উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার— হীরালাল সেনের সন্ধানে

উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার— হীরালাল সেনের সন্ধানে -- মঈনুদ্দিন খালেদ

মঈনুদ্দিন খালেদ

 

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ ফিল্ম বুলেটিন 'চলচ্চিত্রপত্র'-এর দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল একটি লেখা। ১১৩ সেগুনবাগিচা ঢাকা থেকে প্রকাশিত এই বুলেটিনের প্রকাশের তারিখ ১৯৮৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। এই লেখায় আমরা এক যাত্রার অনুপুঙ্খ বিবরণ পাচ্ছি যেখানে বর্ষার এক মেঘাচ্ছন্ন সকালে বাংলাদেশের তিনজন চলচ্চিত্রপ্রেমী তরুণ রওনা দিয়েছিলেন মানিকগঞ্জ জেলার বগজুড়ি গ্রামের উদ্দেশ্যে। এই তিনজনের মধ্যে প্রবন্ধটির লেখক মইনুদ্দিন খালেদ ও চলচ্চিত্রপত্র-এর সহসম্পাদক মুহম্মদ খসরুও ছিলেন। তাঁদের মনে ছিল ইতিহাসকে আরও একটু কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখার অদম্য আগ্রহ, পকেটে ছিল অবিভক্ত ভারত ও বাংলায় চলচ্চিত্রের পথপ্রদর্শক হীরালাল সেন-এর আদি বাড়ির ঠিকানা। তাঁরা কি খুঁজে পেলেন যা তাঁরা খুঁজছিলেন? চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এই সংখ্যার স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে রইল সেই জরুরি ইতিহাসযাত্রার উজ্জ্বল উদ্ধার। 'চলচ্চিত্রপত্র' এপার বাংলায় দুষ্প্রাপ্য এবং অপঠিত বললেই চলে। নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা 'চলচ্চিত্রপত্র'-এর সৌজন্য সংখ্যা থেকে লেখাটি পুনঃপ্রকাশের বন্দোবস্ত করে দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধলেন 'অযান্ত্রিক' পত্রিকার সম্পাদক আলেকজান্ডার বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।

কাগজে লিখে নিয়েছিলাম তাঁর পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে কিছু তথ্য। পিতা চন্দ্রমোহন সেন- কলকাতা হাইকোর্টের আইন ব্যবসায়ী। জন্ম, বগজুড়ি গ্রাম, মানিকগঞ্জ -মুন্সিবংশ। পিতামহের নাম গোকুলকৃষ্ণ; প্রপিতামহ- বাঞ্ছারাম। এছাড়াও তামাটে কাগজে মুদ্রিত ছিল আরো কিছু তথ্য।

এই তথ্য সংগে করে শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর ভোরে যাত্রা শুরু। সকাল দশটার দিকে মাণিকগঞ্জ নেমে অস্বস্তি ও দ্বিধায় পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি; বগজুরি কোনদিকে – কতদূর ? যাত্রা শুরুর আগেমাণিকগঞ্জের মানচিত্র দেখে আসিনি, পথ ঘাটের নিশানাও জেনে আসা হয়নি। অর্বাচীন বালকের মতই এই অভিযাত্রা। এদিকে বাস থেকে নামার সংগে সংগে সামনের চাকা উঁচিয়ে রিক্সাঅলাদের আহ্বান, এদিকে, কইযাবেন? মগজে হিসেবে চলতে থাকে আমাদের; জমিদার বাড়ির মানুষ, প্রশাসনিক যন্ত্রের সংগে অবিচ্ছেদ্য, সুতরাং শহর মাণিকগঞ্জের সংগে সম্পর্কিত থাকতে হয়েছিল, তাই বগজুড়িশহরের খুব কাছেই হবে হয়তো। এই হিসেবে থেকে সামনের রিক্সাঅলাদের দিকে আলটপকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া, বগজুড়ি যাবে নাকি? সংগে সংগে শুভ যোগ। বগজুড়ি তেমন দূর নয়। তিন চাকা আর দুপায়ে দাঁড়ানো রিক্সাঅলারা সবাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ।

শহরের পাকা পথ ছেড়ে এক শক্ত ঝাঁকুনি দিয়ে গ্রাম বাঙলার মাটি স্পর্শ করে আমাদের রিক্সা। অনুসন্ধান স্পৃহা চাগা দিয়ে ওঠে, মুন্সী বাড়ী চেন? জমিদার ছিল তারা।

‘হ চিনি। তারা তো হিন্দু মুন্সী।’ রিক্সাঅলার অজ্ঞতায় তিরিক্ষি মেজাজের মুহম্মদ খসরুর মুখেও হাসি ফোটে:

‘তারা কেউ আছে নাকি এখানে?’

