বিজ্ঞান কংগ্রেস যেমন দেখেছি

সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

কয়েকদিন আগে দেখা হল সঞ্জয়দার সঙ্গে। কেজো সাক্ষাতের মধ্যে অকেজো কথার মতো আলোচনা হচ্ছিল বিজ্ঞান কংগ্রেসের এবারের অধিবেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা। সঞ্জয়দা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের চেয়ে অনেক নামজাদা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনাসভা পরিচালনা করেন মাননীয় অতিথিবর্গের একজন হয়ে। বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন বন্ধ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই সঞ্জয়দাকে বিশেষ বিচলিত করে না। উপরন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বিগত কয়েকটি অধিবেশনে ওঁর অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। আর তাই  মনে হয় যা হয়েছে ভালই হয়েছে। আমি খুব সাধারণ মানের একটি কলেজের কেরানি কাম অধ্যাপক। এই বিষয়ে ওঁর সঙ্গে তাত্ত্বিক বিতর্কে জড়ানোর যোগ্যতা বা বাসনা কোনওটাই আমার নেই।

ভুলেই গিয়েছিলাম। সেদিন বহুল প্রচারিত এক দৈনিকে এই বিষয়ে লেখা একটি প্রতিবেদন উসকে দিল স্মৃতির সলতেখানা। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম মাস্টারমশাইরা বলতেন বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী আর বিজ্ঞানের ছাত্রকে পরস্পরের কাছে আসার সুযোগ করে দেয়। আমাদের কাছে তখন বিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেওয়া বেশ গর্বের ব্যাপার ছিল।

জীবনে প্রথম বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলাম কলকাতাতেই। রাজ্যের বাইরের কোনও অধিবেশনে যোগ দেওয়ার মতো পরিণত হইনি তখনও। সেবার অধিবেশন বসেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি মফস্বল থেকে আসা ছাত্রী যাদবপুর সেভাবে চিনিই না। মাস্টারমশাইরাই আমাদের অভিভাবক। সে সময়ে অধিবেশনে যোগ দিতে গেলে কোনও রেজিস্ট্রেশন ফি লাগত না। তাই বিজ্ঞানের আলোচনায় যোগ দিতে কোনও ছাত্রেরই কোনও সমস্যা হত না। মনে আছে নির্দিষ্ট একটি খাতায় নাম নথিভুক্ত করার পর আমাদের একটি চটের ব্যাগ দেওয়া হয়েছিল। তার উপরে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা— Indian Science Congress Association। সাধারণ ছাত্র থেকে খ্যাতনামা অধ্যাপক সকলকেই একই জিনিস দেওয়া হত অধিবেশনের স্মারক হিসাবে। বড়রা কেউ বলেছিলেন বাজার করার ব্যাগ, কেউ বা বলেছিলেন সে কাজেও লাগবে না। আমি কিন্তু প্রাণে ধরে সে ব্যাগটা বেশ কিছুদিন ব্যবহার করতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল এ বুঝি জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। খুব শৌখিনভাবে ব্যবহার করতাম সেই চটের ব্যাগ। কিছুটা ছেলেমানুষিই বটে, কিন্তু সে সময়ে এমনই শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনকে।

গবেষণা চলাকালীন কোনও বছর বিজ্ঞান কংগ্রেসে যাওয়া বন্ধ হয়নি। প্রত্যেক বছর অধিবেশনের সময় নির্দিষ্ট। জানুয়ারির ৩ থেকে ৭। অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল অধিবেশনের উদ্বোধন। প্রথামাফিক দেশের প্রধানমন্ত্রী এই অধিবেশনের উদ্বোধন করতেন আর যে রাজ্যে অধিবেশন বসছে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দিতেন স্বাগত ভাষণ। জাতীয় স্তরে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই অধিবেশন। সাধারণ গবেষক হিসাবে মঞ্চ থেকে অনেক দূরে বসার জায়গা পেতাম, মঞ্চে আসীন বিদগ্ধজনদের ছোট্ট দেখালেও প্রজ্ঞা, খ্যাতি এবং বিজ্ঞানের জগতে তাঁদের অবদান সুগন্ধি কস্তুরীর মত ছড়িয়ে যেত উদ্বোধনমঞ্চে। ভাবতে ভারী ভাল লাগে সেই সৌরভের আঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগ আমিও পেয়েছি।

দৈনিকের ওই প্রতিবেদন পড়ে মনে পড়ে গেল জীবনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কথা। তরুণ গবেষকদের গবেষণাপত্র বিজ্ঞানচর্চার  জাতীয় মঞ্চে তুলে ধরার সুযোগ করে দিত এই অধিবশন। নির্বাচিত গবেষকরা পেতেন ISCA Young Scientist Award। বিজ্ঞানমহলে এই পুরস্কারপ্রাপকরা যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নিতেন।

