সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে অণুগল্প

সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে অণুগল্প -- বিলাল হোসেন

বিলাল হোসেন

 


লেখক কবি, অণুগল্পকার, অণুগল্পের প্রচার ও প্রসার আন্দোলনে যুক্ত

 

 

 

 

পূর্ব প্রসঙ্গ: অণুগল্প নিয়ে এত বিতর্ক কেন

সাহিত্য আন্দোলন

ক্রমে ক্রমে একটা সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠলে তার নানা স্তর থাকে। প্রথম স্তরেই থাকে অস্বীকৃতি-অবদমন-ঠাট্টা-বিদ্রূপ। এই স্তরের সবটুকু পথ পাড়ি দিয়ে যখন এগিয়ে যাওয়া হয়। তখন শুরু হয় দ্বিতীয় স্তরের পথযাত্রা। সেখানে ওঁত পেতে থাকে ইতিহাসের চিপা থেকে উদাহরণ তুলে ধরার পাঁয়তারা, উত্থাপিত প্রস্তাবিত নতুনকে পুরাতন ন্যাকড়া কাপড়ে পরিষ্কার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এ-স্তরে। তারপরও কাজ হয় না। বরং আন্দোলনটি যদি হয় প্রাসঙ্গিক, পাঠকবান্ধব তবে পাঠকই এগিয়ে নিয়ে যায় বাকি পথটুকু। কিন্তু আন্দোলনমুখর এ সময়টাই হল সবচেয়ে মূল্যবান। এই অধ্যায়ে চারপাশে জয়জয়কার হবে। কিন্তু ভুলও হতে থাকবে। যেমন হচ্ছে অণুগল্পের বিষয়ে।

চারপাশে অণুগল্প বিষয়ক লেখাজোখায় ভরে উঠছে। যেন অণুগল্প একটি নদী; তার ঢেউ ভাঙছে একের পর এক। হ্যাঁ, নদীবাহিত ঢেউয়ের মতই, বই প্রকাশিত হচ্ছে বিস্তর, একের পর এক। অণুগল্প সংখ্যা আর সঙ্কলন প্রকাশিত হচ্ছে। অণুগল্পের এই পর্যায়ে নবীন প্রবীণ, দুকলম লিখতে পারা সবাই অণুগল্প লিখছেন। দুর্বল লেখায় সব ছয়লাপ হয়ে যাচ্ছে, ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যাচ্ছে, অণুগল্পটি আসলে হারিয়ে যাচ্ছে, যেমন সুঁই হারিয়ে যায় গাদার ভেতরে। এই গাদার ভেতর থেকে সত্যিকারের অণুগল্পটি বের করাটা/চিনতে পারাটা একটা বিরাট ঝক্কির ব্যাপার। এখানটায় ভুল করলে এই আন্দোলন যে আগুনের ঢেউ ছড়িয়ে দিয়েছিল সব জায়গায়, সবখানে— সে আগুন নিভে যেতেও দেরি হবে না। ভয়টা এখানেই।

 

প্ররোচনার দরজা

একথা আগেও অন্যত্র আলোচনা হয়েছে— অণুগল্প অনেক রকমের হয় এবং একটি অণুগল্পের চেহারা অবয়ব, অণুগল্পের মতোই হয়।

আমরা যখন একটা অণুগল্প লিখতে বসি, লিখতে লিখতে কলম থেমে যায়; বার বার থেমে যায়। কলম থেমে যাওয়াকে গল্প লেখাকালীন ব্যর্থতা বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। গল্প লিখতে গিয়ে কলম, যেখানে লেখা হচ্ছে সেই খাতা বা কম্পিউটার স্ক্রিন এবং লেখকের মন-মনন এই তিনের এক অসাধারণ মেলবন্ধনে একজন লেখক তার সৃষ্টিকর্ম রচনা করতে থাকেন এবং সেই সৃষ্টিমুহূর্তে লেখকের মনে এমন সব কল্পনার রং ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে— এক বিশাল রংধনুর আকার নেয়; মনের আকাশে জেগে থাকা ঐ রংধনুর কোন রংটি নিয়ে; কোন রংটি উপযুক্ত ভেবে লেখক লেখার খাতায় ছড়িয়ে দেবেন, লেখার এক সেকেন্ড আগেও তিনি জানেন না বলেই আমার বিশ্বাস। প্ররোচনার দরজায় এসে লেখক শুধু এক মুহূর্ত থমকে যান; উপযুক্ত রংটি সংগ্রহের জন্যে অপেক্ষায় থাকেন একটি ইশারার। একটি ইঙ্গিতের।