‘কেউ নাই অহন। অহন তো অইটা এতিমখানা বানাইছে।’

‘আত্মীয়-স্বজন, বংশের কেউ?’

‘খোঁজ কইরা দেখতে পারেন। রিক্সা লইয়া আর যাওন যাইবো না। অহন নামেন।’

তারপর শুরু পদব্রজে পায়ে চলা পথে। অভিযানের কারণ জেনে রিক্সাঅলার আগ্রহ জন্মেছে, সেই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। খাল পার ধরে ঝোপ ঝাড়ের নীচ দিয়ে পথ গিয়েছে এঁকে বেঁকে।ডানে বাঁয়েবার কয়েক মোড় নিয়ে আধঘন্টার চড়াই উৎরাই পথ হেঁটে রিক্সাঅলা থৈ থৈ জলের পাশে এসে দাঁড়ায়।

‘এইহানে আদত বাড়ী আছিল।’-

ছিল, মানে এখন নেই! রিক্সাঅলার কথা শুনে আগ্রহের বেলুন আচমকা চুপসে যায়। এখন আমাদের সামনে ভরা বর্ষার কুল ছাপানো গাঙ। যে পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিলাম তা-ও জলমগ্ন ।গাঙের পাড়ে মাঠ মত ব্যাপ্ত একখণ্ড জমি। ঘরবাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। ধ্বংসাবশেষ পর্যন্ত না। গাঙের জলে একটি জীর্ণ মঠের সামান্য ছায়া পড়েছে। শ্যাওলাজড়ানো একটি বিচূর্ণ মঠ শুধু “আপনার মনে রচিতেছে আশ।”

তবে যে বললো বাড়িটাকে এতিমখানাবানানো হয়েছে। ‘হ, ওনাগো আরেকটা বাড়ি আছে, খুব কাছেই।’ এই সংবাদ শুনে আশালতা আবার সজীব হয়ে ওঠে| জলমগ্ন পথ ছেড়ে অন্য পথে হেঁটে কিছুক্ষণ পরেই এসে পৌঁছলাম এক জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণে। আসতে আসতে রিক্সাঅলার সঙ্গে কথা চলছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। প্রসংগত জানালো এ বাড়িতেও নাকি ঢাকায় ছবির শুটিং হয়। সর্বনাশ! এদেশের মানুষের রুচি ধংসাত্বক ছবির পরিচালকেরা (?) ‘ ঘোড়া নিয়ে ‘ শেষ পর্যন্ত এখানেও পৌঁছে গেছে। এতবড় ধৃষ্টতা! যেখানে নাকি উপমহাদেশের প্রথম চলচিত্রকার আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ঢাকা থেকে লোক এসেছে শুনে জমিদার বাড়ি থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। পরিচয় হলো, তিনি বর্তমানে এতিমখানার দায়িত্বে আছেন। মানিকগঞ্জের লোক নন, বাড়ি উত্তরবঙ্গে। এরকম একটা বিষয়ের জন্য আমরা যে একরোখা সন্ধানী হয়ে উঠেছি তা শুনে পুলক ও বিস্ময় অনুভব করেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তথ্য দিয়ে তিনি কোন রকম সাহায্য করতে পারলেন না। বললেনঃ ‘সুরফতি মাস্টারের সংগে আলাপ করে দেখতে পারেন । উনি এই এলাকার অনেক খবরাখবর রাখেন। আমি সংগে লোক দিচ্ছি আপনাদেরকে পথ চিনিয়ে দেবে।আর সুরফতি মাস্টারের কাছে যদি না পান কিছু তবে সতু বাবুর সংগেও আলাপ করতে পারেন। শুনেছি উনাদের সংগে মুন্সী বাড়ির আত্মীয়তা ছিল।’

