মায়েদের কথা

সাধন দাস

 

ট্রেন পৌঁছুল দিন-দুপুরে। গা-জ্বালানো রোদ্দুর, তবু মনে হল সোনা ছড়ানো। মাঝরাত্তিরেও বনগাঁর মাটিতে পা রাখলে শরীর মন ঝলমল করে ওঠে। নিজেকে হাল্কা লাগে। অনেকদিন চারপাশের উপর না ফলাতে পারা অধিকারবোধ একটু বেশি জেগে ওঠে। পথে চেনা ঘর বাড়ি দোকানপাট পুকুর মাঠ আকাশ বাতাসের ভিতর নিজেকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। নতুন গাছপালাও চেনা মনে হচ্ছে। অচেনা মানুষজনও আপন। জন্মভূমির এমনই গুণ। রাস্তায় ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছিলাম—

—এবাদতকাকা চললে কোথায়?
—শিবুজ্যাঠা, বাড়ির সবাই ভাল তো?
—লক্ষ্মীদিদি, আমার মা কেমন আছে?

লক্ষ্মীদিদি বলল— তাড়াতাড়ি বাড়ি যা।

মা বেঁচে থাকতেই বাড়ি পৌঁছুতে পেরেছিলাম। বাইরের বারান্দায় শুইয়ে রাখা ছিল মাকে, অসাড় দেহ। খানিক আগুনে দুপুর এসে গায়ে লাগছে, খানিক ঘরের শীতল ছায়া। তখনও মা যন্ত্রণামুগ্ধ আশার জীবনে বেঁচে। কিছুতেই মরছিল না। আবার বেঁচেও ছিল না। অন্তর্লীন মৃত্যুকামনা তাঁর জীবন ছিঁড়ে খাচ্ছিল। মুখখানায় কালচে ছাপ পড়েছে। ঠোঁট দুটোতে আশ্চর্য প্রশান্তির হাসি। রূপা আমার অপেক্ষায় ছিল। আমাকে নিয়ে এগিয়ে গেল। মায়ের মাথার কাছে বসে এক ঝিনুক গঙ্গাজল মুখে দিতেই মায়ের শেষ তৃষ্ণা মিটে গেল। ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে এল সবটাই, অবিকৃত মুখে লেগে রইল পৃথিবীর খানিক তৃপ্ত অনুভব। ঠোঁটে শান্তির রেশ, যা ছিল আমাদের সংসারের পার্থিব নিশানা।

কেউ বলল— ছেলের বৌয়ের হাতে জলটুকু পেতেই বেঁচে ছিল।
কেউ বলল— বৌটা মৃত্যু নিয়ে এসেছে। এবার শান্তি পেল।
কেউ বলল— বলোহরি হরিবোল।

 

বহরমপুর এলে মায়ের সঙ্গে অনেকখানি বনগাঁ বহরমপুরে চলে আসত। শীতের সকালে মা ঝুলবারান্দার ধাপিতে হলুদ চাদর গায়ে বসে থাকত। উজ্জ্বল একটা হলুদ পাখি তখন কাঁটাওয়ালা চন্দনগাছটায় এসে বসত। মনে হত চন্দন নয়, ওটা বনগাঁ-বাড়ির উঠোনে বাবার হাতে পোঁতা লিচুগাছ। হলুদ পাখি আর মা দুজনে মিলে দিনের নতুন উষ্ণতায় আয়েস করত। পাখিটা এ ডাল থেকে ও ডালে, মা টুকটুক করে সারাবাড়ি টহল দিত। মায়ের দিকে তাকিয়ে আমার ভুল হয়ে যেত বনগাঁয় আছি না বহরমপুরে। বনগাঁর বাড়ির মতোই এ-বাড়িরও সমস্ত কর্তৃত্ব মায়ের। তবু এ-বাড়ির অধিকারবোধে মার কোনও টান ছিল না। এ-ঘর ও-ঘর সর্বত্র ঘুরে বেড়াত। এটা দেখত, ওটা আদর করত। কোনও ভুল ধরত না। অধিকারের সৌন্দর্য উপভোগ করত। চোখে উপচে পড়ত খুশি। মুখে লেগে থাকত সার্থকতার তৃপ্তি। এই বাড়ি, ছেলে, বৌমা, দুই নাতি সব তারই। তবু তার নিজের সংসার সেই স্বামীর ভিটে, বনগাঁ। ছেলের বাড়িতে মা বেড়াতে আসে। একবার এসেছে, ৩৬৫ সুগার। ডাক্তার দেখানো, ওষুধ খাওয়ানো, বিকেলের রোদ্দুরে হাত ধরে বাড়ির ছাদে হাঁটানো, ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত রূপা। সুগার নর্মাল হওয়া অবধি রূপা মাকে জোর করে রেখে দিয়েছিল। সুস্থ হলে মা অবাধ্যের মতো চলে গেল। প্রতি মাসে রূপাই বনগাঁ যেত মায়ের দেখাশোনা করতে। ওর লক্ষ্য ছিলো সুগার যেন না বাড়ে। মা সুস্থ থাকে। মা আর নেই। পড়িমড়ি করে মাসে মাসে বনগাঁ যাওয়ার ব্যস্ততা রূপার আর থাকল না।

