নার্গেসের নোবেলপ্রাপ্তি ইরানের নারীসংগ্রামের স্বীকৃতি

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়

 



অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

 

ইরানে ক্রমবর্ধমান নিপীড়ক শাসনের বিরুদ্ধে তার ধারাবাহিক এবং নীতিগত সমালোচনার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারটি কারারুদ্ধ ইরানি বিজ্ঞানী, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী নার্গেস মোহাম্মদিকে প্রদান করা হয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের ১২২তম বছরে ১৯ জন মাত্র মহিলা এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। বহুদিন যাবত ইরানে যে ইসলামীয় সরকার শাসন করে আসছে, তারা নারীদের প্রতি বহু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপণের মধ্যে দিয়ে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক মৌলবাদী সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে। এর অন্যতম অঙ্গ মেয়েদের পোশাককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানা নিয়মকানুন। এই নিয়মের লঙ্ঘনের জন্য গ্রেফতার হওয়া একজন তরুণ ইরানি কুর্দ মাহসা আমিনির দুঃখজনক মৃত্যুর পরে ইরানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরে; এই পরিপ্রেক্ষিতে নার্গেসের পুরস্কারটি আসে।

 

নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত বৃহত্তর ইরানি নারী আন্দোলনকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। এই পুরস্কারটি ইরান সরকারের বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে, বিশেষ করে নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এমন লক্ষ লক্ষ মানুষকে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

মাহসা আমিনির মৃত্যু এবং পরবর্তী বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে, ইরানে আন্দোলনরত বহু মানুষ হতাহত এবং গ্রেফতার হয়েছেন। এই ঘটনাগুলির ফলে প্রতিবাদকারীরা “নারী, জীবন, স্বাধীনতা” স্লোগানটি গ্রহণ করে, যা এই আদর্শের প্রতি নার্গেস মোহাম্মদির অক্লান্ত নিবেদনের প্রতিফলন। নারগেস মোহাম্মদির নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও সামাজিক মৌলবাদ ও নীতিহীন শাসন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নারীদের ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতিরই অংশ।

নার্গেস মোহাম্মদির জীবন এবং কাজ অনুপ্রেরণামূলক। তিনি ফলিত পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন, একজন প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন, এবং একই সঙ্গে তাঁর লেখার মাধ্যমে মানবাধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছেন। তিনি তাঁর রাষ্ট্রবিরোধিতা ও সক্রিয়তার জন্য একাধিক অভিযোগের সম্মুখীন হয়ে আজ ইরানের কারাগারে নিক্ষিপ্ত। তাঁর বই, White Torture, ইরানের বন্দিদের শারীরিক এবং মানসিক আঘাতের একটি হতাশাময় বিবরণ। রাষ্ট্রের চরম দমন ও অত্যাচার সত্ত্বেও, নার্গেস মোহাম্মদি ইরানে লিঙ্গভিত্তিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 

একদিকে যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার তাঁর আদর্শ ও আত্মত্যাগের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, অন্যদিকে ইরান সরকার নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার নিঃসন্দেহে রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়; আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি সর্বদা এই পুরস্কারকে বিতর্কিত করেছে। তাই, ইরানের অভিযোগে কোনও চমক নেই। রাষ্ট্র তার দমননীতির সমর্থনে যে কুভাষ্য তৈরি করে তা তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রতর্কে নির্মিত। নারীর অধিকার বনাম স্বাতন্ত্রের খেলায় অপলাপ রাষ্ট্রের মূল হাতিয়ার। মোহাম্মদির পরিবার পুরস্কারটিকে ইরানের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, আর জাতিসংঘ এই পুরস্কারের মাধ্যমে ইরানে বন্দি সকল মানবাধিকাররক্ষাকারীদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।

পাশ্চাত্য দেশসমূহ, বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এই পুরস্কারপ্রাপ্তিকে তাদের বিদেশনীতি ও সাধারণ রাজনীতির স্বার্থে দেখেছে। একাধিক রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে মিলিত হয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন মোহাম্মদির “অদম্য সাহস”-কে “উদযাপন” করার জন্য তথা ইরানি শাসকের নির্মম শাসনের সমাপ্তির মধ্যে দিয়ে সমস্ত ইরানিদের জন্য একটি উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন। তাঁর মতে, যদিও মোহাম্মদি বর্তমানে অন্যায়ভাবে এভিন কারাগারে বন্দি রয়েছেন, তবুও বিশ্ব চিরকাল স্বাধীনতা ও সাম্যের অক্ষয় সংগ্রামে নার্গেস মোহাম্মদির কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। তিনি অবিলম্বে নার্গেসকে এবং অন্যান্য নারী অধিকারকর্মীদের মুক্তি দিতে ইরানের সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। বাইডেন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানিদের নিজেদের ভবিষ্যৎ গঠন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, লিঙ্গসমতার আন্দোলন, এবং সর্বত্র মেয়েদের বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ করার পক্ষে কাজ চালিয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই, মার্কিন বা পশ্চিমা অবস্থান তাদের বিশ্বাস, আদর্শ এবং জাতীয় স্বার্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত। তবুও নারীর স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের দাবি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কৌমবাদী শাসনের স্বাতন্ত্রতার ধারাভাষ্য দিয়ে ও পাশ্চাত্য রাজনীতির হস্তক্ষেপকারী প্রবণতার হাত ধরে এই ন্যায্য অধিকারের লড়াইকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট অবস্থান থাকবে; সেটাই স্বাভাবিক। মানবাধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সমাজ নীতিগত ঐক্যমত তৈরি করতে না পারলে শান্তি পুরস্কারের সুফল আমরা পাব না। নিম্নরুচির রাজনৈতিক বাদানুবাদে অধিকারের ন্যায্য দাবি অদৃশ্য থেকে যাবে।

সংক্ষেপে, নার্গেস মোহাম্মদির নোবেল শান্তি পুরস্কার তার ধারাবাহিক মৌলবাদবিরোধী রাজনীতি, অদম্য সাহস এবং একটি নিপীড়ক ও অনমনীয় শাসনের বিরুদ্ধে ন্যায়, স্বাধীনতা এবং লিঙ্গসমতার জন্য বৃহত্তর ইরানি নারী আন্দোলনের সংগ্রামের স্বীকৃতি। এটি ইরানে মানবাধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং মনোযোগের দাবির উপরও জোর দেয়। বাস্তববাদী ক্ষমতার রাজনীতির সাদাকালো ছকে এর মূল্যায়ন তাই যথার্থ নয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...