মাল্টিপ্লেক্স-উপাখ্যান

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

দিন কয়েক আগে মৃণাল সেনের ‘একদিন অচানক’ ছবিটা দেখতে বসেছিলাম। ইউটিউব-এর কল্যাণে আজকাল ছবি দেখার সুযোগ বেশ অবারিত। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ওটিটি-র বাৎসরিক সদস্যপদ নিলে সোনায় সোহাগা। নামমাত্র মূল্যে ঘরে বসে বিভিন্ন ভাষার ছবি দেখার, যাকে বলে আনলিমিটেড প্যাকেজ। যেন-বা হীরকরাজ্যের রত্নভাণ্ডারের সামনে এসে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া গুপি-বাঘা— কোনটা ছাড়ি আর কোনটা রাখি। শতবর্ষে দাঁড়ানো মৃণাল সেনের ভুবনে ভাল ছবির অভাব নেই। এটাও তেমন একটি। এ ছবি দেখেছি আগেও। তবু নতুন করে দেখতে তো বাধা নেই, তাই। নানা পুরস্কারে পুরস্কৃত ‘একদিন অচানক’-এর কথা আর নতুন করে কী বলি। কিন্তু চোখের অন্য একরকম আরাম হল ছবি দেখতে দেখতে। কাহিনি যে বাড়িটিকে ঘিরে ঘুরতে থাকে তার পুরনো লালমেঝে, পুরনো মডেলের খাট-বিছানা, কাঠের চেয়ার-টেবিল। ছবির একেকটা ফ্রেমে ধরা পড়ছে বাড়ির পরিচারিকার ন্যাতা-বালতি দিয়ে ঘর মোছার বা কলের নিচে বাসন ধোয়ার ছবি, পরিচারিকার সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর টুকরো সংলাপ। এর পাশে ছবির অধ্যাপক চরিত্রটির বসার ও শোওয়ার ঘর, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই বইয়ের পাহাড়, ঠিক যেমনটা হওয়ার কথা। অথচ তাঁর পোশাক, নিত্যব্যবহারের ব্যাগ, তার কন্যা বা গবেষিকা-ছাত্রীর সাদামাটা পোশাক— বাস বা রিকশ চড়ে যাতায়াত, এগুলো সবই যেন এক ভিন্ন পৃথিবীর কথা বলে। আরামটা সেখানেই।

তথ্য বলছে মৃণাল এই ছবি দিল্লির দূরদর্শনের জন্য তৈরি করেছিলেন ১৯৮৯ সালে, হিন্দিভাষী এই ছবি দেখানো হয়েছিল সর্বভারতীয় নেটওয়ার্কে এবং তা বিপুল আলোড়ন ফেলে। কথাটা সেটা নিয়ে নয়। এই ছবির পর কেটে গেছে সাড়ে তিন দশক— বাঙালির জীবন-যাপনে ভাবনায়-চেতনায় এই সময়কালে ঘটে গেছে প্রচুর প্রচুর পরিবর্তন, প্রায় এক বিপ্লবের মতোই, তবে তা নিঃশব্দ, নিরস্ত্র। এই ছবি তৈরির সমকালে ফিল্মের বিপণনমাধ্যম বলতে সাবেকি সিনেমাহল আর সরকার-নিয়ন্ত্রিত দূরদর্শন। ওই সময়টায় সরকারি সংস্থা হিসেবে ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএফডিসি) এবং দূরদর্শন প্রচুর ভাল ছবি প্রযোজনা করেছেন এবং নিজেদের সর্বভারতীয় নেটওয়ার্কে তা পরিবেশন করেছেন। এটাও বলা দরকার, এনএফডিসি বা নয়াদিল্লির দূরদর্শন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থে পরিচালিত হলেও ছবি করার ক্ষেত্রে তেমন কোনও রাজনৈতিক ছুঁৎমার্গ কিন্তু তাঁরা রাখেননি। সত্যজিৎ রায় থেকে মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি, আদুর গোপালকৃষ্ণন, প্রকাশ ঝা, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ সকলকে দিয়েই তাঁরা ছবি করিয়েছেন, করিয়েছেন নানা ধরনের দরকারি তথ্যচিত্র। এসব ছবিতে যে সরকারের গুণকীর্তন করা বাধ্যতামূলক ছিল, এমন নয়। সত্যজিতের ‘সদগতি’ ভারতীয় সমাজে জাতপাতের বৈষম্যের এক অসামান্য ডকুমেন্টেশন, গোবিন্দ নিহালনির ‘তামস’ ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এক মানবিক প্রতিবাদ আর মাত্র দু-লাখ টাকায় কেমনভাবে সাড়া ফেলে দেওয়া ছবি করে সফল হওয়া যায় তার নিদর্শন রেখেছেন মৃণাল সেন তাঁর ‘ভুবন সোম’ ছবিতে। ‘ভুবন সোম’ বাণিজ্যিকভাবে রিলিজ হলেও অন্য অনেক ছবি নিজেরাই সম্প্রচার করেছে দূরদর্শনের জাতীয় কার্যক্রম। এক সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ছবি প্রযোজনা করেছেন। ‘পথের পাঁচালী’র কিংবদন্তি বাদ রাখলেও পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেস সরকারও তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’ প্রযোজনায় এগিয়ে আসে। রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার তাঁদের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজেরা ভাল ছবির জন্য অর্থ জোগান দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্রকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘নন্দন’-এর স্থাপনা, পরে চলচ্চিত্রের স্বার্থে ‘রূপকলা কেন্দ্র’ ও ‘রূপায়ন কালার ল্যাব’ এগুলোর প্রযোজনা ও পরিচালনা সবই রাজ্যের বাংলা ছবির কথা ভেবে করা। এমনকি কলকাতা পুরসভার বিপরীতে পুরনো ‘মিনার্ভা সিনেমা হল’ অধিগ্রহণ করে নতুন সজ্জায় ‘চ্যাপলিন’ প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন এবং তাতে ভাল ছবি দেখানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন এই রাজ্যেরই সরকার।

