বাংলা ছায়াছবির নির্বাক নায়িকারা

কৌশিক মজুমদার

 

হীরালাল সেনের রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি তখন অস্তাচলে। কলকাতার সিনেমাপ্রেমীদের মনোরঞ্জন করছেন একা কুম্ভ ম্যাডান কোম্পানি। মনোহর দাস ট্যাঙ্কের উত্তরে লম্বা তাঁবু খাটিয়ে ম্যাডানদের এলফিনস্টোন বায়স্কোপ। তাতে দেখানো হত প্যাথে কোম্পানি থেকে আসা শহরের ছবি, প্রকৃতির দৃশ্য, যুদ্ধের ছবি। অনেক সময় ১/২ রিলের কমিক ছবিও দেখানো হত। হাঁ করে গিলতেন বাঙালি দর্শকরা। তবে মাঝে মাঝে “জার্মিনাল” বা “লা মিজারেবল”-এর মতো সিনেমাও দুই বা তিন খণ্ডে ভেঙে দেখানো হত। কিন্তু অন্যের ছবি আর কতদিন দেখাবেন তাঁরা? তাঁদেরও ইচ্ছে হল নিজস্ব ছবি তৈরি করার। কিন্তু তেমন অভিনেতা এ দেশে কোথায়? যদি বা থাকে, অভিনেত্রী? ভদ্রঘরের মেয়েরা দূরে থাক, দেহোপজীবিনী, যারা থিয়েটারে অভিনয় করেন, তাঁরাও কোনও অজ্ঞাত কারণে এই নতুন মাধ্যমে মুখ দেখাতে রাজি নন। মহারাষ্ট্রে ফালকে ছেলেদের দিয়ে মেয়েদের অভিনয় করাচ্ছেন। তাঁতে সীতারূপী সালুঙ্কের গোঁফের রেখা পরিষ্কার দেখা গেছে। কলকাতায় ম্যাডান এসবে রাজি নন।

বিল্বমঙ্গল’ ছবির পোস্টার

অগত্যা ১৯১৮ সালে অনেক টাকা খরচা করে ম্যাডান কোম্পানি ইতালিতে “সাবিত্রী” নামে একটা ছবি তৈরি করলেন। নাচঘর পত্রিকায় এই ছবি নিয়ে লেখা হল “বিদেশীদের তোলা হিন্দু পুরাণের প্রথম ছবি সাবিত্রী। ১৩৩১ সালের ৮ই কার্তিক কর্নওয়ালিস থিয়েটারে চলেছিল। মিঃ এমব্রোসিও ছিলেন নাট্যাধ্যক্ষ। যাঁর নাট্যদক্ষতায় আগে তোলা হয়েছিল- Theodora, Last Days of Pompei. এই সাবিত্রীতে অভিনয় করেছিলেন কাউন্টেস রিনা দি লিগুয়ারো। রাজসভার নাচগুলি আর্টের দিক থেকে উত্তীর্ণ তবে হিন্দু নাচ নয়।” পরের বছরই কাউন্টেস লিগুয়ারোর স্বামী মিঃ লিগুয়ারো “শিবরাত্রি” নামে একটি সিনেমা তুলে সাড়া ফেলে দেন। এতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি দারুণ জনপ্রিয় হয়। কিন্তু লিগুয়ারো এদেশে আসেননি কোনওদিন। তাই তাঁকে সিনেমার ইতিহাসে অভিনেত্রীদের মধ্যে ধরেন না কেউই। ১৯১৯ সালেই, একদিকে দেশ যখন জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফুটছে, ম্যাডান রিলিজ করলেন ১০ রিলের ছবি ‘বিল্বমঙ্গল’। পরিচালক রুস্তমজী ধোতিওয়ালা। ১৩০ মিনিট দীর্ঘ এবং ১২০০০ ফিটের এই সিনেমাটির নায়ক ছিলেন দোরাবজি মেওয়াওয়ালা। সেই সিনেমায় ছোট্ট এক বালিকার চরিত্রে অভিনয় করেন ৯ বছরের এক বালিকা। নাম গহর। ছোট্ট চরিত্রেই গহর সবার নজর কেড়ে নেন। ১৯১০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তাঁর জন্ম। পরে চলে আসেন কলকাতায়। ‘বিল্বমঙ্গল’ ছবিতে অভিনয়ের পরে কৃষ্ণা ফিল্ম কোম্পানির ‘ফরচুন অ্যান্ড ফুলস’, কোহিনূরের ‘ব্রিফলেস ব্যারিস্টার’, ‘সম্রাট শিলাদিত্য’ আর ‘টাইপিস্ট গার্ল’ ছবিতে তাঁর অভিনয় সিনেমামোদীদের প্রশংসা কুড়ায়। এর পরে গহরকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন তাঁর নাম মিস গহর। একের পর এক হিট ছবির নায়িকা তিনি। জগদীশ ফিল্ম কোম্পানির ‘বিশ্ব মোহিনী’, ‘চন্দ্রমুখী’, ‘গৃহলক্ষী’, ‘সতী মাদ্রী’ কিংবা রঞ্জিত ফিল্ম কোম্পানির ‘রাজপুতানি’, ‘মাই ডার্লিং’, ‘বেগার গার্ল’…। তাঁর জনপ্রিয়তা এতদূর পৌঁছেছিল যে, সেই ১৯২৯ সালে, তিনি গ্ল্যামার সাম্রাজ্ঞী বোম্বের মিস সুলোচনাকে ৪৫১ ভোটে হারিয়ে “মুভি শো গোল্ড মেডেল” পান। এখানে বলে রাখি, এই সুলোচনা বা রুবি মেয়ার্সের মাইনে নাকি তখন বম্বের গর্ভনরের থেকেও বেশি ছিল।

মিস গহর

তবে এরই মধ্যে বাংলা ছবিতে এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গেল। ভারতীয় ছবিতে দাদাসাহেব ফালকে যে ধার্মিকভাব নিয়ে আসেন, সজ্ঞানে তাকে ভেঙে এক মুক্ত বাতাসের সন্ধান দেন ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি বা ডিজি। ১৯২১ সালে মুক্তি পেল বাংলা তথা ভারতের প্রথম ‘সামাজিক’ ছবি ‘বিলাত ফেরৎ বা ইংল্যান্ড রিটার্নড’। পরিচালক নীতীশ লাহিড়ী। প্রচুর চুম্বন আর আলিঙ্গন দৃশ্যে ভরপুর। এই ছবিতে উকিল বিধুভূষণ মুখুজ্জের শিক্ষিতা সুন্দরী কন্যা সুশীলা দেবী ছিলেন নায়িকা। সিনেমার জন্য তিনি ব্রিচেস পরে ঘোড়ায় চড়া শিখেছিলেন। ভবানীপুরে ক্যালকাটা কেমিক্যালের জমি ভাড়া করে তৈরি রসা থিয়েটারে এ ছবি মুক্তি পায়। সুশীলা দেবীর এই একটিই ছবিতে অভিনয়ের কথা জানতে পাই। দ্বিতীয় ছবি ‘যশোদানন্দন’-এ ডিজি আবার ফিরে যান পৌরাণিক ছবিতে। শ্রীরামপুরের গোঁসাই পরিবারের মেয়ে প্রমীলা দেবী এতে অভিনয় করেন। ডিজি সারা জীবনে মোট ৫৩টি ছবি করেছিলেন। প্রতিটিতেই মহিলাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন “আমি মেয়েদের শিল্পী হতে আহ্বান জানিয়েছিলাম পর্দায়। আমি ওদের মর্যাদা আদায় করে নিতে শিখিয়েছিলাম।” তাঁর স্ত্রী ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রেমিকাময়ী। ঘর বা পরিবারের কথা না ভেবে তিনিও সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। তবে ডিজি-র নায়িকারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অ্যামেচার। পেশাদার অভিনেত্রীদের তিনি নিতেন না। আর তাই হয়ত এক অভিনেত্রীর উল্কার মতো উত্থান তাঁর নজরে আসেনি।