খালের ওপর দীর্ঘ কাঠের পুল। পুল পেরিয়ে খালের পাড়েই সুরফতী মাস্টারের বাড়ি। রিক্সাঅলাকে বিদায় দিয়েছি। সংগে আছে এতিমখানার এক কিশোর। বারান্দায় পা মেলে দিয়ে দরজার চৌকাঠে বসে দড়ি পাকাচ্ছিলেন সুরফতী মাস্টার। সালাম বিনিময়ের পর ঢাকা থেকে আসছি এই সংবাদ জানিয়ে সেই মুদ্রিত তামাটে কাগজটা তার সামনে মেলে দেই। সুরফতী মাস্টার পুরু লেন্সের চশমা চোখে নিবিষ্ট হয়ে পড়তে থাকেন, “এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেনের জন্ম তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার বগজুড়ি গ্রামে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর ফটোগ্রাফীর প্রতি অসীম আগ্রহ এবং আগ্রহ থেকে অধ্যবসায়। ইউরোপে চলচ্চিত্র আবিষ্কারের সংবাদে তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ১৯১৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানীর মাধ্যমে ভারত তথা এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। অতঃপর ১৯০১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী তাঁর চলচ্চিত্রায়িত আলিবাবা নাটকের মর্জিনা আবদাল্লার নৃত্য দৃশ্যের চলচ্চিত্র রূপ প্রদর্শন করে ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯০১-১২ সালের মধ্যে তিনি ১২টি কাহিনী, ৩০টি সংবাদ চিত্র এবং ৩টি প্রচার চিত্র নির্মাণ করেন, যেগুলোর দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ২৫০ ফিট পর্যন্ত ছিল”।

পড়া শেষে চোখ দুটি জ্বল জ্বল করে ওঠে সুরফতী মাস্টারের। বিস্ময়ের সংগে বলে ওঠেন, কন দেহি কান্ড, এমন একটা মানুষের বাড়ি আমাদের গ্রামে আর আমরা খোঁজ রাখি না! দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। যেন দেশের তাবৎ শিক্ষিত লোকের অজ্ঞানতার দুঃখ নিজের মধ্যে অনুভব করেন। সব ছাপিয়ে আমরা লক্ষ্যের অভিসারী হয়ে প্রশ্ন করি:

‘আপনি কি কখনো দেখেছেন তাঁকে’?

‘না, আমার তখন জন্মও হয়নি’। সুরফতী মাস্টারের মুখে কষ্টের হাসি ফুটে ওঠে। তবে জানালেন যে তাদের আদত বাড়িটা জন্মের পর থেকেই দেখে আসছিলেন পরিত্যক্ত। পরে একদিন প্রচন্ড ঝড় ওঠে, তখন বাড়িটা ধসে পড়ে পাশের গাঙে। ক্রমে কালস্রোতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সব। এখন শুধু একটা মঠ আছে। মঠটা গোকুল কৃষ্ণের। তিনি পরামর্শ দিলেন তার চেয়ে বয়স্ক লোকের সংগে যোগাযোগ করতে। বগজুড়ি’র পাশেই মালঞ্চ গ্রামে আবদুল হাকিম সাহেব আছেন তিনি নাকি কি সূত্রে মুন্সী বাড়ির সংগে সম্পর্কিত ছিলেন। এছাড়া ধারে কাছেই এক শাখারী পাড়া আছে, সেখানে গিয়ে রাধারমণের দুই ছেলে দেবেন্দ্র সূর ও বীরেন্দ্র সূর – ওদেরও স্মরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। ভ্রাতৃদ্বয় নয়, ওদের বাবা রাধারমণ মুন্সী বাড়ির নায়েব ছিলেন। হয়ত বাবার কাছ থেকে ওরা কিছু শুনে থাকবে। এর আগের এতিমখানার সেই ভদ্রলোক কথিত সতু বাবুর নাম তুলতেই সুরফতী মাস্টার অনীহার সঙ্গে উচ্চকিত হয়ে উঠলেন, না, না, উনি এসবের খোঁজ রাখেন না। অবশ্য উনাদের সঙ্গে মুন্সী বাড়ির আত্মীয়তা ছিল। কিন্তু সতু বাবুর পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়।