তথাকথিত বিশ্বায়ন, যাকে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত পরিভাষায় বলতেন ‘দুনিয়াদারি’— তার সর্বব্যাপ্ত প্রতিক্রিয়ায় দেশের ও রাজ্যের সরকারের প্রথম অ্যাজেন্ডা ছিল সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোকে গুটিয়ে আনা। যেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোই লাটে তুলে দেওয়ার বহুমাত্রিক আয়োজন সেখানে ফিল্ম প্রযোজনার থেকে যে সরকার হাত তুলে নেবেন এটা কচি শিশুরাও বোঝে, ঘটলও তাই। কিন্তু এমন নয় যে বাংলার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি শুধু এই অর্থের প্রত্যাশাতেই বেড়ে উঠছিল। মূলত ব্যক্তিগত প্রযোজক বা প্রযোজনা সংস্থাই ছিল বাংলা ছবির বিনিয়োগকারী। আরেকটা সমীকরণ ছিল, ফিল্মে যারা টাকা খাটাতেন তাঁরা আবার অনেকেই ছবির প্রচারসত্ত্ব বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপের পেছনেও লগ্নি করতেন। কারণ ছবি তৈরি হলে তা যদি সিনেমাহলে দেখানোর ব্যবস্থা না হয় তা হলে টাকা ফেরত আসে না। ব্যক্তিগতভাবে খবর নিয়ে দেখেছি এই প্রযোজকদের মধ্যে অনেকেই কলকাতা বা মফস্বলের একাধিক সিনেমাহলের মালিক ছিলেন। এতে নিজেদের প্রযোজনা করা ছবি খুব সহজেই তাঁরা নিজেদের হলগুলিতে দেখাতে পারতেন। যদিও এমন অনেক প্রযোজকও ছিলেন যারা ছবি তৈরি হওয়ার আগে থেকেই ডিস্ট্রিবিউটারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নিজেদের ছবির বিপণন নিশ্চিত করতেন। এই পরিবর্তিত ‘দুনিয়াদারি’র আমলে সব থেকে যেটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সিনেমাহলগুলি বেশিটাই বন্ধ হয়ে গেল। প্রাক-বিশ্বায়ন যুগে সারা রাজ্যের প্রায় সাড়ে সাতশো সিনেমা হল নিয়মিত বাংলা ছবি দেখিয়ে ব্যবসা করত। হিন্দি ছবিও চলত না, তা নয়। আবার মফস্বলে বা কলকাতার অনেক সিনেমাহল নুন-শো চালু করে তাতে নিয়মিত যৌন আবেদনপূর্ণ ছবি দেখাত, যার মূল দর্শক ছিল স্কুলের কিশোররা, সম্ভবত কিশোরীরা নয়। আজকে রাজ্যে চালু সিনেমাহল পঞ্চাশেরও নিচে, বাকি যা আছে তা মাল্টিপ্লেক্স অর্থাৎ মাল্টিপল স্ক্রিন— একই ঠিকানায় তিনটে/চারটে হলে ছবি দেখানোর আধুনিকতম ব্যবস্থা। এমনকি যেসব পুরনো প্রেক্ষাগৃহগুলি আজও টিকে আছে তাঁরাও সংস্কার করে কেউ কেউ মাল্টিপল স্ক্রিন করে নিয়েছেন। প্রেক্ষাগৃহের নিচে বাজার ও ওপরে প্রোজেকশন রুম এমন উদাহরণ অনেক, কিন্তু এগুলোকে মাল্টিপ্লেক্স গোত্রে ফেলা যায় না। মাল্টিপ্লেক্সগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং— আইনক্স, পিভিআর ইত্যাদি। আপাতত বাঙালির ছবি দেখার গন্তব্য এইসব মাল্টিপ্লেক্সগুলি।

