চিকিৎসাবিজ্ঞান/শারীরবিদ্যায় নোবেল ২০২৩: mRNA ভ্যাক্সিনের জয়যাত্রা

দীপঙ্কর নন্দী

 



অধ্যাপক, জৈবরসায়ন বিভাগ, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স, বেঙ্গালুরু

 

 

 

 

চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবিদ্যায় নোবেলজয়ী হিসাবে ২ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সম্মানিত হলেন ক্যাটালিন ক্যারিকো এবং ড্রু ওয়েসম্যান। তাঁরা এই সম্মান পেলেন পরিবর্তিত mRNA (Messenger বা বার্তাবহ RNA) ব্যবহার করে কোভিড ১৯-এর প্রতিষেধক টীকা তৈরির পথ দেখানোর জন্য। তাঁদের এই সম্মানলাভ খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না, কারণ তাঁদের দেখানো পথেই পশ্চিমা দেশগুলোর বিশালসংখ্যক জনগণের টীকাকরণ হয়েছে। ক্যাটালিন ও ড্রু কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁদের কাজে সফল হলেন, আর এই কাজের গুরুত্বই বা কতটা, তা জানার দরকার রয়েছে। এই নিবন্ধে আমি ব্যবহার করেছি করোনা অতিমারির সময়ে সংগৃহীত নানা তথ্য আর আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসঞ্জাত খুঁটিনাটি। আশা করছি, আমার এই নিবন্ধ ছাত্রছাত্রীদের ও বৃহত্তর পাঠককুলকে এ-বিষয়ে জানতে আগ্রহী করে তুলবে।

ড্রু ওয়েসম্যান এবং ক্যাটালিন ক্যারিকো

 

যে-বিষয়ে আমরা কথা বলতে চলেছি, তা হল— সাধারণভাবে— ‘চিকিৎসায় DNA ও RNA-র ব্যবহার’। প্রথমে জেনে নেওয়া যাক এই DNA, RNA ও প্রোটিনের সম্বন্ধে।

DNA, বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড, হল এমন একটা সিন্দুক, যার মধ্যে রাখা থাকে আমাদের ‘জেনেটিক কোড’। এই জেনেটিক কোড, বা আমাদের শরীরের কোষের জন্য জিনের মধ্যে বসে থাকা কয়েকটি নির্দেশাবলি— এরই মধ্যে ধরা থাকে মানুষ হিসাবে আমাদের প্রধান শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলি। আমরা কতটা আমাদের মায়ের মতো আর কতটাই বা বাবার মতো, তার হিসাবও রাখা থাকে এই জেনেটিক কোডের মধ্যে।

 

RNA তৈরি হয় DNA থেকে। এই RNA-র মধ্যে থাকে আমাদের শরীরে প্রোটিন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি। এই RNA হয় মূলত তিন ধরনের।

ট্রান্সফার RNA, বা tRNA, হল প্রোটিন সংশ্লেষের জন্য গ্রহীতা অণু। এই tRNA-র কাজ প্রোটিন সংশ্লেষের জন্য mRNA (একটু পরেই এর বিষয়ে আমরা জানব) আর অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়া। প্রোটিন যদি হয় মালা, অ্যামাইনো অ্যাসিড হল সেই মালা তৈরির এক-একটা ফুল।

এবার আসি rRNA বা রাইবোসোমাল RNA-র কথা। রাইবোসোম আমাদের কোষের এমন একটা জায়গা, যেখানে প্রোটিন সংশ্লেষের প্রক্রিয়াটি ঘটে। এই rRNA হল এই রাইবোসোমেরই একটা জরুরি অংশ।

তিন নম্বর RNA হল mRNA, বা মেসেঞ্জার RNA. এই mRNA-র কাজ হল কোন কোন ধরণের প্রোটিন তৈরি হবে তার নির্দেশ বা বার্তা কোষেদের কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া।

 

এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে রান্নার সঙ্গে তুলনা করার একটা চেষ্টা করে দেখা যাক। DNA হল অনেকগুলো রেসিপি-সম্বলিত একটা রান্নার বই। এই বইতে রাখা রেসিপিগুলো দিয়ে যে-যে রান্না তৈরি হয়, সেগুলো আর কিছুই নয়— এক-একটা প্রোটিন। mRNA হল এক-একটা রেসিপি, যা দিয়ে ওই এক-একটা প্রোটিন রান্না করা হবে। এর মানে তাহলে দাঁড়াল এই, যে একটা mRNA যদি তৈরি করে ফেলা যায়, বা আলাদা করে ফেলা যায়, তবে তার থেকে ওই mRNA-র জন্য নির্দিষ্ট প্রোটিনও অনেকটা করে তৈরি করে ফেলা সম্ভব হবে। কাজটা বলা যতটা সহজ করা ততটা সহজ নয় মোটেই। তার কারণ, mRNA হয় কিছুটা অস্থির প্রকৃতির, বা অস্থিতিশীল আর তা সহজেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এ-জিনিস তৈরির খরচও কিছু কম নয়। আর এই mRNA তৈরি করে ফেললেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। তাকে কোষে বা কলায় (টিস্যু) প্রতিস্থাপন করার সঠিক ও নির্ভুল পদ্ধতি চাই। এইসব সমস্যা সত্ত্বেও mRNA তৈরি করা আর তার থেকে প্রোটিন বানাবার সবথেকে বড় সুবিধা হল: mRNA অণুগুলো আমাদের শরীরে সংক্রমণের কারণ হয় না, আর DNA-র চেহারাটাকে পালটে দেয় না। যদি দিত, আমাদের জেনেটিক কোড তাহলে বদলে যেতে পারত। কিন্তু আমাদের এই শরীরযন্ত্রের শৃঙ্খলা এমনই জবরদস্ত, যে এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটার কোনও উপায় নেই।

 

১৯৮৭ সালের শেষের দিকে অ্যামেরিকার স্যান দিয়েগোর স্যাল্ক ইনস্টিটিউটে ইন্দর ভার্মার গবেষণাগারে রবার্ট ম্যালোন mRNA-র সঙ্গে স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট মেশাতে এবং সেই মিশ্রণকে প্রোটিনের জন্মস্থান কোষের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হন।[1] এই সাফল্য যে ভবিষ্যতেও একটা বড় ভূমিকা নেবে, এ সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত হয়ে যান তখনই। ম্যালোনের গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই পথে যাত্রা শুরু করেন ক্যাটালিন ক্যারিকো। কোন কোন শর্তাবলি পূরণ হলে বহুল পরিমাণে প্রোটিন বানানো যেতে পারে, সেই জিজ্ঞাসা তাঁর কাজের পাথেয় হয়।

রবার্ট ম্যালোন

ক্যাটালিনের বেড়ে ওঠা হাঙ্গারির ছোট্ট শহর কিসুইসালাশ-এ। পরবর্তীতে সেগেদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ। ১৯৮৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য অর্থে টান পড়লে স্বামী ও দু-বছরের শিশুকন্যা সুজানকে নিয়ে ক্যাটালিন পাড়ি দিলেন অ্যামেরিকায়। ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন পোস্টডক্টরাল ছাত্র হিসাবে।[2] এখানে বলতে ইচ্ছা করছে, যে ক্যাটালিনের কন্যা সুজান পরবর্তীতে রোয়িং বা নৌকাবাইচে দু-দফায় অলিম্পিক স্বর্ণপদক বিজেতা।

এরপর, ১৯৮৯ সালে পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগবিশেষজ্ঞ ডঃ বার্নাথনের গবেষণাগারে যোগ দেন ক্যাটালিন। গবেষণার জন্য আর্থিক অনুদান পাওয়ার কথা থাকলেও সেই অনুদানের দেখা মেলে না। ইতিমধ্যে ডঃ বার্নাথন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যোগ দেন একটি জৈবপ্রযুক্তি সংস্থায়। ফলে, গবেষণার জায়গা ও আর্থিক সাহায্য, দুই-ই হারাতে হয় ক্যাটালিনকে। পরে ডঃ ল্যাঙ্গারের সঙ্গে কাজ করলেও সেই কাজে সাফল্য আসে না। দীর্ঘ পথচলার সবটাই খুব সুখের হয়নি ক্যাটালিনের, অন্তত প্রথমদিকে তো বটেই।

অন্যদিকে, ড্রু ওয়েসম্যান ১৯৮৭ সালে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন এমডি-পিএইচডি। তারপর ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে, আর পোস্টডক্টরাল গবেষণা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অফ হেলথ-এ। ওয়েসম্যান ১৯৯৭ সালে পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি প্রতিষেধক গবেষণার অধ্যাপক ও RNA Innovations-এর ডিরেক্টর।

