অরবিন্দ-রবীন্দ্রনাথ: ‘নমস্কারে’র রকমফের

অরবিন্দ-রবীন্দ্রনাথ: ‘নমস্কারে’র রকমফের -- অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

 


লেখক নিবন্ধকার; ভারতের নবজাগরণ সম্পর্কে অনিসন্ধিৎসু

 

 

 

১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর ইওরোপ ভ্রমণের সময় একটি বিমানে চড়ে লন্ডন থেকে পারী যাত্রা করেন, তখন সেটি বিশেষভাবে আলাপ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল, কারণ এটি ছিল তাঁর প্রথম বিমানযাত্রা। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর এই আকাশপথে ভ্রমণ নিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কার্টুন আঁকেন, যাতে দেখা যাচ্ছে, একটি চেয়ারে বসে রবীন্দ্রনাথ নিরালম্ব শূন্যে ভাসছেন, এক হাতে তিনি চেপে রেখেছেন তাঁর মাথার বাহারী টুপি, বাতাসে উড়ছে তাঁর ধব্‌ধবে সাদা দাড়ি, তারকাখচিত আকাশে মেঘের মধ্য দিয়ে তাঁর এই উড়ানে তাঁর সঙ্গে ভাসছে  তাঁর চশমা, তাঁর লেখার খাতা ও কলম। এখানে এই কাল্পনিক দৃশ্যটির কথা উত্থাপনের কারণ, অনেকটা ওই ধরনেরই একটি বাস্তব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল ১৯২৮ সালের গ্রীষ্মে রবীন্দ্রনাথের দাক্ষিণাত্য সফরের সময়। পণ্ডিচেরির জাহাজঘাটায় তোলা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে শূন্যে ঝুলন্ত একটি ড্রামের ভেতর বসে আছেন গগন ঠাকুরের আঁকা ঐ ছবির মতোই একটি টুপি মাথায় রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সঙ্গে একজন মহিলাকেও দেখা যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের জীবনকথার পাঠকেরা জানেন, ঐ মাদ্রাজ ভ্রমণের সময়তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। প্রশ্ন হতেই পারে, এ রকম অস্বাভাবিক একটি বাহনে আরোহন করে অসুস্থ শরীরে তিনি এতটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন কেন বা কোন তাগিদে! এর পেছনের ঘটনাটি হল, মাদ্রাজ থেকে তিনি সেদিন যাচ্ছিলেন পণ্ডিচেরি। তাঁর জাহাজ পণ্ডিচেরির জেটিতে ভেড়ানো সম্ভব না হওয়ায় একটি পিপের মধ্যে তাঁকে ও যাত্রাসঙ্গী নির্মলকুমারী মহলানবিশকে বসিয়ে ক্রেনের সাহায্যে তুলে একটি নৌকোয় নামিয়ে দেওয়া হয় ও সেই নৌকোয় তাঁরা স্থলভূমিতে অবতরণ করেন। প্রবাসীতে [শ্রাবণ, ১৩৩৫] প্রকাশিত এক লেখায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ভাঙা শরীর নিয়ে যথেষ্ট কষ্ট করেই নামতে হল— তা হোক অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়েছে।……”

হ্যাঁ, সতেরো বছর আগে রাজনীতি ও বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত ও সে-সময় যোগীতে রূপান্তরিত তাঁর প্রিয় মানুষ অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে দেখা করার বাসনা পূরণই ছিল রবীন্দ্রনাথের এতটা কষ্ট স্বীকার করার  কারণ। পরে রবীন্দ্রনাথ প্রবাসী পত্রিকায় ‘অরবিন্দ ঘোষ’ শিরোনামে প্রকাশিত পূর্বোক্ত রচনাটিতে লিখেছিলেন: “অনেকদিন মনে ছিল অরবিন্দ ঘোষকে দেখব। সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল। ……প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝলুম ইনি আত্মাকেই সত্য করে চেয়েছেন, সত্য করে পেয়েওছেন।…” ইত্যাদি। লেখাটির উপসংহারে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: “অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম, সেখানে তাঁকে জানিয়েছি— অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার। আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে, অপ্রগলভ স্তব্ধতায়— আজও তাঁকে মনে মনে বলে এলুম— অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।”

এখানে রবীন্দ্রনাথ অরবিন্দের অতীত জীবনের যে ‘ক্ষুব্ধ আন্দোলনে’র কথা ও সেই পর্বে অরবিন্দকে তাঁর যে-নমস্কার নিবেদনের কথা বললেন, সেই ইতিহাস ও তাঁর উদ্ধৃত কবিতার ছত্রগুলির সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন বাঙালি বোধহয় খুব বেশি নেই। কিন্তু এখানে যে প্রশ্নটি আমাদের ভাবায়, সেটি হল, ১৯০৬-০৭ সালের যে-অরবিন্দকে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখে প্রণতি জানিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন ব্রিটিশশাসিত ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিদার এক আপসহীন চরমপন্থী রাজনীতির প্রবক্তা আর ১৯২৮ সালে যে অরবিন্দকে ‘তপস্যার আসনে’ দেখে তিনি তাঁর সেই নমস্কারের পুনরাবৃত্তি করলেন, তিনি যৌগিক অধ্যবসায়ে প্রবৃত্ত এক পরিবর্তিত অরবিন্দ, যাঁর সঙ্গে তখন ঘোষিতভাবেই ব্রিটিশ শাসন বা স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও যোগাযোগ নেই। কাজেই এই দুই অরবিন্দের জীবনদর্শন বা কর্মপন্থা যখন স্পষ্টভাবেই আলাদা, তখন তাঁর উদ্দেশে নিবেদিত রবীন্দ্রনাথের এই নমস্কার দুটির প্রকৃতি কী করে একরকম হতে পারে! এই দুই অরবিন্দের অবস্থান ও  কর্মপদ্ধতি যখন ভিন্ন ও অনেক সময় বিপরীতমুখী, তখন রবীন্দ্রনাথ কেন বা কোন প্রেরণায় অরবিন্দের এই দুটি মূর্তিকেই তাঁর দ্বিধাহীন নমস্কার নিবেদনে একইরকমভাবে তৎপর!

