উইঘুরদের ভাগ্য ফিরবে কবে?

নূপুর রায়চৌধুরী

 


আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং সরকার যখন জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুরদের প্রতি মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে গণহত্যা বলে চিহ্নিত করেছে, চিন তখন তার পদক্ষেপকে চরমপন্থী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া হিসাবেই বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করেছে। কিছুদিন আগেই জিনজিয়াং সফরে এসে উইঘুরদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতিগুলো আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলার কথা বলেছেন শি জিনপিং, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নাকি কোনও রেহাই নেই তাঁর জমানায়

 

১০ অক্টোবর ২০২৩, সকালেই হয়ে গেল জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্বাচন, গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। অংশগ্রহণকারী ১৯৩টি দেশ থেকে নির্বাচিত ১৫ সদস্যের মধ্যে এবারও রয়ে গেল পিআরসি (পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না) ওরফে চিন, যদিও তার মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে বিশ্বজুড়ে আছে গভীর উদ্বেগ। এ কোনও কষ্টকল্পিত আশঙ্কা নয়, রীতিমতো নথিভুক্ত, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নৃশংসতার ভুরি ভুরি প্রমাণ। তিব্বতের কথাই ধরুন না কেন: দশ লাখেরও বেশি তিব্বতি শিশুকে জোরপূর্বক বন্দি করা, তিব্বতিদের জন্য তথাকথিত “ওয়ার্ক ট্রান্সফার প্রোগ্রামস”, তিব্বতি সংস্কৃতি ও ভাষার ধ্বংস এবং তিব্বতি পরিবেশরক্ষাকারীদের নিপীড়ন— চিনের অত্যাচারের কথা যতই বলা হোক না কেন, তবু কম পড়ে যাবে। চিনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল-স্থিত জিনজিয়াংয়ের তুর্কি মুসলমান উইঘুরদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদনগুলিও ২০১৯ সাল থেকেই একটু একটু করে মানুষের সামনে উঠে আসতে শুরু করেছিল। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে, জার্মান নৃতত্ত্ববিদ আড্রিয়ান জেনজ তাঁর গবেষণার চাঞ্চল্যকর তথ্য সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন: দশ লাখেরও বেশি উইঘুর বন্দি অবস্থায় জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হয়েছে জিনজিয়াং-এর ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প বা অন্তর্নিবেশ শিবিরে।

গুগল স্যাটেলাইট চিত্র: দ্রুত গড়ে ওঠা বন্দিশিবির, জিনজিয়াং-এর দাবানচেং-এর কাছে

এই খবর চাউর হওয়া মাত্র দিকে দিকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, ফলস্বরূপ, কিছু দেশ, প্রধানত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডা ২০২২ সালের বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের কূটনৈতিক বয়কট ঘোষণা করে। এসব নিয়ে, কাউন্সিলের ভিতরেও অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছিল তলে তলে। এর উপর ২০১৯-২০২০-তে হংকং-এর গণতন্ত্রপন্থী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর সিপিসি (চিনা কমিউনিস্ট পার্টি) অহেতুক খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে— হংকংয়ের উপর এক ব্যাপক জাতীয় নিরাপত্তা আইন আরোপিত হয় এবং তা প্রয়োগের মাধ্যমে বেইজিং কয়েক ডজন গণতন্ত্রপন্থী কর্মী, আইনপ্রণেতা এবং সাংবাদিককে গ্রেফতার করে; ভোটাধিকারে বাধার সৃষ্টি করে; সংবাদপত্র ও বক্তৃতার স্বাধীনতা সীমিত করে। এইসব ডামাডোলের মধ্যেই যখন কাউন্সিলের নির্বাচন ডাকা হয়, বিশ্বের সামনে চিনের মানবতা বিরোধী রূপটা তখনও সদ্য হওয়া কাঁচা ঘায়ের মতোই চিটপিট করছিল আর তারই প্রতিফলন ঘটেছিল ২০২০-র নির্বাচনে। চিনের প্রাপ্ত ভোট-সংখ্যা এক ধাক্কায় নেমে এসেছিল ১৩৯-এ, যেখানে তার ঠিক আগেরবার অর্থাৎ ২০১৬-তে এই সংখ্যাটা ছিল ১৮০। চিন্তার ব্যাপার এটাই যে, ঘরে বাইরে বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও, এবার এই ২০২৩-এ চিন ১৫৪টা ভোট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ৩ বছরের মেয়াদে ফের মঞ্জুর রইল চিনের সদস্যপদ। দেখুন, ২০২০ সালের তুলনায় চিন যে এবার ১৫টা ভোট বেশি পেল, আপাতদৃষ্টিতে সেটা ইঙ্গিত দিতে পারে যে, তাদের প্রতি অন্য সদস্যদের সমর্থন বেড়ে গেছে, কিন্তু আদতে মোটেই তা নয়। নাগরিক গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জাতিসংঘের পরিচালক লুই চারবোনিউ বলেছেন, “এশিয়া গ্রুপে সর্বশেষ স্থানে এসেছে চিন; চিনের সংখ্যা এখনও ইন্দোনেশিয়ার ১৮৬, কুয়েতের ১৮৩ এবং জাপানের ১৭৫-এর পিছনে রয়েছে। যদি আরও প্রতিযোগিতা হত, চিন হেরে যেত এবং এটাই হওয়া উচিত ছিল।”

