প্রতিরোধ আর প্রতিস্পর্ধার উত্তরাধিকার: সান্তাল হুল

প্রতিরোধ আর প্রতিস্পর্ধার উত্তরাধিকার: সান্তাল হুল -- মেরুনা মুর্মু

মেরুনা মুর্মু

 


লেখক অধ্যাপক, গবেষক, সমাজকর্মী

 

 

 

 

এক মাস হল হুল পালিত হয়েছে। আজকাল তো আবার সবেতেই উৎসব। মেতে উঠলেই হল। তাতে আবার সিধুবাবু, কানুবাবুর সঙ্গে ডহরবাবুর পরিবারদের ডাক পড়ে। তাই নিয়ে সান্তালদের জোরদার প্রাতিবাদ। তাতে বাপু আমি খারাপ কিছু দেখি না। ডহর মানে তো রাস্তা। ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন চুনার মুর্মুর সন্তানরা— সিধু, কানু, ফুলো, ঝানো, চাঁদ, ভৈরো— “শাল গিরা” (শালগাছের ডাল) পাঠিয়ে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ভগ্নাডিহির মাঠে দামিন-ই-কোহ, বীরভূম, বাঁকুড়া, ছোটনাগপুর, হাজারিবাগ অঞ্চলের প্রায় দশ হাজার সান্তালকে সংগঠিত করে সান্তাল হুল বা বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধের রাস্তাই তো দেখিয়েছিলেন। দিকুদের (অত্যাচারী মহাজন, জমিদার, জোতদার ও তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ সরকারের) বিরুদ্ধে অসম সমরে শুধুমাত্র তীর, ধনুক, টাঙি সম্বল করে অশ্বারোহী, পদাতিক, কামান, হাতি বাহিনীর মোকাবিলা করা তো এক অভিনব বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড৷ এই প্রতিস্পর্ধার উদযাপন তো উৎসবেই হওয়া ভাল।

 

ইতিহাস, সংক্ষেপে

কেন শান্তিপ্রিয় সান্তালদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ হুল-এর চেহারা নিয়েছিল সেটা জানা যাক। বাংলার গভর্নর উইলিয়ান বেন্টিঙ্ক বীরভূম, সিংভূম, ধলভূম, শিখরভূম, উড়িষ্যা, বর্ধমান, পালামৌ, ছোটনাগপুর, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে সান্তাল জনজাতিদের আহ্বান জানান দামিন-ই কোহ এলাকার দুর্ভেদ্য বনজঙ্গল কেটে চাষযোগ্য করে তুলতে। সান্তালদের স্মৃতি জুড়ে শুধুই বসতভূমি থেকে উৎখাতই হয়ে যাযাবর জীবন— চাঁই চম্পার দেশ থেকে ক্রমাগত পথ চলা। তারা ভাবল বুঝি এবার থামা। বেন্টিঙ্ক ঘোষণা করেন প্রথম কয়েক বছর সান্তালরা বিনা খাজনায় জমি ভোগ করতে পারবেন। তবে বাৎসরিক রাজস্ব ১৮৫৪-৫৫ সালে গিয়ে দাঁড়ায় আটান্ন হাজার। তাই হুল-এ সিধু ও কানুর দাবি ছিল সান্তালরা নিজেরাই যেহেতু অরণ্যপ্রান্তরকে পরিষ্কার করে জনপদে পরিণত করেছে, তাই সময় এসেছে ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন সান্তালরাজ সেখানে প্রতিষ্ঠা করার৷

