ওয়ার্ক সং: হারিয়ে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান

অঞ্জুশ্রী দে

 


কর্মসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং কর্মজীবী মানুষের জীবনের গান। যাঁরা এই গান গাইতেন তাঁরা প্রত্যেকেই প্রান্তিক মানুষ। পাশাপাশি এই গান হিন্দু মুসলিম সব সম্প্রদায়ের গান। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমবেতভাবে কাজ করতে করতে এই গান গাইতেন। ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান হিসেবে ওয়ার্ক সং-এর চেয়ে ভাল গান আর কিছু নেই। প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে। জাতির আত্মসন্ধানের প্রয়োজনেই লোকসঙ্গীতের অন্য ধারার এই গান সংরক্ষণ করা দরকার

 

কর্ম-সঙ্গীত বা ওয়ার্ক-সং বললেই আমাদের কানে ভেসে ওঠে—

জন হেনরি, জন হেনরি,
নাম তার ছিল জন হেনরি
ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন
হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিস দিয়ে
হেসে হেসে কাজ করে রাত দিন
হো হো হো হো হেসে হেসে কাজ করে রাত দিন…!

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কাজের একঘেয়েমি কাটাতে কাজ করতে করতে সমবেতভাবে যে গান গাওয়া হয় সেটাই কর্মসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত সারিবদ্ধভাবে এবং কাজের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে এই গান গাওয়া হচ্ছে। তাই এ-ধরনের সঙ্গীতকে ‘সারিগান’ও বলে। সারিগানের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন সারি শব্দের অর্থ যেহেতু শ্রেণি তাই শ্রেণি বা সারিবদ্ধভাবে গাওয়া গানই সারিগান। কারও মতে, বিশেষ শ্রেণির কর্মরত মানুষের সমবেত গানই সারিগান। তবে, সারিগান আবহমান বাংলার লোকসঙ্গীত। শ্রমিক ও কর্মজীবীদের মাঝে বিশেষ জনপ্রিয় হওয়ায় সারিগান কর্মসঙ্গীত নামেও পরিচিত। মাঝিরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় টেনে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কিংবা একই ছন্দে ছাদ পিটতে পিটতে পিটুনিরা সামনের দিকে এগোনোর সময় কাজের একঘেয়েমি কাটাতে, কাজের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে একধরনের গান ধরতেন। সেই গান মাঝি-মাল্লাদের গান, ছাদ পেটানোর গান বলেই পরিচিত। এই গান শুধু কর্ম-সঙ্গীত নয়, সারিগানও বটে। বাংলায় কর্মসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং-এর মধ্যে মাঝি-মাল্লাদের গান, ছাদ পেটানোর গান ছাড়াও আছে জমি নিড়ানির গান, ধান কাটার গান, ধান ভাঙার গান। এই কর্মসঙ্গীত এবং সারিগান একটা স্তরের পরে মিলেমিশে একাকার। কর্মসঙ্গীত লোকসঙ্গীতের অন্যতম এক ধারা।

 

গ্রামবাংলায় একসময় নৌকার গান, ছাদ পেটানোর গান, জমি নিড়ানির গান, ধানকাটার গান ও ধানভাঙার গান আকছার শোনা যেত। কর্মজীবী মানুষরা তাদের কাজের তালে তালে ওয়ার্ক সংগুলিকে গাইতেন। সেই চেনা ছবি আজ আর চোখে পড়ে না। তাদের মধ্যে নৌকার গান (পুরুষরাই গাইতেন), ছাদ পেটানোর গান (পুরুষ-মহিলা উভয়ই গাইতেন) ও ধানভাঙার গান (মহিলারা গাইতেন) আজ কী অবস্থায় আছে তারই হালহকিকত জানতে এই উদ্যোগ।

 

নৌকা বাওয়ার গান 

হেঁইও হো হো হেঁইও
ও মাঝিভাই-ও,
বাইও রে নাও বাইও
খর নদীর ওপারে, স্বপ্নের-ও দেশে যাইও
হেই রে, আকাশ বড় ভারি
হেই, ঢেউ-এর তালে তুফান মাতে মরণ মহামারি

মাঝিমাল্লারা নৌকার দাঁড় টানার ছন্দে ছন্দে সমবেত কণ্ঠে এ গান গাইতেন। মূল উদ্দেশ্য— কাজের ক্লান্তি দূর করা। কর্মসঙ্গীত হিসেবেই এ-গানের যাত্রা শুরু।

