিন্দু (৬৭ শতাংশ), মুসলিম (৮০ শতাংশ) মনে করেন যে তাঁদের সম্প্রদায়ের মহিলাদের তাঁদের ধর্মের বাইরে বিয়ে না করা ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ’। আমাদের দেশের ৮৯ শতাংশ মুসলমান এবং খ্রিস্টান বলেছেন যে তাঁরা তাঁদের ধর্ম এই দেশে স্বাধীনভাবে অনুশীলন করতে পারেন। অবশ্য একই সঙ্গে ৭৭ শতাংশ মুসলমান বলেছেন তাঁরা ব্যক্তিগত আইনকে (পার্সোনাল ল) অনুমোদন করেন। অর্থাৎ তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের ব্যক্তিগত আইন।

বাংলাদেশেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা আইন আছে। সেখানেও নারীরা বঞ্চিত। সেই আইন ওই দেশের সংখ্যালঘুদের সংগঠন পাল্টানোর দাবি করছে না।

 

উপসংহার

আমাদের দেশে, যে দেশ সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ, সমস্ত ব্যক্তিগত আইনের সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার শুধুমাত্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তন নয়। সেই সময়েই এই পরিবর্তন করা সম্ভব যখন সমাজ তা গ্রহণ করার উপযুক্ত হয়ে উঠবে।

হিন্দু বিবাহ আইন আঞ্চলিক প্রথা দ্বারা অনুমোদিত বিবাহ ব্যতীত হিন্দুদের জন্য জ্ঞাতি ভাই বোনের বিবাহকে অবৈধ বলে। এই আঞ্চলিক প্রথার মধ্যে আছে মামার সঙ্গে ভাগ্নির বিবাহ, মামাতো পিসতুতো ভাই বোনের বিবাহ ইত্যাদি। উত্তর ভারতে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, দক্ষিণ ভারতে সেটাই প্রথা, এবং হিন্দুদের মধ্যে আজও এই বিবাহ প্রচলিত।

হিন্দু আইনের বেশ কিছু বিধান যেমন বিবাহের কন্যাদান, বিবাহের ধর্মীয় প্রকৃতি, হিন্দু যৌথ পরিবারের জন্য আয়কর সুবিধা ইউনিফর্ম সিভিল কোডে স্থান নাও পেতে পারে।

১৮৬৭ সালের গোয়া সিভিল কোড, যা পর্তুগিজরা তৈরি করেছিল, ঈশ্বর এবং পর্তুগালের রাজার নামে শুরু হয়। কোডটি কিছু শর্তে হিন্দুদের জন্য সীমিত বহুবিবাহের অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘পুত্র না থাকলে, পূর্ববর্তী স্ত্রীর বয়স ৩০ বছর হলে এবং, শেষ গর্ভাবস্থা থেকে দশ বছর অতিবাহিত হলে’ এই অনুমোদন দেওয়া যায়।

কোডটি ক্যাথলিকদেরও কিছু ছাড় দেয়। ক্যাথলিকদের তাদের বিবাহ নিবন্ধন করতে হয় না এবং ক্যাথলিক যাজকরা গির্জায় সম্পাদিত বিবাহ ভেঙে দিতে পারেন। চার্চ ট্রাইব্যুনাল তথাকথিত শরিয়া আদালতের অনুরূপ।

আইনি অভিন্নতা সকল সময়ে সমতার গ্যারান্টি নয়। বাংলাদেশের উদাহরণ এই বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনার দাবি করে। আবার একদিকে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিচয়ের ওপর ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অভিন্ন সিভিল কোডের দাবি এর উদ্দেশ্য বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক করে। যাঁরা ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা আজ বলছেন তাঁরা সকল ধর্মের মধ্যেই যেসব ফাঁক আছে তা নিয়ে টুঁ শব্দ করছেন না। এই প্রচার শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভেদের আগুন জ্বালাতেই ব্যাবহার করা হচ্ছে, এরকম ভাবনা ভুল নয়।

তাহলে কি আমরা নারীদের ক্ষমতায়নের দাবি থেকে সরে যাব?

হিন্দু ও খ্রিস্টান আইনের সংস্কার এবং মুসলিম আইনের ক্রমবর্ধমান বিচারের মধ্যে আসা বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইনের মধ্যে একটি অভিন্নতা তৈরি করার দিকে চলেছে। খেয়াল রাখতে হবে যে, সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও বিতর্ক এবং ভিন্নমত রয়েছে। এমনকী ধর্মগুলোর পারিবারিক আইন সংস্কারের জন্য একটি সমন্বিত সমান্তরাল প্রচেষ্টা রয়েছে। তাৎক্ষণিক তিন তালাককে আইনের মধ্যে আনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। দেখা গেছে যে, পরিবারের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য ধর্মীয় আইনের চেয়ে আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে অধিক সম্পর্ক বহন করে।

পার্সোনাল ল-এর পরিবর্তনের জন্য লাগবে ধৈর্য, এবং কখনওই তা শুধুমাত্র মুসলমান পার্সোনাল আইন সংশোধনের অভিমুখে ধাবিত হবে না। আর তা করতে হবে এমন সময়ে যখন রাষ্ট্র সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সংশয়, অনিশ্চয়তা; অবিশ্বাসের বাতাবরণের বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে। ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতি একেবারে তার বিপরীত মুখে।

 

তথ্যসূত্র


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...