শুধু যে এই বর্ধিত রাজস্ব বিদ্রোহের কারণ ছিল তা মনে করলে ভুল হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকসুলভ মনোভাব ও মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি দ্বারা পুষ্ট বাঙালি, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, পশ্চিমা মহাজনী সুদের কারবারি ও ব্যবসায়ীরা আঘাত হানে সান্তালদের বিনিময়ভিত্তিক অর্থনীতিতে। বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলশাসনের জন্য প্রস্তুত ছিল না সমানাধিকার ও সমমাত্রিক সমাজজীবনে অভ্যস্ত সান্তালরা। দামিনে তারা তাদের মোঁড়ল বা মাঝি দ্বারা চালিত প্রশাসনিক কাঠামো ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল। পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সান্তাল সমাজ প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে ব্যবসায়ীদের আনা নানা মনোহারী দ্রব্যের প্রতি। সামান্য অর্থ, লবণ, তামাক, পরিধেয় অস্ত্রের বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের কাছে তারা ধান, চাল, সর্ষে, তিসি, বোরা প্রভৃতি তৈলবীজ বেচতে থাকে। ব্যবসায়ীরা দামিন থেকে কেনা দ্রব্য কলকাতা বা মুর্শিদাবাদে বেচে দিত যা পরে বিদেশেও রপ্তানি হত। ধূর্ত ব্যবসায়ীরা ভুয়ো দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে ওজনে ঠকাত আর বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে সান্তালদের থেকে কিনে নিত। সান্তালদের প্রায়শই এইসব দ্রব্য কিনতে মহাজনদের থেকে ধার নিতে হত যা তারা মেটাতে পারত না। ঋণ ফেরতে অক্ষম হওয়ায় মহাজনেরা তাদের গরু, মোষ, পাঁঠা, মুরগি, বাসনকোসন, লোহার গয়না ও অন্যান্য গৃহস্থালি দ্রব্য লুঠ করে নিয়ে যেত। বর্ধিত খাজনাও তারা জমিদারদের দিতে অপারগ হওয়ায় মাত্রাতিরিক্ত ঋণের জালে জর্জরিত হত। খাজনা দিতে না পারলে ফলন্ত শস্য নষ্ট করার জন্য জমিদারেরা গরুর পাল, গাধা, ঘোড়া, ছাগল এমনকী হাতিও ছেড়ে দিত। ঋণের দায়ে যে সান্তালরা ফসল, লাঙল, বলদই হারাত তা নয়। ব্যক্তিগতভাবে ও বংশানুক্রমিকভাবে তারা বাঁধা শ্রমিক বা ক্রীতদাসে পরিণত হত, যাদেরকে বলা হত কামিয়া। সমস্ত বছর যতই পরিশ্রম করেও পঞ্চাশ থেকে পাঁচশো শতাংশ সুদের হারে ঋণ আর চুকত না। যা ঋণ তার থেকে অনেক বেশি লিখে সান্তালদের দিয়ে টিপসই করিয়ে নেওয়া তো ছিলই। প্রতিকার চাইতে বিচারব্যবস্থার দ্বারস্থ হলে বিচার না পেয়ে বাড়ত আরও জটিলতা। গ্রামসভার আপসকামী ও মানবিক বিচারব্যবস্থায় অভ্যস্ত সান্তালদের ইংরেজদের কঠোর ও আমলাতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থায় হয়রানি বাড়ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিটিশ আধিকারিক, রেলপত্তনে নিয়োজিত ইঞ্জিনিয়র, কর্মী, মহাজন, জমিদারদের দ্বারা সান্তাল মহিলাদের অপহরণ ও ধর্ষণ।

সিধু আর কানু দাবি করেন দামিন এলাকার প্রত্যেক সান্তাল পরিবার সমান জমি পাওয়ার অধিকারী। যেহেতু সঠিকভাবে কোনও রাজস্বই নির্ধারিত হয়নি সেহেতু জমিদারের নিজের বসতবাড়ি ছাড়া অন্য জমি থেকে উৎখাত হতে হবে৷ স্বাধীন সান্তাল রাজত্ব স্থাপন হলে বসবাসকারী প্রত্যেক দিকু বা বহিরাগতকে পাঁচ টাকা কর দিতে হবে। শুধুমাত্র নিম্ন সম্প্রদায়ের হিন্দু যেমন চামার, কামার, হাড়ি, বাগদি, ধাঙ্গর, গোয়ালা, ভুঁইয়া, ডোম ও মুসলমান তাঁতীরা কর-বিহীন জমিতে বসবাস করতে পারবেন৷ সিধু ও কানু ঘোষণা করেন যে মহাজন ও ব্যবসায়ীরা এত দিন ধরে সান্তালদের উপর অন্যায়ভাবে যে সুদের বোঝা চাপিয়েছে তা রদ করে ১ টাকা ঋণে ১ পয়সা সুদ দিলেই চলবে৷