জীবন যেমন ঝড়ঝঞ্ঝায় ভরা, তেমনই ভরা অনিশ্চয়তাতেও। পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য যোগ দেওয়া অধ্যাপক ড্রু ওয়েসম্যানের সঙ্গে একদিন ফোটোকপি করতে গিয়ে ক্যাটালিনের আলাপ হয়ে গেল। ড্রু-এর উদ্দেশ্য ছিল এইচআইভি প্রতিষেধক বানানো। দুজনের শুরু হল একসঙ্গে কাজ। কিন্তু ম্যালোনের পথ অনুসরণ করে বানানো mRNA ও ফ্যাট বা লিপিডের মিশ্রণ ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করতে তার ফল আশানুরূপ হল না। ইঁদুরেরা অসুস্থ হয়ে পড়ল।

 

আলোচনা আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে একটু জেনে নেওয়া যাক আমাদের শরীর টিউমার কোষ আর বাইরের থেকে আসা কোনও জিনিসকে— যেমন প্যাথোজেন, ইত্যাদি— কেমন করে চিনতে পারে। এদের প্রভাবে ঘটতে পারে এমন রোগ প্রতিরোধ করতে গেলে আমাদের শরীর মোটের ওপর দুভাবে কাজ করে: এক, সহজাতভাবে, আর দুই, অভিযোজন বা মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে। সহজাত প্রক্রিয়া হল যাকে বলা যায় প্রথম সারির প্রতিরোধ (দাবার বোড়ের মতো)। এই প্রক্রিয়া ঘটে জলদি, কিন্তু এর কোনও স্মৃতি থাকে না (মানে কোন রোগ সে কেমন করে প্রতিরোধ করল)। অভিযোজক প্রক্রিয়া ঘটে অ্যান্টিবডি আরটি সেল (বা লিম্ফোসাইট, যা এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা)-এর মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়া তুলনায় সময়সাপেক্ষ হলেও অনেক নির্দিষ্টভাবে রোগের প্রতিরোধ করতে পারে, এবং এর নিজস্ব ‘স্মৃতি’-ও রয়েছে। এক-এক ধরনের ভ্যাক্সিনে এক-এক ধরনের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকে। যখন যখন ওইসব রোগের জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়ে, তাদের চিনে নিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করাটাই এইসব ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধকের কাজ। এখানে স্মৃতির গুরুত্ব এই কারণেই, যে একটা ভ্যাক্সিন নেওয়ার অনেক পরে এইসব জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে। নিজের কাজটা মনে না রাখলে তো প্রতিষেধক তার দায়িত্বই পালন করতে পারবে না। আমাদের শরীরে নানানরকমের সেন্সর রয়েছে। এইসমস্ত সেন্সরের মাধ্যমে প্রথমে সহজাত প্রক্রিয়া বহিরাগত জীবকণাগুলোকে— যেমন এন্ডোটক্সিন, আনমিথাইলেটেড DNA, বা RNA— এদের চিনতে পারে।

এই সুযোগে আরেকজনের কথা আমাদের জেনে নিতে হবে। হোস্ট সেল। এই হোস্ট সেলগুলো বহিরাগত জীবকণাগুলোর বসতি বা খাদ্য হিসাবে কাজ করে। আমাদের শরীরে ভাইরাস ঢুকলে প্রথমে সে কোষের চারপাশটা ঘুরে বেড়ায়, যতক্ষণ না কোষের গায়ে তার জায়গা পাকা হচ্ছে। জায়গা পাকা হলেই ভাইরাস আর হোস্ট সেল পরস্পর মিলে যেতে থাকে। ভাইরাসের নিজস্ব DNA আর RNA কোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তারপর বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে। আমাদের সহজাত প্রক্রিয়াকে হারিয়ে দিয়ে ভাইরাসের প্রাণরস যদি যথেষ্ট পরিমাণে হোস্ট সেলে ঢুকে পড়তে পারে, তাহলে ভাইরাসজনিত সংক্রমণও আমাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

ক্যাটালিন আর ড্রু দেখলেন, কোনও কোনও RNA-এর ক্ষেত্রে হোস্ট সেলে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে হচ্ছে না। এই প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে গবেষণাগারে বানানো RNA-রা সফল হচ্ছে অনেক বেশি। এই দুরকম RNA-র মধ্যে তাহলে ফারাকটা কোথায়? খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, যেসব RNA-র গঠন মিথাইল সাইটোসিন বা সুডোইউরিডিন দ্বারা পরিবর্তিত, হোস্ট সেলগুলোকে তারা জাগিয়ে তুলছে না। তাহলে RNA-র সাধারণ গঠনকে পরিবর্তন করলে কি হোস্ট সেলকে না ঘাঁটিয়েই প্রয়োজনমাফিক প্রোটিন তৈরি করা সম্ভব? এই কাজটাই কালক্রমে করে দেখালেন ক্যাটালিন আর ড্রু, আর তাঁদের সৃষ্ট পদ্ধতির নামই হল পরিবর্তিত mRNA পদ্ধতি।[3] প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, ক্যাটালিন RNA বিশারদ হলেও ড্রু কিন্তু প্রতিষেধকবিদ্যার মানুষ।

