লাইটস, ক্যামেরা, অ্যাকশন!

ঊর্বশী সিনহা ও রেজি ফিলিপ

 



অধ্যাপক, আলোক এবং বস্তু-সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান, রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট

 

 

 

 

আলো আর তার ব্যবহারের নানান কৌশলকে আরও একটা নোবেল পুরস্কার! ২০২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ফোটনের কোয়ান্টাম তথ্যের নিরীক্ষামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। ফোটন সহজ কথায় হল আলোর কণা— আলো তৈরির উপাদান। ফোটনের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিজ্ঞানের এমন একটা শাখা, যেখানে আলোকরশ্মির অনন্য ধর্মাবলিকে ব্যবহার করে ‘কোয়ান্টাম উপায়ে’ তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ ও আদানপ্রদান করা হয়ে থাকে। কোয়ান্টাম উপায় কী? সাধারণ কম্পিউটারে যেমন বুলিয়ান বীজগণিতের ০ অথবা ১ ব্যবহার করে তথ্যকে সঙ্কেতে আবদ্ধ করা হয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে তথ্যকে সঙ্কেতে পরিবর্তন করার জন্য ০ ও ১ প্রয়োজন হলে একসঙ্গেই ব্যবহার করা হয়। এর ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার গণনার এমন সূক্ষ্মতায় যেতে পারে, সাধারণ কম্পিউটারের পক্ষে যার ধারেকাছে যাওয়া অসম্ভব। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট আর তার অনন্যসাধারণ গুণাগুণ নিয়ে যুগান্তকারী কাজের জন্যই মূলত তাঁদের পুরস্কারপ্রাপ্তি ঘটে। ২০২২-এ পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ীদের এই আবিষ্কার বিশেষ করে তথ্যসুরক্ষার ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আনে। এর পর কাটল আরও একটা বছর, আর আবারও পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার এল আলো-সংক্রান্ত বিষয়ে, যদিও এবারের বিষয়, নির্দিষ্টভাবে বললে, আলোকরশ্মির ব্যবহারের ক্ষেত্রে সময়ের মাপদণ্ড।

 

পদার্থবিদ্যায় ২০২৩ সালের, অর্থাৎ এই বছরের, নোবেল পুরস্কার পেলেন অ্যামেরিকার ওহায়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ের আগোস্তিনি, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট অফ কোয়ান্টাম অপটিক্স এবং লুডভিগ-ম্যাক্সিমিলিয়ানস-উনিভার্সিটাট (মিউনিখ)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ফেরেঙ্ক ক্রাউজ, এবং সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির অ্যান ল’হুইলিয়র। নিরীক্ষামূলক প্রযুক্তিগত কৌশলের ক্ষেত্রে তাঁদের অসামান্য অবদানই তাঁদের নোবেল পুরস্কার বিজয়ের মূল কারণ। এই বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হল অভূতপূর্ব রকমের সূক্ষ্ম অ্যাটোসেকেন্ড (১০-১৮) আলোর স্পন্দন তৈরি করা। এর ফলে অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞানে ইলেকট্রনের স্বভাবগত বিষয়ে নতুন অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা গেছে, এবং ইলেকট্রন যে যে পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে থাকে তাদের সম্বন্ধে আমাদের জানাশোনার পরিধি বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে।

 

তরল কোনও কিছুর ধারা বয়ে চলার চলচ্চিত্র আমরা যখন দেখি, আসলে তখন দেখি পর পর চলতে থাকা অনেকগুলো স্থির ছবিকে। তেমনই, পর পর ঘটতে থাকা ঘটনার দিকে তাকালে মনে হয় যেন একটাই ঘটনা ঘটছে। এই যে সময়ের সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন ও সেই পরিবর্তনের পরিমাপ, সময়ের মাপদণ্ডে আলোর স্পন্দনের তাৎপর্য এখানেই। এক একটা ক্ষুদ্র ঘটনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে বিশেষ কিছু উপায় অবলম্বন করতে হয়। আলোকস্পন্দন এমনই একটা কার্যকরী উপায়। এই আলোকস্পন্দন আমরা তৈরি করতে পারি লেসার প্রক্ষেপণব্যবস্থার মাধ্যমে। প্রথম কার্যকরী লেসার প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা তৈরি করেন থিওডোর মাইম্যান, ১৯৬০ সালে। সংশ্লেষণের দ্বারা তৈরি রুবি স্ফটিককে গেইন মিডিয়াম হিসাবে ব্যবহার করে মাইম্যানের কৃতিত্ব পদার্থবিজ্ঞানে এক বাঁকবদলের সূচনা করে। এই গেইন মিডিয়াম হল এমন একটা মাধ্যম যার দ্বারা আলোকরশ্মির তীব্রতাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া যায়। ইস্কুলের পদার্থবিদ্যার বইতে আলোকরশ্মি প্রিজমের মাধ্যমে বিচ্ছুরিত হবার ছবি আমরা সকলেই দেখেছি। সহজ করে বলতে গেলে এই গেইন মিডিয়ামও ওইরকমের একটা বিচ্ছুরণের মাধ্যম। যাই হোক, মাইম্যানের কীর্তি লেসার নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে নতুন উৎসাহের সঞ্চার করে, এবং লেসার আলো তৈরির ক্ষেত্রে নতুন নতুন জিনিস ও পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার সুযোগ এনে দেয়।