হায়ার এডুকেশনে দুই ছেলে তখন কলকাতায়। থাকে দমদম। ছেলেদুটোকে সামলাতে রূপাকে সেখানে থাকতে হয়। বাড়ি সামলাতে যেতে হয় বহরমপুর, মাসে একবার বনগাঁ। বর সামলাতে শিলিগুড়ি। তখন আমার সেখানে পোস্টিং। তার নিজের বলতে একটা ছুটন্ত জীবন। বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বলত— মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে ঠিক করতে পারিনে, কোথায় আছি? দমদম, বহরমপুর, বনগাঁ, না শিলিগুড়ি?

মাথায় হাত বুলিয়ে বলতাম— আমার বুকের মধ্যেই আছ। একটু বেশি জায়গা জুড়ে। দমদম থেকে শিলিগুড়ি তুমিই বেঁধে রেখেছ।

কী জানি কেন, রূপার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত!

 

তিন বছর পর ট্রান্সফার হয়ে বহরমপুর ফিরেছি। রূপার শিলিগুড়ি-ধকল কমেছে। সেবার বনগাঁ গিয়ে দেখে, মায়ের অবস্থা কাহিল। যন্ত্রণাকাতর, গোল পাকিয়ে শুয়ে আছে। গায়ের হলুদ চাদরখানা মলিন, রোঁয়া উঠে গেছে, পালক ছাড়ানো পোল্ট্রি মুরগির মতো। শ্যামবর্ণ শরীর কালো। বাড়ি থেকে কেউ উৎসাহ দিল না। সবাই ধরে নিয়েছে মা মারা যাবে। রূপা নিজের দায়িত্বে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে গেলো আরজিকর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুরঞ্জয় (খুড়তুতো ভাই) গিয়েছিল সঙ্গে। ছোটছেলে তখন আরজি কর-এ হাউসস্টাফ। ভর্তি করিয়ে দিল। সে ঠাকুরমাকে ডাকে ‘বৌ’। ছেলের সঙ্গে ছেলের হাউসস্টাফ-বন্ধুরাও মাকে বৌ ডাকে। হাসিহাসি মুখে মা উপভোগ করে। হাউসস্টাফদের বৌ বলে কথা! ধবধবে সাদা বিছানা, বালিশ। সাধারণের মধ্যেও বিশেষ। টুকটুক করে ঘুরে বেড়ানো মানুষটা বিছানা আঁকড়ে ধূসর রঙের কালো ডোরাকাটা চাদর গায়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। মনে হয়, উজ্জ্বল হলুদ পাখি ডানা হারিয়ে ডোরাকাটা ধূসর হয়ে গেছে। চাদরখানা রূপা কিনে দিয়েছে। সাদা সাদা কাকাতুয়ার মতো নার্সদিদিমণিরা ঘুরে বেড়ায়। কর্কশ স্বরে তদারকি করে। মা মানে ডাক্তারবাবুদের বৌ ডাকলেই, ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে আসে। কাকাতুয়ারাও মায়ের কাছে নরম ব্যবহার করে। মা কথা প্রায় বলেই