পেসেন্স কুপার

১৯২১ সালে, যে বছর ‘বিলাত ফেরৎ’ রিলিজ হল, সেই বছরই গিরিশ ঘোষের লেখা নাটক অবলম্বনে ইউজিন লিগুরো সাহেবের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘নল দময়ন্তী’ ছবিটি। ১০ রিলের এই ছবিতে নায়িকা পেসেন্স কুপার নামে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। জন্ম ১৯০৪ সালে, কলকাতায়। সুন্দরী দময়ন্তীর ভূমিকায় তাঁর আত্মপ্রকাশ। পরিচালক নিজেই করেছিলেন পুষ্কর চরিত্র। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন কলকুশরু আদজানিয়া (নল), খোরশেদজি বিলিমোরিয়া (কালী), খুরশেদজি ইঞ্জিনিয়ার (দ্বাপর), মাস্টার মোহন (বিদূষক), ডি. সরকারি (কর্কটক), রমা শংকর (ইন্দ্র), ইস্তাক সিমোয়া (ভীম), মাস্টার রবিন (নারদ), মাঞ্চেরশা চাপগাড় (ইনি করেছিলেন যুধিষ্ঠির, বৃদ্ধ আর শিকারির ভূমিকা)। তারপর একে একে ‘বিষ্ণু অবতার’ ‘ধ্রুব চরিত্র’, ‘বেহুলা’ ‘সতী’, ‘পতি ভক্তি’ ছবিগুলোতে তাঁর অভিনয় প্রশংসা পায়।   

নল দময়ন্তী

নির্বাক যুগের এই স্টার অভিনেত্রীই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন। একবার নয়,  দুটি ছবিতে— পত্নী প্রতাপ (১৯২৪, দুই বোনের ভূমিকা) আর কাশ্মিরী সুন্দরী (১৯২৫, মা ও মেয়ের ভূমিকা)। দুর্ভাগ্যের বিষয়, দুটি ছবিরই অন্য কোনও শিল্পীর নাম পাওয়া যায় না। কুপার শিশু বয়সে বিনোদন জগতে আসেন ব্যান্ডমান নামে এক ইউরো এশিয়ান নাচের গ্রুপে নাচের শিল্পী হিসাবে। ‘নল দময়ন্তী’র সাফল্যের জন্য কুপার পর পর ছবি পেতে থাকেন। ম্যাডান কোম্পানির প্রায় সব ছবির তিনিই নায়িকা। তাঁর অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হল—

১৯২১— বেহুলা, মোহিনী, বিষ্ণু-অবতার, ধ্রুব চরিত্র
১৯২২— রত্নাবলী, নর্তকী তারা (সুশীলা), রাজা ভোজ, ভাগীরথী গঙ্গা, সতী, রামায়ণ, মাতৃস্নেহ, পতিভক্তি (লীলাবতী), কমলে কামিনী, প্রিন্সেস বুদুর
১৯২৩— নুরজাহান (নাম ভূমিকা)
১৯২৪— পত্নী প্রতাপ (দ্বৈত ভূমিকা দুই বোনের), তুর্কী হুর
১৯২৫— সংসার চক্র, আদুরে ছেলে, সতীলক্ষ্মী, কাশ্মিরী সুন্দরী (মা ও মেয়ের দ্বৈত ভূমিকা)
১৯২৬— ধর্মপত্নী, প্রফুল্ল, জয়দেব, কৃষ্ণকান্তের উইল
১৯২৭— চণ্ডীদাস, জনা, দুর্গেশনন্দিনী
১৯২৮— ভ্রান্তি, আঁখ কে তারা, হুর এ আরব
১৯২৯— কপালকুণ্ডলা
১৯৩০— কাল পরিণয়, গণেশ জন্ম, বামনাবতার, রাজসিংহ
১৯৩১— বিবাহ বিভ্রাট, আলাদিন অ্যান্ড ওয়ান্ডারফুল ল্যাম্প

টকি আসার বেশ কয়েকটি সবাক ছবিতে অভিনয় করে ১৯৪৪ সালে নির্বাক যুগের সবচেয়ে বড় ফিল্মস্টার কুপার অবসর নেন। চেহারায় বিদেশি ছাপ, সুন্দর আকর্ষণীয় মুখ, হালকা রং, মসৃণ ত্বক, সুন্দর ভাঁজকরা চুল, সাবলীল অভিনয় তাঁকে এক আলাদা ভাবমূর্তি দিয়েছিল। প্রথম জীবনে মাত্র ২১ বছর বয়সে বিয়ে হয় ব্যবসায়ী মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি-র সঙ্গে। দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। বিচ্ছেদের পরে বিয়ে করেন অভিনেতা গুল হামিদ-কে। সংসার সুখ সইল না তাঁর। গুল হামিদ বিয়ের ছয় বছরের মাথায় মারা যান। কুপার তাঁর পূর্ব স্বামীর সঙ্গে দেশবিভাগের পর পাকিস্তান চলে যান। নতুন নাম নেন সাবরা বেগম। প্রায় সবার অজান্তে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৯৩ সালে, করাচিতে।

নীরদাসুন্দরী

পেসেন্স কুপারের মত বিখ্যাত না হলেও প্রায় একই সময় আরও কিছু অভিনেত্রীকে দেখতে পাই। তাঁরা হলেন নীরদাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, বসন্তকুমারী, তারাসুন্দরী, মৃণালিনী প্রমুখ। এঁদের মধ্যে নীরদা শুরুতে ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনয় করলেও পরে নির্বাক ও কিছু সবাক ছবিতে অভিনয় করেন। শোনা যায় ‘রামানুজ’ নাটকে চমম্বার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণপত্নী সারদা দেবী। বুকে নিয়ে তাঁকে আশীর্বাদও করেন। শেষজীবনে অসুস্থ জড়বৎ নীরদাসুন্দরীকে দেখতে গেছিলেন গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ। এক টুকরো নেংটি পরা, গায়ে কোনও আবরণ নেই, চোখের মণিজোড়া শুকিয়ে গেছে, থরথর কাঁপা হাতে এক টুকরো শুকনো রুটি। নির্বাক যুগের নামী অভিনেত্রীর কী দুর্দশা!