সন্ধানে বেরুলে কোন সূত্র থেকে কোন গ্রন্থি উন্মোচিত হয়ে পড়ে নিশ্চিত বলা যায় না। এই বোধ নিয়ে সেই কিশোর পথ প্রদর্শককে সঙ্গে নিয়ে সতুবাবুর বাড়িতে হাজির হলাম। পুরোনো দোতলা বাড়ি। বাড়ির থামগুলো বেশ চৌকষ, প্রাচারীরীতির কারুকাজ মন্ডিত। সুনসান নিস্তব্ধ। ভেতর থেকে দরজা জানালা সব আটকানো। আমাদের প্রাচীন বাড়ি দেখার মগ্নতার ঘোরে গুটি গুটি হেঁটে সেই কিশোর কখন যে বাড়ির ভিতর চলে গিয়েছিল খেয়াল করিনি। হঠাৎ বাড়ির মাঝখানের দরজাটি খুলে যায়, কিশোর ডাকে -‘আসেন’। বৃত্তাকার এক বিশাল টেবিলের পাশে চেয়ার দেখিয়ে বললো -‘বসেন, উনি আসছেন’। দেখলাম বাড়ির বাইরের জেল্লার সঙ্গে ভেতরের শান শওকতেরও সামঞ্জস্য রয়েছে। প্রাচীন আমলের অজস্র তৈজসপত্র একদিকে সাজানো, ছাদের মাঝখান ধরে ঝুলছে একটি ঝালর বাতি। একদিকে বিরাট একটি নাকাড়া পড়ে আছে। ঘরের দেয়ালগিরিতে কালীমুর্তি। এরকম একটি এন্টিক শোভিত ঘরে বসে যখন পুরাতত্বের আঘ্রান নিচ্ছি তখন ধপ ধপ শব্দ আসে কানে। বুঝতে অসুবিধা হয় না ঘরটার দেয়ালের পাশেই কেউ কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। সিঁড়িটার শেষাংশ ভেতরের ঘরের দরজার সাথে লাগোয়া। যেখানে বসে আছি সেখান থেকে দেখা যায়। নেমে এলেন সুঠামদেহী এক দীর্ঘকৃতি পুরুষ। তিনি আমাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চকিতে মনের মধ্যে একটা শব্দ খেলে গেল – কালিসাধক সিংহ পুরুষ। খসরু ভাইয়ের দিকে হাত প্রসারিত করে সিংহ পুরুষ আত্মপরিচয় দেন, আমি সত্যেন্দ্রনাথ চৌধুরী।

তারপর প্রাথমিক কথা বার্তা শেষে মূল প্রসংগে আসতেই স্পষ্ট হয়ে গেল সুরফতী মাস্টারের অনীহার কারণ। মুদ্রিত কাগজটা পড়ে তিনি মধুর হেসে বললেন, না, আমি এসবের মধ্যে নাই। চা এসে গিয়েছিল, বললেন, চা খান। চায়ে চুমুক দিয়ে কোনোরকম সঙ্কোচ না রেখেই জানালেন নিজের সৌখিন জীবনযাপনের কথা। বর্তমানে তার দুটি বিদেশী ঘোড়া আছে। একটি পাঞ্জাবী, মাদ্রাজী একটি। পৃথিবীর এর চেয়েও বিখ্যাত অঞ্চলের ঘোড়া ছিল আগে। ঠিকমতো যত্নআত্তি করতে পারেননি বলে বছরখানেক হল একটি ঘোড়া মারা গিয়েছে। এছাড়া এলশেসিয়ান ও অন্যান্য প্রজাতির কুকুরও পোষেন। একসময় ঘোড়ার রেস খেলেছেন। ঘোড় সওয়ার বেড়িয়েছেন দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়। আলাপী লোক, বসলে হয়তো চমৎকৃত করার মতো অনেক ঘটনাই শোনাতেন। কিন্তু এদিকে বেলা দেখা যায় না, ঘনকৃষ্ণ মেঘ বর্ষার আকাশে। যে কোন সময় বৃষ্টি হতে পারে। তাই সত্যেন্দ্রনাথ চৌধুরীর নকশাদার পানদান থেকে বিবিধ মশলা মেশানো এক খিলি পান মুখে পুরে খসরু ভাই বললেন, নমস্কার।