না। যেটুকু বলে, রুগ্ন স্বরে সবার সঙ্গে সমান আন্তরিকতায়। বুড়ো বয়সে এসে মায়ের ধর্মকর্মে মতি হয়েছে। জাতপাতের বাতিকও হয়েছে। কিন্তু এখানে কে কোন জাতের বুঝতে পারে না। এক দাড়িওয়ালা মুসলমান হাউসস্টাফ নাতি এসে জিজ্ঞেস করে— কেমন আছ বৌ? নাতির বন্ধু, নাতি বলে কথা! মায়ের বিষণ্ণ মনে অনিচ্ছাতেও চাপা খুশি ছড়িয়ে পড়ে। এক চাটুজ্জে হাউসস্টাফ নাতি, পাখির স্বর নকল করে ডাকে— বৌ কথা কও। মা খুশি আর চাপা রাখতে পারে না। গায়ে কাঁটা দেয়। হাসির হুল্লোড় বয়ে যায় চারপাশে। প্রিয়তম বৌ ডাকের সম্পর্ক নিয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে আন্তরিকতার ঢেউ খেলা করে। মায়ের হিঁদু মুসলমান মুচি মুর্দফরাস আচারবিচার ভুল হয়ে যায়। শাশুমা, বৌ, নাতবৌ, ঠাকুমা, মা… যার যা ইচ্ছা হয় বিচিত্র সম্পর্কে ডাকে। ওরা ডেকে আনন্দ পায়। সবার আপন হয়ে ওঠার ঐশ্বর্যে মা দিন দিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জাতপাত, ছোঁয়াছুয়ির পাট চুলোয় যায়। মজলিশ বসে মাকে ঘিরে। চারপাশে অসুখ, যন্ত্রণা কাতরানির মধ্যে মায়ের সুখের সুস্থ হয়ে ওঠা। মা যখন একা থাকে, চারপাশে তাকিয়ে দেখে, অসুস্থ মানুষে ভর্তি হাসপাতাল। কত মানুষের কত দুঃখযন্ত্রণা! দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রূপা বুঝতে পারে, বনগাঁর বাড়িতে মা সুখে নেই। যতখানি শরীরের তার চেয়ে মনখারাপের অসুখ কম নয়। কষ্টে আনন্দে সুখ অসুখে দিন কেটে যায়। হাতের কাজে ফুরসত পেলেই প্রিয়জনেরা মায়ের পাশে এসে বসে। সুখদুঃখের কথা বলে। ধূসর কালো ডোরাটানা চাদরে ঘোমটা টেনে মা উঠে বসে। যেন বৌ কথা কও পাখি, যেন নতুন বৌ, পৃথিবীতে সবাইকে সমান গুরুত্ব দেয়, সমান সম্মান দিয়ে কথা বলে, শোনে। দুঃখের কথা হলে মুখে ফুটে ওঠে সমব্যথী মানুষের অভিব্যক্তি। সুখের হলে ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। বনগাঁর সবাই ভেবেছিল, মা আর বাঁচবে না। হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ডাক্তার, স্টাফ, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী সকলের ব্যবহারে, যত্নে, চিকিৎসায় মা ভাল হয়ে উঠল।

 