নদীকেন্দ্রিক সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চাকরি করার সুবাদে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয় ‘নৌকা বাইচে’র। বিশ্বকর্মাপুজোর দিন বিকেলে মিনাখাঁ থানার ঘুশিঘাটা থেকে মালঞ্চ পর্য্যন্ত বিদ্যাধরী নদীর দু-পাড়ে স্থানীয় মানুষকে ভিড় করতে দেখা যেত। সেদিন বিকেলে ঘুশিঘাটা থেকে মিনাখাঁ খেয়াঘাট এবং চৈতলঘাট থেকে বাছড়া মোহনপুর ফেরিঘাট পর্য্যন্ত নৌকো বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন মাঝিমাল্লার দল। প্রতিযোগী নৌকোর সংখ্যা কোথাও ১oটি আবার কোথাও ১২টি। বিশেষ ধরনের তৈরি নৌকায় ৮ থেকে ১০ জন মাঝি থাকতেন। তবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সব নৌকায় মাঝির সংখ্যা একই থাকত। মাঝিরা ছন্দ মিলিয়ে দাঁড় টানতেন। দাঁড় টানার শারীরিক কষ্টকে লাঘব করতে দাঁড় টানার তালে তালে গান ধরতেন। লক্ষ্য নৌকার গতি বাড়িয়ে নৌকাকে সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। নৌকার এই দৌড় প্রতিযোগিতার নাম-ই ‘নৌকা বাইচ’। একসময় নৌকা বাইচকে ঘিরে মিনাখাঁয় মেলা বসত, এখন সে ছবি বিরল। শরৎকালে নদী-নালা-খাল-বিল জলে ভরে থাকে, মাঠের ধানে শিস আসে। এই সময় চাষের কোনও কাজ থাকে না। বাতাসে উৎসবের গন্ধ। উৎসবের একটা অংশ হিসেবে বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় নৌকা বাইচ চোখে পড়ত। বিশেষ করে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ জেলায় নৌকা বাইচের চল বেশি ছিল। এখনও আমাদের রাজ্যের অনেক জায়গায় নৌকো বাইচ হয়। তবে এই বাইচকে ঘিরে পুরনো উন্মাদনা আর নেই। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে নৌকা বাইচের গান।

 

তবে এটা বাংলার একান্ত নিজের নয়। দক্ষিণভারতের কেরলের আলেপ্পিতে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় শনিবার ১০০ দাঁড়ওয়ালা ‘স্নেক বোট রেস’ গোটা শহরকে মাতিয়ে তোলে। তখন আলেপ্পির অন্য চেহারা। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে এই চর্চা আছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে এখনও নৌকার দৌড় হয়। চিনে নৌকা বাইচের নাম ‘ড্রাগন বোট রেস’। ইংল্যান্ডের টেমস নদীতে ছেলে মেয়েদের আলাদা আলাদা বোট রেস হয়। প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ লোক তা দেখতে হাজির থাকেন।

তবে, নৌকো বাইচ বছরের নির্দিষ্ট একটা দিনের। কিন্তু আগেকার দিনে সস্তায় মাল পরিবহন করতে নৌকোই ছিল প্রতিদিনের ব্যবহারিক যান। এছাড়া মাছ ধরার প্রধান অবলম্বনও এই দাঁড়টানা নৌকা। যখন নিমাই মালিক তাঁর ছেলে গগন, আসলাম গাজী ও ফকিরকে সঙ্গে নিয়ে একাদশীর দিনে মাছ ধরতে বেরোন, সেই দৃশ্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ছবিকে ফুটিয়ে তোলে। নৌকো ছাড়ার আগে নিমাই মালিকের স্ত্রী ফুল প্রসাদ দিয়ে যখন নৌকোকে পুজো করছেন তখন তিনি চণ্ডী, গঙ্গা ও দুর্গার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন। ভালভাবে মাছ ধরে যেন সুস্থ শরীরে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারেন। ঠিক সেই সময় নৌকোতেই আসলামচাচা জোহরের নামাজ পড়ে নিচ্ছেন। নৌকায় তখন একদিকে ঈশ্বর অন্যদিকে আল্লাহ। ঈশ্বর ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা শেষ। পুজো শেষ করে নিমাই মাঝির স্ত্রী পাড়ে বাঁধা নৌকোকে জলে ঠেলে দিতেই হিন্দুর ছেলে গগন গান ধরে—

দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না
ছেড়ে দে নৌকা আমি যাব মদিনায়
দুনিয়ায় নবি এল মা আমিনার ঘরে
হাসিলে হাজার মানিক কাঁদিলে মুক্তা ঝরে।

এই নৌকোর গানের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন এপার-বাংলার সুন্দরবনের রূপচাঁদ মাঝি আর ওপার-বাংলার আব্বাসউদ্দীন। একসময় নৌকো বাওয়ার সঙ্গে তাঁদের গান একাত্ম হয়ে গিয়েছিল।

 

প্রযুক্তির উন্নতিতে মালবাহী নৌকোতে মোটর লেগেছে। নৌকোর দাঁড় টানার গল্প শেষ। ফলে নৌকো বাইতে আর শারীরিক কসরত করতে হয় না। মাছ ধরার ডিঙি নৌকাতেও লেগেছে ছোট ছোট ইঞ্জিন। যারা মাঝসমুদ্রে মাছ ধরতে যান তাঁরা ট্রলার ব্যবহার করেন। ফলে নৌকোয় ইঞ্জিনের ব্যবহার যত বাড়ছে হারিয়ে যাচ্ছে দাঁড় টানা নৌকো হারিয়ে যাচ্ছে আদি অকৃত্রিম নৌকার গান।

 

ছাদ পেটানোর গান

তরে সন্দ্রহার গড়াইয়া দিল কে
সন্দ্রমুখী লো
তোর লাগি হইলাম দেশান্তরী
ও আমি তোর লাগি হইলাম দেশান্তরী
সিলাই নিল বিলেরই মাছ
সিলাই নিল বিলেরই মাছ
বুক সাপড়াইয়া মরি
সন্দ্রমুখী লো
তোর লাগি হইলাম দেশান্তরী

ছাদ পেটানোর কাজে একঘেয়েমি কাটিয়ে কাজে গতি আনতে ছাদপিটুনিরা একসঙ্গে এই গান গাইতেন। ছাদ পেটানোর সময় এ গান গাওয়া হয় বলে একে ছাদ পেটানোর গানও বলা হয়। তবে ‘ছাদ পেটানোর গান’ বা কোবাকাম, শ্রম-সঙ্গীতের অন্য এক ধারাকে বহন করে।

‘ছাদ পেটানোর গান’-এর কথা প্রথম শুনি আমার এক সহকর্মীর কাছে। ৭০-৭৫ বছর আগে নাকি ওদের গ্রামের বাড়ির জলছাদ বানাতে চুন-সুরকির মিশ্রণের উপর খয়ের, সুপুরি ভেজানো জল ছেটানো হয়েছিল, সঙ্গে চিটেগুড়ের জল। এমনকি সর্ষের তেলও অল্প অল্প করে ঢালা হয়েছিল। এই মেশানোর কাজটা করতেন প্রধান মিস্ত্রি। আর সন্ধ্যা, মালতী, তারা বাগদিদের দল, জুলেখা, আয়েশা বিবি ও অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সেগুনকাঠের তৈরি পেটনা বা মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ওই উপকরণগুলোকে জমাট বাঁধানোর চেষ্টা করতেন। সারাদিন চড়া রোদে মাথায় গামছা চাপিয়ে ছাদ পেটানোর কাজ খুব কষ্টকর। কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজতে মূল মিস্ত্রি গান ধরতেন। সন্ধ্যা, তারা ও আয়েশা বিবিরা সেই গানে গলা মেলাতেন। গানের ছন্দে ছন্দে মুগুর দিয়ে ছাদ পেটাতেন আর একটু একটু করে ছাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এগিয়ে যেতেন। এই গানই ‘ছাদ পেটানোর গান’।

 