এই প্রসঙ্গে আমাদের পর্যবেক্ষণটি স্পষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথের বহুল প্রচারিত ওই কবিতা রচনার পটভূমিটি দেখে নেওয়া যায়। বরোদায় রাজ সরকারে চাকরি করার সময়েই অরবিন্দ কংগ্রেসে জাতীয়তাবাদী নামে পরিচিত চরমপন্থী গোষ্ঠীটির একজন নেতা হিসেবে ও পত্রপত্রিকায় ধারালো প্রবন্ধ লিখে ভারতের শিক্ষিত মহলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ১৯০৭ সালে চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসার পর অরবিন্দ যখন জাতীয় শিক্ষাপরিষদে যোগ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পেলেন সহকর্মী রূপে, আর তিনি যখন ‘বন্দে মাতরম্‌’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদকরূপে যোগ দেন, তখন প্রথম প্রথম রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে পাই তার মুগ্ধ পাঠক রূপে। এ-সময় এই পত্রিকা পূর্ণ স্বরাজের বাণী প্রচার করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছে, পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীতে একাধিক লেখক থাকলেও যে কারণেই হোক, সাধারণ মানুষের মধ্যে তখন এমন ধারণা প্রচলিত যে, অরবিন্দ একাই সেই পূর্ণ স্বাধীনতার বাণীর উদ্গাতা। রবীন্দ্রনাথও যে এমন ধারণার শরিক, তা বোঝা যায় পত্রিকাটি সম্পর্কে নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথকে তিনি যখন লেখেন, “ওটা খুব ভালো কাগজ হয়েচে। কিন্তু অরবিন্দকে যদি জেলে দেয়, তা হলে ও কাগজের কি দশা হবে জানিনে… আমাদের দেশে জেল খাটাই মনুষ্যত্বের পরিচয় হয়ে উঠবে।” (২৬.৮.১৯০৭)

‘বন্দেমাতরম্‌’ পত্রিকাটির মাধ্যমে প্রচারিত ‘ইন্ডিয়া ফর ইন্ডিয়ানস’-এর যে-বাণী, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব অরবিন্দেরই, জনমনের এই বিশ্বাস আরও জোর পেয়ে যায়, যখন সে-বছরই আগস্টে ‘বন্দেমাতরম্‌’-এর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করে সম্পাদক হিসেবে শুধু অরবিন্দের নামেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ‘‘অরবিন্দকে যদি জেলে দেয়…”— রবীন্দ্রনাথের এই রোমান্টিক কল্পনা প্রায় বাস্তবায়িত হবার উপক্রম হলেও অরবিন্দ শেষ পর্যন্ত তার সুযোগ দেন না আদালতে আত্মসমর্পন করে জামিন নিয়ে। এই সময়েই (আগস্ট, ১৯০৭) রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেন, তাঁর সেই বহুশ্রুত ‘নমস্কার’ কবিতাটি: “অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার!/ হে বন্ধু, হে দেশবন্ধু, স্বদেশ-আত্মার/ বাণীমূর্তি তুমি।……” ইত্যাদি।

এই কবিতাটি আমাদের মধ্যে অনেকেই পড়েছেন, তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, অরবিন্দের ভূমিকা যতক্ষণ এক আপসহীন জাতীয়তাবাদী লেখক বা অগ্নিবর্ষী সম্পাদকের, ততক্ষণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুক্তিবাণীর সমর্থক, কবিতায় তিনি পরিষ্কারভাবে সমর্থন করেন ‘বন্দে মাতরম্‌’ পত্রিকায় উচ্চারিত ‘ইন্ডিয়া ফর ইন্ডিয়ান্‌স’ দাবিটিকে—

যার লাগি কবি বজ্ররবে
গেয়েছেন মহাগীত, মহাবীর সবে
গিয়াছেন সঙ্কটযাত্রায়, যার কাছে
আরাম লজ্জিত শির নত করিয়াছে,
মৃত্যু ভুলিয়াছে ভয় — সেই বিধাতার
শ্রেষ্ঠ দান আপনার পূর্ণ অধিকার
চেয়েছ দেশের হয়ে অকুণ্ঠ আশায়
সত্যের গৌরবদৃপ্ত প্রদীপ্ত ভাষায়
অখণ্ড বিশ্বাসে।…… 

এর পর আরও অগ্রসর হয়ে তাঁকে তিনি বর্ণনা করেন সেই ‘রুদ্রদূত’ বলে, যাঁকে “কারাগার করে অভ্যর্থনা”।, কারণ তখন তাঁর মাথায় ছিল অরবিন্দের বিরুদ্ধে সদ্য দায়ের করা রাজদ্রোহের মামলার কথা, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, তাঁর কারাদণ্ড হবে ও তাঁর সেই সম্ভাব্য লাঞ্ছনাভোগের জন্য হয়তোবা আগাম বন্দনাও রচনা করে রাখতে চেয়েছিলেন ওই কবিতার ছত্রে ছত্রে। কিন্তু পরে সেই কারাগারে ফাঁদ কাটিয়ে মামলা থেকে খালাস পেয়ে অরবিন্দ যখন বেরিয়ে আসেন (সেপ্টেম্বর, ১৯০৭), তখন রবীন্দ্রনাথ কার্যত তাঁর প্রিয় নায়ক একটি গৌরব থেকে বঞ্চিত হওয়াতে যেন কিছুটা নিরাশই হন। দায়মুক্ত অরবিন্দকে যখন রবীন্দ্রনাথ অভিনন্দন জানাতে গিয়ে সাশ্রুনেত্রে জড়িয়ে ধরেন ও শেষ পর্যন্ত কারাগারে যেতে না হওয়ায় তাঁকে বলেন, “আপনি আমায় ফাঁকি দিলেন”, তখন রবীন্দ্রনাথের ভাবাবেগটি বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এ পর্যন্ত সমস্তই চমৎকার এবং বোধগম্য! কিন্তু এ পর্বটি ছিল বড়ই ক্ষণস্থায়ী এবং গণ্ডগোলের সূচনা এর ঠিক পরেই। ডিসেম্বরে সুরাটে কংগ্রেসের অধিবেশন যখন নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মতবিরোধে পণ্ড হয়ে যায়, তখন রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত হয়ে “ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করিয়া” এই ‘কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের অভিনয়’কে ধিক্কার দিলেন (‘যজ্ঞভঙ্গ’ প্রবন্ধ)। প্রধানত তিলক আর অরবিন্দ সেখানে চরমপন্থীদের নেতৃত্ব দিলেও কংগ্রস অধিবেশন পণ্ড করেছিলেন অরবিন্দের অনুগামীরা এককভাবে তাঁরই নির্দেশে। এসব তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথের এগুলি না জানার কথাও নয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, তিনি এই ঘটনার নিন্দা করার সময়ে চিঠিতে বা প্রবন্ধে একবারও অরবিন্দের নামোল্লেখ তো করলেনই না, এমনকি এর পরের বছর (ফেব্রুয়ারি, ১৯০৮) পাবনায় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ দেওয়ার সময়ে, যখন অরবিন্দ সেখানে সশরীরে উপস্থিত, সুরাটের ঘটনার নিন্দা করার পরিবর্তে তাকে কংগ্রেসের প্রাণশক্তির পরিচয় বলে শংসাপত্র দিয়ে বসলেন! এখানেও প্রশ্ন উঠতেই পারে, যে, এই অদ্ভুত মতপরিবর্তন কি সভাপতি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের দু পক্ষকে শান্ত করার কৌশল, না কি অরবিন্দকে সামনাসামনি সমালোচনা করার অপ্রিয় কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা, যার পেছনে অরবিন্দ সম্পর্কে তাঁর এক পূর্বসঞ্চিত ব্যাখ্যাতীত দুর্বলতা কাজ করে থাকতে পারে! তিনি অরবিন্দের প্রতি পূর্বে উচ্চারিত তাঁর নমস্কারটিকে যেন কিছুতেই ‘ব্যর্থ নমস্কারে’ পর্যবসিত হতে দিতে চাইছেন না!