মোদ্দা কথা হল, গঠনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে mRNA-দের উন্নীত করে[4] এবং লিপিডের মধ্যে তাদের পুরে (লিপিড ন্যানোপার্টিকলস তৈরি করে) এবং সুরক্ষিত অবস্থায় সফলভাবে কোষের মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে পারাটাই হল আসল কাজ।[5] পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যে ইঁদুরের ত্বকে বা পেশিতে এই মিশ্রণ প্রয়োগ করলে কোনও অসুস্থতা ছাড়াই প্রোটিন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।[6] মানুষের ক্ষেত্রে mRNA প্রতিষেধক দেওয়া হয় পেশিতে।

 

 

ক্যাটালিন ও ড্রু নোবেল পুরস্কার পেলেও এ-বিষয়ে যাঁদের কাজের শ্রদ্ধাপূর্বক উল্লেখ করা প্রয়োজন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভারে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত পিয়েটার কালিস। কালিস লিপিড ন্যানোপার্টিকলস-এর মধ্যে নিউক্লিক অ্যাসিড প্রক্ষেপণ করার প্রযুক্তির জনক। বিভিন্ন mRNA-লিপিড ন্যানোপার্টিকলস মিশ্রণের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য কালিস-প্রতিষ্ঠিত ও টমাস ম্যাডেন পরিচালিত অ্যাকুইটাস থেরাপিউটিকস সংস্থার সঙ্গে ড্রু ওয়েসম্যানের চুক্তি রয়েছে।

নিজেদের গবেষণা প্রকাশ করার পর ক্যাটালিন ও ড্রু ভেবেছিলেন সারা বিশ্বই তাঁদের গবেষণালব্ধ ফল নিয়ে খুব উৎসাহী হবে। বাস্তবে অতটা উৎসাহ দেখা না গেলেও দুজন বিজ্ঞানীর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। প্রথমজন বস্টনের শিশু হাসপাতালের ডেরিক রোসি, যিনি স্টেম সেলের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা ভেবে মডার্না (MODified RNA) নামক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয়ত, উগার সাহিন ও ওজলেম তুরুসি, যাঁরা ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন বায়োএনটেক (BioNTech – BIOpharmaceuticals New TECHnologies) সংস্থার। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্থায় যোগ দেন ক্যাটালিন— ২০১৩ সালে। বর্তমানে এই সংস্থায় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেগেদ বিশ্ববিদ্যালয় ও পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০২০-র গোড়ার দিকে মডার্না বিভিন্ন সংক্রামক রোগের জন্য mRNA ভ্যাক্সিন নিয়ে জোরকদমে নেমে পড়ে। কোভিড ১৯-এর আগমনের পরেই তারা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অফ হেলথ-এর সঙ্গে যৌথভাবে ইঁদুর ও মানুষের ওপর ভ্যাক্সিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ আরম্ভ করে দেয়। বায়োএনটেক-ও ওষুধ প্রস্তুতকারক ফাইজারের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করে দেয়। তথ্য থেকে জানা যায় যে বায়োএনটেক/ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাক্সিন ৯৪-৯৫ শতাংশ সাফল্যের সঙ্গে কোভিড ১৯ ভাইরাসের মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় ও কোভিড-আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা অনেকাংশে হ্রাস করে।[7] ডিসেম্বর ২০২০-র মধ্যে বায়োএনটেক/ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাক্সিন অ্যামেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) রেকর্ড দ্রুততায় স্বীকৃতি দেয়— মাত্র এগারো মাসে। এর আগে এই রেকর্ড ছিল মাম্পস-এর ভ্যাক্সিনের, যে-ক্ষেত্রে স্বীকৃতি আসতে সময় লেগেছিল চার বছর।[8]