১৯২১ সালে আরও এক অভিনেত্রী আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর নাম নীহারবালা। বয়সে কুপারের থেকে ছয় বছরের বড়। তাঁর প্রথম ছবি আর্ট থিয়েটারের ‘চন্দ্রশেখর’। এরপর অহীন্দ্র চৌধুরী আর দুর্গাদাসের ‘মিশররানি’ (১৯২৫) আর নরেশ মিত্র পরিচালিত ‘দেবদাস’ (১৯২৯)-এ তাঁর অভিনয় সবার মন জয় করে নেয়। সঙ্গে চলছিল থিয়েটারের কাজ। ১৯৩২ সালে ‘মহাপ্রস্থান’ নাটক করার সময় তাঁর দুখানি হাত পুড়ে যাওয়ায় নাটক বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখতে হয়। নীহার ছিলেন নাচে পারদর্শী। ম্যাডান কোম্পানির ‘প্রহ্লাদ’ ছবিতে আরতি নৃত্য দেখিয়ে সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন তিনি। শেষ জীবন কাটে অরবিন্দের আশ্রমে। ১৯৫৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

ম্যাডানের পাশাপাশি পুরো বাঙালি প্রোডাকশন হাউস খোলেন অনাদি বসু। নাম দেন অরোরা। প্রথমে ম্যাডানের মতো এঁরাও গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে শো দেখাতেন। এছাড়াও “পূজা পার্বণ বিবাহ বারোয়ারী ইত্যাদি উপলক্ষে এনগেজমেন্ট লইয়া বায়স্কোপ দেখাইতেন”। রসা থিয়েটারে ১৯২১ সালের ১৩ আগস্ট এঁদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক ছবি ‘রত্নাকর’ মুক্তি পায়। অভিনয়ে ছিলেন শশীমুখী আর সুশীলাবালা। সুশীলাবালার জন্ম এক নিষিদ্ধ পল্লীতে। তবু প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর ছিল। অভিনয়ে মেয়ের ঝোঁক দেখে মা তাঁকে মিনার্ভা থিয়েটারে পাঠান। অভিনয় শেখেন অর্ধেন্দু মুস্তাফির কাছে। ‘বলিদান’ নাটকে অভিনয় করে তিনি প্রথম শ্রেণির অভিনেত্রীর তকমা পান। থিয়েটার কাঁপিয়ে সিনেমায় আসার এই ঝোঁক সেই প্রথম নয়। শিশির ভাদুড়ির ‘আলমগির’, ‘সীতা’-র অভিনেত্রী প্রভা দেবীর সিনেমায় প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯২৩ সালের ‘মাতৃস্নেহ’ ছবিতে। সেই থেকে প্রায় একশটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। ১৯০৩ সালের ১২ই আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মা বিন্ধবাসিনী। বিখ্যাত অভিনেত্রী তিনকড়ির আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন প্রভা দেবী। ললিতকুমার গোস্বামীর কাছে নাচ গানের শিক্ষা, আট বছর বয়সে মিনার্ভা থিয়েটারে যোগদান, মাসিক পাঁচ টাকা জলপানির বিনিময়ে ‘জয়দেব’ নাটকে একটি বালকের চরিত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ১৯২১-২২ খৃষ্টাব্দে বেঙ্গলি থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানির অধীনে এবং আরও পরে শিশিরকুমার ভাদুড়ি পরিচালিত রঙ্গালয়গুলিতে অভিনয় করেন। শিশিরকুমার সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমেরিকা গিয়ে “সীতার” ভূমিকায় অভিনয় করে সুখ্যাতি পান। শিশিরকুমারের উপস্থিতিতে তিনি দু একবার রিহার্সালও পরিচালনা করেছেন। শিশিরকুমার বলেছেন “তাঁর মত অভিনেত্রী বিলেতে একটিও নেই।” শম্ভু মিত্র তাঁর “কিছু স্মরণীয় অভিনয়” নিবন্ধে শ্রীমতী প্রভাদেবী অভিনীত ‘উদীপুরী’, ‘রমা’, ‘কুন্তী’ প্রভৃতি চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন ‘বিন্দুর ছেলে’ নাটকে স্বামীর অপমানে স্তম্ভিত হয়ে যখন বড় বউয়ের চরিত্রে প্রভাদেবী বলতেন “তুই কাকে কী বল্লি লা ছোটবউ?” সেই তাঁর কাছে পৃথিবীর বিখ্যাত অভিনয়ের মধ্যে গণনীয়। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল ‘আলমগির’, ‘সীতা’, ‘পাষাণী’, ‘জনা’, ‘প্রফুল্ল’, ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘সধবার একাদশী’, ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘শেষরক্ষা’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘সরমা’, ‘দশের দাবি’, ‘শ্যামা’, ‘রীতিমতো নাটক’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘পথের দাবি’, ‘দুইপুরুষ’, ‘ধাত্রীপান্না’, ‘দুঃখীর ইমান’। তাঁর লেখা গানের সংকলন একত্র করে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রকাশ পেয়েছিল “গীতায়ণ”। শিশিরকুমারের অনুজ তারাকুমার ভাদুড়ির স্ত্রী তিনি। বিখ্যাত অভিনেত্রী কেতকী দত্ত তাঁদের কন্যা এবং চপল কুমার ভাদুড়ি তাঁদের পুত্র। প্রভাদেবীর মৃত্যুতে শ্রীরঙ্গমে অভিনয় বন্ধ থাকে এবং তাঁর বিজ্ঞপ্তিতে পোস্টার লেখা ছিল “প্রভাদেবীর মৃত্যুতে রঙ্গমঞ্চ নিষ্প্রদীপ”।

আঙুরবালা

১৯২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেল ম্যাডানের ৩ রিলের ছবি ‘ইন্দ্রসভা’। ছবিতে সবাই মহিলা শিল্পী। গুলফন—  মিস শরিফা, সবুজপরী— আর্টারিজান, রাজা— আঙুরবালা। এই শেষের জন মনোযোগের দাবি রাখেন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল প্রভাবতী দেবী। তাঁর জন্ম কলকাতার কাশীপুরে। বাবা জলি ব্যানার্জীর বন্ধু অমূল্যবাবুর কাছে গানে হাতে খড়ি। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে স্কুলে ছাত্রীবৃত্তি পরীক্ষায় জলপানি লাভ করেন তিনি। সঙ্গীত প্রতিভা তাঁর সহজাত। সুকণ্ঠের অধিকারী হওয়ায় শৈশবেই সঙ্গীত সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। খেয়াল, ঠুংরি, দাদরা ও গজলে একাধিক গুণী ওস্তাদের কাছে তামিল গ্রহণ তাঁর। কিশোরী বয়সেই গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে গানের রেকর্ড প্রকাশ। তাঁর সঙ্গীত জীবনের উপর উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন ঈশান ঠাকুর, জমীরুদ্দিন খাঁ এবং কাজী নজরুল ইসলাম। ঈশান ঠাকুরের কাছে কীর্তন, জমীরুদ্দিন খাঁর কাছে গজল ও দাদরা এবং কাজী নজরুল ইসলামের কাছে নজরুল গীতি শেখেন। অজস্র হিন্দি ও বাংলা গানে কণ্ঠদান করেন। তাঁর গাওয়া রেকর্ডের সংখ্যা আনুমানিক পাঁচশো। অভিনেত্রী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। মিনার্ভা থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত থেকে অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত কয়েকটি বিখ্যাত নাটক ‘পোষ্যপুত্র’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘বিদ্রোহিণী’, ‘চণ্ডীদাস’। বাংলা ছবি সবাক হলে ‘যমুনা পুলিনে’, ‘ধ্রুব’, ‘খনা’, ‘দেবযানী’ ইত্যাদি ছবিতে দাপটে অভিনয় করেন তিনি।