সুরফুতী মাস্টারের কথা মতো এখনো দুটি জায়গায় ঢু মারা চলে। এখান থেকে দুমাইল দূর আবদুল হামিদ সাহেবের বাড়ি। তার আগে বরং মাইল খানেক দূরে সুরভী গ্রামের শাখারী পাড়ার রাধারমণের পুত্রদ্বয়ের বাড়ি পৌঁছে দেখা যাক।

টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। পথ চলছি। মনের ব্যারোমিটারের পারদ আশা নিরাশার দ্বন্দ্বে ওঠানামা করছে৷ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি হয়তো এই আবিষ্কৃত হয়ে যাচ্ছে এমন কোনো তথ্য যা এই উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের কৃতিত্ব বুঝতে অনেক সহায়ক হবে। শ্যামল বাঙলার প্রকৃতি বর্ষার আঁধারে ক্রমশঃ কালচে হয়ে উঠেছে। এমন সময় পথের পাশে এক ঝুপরিমতো গাছের আড়াল থেকে মহিলা কন্ঠ শোনা গেল, কই কিছু পান নাই? আশ্চর্য এক মহিলাও আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছে! শাখারী পাড়ায় যাচ্ছি শুনে ঘোমটার আড়াল থেকেই অন্বিষ্ট বাড়ির নিশানা দেখিয়ে দিলেন। সাঁকো পেরিয়ে বর্ষা পিচ্ছিল খালের পথ ধরেই ঢুকে গেলাম কাঙ্ক্ষিত বাড়ির উঠোনে। পরিপাটি চুল আচড়ানো এক কিশোর এসে জানালো, তারই বাবা বীরেন্দ্র সূর। খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর বীরেন্দ্র সূর নিজেই ছুটে এলেন। সব শুনে শেষে বললেন, দাদা (দেবেন্দ্র সূর) বাড়িতে নাই, উনি হয়তো বাবার কাছ থেকে কিছু শুনে থাকবেন। এই বিষয়ে বাবা কখনো কোনো আলাপ করেছেন কি না আমার ঠিক স্মরণে আসছে না।

অতএব এখন একটাই শেষ ভরসা – মালঞ্চ গ্রামের আব্দুল হামিদ সাহেব। তিনি এই এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন লোক, তাছাড়া মুন্সী বাড়ির সঙ্গে যেহেতু তার যোগাযোগ ছিল, তাই কোনো হদিস মিলেও যেতে পারে৷ এই হিসেব কষে অনেক আশায় বুক বেঁধে যাত্রা শুরু হলো মালঞ্চ গ্রামের দিকে। যে পথে রিক্সা অলা এসে দাঁড় করিয়েছিল এক ভাঙা মাঠের পাশে, সেই পথে। মঠ দেখে তথ্য সংগ্রহের স্পৃহায় দুর্গম পথের অভিযাত্রিকের মতই রোমাঞ্চ অনুভব করি মনের মধ্যে। প্রায় কোমর অব্দি পানি ভেঙ্গে আমি আর বন্ধুবর মামুন সেই মঠের ভেতর গিয়ে উঠি। ভেতরে গিয়ে দেখি বট-পাকুড়ের শিকড়ের চতুর্মাত্রিক আক্রমণে স্মৃতি-ফলকটি পর্যন্ত দীর্ণ – বিদীর্ণ, শেষাংশ শুধু পড়া যায় ‘…..এই শিব মন্দির প্রস্তুত করালেন’। ইতি। ১২৯৭ সন।