ঠিক হয়, দীর্ঘমেয়াদি নির্যাতনের জন্য সান্তাল বিচারসভায় জবাবদিহি করতে হবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে৷ ভাগলপুর আর বীরভূমের কমিশনার, কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, দিঘি ও তিকরি পুলিশ স্টেশনের দারোগা আর কিছু জমিদারের বিরুদ্ধে অভিযোগের খতিয়ান তৈরি করে অভিযোগপত্র পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় সান্তাল সমাজের স্বীকৃত মোড়ল বা মাঝি কির্তা, ভাদো আর সুনো মাঝির উপর৷ সরকারিভাবে অভিযোগের নথি প্রমাণ করে যে নিজস্ব রীতিনীতি অনুযায়ী শেষবারের মতো আপস-নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছিল সান্তালরা৷ যেহেতু স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোনও সাড়া মেলেনি সেহেতু ৭ই জুলাই ১৮৫৫ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ভগনাডিহি থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে কলকাতায় বড়লাটের কাছে যাওয়া হবে ইউরোপীয় আধিকারিক, মহাজন, ব্যবসায়ী ও জমিদারদের অত্যাচারের থেকে প্রতিকারের পথ জানতে চেয়ে৷

সান্তালদের সমবেত হওয়ার খবর শুনে দিঘি থানার কুখ্যাত দারোগা মহেশলাল দত্তের কাছে সিধু ও কানুর নামে মিথ্যা চুরির অভিযোগ দায়ের করেন মহাজনরা। দারোগা সিধু ও কানুকে গ্রেপ্তার করতে এলে নিহত হন। কুখ্যাত আরও পাঁচজন বাঙালি মহাজন— মানিক চৌধুরী, গোরাচাঁদ সেন, সার্থক রক্ষিত, নিমাই দত্ত ও হারু দত্তকেও হত্যা করা হয়। বিহারের গোড্ডা, পাকুড়, মহেশপুর, ভাগলপুর এবং বাংলার বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অবর্ণনীয় উৎপীড়ন ও ধ্বংসলীলার মুখেও সান্তালদের নৈতিক অবস্থান। ভুললে চলবে না ত্রিভুবন মাঝির নেতৃত্বে দুজন ইউরোপীয় মহিলা ও শিশুর হত্যা ঘটলে সিধু ও কানু তাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। ই জি মান লিখেছেন যে সান্তালরা বিষাক্ত তীর ব্যবহারে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের সময়েও ইংরেজদের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করেননি।

অপরদিকে নিজেদের নৃশংসতার কথা স্বীকার করে মেজর ভিনসেন্ট জার্ভিস তাঁর ডায়েরিতে লেখেন: “আমরা যা করেছি সেটা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা। আত্মসমর্পণ কাকে বলে সান্তালরা জানত না। তাদের যুদ্ধমাদলের আওয়াজ যতক্ষণ শোনা যেত, ততক্ষণ দলের সবাই দাঁড়িয়ে থাকত… তারা ছিল আমার দেখা বিশ্বাসভাজনদের অন্যতম৷ তাদের সাহসিকতা তারিফ করার মত।”

১৮৫৬র ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিধুকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ মতান্তরে অনেকে বলেন তাঁর ফাঁসি হয়েছিল৷ ভাগলপুরে ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে চাঁদ ও ভৈরো প্রাণ হারান৷ পুরুষবেশে এক সান্তাল নেত্রীও মৃত্যুবরণ করেন। নতুন গবেষণায় জানা গেছে সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরোর বোন ঝানো ও ফুলো মুর্মু ২১ জন ব্রিটিশ সেনাকে ঘায়েল করেন। ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কানুকে গ্রেপ্তার করে প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এক ইংরেজ লিখেছিলেন যে পনেরো থেকে পঁচিশ হাজার সান্তাল মানুষের রক্তে ভেসে যায় বীরভূম থেকে ভাগলপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ।

বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তাদের কাগজ ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ ও ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-তে লেখে, ইংরেজদের প্রতিটি পরাজয় ও হত্যার প্রতিশোধ যেন এতটাই ভয়ঙ্কর হয় যাতে সান্তালরা ভবিষ্যতে বিদ্রোহের প্রতিস্পর্ধা না দেখাতে পারে। এমন মতামতও দেন যে ‘অসভ্য’, ‘কুৎসিত’, ‘কালো ভূত’ সান্তালদের যেন বার্মার ভয়ানক জঙ্গলে নির্বাসনে পাঠানো হয় অথবা গুলি করে বা ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। আদালতে ১২৫১ জনকে অভিযুক্ত করা হয় যার মধ্যে ১৯১ জন সান্তাল আর বাদবাকি অন্যান্য নিম্নবর্ণের হিন্দু মানুষ। অভিযুক্তদের ৭৬ জন ছিল নয়-দশ বছরের বালক, যাদের বেত্রাঘাতে দণ্ডিত করা হয়। অন্যদের সাত থেকে চোদ্দ বছরের কারাগার বাস বা দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়।

 