অরবিন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই ‘কোমল’ মনোভাবটি রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর অবস্থানের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, সেটাও একটা ভেবে দেখার মতো ব্যাপার। শুধু তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটির মাধ্যমেই নয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাবনা-অভিভাষণেও নরমপন্থী-চরমপন্থী দু পক্ষকেই ডাক দিয়েছিলেন নিজেদের চেষ্টায় এক একটি আত্মনির্ভর পল্লীসমাজ গড়বার। রবীন্দ্রনাথের এই তত্ত্ব তাঁদের পছন্দ হোক বা না হোক, দু পক্ষই কিন্তু এ-ব্যাপারে ‘কাজে লাগবেন’ বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু নরমপন্থীরা এ ব্যাপারে কিছু কাজ শুরু করলেও চরমপন্থীরা যে একেবারেই নিশ্চেষ্ট হয়ে চরমের কথা ভেবেছেন, “এঁদের দ্বারা একটি অতি ক্ষুদ্র কাজও হয়নি”— হতাশ হয়ে অবলা বসুকে একটি চিঠিতে (এপ্রিল, ১৯০৮) রবীন্দ্রনাথকে এমন কথা লিখতে দেখা যায়, কিন্তু এখানেও চরমপন্থীদের সমালোচনা প্রসঙ্গে একবারও তিনি তাদের নেতা অরবিন্দের নাম করেন না!

চরমপন্থীদের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রচারিত কর্মসূচিতে এই অনীহা অবশ্য আদৌ আশ্চর্য নয়, কারণ চরমপন্থীদের দুই পত্রিকায় (‘যুগান্তর’ ও ‘বন্দে মাতরম্‌’) এই গোটা সময়টি ধরে অরবিন্দ ও তার সহকর্মীরা রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ করে ও না করে ক্রমাগত তাঁর নানা রাজনৈতিক মতের বিরোধিতা করে আসছিলেন।  দেশের উন্নতিসাধনে আত্মশক্তি প্রয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্বরাজের অপেক্ষায় থাকায় রবীন্দ্রনাথের আপত্তি ছিল, অপর পক্ষে অরবিন্দের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের তত্ত্ব অনুযায়ী রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সর্বপ্রথম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ না করে জাতির নৈতিক উন্নয়ন ও সমাজসংস্কারের চেষ্টা করাটা চূড়ান্ত মূর্খতা ও নিষ্ফল প্রয়াস। আমরা জানি যে, বিলিতিবর্জন বা বয়কটকে ও তা কার্যকর করতে জবরদস্তিকে রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত সমর্থন করতে পারেননি। কিন্তু অরবিন্দ ও চরমপন্থীরা বয়কটের শুধু ঘোর সমর্থকই নন, এর বিরোধীদেরও কড়া সমালোচক। বয়কটের সাফল্যের উদাহরণ দিয়ে অরবিন্দ লিখেছিলেন, “আমাদের রবীন্দ্রনাথ যেন বয়কটের চরম তাৎপর্য বিস্মৃত না হন।….. তা জনগণের দীর্ঘ অনুভূত বাসনাকে রূপায়নের প্রয়াস, যার বিকাশে ঋষি-কবি রবীন্দ্রনাথের দান যথেষ্ট।” (‘Why the Boycott succeeded’, বন্দেমাতরম্‌’, ৩০.৭.১৯০৭.) ‘বন্দে মাতরম্‌’-এর অন্যান্য রচনায় এর থেকেও কড়া ভাষায় কিছু ‘মোলায়েম মানবতাবাদী ব্যক্তি’র বয়কট সম্পর্কে আতঙ্ক ও অবিশ্বাসকে আক্রমণ করা হয়েছিল।

কাজেই এ ব্যাপারটা বেশ বিস্ময়কর ও রহস্যপূর্ণ মনে না হয়ে পারে না যে, রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে আক্রমণ করে যে-সময় ‘বন্দে মাতরম্‌’-এ এই সব রচনা ছাপা হচ্ছে, ঠিক সে-সময়েই রবীন্দ্রনাথ এটিকে ‘খুব ভালো কাগজ’ বলে প্রশংসা করছেন ও ভাবাবেগসিক্ত কবিতা লিখে অরবিন্দকে ‘নমস্কার’ জানাচ্ছেন! তবে কি তিনি অরবিন্দের বা পত্রিকাটির সব লেখা ভালো করে পড়তেন না? অথবা অরবিন্দের সঙ্গে নিজের মতের দুস্তর ব্যবধান লক্ষ করেও সে ব্যাপারে চোখ বুজে থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলেন? এখানে উল্লেখ্য যে, শুধু বয়কট নয়, স্বদেশী ডাকাতি ও রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা— বলপ্রয়োগের যে কোনও প্রয়াসকেই রবীন্দ্রনাথ অধর্ম ও বর্জনীয় বলে মনে করেছেন। অপরপক্ষে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় অর্থসংগ্রহের জন্য বলপ্রয়োগকে খোলাখুলিভাবেই  সমর্থন করা হয়েছিল। আবার সুরাট পর্বের পরেও নরম ও গরম এই দু পক্ষের দলাদলির বহিঃপ্রকাশ দেখে রবীন্দ্রনাথ যেতাঁর একদা প্রিয় ‘বন্দেমাতরম্‌’ পত্রিকাটির প্রতি ক্রমশ আকর্ষণ হারাচ্ছিলেন, তা বোঝা যায় ওই পত্রিকায় ‘‘স্বাধীনতার অভয় মন্ত্রপূর্ণ কোনও উদার কথা” আর পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর এই অভিমত থেকেও। কিন্তু জগদীশ বসুকে লেখা চিঠিতে (৮.১.১৯০৮) এই হতাশার কথা ব্যক্ত করেও রবীন্দ্রনাথ অরবিন্দ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন!