মায়ের ছুটি হয়ে গেছে। নিয়ে যেতে হবে। সকাল থেকে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। দুর্যোগ শুরু হয়েছে। আমি সুদখোরের অফিসে কাজ করি। দিনের প্রতি মুহূর্ত নিংড়ে আমার শেষ ক্লান্তি টিপে সময় বের করে নেওয়া হয়। ছুটি মেলে না। ছেলে হাসপাতালে নেই। ডিউটিতে অন্য কোথাও গেছে। বাড়ি থেকে কেউ নিতে আসেনি। পুরঞ্জয়ের গাড়ি পাঠাবার কথা ছিল। পাঠায়নি। মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রূপা সেই একা। মায়ের ছোটছেলের বৌ বলে পাঠিয়েছে, আমরা এতদিন দেখেছি। এখন শাশুড়িমাকে বড়বৌ রেখে দিক। আমরা কেউ আনব না। ছোটভাইয়ের বৌ চেয়েছিল মাকে আমাদের সংসারে ঠেলে দিতে। মায়ের গহনা, কাঁসা পিতল ভাগেযোগে দখল করা হয়ে গেছে। এখন অথর্ব নিঃস্ব বুড়ি, বোঝা। অতএব ঝেড়ে ফেলে দাও। বরাবরের জন্যে মাকে বহরমপুর নিয়ে যেতে চেয়েছি অনেকবার। মা যায়নি। সেই এক গোঁ স্বামীর ভিটেতেই মরবে।

তুমুল ঝড়বৃষ্টি। দুর্যোগে হাসপাতাল ফাঁকা। স্টাফ খুব কম, সবাই ব্যস্ত। সাহায্য করতে কেউ আসতে পারল না। রূপা একা। দু-একজন রুগিনী আর আয়ামাসি মাকে ট্রলিতে তুলে দিয়েছে। লিফট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে। রূপা চারতলা থেকে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে লিফটে করে মাকে নিচে এনেছে। মাটিতে একা বসিয়ে চারতলায় ট্রলি ফেরত দিয়ে এসেছে। ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে ফেরার এ্যাম্বুলেন্স ঠিক করেছে। বনগাঁ থেকে রুগি এনে ফেরত যাওয়া খালি এ্যাম্বুলেন্স। একটু সস্তায় হয়েছে। হাসপাতালের মধ্যের এ্যাম্বুলেন্সওয়ালারা বাইরের এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে ভাড়া নিতে দেবে না। বনগাঁর এ্যাম্বুলেন্সকে তাড়িয়ে দিয়েছে সীমানার বাইরে। শেষ পর্যন্ত ভাগনে বুবুন এসেছিল বৌকে (নাতিরা সবাই মাকে বৌ বলেই ডাকে) নিতে। সে-ই মাকে পাঁজাকোলা করে প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ছুটেছে। হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্সওয়ালারা ভাড়া ধরতে পিছনে তাড়া করেছিল। প্রায় হাফমাইল দূরে রাখা এ্যাম্বুলেন্সে পৌঁছানোর দৌড়ে দুর্যোগই বুবুনকে জিতিয়ে দেয়। আর রূপা হামলাবাজদের লুকিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে এসে উঠলে গাড়ি ছাড়ল। বৃষ্টিতে ভিজে মা সপসপে, গোল পাকিয়ে গেছে। রূপা গামছা দিয়ে মাথা গা হাত পা মুছিয়ে, শুকনো কাপড় পড়িয়ে ধূসর চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে দিলে, বুবুন মাকে কোলের মধ্যে শুইয়ে নিয়েছে। মা চুপ।

বুবুন ডাকল— বৌ কথা কও।

মা ম্লান গলায় উত্তর দিল— বৌমা, আমাকে বনগাঁর বাড়ি নিয়ে চলো, আমি ওখানেই মরব।

তার ইচ্ছাকে সম্মান দিতে রূপা মাকে বনগাঁতেই পৌঁছে দিয়েছে। মায়ের বিশ্বাস স্বামীর ভিটে, পূণ্যভূমি।

রূপাকে বলেছিলাম— তুমি বনগাঁতেই থাকো। দেখো, মায়ের অযত্ন না হয়।

রূপা বনগাঁ থেকে গেল। তবে শ্বশুরবাড়িতে জায়গা হয়নি। বাবা মরার পর থেকে আমরা নিজের বাড়িতে ব্রাত্য। পাড়ার এমাথা-ওমাথা তফাত, রূপাকে থাকতে হয় ওর বাপের বাড়িতে। এবেলা-ওবেলা ও-বাড়ি গিয়ে মায়ের স্নান করানো, খাওয়ানো, সেবা যত্ন করে আসে।

