অর্থনীতির নতুন স্টার্ট-আপ: সদর দরজায় শেষকৃত্যের গাড়ি

দেবাশিস মিথিয়া

 


সমাজে ঘটে যাওয়া কোনও বড় ঘটনা সেই যুগের সামাজিক ভাবনাকে আমূল বদলে দেয়। সাম্প্রতিক করোনা মহামারিও তাই করেছে। জীবনহানি, সম্পদহানির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধকেও বদলে দিয়েছে। কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতি মানুষের ধারণাতেও বদল এনেছে। তাঁরা বুঝেছেন এখন ফিউনেরাল সার্ভিসিং ছাড়া শেষযাত্রায় বিকল্প নেই। মানুষের ভাবনার বদল স্টার্ট-আপগুলিকে উৎসাহ জুগিয়েছে ও কোম্পানি হিসেবে বৈধতা দিয়েছে

 

জীবনের একমাত্র অমোঘ সত্য মৃত্যু। আর কালের নিয়মে সেই সত্যই আমাদের দাঁড় করিয়েছে আর এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি— পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নিজের পারলৌকিক ক্রিয়ার বন্দোবস্ত নিজেকেই করে রেখে যেতে হবে। ঠিক যেমনটি দেখা গেছে ‘পিস হাভেন’ সিনেমায়। বন্ধুর মৃত্যুর পরে তাঁর একমাত্র প্রবাসী পুত্র বাবার মৃত্যুতেও দেশে ফেরেননি। মৃতদেহের মুখাগ্নি করছেন সেই ছেলের বন্ধু। এই ধাক্কা খানখান করে দিয়েছে তিন বৃদ্ধের দীর্ঘদিনের লালিত বাসনাকে— মৃত্যুর পর মুখাগ্নি করবে নিজের পুত্রসন্তান। চরম এই ধাক্কা থেকেই তিন বৃদ্ধ, নিজেদের জন্য ‘মরচুয়ারি’ বানাতে উদ্যোগী হয়েছেন। চেষ্টা চালাচ্ছেন নিজেদের মৃত্যুপরবর্তী যা যা করণীয় তার ব্যবস্থা করে রেখে যেতে। এ ছাড়া উপায় কী!

এ তো গেল সিনেমার কথা। বাস্তবও সিনেমার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ইন্টারনেটের যুগে এখন ব্যক্তিগত অনুভূতিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে সবাইকে জানাতে হয়। সুখ-দুঃখ সবার সঙ্গে ভাগ করতে হয়! নচেৎ ষোলোকলা পূর্ণ হয় না। কিছুদিন আগে এমনই একটি ফেসবুক পোস্টে চোখ আটকে গেল। পোস্টটি কলকাতার এক অধ্যাপকদম্পতির প্রবাসী কৃতি কন্যার। মায়ের শেষকৃত্যে অনুপস্থিত। সোশ্যাল সাইটে ‘গুড বাই মা’, ‘যেখানে থাকো ভালো থেকো’ লিখেই মায়ের প্রতি কর্তব্য সেরেছেন ছেলেমেয়েরা। আধুনিক কেরিয়ারসর্বস্ব পৃথিবীতে ছেলেমেয়েরা আজ বাবা-মার থেকে বহু দূরে। পুরনো পাড়াকালচারও তলানিতে। ফ্ল্যাটবাড়িতে একে অপরকে প্রায় কেউই চেনার চেষ্টা করেন না। সময়ের দাবি মেনে বাবামায়ের সঙ্গে সন্তানের বেড়ে চলা দূরত্ব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়া, এখন চেনা ছবি। আপনজনের মৃত্যুর পর শেষকৃত্য সম্পন্ন করার তাগিদ কেউ অনুভব করছেন না। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক ভারতে চালু হয়েছে ‘ফিউনেরাল সার্ভিসিং’ বা ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’-র নতুন স্টার্ট-আপ। এক কথায় শেষকৃত্যের কোম্পানি। অর্থের বিনিময়ে এরাই সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে আপনার আপনজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করবে। শবানুগমন থেকে শুরু করে মৃতের অস্থি বিসর্জন এবং পারলৌকিক কাজ— সব এরাই করে দেবে।