১৯০৮ সালের মে মাসে মজঃফরপুরে অরবিন্দের গুপ্তসমিতির এক কর্মীর ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার চেষ্টার পর তার সূত্র ধরে মানিকতলায় বোমার কারখানা আবিষ্কার ও অরবিন্দ সহ ওই সমিতির যুবকদের গ্রেপ্তারের পর যখন তাঁর এক নতুন ভূমিকা দেশের মানুষের সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল, তখন কিন্তু এক বছর আগে অরবিন্দের গ্রেপ্তারের সম্ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ যেমন উদ্দীপিত হয়েছিলেন তেমনটা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না, বরং এইসব ঘটনা তাঁদের দুজনের মতবাদগত দূরত্বকে আরও প্রশস্ত ও প্রকট করে তুলল। অরবিন্দের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীরা তাঁরই সিদ্ধান্ত বা অনুমোদন অনুযায়ী যেসব রাজনৈতিক ডাকাতি ও হত্যার প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাকে জাতির চরিত্রকে নষ্ট করে জাতিগঠনের চেষ্টার মতো ভয়ঙ্কর ভুল বলেই মনে করলেন ও যে “দস্যুবৃত্তি, তস্করতা ও অন্যায় পীড়ন দেশহিতের নাম ধরিয়া চারিদিকে সঞ্চরণ করিতেছে”, তাকে অধর্ম ও পাপ বলে তীব্র ভাষায় নিন্দা করলেন। (‘দেশহিত’ প্রবন্ধ)

কিন্তু গুপ্তবিপ্লবকে নিন্দা করেও বাংলাদেশে তার হোতা অরবিন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগাগোড়া নীরবতা আমাদের বিস্মিত না করে পারে না! আলিপুর বোমার ষড়যন্ত্রের মূল হোতারূপে অভিযুক্ত হয়ে অরবিন্দের এক বছর কারাবাসের সময় বা উকিলদের কেরামতিতে ঐ মামলা থেকে তাঁর রেহাই পাওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে আগের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি বটে, কিন্তু তাঁর ধিক্কৃত ‘পাপ’ ও ‘’অধর্মে’র পন্থার পথিক ও দিশারী হিসেবে অরবিন্দের নূতন পরিচিতিটি উদ্ঘাটিত হওয়ার পরেও কিন্তু অরবিন্দের প্রতি তাঁর সেই ‘নমস্কার’ কখনও প্রত্যাহার করেননি— আলিপুর মামলার সমকালে তো নয়ই, অরবিন্দের রাজনীতি ত্যাগ করে চলে যাওয়ার বহু বছর পরেও না! এ সব দেখে মনে না হয়ে পারে না যে, অরবিন্দ সম্পর্কে কোনও এক গোপন দুর্বলতা তাঁর মধ্যে আগাগোড়া কাজ করে যাচ্ছিল।

১৯১০ সালে অরবিন্দের রাজনীতি থেকে বিদায়ের পরেও রবীন্দ্রনাথ বারবার গুপ্তবিপ্লবের রাজনীতিকে ধিক্কার দিয়েছেন, কিন্তু অরবিন্দের প্রতি তাঁর সেই আবেগাপ্লুত ‘নমস্কার’ কখনও প্রত্যাহার করেননি, বরং নানা উপলক্ষে তার পুনরাবৃত্তি করেছেন ও সেই নমস্কারকে যুক্তিসিদ্ধ করতে এর নানারকম কারণ উপস্থিত করেছেন! রবীন্দ্রনাথের অরবিন্দ সম্পর্কে এই প্রশ্নহীন আনুকূল্য প্রসঙ্গে দুটি প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, তিনি কি বিপ্লব কাণ্ডে অরবিন্দের প্রত্যক্ষ দায়িত্বের কথা জানতেন না? অথবা তা শুনেও তিনি বিশ্বাস করেননি? দ্বিতীয়ত, প্রথমে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রবক্তা ও কংগ্রেসের এক জাতীয়তাবাদী নেতা, পরে গুপ্তবিপ্লবের হোতা ও তার পরে রাজনীতি থেকে অপসৃত ও অবসৃত এক আশ্রমবাসী যোগী— এই বিভিন্ন ভূমিকায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় অরবিন্দের প্রতি বিভিন্ন সময়ে নিবেদিত তাঁর নমস্কারগুলিও কি ছিল ভিন্ন চরিত্রের? অন্য ভাষায় বলতে গেলে এই নমস্কারেরও কি তবে রকমফের ছিল? এই প্রশ্ন দুটি আমরা একে একে বিবেচনা করে দেখব।

 

আলিপুর বোমার মামলায় অরবিন্দের কয়েকজন বিপ্লবী সহচরের কারাবাস ও দ্বীপান্তর, রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে বাংলা থেকে তাঁর প্রস্থান, বঙ্গভঙ্গ রদ ও স্বদেশি আন্দোলনের সমাপ্তি ইত্যাদি ঘটনায় বাংলাদেশের বিপ্লববাদ তখনকার মতো কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও বোমার রাজনীতি একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। ১৯১২ সালে রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে দিল্লিতে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমানিক্ষেপ, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখের নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক ডাকাতি ও রডা কোম্পানির অস্ত্র লুঠ (১৯১৪) ইত্যাদি ঘটনা এরই ইঙ্গিত দেয়।

দিল্লির বোমা সম্পর্কে মনঃপীড়া বোধ করে রবীন্দ্রনাথ জগদানন্দ রায়কে লেখেন, “……আমাদের হতভাগ্য দেশে আমরা যথার্থ ত্যাগস্বীকার করে দেশের কাজ করতে কষ্ট বোধ করি বলেই আমাদের ওখানেই একদল বীরপুরুষ বোমা ছুঁড়ে দেশ উদ্ধার করতে চায়। এই বোমা কোনখানে গিয়ে পড়ে বলো দেখি? একেবারে স্বদেশলক্ষ্মীর মঙ্গলঘটের উপরে।”… (২৫-১২-১৯১২), ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায় যে, গুপ্তবিপ্লব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কঠোর বিরুদ্ধতা ১৯১০-পরবর্তী পর্বেও এতটুকু প্রশমিত হয়নি। আবার এটাও বিস্ময়কর যে, অরবিন্দ সম্পর্কে তাঁর পূর্বের আবেগাপ্লুত মনোভাবেরও যে বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি, তার পরিচয়ও এই পর্বে পাওয়া যায় দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানায় রক্ষিত এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে। ১৯১৬-১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন জাপান সফর করছিলেন, তখন সেখানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ফরাসি বুদ্ধিজীবী পল রিশার ও তাঁর স্ত্রী মীরার (যিনি পরবর্তীকালে পণ্ডিচেরির অরবিন্দ-আশ্রমে মাদার/শ্রীমা নামে পরিচিতা হন) এবং তাঁদের কথাবার্তায় অরবিন্দ-প্রসঙ্গও ছিল। এই সাক্ষাতের কথা তাঁরা অরবিন্দকে লিখে পাঠান ও সেই চিঠি ব্রিটিশ গোয়েন্দারা খুলে পড়ে। সেই গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, রিশারদের কাছে রবীন্দ্রনাথ যখন অরবিন্দের বিষয়ে বলছিলেন, তখন তাঁর চোখে ছিল প্রেমাশ্রু!