তারকবালা

১৯২৪ সালের প্রথমদিকে তাজমহল ফিল্ম কোম্পানির ‘চন্দ্রনাথ’ মুক্তি পায় রসা থিয়েটার আর স্টারে। অভিনয়ে মহিলাদের মধ্যে মিস লাইট ছাড়াও ছিলেন শিশুবালা। এই তাঁর প্রথম অভিনয়য়। ১৯৩২ সালে নরেশ মিত্রর নির্বাক ছবি ‘নৌকাডুবি’তেও তিনি অভিনয় করেন। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত ‘দেনা পাওনা’ তাঁর প্রথম সবাক ছবি। আর মিস লাইট ছিলেন তারকবালা। চারুচন্দ্র বসুর মেয়ে। আনুমানিক ১৯১৫ সালে কলকাতায় জন্ম তাঁর। জন্মের বছর দেড়েকের মধ্যে বাবা এবং বছর পাঁচের মধ্যে মায়েরও মৃত্যু হওয়ায় বড় হন দিদিমার কাছে। ডাক নাম রমা, ভালো নাম তারক। দিদিমা ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন ডাফ স্কুলে, কিন্তু পড়াশোনাটা বেশিদূর এগোনো হয়নি তাঁর। কারণ দারিদ্র। দিদিমা চিনতেন অভিনেত্রী তারাসুন্দরীর বোনকে আর সেই সূত্রে তারাসুন্দরীর হাত ধরেই মাত্র সাত আট বছর বয়সে স্টার থিয়েটারে পা রাখা তাঁর। ‘মদন চরিত্র’ নাটকে বালক মদন সেজে প্রথম অভিনয়েই মাত করেছিলেন তিনি। তাঁর সারা গায়ে টুনি বালব আর ফুল লাগানো থাকত। স্টেজের এক জায়গায় এসে দাঁড়ালে ব্যাটারির সঙ্গে তার জুড়ে বালবগুলো জ্বলে উঠত। এইভাবেই তারকের নাম হয়ে গেল লাইট আর বড় হলে সেটাই হয়ে দাঁড়ালো মিস লাইটে। স্টারেই তারপর একে একে ‘রাখিবন্ধন’, ‘বাসবদত্তা’, ‘হরিশচন্দ্র’, ‘অযোধ্যার বেগম’, ‘মীর কাশেম’ আর আরও নানা নাটকে ছোটখাটো বালক চরিত্রে অভিনয় করতে করতেই মাত্র বারো বছর বয়সে ‘ফুল্লরা’ নাটকে অহীন্দ্র চৌধুরীর বিপরীতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেলেন তিনি। স্টার থিয়েটারে থাকা কালীনই তারক ফিল্মে আসেন। চন্দ্রনাথ-এর সাফল্যের পরপর ‘গিরিবালা’, ‘শাস্তি কি শান্তি’, ‘সুদামা’, ‘ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয় সাবিত্রী’, ‘মন্ত্রশক্তি’ ইত্যাদি বহু ছবিতে নায়িকা হন তিনি।  তাঁর সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছবি ‘দেবদাস’ (১৯২৮)। পরে বহুবার চিত্রায়িত এই গল্পের তিনি পার্বতী। প্রথম পার্বতী। নায়ক দেবদাস ছিলেন ফণী বর্মা, পরিচালনায় নরেশ চন্দ্র মিত্র। তারকবালার গানের গলা ছিল চমৎকার, তাই বেতার আর গ্রামোফোনেও গান গাইবার ডাক আসে তাঁর। বেতারের কাজ বলতে প্রধানত গান গাওয়া, এ ছাড়া রেকর্ডেও গান বেরোল তারকবালার। এই সময়ে “শেফালি তোমার আঁচলখানি বিছায় শারদ প্রাতে” গানটি রেকর্ড বিক্রির আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। এইচএমভি থেকে দুটি পালার রেকর্ডেও তাঁর গান ছিল। এই রেডিও বাড়িতেই কানাকেষ্টর সঙ্গে প্রথম পরিচয় তারক-এর। আপন করে নিলেন কৃষ্ণচন্দ্রই। রীতিমতো ব্রাহ্মণ ডেকে, মন্ত্র পড়ে, মালা পরিয়ে স্বীকৃতি দিলেন স্ত্রী হিসেবে। আর পাঁচজন ডাকত লাইট নাম নিয়ে, কৃষ্ণচন্দ্র ডাকতেন মেমসাহেব বলে। স্ত্রী বলে সামাজিক স্বীকৃতি, নারীর মর্যাদা, ভালোবাসা সবই পেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে। একটি ছেলেও হয়েছিল তাঁদের। আর এই ছেলের জন্যই স্টেজ ছাড়লেন তারকবালা। ছেলে বড় হচ্ছে, তাকে “থিয়েটার করতে যাচ্ছি” বলতে ভালো লাগত না তারকবালার, কুণ্ঠা বোধ হত, কেমন যেন অপরাধী মনে হত নিজেকে। তাই ছেড়েই দিলেন থিয়েটারে যাওয়া। কিন্তু এই ছেলেটি আবার অসুখে পড়ল, শেষ অবধি বাঁচল না। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই সব শেষ। ভেঙে পড়লেন তারকবালা, বিব্রত হলেন কৃষ্ণচন্দ্র তখন স্ত্রীকে নিয়ে, তবে কিছু পরে বুঝিয়েসুঝিয়ে আবার সেই থিয়েটারেই ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গেই স্টার থেকে এসেছিলেন রংমহল থিয়েটার-এ।  তখন হাউস তৈরি হয়নি তাই, দীপালি নাট্য সংঘ নাম দিয়ে শো করতেন যতদিন না হাউস তৈরি হয়। কৃষ্ণচন্দ্র বেঁচে ছিলেন ১৯৬২ অবধি। তাঁর মৃত্যুর পর একেবারে একা হয়ে যান তারকবালা। দে পরিবার কোনওদিন কৃষ্ণচন্দ্রের এই নটী স্ত্রীকে স্বীকার করেনি। কৃষ্ণচন্দ্রের পৈতৃক সম্পত্তির কোনও ভাগ তারকবালাকে দেওয়া হল না। অনেক পরে ১৯৭৩-৭৪ সালে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্যমন্ত্রী পুরনো দিনের বহু শিল্পীকে সংবর্ধনা দেন রবীন্দ্র সদনে। সেই শিল্পীদের মধ্যে তারকবালাও ছিলেন।

পেসেন্স কুপার বাংলা ছবির একমাত্র অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রী ছিলেন না। সীতা দেবীর নাম অবশ্যই বলতে হবে। তাঁর আসল নাম রিনি স্মিথ। ‘লাইট অফ এশিয়া’-তে গোপার ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। নিরঞ্জন পালের দেওয়া স্টেটসম্যানের বিজ্ঞাপন দেখে বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে আসেন তিনি। ১৯২৭ সালের ১২ মার্চ ক্রাউন থিয়েটারে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম বাংলা ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল “রক্ষণশীল অভিজাত বংশীয়া হিন্দু পরিবারের বিদুষী কন্যা— সীতা দেবী”। বিজ্ঞাপন আর কবে থেকেই বা সত্যি কথা বলছে! সেই বছরই ২৫শে ডিসেম্বর ক্রাউনে মুক্তি পায় ‘জয়দেব’। পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্যামেরায় চার্লস ক্রিড। অভিনয়ে পেসেন্স কুপার, শ্রীমতী হিপোলাইট, শশিমুখী, মনোরমা, রেণুবালা, বীণাপাণির সঙ্গে শ্রীরাধার ভূমিকায় নবাগতা কাননবালা।  