গল্পকার গল্প লিখতে লিখতে অনেক চরিত্র সৃষ্টি করে ফেলেন, অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে যান। চরিত্রের মুখে সংলাপ আসে বা ঘটনার বিবরণীতে পারিপার্শ্বিকতা চলে আসে। এই যে চরিত্র, সংলাপ, পারিপার্শ্বিকতার বয়ান— এইসব করতে গিয়ে লেখককে এমন সব সম্ভাব্যতা আবিষ্কার করতে হয় যে প্ররোচনার মূল দরজার বাইরে আরও অনেকগুলো সম্ভাবনার দরজা বন্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রত্যেক দরজার বাইরে অপেক্ষা করে থাকে অনেকগুলো পথ। লেখককে ভাবতে হয় খানিক বিরতি দিয়ে— আমি কোন সম্ভাবনার কোন দরজা খুলে কোন পথ ধরে এগোব।

লেখক মনের দরজায় কান পেতে থাকেন ওই ক্ষণিক বিরতিকালে— কী প্ররোচনা আসে!

যদি এমন হয়— প্ররোচনার ভাষাটি/ইঙ্গিতটি ধরতে লেখক অক্ষম হন তবে তিনি নির্ঘাত সম্ভাবনার দরজার সেই দ্বারটিই খুলবেন যেখান থেকে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না; কিছুদূর গিয়েই দেখার যাবে সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেছে। এগোবার মত আর পথ নেই। এই অবস্থায় আবার থামতে হয়। প্ররোচনার দরজায় কান পাততে হয়। অপেক্ষায় থাকতে হয়। এই যে লিখতে লিখতে বিভিন্ন দরজা চলে আসে বা মননজুড়ে সাতরঙের রংধনু ওঠে— এটা কীভাবে হয় একটি উদাহরণের মাধ্যমে দেখি। এটি একটি উদ্ধৃতি। উপকারে আসবে।

ধরা যাক, এক নারী; নারীটি তার বাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল; তার একটি নাম ভেবে নিয়ে প্রথম বাক্যটি এরকম লেখা গেল— ‘সদর দরজা খুলে মিনু দাড়াল’। এবার আসুন আমরা ভেবে নিই, সময়টা কী? সকাল, দুপুর, বিকেল কিংবা রাত? যে-কোন একটি ধরে নেই— বিকেলই হোক তবে। ‘সদর দরজা খুলে মিনু দাঁড়াল। এখন বিকেল।’ বিকেল যদি সময় হয় তো তার নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিকতা রচনা করতে হবে। কারণ শিল্প হয় অনিবার্যভাবে সম্পাদিত একটি সৃষ্টি, শিল্পে কোনও কিছুই গূঢ় অভিপ্রায় বিনা আসে না, আসবে না।

মিনু কি বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুলেছে? মিনু কি বাড়ির ভেতরে হাঁপিয়ে উঠেছিল, তাই দরজা খুলে নিশ্বাস নেবার ইচ্ছে তার? কারও কি আসবার কথা ছিল অনেক আগেই, এখনও আসেনি, তাই বড় উদ্বিগ্ন হয়ে দরজা খুলে পথের দিকে তাকিয়ে আছে সে? যদি কারও আসবার কথা থাকে তো সে কে? যদি বাড়ির ভেতরে হাঁপিয়ে উঠে থাকে, তবে সেই হাঁপিয়ে ওঠার কারণ কী? বাইরে যদি যাবে তো কোথায় যেতে তার পা ফেলা?

এতক্ষণে আমাদের করোটি কাজ করতে শুরু করেছে, কল্পনা নড়েচড়ে উঠেছে, গল্পের একটি আভাসের দিকে আমরা এখন এগিয়ে যাচ্ছি; আমরা যে-কোনও একটি বিকল্প নিয়ে কাজ করতে পারি; তৃতীয় বিকল্পটি গ্রহণ করা যাক— কারও আসবার কথা ছিল?