 

‘ঘরে বাইরে’-র পশ্চাদ্‌পট ও অরবিন্দের রাজনীতি

স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটির ইংরেজি সংস্করণ ‘দি হোম অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৯ সালে। এ-বছরেই ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় (নভেম্বর, ১৯১৯) এই বইটির এক সমালোচনা লেখেন ইতিহাসবিদ্‌ যদুনাথ সরকার। এর প্রথমাংশে তিনি মন্তব্য করেন, “বাংলার বিরাট স্বদেশী আন্দোলনকালের ভারতীয় জীবন সম্পর্কে রচিত এই উপন্যাসটি অরবিন্দ ঘোষের বক্তব্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তর।… বর্তমান জাতীয় আন্দোলনের ঊষালগ্নে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রেষ্ঠ শৈলীতে প্রকাশ করেছিলেন এক কাব্যার্ঘ্য: ‘অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার!’ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবুদ্ধ দ্রষ্টাপুরুষটিও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সমমাত্রায় মধুর ভাবনা পোষণ করতেন। আর তারপর তাঁরা শুরু করলেন দ্বন্দ্বযুদ্ধ।”

এ হেন নাটকীয় ভাষায় শুরু করে যদুনাথ স্বদেশি আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ও অরবিন্দের ‘বন্দেমাতরম্‌’ গোষ্ঠীর [তিনি বিপিন পালেরও নাম করেছেন] মতদ্বৈধের কিছু বর্ণনা দিয়েছেন, যা আমরা প্রথম পর্বে কিছু কিছু বলেছি। তাঁর মতে অরবিন্দ ও তাঁর সহগামীরা রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতায় যা বলেছিলেন, তিনি তখনই তার উত্তর দেননি: “যে নৈতিক আঘাত তিনি পেয়েছিলেন, তা তাঁকে বাধ্য করেছিল স্বদেশী শিবির ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনের গ্রামীণ প্রশান্তির মধ্যে আহত হৃদয়ের নিরাময় খুঁজতে। তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে নির্মাণ করলেন এক ভীষণ ধারালো অস্ত্র। সে অস্ত্র কোনও বিতন্ডা-পুস্তিকা বা বক্তৃতামঞ্চ নয়, তা একটি উপন্যাস— ‘ঘরে বাইরে’…” ইত্যাদি।

সাধারণভাবে ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটিকে তাঁর স্বদেশি আন্দোলনকালীন চরমপন্থা-বিরোধিতার দলিল বলে বর্ণনা করলে হয়তোবা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ততটা অস্বস্তির কারণ ঘটত না, কিন্তু নানা চরমপন্থী নেতার মধ্যে বেছে বেছে শুধু অরবিন্দকেই যেভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী মল্লযোদ্ধা হিসেবে যদুনাথ খাড়া করলেন, সেটা যে তাঁকে কিঞ্চিৎ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল, ‘মডার্ন রিভিউ’-এর জানুয়ারি (১৯২০) সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে তা বোঝা যায়। কোনও পত্রলেখকের চিঠির জবাবে লেখা এই সংক্ষিপ্ত পত্রটিতে রবীন্দ্রনাথ শুধু অরবিন্দ সম্পর্কে তাঁর ধারণার কথাই জানিয়েছেন, উপন্যাসটির প্রেক্ষিত বিষয়ে কিছুই বলেননি। রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিটির বক্তব্য থেকে মনে হয় উপন্যাসের সন্দীপ চরিত্রটির নির্মাণে অরবিন্দের ছায়া থাকতে পারে কিনা, এমন কোনও প্রশ্নই ঐ পত্রলেখক তুলেছিলেন, যদুনাথের উদ্ধৃত মন্তব্যগুলি সেই প্রশ্নের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।

৩০ নভেম্বরে লিখিত রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিটির বক্তব্যটি তর্জমা করলে যা দাঁড়ায়, তা হল: “আমার বইয়ের যদুবাবুকৃত পর্যালোচনাটি আমি এখনও পড়িনি, তবে আমার মনে হয়, তিনি নিশ্চয়ই এমন কথা বলতে চাননি যে, আমার কাহিনির সন্দীপ যে ধরনের মানুষ, অরবিন্দ ঘোষও সেই একই ধরনের। আমাদের সমকালীন রাজনীতির লেখাপত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় আকস্মিক ও অনিয়মিত হওয়ায় অরবিন্দ ঘোষের রাজনৈতিক অবস্থানটি যে কী, তা আজও আমি সঠিকভাবে জানি না। তবে এ-কথা আমি নিশ্চিত জানি যে, তিনি একজন মহৎ মানুষ— আমাদের মহত্তমদের অন্যতম…। তাঁর সম্পর্কে আমার নিজের যা মনোভাব, তা হচ্ছে শ্রদ্ধা— তাঁর আধ্যাত্মিক গভীরতা, দৃষ্টির বিশালতা আর কল্পনার অন্তর্দৃষ্টি ও অভিব্যক্তিতে অনন্যসাধারণ তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার জন্য। তিনি একাধারে একজন প্রকৃত ঋষি ও কবি। আমি এখনও পুনরাবৃত্তি করি আমার সেই ‘নমস্কারে’র, যা আমি তাঁকে নিবেদন করেছিলাম, প্রথম যখন তিনি ঝঞ্ঝাটে পড়েন, যা পরে বাংলার মাটি থেকে তাঁর নির্বাসনের কারণ হয়।”

এখানে প্রথমেই লক্ষ করা যায়, রবীন্দ্রনাথের ঐ উপন্যাস সম্পর্কে যদুনাথের মন্তব্যটিতে তিনি কিন্তু  সোজাসুজি এমন কথা একবারও বলেননি যে, উপন্যাসের সন্দীপ চরিত্রটি অরবিন্দের প্রতিরূপ। কাজেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি যে বলেছেন, উপন্যাসটিতে অরবিন্দের রাজনৈতিক মতবাদের ‘জবাব’ দেওয়া হয়েছে (এবং সে কথা মিথ্যাও নয়), তা থেকে এমন ধারণা কীভাবে জন্মাতে পারে যে, উপন্যাসে ঐ মতবাদের প্রতিভূ হিসেবে যাকে খাড়া করা হয়েছে, সে চরিত্রগতভাবেও অরবিন্দেরই প্রতিরূপ হবে! সন্দীপ শুধু অরবিন্দেরই প্রতিমূর্তি, চরমপন্থী অন্য কোনও নেতার নয়, মনস্ক বিবেচনায় এমনটা ভাবার সত্যিই কোনও কারণ নেই। এসব সত্ত্বেও মনে হয়, সাধারণ পাঠক বা অরবিন্দের ভক্ত-শিষ্যেদের পক্ষে এতটা বিচার-বিবেচনার পরিশ্রম স্বীকার না করে যদুনাথের অরবিন্দের নাম করে ঢালাও মন্তব্যটি থেকে তেমনটা ভেবে বসাটা অস্বাভাবিক না হতেও পারে।