 

বিয়ের পর রূপাকে বাড়ির অনেকেই পছন্দ করেনি। যে রূপা বিয়ের আগে মা, কাকিমা, বোনেদের ভীষণ প্রিয় ছিল, বিয়ের পর সেই রূপাকে মেয়েরাই সহ্য করত না। মায়ের তো মেয়ের সমান ছিল, বিয়ের পর রূপাই হয়ে উঠল মায়ের চোখের বিষ। মায়ের দুর্ব্যবহারেই বাবা আমাদের তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু মন থেকে আলাদা করতে পারেনি। ট্রান্সফারের চাকরি, মাটিয়ারি, কৃষ্ণনগর, দমদম যখন যেখানে থাকতাম, সংসারের ইচ্ছা অমান্য করে বাবা মাসে পনেরো দিন আমাদের কাছে এসে থাকত। সেই কারণে মা বাবাকে আকথা-কুকথা শুনিয়েছে। এমনকি সেজছেলেকে দিয়ে শিক্ষাও দিয়েছে। পাপ ছাড়ে না বাপ কেন, মাকেও। আমাদের উপর, বাবার উপর করা অন্যায়বোধে মা নিজেও কষ্ট পেত। বাবা মারা যাওয়ার পর সেইসব চাপা কষ্ট ফুটে ওঠে। দিনেরাতে মা ঘুমুতে পারত না। চমকে চমকে জেগে উঠত। প্রেশার সুগার বেড়েই থাকত। কখনও ভীষণ বেড়ে যেত। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে মা শেষ পর্যন্ত সন্দেহবাতিক, শুচিবাই, ধর্মগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দিনরাত পুজো-অর্চনা, মালা জপ নিয়ে থাকত। বাবা মারা গেলেও অহঙ্কার ভেঙে আমাদেরকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি কিন্তু বাবার সাহস সঞ্চয় করে মাঝে মাঝে আমাদের বহরমপুরের বাড়িতে আসত।

বহরমপুরের বাড়িতে ইদের দিন তোরাপ (কাজের ছেলে) খাসির মাংস দিয়ে যেত। একবার, মা তখন বহরমপুরে। তোরাপকে বিশ্বাস করেনি। জিজ্ঞেস করেছিল— ভগবতীর মাংস খাওয়াচ্ছ না তো? তোরাপ কেঁদে ফেলেছিল।

বলেছিল— আল্লার কসম মা, অমন গুনাহ করিনে।

ব্যাগের ভিতর মাংসের দিকে মা তবু সন্দেহের তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তোরাপ সৎ বুদ্ধিমান ছেলে, ঝোলার মাংস ফেরত নিয়ে সাত কিলোমিটার দূরের বাড়ি সাইকেলে ফিরে জ্যান্ত মোরগ এনে মায়ের সামনে ছেড়ে দিয়েছিল। কালো-বাদামি, তেলচকচকে, মাথায় লাল টকটকে ঝুঁটি। অহঙ্কারে পা তুলে তুলে হাঁটে। ক্কঁক ক্কঁক কক কক। ঘরময় ঘুরিয়ে তোরাপ প্রমাণ দিয়েছিল, গরু নয় জ্যান্ত মোরগ এনেছে। ছেলে কামালের মোরগ। জোর করে কেড়ে এনেছে। কাঁদতে কাঁদতে তোরাপ কলঘরের চাতালে মোরগটার কুরবানি দিয়ে ইদের গোস্ত বানিয়ে দিয়েছিল।

মুসলমান ঘরের মোরগ বলে মা সে মাংসও খায়নি। ধর্ম-বাতিকগ্রস্থ হয়ে মুরগির মাংস খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি মুরগির ডিমও খেত না। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর কী জানি, কী হলো! পুজো-অর্চনার বাতিক একদম নেই হয়ে গেল। একদিন রূপাকে আড়ালে ডেকে চুপিচুপি বলেছিল; মা, আমার খুব মুরগির মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। হাফিজদের কালো-বাদামি, লাল ঝুঁটিওয়ালা তেজি মোরগটা রেঁধে খাওয়াবে? তোরাপের মোরগটা তো ওরকমই দেখতে ছিল, স্বপ্নে আবার দেখলাম। তোরাপ সেদিন আমাকে মা বলে ডেকেছিল, মনে আছে তোমার?

