এবার জেগে ওঠার সময়…

জয়রাজ ভট্টাচার্য

 

এই উপমহাদেশে খুন স্বাভাবিকতা হয়ে উঠেছে, বিগত কয়েক বছরে। রাষ্ট্রের মদত, রাষ্ট্রের সহযোগিতা, এবং রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া এরকম ঘটে না। কোথাও রাষ্ট্র খুনিদের উৎসাহিত করছে এবং প্রোটেক্ট করছে, কোথাও রাষ্ট্র নিজেই খুন করছে, তার নিজেরই নাগরিককে। জনপরিসরে একটা সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য, যাতে কোনও বিরুদ্ধমত উত্থাপিত না হয়।

২০১৫ সাল থেকে বেছে বেছে এমন কিছু মানুষকে ভারত এবং বাংলাদেশে ধারাবাহিক হত্যা করা হচ্ছে, যারা রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক মত ও অসত্য, অর্ধসত্য তথ্যের বিরুদ্ধে, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে, যুক্তিবোধকে জাগরূক রাখতে অকুতোভয় ছিলেন। কিন্তু এই ধারাবাহিক হত্যালীলাও তেমন অভিঘাত তৈরি করছে না জনমানসে, স্বতঃস্ফূর্ত অথচ সংগঠিত গণ প্রতিরোধের সেই কাঙ্খিত ছবি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, যা কয়েক দশক আগে দিল্লিতে প্রকাশ্য দিবালোকে বামপন্থী রাজনৈতিক নাট্যকর্মী সাফদার হাসমিকে শাসক শ্রেণির ভাড়াটে গুণ্ডারা খুন করলে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।

বাংলাদেশ, ভারত দুই দেশেই, প্রগতিশীল, মুক্ত চিন্তক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, তাঁদের খুন করে ফেলা একটা দৈনন্দিন, স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১১ জুন, সন্ধ্যায়, বাংলাদেশের লেখক, প্রকাশক, মুক্ত চিন্তক শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করেছে সে দেশের ধর্মান্ধ মুসলমান উগ্রবাদীরা। ১১ তারিখ সন্ধ্যায়, ঘটনার আধ ঘণ্টার মধ্যে শাহজাহান বাচ্চুর কন্যা, দুর্বা জাহান ফেসবুকে পোস্ট করে জানান, “আমার পিতা শাহজাহান বাচ্চু আজ প্রয়াত হয়েছেন, আমাদের গ্রামে। বাবাকে দুটো গুলি করে হত্যা করেছে অজানা দুষ্কৃতীরা।”

দূর্বা, আমাদের গ্রাম বলে, যে অঞ্চলটিকে বোঝাতে চেয়েছেন, সেটি মুন্সীগঞ্জ জেলার কাকালদি গ্রাম, যে এলাকাতেই শাহজানের আবাস। পুলিশ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, দুটি মোটরসাইকেলে চড়ে মোট চারজন দুষ্কৃতী, শাহজাহান বাচ্চুকে, খুব কাছ থেকে গুলি করে। মুন্সীগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালের ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

শাহজাহান ছিলেন বিশাখা প্রকাশনীর কর্ণধার, প্রকাশক, ব্লগার, মুক্ত চিন্তক। তিনি কম্যুনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলা কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক ছিলেন। কম্যুনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশের সেন্ট্রাল কমিটির পক্ষে এক বিবৃতিতে পার্টির নেতা সাজ্জাদ জাহির চন্দন বলেন, “মুন্সীগঞ্জ জেলায় পার্টিকে গড়ে তোলা ও বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে শাহজাহান ছিলেন প্রধান মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হল। প্রকাশক হিসেবে তিনি তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল আদর্শের সাথে কখনও আপোষ করেননি। আর সেটাই সম্ভবত উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীরা সহ্য করতে পারছিল না।” ইউনেস্কোর ডিরেকটর জেনারেলও ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বলেন, “সমাজে যারা সুস্থ বিতর্কের পরিসর তৈরি করার কাজে ব্রতী, তাঁদের ওপর এরকম জঘন্য আক্রমণ নামিয়ে আনা আসলে, বৃহত্তর অর্থে মানুষের সমাজের ওপরেই আক্রমণ শানানো। ঘটনার সাথে জড়িত অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি সুনিশ্চিত করতে হবে।”

এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুই দেশেই লাগাতার এই হিংসা চলছে। দুই দেশের সরকারই তেমন কোনও ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে নিচ্ছে না। সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় মৌলবাদ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। বাংলাদেশে, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাস শহীদ হচ্ছেন; ভারতে নামগুলো গৌরী লঙ্কেশ, দাভালকর, সুজ্জাত বুখারি। বাংলাদেশে সংগঠিত হচ্ছে মুসলিম মৌলবাদের নামে। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের নামে। যার যেখানে ক্ষমতা। সমস্যাটা ক্ষমতার। সংখ্যাগুরুর ক্ষমতার। সমস্যাটা ক্ষমতা প্রদর্শনের। সংখ্যাগুরুর ক্ষমতা প্রদর্শনের। তবে ভারত বা বাংলাদেশে আসলে সংখ্যাগুরু গরীব নিপীড়িত ক্ষমতাহীন মানুষ। তাঁরা যেদিন বুঝে ফেলবে, তাঁরাই সংখ্যাগুরু, সেদিন এই কতিপয় ধর্মের কারবারির অপরিসীম দুঃখ আছে। শাহজাহান বাচ্চুরা বেঁচে থাকলে, গৌরী লঙ্কেশরা বেঁচে থাকলে, খুব দ্রুত মানুষ সত্যিটা বুঝে ফেলছে। সত্যকে প্রকাশ করতে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে এরা মরতেও ভয় পায় না। তাই এত ভয়, মিথ্যের ওপর টিকে থাকা ব্যবসায়ীদের। সত্যের ভয়। মৃত্যুর ভয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. হ্যাঁ, ঠিক। সত্যকে এরা ভয় পায়। একদিক থেকে দেখতে গেলে সত্যই ওদের কাছে মৃত্যুবৎ।

Leave a Reply to প্রতিভা সরকার Cancel reply