চিন কিন্তু মানবতার অধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত অভিযোগ বরাবর, কঠোরভাবে অস্বীকার করেছে— সে তিব্বতই হোক, বা হংকং, বা অন্য কোথাও। সুতরাং জিনজিয়াং-এর বেলায়ও তার অন্যথা হয়নি। সেখানকার ক্যাম্পের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠে আসতেই, প্রথমে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে না জানার ভাব করলেও, পরে দুনিয়ার চাপের মুখে পড়ে বেইজিং সাফাই দিয়েছে, উইঘুরদের সুবিধার্থে ওই “বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র” ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। বেশ একটা গালভরা নাম ও দিয়েছে তারা ক্যাম্পের “পুনঃশিক্ষা শিবির”। আচ্ছা, বলুন তো, তাই যদি হবে, তবে, কোন হিসাবে ৩-৬ বছর বয়সি শিশুদেরকে, এই প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এবং সেও রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে। বিশ্ববাসীকে ভাঁওতা দেওয়ার কী চমৎকার মতলব।

২০১৮ সালে জিনজিয়াংয়ের উইঘুর-সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর তুর্পানের একটি স্কুলে প্রবেশের পথ। গেটে-র মুখেই চিনা ভাষায় লেখা আছে: আপনি স্কুল-প্রাঙ্গনে প্রবেশ করছেন। অনুগ্রহ করে “জাতীয় ভাষা” মানে “ম্যান্ডারিন চাইনিজ” বলুন

ওদিকে ভোটের ফলাফল আসতেই, জাতিসংঘে চিনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন গদগদভাবে নির্বাচনে চিনের সকল সমর্থনকারীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন; রাষ্ট্র-নির্দেশিত এক বিদেশি সাংবাদিক-দলের জিনজিয়াং সফরের একটা সাম্প্রতিক টুইটের রিপোস্টও করেন তিনি যেখানে, উজ্জ্বল ঐতিহ্যবাহী পোশাকে উইঘুরদের আনন্দ-নাচের একটা ছবি তুলে ধরা হয়েছে— মানুষের চোখে ঠুলি পড়াবার কত না প্রচেষ্টা! তাও যদি না, ২০২২ সালে বিবিসি-র হাতে উঠে আসত সেই পুলিশফাইলগুচ্ছ, যেগুলো থেকে প্রকাশ পেল: এই শিবিরগুলোতে সশস্ত্র চিনা অফিসারদের নিয়মিত ব্যবহার করা হয় এবং যেসব উইঘুররা পালানোর চেষ্টা করে তাদের উপর ‘শুট-টু-কিল’ নীতি ব্যবহারের ঢালাও অনুমতি রয়েছে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কী ব্যর্থ চেষ্টা গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের!