 

দুই.

কিন্তু ঠিক কেমন ছবি আমরা দেখতে চাইছি এইসব মাল্টিপ্লেক্সগুলিতে? এটা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই ভাবতে হবে আদি সিনেমাহলের সঙ্গে ঠিক কোথায় পার্থক্য এই মাল্টিপ্লেক্সগুলির। আমরা সবাই জানি, মূলত একটা প্রকাণ্ড চেহারার শপিং মলের অন্তর্গত থাকে এই মাল্টিপ্লেক্সগুলি। সিনেমা দেখার আগে বা পরে নানা কিসিমের হরেক মালের পসরায় সজ্জিত বিপণিগুলি আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি বা কেনাকেটা করি, ফুড কোর্টে পছন্দের খাবার খাই। এই সব মিলিয়ে একটা সিনেমা দেখা। ব্যাপারটা যে বিরাট কোনও পরিবর্তন তা নয়। কলকাতার হাতিবাগান বা চৌরঙ্গি এলাকায় কিংবা ভবানীপুর-কালীঘাট পাড়ায় একটা সময় অনেক সিনেমাহল কাছাকাছি ছিল। এই সূত্রেই সেই অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল অনেক খাবার দোকান— চৌরঙ্গিপাড়ার ‘অনাদি কেবিন’ বা ‘কাফে ডি মনিকা’র নাম এখনও আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ে। সিনেমা দেখার পর দর্শকরা দল বেঁধে সেখানে খেতে যেতেন— একটা-চারটে-সাতটা-র নির্ধারিত শোয়ের পর গমগম করত খাবার দোকানগুলি। অনেক বাংলা গল্পে ইভনিং বা নাইট শোয়ে সিনেমা দেখে বাইরে খেয়ে বাড়ি ফেরার এমন অনেক আখ্যান আমরা পড়েছি। বিবর্তিত হয়ে এখন খাওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানান পণ্যের বিপণিকেন্দ্র, আসলে শপিং মলের মেরুদণ্ড যা দিয়ে তৈরি হয়। তার অনুষঙ্গে ঝাঁ-চকচকে বহিরঙ্গ, ঝকমকে প্রকাণ্ড এস্কেলেটার, রঙিন বেলুন এবং আড়ালে টিফিন-বাক্স-থেকে-রুটি-আলু তরকারি-খাওয়া সেলাম-ঠোকা সিকিউরিটি গার্ড।