কে সে? নারী না পুরুষ? যদি পুরুষ, সে কি তার স্বামী? স্বামী হলে মিনু অবশ্যই বিবাহিতা, বিবাহিতা হলে কতদিন বিয়ে হয়েছে তার, ছেলেমেয়ে আছে কিনা, সে কি শ্বশুরবাড়িতে আছে? বাপের বাড়িতে আছে? না এটি তার নিজের সংসার— এইসব এবার আমাদের ভেবে নিতে হবে, এক্ষুণি উল্লেখের দরকার নাও হতে পারে, কিন্তু এই মুহূর্তেই ভেবে নেওয়া চাই, কারণ কোনও চরিত্রই নিরালম্ব নয়, এমনকি যে নিঃসঙ্গ সেও পরিবেশ সংলগ্ন— ঋণাত্মক অর্থে। যদি স্বামীর অপেক্ষা মিনু না করছে এবং কোনও পুরুষেরই অপেক্ষা করছে, তবে কি সে তার বন্ধু কেউ? অতিথি বা নতুন প্রেমিক? মিনুর ভাই? পিতা? আমরা দীর্ঘ এক তালিকা মনের মধ্যে রচনা করতে পারি। নাকি, নারী কেউ? মিনুর কোনও বান্ধবী? তার স্বামীর কোনও বান্ধবী? এমন কোনও বান্ধবী যার সঙ্গে তার স্বামীর গোপন প্রেমের সম্পর্ক আছে বলে মিনু অনুমান করে, কিন্তু এখনও কোনও প্রমাণ পায়নি? স্বামীর যদি অপেক্ষা, তো কেন অপেক্ষা করছিল মিনু, এতটাই অপেক্ষা যে ব্যাকুল হয়ে বাইরের দরজা সে খুলেছে, স্বামী নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফেরে এবং সময়টা অনেক আগে পার হয়ে গেছে, তাই কি সে ব্যাকুল? নতুন প্রেমিক হলে, বিয়ের পরে কোনও মানুষ হলে, তার তো পড়ন্ত বিকেলে আসবার কথা নয় যখন যে কোনও মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে পারে মিনুর স্বামী; পুরনো প্রেমিক হলে তার কি এই প্রথম আসবার কথা এ বাড়িতে? আসতে নিষেধ করেছিল কি মিনু? কিংবা কারও আসার কথাই নয়; মিনু জানে না কেন সে দরজা খুলেছে; একবার খুলে ফেলার পর মিনু তার নিজের ভেতরে তাকিয়ে দেখছে কেন অর্থহীনতার এই দরজা খোলা; মনে পড়ে যাচ্ছে কি অতীতের কোনও দরজা খোলা?— আক্ষরিক অর্থে নয়, প্রতীক যে দরজা কিংবা ও সংসার থেকে নিষ্ক্রমণের অন্তঃশীল প্রেরণায় এখন দরজায় পড়েছিল তার হাত এবং দরজাটি খুলে সে স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে আছে তার সংসারটিকে পেছনে রেখে।

আরও একটু সময় নিয়ে ভাবলে আমরা দেখতে পাব হাজার সম্ভাবনা ধারণ করে আছে পড়ন্ত বিকেলে দরজা খুলে দাঁড়ানো মিনুর এই পরিস্থিতি। একটি মানুষকে তার তল-ব্যাস-বেধ সমেত ভাবতে-ভাবতে অসাধারণ একটি ক্রিয়া এইভাবে হয়ে ওঠে ‘অসাধারণ’ এবং গভীরস্পর্শ। ‘সদর দরজা খুলে মিনু দাঁড়াল। এখন বিকেল।’— এর পরের বাক্যটি তাই আর সহজ হবে না লেখা, এবার আমাদের লিখতে হবে অনেক ভেবে, অনেক কিছুর ভেতরে একটি সূত্র অবলম্বন করে এবং তখনই শুরু হবে শিল্প রচনার প্রকৃত কাজ, সকল সম্ভবপরতার ভেতর থেকে এমন একটিকে বেছে নেওয়ার কাজ যা কেবল একটি গল্প বলবে না, গল্পের ভেতর দিয়ে বিশেষ জীবনবোধ প্রকাশ করবে।”[1]