কানন দেবী

কাননবালা বা কানন দেবীর কথা গোটা প্রবন্ধ শুধু নয়, একটি বইয়ের দাবি রাখে। ১৯২৬ সালে যখন ‘জয়দেব’ মুক্তি পেল, সেই বছরই ওয়ার্নার ব্রাদার্স পৃথিবীর প্রথম টকি বা সবাক ছবি আনল বাজারে। ‘ডন জুয়ান’। সবাক, তবে কোনও সংলাপ নেই, কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতে মোড়া। মাত্র দশ বছর বয়সে ‘জয়দেব’-এ রাধা চরিত্রে অভিনয় করে পুরস্কার স্বরূপ পাঁচ টাকা সম্মানী পান। তিনি  ছিলেন একজন রক্ষিতার সন্তান। তার বাবার নাম রতনচন্দ্র দাস। জন্মের পরপরই তিনি বাবাকে হারান। বড় হয়ে জানতে পারেন, বাবা তার মাকে বিয়ে করেননি। তার বাবা ছিলেন সওদাগর অফিসের একজন ছোট কেরানি। তার একটি ছোট দোকানও ছিল। কাননের মা তখন তার দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে রাঁধুনি ও ঝিয়ের কাজ নেন। দারিদ্রের কারণে কানন দেবী মাত্র বারো বছর বয়সে ম্যাডানের স্টুডিওতে হাজির হন অভিনয় করতে। ‘জয়দেব’-এর পর আরেকটা ছোট্ট রোল পেয়েছিলেন কানন ‘শঙ্করাচার্য’ (১৯২৭) ছবিতে, গোড়ায় যার পরিচালনায় ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ডিজি। মধ্যিখানে ডিজি কাজ ছেড়ে চলে গেলে তড়িঘড়ি ছবি শেষ করেছিলেন কালিকাপ্রসাদ ঘোষ। ছবিও তড়িঘড়ি পাততাড়ি গুটিয়েছিল হল থেকে। কাননের কপালেও পুরো পারিশ্রমিক জোটেনি। এর পর তো টানা বেশ কয়েক বছর হাতে কাজ নেই। কাজে ফিরতে ফিরতে পেরিয়ে গেল অনেকগুলো বছর।

কানন দেবী ছিলেন সমাজের নিচুতলা থেকে উঠে আসা শেষ বড় অভিনেত্রী। অভাবের কারণে কিশোর বয়স থেকেই তাকে পর্দায় পরিচালকের ইচ্ছে মতো চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। নায়ক ও পরিচালকের লোলুপতার শিকার হতে হয়েছে। ১৯৩১ সালের ছবি ‘জোর বরাত’-এ একটি দৃশ্যে নায়ক তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোটে চুমু খান— যা তাকে অপমানিত ও ব্যথিত করে। পরিচালকের নির্দেশেই নায়ক এই কাজ করেন তাকে আগে না জানিয়েই। অভিভাবকহীন নিচু ঘরের মেয়ে হওয়ায় তাকে টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে নগ্ন দৃশ্যে বাধ্য করা হয়। এরকম একটি ছবি হল ‘বাসব দত্তা’। এ ছবিতে তার অনিচ্ছায় নগ্নতার প্রদর্শন ছিল। সম্ভবত সে কারণে এই ছবি সফল হয়নি। এছাড়া পরিচালকেরা তার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে টাকা পয়সার ব্যাপারে ঠকাত। কানন দেবীর সত্যিকারের অভিনয় জীবন শুরু হয় ত্রিশের দশকে। ১৯৩১ সালে থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত কানন দেবী ছিলেন নায়িকা-গায়িকা। ১৯৩১ সালে পূর্ণাঙ্গ সবাক চলচ্চিত্র ‘জোর বরাত’-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৩৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ তাকে প্রতিষ্ঠা দেয় চলচ্চিত্র জগতে। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে চলার সময় কানন দেবীর অভিনয় দেখতে বহু তরুণ পাগলের মতো ছুটে যেতেন সিনেমার পর্দায় তাকে স্পর্শ করতে। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্রটি তাকে প্রথম খ্যাতি এনে দেয়। ৪০-এর দশকের ‘পরিচয়’ এবং ‘শেষ উত্তর’ ছবির জন্য তিনি পরপর দু’বার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে তার গাওয়া ‘মেঘ নগরের অন্ধকারে’ এবং ‘কেন অকারণে…’ অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ‘মুক্তি’ ছবিতে অভিনয় করেই তিনি পেয়ে যান তারকা খ্যাতি। ‘স্ট্রিট সিংগার’ (১৯৩৮), ‘সাথী’ (১৯৩৮), ‘পরাজয়’ (১৯৪০), ‘জওয়ানি কি রাত’ (১৯৪০), ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৮), ‘সাপুড়ে’ (১৯৩৯) প্রভৃতি ছবিতে কানন দেবীর নাচ-গান-অভিনয় এক কথায় ছিল অনবদ্য। তার শেষ ছবি ছিল ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি’ (১৯৫৭)। বহু প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন কানন দেবী। অভিনয়, নাচ, গান— এই তিন প্রতিভাসহ অসংখ্য গুণের সমন্বয় ঘটেছিল তার মধ্যে। বিজ্ঞাপন চিত্রেও দেখা যায় কানন দেবীকে। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০টি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। কানন দেবী যেসব নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেন তারা হলেন— জয় নারায়ণ, হীরেন বসু, জহর গাঙ্গুলি, ধীরাজ ভট্টাচার্য, জাল মার্চেন্ট, প্রমথেশ বড়ুয়া, কুন্দন লাল সায়গল, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, নওয়াব নাজাম, পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামোহন ভট্টাচার্য, বিকাশ রায়, কমল মিত্র, অশোক কুমার প্রমুখ।

১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কানন দেবীর জন্য সবচেয়ে বেশি খ্যাতির সময় ছিল। তিনি এ সময় সম্ভ্রান্ত কানন দেবীতে পরিণত হন কাননবালা থেকে। তিনি তখন রোমান্টিক নায়িকার বদলে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাতেই বেশি অভিনয় করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি শ্রীমতি পিকচার্স গড়ে তোলেন যার বেশিরভাগ ছবিই ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে। এই কোম্পানির ছবিতে তিনি কেবল অভিনয় ও প্রযোজনাই করেননি, তিনি পরিচালনাও করেন। তার ছবির পরিচালকের একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট দল ছিল যার নাম— সব্যসাচী। তিনি তিন জনের একজন ছিলেন।

সিনেমার বাইরেও তার গানের রেকর্ড ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা নেন। এছাড়াও তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার ও পঙ্কজ মল্লিকের কাছেও তালিম নেন। কানন দেবী ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি ও আধুনিক গানের সফল গায়িকা। তার কন্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ এবং নজরুল সঙ্গীত ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো’ এই গান দু’টি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৯ সালে ‘মেজদিদি’ করার সময় নেভাল এডিসি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ বিয়ে বেশি দিন না টিকলেও কানন দেবীর দ্বিতীয় বিয়ে সুখের হয়েছিল। কানন দেবীর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ এক প্রামাণ্য দলিল। সেখানে কানন দেবী লিখছেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকলে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’ ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে হরিদাস ও কানন জোড়ে গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সেদিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। ১৯৮৯ সালের এক দিন ওঁর টাকাপয়সা, কাগজপত্র, শখের পিস্তল ও রিভলভার গুছিয়ে হরিদাস ওঁদের ১নং রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। কিছু দিনের মধ্যে কানন দেবীও ১৭ জুলাই, ১৯৯২-এ বেল ভিউ ক্লিনিকের এক নির্জন কেবিনে শুয়ে সংসার ত্যাগ করলেন।