কিন্তু কলকাতার অনেক সাহেবি ক্লাবে যেমন এখনও বাঙালি পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি-চটি পরে ঢোকা নিষিদ্ধ, আদপে শপিং মলেও কারা ঢুকবেন বা ঢুকবেন না তার একটা সীমানা আছে। সেটা কোনও কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দেননি, এটা স্বতঃ-ই নির্মিত হয়ে গেছে তার চরিত্রের ভিতর থেকেই। সবাই জানে এক কাপ চা খেতে গেলে বাইরের দোকানে দশ টাকা লাগলে শপিং মলে লাগে পঞ্চাশ টাকা— তাই যারা এই যোগ্যতার উদ্বর্তনে পাশ করতে পারেন তাঁরাই স্মার্ট গেট পেরিয়ে গাড়ি পার্কিং স্লটে রেখে, সিকিউরিটি দিয়ে ব্যাগ তল্লাশি করিয়ে ও তাঁদের মুখে নিজেদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ হিসেবে অভিহিত হয়েই শপিং মলে ঢোকেন এবং মাল্টিপ্লেক্সেও। যে-কোনও মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা ছবির টিকিটের মূল্য কমপক্ষে আড়াইশো টাকা, হিন্দি বা ইংরিজি ছবি হলে তা বেড়ে হয় অন্তত পাঁচশো। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্স-ওয়ালারা ঘোষিতভাবে জানিয়েই দিয়েছেন আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে, আধুনিকতম শব্দ-আলো-প্রক্ষেপণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ও দর্শকদের জন্য যথেষ্ট আরামদায়ক আসন ও অন্য যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেও কিন্তু তাঁদের তেমন লাভ হয় না। তাঁদের লাভের মূল উৎস খাবার যা দর্শকদের পরিবেশন করা হয় সিনেমা দেখার সময়। বস্তুত ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে টিকিট বুকিং করার সময়েই দর্শক তার খাবার বুক করে ফেলতে পারেন, আর, তা না করলেও সিনেমা শুরু হওয়া মাত্র একেবারে রেস্টুরেন্ট স্টাইলেই তার কাছে চলে আসে অর্ডার-বয়। তাঁদের সঙ্গে আবার নানা ‘অফার’-এর লোভনীয় প্যাকেজ, কত টাকার খাবার কিনলে যেন কী কী সব মুফতে পাওয়া যায়— ‘শুধুমাত্র সেই দিনটির জন্য’। খাবারের অর্ডার দিয়েই চলচ্চিত্র-রসিক দর্শক আবিষ্কার করেন তার সিটের হাতলে মস্ত মস্ত ভুট্টাভাজার বালতি ও সফটড্রিঙ্কের মগ রাখার জন্য সুন্দর সুন্দর সব মাপসই গর্ত করে রাখা হয়েছে। হাতে গরম খাবার এনে তাতে শুধু বসিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। কিছু কিছু বড় মাল্টিপ্লেক্সে আরও চড়া দামের ‘গোল্ড’ বা ‘প্রিমিয়াম’ গোত্রের আসন আছে, যেগুলিতে বসার ব্যবস্থা সোফায় এবং সামনে নিচু টেবিলে খাদ্য পানীয় রাখার রাজসিক বন্দোবস্ত। ফিল্ম দেখা না ভোজসভা, ঠাহর করা মুশকিল।

অতঃপর পর্দায় আলো এসে পড়ে। দর্শক মুচমুচ করে পপকর্ন চিবোন ও কোকে চুমুক দেন। ছবি এগিয়ে চলে। মাঝে মাঝেই দর্শকের সামনে দিয়ে অর্ডার-বয়দের গতায়াত, তাঁদের সিলুয়েট ছবি প্রক্ষিপ্ত হয় পর্দায়। দু-একটা শট আড়াল হয়ে যায়। আশেপাশে বেজে ওঠে মোবাইল, মাল্টিপ্লেক্সের দর্শক এইসবে অভ্যস্ত, তাঁদের মনোসংযোগে আদৌ কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। এমনটা তো হয়েই থাকে। তাছাড়া, এত চড়া দামে এমন আবহে সিনেমা দেখতে এসে প্রতিটা শট প্রতিটি দৃশ্য প্রতিটি ক্যামেরার চলাচল খেয়াল করতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে কোথায় দিয়েছে? সাবেক সিনেমা হলে শুধুমাত্র ‘হাফটাইম’ হলে বাদাম ও চানাচুর-ওয়ালারা হলে ঢুকতে পারতেন এবং ফিল্মের দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হয়ে গেলেও যারা অন্ধকারে হলের ভিতর ফিসফিস করে বেচাকেনা করতে চাইতেন দর্শক তাতে প্রতিবাদ করতেন, সম্ভবত তাতে ছবি দেখার নিভৃতির হানি হত। মাল্টিপ্লেক্স নিজেই এখানে এক প্রকাণ্ড ‘হকার’, ছবি দেখানোর স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে তাঁরা মিশিয়ে দিয়েছেন পেটপুজোর অষ্টমী-নবমী। এর পরেও কথাটা হল, অন্তত দুজন দর্শক ঘণ্টা আড়াইয়ের জন্য যে পাঁচশো টাকা দিয়ে টিকিট কাটলেন, রাস্তার পঁচিশ টাকার ভুট্টাভাজা নশো টাকায় খরিদ করে ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে তা গলাধকরণ করলেন, গাড়ির পার্কিং-এ অন্তত শ-দেড়েক টাকা খসালেন তাঁরা পর্দায় ঠিক কী ধরনের ছবি দেখতে পছন্দ করবেন? যেখানে কাজের লোক ন্যাতা দিয়ে ঘরের লালমেঝে মুছছেন বা নায়িকা চলেছেন ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের জানলায় মুখ রেখে? এই প্রশ্নের জবাব না এবং না। দুনিয়াদারির বদলে যাওয়া বিশ্বে যারা মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখতে যান, তাঁরা যেমন ছবিকে আর ঠিক ‘বই’ বলেন না, একইভাবে, পর্দায় ওই ধরনের চরিত্র আর তাঁরা দেখতে রাজি নন।

