“এই মিছিল সবহারার সব পাওয়ার এই মিছিল”

পাঞ্চালী কর

 

এই মিছিল কী বা কেন, সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। ১৪ মে, ২০১৯-এ বিজেপি বিগ-শট্ অমিত শাহের কলকাতায় নির্বাচনী র‍্যালি করতে আসা, এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে কালো পতাকা এবং ‘গো ব্যাক’ পোস্টার দেখানোয় বচসা, হাতাহাতি থেকে বিদ্বেষের আগুন ঘনীভূত হয় এবং তা অচিরেই রাজনৈতিক হিংসার রূপ নেয়। এর ফলস্বরূপ শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যাসাগর কলেজে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাসাগর মূর্তি আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা।

বিজেপি যে একটি বিষাক্ত পদার্থ বিশেষ তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। উগ্র হিন্দুত্ববাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, মুসলমানবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, সংবিধান বিরোধ, সংখ্যালঘুর প্রতি অত্যাচার, বিজ্ঞান বিরোধিতা, কুসংস্কার, ইত্যাদি অর্বাচীন সমস্যার মধ্যে দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছেন, এবং তার সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় বহুজাতিক করপোরেশন। এই হেন বিজেপি সরকার যে রাজনৈতিক বিরোধিতা বা ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু হবে সেটাই কাম্য। তার ওপর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কর্ম নারীর উত্থান, এবং আধুনিক শিক্ষার বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত; বলাই বাহুল্য, তা বিজেপির চক্ষুশূল হওয়াই স্বাভাবিক।

রাজনৈতিক বিভেদের নামে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে ১৫ মে দিনভর রাস্তায় নামল কলকাতা। বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন নিজের নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানাল। আমরা রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষ, শিল্পী, লেখক, ছাত্র-ছাত্রীদের তরফে একত্রিত হয়েছিলাম আমাদের প্রতিবাদ রেজিস্টার করতে, এবং উদ্যোক্তা হিসেবে পাশে পেয়েছিলাম সহমন, বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মঞ্চ, আসাম সংহতি অভিযান, বন্দিমুক্তি কমিটি, ইত্যাদিকে। উদ্যোগের শুরু থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে, তার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এই মিছিলের রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে, অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত বিজেপি বিরোধিতায় সেই সব রাজনৈতিক দল কি পা মেলাতে পারে, যারা খানিক একইরকম দোষে দুষ্ট?

রাজনৈতিক অবস্থানে একটি কথা বহু প্রচলিত: ব্রড ডেমোক্র্যাটিক স্পেস, অর্থাৎ এমন পরিসর যা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে এক ছাদের তলায় নিয়ে আসে। বলাই বাহুল্য নরক সময়ে এমন মানুষ বা মতাদর্শকে জায়গা করে দিতে হয় যা ব্রড বা ডেমোক্র্যাটিক কোনওটাই নয়। এর সুফল নিশ্চয়ই আছে। অনেক মানুষ এক হওয়ায় একটা সংখ্যাগরিষ্ঠতার আভাস পাওয়া যায়। কোনও ইস্যুর প্রতিবাদে যখন বহুসংখ্যক মানুষ এক হন, সেই সংখ্যা বা ভল্যুমের একটা নিজস্ব ইমপ্যাক্ট আছে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। একই সঙ্গে এই ধরনের স্পেসের সীমাবদ্ধতাও প্রচুর। কারণ বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ এক সঙ্গে থাকা মানে সেই মতাদর্শগুলির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার স্পেস বন্ধ হয়ে যায়। ব্রড ডেমোক্র্যাটিক স্পেসের রাজনীতি সমঝোতার, তুমি আমায় প্রশ্ন কোরো না, আমি তোমায় প্রশ্ন করব না। আমাদের কাছে অপশন ছিল সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ঝামেলা খানিক কমানোর, এবং অল্প পরিশ্রমে অনেক মানুষের ভিড় তৈরি করার। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে খানিক বাধল: বাধল ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিলে তৃণমূল কংগ্রেসকে জায়গা করে দিতে।