রূপা চুপ। আপনমনে বিড়বিড়িয়ে মা বলছিল— তোরাপ, তোরাপের ছেলে খুব কষ্ট পেয়েছিল। ছেলেদের কষ্ট দেওয়া আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।

কোন তোরাপের, কার ছেলের কথা ভেবে মায়ের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল, কে জানে? তোরাপদের জন্যে পাওয়া কষ্টের মধ্যে আমাদের জন্যে পাওয়া, বাবার জন্যে পাওয়া কষ্টও কি মিশে ছিল না? বহরমপুরের তোরাপদের উদ্দেশ্য করে সবার জন্যে করা পাপমোচন করার জন্যে মা বনগাঁর হাফিজদের মোরগ খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিল।

রূপা হাফিজদের মোরগটা কিনে এনে নিজের বাপের বাড়িতে রান্না করে সন্ধের অন্ধকারে সবার অজান্তে মাকে খাইয়েছিল। মুরগির মাংস খাওয়ার অভ্যেস মার নষ্ট হয়ে গেছিল। তবুও আমিষগন্ধ সহ্য করে মা খেয়েছিল। রূপার মাথায় হাত রেখে বলেছিল— খুব সুন্দর খেয়েছি, মা। শান্তি হয়েছে। তোরাপকে আমার কথা বোলো। খোকাকেও বোলো।

তার কয়েকমাস পর মা গেল।

 

সবুর সয়নি, শ্রাদ্ধের রাতেই ভাই-ভাইবৌদের মিটিং বসেছিল সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে। আমাকে তলব পাঠানো হল। একদিন পর আত্মীয়-স্বজন খাওয়ানোর অনুষ্ঠান। চারদিকে হাজার কাজ! ম্যারাপ-বাঁধা কাজকর্ম ফেলে গেলাম। মেজভাই মদ গিলে মিটিংয়ের মধ্যমণি হয়ে বসেছিল। সাকরেদ হয়ে ছোটভাইয়ের বৌ মিটিং তদারকি করছে। আমার তখনও মায়ের কথা যখন-তখন মনে পড়ছে, কান্না পাচ্ছে। মিটিংয়ে আমি বসিনি। আমাকে মাস্তানের ভয় দেখানো হল। আমার রাগ হল। মিটিং ভণ্ডুল করে চলে এলাম।

বলেছিলাম, বাবার ব্যাঙ্কের টাকা, বিষয়সম্পত্তি কিছু নেব না। নিশ্চিন্ত থাক। তোরা মিলেমিশে থাকলেই আমি খুশি। ওরা বিশ্বাস করেনি। ব্যাঙ্কে বাবার অ্যাকাউন্টে প্রতিমাসে পাঠানো আমার টাকা বাবা খরচ করতেন না। যদি বাবার অ্যাকাউন্টের টাকা, বিষয়সম্পত্তির ভাগ নিই, হয়তো সেই ভয়ে রূপাকে অপছন্দের অজুহাতে আমাদেরকে বাড়িতে থাকার অধিকার দিত না। পরিবারের চক্রান্তে, সংসারে অশান্তির ভয়ে বিয়ের পর বাবা আমাদের প্রথমবার তাড়িয়েছিল। পাড়ার লেখাপড়া জানা শাহাদৎকাকার হাতের লেখায় নিজে সই করে আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে চিঠি দিয়েছিলেন। সেখানেই ছিল ওদের তাড়াবার জোর।