বছর খানেক আগে টুইটারে প্রাক্তন আমলা অবনীশ শরণের পোস্ট করা একটি ছবি নেটদুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল। দিল্লির প্রগতি ময়দানে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে একটি স্টার্ট-আপের ছবি। যার নাম সুখান্ত ফিউনেরাল ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড। যারা মৃত্যুপরবর্তী সবরকমের সার্ভিস দিয়ে থাকে। কোম্পানির ওয়েবসাইট বলছে, মৃত ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে শেষ বিদায় জানাতেই তাদের যাত্রা শুরু। তারা আরও বলেছে, হাসপাতাল বা বাড়ি থেকে শ্মশান পর্যন্ত শেষকৃত্যই শুধু নয়, শেষকৃত্যের পরের করণীয় কাজও তারা করে থাকে। স্টার্ট-আপটি ইতিমধ্যে কয়েক হাজার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে। কোম্পানির ব্যালেন্স শিট বলছে শেষকৃত্য করে বাৎসরিক আয় হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এদের লক্ষ্য, আয়কে বছরে ২০ কোটিতে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি, কয়েক বছরের মধ্যে নিজেদের ২০ হাজার কোটি-বিশিষ্ট কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা।

এ থেকেই পরিষ্কার স্টার্ট-আপগুলির অর্থনৈতিক দিকটা অবহেলা করার নয়। এগুলি অর্থনীতির সেবা ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে। যে-কোনও অর্থনীতিতে জাতীয় আয়ে সেবা ক্ষেত্রের অবদান যত বাড়ে তার উন্নয়নও তত বেশি সেটাই প্রচলিত ধারণা। ভারতীয় অর্থনীতিতে যখন নতুন শিল্প তৈরির সম্ভাবনা একেবারে তলানিতে তখন এ-ধরনের স্টার্ট-আপগুলি মাথাপিছু আয় বাড়াতে সাহায্য করবে। কিছুটা হলেও বেকারত্ব কমাবে। দিল্লির ‘লাস্ট জার্নি’ ভারতের ছয়টি শহরে ডেথ কেয়ারের ব্যবসা করে। এরা দিল্লি ছাড়াও অন্য শহরে কাজ করে মূলত ‘অ্যাস্টেট-লাইট’ মডেলের ভিত্তিতে। অর্থাৎ ব্যবসার এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ ফান্ডের জোগান এরা দেয়। বাকিটা অংশীদার কোম্পানির। লাস্ট জার্নি অনাবাসী ভারতীয়দের মৃতদেহও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, যুক্তরাজ্য এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এনে শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে দেয়। এদের ব্যবসার আয়তন তুলনায় অনেক বেশি। এরা দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি মৃতদেহ সৎকার করে সেখানে বেঙ্গালুরুর ‘অন্থ্যেষ্টি’ সৎকার করে গড়ে মাত্র ৩-৪টি। লাস্ট জার্নির ধারণা বর্তমানে ফিউনেরাল সার্ভিসিং ভারতে ৩.৫ লক্ষ বিলিয়ন ডলারের শিল্প। ২০০৮ সালে যার পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৯৮ বিলিয়ন ডলার। এ-ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বেশ ভাল। কারণ, এক, শুধুমাত্র টায়ার-১ শহরেই প্রতিদিন এগারো থেকে বারো হাজার মানুষ মারা যান। দুই, সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের ফলে আপনজনের শেষ বিদায় ঘিরে অদ্ভুত এক অমানবিক পরিস্থিতি।

আজকের দুনিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়াই নীতিপুলিশের কাজ করে। তাই এই ব্যবসায় যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন তাঁদেরকে কেউ কেউ ‘শকুন’ বলতেও ছাড়ছে না। কেউ বললেন, কিছু একটা করতে হবে বলে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে ব্যবসা! কেউ লিখলেন, “এত দুঃখের… এটা হওয়া উচিত নয়।” যুক্তিকে সরিয়ে রেখে আবেগে প্রাধান্য দিলে হয়তো এই অনুভূতি মিথ্যে নয়। কিন্তু বাস্তবের মাটি বড়ই কঠিন। কোভিড মহামারির সময় দেখা গেছে মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টি করার জন্য অতি নিকট আপনজনও পাশে দাঁড়ায়নি। তখন এই স্টার্ট-আপগুলি গড়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি করে শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে।