গাছ-গাছালির ঘেরাটোপে বাঁশ ঝাড়ের নীচে যে এমন একটা কুঁড়ে ঘর রয়েছে বাইরে থেকে একদম বোঝা যায়নি। আবার তাতে যে এক বৃদ্ধ জীবনের শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করে যাচ্ছেন – এই দৃশ্য ঠিক স্বচক্ষে না দেখে কারো মুখে শুনলে মনে হতো গল্পের খাতিরে বানানো। এবার বাস্তবে এরকম দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হলো। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে৷ কয়েকটি আলোক রশ্মি গাছগাছালির পাতা ভেদ করে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকেছে সেই কুঁড়ের ভেতরে। আমরা তিনজন বিস্ময় নির্বাক দাঁড়িয়ে আছি সেই কুঁড়ের কাছে। দরজাটা খোলা। দরজার ওপর রাখা আছে বার্ধক্যের সঙ্গী লাঠিটি। আলো অন্ধকারে যেন এক মায়াজালের তন্দ্রায় ডুবে আছেন এই এলাকার প্রাচীনতম মানুষটি। তন্দ্রা ভেঙ্গে জাগাতে পারলেই হয়তো জানা যাবে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক সম্পর্কে কোনো অবাক করা ঘটনা বা আশ্চর্যজনক কোনো তথ্য। ইতিমধ্যে কোত্থেকে এক বালক এসে ডাকতে শুরু করে, “ও দাদু, দাদু, ওঠেন লোক আসছে। বৃদ্ধ তড়িঘড়ি উঠে বসেন। বিস্মিত হন, এমন সময় তাঁকে জাগানোর তো কথা ছিল না। সালাম বিনিময়ের পর কোনো রকম রহস্যের অবকাশ না দিয়ে সেই মুদ্রিত কাগজটা পড়ে শোনাই। তারপর প্রশ্ন, “শুনলাম মুন্সীবাড়ির হীরালাল সেনদের সঙ্গে আপনার উঠা-বসা ছিল।”

উত্তরে বললেন, হীরালাল বাবু, মতিলাল বাবু, দুজনকেই দেখেছেন তিনি। সেটা অবশ্য তার খুব ছোট বেলাকার কথা। যৌবনে ফিল্মও দেখেছেন। কিন্তু হীরালাল সেনের সঙ্গে ফিল্মের কোনো যোগাযোগ ছিল সে বিষয়ে কোনো কিছুই মনে করতে পারছেন না। স্মৃতি কি তবে সত্যই এত প্রতারক! ঘরের মেঝেতে বসে আছি আমরা তিনজন বিপন্ন, বিমূঢ়। বৃদ্ধ চোখের দৃষ্টি সরু করে অবচেতনে ডুবে যান। পরক্ষণেই দূর থেকে কী এক ইশারা পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলেন হঠাৎ। “ও হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়ছে, আমি দেখিনাই, শুনেছি হীরালাল বাবু বিলাত থেইকা কী এক যন্ত্র আনছিলেন। বগজুড়ির সব মানুষরে বায়োস্কোপ দেখাইছিলেন।” আগ্রহের আতিশয্যে অনেক কথা বলে শেষে মত্ত গ্রামের জনৈক প্রবোধ বাবুর সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ দিলেন। প্রবোধ বাবু বয়সে তাঁর চেয়েও প্রবীণ। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুপ্রতীম সম্পর্ক আছে। এখন বিশেষ বাইরে যাওয়া হয় না বলে, অনেক দিন বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ নেই। আমরা তাঁকে যতটা চলংশক্তিহীন মনে করেছিলাম বস্তুত তিনি তা নন। আমাদের অবাক করে দিয়ে একটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে লাঠি হাতে নিয়ে বললেন, চলেন, আমিও যাবো। অনেক পীড়াপীড়িতেও তাঁকে পুরোপুরি নিরস্ত করা সম্ভব হলো না। খালের পাড় পর্যন্ত এসে প্রবোধ বাবুর বাড়ি যাওয়ার জন্য নৌকা ঠিক করে দিয়ে আমাদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন।

চারপাশের নিসর্গ জলমগ্ন। নৌকা ভেসে চলছে প্রশস্ত খালের ওপর দিয়ে। পানা-শ্যাওলার দামে জড়িয়ে গেলে লগি মেরে, কখনো স্বচ্ছ জলের অনুকূল স্রোতে ভেসে আধঘন্টার মধ্যেই একটি উঁচু মাটির সড়কের কাছে এসে নৌকা ভেড়ে।