 

১৯৬২ নাগাদ কিউ(Q) সুইচিং প্রযুক্তি (ছোট ছোট লেসার স্পন্দন তৈরি করার উপায়) ন্যানোসেকেন্ড (১০-৯ সেকেন্ড) লেসার কম্পন তৈরি করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। এরপর মোড-লকিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলে আরও ছোট লেসার কম্পন তৈরি করা সম্ভব হয়। প্রথমে পিকোসেকেন্ড (১০-১২ সেকেন্ড), তারপর ফেমটোসেকেন্ড (১০-১৫ সেকেন্ড)। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, অত্যন্ত দ্রুতগতির ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ন্যানোসেকেন্ড সময় মাপদণ্ডে চলে, আণবিক কম্পন মাপা যায় পিকোসেকেন্ড মাপদণ্ডে, আর ফেমটোসেকেন্ডে মাপা যায় উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ। তবুও, এত সূক্ষ্ম পরিমাপের ফেমটোসেকেন্ডও ইলেকট্রনের গতিবিধি মাপার জন্য যথেষ্ট নয়! ইলেকট্রন এতই চঞ্চল। এর জন্যে আমাদের চাই আরও সূক্ষ্ম কম্পন। আর তার জন্যেই দরকার অ্যাটোসেকেন্ড-এর।

লেসারের অনেকগুলো রকম আছে। এরই মধ্যে একটার নাম সলিড স্টেট লেসার। টাইটানিয়াম স্যাফায়ার লেসার এমনই এক ধরনের সলিড স্টেট লেসার যা ফেমটোসেকেন্ড লেসার কম্পন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। টাইটানিয়াম স্যাফায়ার লেসার গ্যাসীয় মাধ্যমে উচ্চকম্পনযুক্ত হারমনিকস, বা সমদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ তৈরি করার আদর্শ লেসার পাম্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়। লেসার পাম্পিং হল বাইরের থেকে এনার্জি বা শক্তি লেসারের গেইন মিডিয়ামে চালনা করার পদ্ধতি। এই ধরনের লেসারের কারণেই আমরা এখন অ্যাটোসেকেন্ড আলোকস্পন্দন তৈরি করতে পারছি। এই কথাটাও বলে রাখা দরকার যে এই অ্যাটোসেকেন্ড ব্যাপারটা এতটাই সূক্ষ্ম, যে মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো সেকেন্ড আমরা অতিক্রম করেছি, এক সেকেন্ড সময়কালের মধ্যে অতগুলো অ্যাটোসেকেন্ড আছে। ইলেকট্রনের দুনিয়ায় এক অ্যাটোসেকেন্ডের দশভাগের এক ভাগ সময়ে পরিবর্তন ঘটে যায়। এবারের নোবেলজয়ীদের গবেষণার ফলে যে আলোকস্পন্দন তৈরি করা গেছে, তার দ্বারা অণু ও পরমাণুর অভ্যন্তরে বসে থাকা ইলেকট্রনের কাণ্ডকারখানার ছবি তুলে রাখা সম্ভব হয়েছে।

 

২৩ জুলাই ১৯৪১-এ ফ্রান্স-আশ্রিত তিউনিসিয়ার তিউনিস শহরে জন্ম নেওয়া পিয়ের আগোস্তিনি একজন বিশিষ্ট ফরাসি নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ। নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান কী?

নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান হল পদার্থবিদ্যার সেই বিশেষ বিভাগ যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য হল গবেষণাগারে নানান রকমের পরীক্ষার ফলাফল নিরীক্ষণ ও লিপিবদ্ধকরণ। এই বিভাগের অন্যতম কাজ পরীক্ষানিরীক্ষার সম্পূর্ণ পদ্ধতি ঠিক করা এবং পরীক্ষালব্ধ তথ্যসমূহ লিপিবদ্ধ করা। গ্যালিলেও-র যে পরীক্ষানিরীক্ষার কথা আমরা বইতে পড়েছি, বা যে হেড্রন কোলাইডারের কথা কাগজে দেখেছি, তার থেকে যা যা জানার সেগুলো লিখে রাখাই নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের কাজ।