একই সঙ্গে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষের মিছিলে আর একটা সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে: সিপিআইএম একটি প্রধান বামপন্থী দল হওয়ায়, বামপন্থী মিছিল মাত্রেরই সিপিআইএম-এর মিছিল হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা দেখা দেয়, স্বভাবতই সিপিআইএম-এর অতীত ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে কৃষকের অধিকারের দিকে কর্ণপাত না করা সরকারের প্রতিনিধিরা ভাঙর আন্দোলনের মিছিলে প্রথম সারিতে হাঁটেন। তাপসী মালিকের ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে কুরুচিপূর্ণ লেখা লিখে সিপিআইএমকে তোষণ করা কবি ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের মুখ হয়ে ওঠেন। তাই সিপিএমের কর্মী সমর্থকদের প্রতি ব্যক্তি স্তরে বিশেষ ছুৎমার্গ না থাকলেও, যাতে তাদের সিপিআইএম পরিচয় প্রকট না হয়ে ওঠে এবং সেটা মিছিলের রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রভাবিত না করে, সেটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ ছিল।

এই চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়ে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কিছু সংস্থা, যাঁরা উদ্যোক্তা হিসেবে থাকতে চেয়েছিলেন, তাঁদের না বলতে হয় কারণ তাদের রাজনৈতিক আলাইনমেন্ট সরাসরি তৃণমূল বা সিপিআইএম পন্থী। বেশ কিছু মানুষ তৃণমূলের বিরোধিতা করতে রাজি হন না, কারণ তাঁরা বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে তৃণমূলকেই হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। এহেন বাকবিতণ্ডার, বাধাবিপত্তির মধ্যে মিছিলটা প্রোঅ্যাক্টিভলি অর্গানাইজ করার গুরুদায়িত্বটা আমরা মুষ্টিমেয় কিছু বন্ধুবান্ধব নিজেদের হাতে তুলে নিই। সংশয় ছিল, মানুষ আসবে তো! করে উঠতে পারব তো! কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম আমরা যে রাজনৈতিক মতাদর্শে কম্প্রোমাইজ করব না।

মিছিল শুরু হয় কলেজ স্কোয়ার থেকে এবং শেষ হয় হেদুয়া ছাড়িয়ে, কলকাতা বিজেপির কার্যত হেডকোয়ার্টার কেশব ভবনের সামনে, এবং আমাদের ভরসায় ইন্ধন জুগিয়ে হাজারো মানুষ তাতে পা মেলান, উঁচু গলায় স্লোগান দেন, পোস্টার নিয়ে হাঁটেন। আর্টিস্ট ইউনাইট কলকাতার তরফে একটি ৭৫ ফুট লম্বা ব্যানার আনা হয়, “Save Our Constitution” লেখা। আমাদের মিছিলের পাশ দিয়ে যখন তৃণমূলের বাইক বাহিনী আস্ফালন করতে করতে যাচ্ছিল, আমরা তখন আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে জোর গলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধেও স্লোগান দিয়েছি। আমাদের মিছিলে বহু হিন্দিভাষী মানুষ পা মেলান। তাঁরা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বাংলায় স্লোগান দেন। এঁদের মধ্যে একজন একেবারেই বাংলা বোঝেন না, বার বার আমায় জিগ্যেস করছিলেন এটা কী ওটা কী। বাংলা না বুঝুন, উনি এটা বোঝেন যে বিজেপি ওনারও শত্রু। হিন্দিভাষী মানেই বিজেপি-র মত প্রচলিত ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিল এই মিছিল। মিছিল শেষে কেশব ভবনের সামনে আমরা স্লোগান দিচ্ছি, বিজেপির প্রতি নিজেদের সমস্ত ঘৃণা উজাড় করে, তখন নেমে আসে পুলিশি আক্রমণ। লাঠিচার্জ হয় প্রতিবাদীদের ওপর। আমাদের সাতজন কমরেড আহত হন, এবং তাদের মধ্যে আমি নিজেও একজন। বলাই বাহুল্য সেখানে কোন মহিলা পুলিশ ছিল না। আমাদের বন্ধুরা আমাদের নিয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজের দিকে রওনা হন তৎক্ষণাৎ, এবং মেডিক্যাল রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তদন্তের দাবি জানিয়ে পুলিশ কমিশনারকে ইমেইল পাঠাই।