ঝোপঝাড় জঙ্গলের নিবিড় এক নিস্তব্ধ বাড়ি। বাড়ির সামনে স্যাঁতস্যাঁতে এক টুকরো উঠোন। উঠোন পেরিয়ে গভীর জঙ্গল। ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দায় পুরনো জীর্ণ চেয়ার ফেলে বসে আছে বৃদ্ধ, সামনের জঙ্গলে নিবদ্ধ তাঁর দৃষ্টি। চোখদুটি কোটরাগত, হাড় জিরজিরে শরীর, লোলচর্ম সার। সহজেই নিশ্চিত হয়ে পড়ি – ইনি-ই তিনি।

মালঞ্চ গ্রামের হামিদ সাহেবের কথা তুলতেই বন্ধু সান্নিধ্যের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে প্রবীণ প্রবোধবাবুর মুখ। মুন্সিবাড়ির কথা উঠতেই সেনদের সঙ্গে লতায়-পাতায় জড়ানো তাদের নানা সম্পর্কের কথা বলতে থাকেন মৃদুস্বরে। হীরালালদের এক জ্ঞাতিভাই শ্রীমোহন সেনের সঙ্গে তাঁর পিসি, কালির বিয়ে হয়েছিল। সুবিখ্যাত ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক দীনেশচন্দ্র সেনও তাঁদের নিকটাত্মীয়। তিনি বগজুড়িতে বসেই অনেক সাহিত্যচর্চা করেছেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক শেষে সিনেমার কথা ওঠে। দুর্বল কন্ঠে স্মৃতির টুকরো টুকরো কথা জোড়া লাগিয়ে নির্বাক যুগে ফিল্ম দেখার নানা ঘটনা বলেন, ‘আমি তখন পগস স্কুলের ছাত্র। ঢাকায় লালবাগ কেল্লার কাছে থাকি। আমার এক দূর সম্পর্কের ভাই ঢাকা জেলখানায় চাকরী করতেন। তার সঙ্গেই প্রথম ফিল্ম দেখি। তখন তো টকি ছিল না। অনেক আগের কথা। ১৯১৩-১৪ হবে। তখন কয়েদীদের ফিল্ম দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। স্ট্রং উম্যান নামে একটা ছবি দেখেছিলাম। এখন বিশেষ কিছু মনে নাই। তখন একবার বাড়ি এসে শুনি বগজুড়িতেও নাকি হীরালাল সেন বায়োস্কোপ দেখিয়েছেন। আমি আগেই ছবি দেখেছিলাম, তাই ততটা আশ্চর্য হই নাই। কিন্তু এখানে যারা সেই চলমান ছবি দেখেছিলেন তাদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। যেখানেই যাই শুনি, সেই আশ্চর্য বিষয়ের কথা সবাই বলাবলি করছে।’

আকাঙ্ক্ষা সংকুচিত করে এতটুকু করে ফেলেছি। সবশেষ আশা – হীরালাল সেনের ছবি স্বচক্ষে দেখেছেন এমন একজনের দুর্লভ বর্ণনা শুনে যেতে পারবো। শিল্পের দেবীর কাছে মনে মনে প্রর্থনা করি, ‘একটু প্রসন্ন হও দেবী’। এই গণ্ডগ্রামে সারাদিন পথ হেঁটে দুটো শুকনো মুড়ি চিবিয়ে আমরা যখন ক্লান্ত, আশাভঙ্গের বেদনায় বিপন্ন, তখনই ঘটে যায় সারাদিনের নাটকের সবচেয়ে বড় ঘটনা-সংঘাত। দরজার দুই পাল্লা অকস্মাৎ উন্মোচিত করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বেরিয়ে আসেন আরেক বৃদ্ধ, ‘আপনাদের সব কথা আমি ভেতরে বসে শুনেছি। সেদিন আমিও হীরালালবাবুর বায়োস্কোপ দেখেছিলাম’। এতদিনের পুরোনো স্মৃতি জীবনের গোধূলিবেলায় এসে কারো প্রয়োজনে আসতে পারে, এই ভেবে বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে পড়েন। তারপর মগ্ন হয়ে যান দূর অতীতের স্মৃতিচারণায়। প্রবোধবাবুর ছোটভাই জনৈক অজ্ঞাত শিশিরকুমার বাংলাদেশের এক অখ্যাত গ্রামে বর্ষার বিকেলে বাড়ির আঙিনায় বসে উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকারের ছবি দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন ভাবতেই আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তের বেগ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে। শিশিরবাবুর কন্ঠ আনন্দে উচ্ছ্বলিত হয়ে যায় :