এই ভ্যাক্সিন নিয়ে একটা দুশ্চিন্তার কারণ হল প্রচুর পরিমাণে স্পাইক প্রোটিনের সৃষ্টি। স্পাইক প্রোটিন আর কিছুই নয়, করোনাভাইরাসের ছবিতে গোল বলের গায়ে যে শুঁড়ের মতো অংশগুলো আপনারা দেখেছিলেন, সেগুলোকেই বলে স্পাইক প্রোটিন। mRNA ভ্যাক্সিন দেহের মধ্যে যে অ্যান্টিজেন তৈরি করে, স্পাইক প্রোটিন থাকে তাতেও। এই ‘ভাল’ স্পাইক প্রোটিন তৈরি হয়ে আক্রান্ত হোস্ট সেল শনাক্তকরণে সাহায্য করে। অত্যধিক পরিমাণে স্পাইক প্রোটিন তৈরি হলে দেহে তরলের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে, এবং হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর সমস্যা তৈরি হতে পারে।[9] এ ছাড়াও, mRNA ভ্যাক্সিন রাখতে হয় খুব ঠান্ডার মধ্যে, যার ফলে দূরদূরান্তে এই ভ্যাক্সিন পাঠানোর ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে। আরেকটা কথাও মনে রাখতে হবে, যে এখন জিকা, সারস, এইচআইভি, ফ্লু ইত্যাদি রোগের জন্যও mRNA ভ্যাক্সিন তৈরির কাজ চলছে।

 

ক্যাটালিন ক্যারিকোর একটা কথা দিয়ে এই লেখা শেষ করি। আমরা জেনেছি, যে গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁকে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ওঁর নিজের কথা শুনে নেওয়া যাক:

হাইস্কুলে আমার শিক্ষক আমাকে ‘দ্য স্ট্রেস অফ লাইফ’ নামে একটি বই পড়তে দেন। সেই বইতে হাসন সেল্যে লিখেছিলেন— ‘সঠিক মনোভাব থাকলে নঞর্থক স্ট্রেসকেও সদর্থক বানানো যায়।’ আমার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার সম্পূর্ণ যাত্রাপথে এই বইটা ছিল আমার পথপ্রদর্শকের মতো। জীবনে যখনই ব্যর্থতা এসেছে— তা সে ছাত্রজীবনে হোক বা কাজের ক্ষেত্রে— আমি আমার মনোভাব সদর্থক রাখতে চেষ্টা করেছি। সেল্যের কথাগুলো মনে করেছি। নিজেকে আরও যোগ্য, আরও পরিশ্রমী, আরও সৃজনশীল করে তোলার চেষ্টা করে গেছি। আমি কী করতে পারি আমার নজরটা থাকে সেইদিকেই। যা আমার আয়ত্তে নয় তার পিছনে আমি একেবারেই সময় নষ্ট করি না। … একজন মহিলা ও মা হিসাবে আমার মহিলা বিজ্ঞানী সহকর্মীদের আমি বলি, পরিবার বা কাজের মধ্যে যে-কোনও একটাকে বেছে নেওয়ার কোনও দরকারই নেই। একটা সুন্দর পরিবার তুমি পেতেই পারো। তার মানে এই নয় যে তোমায় সর্বক্ষণ বাচ্চা সামলাতে হবে। বাচ্চা তোমায় কাজ করতে দেখেই শিখবে। তুমিই হবে তার কাছে আদর্শ উদাহরণ। … বিজ্ঞান সুন্দর। বিজ্ঞানী হওয়া অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।[10]

 

আমার ছাত্র অভীক চট্টোপাধ্যায়শ্রেয়সী দাস এই নিবন্ধের বিভিন্ন খুঁটিনাটি পর্যালোচনা করে নিবন্ধটি সহজপাঠ্য করে তুলতে সাহায্য করেছেন। নিবন্ধের মধ্যে ব্যবহৃত শেষ ছবিটি পাওয়া গেছে শ্রেয়সীর সহায়তায়। এঁদের দুজনকে ধন্যবাদ জানাই।


[1] Malone et al., Proc. Natl. Acad. Sci. USA (1989) 86: 6077-6081.
[2] Kolata, Gina. Long Overlooked, Kati Karico Helped Shield the World From the Coronavirus. NYT. April 8, 2021.
[3] Kariko et al., Immunity (2005) 23: 165-175.
[4] Kariko et al., Nucleic Acids Research (2011) 39: e142.
[5] Dolgin, Elie. The tangled history of mRNA vaccines. Nature (2021) 597:318-324.
[6] Pardi et al., Journal of Controlled Release (2015) 217: 345-351.
[7] Modified mRNA vaccines. 2021 Lasker~DeBakey Clinical Medical Research Award. Lasker Foundation.
[8] Smedley, Tim. Could mRNA make us superhuman? BBC. Oct 2, 2023.
[9] Fraiman et al., Vaccine (2022) 40:5798-5805.
[10] ‘Was forced to retire…’: Nobel Prize Winner Katalin Kariko shares her journey. India Today. Updated: Oct 2, 2023.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4760 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...