প্রয়োজন হবে শুধু একজোড়া কানের, যে কান শুনতে পাবে প্ররোচনার দরজা থেকে উঠে আসা নৈঃশব্দের বাণী।

 

অণুগল্পের মেদ সংক্রান্ত খুঁটিনাটি

আমাদের অণুগল্প দুনিয়ায় অনেকগুলি শব্দবাক্যপ্রশ্ন নিত্যদিন শুনতে হয়। এইসব শব্দবাক্যপ্রশ্নের উচ্চারণ এতই অধিক যে, মনে হতে পারে অণুগল্প বুঝি এইসব শব্দ, বাক্য আর প্রশ্নের পাঁকে আটকে যাওয়া কোনও সাহিত্য মাধ্যম। অথচ এইসব শব্দবাক্যপ্রশ্ন এই অণুগল্পের বহিরঙ্গের সেই মূল্য নিয়েই বাঁচে— যেমন আপনার আমার শরীরে লেগে থেকে বেঁচে থাকে প্রতিদিনের ধুলি। ধুলিসম সেইসব শব্দবাক্যপ্রশ্নের অবতারণার এতটাই প্রাথমিক পর্যায়ের যে অণুগল্পের গভীরতার কাছে তা একেবারেই গৌণ। কার্যত অণুগল্পের চলাচল অনেক গভীরের পথ ধরে। এমনি একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে— মেদ। অণুগল্পের আলোচনাকালে বা আমার অণুগল্প লিখিত হওয়ার প্রাক্কালে গোটাকতক বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে কাজ করি। সেগুলিকেই আমি আমার অণুগল্পের প্রধান বিষয় বলে ধরে নিই। সেগুলি হল— স্বল্পায়তন, শুরুর ম্যাজিক, রহস্যময়তা, বহুস্বর, উল্লম্ফন, মহামুহূর্ত, অভিঘাত, ফ্রেমওয়ার্ক এবং এইসবের মধ্যে অন্য আরেকটি হল— মেদহীনতা। কিছু কিছু আলোচনা করা যেতে পারে এ-সম্পর্কে।

‘মানুষ যখন কথা বলে সেটা অন্তত তিন অর্থে সৃষ্টিশীল ঘটনা। এক তো ভাষার অন্তর্নিহিত অপরিমেয় প্রাচুর্য— কতরকম কথা বলা যায় তার কোনও শেষ নেই, এই অশেষত্বই সৃষ্টিশীলতার আশ্রয়; তারপর, মানুষ যা বলে তা তার স্থান-কালের পরিস্থিতির হুকুমমাফিক হয় না, যে কথা বলছে তার স্বাধীন সম্বন্ধ স্থাপনের সৃষ্ট রুচি প্রকাশ পায়; আর তৃতীয়, লোকে যা কথা বলে সেই কথার একটা সংহত গ্রন্থন থাকে, তার থাকে প্রাসঙ্গিকতা।

এই সংহত গ্রন্থণবিযুক্তি বা এই প্রাসঙ্গিকতাবিহীন গ্রন্থনাই হল মেদ।

এ বিশাল জগতের সঙ্গে আমাদের যোগ। এই যোগ দেখাতে গেলে বর্ণনার যে স্বাধীনতা গ্রহণ করতে হয়— তাও নেওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল তখনই হয় যখন জগতের সঙ্গে যোগ না থাকলে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকে, অভিজ্ঞতাহীন হয় বোধশক্তিহীন। কিন্তু কৃত্রিম বর্ণনা করতে চাইলে স্বাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে— যথেচ্ছ ব্যবহার হতে থাকে আর তখনই লেখার ভেতরে মেদ জমতে শুরু করে। যোগের অভাব মানুষ অতিকথনে মিটিয়ে ফেলতে চায়।

লেখককে প্রথমেই শব্দ নির্বাচন করতে হয় আর সেটি হতে হয় যথাযথ শব্দ এবং এই যথাযথ শব্দ নির্বাচন এবং প্রয়োগকৌশল যদি আমরা না জানি তাহলে অণুগল্পের আয়তনজনিত চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে যে ইমেজ তৈরি করতে চাই, যে পরিবেশ তৈরি করে বিশ্বাসযোগ্যতা/বিশ্বস্ততা বা গল্প ফুটিয়ে তোলার যে মুনশিয়ানা দেখাতে চাই— তা হবে না। আর তার হাজারো শব্দের মধ্য থেকে সত্যিকারের শব্দটির প্রয়োগ করা— লেখকের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হল এই যথাশব্দটি চেনার উপায় কী? কী কৌশলে প্রবৃত্ত হলে আমরা এই কাজটি করতে পারি?