সমাজে ঘটে যাওয়া কোনও বড় ঘটনা সেই যুগের সামাজিক ভাবনাকে আমূল বদলে দেয়। সাম্প্রতিক করোনা মহামারিও তাই করেছে। জীবনহানি, সম্পদহানির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধকেও বদলে দিয়েছে। কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতি মানুষের ধারণাতেও বদল এনেছে। তাঁরা বুঝেছেন এখন ফিউনেরাল সার্ভিসিং ছাড়া শেষযাত্রায় বিকল্প নেই। মানুষের ভাবনার বদল স্টার্ট-আপগুলিকে উৎসাহ জুগিয়েছে ও কোম্পানি হিসেবে বৈধতা দিয়েছে। কোম্পানিগুলি শেয়ার বিক্রি করে তহবিল জোগাড়ের ভাবনাও করেছে। বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ এক্ষেত্রে লগ্নি করতে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও বেশিরভাগই খুব সাবধানী। তাঁরা মনে করেন এই ব্যবসা স্কেলযোগ্য নয়। ফলে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল-ফান্ডেবেল নয়। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল হল দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির সম্ভাবনাযুক্ত স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলিতে বিনিয়োগকৃত অর্থ। এই স্টার্ট-আপগুলির বড় সমস্যা মার্কেটিং। এ-ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজার দখল করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। আধুনিক সিধুজ্যাঠা ‘গুগলে’ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বুকিং এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিষেবা সম্পর্কিত কিওয়ার্ডগুলি অনুসন্ধান করা লোকের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। শ্মশান-সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠানগুলির আউটসোর্সিং-এর প্রতি ঝোঁকের যে গ্রাফ তা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ‘টিআরএসিএক্সএন’ (গ্লোবাল স্টার্ট-আপ ডেটা প্ল্যাটফর্ম)-এর তথ্য বলছে, সারা বিশ্বে প্রায় ২০০টি এরকম কোম্পানি রয়েছে। যাদের মোট বাণিজ্যের আয়তন হেলাফেলা করার নয়। রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বে ডেথ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রির আকার ২০২৬ সালের মধ্যে ১৫২.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। যা ২০২০ সালে ছিল ১১৫.৪ বিলিয়ন ডলার।

ইতিমধ্যে, এই ব্যবসা আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। সেন্ট্রাল রোটারি ক্লাবের নেতৃত্বে চেন্নাইয়ে চালু হয়েছে মোবাইল ক্রিমেশন ভ্যান বা এমসিভি। এই ভ্যানগুলিতে প্রাকৃতিক গ্যাস, জেনারেটর, বিদ্যুৎ এবং একটি লাউডস্পিকার থাকছে। এমসিভি মৃত ব্যক্তির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে শবদেহের দাহ সম্পন্ন করে আত্মীয়দের হাতে শেষকৃত্যের ফটোগ্রাফ এবং মৃতের দেহাবশেষ দিয়ে চলে আসছে। তামিলনাড়ুর ইরোডবাসী মিস্টার ব্যাঙ্গিরি, বলছিলেন— “আমার মায়ের শেষকৃত্য হয় মোবাইল ক্রিমেশন ভ্যানে। এখন অনেক মানুষই এমসিভি-র সাহায্য নিচ্ছেন।” এই পরিষেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ইতিবাচক। তাঁদের বক্তব্য, বর্ষায় মৃতদেহ দাহ করা খুব কষ্টকর। তাছাড়া যারা পাহাড়ে থাকেন, তাদের পক্ষে শ্মশানে গিয়ে দাহ করানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সেইসব দিক থেকে এমসিভি খুব উপকারী।এমসিভির প্রতিনিধি ভিকে রাজমানিকমের কথায়, “দরিদ্র মানুষের জন্য এই পরিষেবা অত্যন্ত উপকারী। আবার কিছু লোকের ইচ্ছে তাঁরা সারাজীবন যেখানে কাটিয়েছেন সেখানেই তাঁদের শেষকৃত্য হোক। বা কেউ কেউ চান, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, মৃত্যুর পর শেষকৃত্য তাঁর বাড়ির কাছেই হোক। এমসিভি সেই শেষ ইচ্ছেগুলো পূরণ করে দিচ্ছে। মৃত মানুষগুলোর শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে পেরে আমাদেরও ভাল লাগছে। এতে তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে এই আশা নিয়েই কাজটা করছি। প্রথমে আমরা দিনে ১-২টো বরাত পেতাম। এখন গড়ে ৫-৬টা পাই।”

তবে এ-পর্যন্ত স্টার্ট-আপগুলির কর্মকাণ্ড বেশিরভাগটাই শহরকেন্দ্রিক। গ্রাম-গ্রামান্তরে এর প্রসার ঘটলে বাণিজ্যের আয়তন বহুগুণ বাড়বে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে সেটা হতে আরও কয়েক বছর লাগবে।

যে-সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি তা প্রচলিত মূল্যবোধকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে এমন অনেক কিছুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে, যা আগে ভাবাই যেত না। শেষকৃত্য নিয়ে ব্যবসা, মন থেকে মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু নিঃসঙ্গ বাবা-মার শেষকৃত্য ঘিরে অমানবিকতার ছবিটা বদলে দিতে পারে ফিউনেরাল সার্ভিস দানকারী সংস্থাগুলি। সংস্কার ঝেড়ে ফেলে, শুধু সত্যিটা মেনে নিতে পারলে এই ব্যবসায়িক উদ্যোগও সয়ে যাবে। তখন মনে হবে স্টার্ট-আপগুলি মহৎ কাজই করছে। খুঁজে পাওয়া যাবে ফিউনেরাল সার্ভিসের মানবিক দিকও।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...