এই মিছিলের কোনও রেজিমেন্টেড স্ট্রাকচার ছিল না। কোনও সিনিয়র মানুষ পদে পদে ইন্সট্রাকশন দেওয়ার জন্য ছিলেন না, এবং এই না থাকাটা ইচ্ছাকৃত এবং ভীষণরকম রাজনৈতিক একটা চয়েস। এর ফলে কিছু কম্যুনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়। কেউ ইন্সট্রাকশন দেওয়ার না থাকলে সবার ওপরেই দায়িত্ব খানিক বেড়ে যায় কাজটা সুষ্ঠুভাবে করার। কিন্তু যেহেতু এই ধরনের রাজনৈতিক মডেলে মানুষ বিশেষ অভিজ্ঞ নন তাই নিজেদের দায়িত্ব অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেননি। তাই মিছিলে আসা মানুষদের নোটিফাই না করে একদল মানুষ মিছিল শুরু করে দেন। আমাদের সৌভাগ্য যে মিছিলে পিছিয়ে পড়া মানুষেরা বাকবিতণ্ডা না করে পা চালিয়ে এগিয়ে যান এবং এগিয়ে যাওয়া মানুষেরা অপেক্ষা করেন। আবার মিছিলের শেষে মিছিলের এক ভাগ কেশব ভবনের দিকে এগোলে, মাঝের ভাগ সেদিকে যেতে চান না, এবং হেদুয়ার সামনে মিছিল শেষ বলে ঘোষণা করে দেন, তাতে পিছনের ভাগের অনেক মানুষ যাঁরা কেশব ভবনে যেতে আগ্রহী ছিলেন তাঁরা বিভ্রান্ত হন। এই মিছিল সব লিমিটেশন সত্ত্বেও ম্যাচিওরিটির পরিচয় রেখেছে বেশিরভাগ মানুষ একে অপরের দিকে ভুল ত্রুটির জন্য আঙুল না তুলে, এবং বিগার কজ-টাকে প্রাধান্য দিয়ে। মিছিলের অ্যাক্টিভ কোঅর্ডিনেটর হিসেবে এই কম্যুনিকেশন গ্যাপের দায় আমাদের কারণ মানুষের মধ্যে এই কার্যপদ্ধতি নতুন জেনেও আমরা তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করি, এবং ভবিষ্যতেও এই মডেলেই কাজ করবার চেষ্টা করব, বার বার ভুল হবে তবুও করব, যতদিন না মানুষ মিছিলে একজন অভিভাবক থাকবে এই ন্যারেটিভের ওপর ডিপেন্ড করা বন্ধ করছেন। আবারও হয়ত ভুল হবে, আবারও দায় নেব; দায় নেব কারণ আমাদের প্রজেক্টেড আনকমন মডেলের বোঝাপড়ায় ঘাটতির দায় যাঁরা এই ব্যবস্থায় ওয়াকিবহাল নয় তাদের ওপর চাপলে আমরাও ব্রড ডেমোক্র্যাটিক স্পেসের অংশীদার হওয়ার যোগ্যতা হারাব।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. হিন্দীভাষী মানেই বিজেপি নয় ,এটা এই অন্ধ সময়ে খুব বড় কথা।

Leave a Reply to prativa sarker Cancel reply