আসলে, আমরা সবাই জানি, ছবিতে দর্শক আসলে তার নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে পর্দার চরিত্রকে আইডেন্টিফাই করেন। মধ্যপঞ্চাশ থেকে ষাট বা সত্তর দশক অবধি বাংলার দর্শক যে সুচিত্রা-উত্তমকে মাথায় করে রেখেছিল তার প্রধান কারণ, ওই সময়ের গল্পে যেভাবে নায়ক-নায়িকাকে চিত্রিত করা হত তার সঙ্গে ছবি দেখা মধ্যবিত্ত বাঙালি নিজেদের মিলিয়ে নিতে পারতেন। দরিদ্র ঘরের ‘প্রেমিক’ উত্তমকুমার সেই সব সাদাকালো ছবিতে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এমনভাবে অভিনয় করতেন যাতে বাঙালি দর্শক মনে করেন এ তো আমাদের ঘরেরই ছেলে! সুচিত্রা সেন বা সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আমাদেরই চেনা বৃত্তের মেয়ে! তাছাড়া, পুরনো সিনেমাহলের প্রক্ষেপন ব্যবস্থা, দর্শকাসনের শ্রেণিভেদ এমন একটা পর্যায়ে ছিল যার মধ্যে নিহিত ছিল একটা গণতান্ত্রিক সাম্য। গড়পড়তা সিনেমাহলের একেবারে সামনের ‘সত্তর পয়সার সিট’ ছাড়া ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস বা ব্যালকনি এগুলোর প্রবেশ মূল্যে খুব বড় ফারাক কিন্তু ছিল না। একেবারে সামনের সিটে ‘গুরু’কে দেখে সিটি মারার ‘পাবলিক’ বসত করলেও পরের শ্রেণিতে থাকতেন সুভদ্র মানুষজন। কিন্তু কোনও বৈষম্য ছিল না। অফিসের চাকুরে বাবু যখন নিজের গৃহিণীকে নিয়ে ফার্স্ট ক্লাসে টিকিট কেটে ছবি দেখতে আসতেন, হতেই পারে তার পাশের সিটে এমন একজন এসে ব্সলেন যিনি সিনেমা হলের বাইরে্র দুনিয়ায় সেই অর্থে শিক্ষিত সুভদ্র হিসেবে চিহ্নিত নন, হয়তো তিনি একটা স্টেশনারি দোকান চালান। কিন্তু পাশাপাশি বসে একই ছবির আবেগ অনুভূতির শরিক হওয়া আসলে একটা গণতান্ত্রিক ও সামাজিক সাম্যের পরিসর তৈরি করে দিত। মাল্টিপ্লেক্স গোড়াতেই এই সাম্যের পরিধিটাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। সেখানে যাঁরা ছবি দেখতে আসছেন তাঁদের ‘জাত-গোত্র’ আলাদা কিন্তু অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থান প্রায় একইরকম— যাকে বলে হোমোজিনিয়াস। আজকের একটি মাল্টিপ্লেক্সে একজন ব্যাঙ্ককর্মচারী আর অটোচালক একই পাশাপাশি আসনে বসে ছবি দেখতে পারেন না। একেবারে আর্থিক কৌলীন্যের কারণেই সেটা সম্ভব নয়— কারণ একটা ছবি দেখার জন্য এত বিপুল অর্থ খরচ করা, পরের ব্যক্তিটির পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের রাজ্যে অত্যন্ত দক্ষ শ্রমিকের গড় দৈনিক মজুরি কিন্তু মাত্র তিনশো ছাপ্পান্ন টাকা— যার মাসিক আয় দশ হাজারের নিচে, তিনি কি মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা ছবি দেখার বিলাসিতা আদৌ করে উঠতে পারেন?