অজানা এক পাঠকের এমন অনুমানের বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথ যে অস্বীকার করবেন, এতে কোনও অস্বাভাবিকতা না থাকলেও তাঁর জবাবি বক্তব্যের সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশটি হল অরবিন্দের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার ঘোষণা। অতীতের ঘটনাবলি আমরা যতটা জেনেছি, তার ভিত্তিতে এ-কথা বলতেই হয় যে, রবীন্দ্রনাথের ঐ দাবি সম্পূর্ণ সত্যি হতে পারে না। তা যদি হত, তা হলে তিনি কী করে অরবিন্দকে নমস্কার জানিয়ে ও ‘রুদ্রদূত’ বলে বন্দনা করে তাঁকে নিবেদন করেছিলেন কাব্যার্ঘ্য? কী করে তবে তিনি একদা (১৯০৭) অরবিন্দের সম্পাদনার কারণেই তাঁর রাজনৈতিক মতবাদের বাহন ‘বন্দে মাতরম্‌’ পত্রিকার প্রশংসা করেছিলেন? হ্যাঁ, এটা অবশ্য সম্ভব যে, তিনি ঐ পত্রিকাটি খুব ভালোভাবে পড়তেন না, অরবিন্দের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়তো বা খুব পাকাপোক্ত ধরনের বা সম্পূর্ণ ছিল না, কিন্তু একেবারেই এ ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল না, এমনটা হতে পারে না। আমাদের মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের এমন অদ্ভুত দাবির নিহিত কারণ— অরবিন্দের সঙ্গে তাঁর দুস্তর রাজনৈতিক ব্যবধানটিকে তিনি জনসমক্ষে উদ্ঘাটিত করতে চাননি, কারণ তা উদ্ঘাটিত হলে তার সমালোচনার একটা দায়ও এসে পড়ে। আর চাননি বলেই হয়তো তিনি যদুনাথের সমালোচনাটিও পড়েননি বলে উল্লেখ করেছেন, কারণ ঐ রচনাটিতে রবীন্দ্র-অরবিন্দ মতদ্বৈধের কথা বেশ খোলসা করেই দেখানো হয়েছিল। এ কথা বিশ্বাস করা শক্ত যে, যেখানে তিনি নিজেও অনেক লিখেছেন, সেই  মডার্ন রিভিউ-এর মতো কাগজে নিজের লেখা নিয়ে আলোচনা রবীন্দ্রনাথ পড়বেন না।

রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যে আর একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এর সমস্তটাই অরবিন্দ সম্পর্কে নির্জলা প্রশস্তিবাদ এবং তা অভিব্যক্তির সর্বোচ্চ মাত্রায় রচিত, যা আমাদের মনে কিছু অনিবার্য প্রশ্নের জন্ম দেয়। রবীন্দ্রনাথ যদি অরবিন্দ সম্পর্কে সত্যিই এতটা উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকেন, তা হলে সেটা কি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে তৈরি, না কি জনসমক্ষে তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্যটিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠার তাগিদে তিনি অরবিন্দ সম্বন্ধে প্রচলিত জনশ্রুতিগুলিরই নিছক পুনরাবৃত্তি করেছেন? এ-প্রশ্ন বিশেষভাবে ওঠে অরবিন্দ সম্বন্ধে তাঁর “আধ্যাত্মিক গভীরতা, দৃষ্টির বিশালতা আর কল্পনার অন্তর্দৃষ্টি ও অভিব্যক্তিতে অনন্যসাধারণ তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা” ইত্যাদি উল্লেখ থেকে। ১৯১৯ সালে তিনি অরবিন্দের আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যিক প্রতিভার কতটা পরিচয় পেয়েছিলেন, সে নিয়ে আমাদের সন্দেহের কারণ, অরবিন্দ পত্রপত্রিকায় প্রধানত রাজনৈতিক রচনাই লিখতেন। আলোচ্য সময়ে অন্তত বাংলাদেশের কোনও পত্রিকায় তাঁর কোনও সাহিত্যিক বা দার্শনিক রচনা প্রকাশিত হত বলে আমাদের জানা নেই। এখানে অনেকের মনে পড়তে পারে তাঁর ঐ বহুশ্রুত ‘নমস্কার কবিতার এই ছত্রগুলি, যেখানে তিনি অরবিন্দকে সম্বোধন করেছিলেন ‘কবি’ বলে: “……ভারতের বীণাপাণি/ হে কবি, তোমার মুখে রাখি দৃষ্টি তাঁর/ তারে তারে দিয়েছেন বিপুল ঝঙ্কার—” ইত্যাদি। অরবিন্দের কবিখ্যাতির কথা রবীন্দ্রনাথ পারিবারিক সূত্রে হয়তো বা শুনে থাকবেন, কিন্তু এই সময়ে বা তার পরবর্তীকালেও তিনি অরবিন্দের রচিত কোনও সাহিত্য নিয়ে কোথাও লিখেছেন বা কারও কাছে মন্তব্য করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এর অন্তত আট ন বছর পরে কলকাতায় প্রথম অরবিন্দের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় আর দিলীপ রায়ের মতো অরবিন্দ-শিষ্যদের থেকে অরবিন্দের অরাজনৈতিক রচনার নমুনা ও ‘আধ্যাত্মিক সাধনার’ কিছু  একতরফা সংবাদ রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে পেয়েছেন বটে, কিন্তু সেই সময়েও তাঁর মন্তব্যগুলি থেকে অরবিন্দ সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা ও অধ্যয়নের অপ্রতুলতার কথা ও আধ্যাত্মিক সাধনা বিষয়ে তাঁর ‘অনধিকারিত্বের’ কথাই প্রকট হয়েছে।