সেবার অধিবেশন বসেছিল হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজামের শহরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের  যথেষ্ট খ্যাতি ও সুনাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নির্মাণ-স্থাপত্যও অসাধারণ। এত বছর পরেও ছবির  মতো মনে আছে সেই সৌন্দর্য। অধিবেশন শুরুর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় Young Scientist Award-এর প্রস্তুতি। এবারেও তার অন্যথা হল না। বিজ্ঞান কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণাপত্র জমা করার নির্দেশ এল। প্রতিযোগিতায় সামিল হলাম আমিও। প্রতিযোগিতার ভার যথেষ্ট। পাঠিয়ে দিলাম বেশ পরিশ্রম করে সযত্নে তৈরি করা গবেষণাপত্র। সারা ভারতবর্ষে আমার মতো অসংখ্য প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে এই প্রতিযোগিতায়। সে সময়ে ১৬টি বিভাগে  বিভক্ত ছিল বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়। প্রথম পর্যায়ে প্রত্যেক বিভাগে ৬ জন করে মোট ৯৬ জন গবেষককে নির্বাচন করা হত, যারা বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁদের গবেষণাপত্র পরিবেশন করার সুযোগ পেতেন।

গবেষণাপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার কয়েকদিন পরে ক-দিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম। বেড়ানোর আনন্দে একটু ভাটা পড়েছিল উৎকন্ঠায়। এখনকার মতো টেলিফোনিক যোগাযোগ তখন অত সহজ ছিল না। প্রতিদিন সকালে টেলিফোন বুথ থেকে আমার মাস্টারমশাইকে ফোন করতাম বুকে এক টুকরো আশা নিয়ে। যদি আমার গবেষণাপত্র নির্বাচিত হয়ে যায়! অবশেষে একদিন টেলিফোনের ওপার থেকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে আমার মাস্টারমশাই বললেন— “ইউ হ্যাভ মেড ইট”। প্রথম ৯৬ জনের মধ্যে আমার গবেষণাপত্র নির্বাচিত হয়েছে। প্রথম ধাপটা উতরে গেছি এটাই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

সেবারের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরাল, স্বাগত ভাষণ দিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। যে সমস্ত দিকপাল বিজ্ঞানীদের চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এপিজে আব্দুল কালাম। অত বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী যে এমন শিশুর মতো সরল, মাটির মানুষ হতে পারেন, এ কথা তাঁর সান্নিধ্য না পেলে বিশ্বাস করা যায় না। এমন সান্নিধ্যসুখ আমাকে দিয়েছিল বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন।

প্রতিটি বিভাগ থেকে নির্বাচিত ৬ জন তরুণ গবেষককে তাবড় অধ্যাপক, ছাত্র, মান্যগণ্য একদল শ্রোতার সামনে পরিবেশন করতে হত নিজের গবেষণাপত্র। আমার বিভাগে নির্বাচিত ছয়জনের মধ্যে হিমাচল প্রদেশ থেকে আসা একজন গবেষক আমার সঙ্গে থাকত। তার কাছে শুনেছিলাম পার্বত্য জনজাতিদের নিয়ে ওর গবেষণার কথা। পাহাড়ের চড়াই উতরাই ভেঙে, কখনও দুধের গাড়িতে, কখনও মালবাহী কোনও গাড়িতে, কখনও বা দুর্গম পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে একের পর এক গ্রামে গিয়ে এই গবেষণা চালিয়েছিল পুনম। এ গবেষণা খুব সহজ ছিল না। জেনেছিলাম কতরকম প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে আমার ওই প্রতিদ্বন্দ্বী গবেষক। প্রতিযোগী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও গবেষণা চালানোর জন্য একজন পাহাড়ি মেয়ের জীবনসংগ্রামের কাহিনি সেদিন মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেছিল আমাকে। বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনই এমন বৌদ্ধিক আদানপ্রদানের সুযোগ করে দিত আমাদের প্রজন্মের গবেষকদের।

খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা আমার মতো তরুণ গবেষকদের কাছে গবেষণাপত্র পরিবেশন করার  জন্য এই মঞ্চে ওঠা এবং নিজেকে প্রমাণ করা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের কাজ। ইংরাজি বলতে হোঁচট খাই, এত বড় মঞ্চে পরিবেশনার আদবকায়দাও বিশেষ রপ্ত নেই। তার উপরে দর্শকাসনে বসে থাকা বাঘা বাঘা পণ্ডিত। সব মিলিয়ে আমরা কেউই খুব স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। তার উপর প্রতিযোগিতার প্রচ্ছন্ন চাপ তো আছেই। তখন কতই বা বয়স আমাদের। ভয়ে সাদা হয়ে যাওয়া মুখগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে খুঁজেছি নিশ্চিন্তির অবলম্বন। বড় হতে গেলে যে ছোট হতে হয়, এই প্রতিযোগিতা-মঞ্চ আমাকে তা শিখিয়েছিল। প্রবীণ অধ্যাপকরা যেভাবে নবীন গবেষকের দলকে উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত  করেছিলেন তা সত্যিই শিক্ষণীয়। নিজের অধ্যাপনা-জীবনে ছাত্রছাত্রীর মনোবল বাড়াতে সেদিনের সেই শিক্ষা আমায় বরাবর সাহায্য করেছে। এই শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল বিজ্ঞান কংগ্রেসের সেই অধিবেশন।

