গোবলয়ে গোসমস্যা

সন্দীপ পাণ্ড্যে এবং কুশাগ্র কুমার

 

লেখকদ্বয় রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মী। মূল ইংরাজি থেকে লেখাটি তর্জমা করেছেন সত্যব্রত ঘোষ

নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসবার পর ভারতে নতুন একটি ব্যাপার শুরু হয়— গোরক্ষায় অত্যধিক নজরদারি। বেশ কিছু গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। যেগুলিতে আক্রান্তরা প্রাণ হারান, তাঁরা অধিকাংশই মুসলমান। দলিতেরাও পিটুনির শিকার হন। অথচ আক্রমণকারীদের তেমন কোনও শাস্তি হয়নি। সত্যিটা হল, পিটুনিতে কেউ মারা গেলে, তাঁর অথবা তাঁর আত্মীয়দের বিরুদ্ধে পুলিশে প্রথম অভিযোগ দায়ের করাটা ভারতীয় জনতা পার্টির আমলে সাধারণ এক দস্তুর হয়ে গেছে।

গোরক্ষায় এই সজাগ নজরদারির দরুন গরু বেচাকেনাই বন্ধ হয় এক সময়ে। একটি বয়স্ক গরুকে বা বলদকে অথবা এঁড়ে বাছুরকে যখন কৃষক আর খাওয়াতে পারেন না, তখন সেই পশুটিকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হত। ছাড়া পেয়ে এই পশুগুলি গ্রামে গ্রামে উৎপাত শুরু করে। মাঠে চরে ফসল সাফ করে দেয়। আগে নীলগাই অথবা হরিণরা এমন উপদ্রব করত। নীলগাইরা মানুষ দেখলে পালায়। কিন্তু এতদিনের পোষা, এখন বিতারিত এই গরুগুলি তাড়া খেয়েও হঠে না। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকারের আমলে কৃষকদের দুর্গতির একটি অন্যতম কারণ হয়েছে এই গবাদি পশুগুলি। যে ফসলের জন্যে তাঁদের কর দিতে হয়, সেই ফসলই এই প্রাণীরা খেয়ে ফেললে কীভাবে তাঁরা কর দেবেন? সমস্যাটি তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সরকারি নীতির জন্যেই। যাঁরা কর দিতে পারেন না সেই কৃষকদের তহসিলে আটকে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবার রেওয়াজ ছিল।

কৃষকদের দাবি, প্রত্যেক গ্রামে একটি গোশালা তৈরি করা হোক। সরকার এই দাবি অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। শুধুমাত্র কয়েকটি গোশালা বানাবার ঘোষণা করেছে।

সরকারি বিজ্ঞাপনের ছবিতে দেখা যায় যোগী আদিত্যনাথ গুড় খাওয়াচ্ছেন গরুদের। গোরক্ষা বিষয়ে বড় মাপের এক প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি। কিন্তু প্রকৃত বাস্তব ছবিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

লখনঊ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে হরদোই জেলার লালামাঊ মাওয়াই গ্রামের বাসিন্দারা এই ছাড়া পাওয়া গবাদি পশুগুলির উপদ্রবে তিতিবিরক্ত হয়ে ঠিক করেন সমস্যাটি থেকে উদ্ধারের উপায় বার করতে হবে। জেলা কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা এই মর্মে আবেদন জানান। পশুচিকিৎসা বিভাগ থেকে কেউ এসে গ্রামবাসীদের আটকে রাখা ৫২টি জন্তুকে দাগিয়ে দেয়। ভারপ্রাপ্ত সেই কর্মচারীটি গ্রামবাসীকে বলেন দুটি আলাদা গোয়ালে নিয়ে যেতে হবে গরুগুলিকে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে গরুগুলিকে অন্য কোথাও নিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে যে অর্থের প্রয়োজন, তা সরকার দিতে পারবে না।

ঢিক্কুনি গ্রাম এক কিলোমিটার দূরে। সেখানে একটি গোয়ালে কিছু গরু রাখা হল। কিন্তু পাওয়াযান ভগবন্তপুরে অন্য গোয়ালটি সেখান থেকে পনের কিলোমিটার দূরে। অগত্যা গত ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে ৩৫ জন গ্রামবাসী ২৮টি গরুকে দ্বিতীয় গোয়ালটিতে পৌঁছে দিতে যান। পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। পাওয়াযান ভগবন্তপুরের বাসিন্দারা তো গরুগুলিকে দেখে খাপ্পা। তাঁরা জানান যে ইতিমধ্যে যে গরুগুলিকে এনে গোয়ালে রাখা হয়েছে, তাদের খোরাকের কোনও ব্যবস্থা করেনি সরকার। নাস্তানাবুদ গ্রামবাসীরা ওই গরুগুলিকে গোয়ালে বেঁধে রাখতে পারেননি। ফলে সেগুলি এখন গ্রামের যত্রতত্র চরে বেড়ানোয় অশেষ দুর্গতি ঘটেছে। তাই লালামাঊ মাওয়াই গ্রামের বাসিন্দাদের বলা হয় যে গরুগুলিকে এখন আনা হয়েছে, সেগুলিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। গ্রামবাসীরা পশুচিকিৎসা বিভাগের কর্মচারীটিকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে ভদ্রলোক নিজের মোবাইল ফোনটি স্যুইচ অফ করে রাখেন। অতঃপর সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভান করেন এই বিষয় সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। পরের দিন সকাল অবধি গ্রামবাসীদের অপেক্ষা করতে বলেন তিনি। কিন্তু পাওয়াযান ভগবন্তপুরের মানুষরা অথিথি সৎকারে রাজি না হওয়ায় গরুগুলিকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন লালামাঊ মাওয়াই-এর বাসিন্দারা।