গল্পের সাম্যাবস্থা, সমজাতীয়করণ এই দুই বিষয়কে সামনে রাখতে হয়। এবং শব্দ সংগ্রহের জন্য গল্পের পরিবেশ থেকেই শব্দের অনুসন্ধান করতে হবে।

শব্দকে মাপযন্ত্রের ওপর চাপিয়ে দেখতে হবে কোন শব্দ থেকে কী পরিমান ওজন গ্রহণ করেছে। যদি কম-বেশি হয় তবে বুঝতে হবে সারিবদ্ধ শব্দের মধ্যে সাম্যাবস্থা সঠিক হয় নাই।

আবার এমনও হয়, গল্পের পরিবেশ যেসব দিকে ইঙ্গিত করে সেটা নির্বাচন সনাক্ত করতে লেখকের ভুল হলে জাতীয়করণে ভুল হয়েছে ধরে নিতে হবে। এটাকে বলে ম্যাচিং।

আলোচনা জটিল হয়ে যাচ্ছে?

একটি উদাহরণ দিয়ে নরম করে দিচ্ছি। আলোচনাটি গল্পের গদ্যবিষয়ক হলেও উদাহরণ একটি কবিতা থেকে নিলাম।

নারকেলের অই লম্বা মাথায় হঠাত দেখি কাল
ডাবের মত চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল।

এই দুটি লাইনে নারকেল গাছের লম্বা মাথায় কিছু দেখার কথা বলা হচ্ছে। কী সেটা? চাঁদ। কবি চাঁদ দেখছেন, যে চাঁদ আকাশে উঠেছে কিন্তু কবি দেখছেন নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। কেমন চাঁদ? সেটার উপমা দিতে গিয়ে লেখক পরিস্থিতি/ঘটনার পাশ থেকেই খুঁজে ফিরেছেন। পরিবেশ থেকেই নিয়ে নিয়েছেন। যতটা পেরেছেন চাঁদের কাছাকাছি থেকেছেন। কবি নারকেল গাছের উঁচু মাথায় শুধু চাঁদই দেখছেন না আরেকটি জিনিসও দেখছেন। ডাবও দেখছেন। ডাব মানেই ঠান্ডা স্পর্শ। ডাব মানেই হল গোলগাল কিছু। অতএব চাঁদের উপমা আনতে এর চেয়ে উপযুক্ত আর কিছুই হতে পারে না। আর এইভাবে পরিবেশ থেকে আলগোছে তুলে নিতে হয় শব্দ। যথাশব্দ। প্রতিষ্ঠিত হয় সাম্যাবস্থা। এতে গদ্যের থলথলে মেদ প্রাকৃতিকভাবেই সঙ্কুচিত হয়ে যায়।

ডিটেইলে এখন গদ্য বলার চল। অনেক খ্যাতিমানরা এটাকে তাদের গদ্যের প্রধান অনুষঙ্গ করেছেন। পরীক্ষানিরীক্ষাও করেছেন। অণুগল্পে এই নিরীক্ষাটা চলতে পারে না এর স্বল্পায়তনের উপাদান থাকার কারণে। আমি নিজে এই নিরীক্ষা চালিয়েছি। কিন্তু দেখেছি ডিটেইলিংয়ে কেবল মেদই জমে। গল্পের খুব একটা মান বাড়ে না। ডিটেইলসমৃদ্ধ ছোটগল্প বা উপন্যাসের নানা পার্ট এবং অনুষঙ্গ থাকে কিন্তু অণুগল্প যেহেতু পুরোটা নিয়েই একটি পার্ট তাই ডিটেইল ব্যবহারের তেমন সুযোগও নেই।