আজকে যাঁরা মাল্টিপ্লেক্স চালাচ্ছেন বা ছবি বানাচ্ছেন এই বেখাপ্পা অর্থনীতির থিওরিটা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। তাই তাঁদের ছবি অন্যরকম। কীরকম? না, আজকের বাংলা ছবিতে সাদাকালোর সেলুলয়েড যেমন আর নেই ঠিক তেমনই নেই ভিন্ন কোনও দুনিয়ার গল্প যে আখ্যান আসলে ‘দুনিয়াদারি’র আয়তক্ষেত্রে ধরে না। ভাল ছবি চিরকালই হয়, আজও হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু গড়পড়তা বাংলা ছবির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আজ বড্ড প্রকট। হালের বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকা বা পার্শ্বচরিত্ররা বড় বেশি ঝকঝকে, তাঁরা মহার্ঘ্য পোশাক পরেন, দামি আবাসনের সুসজ্জিত বহুতল ফ্ল্যাটেই মূলত তাঁরা থাকেন— তাঁদের গৃহসজ্জার ওপর দিয়ে ক্যামেরা প্যান করলে চোখে পড়ে মূল্যবান আসবাব, পল্লবিত ফুলের টব, ব্যালকনির ওপর দিয়ে শহরের আকাশচুম্বী স্কাইলাইন। আধুনিক ছবির নায়ক/নায়িকারা শীত-গ্রীষ্ম সমেত সব ঋতুতেই গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোন, তাঁদের শয়নগৃহে মশারি টাঙানোর বালাই থাকে না। ঘরে বা বাইরে চা বড় একটা তাঁদের খেতে দেখা যায় না, মূলত তাঁরা পার্টিতে বা নিজের ঘরে বসে চড়া দামের কাটগ্লাসের পাত্রে বিদেশি সুরা পান করেন— সুরাপানের সূত্রেই তাঁদের কখনও কখনও আত্মমোক্ষন ঘটে, নির্মিত হয় পাত্র-পাত্রী সংঘাত। এসব ছবি দেখলে মনে হয়, কলকাতা শহরে কার্যত কোনও গণ-পরিবহন ব্যবস্থা নেই— কেননা পাত্র-পাত্রীরা গল্পের খেই ধরে সকলেই চকচকে গাড়ি করে এখানে ওখানে যান, এটাও লক্ষ করা যায় গাড়ি তাঁরা সবাই চালাতে জানেন। তাঁদের গাড়ি চালানোর পথ হিসেবে দেখানো হয় নিউটাউনের ফাঁকা রাজপথ আর বড়জোর ‘মা’ ফ্লাইওভার— আদপে যেখানে কোনও জ্যামযন্ত্রণা নেই— শহরের ঘামে-ভেজা উত্তাপ আর ক্যাকোফোনি স্পষ্টত তাঁদের না-পসন্দ। এইরকম একটা অনায়াস, শিথিল ও নিরুপদ্রব জীবনের ছবিই আজকের বাংলা ছবির উপজীব্য। আর এইখানেই সেই আইডেন্টিফিকেশনের ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে আসে। মাল্টিপ্লেক্সের সম্ভাব্য দর্শক আসলে এইরকম জীবনেরই শরিক। কার্যত দুনিয়াদারির ফলশ্রুতিতে যে নতুন উচ্চমধ্যবিত্তের প্রাদুর্ভাব হয়েছে তাঁদের যাপিত জীবনের সঙ্গে এই ছবির চিত্রায়িত জীবনের আহ্লাদিত মিল— তাই মাল্টিপ্লেক্সের এই বৈভব-ঋদ্ধ দুনিয়ায় দুয়ে দুয়ে চার হতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, হচ্ছেও না।

মুশকিলটা অন্য জায়গায়। সেই অঞ্জন চৌধুরী-স্বপন সাহাদের আমলে তাঁদের ছবির লঘুতা নিয়ে একটা মহলে অন্তত কথা হত, আলোচনা হত আরেকটু অন্যরকমভাবে ছবি করা চলে কি না। আজকে সেই আলোচনাটুকুও যেন কোথায় উধাও, কেউ বলছেন না নিউটাউন বাইপাস আর বড়জোর বোলপুরের জঙ্গল এইটুকুই কেবল বাংলা ছবির পায়চারির বারান্দা হতে পারে না। সবার উপরে মাল্টিপ্লেক্স সত্যি! এই আবহে টিভির পর্দায় মৃণাল-জমানার বেরঙিন আবহ আমাদের চোখকে সাময়িক আরাম দেবে, এইটাই কি স্বাভাবিক নয়?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...