কিন্তু সবাই অত বোকা নয়! প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে চিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, ঝাং জুনের এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার মাধ্যমে জিনজিয়াং-এর কালিমাময় ঘটনাকে নতুন আকার দিতে চাইছে চিন। মার্কিন হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান চিনা সরকারি দমনপীড়নের প্রচুর প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেসের ইউকে ডিরেক্টর, রাহিমা মাহমুত দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, গত ছয় বছর ধরে জিনজিয়াং-এ চলমান গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধে জড়িত যে চিন, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে তার কোনও স্থান থাকতে পারে না। স্যার জিওফ্রে নিসের কথা মনে আছে? ওই যে যিনি প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অংশ নিয়েছিলেন এবং স্লোবোদান মিলোসেভিচের বিচারে প্রধান প্রসিকিউটর ছিলেন। সেই নিস এখন চিন ট্রাইব্যুনাল এবং উইঘুর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান, যারা স্বাধীনভাবে চিনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করেছে। ২০২১ সালে এই ট্রাইব্যুনাল নির্ধারণ করে যে, চিনা সরকার পশ্চিম চিনা অঞ্চলে তার পদ্ধতিগত জোরপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং গণবন্ধ্যাকরণ অভিযানের মাধ্যমে গণহত্যার জন্য দোষী। বিশ্ব চিন্তাকুল হয়ে উঠেছে: হলোকাস্টের সময়কার নাৎসি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বিভীষিকা কি তবে আরেকবার ফিরে এল এই একবিংশ শতাব্দীতে? হ্যাঁ ক্যাম্পের ভিতরের খবরাখবর জানতে পারলে আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। শুনবেন, কেমনভাবে চিন সাম্রাজ্যে দিনাতিপাত করছেন জিনজিয়াং-এর উইঘুররা?

উইঘুরদের উপর তাঁর সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। ঘর থেকে বেরিয়ে মাত্র কয়েকটা ব্লক যেতে-না-যেতেই কোনও একটা চেকপয়েন্টের মুখোমুখি হন উইঘুররা, যেখানে লুকানো থাকে জিনজিয়াং-এর কয়েক হাজার নজরদারি ক্যামেরার মধ্যে কোনও একটা। সেই ক্যামেরার ফুটেজগুলো অ্যালগরিদম দ্বারা প্রসেস করা হয় যা, উইঘুরদের তথাকথিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় পুলিশের তোলা স্ন্যাপশটের সঙ্গে মুখের ছবি মেলায়। এই চেকিংগুলোর সময় পুলিশ উইঘুরদের সম্ভাব্য সমস্ত শারীরিক তথ্য বের করার জন্য তাদের উচ্চতা পরিমাপ করে, রক্তের নমুনা নেয়, ভয়েস রেকর্ড করে এবং ডিএনএ সোয়াব পরীক্ষা করে। এখানেই শেষ নয়, কিছু উইঘুরকে জেনেটিক ডেটা-মাইনিং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। জানতে চান কী সেই পরীক্ষা? উইঘুরদের ডিএনএ কীভাবে স্বতন্ত্রভাবে উইঘুরসদৃশ চিবুক এবং কান তৈরি করে তার নির্ণয়। উইঘুর মহিলাদের গর্ভাবস্থা পরীক্ষার নমুনা শুনলে শিউরে উঠবেন। কিছুজনকে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করা হয়, বা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁদের শরীরে জোর করে আইইউডি (ইন্ট্রা উটেরিন ডিভাইস) ঢোকানো হয়। অন্যদের রাষ্ট্র দ্বারা বন্ধ্যা করে দেওয়া হয়। পুলিশ অননুমোদিত শিশুদের তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়, যাদের পরে আটক করে রাখা হয়। এই ধরনের পদক্ষেপ তিন বছরের মধ্যে জিনজিয়াং-এর কিছু অঞ্চলে উইঘুরদের জন্মহার ৬০ শতাংশের বেশি কমিয়ে দিয়েছে।

এবার আসুন এক ঝলক দেখে নিই, কারা এই উইঘুররা আর তাদেরকে নিয়ে সিপিসি-র সমস্যাটাই বা কোথায়?

মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠী এই উইঘুররা। উইঘুররা চিনের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রধান সুন্নি মুসলিম জাতিসত্তা এবং উইঘুর পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ইসলাম। মূলত চিনের জিনজিয়াং, যা আনুষ্ঠানিকভাবে জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ওরফে জুয়ার (Xinjiang Uyghur Autonomous Region, XUAR) নামে পরিচিত, সেখানে বর্তমানে ১১০ লাখের উপর উইঘুর বসবাস করেন। এই সংখ্যাটা কিন্তু জিনজিয়াং-এর সমগ্র জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম। চিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রধান জাতিগোষ্ঠী হান চিনাদের থেকে তারা  আলাদা। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে জিনজিয়াং-এ হান-দের ব্যাপক অভিবাসন দেখা গেছে, অভিযোগ উঠেছে সেখানকার সংখ্যালঘু উইঘুর জনসংখ্যাকে দুর্বল করার জন্যই বেইজিংয়ের এই ছক। উইঘুর এবং হান উভয়ই জিনজিয়াংকে দাবি করে। উইঘুররা বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চায়, ওদিকে হান সরকার এটিকে একটি সীমান্ত অঞ্চল থেকে একটি একক চিনা রাষ্ট্রের একটি “অখণ্ড” প্রদেশে রূপান্তর করার চেষ্টা করছে। অতএব দুই তরফের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের উদ্রেক। ফলাফল? দুই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধ ও বিক্ষিপ্ত সহিংসতা। আর সেই মওকাতেই ধর্মীয় চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার নামে সিপিসি জুয়ারকে গোপনীয়তায় আবৃত এক বিশাল বন্দিশিবিরে পরিবর্তন করেছে— ঠিক যেমনটি হলোকাস্টের সময় নাৎসিরা করেছিল ইহুদিদের বেলায়।

