ভুলে-যাওয়া মানে

হুমা ইউসুফ

 

হুমা ইউসুফ পাকিস্তানের একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। বর্তমান নিবন্ধটি ডন পত্রিকার সৌজন্যে প্রাপ্তলেখাটি ডন’-এ ১৪ই আগস্ট প্রকাশিত হয়েছেএই লিংকে মূল রচনাটি লভ্য।

 

 

স্বাধীনতা দিবস। স্মরণ আর উদযাপনের একদিন। সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। কিন্তু, কার থেকে স্বাধীনতা– এটা আপনি শেষ কবে চিন্তা করে দেখেছেন?

১৪ই আগস্ট-এর থেকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে মুছে দেওয়া হয়েছে অনেককাল আগেই। এই দিনটি এখন স্বাধীনতার কথা ভুলে শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়ের একটা সস্তা অবতারের অর্চনা করবার দিন। আমার কাছে এই দিনটা সবুজ-সাদা পতাকায় মোড়ানো, রঙচঙে জামা পরে কিশোরী বয়সে স্কুল যাওয়ার রোমাঞ্চ, একটা ফ্রি কোক বা আইসক্রীম পাওয়া, আর গান। ঘুরে ফিরে একই কথা— দিল দিল পাকিস্তান; জীয়ে জীয়ে জীয়ে পাকিস্তান; হাম দেখেঁ আজাদ তুঝে, হাম দেখেঁ আজাদ। সহজ গানের কলি শুনলে মনে হবে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়ে ওঠাটা এমন কিছুই কঠিন নয়। সকলে গলা মিলিয়ে গান করো আর ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তোল।

স্বাধীনতা দিবস পালনের সঙ্গে স্বাধীনতার ধারণা খুব সুসংলগ্ন নয়। পতাকা নাড়ানোর উত্তেজনা থিতিয়ে পড়লে যে বিষয়টার মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হয় তা হল দেশভাগ। সিটিজেনস আর্কাইভ অফ পাকিস্তান এবং ১৯৪৭ পার্টিশন আর্কাইভের মতো মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পগুলির ক্রমাগত সংখ্যাবৃদ্ধি, এবং তার সাথে সাথে দেশভাগের গল্প সংগ্রহ করার জন্য মিডিয়া আউটলেটগুলির মরিয়া চেষ্টার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই সব মনে-করানোগুলোর মধ্যে দিয়ে দেশভাগের প্রেক্ষিতটাই এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক নয়।

দেশভাগের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ দিন দিন সহজলভ্য হতে থাকলেও এ বিষয়ে সীমান্তের দুই পাশেই একটা নীরবতা বিরাজ করে, এবং এটা করবেও। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই নীরবতার কারণ– সেই কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানো– যে ভয়াবহ হিংসা এবং বাস্তুচ্যুতির মধ্যে দিয়ে তার বাসভূমি অর্জিত হল, তার কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? আর ভারতের ক্ষেত্রে এই এক দেশভাগ আরও দেশভাগের ভয় দেখায়, যুক্তরাষ্ট্রের আরও অঙ্গহানির আশঙ্কা তৈরি করে। বিষয়টা অস্বস্তিকর, ঠিকই। তবুও পাশ না কাটিয়ে এর মোকাবিলা করাটাই বাঞ্ছনীয়। বস্তুত, দেশভাগের মতো এত কম তথ্যসম্বলিত আর এত কম আলোচিত এরকম বড় ঐতিহাসিক ঘটনা আর খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু তবু দেশভাগ মানেই স্বাধীনতা নয়।