রেণুবালা

‘জয়দেব’ ছবিতে কাননবালার সঙ্গে ছিলেন আর এক নবাগতা রেণুবালা। নাট্যকার ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে রেণুবালার জন্ম ১৯১৮ সালে রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে পৈতৃক নিবাসে। রেণুবালার মা হরিমতি (ছোট) অভিনেত্রী ছিলেন বলে মেয়েকে অভিনেত্রী করে তুলতে চাননি তাই হেদুয়ার ডাফ স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ওঁর মায়ের সঙ্গে আলাপ ছিল অভিনেত্রী চারুশীলার। চারুশীলা রেণুদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। চারুশীলা একদিন ওঁর মাকে বললেন, মেয়েকে থিয়েটারে দিন, ওই লাইনে ও ভালো করবে। আর এভাবেই রেণুবালার থিয়েটারে যোগদান তাও মাত্র সাত কি আট বছর বয়সে মিনার্ভা থিয়েটারের ‘আলিবাবা’ নাটকে কাঠুরে বালকের চরিত্রে। দীর্ঘদিন ছিলেন মিনার্ভায়। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে দানীবাবুর সঙ্গে এবং পরে শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গেও আত্রেয়ী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তেরো কি চোদ্দ বছর বয়সকালে ‘আত্মদর্শন’, ‘কিন্নরী’ সহ বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন। আত্মদর্শনে ‘সুখ’ চরিত্রে তিনি এমন খ্যাতির সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন যে পাবলিক তাঁর আসল নাম ভুলে গিয়ে তাঁকে ‘সুখ’ বলেই ডাকতে লাগল। রেণুবালা অভিনয় শিখেছিলেন কালীপদ ঘোষের কাছে আর গান শিখেছিলেন দেবকণ্ঠ বাগচী, ভূতনাথ দাস ও পরে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। ১৯২৬ সালে জ্যোতিষ ব্যানার্জীর নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ প্রথম অভিনয় করেন। ওই ছবিতে কানন দেবী হয়েছিলেন রাধা এবং কৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রেণুবালা। এরপরে রেণুবালা অভিনীত নির্বাক ছবিগুলো হল— শঙ্করাচার্য (১৯২৭), নিষিদ্ধ ফল (১৯২৮), অপহৃতা (১৯২৯), কণ্ঠহার (১৯৩০), মায়াবী (১৯৩০), সন্দিগ্ধা (১৯৩০), বিগ্রহ (১৯৩০) ইত্যাদি। আর টকির যুগে রেণুবালা ম্যাডান কোম্পানির ‘আবু হোসেন’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। এতে টুকরো টুকরো ভাবে চিত্র ব্যবহৃত হয়েছিল। আবু হোসেনে রোশেনারা সেজেছিলেন রেণুবালা। ১৯৩১ সালে জ্যোতিষ ব্যানার্জির ‘জোর বরাত’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছিলেন, ওই ছবিতে কানন দেবীও নায়িকা ছিলেন। নায়ক ছিলেন জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। ১৯৩২ সালের ‘বিষ্ণুমায়া’ ছবিতে রেণুবালা ছিলেন রাধার চরিত্রে। ওই ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন— অহীন্দ্র চৌধুরী, জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, কার্তিক দে, কার্তিক রায়, শিশুবালা, উমাশশী, কানন দেবী, বেলারানি, জ্যোতি, গণেশ গোস্বামী প্রমুখ। ১৯৩৩ সালে ‘যমুনা পুলিন’ ছবির বাংলা ও হিন্দি দুই ভার্সানেরই নায়িকা ছিলেন রেণুবালা, ওই ছবিতে আঙুরবালা ও ইন্দুবালাও ছিলেন। রেণুবালা যমুনা পুলিন ছবিতে গানও গেয়েছিলেন। রেণুবালা অভিনীত মনে রাখার মতো ছবি হল ‘বিদ্রোহী’, ‘জাগরণ’, ‘একই গ্রামের ছেলে’, ‘দুঃখীর ইমান’, ‘সন্দীপনের পাঠশালা’ ইত্যাদি। ‘অপহৃতা’ ছবিতে অভিনেতা ভূমেন রায়ের বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে তাঁদের মন দেয়া নেয়া শুরু হয়। এরই কিছুদিন পরে রেণুবালাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন ভূমেন রায়। এর আগে ‘বনের পাখি’ নাটকে কুমার মিত্রের বিপরীতে অভিনয়, কুমার মিত্রের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন এবং নৃত্য পরিবেশনও করেছিলেন।

‘জয়দেব’ ছবির মনোরমাকে সবাই ডাকত কাপ্তেন মোনা বলে। তিনি বহু রাজা মজারাজার সেবাদাসী হয়ে আর অভিনয় করে প্রচুর টাকা রোজগার করতেন। সে টাকা উড়াতেনও দুই হাতে। ক্যাপ্টেনের মতো পুরুষের পোশাক পরে থাকতেন বলে তাঁর এ হেন নাম। লাইট অফ এশিয়া-তে সীতাদেবীর সঙ্গে মনোরমাও ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক অভিনেত্রী ছিলেন চুনিবালা দেবী। তাঁর প্রথম নির্বাক ছবি ১৯৩০-এর “বিগ্রহ”। পরে সুযোগ পান রবি ঠাকুর পরিচালিত নিউ থিয়েটার্সের ‘নটীর পূজা’তে। শেষ ছবি ১৯৩৯ এর ‘রিক্ত’। মনে রাখার মতো না। কিন্তু দুটি কারণে চুনিবালাকে ভোলা যাবে না। এক, সবাই জানে, ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে ইন্দির ঠাকরুণের ভূমিকায় অসামান্য অভিনয়ের জন্য। দুই, যেটা অনেকেই জানি না, মা বাবা-কে হারানোর পর শিশু নিভাননীকে তিনিই মানুষ করেন। চুনিবালা না থাকলে আমরা নির্বাকযুগের এক শক্তিশালী অভিনেত্রীকে হারাতাম।