ফলাফল, প্রাসঙ্গিকতা

আসা যাক বস্তুগত ফলাফলে। সান্তাল বিদ্রোহের ফলে ভারতবর্ষের মানচিত্রে প্রকাশ পায় একটি নন-রেগুলেশন জেলা— সান্তাল পরগণা। ৩৭ আইন দ্বারা দামিন-ই কোহ, বীরভূম ভাগলপুর থেকে কিছু অংশ নিয়ে গড়া এই পরগণায় ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। বিদ্রোহের প্রচণ্ড আঘাত থেকে শাসকগোষ্ঠী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে যে শক্তি পরীক্ষায় পরাহত হয়েও আত্মসমর্পণের চিন্তা মনে না এনে যারা আত্মবলিদান দিতে পারে, তাদের সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণের অবাধ মিশ্রণের ফলে বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হবে জায়গায় জায়গায়। ভাগলপুরের কমিশনার জর্জ ইউলের অধীনে এই স্বতন্ত্র জেলা ন্যস্ত হয়। পাঁচটি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিভক্ত এই জেলায় পাঁচজন সহকারী কমিশনার ও চারজন উপসহকারী কমিশনারের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব ন্যস্ত হলেও সান্তাল সমাজের পরম্পরাগত পরিকাঠামোকে স্বীকৃতি দিয়ে মোড়ল বা মাঝির হাতেই বিচারব্যবস্থা ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। এই জেলার বেসরকারি ও রাজস্বসংক্রান্ত স্ট্যাম্প ডিউটি রদ করা হয়। পুলিশি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়। সহকারী কমিশনার ও অভিযোগকারীর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রয়োজন রদ করা হয়। দুমকা, রাজমহল ও গোদ্দায় আদালত স্থাপন করা হয়। সান্তালদের ওপরেই দায়িত্ব দেওয়া হয় অপরাধী ও সাক্ষী পেশ করার। ঋণের ওপর সুদ ও রাজস্ব হ্রাস করা হয়। সান্তালদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে আনাদিবাসীদের হাতে জমি হস্তান্তর রদ করা হয় এবং অধিকাংশ জমিই পূর্বতন সান্তাল অধিবাসীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সাবেকি সংস্কৃতি রক্ষা পেলেও সান্তালদের স্থায়ী বাসভূমির স্বপ্নসম্ভব কল্পনার বাস্তবায়ন হয়নি। জীবিকার তাগিদে অসমের চা বাগানে ‘বাঁধা শ্রমিক’ বা ‘কুলি’-র জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়।

তবে তাতে সান্তাল হুলের প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না। নতুন গবেষণায় জানা যায় যে হুলের পরেও আর্থ-সামাজিক অসাম্য ও দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে সান্তালরা প্রতিবাদ জানিয়েছে বারংবার। মেহনতী মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করা ঐক্যবদ্ধ সান্তালরা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম গণফৌজ তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, ঘটিয়েছিল সুদূরপ্রসারী জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ। ১৮৫৫ সালে সান্তাল বিদ্রোহ যে গণসংগ্রামের নিশান তুলে ধরেছিল, যে বিদ্রোহের মাদল তারা বাজিয়েছিল, তা অনুপ্রেরণা জোগায় ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের, ১৮৯০-এর নীল বিদ্রোহের, ১৮৭৫-৭৬-এ মহারাষ্ট্রে কৃষক আন্দোলনের। এই বিদ্রোহ শিক্ষা দেয় যে সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধটাই বড় কথা, পরাহত হওয়াটা নয়। সান্তাল লোকগান, লোককথা, চারণগীতিতে হুল সম্ভাবনাময় বর্তমানের কথা যেমন বলে, স্বপ্নসম্ভব নবজাগরণের প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিতও দেয়। এই বিদ্রোহ সান্তাল জনগোষ্ঠীর আদিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনচর্চাতে আনে পরিবর্তন৷ যেকোনও বিক্ষোভ বা বিরুদ্ধতার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুত থাকা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে ছোটনাগপুর, ওড়িশা ও দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের সান্তালরা যোগদান করেন৷ ১৮৫৮ সালে পূর্বনির্ধারিত শিকারের দিন না হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য সান্তাল দেওঘরে তীর-ধনুক নিয়ে সমবেত হয়। ১৮৭১ সালে তারা আদমশুমারির সমীক্ষার বিরোধিতা করে, বিক্ষোভ দেখায়। ১৮৭৪-৮১ পুনরুত্থানবাদী আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারমূলক খেরওয়াল আন্দোলন শুরু করেন তারা। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা ময়ূরভঞ্জে সান্তাল শ্রমিক জোগাড় করছিল, তখন বিক্ষোভ দেখায় সান্তালরা।