প্রতিযোগিতা মানে যে শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, এ শিক্ষাও এই মঞ্চ থেকেই পেয়েছিলাম। ৬ জনের মধ্যে একজনই ISCA Young Scientist Award-এ ভূষিত হবে এ কথা আমাদের সকলের জানা। তবুও প্রত্যেকে বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। আগের দিন থেকে স্লাইড গুছোনো, মার্কিং করা, সম্ভাব্য প্রশ্ন বাছাই করা, একে অপরের পরিবেশনা শোনা এবং প্রয়োজনমতো পরামর্শ দেওয়া, সব মিলিয়ে মূল্যবোধের এক ব্যতিক্রমী চিত্র দেখেছিলাম এই প্রতিযোগিতার দরবারে। আমার কাছে ব্যতিক্রমী হলেও এমনই ছিল বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনের সংস্কৃতি।

পরিবেশনার পর তিনদিন কাটল প্রবল উৎকণ্ঠায়। সমস্ত বিভাগের ফলাফল একসঙ্গে  প্রকাশিত হবে। সকলে দল বেঁধে পৌঁছলাম কার্যনির্বাহী অফিসে। জীবনে বহু বড় পরীক্ষা দিয়েছি, সফলও হয়েছি, কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় সফল হওয়ার মতো আনন্দ কখনও পেয়েছি বলে মনে হয় না। আরও পাঁচজন প্রতিযোগী পরম বন্ধুর মতো আমাকে ভরিয়ে দিয়েছিল অভিনন্দনের উষ্ণ আবেশে। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। মনে হচ্ছিল কেউ হারিনি, আমরা সবাই জিতেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাতে তুলে দেবেন পুরস্কার। সে মহার্ঘ্য পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠেছি, সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছে ওরা পাঁচজন। সেই মুহূর্তের যে ছবিটা আমার কাছে চিরদিনের সম্বল হয়ে আছে সে ছবিটাও ওদেরই একজনের ক্যামেরায় তোলা। সবাই যে যার জায়গায় ফিরে এসেছি আমরা, ছবিটা পাঠিয়ে দিতে কিন্তু তার ভুল হয়নি।

সে সময়ে “ইয়ং সায়েন্টিস্ট” সম্মান পাওয়া তরুণ গবেষককে সকলেই যথেষ্ট সম্মান করতেন। বিজ্ঞান কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল সাম্মানিক আজীবন সদস্যপদ। সে পদের অপরিসীম গুরুত্ব আমাদের কাছে। আজীবন সদস্য হিসাবে মিলত বিভিন্ন কর্ণধারদের নির্বাচন করার ভোটাধিকার। একজন সাধারণ তরুণ গবেষকের কাছে এ সম্মান অতুলনীয়।

যে প্রতিবেদনের সূত্র ধরে লিখতে শুরু করেছিলাম, সেখানে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রকাশনা “এভরিম্যান’স সায়েন্স”-এর উল্লেখ আছে। আজীবন সদস্য হওয়ার জন্য এই পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা নিয়ম করে পাঠানো হত আমার ঠিকানায়। শুধু আমিই নয় আমার অনুজ গবেষকদের অনেকেই সেই পত্রিকা খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়ত এবং উপকৃত হত।

ইদানিং বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে নিয়মিত যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। ধীরে ধীরে গবেষণার জগতের সঙ্গে যোগাযোগও ফিকে হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে একটু-আধটু শুনে অনুভব করেছিলাম বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনের চরিত্রটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। ওদের কথায় ইঙ্গিত মিলেছে— বিজ্ঞানকেন্দ্রিক অধিবেশন ক্রমশ বাণিজ্যকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। শুধু বিজ্ঞান কংগ্রেসই তো নয়, সমস্ত শিক্ষাজগৎই এখন বণিকদের দখলে। মেধা, অধ্যাবসায় এ-সব শব্দগুলো এই জগতে বিলুপ্তপ্রায়। সবই মানতে বাধ্য করা হয়েছে আমাদের। বিজ্ঞান কংগ্রেসের বিভিন্ন বিভাগের সংখ্যা কমে যাওয়া, অধিবেশনে যোগদানের জন্য ছাত্র-গবেষদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন ফি নেওয়া, অধিবেশনের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বা রাজ্যস্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে চলে যাওয়া সবকিছুই মেনে বা মানিয়ে নিয়েছে সবাই। এতদসত্ত্বেও অধিবেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। আর তাই উলটে দেখলাম জীবনখাতার পুরোনো পাতাগুলো।

বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন বন্ধ করার জন্য নানা প্রসাধনে সুসজ্জিত করে প্রমোট করা হচ্ছে “ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল” নামক অন্য একটি দ্বিতীয় মঞ্চকে। তবে শুধু এই সমান্তরাল মঞ্চের জন্য ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস তার জৌলুস হারাচ্ছে ব্যাপারটা এত সরল গণিত নয়। শুধু বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনই নয় সরকারি অনুদান আসা বন্ধ হয়েছে শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সাধারণ গবেষক থেকে শুরু করে শতাব্দীপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকলকেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছে নিজেকে প্রমাণ করার ইঁদুরদৌড়ে। অন্ধকার খনিগর্ভ থেকে উঠে আসা অর্থলোলুপ, পৈশাচিক একদল বিপণন সংস্থা তিমির মতো গিলে ফেলছে এই ছুটন্ত ইঁদুরের দলকে। শিক্ষার আলো থেকে প্রলোভনের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার গবেষক, শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আজ কারও কোনও খিদে নেই। পড়ুয়ার জ্ঞানের খিদে নেই, গবেষকের নেই অনুসন্ধানের খিদে। সবই পণ্য হয়ে গেছে কোনও-না-কোনও বাণিজ্য সংস্থার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের বাজারে।

আজ বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন বন্ধ হয়েছে, কাল হয়তো তালা পড়বে বহু সুখস্মৃতিবিজড়িত বীরেশ গুহ স্ট্রিটের ওই বাড়িটায় যা ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের হৃৎপিণ্ড  হিসাবে আজও কলকাতার গর্ব। জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে আর হয়তো সাবলীল ভঙ্গিতে কেউ জনপ্রিয় বিজ্ঞানের কথা বলবে না। অনুদানের অভাবে হয়তো আর প্রকাশিত হবে না “এভরিম্যান’স সায়েন্স”-এর মতো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। যা শুধু কেতাবি বিজ্ঞানচর্চার কথা বলে না, বলে অন্তর থেকে দর্শনগতভাবে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার কথা। শুধ “এভরিম্যান’স সায়েন্স”ই কেন, শিক্ষার মৌলিক অধিকারই যে “এভরিম্যান’স” থাকবে না, এই অশনিসঙ্কেতই বুঝি ধেয়ে আসছে একটু একটু করে। বিজ্ঞান কংগ্রেসের মতো জাতীয় স্তরের এমন বহু অধিবেশনই হয়তো আগামীদিনের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে হয়ে যাবে মিউজিয়াম-পিস। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য দুনিয়ার কুযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাসের বিপণন হবে বিজ্ঞাপনের ঝলমলে মোড়কের আড়ালে। বিজ্ঞানের অধিবেশনের নামে আজগুবি গল্প শোনাবেন বিজ্ঞানীরা। গণেশের মাথা হবে প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ, গরুর দুধে মিলবে খাঁটি সোনা। পুরাণের এক কাল্পনিক চরিত্র হয়ে উঠবে ঐতিহাসিক নায়ক যার জন্ম থেকে মৃত্যুভূমির হদিশ দেবে দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়। সংবাদপত্রে তো বটেই অনুক্ষণ গবেষণাগারে ব্যস্ত থাকা বন্ধুবান্ধবদের মুখে নিত্যদিন খবর পাচ্ছি বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অনুদান পাচ্ছেন না সতীর্থ গবেষকরা। বহু গবেষণা চলতে চলতে অর্থের অভাবে মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ছে। উধাও হয়ে যাচ্ছে চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব। ময়ুরের চোখের জল নাকি তার যৌনতা, এমন অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারকে বিজ্ঞানের জামা পরিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশময়। আব্দুল কালামের মতো বিশ্ববন্দিত কোনও বিজ্ঞানীকে হয়তো নিজের নাম বদলে “অমৃতভাই প্যাটেল” হতে হবে, তবেই তিনি অধিবেশনে আমন্ত্রণ পাবেন। নিজামের শহরে অধিবশনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হবে, সুযোগ মিলবে শুধুই আর্যাবর্তের কোনও শহরের। বিচিত্র কায়দায় অবিরাম চোখে ধুলো দিয়ে যাবে স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা। আর আমরা! ভাবী প্রজন্মের কাছে গল্প বলব— আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা…।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...