অনেক ডিটেইল আবার তথ্যের মুখোশ পড়ে থাকে। অর্থাৎ মুখোশের আড়ালে বিচরণ করে ডিটেইল। সেজন্যে তথ্যমূলক গল্প সম্পর্কে লেখক পাঠকদের কিছুটা পরিচয় থাকলে ডিটেইল বলা গল্পগুলি কীভাবে মেদে পরিণত হয়ে অণুগল্পকে বরবাদ করে দেয় সে-ধরনের শতশত অণুগল্প আমরা চর্চা করছি প্রতিদিন, ‘অণুগল্প’ গ্রুপেই।

দুটি উদাহরণ—

ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতরে লেপ্টে আছে মুখ হাত পা—সমস্ত শরীর। জঙ্গলের ভেতরে জঙ্গল। জঙ্গলেরাও কথা বলে। হাত নাড়ে। মাথা দোলায়। নিঃশব্দে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়। জঙ্গলের গায়েও এক ধরনের কাঁচা কাঁচা গন্ধ থাকে।

ইয়া মাবুদ— পানির ভেতরেও পানির গন্ধ! কচুরিপানা ডাটা ছিড়ে নাকের সামনে নিলে যেমন গন্ধ— সেইরকম।

হাসমতের নৌকাটা বাঁধা কদম গাছের গলায়। কদম গাছের ডালফুল পাতাসহ বৃষ্টিভারে নেমে এসেছে পানির কাছাকাছি। এদিকে, নদীর পানি ফুলে উঠেছে অনেকদিন হল। আরও ফুলবে। বৃষ্টিতে ধসে গেছে বাঁধ সেই কবে।

উথাল পাথাল ঢেউয়ে পুরো গ্রামগঞ্জ গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। হাসমত বিড়ি ধরাল। তারপর হ্যাজাক বাতিকে গুতিয়ে বাড়াল আলোর উজ্জ্বলতা । অপেক্ষার প্রহর আর যেতে চাইছে না।

অনেকটা পথ, ধৈর্য না হারিয়ে রয়েসয়ে আসতে হবে। প্রথমে দেবীর দীঘি, তারপর মন্মথনাথের চিতার ওপর তৈরি করা শিবমন্দির, এরপর অনেকটা পথ কেবল নারকেল, সুপারি আর পামগাছের সারি, মাঝে পথ। কী নিবিড় আর নিটোল সেই পথ, আহা! বাতাসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পাতাদের দল গেয়ে ওঠে আর তখন চেনা অচেনা অনেক পাখিরাও গাইতে থাকে “প্রাণও ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ”। এই তো এসে গেছি প্রায়, বৈঠকখানা ঘরটা দেখা যাচ্ছে। পাশে কালীমন্দির। মন্দিরের বারান্দায় কৃষ্ণের রথ দেখা যাচ্ছে।

এসব পাশ কাটিয়ে যাবার পরেই বাড়ির সিংহদরজা দেখা যায়। অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে উঠে আসি দরজার সামনে। কড়া নাড়ব ভেবে নকশাকাটা লোহার দণ্ডের দিকে হাত বাড়াতেই মনীশ ডেকে ওঠে। কোথায় যাচ্ছিস? আগেই বাড়িতে ঢুকছিস ক্যানো? নেমে আয়, নেমে আয়। প্রথমে আমরা তলকুঠুরিতে নামব। আমি দৌড়ে নেমে আসি। সিঁড়ির নীচে সিমেন্টের গোল পাইপ। সেটার ভিতর ঢুকে পড়তেই তলকুঠুরির মুখ। লোহার ছোট দরজা। ঠেলা দিতেই ক্যাঁচ করে খুলে যায় লোহার কবাট। ভিতরে একঝলক অন্ধকার। একটু পর চোখে সয়ে আসে অন্য ভুবনের নীরবতা। সামনেই মা লক্ষ্মীর পিতলের মূর্তি। সেখানে বাদাম তেলের পিদিম জ্বলছে। গিন্নিমার এসব দিকে চোখা নজর। সাতসকালে সারা বাড়িতে যে কজন দেবী আছেন, সবার বন্দনা শেষে সুগন্ধি পিদিম জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তিনি হেঁসেলে যাবেন। সঙ্গে থাকবে তিনজন বাদী। গিন্নিমা স্বপাকে খান। বাদীরা সহযোগিতা করে তাকে।