এর পরেও অরবিন্দকে রবীন্দ্রনাথের একজন মহান্ মানুষ, “আমাদের মহত্তমদের অন্যতম” বলে ঢালাওভাবে শংসাপত্র দেওয়াটা আমাদের বিস্ময়কর মনে হয়, কারণ আমরা আগেই দেখেছি যে, অরবিন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বহু সমালোচিত রক্তাক্ত বিপ্লবের সংগঠক ও হোতা— স্বদেশি আন্দোলনকালের ডাকাতি ও গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টাগুলিতে তাঁর ব্যক্তিগত দায়িত্ব কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কাজেই প্রশ্ন ওঠে যে, রবীন্দ্রনাথ সত্যিই কি ঐ সব ঘটনায় অরবিন্দের সংস্রবে বিশ্বাস করেননি? এ কথা ঠিক যে, আলিপুর বোমার মামলার সূত্রে অরবিন্দের গ্রেপ্তারের ঠিক পরেই কেউ কেউ এতে অরবিন্দ নিজে জড়িত বলে বিশ্বাস করতে চাননি আর সহজবোধ্য কৌশলগত কারণে অরবিন্দও তাঁর পরবর্তীকালের লেখায় ও কথাবার্তায় তা কখনও স্পষ্টভাষায় স্বীকার করেননি, তা না হলে তাঁর মামলা থেকে অব্যাহতিলাভ কারও ওকালতি দক্ষতায়ও সম্ভব হত না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাংলার গুপ্তসমিতির নানা কাজে জড়িত তাঁর আত্মীয়দের (সরলা দেবী, সুরেন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) থেকেও এ বিষয়ে কোনও আঁচ পাননি, অথবা আলিপুর মামলায় অরবিন্দের উকিলেরা তাঁকে বাঁচাবার তাগিদে যা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি চোখ বুজে তা-ই বিশ্বাস করেছিলেন, এ কথা মেনে নিলে এটাও মেনে নিতে হয় যে, তাঁর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ একেবারেই অপরিণত ছিল। [তা ছাড়া ১৯১৯ সালের পরবর্তীকালে যখন গুপ্তসমিতির একাধিক সদস্যের সাক্ষ্য, তাঁদের রচনা ও বইগুলি থেকে অরবিন্দের বিপ্লব প্রয়াসে জড়িত থাকার ইতিহাস নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখনও যে রবীন্দ্রনাথের অরবিন্দ-নমস্কার যে অব্যাহত থেকেছে, সেটা আমরা ক্রমে লক্ষ করব।] তাই এ-কথাই আমাদেরমনে হয় যে, এই ‘পল্লবিত’ ও উঁচু সুরে বাঁধা প্রশস্তিটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিজের অরবিন্দ-মূল্যায়নকে লোকচক্ষুর সামনে সব সন্দেহ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চেয়েছিলেন, যা ছিল প্রথমাবধি তাঁর এক ব্যাখ্যাতীত দুর্বলতা। অরবিন্দের রাজনৈতিক পরিচয়টি যেমন রবীন্দ্রনাথের কাছে অর্ধস্ফুট ও অসম্পূর্ণ, তেমন তাঁর আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যিক পরিচয় সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের ধারণা খুব পাকাপোক্ত নয় বলেই আমাদের মনে হয়।

 

নমস্কারের পুনরাবৃত্তি— পণ্ডিচেরিতে সাক্ষাৎকার

১৯২৮ সালে, অর্থাৎ ঘরে-বাইরে’-বিতর্কের প্রায় এক দশক পরে পণ্ডিচেরিতে রবীন্দ্র-অরবিন্দ সংবাদের পরবর্তী দৃশ্যের যবনিকা উত্তোলন হয়। মাদ্রাজ থেকে জাহাজে কলম্বো যাবার পথে পণ্ডিচেরিতে জাহাজ থামলে অরবিন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের কথা আমরা প্রথম পর্বের শুরুতেই উল্লেখ করেছি। অরবিন্দের বাসভবনের এক তাঁর নিভৃত কক্ষে দুজনের এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার হয় ২৯শে মে। চিত্তরঞ্জন দেবের বর্ণনা অনুযায়ী “উভয়ে উভয়কে দু’ হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। তারপর দু’জন মুখোমুখি বসলেন দুটি চেয়ারে। রবীন্দ্রনাথ কথা বললেন, কিন্তু কি বললেন তা জানা যায় না। রবীন্দ্রনাথের কথার উত্তরে অরবিন্দ কি বললেন সে-ও অজ্ঞাত……।” এটা ছিল একান্ত সাক্ষাৎকার।

রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণসঙ্গী নির্মলকুমারী মহলানবিশের সাক্ষ্য অনুযায়ী এই অরবিন্দ সন্দর্শন তাঁকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। জাহাজে ফিরে এসে তিনি নাকি বলেন, “অরবিন্দকে দেখে খুব আশ্চর্য লেগেছে, একেবারে উজ্জ্বল চেহারা— চোখ দুটোর মধ্যে কী আছে বর্ণনা করা যায় না, এমন আশ্চর্য চোখের ভাব। বুঝলুম অন্তরের মধ্যে কিছু একটা পেয়েছেন, তা না হলে চেহারার এ রকম দীপ্তি হয় না। বহুদিন পর দেখা— খুশি হলুম দেখে।” নির্মলকুমারী লিখেছেন, সেদিন রবীন্দ্রনাথ সারাদিনই বসে লেখেন তাঁর অরবিন্দ দর্শনের অভিজ্ঞতা, কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলেন না। বিকেলে সবাইকে পড়ে শোনান সেই লেখা আর তাঁর অরবিন্দকে নমস্কার জানিয়ে লেখা পুরানো কবিতা, তারপর বলেন, “বহুদিন পরে দেখা, এবারও তাঁকে নমস্কার জানিয়ে এলুম।” (‘কবির সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে’)

পরের দিন পণ্ডিচেরি থেকে কলম্বো পৌঁছেও রবীন্দ্রনাথের ঐ ঘোর কাটে না, বেশি কথাবার্তা বলেন না, নানাজনকে [কন্যা মীরা, পুত্রবধূ প্রতিমা ও ‘প্রবাসী” সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়] চিঠি লিখে জানাতে থাকেন তাঁর এই অরবিন্দ-দর্শনের কাহিনি। অরবিন্দের নির্জনবাসের ব্যাপারটা তাঁর খুব পছন্দ হয়, নিজেও যে সেই অনুশীলন করবেন, এমন একটা ইচ্ছের কথা তিনি ঐ চিঠিগুলিতে লিখতে থাকেন। মীরা দেবীকে তিনি লেখেন, “……অরবিন্দকে দেখে আমার ভারি ভাল লাগল। বেশ বুঝতে পারলুম নিজেকে ঠিকমত পাবার এই ঠিক উপায়।” (৩০-৫-১৯২৮)