নিভাননী দেবী

শ্রীমতী নিভাননী একদা মঞ্চ কাঁপানো তারকা ছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রেও তাঁর অবদান মনে রাখার মতো। নির্বাক যুগে নায়িকা হিসেবে তিনি ১৯২২ সালে ‘বিষবৃক্ষ’ ছবিতে অহীন্দ্র চৌধুরীর বিপরীতে, ১৯২৭ সালে ‘শঙ্করাচার্য’ ছবিতে নির্মলেন্দু লাহিড়ীর বিপরীতে, ১৯২৮ সালে ‘নিষিদ্ধ ফল’ ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বড়) বিপরীতে, ১৯৩১ সালে ‘চুপ’ ছবিতে হীরেন বসুর বিপরীতে অভিনয় করেন। বাংলা সবাক ছবি নির্মাণ শুরু হয় ১৯৩১ সালে। প্রথম বছরেই অর্থাৎ ১৯৩১ সালে ‘দেনা পাওনা’ ছবিতে  দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছিলেন নিভাননী। ছবিতে তিনি ষোড়শী আর দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রূপ দিয়েছিলেন জীবানন্দ চরিত্রে। নিভাননীর জন্ম বাংলা ১৩০৩ সালের ২০শে ফাল্গুন, ওঁর বাবার নাম যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। মাত্র ৯ বছর বয়সে মাকে এবং ১৫ বছর বয়সকালে বাবাকে হারান তিনি। এ অবস্থায় মামাবাড়িতেই তাঁকে থাকতে হয়েছিল। যদিও ব্রজরানিদেবীই ছিলেন নিভাননীর জন্মদাত্রী, তবুও মায়ের সই প্রখ্যাত অভিনেত্রী চুনিবালাই ছিলেন নিভাননীর মায়ের মতো। নিভাননীরা ছ’ ভাইবোনই এই চুনিবালার কাছে মানুষ হয়েছিলেন। যখন নিভাননীর বয়স ৬ কি ৭ তখন চুনিবালা ওঁকে নিয়ে আসেন পরিচালক অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির কাছে। তিনিই ওঁকে ‘সমাজ’ নাটকে একটি ছোট্ট বালক চরিত্রে প্রথম অভিনয় করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এগারো বছর বয়স থেকে নিভাননী ন্যাশনাল থিয়েটারের ‘গুলজেরিনা’, ‘হীরের ফুল’ এবং আরও বহু নাটকে ব্যালে ট্রুপের মধ্যে নাচতেন। ‘বলিদান’ নাটকে অভিনয় করে প্রথমে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। নিভাননীর যেমন ছিল রূপ তেমনি ছিল অভিনয় প্রতিভা। ন্যাশনাল থিয়েটারে থাকাকালীন প্রভূত অর্থের অধিকারী এবং নাট্যপ্রেমিক হেমেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পর থিয়েটার ছাড়লেও পরে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও প্রবোধ গুহের অনুরোধে স্টার থিয়েটারে ‘অযোধ্যার বেগম’ নাটকে প্রথমে গুজারী চরিত্রে এবং পরে তারাসুন্দরী অসুস্থ হলে প্রধান রানি চরিত্রে অবতীর্ণা হন নিভাননী। ওইসময় আর্ট থিয়েটারের সঙ্গে তিনি বার্মার রেঙ্গুনেও অভিনয় করতে গিয়েছিলেন। মিনার্ভায় থাকাকালীন রেডিও এবং রেকর্ডে অভিনয় করার পর সুযোগ পান রূপালী পর্দায়। নির্বাক ছবি ‘শঙ্করাচার্য’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘নিষিদ্ধ ফল’, ‘প্রহ্লাদ’ ইত্যাদিতে অভিনয় করে সকলের মন জয় করে নিলেন। বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হল “নিভাননী- নিভাননী”। পরবর্তীতে এই নিভাননী সবাক যুগে সেই ১৯৩২ সালে ‘চিরকুমার সভা’ ছবিতে শৈলবালা চরিত্রে, ১৯৩৩ সালে ‘কপাল কুণ্ডলা’ ছবিতে মতিবিবির চরিত্রে, ‘মীরাবাঈ’ ছবিতে লালবাঈয়ের চরিত্রে, ১৯৩৬ সালে ‘পরপারে’ ছবিতে হিরন্ময়ী চরিত্রে, ১৯৩৭ সালে ‘ইম্পস্টার’ ছবিতে ক্ষীরি চরিত্রে, ১৯৩৭ সালে ‘প্রভাস মিলন’ ছবিতে যশোদা চরিত্রে, ১৯৩৯ সালে ‘জীবন মরণ’ ছবিতে গীতার মা চরিত্রে, ‘বড়দিদি’ ছবিতে বিন্দু চরিত্রে, ‘বামনাবতার’ ছবিতে অদিতি চরিত্রে অভিনয় করে চিত্রজগতে অবিস্মরণীয় তারকার মর্যাদা পেয়েছিলেন। নিভাননী অভিনীত আরও উল্লেখযোগ্য ছবি হল ‘যখের ধন’, ‘অমরগীতি’, ‘শাপমুক্তি’, ‘ব্যবধান’, ‘কবি জয়দেব’, ‘প্রতিশোধ’, ‘শ্রীরাধা’, ‘জননী’, ‘সহধর্মিণী’, ‘দোটানা’, ‘মানে না মানা’, ‘সাত নম্বর বাড়ি’, ‘দেশের দাবি’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘রামপ্রসাদ’ ইত্যাদি। উল্লেখিত ছবিগুলো ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে মুক্তি পেয়েছিল। নিভাননী দেবী একটি শৌখিন নাট্য দলের হয়ে ‘বিপ্রদাস’ নাটকে শেষ অভিনয় করেন। তাঁর শেষ অভিনীত ছবি ‘রাতের রজনীগন্ধা’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে, ওই ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন উত্তম কুমার, অপর্ণা সেন, অজয় ব্যানার্জি, অনিতা গুপ্ত, বঙ্কিম ঘোষ এবং আরও অনেকে।

নির্বাক যুগের আরও দুই তারকা ছিলেন কঙ্কাবতী আর চন্দ্রাবতী, দুই বোন। বাবা গঙ্গাপ্রসাদ সাহু। চলচ্চিত্রে আবির্ভাব ১৯২৮ সালের নির্বাক ছবি ‘বিচারক’-এ ক্ষীরোদার ভূমিকায়। শিশির ভাদুড়ির পরিচালিত ‘পল্লীসমাজ’ আর ‘সীতা’তেও তাঁর অভিনয় প্রশংসা কুড়োয়। সীতা-য় তিনি ছিলেন নাম ভূমিকায়।  ১৯৩৯ সালে কালী ফিল্মস লিমিটেডের বিরাট ঐতিহাসিক ছবি ‘চাণক্য’তে মুরার ভূমিকায় অভিনয় তাঁর শেষ কাজ। মেনিনজাইটিস রোগে আচমকা তাঁর মৃত্যু ঘটে। ছবিটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। ‘চাণক্য’ ছবির প্রচার পুস্তিকায় কালো বর্ডারে কঙ্কাবতীর মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছিল।