যে স্বাধীনতা আজ আমাদের পালনীয় তা পাওয়া গেছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে। ভারতে স্বাধীনতার ধারণাকে এখনও ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করা হয়। এই বছরেই শশী থারুর বলেছেন কীভাবে বৃটিশ রাজ উপমহাদেশকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে, এবং এ-জন্য তাদের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত। এজন্য তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সঙ্গে আমাদের ঔপনিবেশিক অতীতের সম্পর্ক অনেকটাই দূরবর্তী, ফলে অনেক কম প্রাসঙ্গিক।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পশ্চিম-বর্জনের যে আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাওয়া গেছে (মূলত অ্যামেরিকাবিরোধী মনোভাবের মাধ্যমে) তাকে আমাদের জাতীয় মানসের ওপর ঔপনিবেশিক ইতিহাসের তিক্ত অভিজ্ঞতার একরকম প্রকাশ হিসাবে আমরা দেখতে পারি। মার্কিন চাপ ও হস্তক্ষেপের নিন্দা করতে গিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহে আমরা ব্যবহার করেছি সার্বভৌমত্বের ভাষা। তবে এরও একটা সমালোচনামূলক দিক আছে। নিন্দুকেরা বলে, আমরা একদিকে মার্কিন অসামরিক এবং সামরিক সাহায্য চাইছি, কোয়ালিশন সাপোর্ট ফান্ড প্রত্যাশা করছি, যুদ্ধবিমান চাইছি, আই এম এফ-এর সাথেও দহরম মহরম চালাচ্ছি, আর অন্যদিকে সার্বভৌমত্বের দাবি করছি। এই ধরনের স্বাধীনতা আসলে একটি রাজনৈতিক চাল, কিছু বেশি ছাড় মেলার জন্য পাওয়া।

স্বাধীনতার অর্থটাই সম্ভবত ভুলতে বসেছি আমরা। পরমুখাপেক্ষী হওয়া নয়। নিজের বলে বলীয়ান হওয়া। অন্যের নাক-গলানো ছাড়াই নিজের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হওয়া। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অতীতের উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ধারণাটা আমাদের যথেষ্ট গভীরে ঢোকেনি যা দিয়ে ঔপনিবেশিকতার সম্পর্ককে আমরা সত্যকারের বর্জন করতে পারি। আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাস তাই এক দালাল রাষ্ট্রের ইতিহাস: কখনও আমেরিকার, কখনও সৌদির, কখনও চীনের। আমাদের স্কুলের বাচ্চারা মান্দারিন শিখছে, আর আমরা আমাদের বন্দর, রাস্তা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্টক এক্সচেঞ্জ, ডিজিটাল পরিকাঠামো, সব চীনের হাতে তুলে দিচ্ছি। আমাদের এই প্রশ্নটা আবারও জিজ্ঞেস করতে হবে, কীসের স্বাধীনতা আমরা উদযাপন করছি? কার থেকে স্বাধীনতা?

আসল কথা হল, ইতিহাসকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস ভারতের থেকে আলাদা। ভারতই যেন আমাদের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের সবথেকে বড় শত্রু– সুচতুরভাবে এমন একটা কথাও বিশ্বাস করানোর চেষ্টা চলছে। আমাদের ইতিহাস– হাস্যকরভাবে একনায়কতন্ত্র ও সামরিক শাসনের  অধীনে আমাদের স্বাধীন ইতিহাস– এই পুনর্নির্মাণ ঘটিয়েছে এবং একটা প্যারানয়া তৈরি করছে যে, ভারতীয় আগ্রাসনই আমাদের স্বাধীন, সার্বভৌম সত্তার কাছে প্রধান বিপদ। স্বাধীনতা দিবসে আমরা যে জাতীয়তাবাদ উদযাপন করি, সেটা একদমই ভারত-বিরোধী অবস্থান দিয়ে সংজ্ঞায়িত, অন্য কিছু দিয়েই নয়। কিন্তু এমন একটা শক্তির থেকে স্বাধীনতা উদযাপন কিভাবে করতে পারা সম্ভব– যে কখনও পাকিস্তানের শাসক ছিলই না, এবং ভবিষ্যতেও যে থাকবে সে সম্ভাবনা বিরল?

স্বাধীনতার সমস্যা হল, এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে দায়িত্ব নিতে হয়— কক্ষপথের, দৃষ্টির, ভবিষ্যতের। এই ৭০ বছর পার করেও সেটা আমরা নিতে চাই বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, এই ছুটির দিনটার কয়েক দিন আগেই সেনেট সংসদকে শক্তিশালী করার এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আন্তঃ-প্রতিষ্ঠান আলাপ আলোচনা চালানোর ডাক দিয়েছে। এই ধরনের মিটিং গুরুত্বপূর্ণ কারণ পাকিস্তানে প্রায় প্রতিটা প্রতিষ্ঠানই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্বীপের মতন কাজ করছে। রাষ্ট্রের থেকে নিজেদের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর তাই এই ধরনের স্বাধীনতা উদযাপন অর্থহীন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. উরিব্বাস! কী করেছেন মশাই! বাংলা ওয়েবম্যাগে পাকিস্তানের স্বাধীনতা নিয়ে এমন লেখা!! চালিয়ে যান… অসাধারণ…

Leave a Reply to ক.ব. Cancel reply