যখন সিমেন্টের ব্যবহার শুরু হয়নি তখন চুন-সুরকি মেখে তা দিয়ে জাফরি ইট গেঁথে দেওয়াল উঠত। তার উপর কড়িকাঠ পেতে তাতে বিছিয়ে দেওয়া হত ইটের মতন টালি। এরপর সুরকির গুঁড়ো ও চুনের মিশ্রণ দিয়ে ছাদের উপর ঢালাই দেওয়া হত। এটাকেই বলা হত জলছাদ। এই জলছাদের কাজের জন্য এক নতুন পেশাজীবী শ্রেণির উদ্ভব হয়। বৃদ্ধ নারী থেকে পুরুষ ছিল এই জলছাদের শ্রমিক। সারাদিন ক্লান্তিহীনভাবে কাঠের মুগুর দিয়ে ছাদ পিটে যেতেন এঁরা। ফলে কাজের একঘেয়েমি দূর করার জন্য কাজের সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে গান ধরতেন।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

আধুনিক নির্মাণশিল্পে চুন-সুরকির কোনও জায়গা নেই। ফলে ছাদ পেটানো এখন গল্পকথা। সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছাদ পেটানোর গান। অথচ, এই গান একসময় বহুল প্রচলিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের রাজমিস্ত্রি কবিতায় “সমস্ত দিন ছাত-পিটুনি/ গান গেয়ে ছাত পেটায় শুনি”— লাইন থেকেই তা স্পষ্ট। কিংবা নজরুলের গানের সেই লাইন— “সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো/ ভাত পাই না, ধরে আসে হাত গো।”

এই গানের খোঁজে কথা বলেছিলাম রাজমিস্ত্রি সুকুমার কোলের সঙ্গে। আশি-ঊর্ধ্ব সুকুমারবাবু বলছিলেন—

আমি তখন ছোট, বাবার সঙ্গে জলছাদ বানানোয় জোগাড়ের কাজ করেছি। মিস্ত্রি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে কখনও জলছাদ বানাইনি। কারণ আমি যখন মিস্ত্রি হলাম ততদিনে সিমেন্ট বালি স্টোনচিপের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। তবে চুন-সুরকির ছাদ সারানোর কাজ যে করিনি এমনটা নয়। আপনি যে গান খুঁজছেন সেই গানের চল গ্রামবাংলায় আজ আর নেই। আজকাল তো মেশিনে ঢালাই-এর মশলা মাখা হয়, এক-এক বেলায় দেড় থেকে দু-হাজার স্কোয়ার ফুট ছাদ ঢালাই হয়। তাই এখন সারাদিন ধরে ছাদ পেটানোর প্রশ্নই নেই! ফলে ছাদ পেটানোর গান তৈরি হওয়া বা গাওয়ার সুযোগ কোথায়?

 

ধান ভাঙার গান

ধান ভানি রে, ঢেঁকিতে পাড় দিয়া।
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি, হেলিয়া দুলিয়া।
ও ধান ভানি রে।

ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার সময়ে সমবেতভাবে এই গান গাওয়া হত। এই গান ধান ভাঙার গান।

একসময় গ্রামীণ জীবনে ঢেঁকি ছিল অপরিহার্য। দৈনন্দিন খাবারের জন্য ধান থেকে চাল তৈরিতে ঢেঁকির বিকল্প ছিল না। তার প্রমাণ পাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কমলাকান্তের দপ্তরে, সেখানে ‘কমলকান্ত’ ঢেঁকি সম্বন্ধে বলছেন, “আমি ভাবি কি, যদি পৃথিবীতে ঢেঁকি না থাকিত, তবে খাইতাম কী? পাখির মতো দাঁড়ে বসিয়া ধান খাইতাম? না লাঙ্গুলকর্ণদুল্যমানা গজেন্দ্রগামিনী গাভীর মতো মরাইয়ে মুখ দিতাম? নিশ্চয় তাহা আমি পারিতাম না।” ধান থেকে চাল তৈরি ছাড়াও চিঁড়ে, খইনাড়ু তৈরির খই কুটতে, গোটা ডালের খোসা ছাড়াতে, ডাল থেকে বেসন তৈরি করতে, চাল কুটে পিঠে ও ইডলির গুঁড়ি তৈরিতে ঢেঁকি-ই ছিল ভরসা।

 