দেখুন, সিপিসি-র দ্বারা উইঘুরদের নিপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণের প্রকল্প কোনও বিচ্ছিন্ন কাহিনি নয়, ইতিহাস জানে যে গণতন্ত্রের নির্মম প্রতিরোধ, মানবাধিকারের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা ও স্বৈরাচারিতার অবলম্বন— এ-সবই চিনা সম্রাট জিয়াওয়েন দ্বারা ৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদের এক পদ্ধতিগত নীতি। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের নেতারা চিরকালই নিজেদেরকে একটা চিনা রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী হিসেবেই দেখেন যেটা লিপিবদ্ধ ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ই একটা পরাশক্তি ছিল। সম্রাটের উত্তরসূরিরা আজও তাই পরম নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন সেই অতি পুরাতন রণকৌশল, এটাই সিপিসি-র আগ্রাসী ক্ষমতার উৎস। দুনিয়া দেখেছে ১৯৮৯ সালে চিনের কমিউনিস্ট শাসকরা তিয়েন-আনমেন স্কোয়ারে কীভাবে নিজেদের ছাত্র-বিক্ষোভ চূর্ণ করেছিল, কীভাবে তাদের নিজস্ব নাগরিকদেরকেই অম্লানবদনে হত্যা করেছিল; তাহলে এখন যখন বেইজিংয়ের মাথাব্যথার কারণ দেশেরই একটা অচৈনিক সংখ্যালঘুগোষ্ঠী, ভেবে দেখুন সুধীগণ, তাদের শায়েস্তা করার জন্য, শাসকদের অত্যাচারের পরিমাণটা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে!