“বগজুড়ি গ্রামে সেদিন সকাল থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক আসছে। কারণ মুন্সিবাড়িতে আশ্চর্য ঘটনা ঘটবে আজসন্ধ্যায়। বাস্তবে যেমন দেখা যায় তেমনি নাকি ছবিতেও মানুষ জীবজন্তু সব ছুটে চলবে। আমার মনে পড়ে,মায়ের আঁচল ধরে আমি সেদিন সন্ধ্যায় বিশাল উঠানে অনেকের ভীড়ে মায়ের পাশে বসে আছি। মনের ভেতর তোলপাড় তুছে একটি প্রশ্ন, ছবি কি করে চলে ? এরি মধ্যে কে যেন গলা উঁচিয়ে বলল, ওদিকে তাকা, ওদিকে তাকা। কোনদিক থেকে ছবি এসে কোনদিকে দৌড় দেবে। বালক বয়সে তখন অনেক ভেবেছি। সেই গলা শুনে চোখ তুলতেই দেখি, অদূরে সাদা পর্দার ওপর ওভাল শেপ জায়গা আলোকোজ্জ্বল হয়ে আছে। তারপর অসম্ভবের পায়ে আঘাত করে সত্যিই ছবি চলতে থাকে। কি দেখেছিলাম সেদিন পুরোপুরি মনে নেই। আর ছবি যে চলছে এই বিস্ময়-আনন্দের ঘোর কাটতেই অনেক সময় চলে গিয়েছিল। একবার দেখি হুইপের আঘাত দিয়ে একটা লোক ভেড়া চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর দেখি অনেকগুলো কলসী নিয়ে একটা গরুর গাড়ি যাচ্ছে। ভুঁড়িওয়ালা একটা লোক এসে এমন সময় গাড়িটা থামালো এবং সংগে সংগে শুয়ে পড়লো গাড়ির নীচে। একটি কলসী ফুটো করে দিল গাড়ির চালক। লোকটা শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ তা’ খেলো।”এটুকু বলে শিশিরবাবু একটু থামেন। সেই কলসীতে আখ-খেজুরের রস ছিল বোধহয় – এই ধারণা থেকে প্রশ্ন করতেই হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। “আরে না না, মদ, মদ ছিল। একটু পরে গাড়ির তল থেকে উঠে এসে নেশায় ঢুলতে থাকে লোকটা। এমন সময় কোত্থেকে এক লোক এসে তাকে পরিয়ে দেয় চাকাওলা জুতো। লোকটা তখন ছেলে ছোকরার ভেতর দিয়ে দ্রুত চলতে থাকে। মাঝে মাঝে ঢুলে পড়ে। ঢুলে পড়তেই ছেলেরা তাকে ধাক্কা দেয়, চাকাওলা জুতো পরে তরতরিয়ে এগিয়ে যায়।”

স্মৃতির পটে ধূসর আরো ছবির ঘটনার চূর্ণিত অংশ শোনালেন তিনি। ধীরে ধীরে যৌবন বয়সে দেখা অন্য ফিল্মের আলাপ জমে উঠল। প্রবোধবাবু ও শিশিরবাবু দুজনেরই স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে সিনেমার অনেক ঘটনা। অস্ফূট আবেগে বার বার বলছেন, উমাশশীর অভিনয়ের কথা, আ-হা, চন্ডীদাস ছবিতে কানাকেষ্ট যে গানটা গেয়েছিল “ফিরে চল, ফিরে চল, আপন ঘরে।”

আমাদেরও ফেরার পালা। বিদায় নিতে গিয়ে কেমন যেন দুঃখময় এক বোধে কাতর হয়ে পড়ি। পড়ন্ত বিকেলের একটুকরো আলো এসে পড়েছে উঠোনের এক পাশে। বাড়িতে দু’জন বৃদ্ধ। প্রসংগত জানতে পেরেছি, দু’জনাই অকৃতদার, আর আছেন এক বিধবা বোন।

কিন্তু এই নিষ্ফলা বাড়ি থেকেই আমরা উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের একটি অধ্যায়।

(মূল লেখার বানান অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...