—বর্ণনা হিসেবে এইসব দৃশ্যাবলির যে পরিমাণ সৌন্দর্য ছড়িয়েছিটিয়ে আছে, সেসবের মূল্য যাই হোক না কেন স্বল্পায়তনধারী অণুগল্পের ধারালো ভাব অনেকখানি কমিয়ে দিয়ে গল্পটিকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে অণুগল্প তার জয়যাত্রা করে বলেই অনেক লেখক এই মাধ্যমে এসে ধসে যান এবং যারা পেরে ওঠেন তাদের মাথায় যে-বিজয় মুকুট দেখা যায়, তাতে চোখধাঁধানো দ্যুতি থাকে।

উপন্যাসে বা ছোটগল্পের অন্যতম একটি বিষয় হল স্বগতোক্তি। চরিত্রের মুখে আপন মনে কথা বলিয়ে লেখক মূলত গল্পের অপর্যাপ্ততা, লেখকত্বের শূন্যতা, গল্পের চরিত্রের অপূর্ণতা, এবং গল্পের ভেতরগত গতিমুখ নানাদিকে পরিবর্তন বা অন্যান্য বিষয়গুলি পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে চরিত্রের মুখ দিয়ে স্বগতোক্তি প্রকাশ করার মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয় লেখক। স্বগতোক্তি মূলত লেখকের একটি আশ্রয়। উপন্যাস-ছোটগল্পের মত সাহিত্যের এই লেখনশৈলী জনপ্রিয় বা লেখকপ্রিয় হলেও অণুগল্পে এই রীতি অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা অণুগল্পে এই রীতির প্রয়োগ করার কোনও সুযোগই নেই শুধু এর স্বল্পায়তনের সীমাবদ্ধতার জন্যে। সুতরাং অণুগল্পে; চরিত্রের মুখে স্বগতোক্তি— একটি প্রকাশ্য মেদ। মারাত্মকভাবে সৌন্দর্য বিনাশকারী।

তবে এটা মনে রাখা দরকার—

উত্তমপুরুষে লেখা অণুগল্প আর গল্পের চরিত্রের মুখে স্বগতোক্তি এক জিনিস নয়। স্তবক থেকে স্তবকে যাওয়ার প্রাক্কালে বা প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার বেলায় একটি সার্থক উল্লম্ফন দিতে পারলে গল্পের ভেতরের অনিবার্য ফাটল থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। আর এই উল্লম্ফনটি যদি একটি/দুটি শব্দের স্বগতোক্তির মাধ্যমে দেয়া হয়— তবে পাঠক গল্প পড়তে পড়তে একবারের জন্যেও অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ পাবে না। এক্ষেত্রে স্বগতোক্তি মহামূল্যবান অলঙ্কার, অণুগল্পের।’ [গদ্য সিরিজ অ আ ক খ]

গল্পের ভেতরে মেদ কাটানোর একটি অন্যতম কৌশল হল উল্লম্ফন। অর্থাৎ সময় আর স্থানের দূরত্ব কমাতে লেখক যে লাফ দিয়ে থাকেন সেখানে চরিত্রের মুখে নয় কিন্তু মনে হবে চরিত্রের মুখেই একটি সংলাপের মত শোনাবে— কিন্তু সংলাপ নয়, ‘স্বগতোক্তি’— তুলে দেন । ফলে পাঠক খুব সহজেই সময় এবং স্থানের দূরত্ব পাড়ি দেন, পাঠক একটি চমৎকার মন চঞ্চল করা বর্ণনার ছদ্মাবরণে সংলাপের মত করা কিছু পান। আর এই কর্মকাণ্ড সাফল্যজনকভাবে করতে পারলে খুব সহজেই বাড়তি শব্দ ব্যবহার করার মত সব সুযোগ নেওয়া যায়। সঠিক শব্দস্পৃষ্ট করতে পারলে গল্প জেগে ওঠে, প্রাণ পায়। বাড়তি শব্দটি হয়ে যায় অনেকগুলি না-বলা কথার প্রতিনিধি। সম্ভাব্য মেদ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।