পিয়ের ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন এমেরিটাস প্রফেসারও বটেন। স্ট্রং-ফিল্ড লেসার ফিজিক্স ও অ্যাটোসেকেন্ড বিজ্ঞানে পিয়ের একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। ডক্টরেট করে ১৯৬৯ সালে ফ্রান্সের অচিরাচরিত শক্তি ও আণবিক শক্তি কমিশনে (CEA Saclay) তাঁর গবেষক হিসাবে যাত্রা শুরু। সেখানে তিনি থাকলেন ২০০২ পর্যন্ত।

CEA Saclay-তে থাকাকালীন জেরার ম্যাঁফ্রে ও ক্লদ মানুস-এর গবেষণাগারে যোগ দেন পিয়ের। কাজ করেন শক্তিশালী লেসারের সাহায্যে মাল্টিফোটন আয়োনাইজেশনের ক্ষেত্রে। আর মাল্টিফোটন আয়োনাইজেশন হল অনেকগুলি ফোটন ব্যবহার করে খুব জোরালো লেসার আলোর সাহায্যে একটা অণু বা পরমাণু থেকে ইলেকট্রন আলাদা করে আনার একটা প্রক্রিয়া। এই তিন বিজ্ঞানীর বিখ্যাত কৃতিত্ব ১৯৭৯ সালে জেনন গ্যাসের আয়োনাইজেশন।[1]

এরপর, ২০০১ সালে, ‘হাই হারমনিক জেনারেশন’ পদ্ধতিতে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন সৃষ্টি করে পিয়ের এক অভূতপূর্ব কৃতিত্বের অংশীদার হন।[2] বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক। একটা পরমাণুর ওপর তীব্র লেসার রশ্মি প্রক্ষেপণ করলে পরমাণুর ভিতরকার ইলেকট্রনগুলো কেঁপে ওঠে। এই কম্পনের থেকে তৈরি হয় অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন, যা কী না অতি ক্ষুদ্র আলোর বিচ্ছুরণ। হাই হারমনিক জেনারেশন প্রক্রিয়া হল কোনও একটা গ্যাসীয় লক্ষ্যের ওপর (যথা নিষ্ক্রিয় গ্যাস, জেননের মতোই) লেসার প্রয়োগ করে লেসার স্পন্দনের কম্পাঙ্কের থেকে অনেক গুণ বেশি কম্পাঙ্কের আলোকরশ্মি তৈরি করা। এ ছাড়াও, পিয়ের তৈরি করেন RABBITT (reconstruction of attosecond beating by interference of two-photon transitions) পদ্ধতি, যার দ্বারা অ্যাটোসেকেন্ড আলোক স্পন্দনকে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ফেলা যায়।[3]

 

ফরাসি-সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী ও সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনারত অ্যান জিনেভিয়েভ ল’হুইলার-এর জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৬ আগস্ট। অ্যান অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিদ্যার একটি রিসার্চ গ্রুপের প্রধান। এই গ্রুপের কাজ রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে আরও ভাল করে বোঝার জন্য ইলেকট্রনের গতিবিধির ওপর নজর রাখা। চর্চার নতুন ক্ষেত্র হিসাবে অ্যাটোকেমিস্ট্রির উদয়ের অন্যতম হোতা হিসাবে অ্যান স্বীকৃত হন। নিরীক্ষা ও তাত্ত্বিক বিষয়ে অ্যানের অবদানও প্রণিধানযোগ্য।

১৯৮৭ সালে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ওপর ১০৬৪ মিলিমিটার লেসাররশ্মির হাই হারমনিক জেনারেশন-এর মাধ্যমে অ্যান এক অতি প্রয়োজনীয় আবিষ্কার করেন। গ্যাসের পরমাণুগুলির সঙ্গে লেসাররশ্মির বিক্রিয়ায় এই বিস্ময়কর ফলাফলের সৃষ্টি হয়।[4] হাই হারমনিক জেনারেশন-এর বিবিধ দিক নিয়ে অ্যান-এর কাজ অব্যাহত থাকে, যার ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবিষ্কার করা সম্ভবপর হয়। হাই হারমনিক জেনারেশন-এর ক্ষেত্রে যাকে ‘অবজার্ভড প্লেটো’ বলা হয়— অর্থাৎ পরমাণুগুলির সঙ্গে সংঘাতের ফলে প্রক্ষেপিত আলোকতরঙ্গ যখন সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য লাভ করে, সেই মহাক্ষণ— অ্যান TDSE (time-dependent Schrödinger Equation) সমীকরণের মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা করেন। লিউয়েনস্টাইন ও করকামের সঙ্গে যৌথভাবে এই প্রক্রিয়ার কোয়ান্টাম তত্ত্ব তৈরি করেন অ্যান। অ্যানের রিসার্চ গ্রুপ ২০০৩ সালে সবথেকে ছোট আলোর স্পন্দন তৈরি করে বিশ্বরেকর্ড করে। এই আলোর স্পন্দনের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ১৭০ অ্যাটোসেকেন্ড।