শ্রাদ্ধে খরচ হয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। ছোটভাই দিয়েছিল দু-হাজার, সেজভাই দিয়েছিল পাঁচ হাজার, মেজভাই দশ, বাকি আমার। অপরাধ, বাড়ি থেকে সুবিধা নিয়ে বড় হয়েছি, কোনও দায়িত্ব পালন করিনি। অনুষ্ঠানের পরদিন রাতে মিটিং আবার বসেছিল। ছুটি শেষ হয়ে গেছে। চলে যাব। ওই মিটিংয়েই সব হিসেব মিটিয়ে দিয়েছি। শ্রাদ্ধের বাকি টাকা চাইতে কেউ যেন এই ভিটেতে না আসে। মায়ের নামে অশান্তি না হয়। সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে জোর আলোচনা চলছিল। যেমন কষ্ট, তেমনই রাগ হচ্ছিল। মা চলে গেছে। কান পাতলে মায়ের হাঁটাচলার শব্দ ঘরদোরে এখনও পাওয়া যাবে। ওদের কষ্ট হচ্ছে না! লজ্জা করছে না! সম্পত্তিঅন্ত প্রাণ হয়ে গেছে ওদের! ওরা নিষ্ঠুর!! মিটিংয়ে কিছু বলতেই হল। বললাম— সম্পত্তি ভাগের কাগজে সই করব না। সম্পত্তি নিতেও আসব না। আমার অংশটুকু তোরা মারামারি কামড়াকামড়ি করে ভোগদখল করবি। যদি সই করতেই হয় আমার ভাগ আমি নেব। কিন্তু তোদেরই কাউকে দিয়ে দেব।

সমস্বরে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল—

—কাকে দিবি?
—কাকে দেব ঠিক করিনি।

কথাটা ওদের পছন্দ হয়নি। আগুনচোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। ওরা অনেক, আমরা সংখ্যালঘু। সেই রাতেই ভাই-ভাইবৌরা ভিটে থেকে আমাদের আবার তাড়াল। বোন-ভগ্নিপতিরা চুপ করে ছিল। এই নিয়ে তিন-তিনবার বাড়ি থেকে আমাদের তাড়ানো হল। শ্বশুরবাড়ি কাছে হওয়াই বারবার সেখানেই ঠেলে উঠি। সেবারও উঠেছি। পেছন পেছন মেজভাই ছুটে এসেছে। আত্মীয়স্বজন রয়েছে বাড়িতে। তাদের থাকাখাওয়ার খরচ নিতে ভুলে গেছে। শুনেছিলাম, আমারই দেওয়া ‘ভুলে যাওয়া সেই খরচ’-এর টাকায় অনুষ্ঠানের দুদিন পরের রাতে শ্রাদ্ধের প্যান্ডেলেই মদ মাংস নাচ গান হুল্লোড় চলেছে, আমাদের ভিটেছাড়া করতে পারার ফুর্তিতে।

ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি, আমার টাকায় মায়ের শ্রাদ্ধের প্যান্ডেলে মদ মাংস নাচ গান হুল্লোড় হবে। এক অসহ্য কষ্ট আমাকে, রূপাকে অস্থির করে তুলছিল। সে রাতে আমি আর রূপা বেরিয়ে পড়েছিলাম। দুজনেরই আজন্ম বেড়ে ওঠা জন্মভূমি, এই বনগাঁ। হাতের কাছে যা পাচ্ছি ছুঁয়ে দেখছি। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করছি। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। হাঁটছি। অন্ধকার ভেদ করে চলেছি। কত পথ হেঁটেছিলাম হিসেব রাখিনি। যেন বনগাঁ, বহরমপুর, কলকাতা, শিলিগুড়ি হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইছামতীর তীরে এসে বসেছি। মাথার উপর বহুকালের শিরিষ, রাত্রি মেখে জমাট বেঁধে আছে। রাত্রির ছায়া নেমে এসেছে আমাদের উপরে। শ্বাপদ প্রহর ঘোষণা করল। তারপরই নৈঃশব্দ্যের সূচনায় কেঁদে উঠলাম। এক কান্নায় দুজনই কেঁদে চলেছি। চোখের নিচে ইছামতী। অশ্রুধারা আগুনের মতো গরম। জন্মভিটে ছেড়ে চলে যাব? চৌদ্দপুরুষের ভিটে, নদী, মাঠ, ঘাট, আকাশ, বাতাস প্রাণে কী ভীষণ আঁকড়ে আছে! রক্ত মাংস মজ্জায় কী গভীর শিকড় গেঁথেছে! ভাবনায় চিন্তায় ভাষায় আচার আচরণে মিশেছ। কিছুতেই উপড়াতে পারছিনে। অপমানিত, অত্যাচারিত, বঞ্চিত হয়েও অনিবার্য টানে মিশে আছি এই মাটিতে। লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে বারবার এই ভিটেতেই ফিরি। উঠোনে পা দিলেই ভাইবৌরা বাড়ি ছেড়ে লুকিয়ে পড়ে। থাকলেও কথা বলে না। গেরিলাযুদ্ধ চালায়। ফাঁকা বারান্দা ঘর, পড়ার ঘর, চেয়ার টেবিল, বিছানা, বালিশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে বেড়াই। দেওয়ালে এক জায়গায় নিজে হাতে নিজের ছবি এঁকে রেখেছিলাম। ওরা মুছে দিয়েছে। মোছা সেই কাল্পনিক দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বললাম, অধিকার ছেড়ে চলে যাবি? সামনে না থাকলে, প্রতিবাদ না করলে, ওরা বেড়ে যাবে। চলে যাওয়াকে ওরা বলবে পালিয়ে যাওয়া। ওদের বড় হওয়া এই প্রকৃতি সমাজ সংসার শিক্ষা সংস্কৃতির অন্য একটা ধারায়ই তোদের বড় হয়ে ওঠা। এ জন্মভূমি তোদেরও। ওদের হাতে বিলিয়ে দিবি? একতরফা নোংরামিতে ভরিয়ে দিচ্ছে। পাল্টা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে জন্মভূমির সব গৌরব ওরা নস্যাৎ করে দেবে। সত্যিকে মিথ্যে, মিথ্যেকে সত্যি করে তুলতে হাজার উপায় বেরিয়ে গেছে। জন্মভূমি, ভিটে যদি একবার বিষয়-সম্পত্তি হয়ে ওঠে, উফ! সে কী ভীষণ জটিল! কী ভয়ঙ্কর বিচ্ছিন্নতাকামী!! প্রাণান্তকর!! জড়িয়ে ধরলাম রূপাকে। রূপাও বুঝি আমার মতোই কিছু ভাবছিল। স্বতঃস্ফূর্ত আমাকে জড়িয়ে ধরল।

সেই মিলনমুহূর্তে আগুন ধরে গিয়েছিল আমাদের দুজনের অস্তিত্বে। সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছিল গর্ভজাত ভ্রাতৃত্ববোধ। এই দিগন্তবিস্তৃত জন্মভূমির প্রতিটি ধূলিকণায় গড়ে ওঠা আমাদের প্রাণের টান জেগে উঠছিল এক বিশাল ভূখণ্ডের মতো। ভিটেকে ওরা বিষয়-সম্পত্তি করে ফেলেছে, জন্মভূমিকে আজও পারেনি। স্নেহ মমতা ভালবাসা প্রেম প্রীতি বোধ সবটাই সম্পত্তি হয়ে যায়নি। ও-বাড়ি আমাদের পর করে দিয়েছে। কিন্তু বনগাঁ, বহরমপুর, শিলিগুড়ি, দমদম আপন হয়ে উঠেছে। মাথার উপর বিশাল মহীরুহের জটিল অন্ধকার থেকে একটা লক্ষ্মীপেঁচা ঝটপট করে উড়ে গেলো ভোরের আভার দিকে। একটু বাদেই সূর্য উঠবে। পৃথিবী একটু একটু করে ফুটে উঠছে। তারাহীন তারাময় আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম— মা মাগো জননী জন্মভূমি তুমি আমাদের, আমাদের কাছেই থাকবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...