গল্প উপন্যাসের একটি যুগ ছিল যখন চরিত্রের মনোবিশ্লেষণ হত একজন সাইকোলজিস্টের মতই। ঘটনার পরম্পরা আর সম্পর্কের টানাপোড়েন এমন এক পর্যায়ে চলে যেত আর তার সূক্ষ্ম বিচার ব্যাখ্যা এমন ঘটা করে লেখকের কলম থেকে বেরুত যেন পাঠকের মাঝেমধ্যে ভ্রম হত— লেখক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কিনা! এইধারার গল্প উপন্যাস এত বেশি রচিত হয়েছে যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। অণুগল্পে এ ধরনের বিচারবিশ্লেষণের কোনও উপায় নেই। কেউ করে ফেললে নির্ঘাত গল্পটি মেদের জালে আটকে যাবে। পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

চাবিশব্দ অণুগল্পের সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যা অকৃত্রিম। আর এই চাবিশব্দ ধরে ধরে বাক্য গঠন, স্তবক গঠন করলে মেদ জমার যে বাড়তি শব্দ নিজের অজান্তেই গল্পে ঢুকে বসে থাকে সেটি হতে রেহাই পাওয়া যায়। পাশাপাশি গল্পের ভাষার মধ্যে যে গতিশীলতা বা প্রবহমানতা আনার চেষ্টা থাকে সেটাও রক্ষিত হয়। পাঠককে গল্পের ভেতরে ধরে রাখার মোক্ষম উপায় হল তাকে একবারেরও মত লেখকের পক্ষ থেকে অমনোযোগী না করে তোলা। চাবিশব্দের মাধ্যমে বাক্য স্তবক এবং গল্পটি শেষ করাতে পারলেই এই অতুলনীয় ঘটনাটি ঘটে। ফলে গল্পের ভেতরে মেদ প্রবেশ না করার কৌশল, কিংবা দুএকটি মেদ বা গাদযুক্ত শব্দ ঢুকে পড়লেও চাবিশব্দের ব্যবহারের ফলে পাঠকের মনে তালা লাগতে পারে না। চাবিশব্দ তালা খুলতে ওস্তাদ।

 

শেষ পঙক্তির অণুগল্প

বাক্য এবং পঙক্তির মধ্যে পার্থক্য আছে। বাক্যকে ইংরেজিতে সেনটেন্স বলে। আর পঙক্তিকে লাইন বলে; চরণ বলে। বাক্য একটি ব্যাকরণগত পরিভাষা বা টার্মস। অন্যদিকে, পঙক্তি হল কাব্যের সঙ্গে জড়িত একটি কাব্যমথিত অলঙ্কার। কাব্যের যেমন অনেক অলঙ্কার থাকে উপমা, অনুপ্রাস, ব্যাঞ্জনা— এইসব। এইসব অলঙ্কারের মধ্যে পঙক্তি বা চরণও একটি। চরণকে পদও বলে।

কিন্তু পঙক্তিও একটি বাক্য হিসেবে ধরা যেতে পারে। কবিতার বাক্য। বাক্য ছাড়া ভাষা অচল, কাব্য ছাড়া ভাষা নিষ্প্রাণ। আর এই কাব্যের অন্তরে প্রাণ ফুঁকে দেয় পঙক্তি। তাই পঙক্তিকে আলাদা মর্যাদা দিতেই হয়।

বাক্য একটি আটপৌরে বিষয় কিন্তু পঙক্তি একটি সাজসজ্জাময় নির্বাচিত কিছু। তাই গদ্যের যে-ক্ষেত্রটিতে এসে বাক্য বা বাক্যের ধ্বনি বিশেষ হয়ে যায়, সুনির্বাচিত হয়ে ওঠে, ওই বাক্যটিকে আমি বাক্য না বলে পঙক্তি বলাতে বেশি পক্ষপাতিত্ব করব। কারণ ওইটা শুধু বাক্যই নয় বাক্যের অধিক। এইসব কারণে যেসব অণুগল্প মোচড়ভিত্তিক, অভিঘাতভিত্তিক বা টুইস্টে এসে পাঠক বিহ্বল হয়ে পড়ে, সেইসব শেষ লাইনের গল্পগুলি অসাধারণ হিসেবেই ফুটে ওঠে। তাই শেষ বাক্যকে আমি পঙক্তি বলব। আর অণুগল্পটি হবে শেষ পঙক্তির অণুগল্প‘।


[1] উদ্ধৃতিটি সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃদকলমের টানে’—থেকে নেয়া হয়েছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...