 

এবং, বর্তমান

সেই বিদ্রোহের আগুন আজও নেভার কোনও কারণ ঘটেনি স্বাধীনতার ৭২ বছর পর। অরণ্যের অধিকার আইনে (২০০৬) নতুন সংশোধন এনে বনাঞ্চল থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে। উদ্দেশ্য খনিজ সম্পদশালী তফসিলি জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো দেশি বিদেশি কর্পোরেট বৃহৎ পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া। সংবিধান অনুযায়ী এই অঞ্চলগুলিতে তাঁদের পূর্ণ স্বশাসনের অধিকার আছে। তা ছাড়া পঞ্চায়েত আইন (১৯৯৬) অনুযায়ী এই সব অঞ্চলে আদিবাসী গ্রামসভা-ই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁদের অনুমোদন ও সিদ্ধান্ত ছাড়া সরকার ‘উন্নয়ন’-এর নামে কোনও অনাদিবাসীকে জমি বেচতে বা হস্তান্তর করতে পারে না। কর্পোরেটের স্বার্থে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলছে আদিবাসীরা।  ২০১৩-১৪য় আমরা দেখি ওডিশার কালাহান্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ে বেদান্ত অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড নিয়মগিরি পাহাড় খনন করে বক্সাইট উত্তোলন করার প্রস্তাবে সরকার রাজি হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় ডোংরিয়া কোন্ধ জনজাতির মানুষেরা কী প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২০১৬-১৭য় ঝাড়খণ্ড সরকার যখন ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট-এর সংশোধন এনে আদিবাসীদের জমিকে ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য হস্তান্তর করতে চায় তখন খুনতি, গুমলা, সিংভূম, পশ্চিম সিমডেগার আদিবাসীরা জল, জঙ্গল, জমির লুট প্রতিরোধের জন্য অভিনব পাতালগড়ি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তফসিল জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের জন্য সংবিধানের অংশবিশেষ পাথরের ওপর খোদাই করেন তারা।

এই রাজ্যে ১৬ অগস্ট ১৯৯২ সালে লোধাশবর জনজাতির প্রথম স্নাতক চুনি কোটাল লাগাতার জাতভিত্তিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে আত্মহননের পথ বেছে নেন। তফসিলি জাতি ও জনজাতি (নির্যাতন নিরোধ), ১৯৮৯ আইন মোতাবেক সেই অপরাধের শাস্তি আজও মেলেনি। ১৬ অক্টোবর ২০১৭-র খবরে জানা যায় যে, তফসিলি জাতি-জনজাতি সংক্রান্ত জাতীয় কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে, দলিত ও আদিবাসীদের উপর অপরাধের নিরিখে এই রাজ্য দ্বিতীয়, এবং সরকার সে ব্যাপারে শুধু উদাসীনই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে। তথ্যে এটা স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী গোষ্ঠী শিক্ষা, জীবিকা, আর্থিক অবস্থা, জীবনধারণের মানের নিরিখে অবহেলিত গোষ্ঠী এবং তাদের অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় গড়ের নীচে। একদিকে বেড়ে চলেছে আদিবাসীদের ওপর হিংসাত্মক ঘটনা আর অপরদিকে লঘু করা হচ্ছে তফসিলি জাতি ও জনজাতি (নির্যাতন নিরোধ) আইন।

ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট জাতিবৈষম্যমূলক ‘সামাজিক দূরত্বের’ মনোভাবের সুগভীর শিকড় কোভিড-১৯-হীন ব্যবহারিক জীবন থেকে কোনওদিনই উৎপাটিত হবে না হয়তো। আদিবাসীদের হাজার হাজার বছরের বঞ্চনা, অবহেলা, শোষণ ও শাসন যন্ত্রণার ইতিহাসও পাল্টাবে না অদূর ভবিষ্যতে। তবে আপসহীনতা আদিবাসীদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য কিনা। তাই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে জারি থাকবে তাদের মৃত্যুহীন শৌর্যবীর্য ও প্রতিরোধ। ফুলো মুর্মু আর ঝানো মুর্মুর প্রতিস্পর্ধা যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখবেন হাজারো থাংজম মনোরমা আর সোনি সোরি-রা। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

 

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4245 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...