উইঘুরদের বিষয়ে শি জিনপিং সরকারের মূলনীতি: ’ওদের বংশ নিশ্চিহ্ন করে দাও, শিকড় উপড়ে ফেলো, সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দাও, এবং ওদের উত্স বিলুপ্ত করো!’ ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার আগে আক্রান্ত অঙ্গগুলোকেই কেটে সরিয়ে ফেলাই যে সমীচীন, সেটা মাথায় রেখেই ২০১৪-র মে মাস থেকে জিনজিয়াং-এ তাদের কর্মপন্থা শুরু করেছিল সিপিসি! যেন-তেন-প্রকারেণ উইঘুরদের জাতিগত বিশিষ্ট পরিচয়, স্বতন্ত্র ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সব ধুয়েমুছে সাফ করে, তাদেরকে চৈনিক করে তোলার বা ইসলামের সিনিসাইজেশনের তীব্র প্রচেষ্টায় বদ্ধপরিকর শি জিনপিং। মুসলিম ধর্মীয় ঐতিহ্য যেমন মাথার স্কার্ফ পরা বা মুখ ঢেকে রাখা এবং ছেলেদের বড় দাড়ি রাখা অনগ্রসর, সেকেলে বা চরমপন্থার প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচারণা চালানো হচ্ছে। গত ছয়-সাত বছরে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পবিত্র মসজিদ এবং উপাসনালয়; যাঁরা সেগুলো পরিদর্শনে গেছেন তাঁদেরকে ধর্মীয় চরমপন্থার মিথ্যা অভিযোগে দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে কবরস্থান— উদ্দেশ্য? বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া উইঘুরদের আধ্যাত্মিক ইতিহাস। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ করা বা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো সামান্য কারণগুলোর জন্যও বিদেশ থেকে জিনজিয়াং প্রদেশে ফিরে আসা একশোরও বেশি উইঘুর ছাত্র নিখোঁজ হয়ে গেছে, অন্যরা কারাগারে নির্বিচারে আটক হয়েছে বা আটক অবস্থায় মারাই গেছে। বিশিষ্ট উইঘুর ব্যক্তিত্ব যাঁরা তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তাঁরাও হয় হাজতবাস করছেন বা ভোজবাজির মতো রাতারাতি অদৃশ্য হয়েছেন। জিনজিয়াং-এর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আইন বাস্তবায়নের জন্য সোচ্চার হওয়ার পরপরই বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কিত অভিযোগে ২০১৪ সাল থেকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন অর্থনীতিবিদ ইলহাম তোহতি। ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক রাহিলে দাউতকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুই হুয়া ফাউন্ডেশন অধিকার গোষ্ঠী কদিন আগেই নিশ্চিত করেছে অধ্যাপক দাউতকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে চিন। তাঁর অপরাধ? সিপিসি বলছে, দাউত নাকি চিনা জাতিকে বিভক্ত করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। দাউত একজন অসামান্য শিক্ষক ও গবেষক, উইঘুর সংস্কৃতির উপর করা তাঁর কাজ তরুণ সমাজের কাছে এক মহা সম্পদ; দেশবিদেশে ছড়িয়ে আছে তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তের দল, তিনি কোন দুঃখে বিভক্তবাদী হতে যাবেন? চিন একথা ভাল করেই জানে যে, উইঘুরদের শিক্ষার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারলে, ওদের শিরদাঁড়ায় জব্বর চোট পৌঁছানো যাবে, ওরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, তাই ভুয়ো মামলা সাজিয়ে দাউতকে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৮-র জানুয়ারিতে চিনা পুলিশ হেফাজতে সন্দেহজনকভাবে মারা গেছেন ইসলামি শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ সালিহ হাজিম। আর পপশিল্পী আব্দুরহিম হেইত? প্রথমে শোনা গেছিল বন্দিশিবিরে তিনি মারা গেছেন, খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই, চিনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম একটি ভিডিও প্রকাশ করে যাতে দেখানো হয়: হেইত বলছেন যে তিনি “সুস্থ” আছেন। কিন্তু সেই ভিডিও-র সত্যতা নিয়ে অনেকেরই দারুণ সন্দেহ রয়েছে। হেইত গুমখুন হয়েছেন, না এখনও বেঁচে আছেন— কেউ তার সঠিক হদিশ জানে না। এইভাবে, উইঘুর বুদ্ধিজীবীদের সমাজের বুক থেকে একে একে লোপাট করে দিলে, উইঘুর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা ও সংরক্ষণের কাজটিকে সমূলে বিনাশ করা যাবে, আর জুয়ারকেও তখন পুরোপুরি নিজেদের কুক্ষিগত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যাবে— চিনের বিস্তৃত পরিকল্পনার রূপরেখা এমনটাই।

এরই সঙ্গে সঙ্গে, জিনজিয়াং-এর উইঘুর সংখ্যালঘুদের হান-সংখ্যাগরিষ্ঠ জীবনধারায় জোরপূর্বক আত্তীকরণের কাজটিও ছলে বলে কৌশলে হাসিল করা সিপিসির আরেকটি স্পষ্ট লক্ষ্য। কপালজোরে যেসব উইঘুররা বন্দিশিবির থেকে রেহাই পেয়েছে, পৃথিবীতে তারাই আজকে সবচেয়ে বেশি নজরদারির আওতায় থাকা জনসংখ্যা। চিনা সংস্কৃতির মূলধারায় উইঘুরদের আত্তীকরণ ঠিকঠাক হল কিনা তা যাচাই করার জন্য, জিনজিয়াং-এর প্রাচীন সিল্ক-রোড শহরগুলির বাড়িতে বাড়িতে হাজার হাজার হান চিনা “বড় ভাই ও বোনদের” স্থানান্তরিত করেছে চিনা সরকার। তারা উইঘুর পরিবারের সঙ্গেই খাবার খায় এবং কিছু “বড় ভাই” কারারুদ্ধ উইঘুর পুরুষদের স্ত্রীদের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমায়। বুঝতেই পারছেন, সব নজরদারি কিন্তু ডিজিটাল নয়!