চন্দ্রাবতী

১৯০৮ সালে জন্ম চন্দ্রাবতীর। বিহারের মজফফরপুর শহরে।  বাবা গঙ্গাধর প্রসাদ সাহু ছিলেন জমিদার, আবার ম্যাজিস্ট্রেট। দিদি কঙ্কাবতী। দুই বোনই কিন্তু অল্প বয়সে লেখাপড়ার জন্য কলকাতায় চলে আসেন আর তাই অবাঙালি হয়েও দুইজনেই চমৎকার বাংলা বলতেন, বাঙালিদের মতোই। দুই বোনই প্রথমে ভর্তি হন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে, পরে বেথুন কলেজে। চন্দ্রাবতী ছিলেন এই বেথুন কলেজ থেকে কলা বিভাগে প্রথম স্নাতক। চন্দ্রাবতীর বিয়ের তারিখটা সঠিক জানা যায় না তবে, স্বামী বিমল পাল ফিল্ম এবং পত্রিকা জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর এরই জন্য চন্দ্রাবতীর ফিল্মে আসাটা সুবিধার হয়। চন্দ্রাবতীর প্রথম ছবি পিয়ারী (১৯২৯), নির্বাক ছবি। তৈরি হয়েছিল মুভি প্রোডিউসার্স-এর ব্যানারে। এই ফিল্ম কোম্পানির মালিক ছিলেন চন্দ্রা আর বিমলবাবু যৌথভাবে। অফিস ছিল ১ নম্বর ন্যায়রত্ন লেন-এ, কলকাতায়। চন্দ্রার স্বামী বিমল পাল ছিলেন ছবিটির পরিচালক আর প্রযোজক হিসেবে নাম ছিল চন্দ্রাবতীর, এটা ধরলে চন্দ্রাবতীই কিন্তু ভারতের প্রথম মহিলা প্রযোজক। শুধু তাই নয়, চন্দ্রাবতী কিন্তু ভারতের প্রথম মহিলা, যিনি সিনেমা হলের মালিক ছিলেন। নদীয়া জেলার রানাঘাট টকিজ ১৯৩৭ সালে তৈরি হয় আর তাঁর মালিক ছিলেন চন্দ্রা। স্বামীর সূত্রেই, একটি পত্রিকা প্রকাশন সংস্থার মালিক ছিলেন এই নায়িকা। এদের কাছ থেকেই প্রকাশিত হত ‘বায়োস্কোপ’ নামে পত্রিকা যার সম্পাদনার কাজ ছিল চন্দ্রাবতীর। ‘পিয়ারী’ (১৯২৯) ছবির পর পর বম্বে থেকে ডাক পান চন্দ্রা, অশোক কুমারের বিপরীতে অভিনয় শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু ছবিটিও শেষ হয়নি আর যে কোনও কারণেই হোক চন্দ্রাবতী ফিরে আসেন কলকাতায়। ১৯৩৩ সালে ‘মীরাবাঈ’ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় আর গান করেন। ‘মীরাবাঈ’ নিউ থিয়েটার্স-এর ছবি, দ্বিভাষিক, কিন্তু হিন্দি ছবিটিতে নেওয়া হয়নি চন্দ্রাবতীকে বরং বম্বে থেকে আনা হয়েছিল দুর্গাবতী খোটেকে। ‘মীরাবাঈ’ (১৯৩৩) ছবিতে অভিনয়ের সময় পরিচালক দেবকী কুমার আর সঙ্গীত পরিচালক রাইবাবুর মধ্যে প্রায়ই ঝামেলা লেগে যেত। পরিচালক চাইতেন যাতে অভিনয়টা নিখুঁত হয় আবার ওদিকে রাইবাবু চাইতেন গানে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। দুজনকেই খুশি করতে প্রাণ যেত নায়িকার। এই ছবিতে ওঁর অভিনয় আর গানের পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পর পর ছবিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় এবং প্রয়োজন মতো গান করতে থাকেন। ‘দেবদাস’ ছবিতে অভিনয় দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র; যেমনটি লেখকের মনে ছিল ঠিক তেমনটি নাকি করেছিলেন চন্দ্রা। এই ছবির পর চন্দ্রমুখী চরিত্রকে প্রচুর নাচ গান করতে দেখা গেছে;  বিশেষ করে হিন্দি ছবিগুলোতে। ‘দেবদাস’, ‘বিজয়া’, ‘দিদি’, ‘শুকতারা’, ‘বিজয়িনী’, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘মাই সিস্টার’, ‘বড়দিদি’, ‘রাঙামাটি’, ‘দুই পুরুষ’ এরকম একের পর এক ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। ‘দেবদাস’ ছবির বিরাট সাফল্যের পর বারবনিতার ভূমিকায় ওনাকেই শুধু দেখা যেত সেই সময়ে। ‘শুকতারা’ (১৯৪০) আর ‘দুই পুরুষ’ (১৯৪৫) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন চন্দ্রা। ২২শে এপ্রিল ১৯৯২ চন্দ্রাবতীর মৃত্যু হয়।

নির্বাক যুগের নায়িকাদের আলোচনা হবে, আর উমাশশী থাকবেন না, তা হয় না। ১৯৩২ সালে দেবকী বসুর ‘চণ্ডীদাস’ ছবিতে রামীর ভূমিকায় সুন্দরী, সুকন্ঠী উমাশশী অমর হয়ে গেছেন। তাঁরও জীবনের শুরু থিয়েটারে। ১৯২৯ সালে নির্বাক ছবি ‘বঙ্গবালা’য় তাঁর প্রথম অভিনয়। একে একে ‘বিগ্রহ’, ‘অভিষেক’। কিন্তু তাঁকে রাতারাতি স্টার বানাল ‘চণ্ডীদাস’। প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘ভাগ্যচক্র’, ‘দেশের মাটি’, ‘কপালকুণ্ডলা’ কিংবা হিন্দি ‘ধুপছাঁও’তে তাঁর অভিনয় কে ভুলতে পেরেছি? কিন্তু সংসারের তাগিদে আচমকা সব ছেড়ে ঘরকন্নায় মন দেন উমাশশী। স্বামী গুরুপ্রসাদ দেব শোভাবাজার রাজবাড়ির বংশধর।

এদিকে ভিতরে ভিতরে একটা চাপা লড়াই চলছিল অনেকদিন থেকেই। বম্বের ইম্পেরিয়াল মুভিটোন আর কলকাতার ম্যাডানের মধ্যে। ম্যাডান তখন ভারতে সিনেমার সবচেয়ে বড় নাম। আগে অন্য বিলেতি সিনেমা দেখালেও অবশেষে নিজেরাই সিনেমা বানাচ্ছেন। গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখান না আর। বরং কিনে নিয়েছেন প্রাসাদোপম এলফিনস্টোন থিয়েটার। একের পর এক হিট ছবি বানাচ্ছেন তাঁরা। এদিকে হলিউডে সেই ১৯২৮-এই টকি ছবি তৈরি হয়ে গেছে। ভারতেও তাই লড়াই শুরু হল ইতিহাস সৃষ্টির। একদিকে আর্দশির ইরানি অন্যদিকে ম্যাডান স্টুডিওর অমর চৌধুরী। ইরানি বেছে নিলেন রাজা রানি নিয়ে এক পৌরাণিক গল্প আর অমরবাবু নিজেই লিখলেন এক স্ল্যাপস্টিক কমেডি অনেকটা তাঁর পূর্বসূরি ডিজির ধাঁচে। অভিনয়ে নায়ক কুবেরের ভূমিকায় তিনি নিজে, তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় মিস গোলাপ আর শাশুড়ি রানিসুন্দরী দেবী। গান লিখলেন আর সুর দিলেন ক্ষীরোদগোপাল মুখুজ্জে। কিন্তু একটা মুশকিল হল। ম্যাডান একসাথে পাঁচটি হিন্দি বাংলা টকি রিলিজ করতে চাইলেন, যার মধ্যে বিগ বাজেট হিন্দি সিনেমা শিরিন ফারহাদ ছিল। ফলে ক্রু মেম্বারদের অমরবাবুর সেট থেকে সরিয়ে নেওয়া হত প্রায়ই। ম্যাডানের পরিকল্পনা ছিল শিরিন দিয়েই শুরু হবে ভারতের প্রথম টকি যাত্রা। এদিকে মুভিটোন ১৯৩১-এর মার্চে সাততাড়াতাড়ি রিলিজ করে দিল পৃথ্বীরাজ কাপুর, জুবেদা আর মাস্টার বিঠঠল অভিনীত ‘আলম আরা’। ভারতের প্রথম টকি। শিরিন ফারহাদ তখনও মাঝপথে। বাজারে টিকে থাকতে মাত্র দুই হপ্তায় অমরবাবুর সিনেমা শেষ করে এপ্রিলেই রিলিজ করে দেওয়া হল। ইতিহাস সৃষ্টি হল। প্রথম বাংলা টকি আলোর মুখ দেখল। ছবির নাম? ‘জামাইবাবু’। শুরু হল টকির যুগ। যেসব নায়িকাদের কণ্ঠ ভালো, তাঁরা সুযোগ পেলেন নতুন এই মাধ্যমে। যাদের কণ্ঠ সুরেলা নয়, বা বিদেশি অভিনেত্রীরা মানিয়ে নিতে পারলেন না এই নতুন মাধ্যমে। ধীরে ধীরে বিদায় নিলেন তাঁরা। হারিয়ে গেলেন সেপিয়া টোনে মাখা অদ্ভুত এক ধূসর জগতে। যেখানে স্পটলাইট নেই, মেকআপ নেই, স্টারডমের ঝলমল নেই। আছে শুধু অন্ধকার আর মুখোমুখি বসে থাকা উজ্জ্বল অতীত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...