ফেরবার পথে জ্ঞানেন্দ্র সিং নামে বিজেপি-র এক কর্মী এবং গোরক্ষা নজরদার তাঁদেরকে আটকায়। অতগুলি গরু নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে ও তার সঙ্গীসাথীরা গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণ করে। তাদের বোঝানো হয় গরুগুলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সরকারের অনুমতি আছে এবং পুলিশের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা হয়েছে। তা সত্ত্বেও পিটুনি বন্ধ হয় না। গরুগুলি ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়ায়। আহত মানুষগুলি সোজা আটরুলি-র পুলিশ থানায় যান। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন দলিত ছিলেন। পুলিশ বলে রাত হয়েছে, তাই আগামীকাল আবার আসতে হবে।

২৮ ডিসেম্বরে লালামাউ মাওয়াই-এর বাসিন্দারা থানায় যান। স্টেশন হাউস অফিসারের জন্যে তাঁদের সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করতে হয়। অভিযোগপত্র দেন তাঁরা। সাব-ডিভিসশল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করে, ১লা জানুয়ারি জেলা সদরে বিক্ষোভ করে এবং গ্রাম থেকে থানা অবধি মিছিল করে যাওয়ার পরেও পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেনি। পিটুনিতে আহত হওয়ার এক মাস পরেও সেই অভিযোগ রুজু হয়নি। তার প্রধান কারণ, অভিযুক্ত ক্ষমতাসীন দলের একজন কর্মী।

গরুগুলি যত্রতত্র চরে বেড়ায় কারণ, ওরা খেতে পায় না কারণ, গোয়াল বলে আর কিছু নেই। দুর্বল প্রাণীগুলি যে কোনও গাড়িদুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। শহরগুলিতে আবর্জনায় খাবারের খোঁজে ওরা হামেশাই ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টর সঙ্গে প্লাস্টিক ব্যাগগুলিও খেয়ে ফেলে। পেটে ক্রমাগত প্লাস্টিক জমা হওয়ার কারণে প্রাণ হারাতে হয় ওদের। জবাইয়ের হাত থেকে এদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যটা তাই সম্পূর্ণ মাটি হয়ে যায়। এমনিতেই অবহেলাতে মরতে হয় ওদের। তথাকথিত গোরক্ষকেরা এদের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসে না। গোরক্ষকেরা শুধু অপেক্ষায় থাকে। গোমাংস খাচ্ছে অথবা জবাই করতে নিয়ে যাচ্ছে বলে কাউকে সন্দেহ করলেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পিটতে সদাপ্রস্তুত।

গোশালা নির্মাণ এবং ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের দুর্নীতি চলে। এগুলির ঠিকাদারি সাধারণত এমন ব্যক্তি ও সংস্থাগুলিকে দেওয়া হয় যারা বিজেপি অথবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের আশীর্বাদধন্য।

গ্রামবাসীরা অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন বেওয়ারিশ গরুগুলিকে প্রজাতন্ত্র দিবসে মুখ্যমন্ত্রীর আবাসে নিয়ে যাওয়া হবে। যাতে অবলা প্রাণীগুলি একটু যত্ন পায়। সেই আহ্বান তুলে দুটি মিছিল আয়োজন করা হয়। একটি ২৫ জানুয়ারি উন্নাও জেলার মিয়াঁগঞ্জ থেকে, অন্যটি ২৬ জানুয়ারি লালামাঊ মাওয়াই থেকে। কিছু দূর এগোনোর পর হজরতগঞ্জের সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাণ্ডিলা-র সার্কেল অফিসার গরুসহ এই মিছিলগুলিকে আটকে দেন। গরুগুলিকে গোশালায় পাঠানো হয় এবং বিজেপি-র সেই কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রুজু করে পুলিশ। তফসিলি জাতি/উপজাতিদের প্রতি নৃশংসতা প্রতিরোধের ধারাও যুক্ত হয় সেই অভিযোগে। উন্নাও-এর জেলাশাসক সম্প্রতি একটি নোটিস জারি করে জানিয়েছেন এখন থেকে গবাদি পশুরা যত্রতত্র ঘুরে বেরালে সংশ্লিষ্ট গ্রামসভাগুলির জন্যে গ্রামপ্রধানেরা এবং গ্রামোন্নয়ন অফিসারেরা দায়ী থাকবেন।

এই আপাতত বিজেপির গোরক্ষার মর্মবিদারক চিত্র।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...