মজার ব্যাপার, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং সরকার যখন জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুরদের প্রতি মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে গণহত্যা বলে চিহ্নিত করেছে, সিপিসি তখন তার পদক্ষেপকে চরমপন্থী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া হিসাবেই বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করেছে। জিনজিয়াং অঞ্চলে শান্তি আর সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই নাকি সিপিসির একমাত্র লক্ষ্য। ২৬ আগস্ট, ২০২৩ জিনজিয়াং সফরে এসে উইঘুরদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতিগুলো আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলার কথা বলেছেন শি জিনপিং, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নাকি কোনও রেহাই নেই তাঁর জমানায়। ভাবতেই আতঙ্ক হয়, কী আছে উইঘুরদের ভাগ্যে।

এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, উইঘুরদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব দেশগুলো কিন্তু চিন-বিরোধী অভিযোগের প্রকাশ্য আন্তর্জাতিক নিন্দায় যোগ দেয়নি। তারা যে শুধু নিশ্চুপই রয়েছে তাই নয়, উইঘুর প্রসঙ্গে চিনকেই তারা সমর্থন করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে চিনের কর্তৃত্ববাদী প্রভাব, এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের সম্পর্ক থাকার দরুনই মূলত এই দেশগুলো দূরে সরে আছে। এই ধরুন না, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াও বেইজিংকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে ভয় পায়, পাছে চিনা বিনিয়োগ বিপন্ন হয়ে যায় বা প্রতিশোধস্পৃহায় পাপুয়া অঞ্চলের খ্রিস্টান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বসে চিন— অনেকেরই তো এরকমই কোনও-না-কোনও কারণে টিকিটি বাঁধা রয়েছে পুঁজিপতি ক্ষমতাধর চিনের কাছে।

উইঘুর সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা এবং জিনজিয়াং-এর প্রান্তিক ভৌগোলিক অবস্থানও সম্ভবত তাদের প্রতি বিশ্বের প্রধান আরব রাষ্ট্রগুলোর উদাসীনতার এবং দায়িত্ববোধ প্রদর্শনে নিরুৎসাহের আরেকটা সূক্ষ্ম কারণ। মধ্যপ্রাচ্যের সমর্থনের অভাব উইঘুরদের জন্য একটা বিশাল মানবিক ট্র্যাজেডি এবং আশাভঙ্গের ধাক্কা আর চিনের প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থা ও স্ট্র্যাটেজিক রি-অ্যালাইনমেন্ট দুটোই প্রতিফলিত করে।

আচ্ছা, উইঘুরদের সঙ্গে যাদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক নিবিড় বন্ধন রযেছে, সেই তুরস্ক, কোন পথে হাঁটছে সে? প্রথম প্রথম উইঘুরদের দুর্দশার বিষয়ে সোচ্ছার হলেও, গত দুই বছরে চিনের সমালোচনা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে সে। রাজনীতিবিদরা তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের এই নীরবতাকে একটি কৌশলগত ভুল বলেই সমালোচনা করছেন। মুসলিম বিশ্বের নৈতিক নেতৃত্বের প্রতি এরদোগানের উচ্চ দাবিকেই ক্ষুণ্ন করে এই নিস্পৃহতা।

জিনজিয়াংয়ের উইঘুর জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চিনা কর্মকর্তাদের উপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হাওয়া মাত্রই বেইজিং সব অভিযোগ কঠোরভাবে অস্বীকার করেছে, এবং দাবি করেছে যে তারা দেশীয় সন্ত্রাসবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। উইঘুরদের গণহত্যার ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চিন নানাবিধ প্রচেষ্টা যেমন, পর্যটন বৃদ্ধি, বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনীতিক এবং সাংবাদিকদের জিনজিয়াং-এ আমন্ত্রণ জানানো ইত্যাদি নিরন্তর চালিয়ে গেলেও আশার কথা, এই অক্টোবর মাসেই, একটি যৌথ বিবৃতিতে, উইঘুরদের প্রতি চিনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন— সব মিলিয়ে ৫১-টি দেশ। ২০১৯ সালে, স্বাক্ষরকারী দেশের এই সংখ্যাটা ছিল মাত্র ২০। এই ঘটনা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় যে জিনজিয়াং-এর গণহত্যার বিষয়ে বহির্বিশ্বের কাছে ভুল তথ্য প্রচারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে চিন। আশার কথা বিশ্ববাসী জেগে উঠছে; গণতন্ত্রের জন্য অগ্রাধিকারের উপর নির্মিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় চিনা সরকারের জন্য পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে জনগণের রোষ, ধিক্কার ও উপযুক্ত শাস্তির দাবি; অপেক্ষা শুধু উপযুক্ত সময়ের।

 

তথ্যসূত্র:


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...