একসময় ঘরে নতুন ধান ওঠার পর বাড়িতে বাড়িতে ধান ভাঙার ধুম পড়ে যেত। সন্ধ্যা, ভোর, দুপুর ও রাতে, মহিলারা পালা করে ঢেঁকিতে ধান ভাঙতেন। বিত্তশালী বাড়িতে ধান ভাঙতে আসতেন প্রান্তিক খেটে খাওয়া মহিলারা। পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা কিংবা ধান দেওয়া হত তাঁদের। অর্থাৎ সেই সময় ঢেঁকিতে কাজ করাই ছিল দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের আয়ের প্রধান উৎস। আর গৃহস্থ বাড়ির মহিলারা ঢেঁকির মাধ্যমে চাল তৈরির কাজে ব্যস্ত থেকে নিজেদের সময় কাটাতেন। সেইসময় ঢেঁকি-শাল ছিল মহিলাদের পারিবারিক ও সামাজিক আলাপের জায়গা।

সাধারণত মহুয়া, শাল, বাবলা, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি শক্ত কাঠ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করা হত। মোটা, ভারী দীর্ঘ এক কাঠের খণ্ডের আগায় তিন-চার ফুট লম্বা একটি কাঠের লম্বা টুকরো, মাটিতে তৈরি করা একটি গর্তের সোজাসুজি লাগানো হত। কাঠের টুকরোর আগায় একটি লোহার বেড় পরানো অংশ থাকত। একে বলা হত ‘মুষল’। আর মাটিতে তৈরি গর্তটিকে বলে ‘গড়’। প্রবাদে আছে ‘ঢেঁকি যতই মাথা নাড়ুক গড়ে তাকে পড়তেই হবে’। মূল ঢেঁকিটিকে পাথরের বা কাঠের চাপানে বসানো হত। ঢেঁকির পিছনে এক বা একের বেশি মানুষ পায়ে চাপ দিলেই ঢেঁকি ওঠা-নামা করে। এই পদ্ধতিকে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মানুষজন ‘পাহার’ দেওয়া বলেন। ঢেঁকির ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একজন গড়ের মধ্যে শস্য ফেলতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ঢেঁকিতে কাজ করার অমানুষিক পরিশ্রম দূর করতে সবাই মিলে গান ধরতেন।

হুগলি, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের বেশ কিছু পরিবারে এখনও ঢেঁকি দেখা যায়। মূলত পৌষসংক্রান্তির সময় চালগুঁড়ি তৈরিতে তা ব্যবহার হয়। ঢেঁকি ও ঢেঁকির গানের খোঁজে গিয়েছিলাম হুগলির কামারপুকুর পঞ্চায়েতের মধুবাটি গ্রামে। সেখানে এখনও রাধা, মেনকা, বৃন্দারা ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করেন। তবে শুধুই পৌষসংক্রান্তির সময়। মজার বিষয় হল এই কামারপুকুরেই ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্ম হয় ঢেঁকিশালে।

 

কথিত আছে, নারদ ঢেঁকির সাহায্যে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে যাতায়াত করতেন। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় কোথাও ঢেঁকির শব্দ নেই। আজ হাস্কিং মিল, রাইস মিলের ড্রায়ার, গ্রাইন্ডারের কাছে হার মানতে হয়েছে ঢেঁকিকে। ফলে গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি ঢেঁকি বিলুপ্তপ্রায়। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানেও ঢেঁকির ব্যবহার নেই। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কেউ কেউ বাড়িতে ঢেঁকি রাখলেও ব্যবহার করছেন না।

সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছুর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ঢেঁকিও। সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলায় কিষাণীদের কণ্ঠে ঢেঁকির গান। কালের বিবর্তনে এসব এখন শুধুই ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে।

 

শেষ কথা

আলোচনায় স্পষ্ট, কর্মসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং কর্মজীবী মানুষের জীবনের গান। যাঁরা এই গান গাইতেন তাঁরা প্রত্যেকেই প্রান্তিক মানুষ। পাশাপাশি এই গান হিন্দু মুসলিম সব সম্প্রদায়ের গান। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমবেতভাবে কাজ করতে করতে এই গান গাইতেন। ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান হিসেবে ওয়ার্ক সং-এর চেয়ে ভাল গান আর কিছু নেই। প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে। লোকসঙ্গীতের অন্য ধারার এই গান আজ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ জাতির আত্মসন্ধানের প্রয়োজনেই লোকসঙ্গীতকে অবিকৃত রাখা দরকার। তাই বিলুপ্ত হতে বসা ওয়ার্ক সংকে সংরক্ষণ করা জরুরি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4760 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...