হাঙ্গারিয়ান-অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত ফেরেঙ্ক ক্রাউজের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৭ মে। ক্রাউজ বর্তমানে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনসটিটিউট অফ কোয়ান্টাম অপটিক্সের ডিরেক্টর, এবং মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ফেরেঙ্ক-এর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ বুদাপেস্ত-এর ঈতভশ লোরন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ফেরেঙ্ক-এর মূল কাজ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোর স্পন্দন তৈরি করার জন্য সহায়ক লেসার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা।

এই ক্ষেত্রে ফেরেঙ্কের অবদান অনেক। ফিউ-সাইকল লেসার পালস জেনারেশন, ব্রড হাই হারমনিক স্পেকট্রাম এবং প্রথম আইসোলেটেড অ্যাটোসেকেন্ড লাইট ফ্ল্যাশ (IAP) তৈরির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে, তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ক্রস কোরিলেশন এবং অ্যাটো-স্ট্রিকিং-এর প্রয়োগ করে IAP-র পরিমাপ তাঁর এক যুগান্তকারী কাজ, যা একরকমভাবে অ্যাটোফিজিক্স-এর জন্মদাতা বলা যেতে পারে।[5] অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন ব্যবহার করে ফেরেঙ্ক ভিন্ন ভিন্ন সংশ্রয়ে (জৈব নমুনাসহ) ইলেকট্রনের গতিপ্রকৃতি নিরীক্ষণ করেন। তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করেন অ্যাটোসেকেন্ড-সংক্রান্ত মাত্রাবিজ্ঞানে। আলোকস্পন্দনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে লেসারের উৎস ও ব্যবহারের পদ্ধতি নিয়েও ফেরেঙ্ক অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর অক্লান্ত গবেষণার কারণেই লেসাররশ্মির এমন উৎস আমরা পেয়েছি, যার ফলে সময়গত বৈশিষ্ট্যের ওপর আমাদের অদৃষ্টপূর্ব নিয়ন্ত্রণ এসেছে। এর ফলে আজকের গবেষকেরা অতীতের তুলনায় সময়দণ্ডের অনেক বেশি সূক্ষ্মতায় পৌঁছতে পারছেন।

 

“আমরা এখন খুলে দিতে পারি ইলেকট্রন-বিশ্বের দরজা। অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিদ্যা আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে ইলেকট্রন-পরিচালিত ও প্রভাবিত পদ্ধতিগুলিকে জানবার, বোঝবার। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে এদের ব্যবহার করতে শেখা”— এই কথা বলছেন পদার্থবিদ্যার জন্য গঠিত নোবেল কমিটির প্রধান ইভা অলসন। কীভাবে ব্যবহার করব আমরা? মনে এই প্রশ্ন আসা সঙ্গত। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রন গতিবিদ্যা বুঝতে পারছেন। তাঁদের পরবর্তী স্বপ্ন ইলেকট্রনের গতিপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এমন একটা সময়ের কথা কল্পনা করা যাক, যখন ঘড়ির দেখানো সময় এখনকার থেকে আরও অনেক বেশি নির্ভুল হবে। এখন আমাদের মোবাইল ফোন এক সেকেন্ডের একশো কোটি ভাগ অবধি নির্ভুল। অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিদ্যার সামর্থ্য ব্যবহার করতে পারলে হয়তো আরও একশো কোটিগুণ বেশি নির্ভুল হওয়া সম্ভব হবে। এইরকম নির্ভুলতায় যে আদৌ পৌঁছনো সম্ভব, এই সম্ভাব্যতাকে দেখতে শেখাল এই বছরের নোবেলজয়ীদের যুগান্তকারী কাজ।


[1] Agostini, P.; Fabre, F.; Mainfray, G.; Petite, G.; Rahman, N. K. (1979). Free-Free Transitions Following Six-Photon Ionization of Xenon Atoms. Physical Review Letters. 42 (17): 1127-1130.
[2] Paul, P. M., Toma, E. S., Breger, P., Mullot, G., Augé, F., Balcou, P., Muller, H. G. and Agostini, P. Observation of a train of attosecond pulses from high harmonic generation. Science 292(5522), 1689–1692 (2001).
[3] পূর্বোক্ত।
[4] Ferray, M. et al. Multiple-harmonic conversion of 1064 nm radiation in rare gases. J. Phys. B: At. Mol. Opt. Phys. 21 L31. 1988.
[5] Krausz, F. and Ivanov, M. Attosecond physics. Reviews of Modern Physics. American Physical Society (APS). 81 (1): 163–234. 2009.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...