এই অরবিন্দ-দর্শন বিষয়ে একট লেখা প্রবাসী-তে (শ্রাবণ, ১৩৩৫) এবং ইংরেজিতে ‘মডার্ন রিভিউ’-য়েও প্রকাশিত হয় [জুলাই,১৯২৮]। মূল বাংলা রচনাটির কিছুটা এবার দেখা যাক: “অনেকদিন মনে ছিল অরবিন্দ ঘোষকে দেখব। সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল। ……প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝলুম ইনি আত্মাকেই সত্য করে চেয়েছেন, সত্য করে পেয়েওছেন। সেই তাঁর দীর্ঘ তপস্যার চাওয়া ও পাওয়ার দ্বারা তাঁর সত্তা ওতপ্রোত। আমার মন বললে ইনি এঁর অন্তরের আলো দিয়েই বাহিরের আলো জ্বালবেন।…. অতি অল্পক্ষণ ছিলুম। তার মধ্যেই মনে হল তাঁর মধ্যে সহজ প্রেরণাশক্তি পুঞ্জিত। কোন খরদন্তুর মতের উপদেবতার নৈবেদ্য রূপে সত্যের উপলব্ধিকে তিনি  ক্লিষ্ট ও খর্ব করেন নি। তাই তাঁর মুখশ্রীতে এমন সৌন্দর্যময় শান্তির উজ্জ্বল আভা।”

রবীন্দ্রনাথ এই স্বল্পস্থায়ী সাক্ষাতের সময় অরবিন্দকে ঠিক কী বলেছিলেন? তিনি নিজেই এর পর সে কথা জানাচ্ছেন, “আমি তাঁকে বলে এলুম – আত্মার বাণী বহন করে আপনি আমাদের মধ্যে বেরিয়ে আসবেন এই অপেক্ষায় থাকব। সেই বাণীতে ভারতের নিমন্ত্রণ বাজবে। শৃণ্বন্তু বিশ্বে।…….”  লেখাটির উপসংহারে রবীন্দ্রনাথ পুনরাবৃত্তি করেন তাঁর সেই পুরানো বক্তব্যেরঃ- “অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম, সেখানে তাঁকে জানিয়েছি, – অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার। আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে, অপ্রগলভ স্তব্ধতায় –আজও তাঁকে মনে মনে বলে এলুম — অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।”

পণ্ডিচেরি আশ্রমের নলিনীকান্ত গুপ্তের এক চিঠির জবাবে ঐসাক্ষাৎকারের মাসখানেক পরে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন, সেটিই তাঁর  লিখিত বিবরণগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি  অরবিন্দের ‘আধ্যাত্মিক গভীরতা’ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান ও ধারণার প্রকৃত অবস্থাটিকে খুলে ধরে। রবীন্দ্রনাথের চিঠিটির কিছু অংশ এ-রকম: “অরবিন্দের সঙ্গে আমার ক্ষণকালের দেখা – সবসুদ্ধ বিশ মিনিট মাত্র। তাঁর কি মত, কি উদ্দেশ্য, কি সাধনা আমি তার কিছুই জানিনে। বর্তমান কালের যে-বাণীর একান্ত প্রয়োজন – সেই বাণী কোন এক সাধক বহন করে আসবেন, এই ইচ্ছা মনে নিয়েই তাঁকে দেখেছি এবং খুব সম্ভব আমার যে-প্রত্যাশা তাঁর উপর প্রয়োগ করেছি তাঁর নিজের সঙ্গে তার মিল নেই। আন্দাজে কথা কওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা – তাই নিজেরই মনে যা এসেচে তাই বলেচি তাঁর মনে কি আছে কেমন করে জানব? তাঁর Mother  নামক বই হাতে এলে পড়ে দেখব।” (২২-৭-১৯২৮) এই চিঠির “তাঁর মনে কি আছে কেমন করে জানব?” বাক্যটি থেকে বোঝা যায় যে, অরবিন্দ এই সাক্ষাতের সময় কোনও কথা বলেননি, একতরফাভাবে রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন।

এই সাক্ষাৎকারের প্রতিক্রিয়ায় অরবিন্দ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই সব বয়ান থেকে বোঝা যায়, স্বদেশিযুগের “ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে” অরবিন্দকে দেখার দীর্ঘ দুই দশক পরে তাঁকে দর্শন করে তাঁর চেহারায় যে অনিবার্য পরিবর্তন রবীন্দ্রনাথ দেখতে পান, তা তাঁকে অভিভূত করেছিল। সম্ভবত পণ্ডিচেরিতে আশ্রমের নিশ্চিন্ত পরিসরের মধ্যে নির্জনবাস, মৌনব্রত, যোগাভ্যাস ও অজানা ‘আধ্যাত্মিক’ জীবনযাপনের ফলে যে প্রশান্তি ও ঔজ্জ্বল্য তাঁর চেহারায় এসেছিল বাইরে থেকে রবীন্দ্রনাথ তা দেখে বিমোহিত হয়ে তিনি “তপস্যার আসনে, অপ্রগলভ স্তব্ধতায়” রয়েছেন, এ-রকমটা ভাবতেই পারেন। কিন্তু “নিজেকে ঠিকমত পাবার এই ঠিক উপায়” ইত্যাদি তাঁর একান্ত নিজস্ব ভাবনা [তাঁর নিজের ভাষায় “আমার মন বললে”] এ নিয়ে যুক্তিতর্ক বা বিশ্লেষণ নিরর্থক। অরবিন্দ সম্পর্কে যেহেতু আগে থেকেই তাঁর মনে সংরক্ষিত রয়েছে এক কোমল পরিসর, তাই অরবিন্দ কোনও কথা না বললেও রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে ভেবে নিতে পারেন যে, “ইনি এঁর অন্তরের আলো দিয়েই বাহিরের আলো জ্বালবেন”, কিংবা— “তাঁর মধ্যে সহজ প্রেরণাশক্তি পুঞ্জিত। “তিনি নিজেও ও-রকম নির্জনবাস ‘তপস্যা’ করবেন ও তার ফলে তিনি “নিজেকে ঠিকমতো” পাবেন— এটিও রবীন্দ্রনাথের এক রোমান্টিক কল্পনাবিলাস বলেই আমাদের মনে হয়।

নলিনীকান্তকে লেখা চিঠিটি থেকে আরও বোঝা যায় যে, ১৯২৮ সালেও রবীন্দ্রনাথের কাছে অরবিন্দের আধ্যাত্মিক পরিচিতি স্পষ্ট ছিল না [“তাঁর কি মত, কি উদ্দেশ্য, কি সাধনা আমি তার কিছুই জানিনে।“]! অরবিন্দের দার্শনিক রচনাবলি সম্পর্কে তাঁর অধ্যয়নও, অন্তত তখন পর্যন্ত, বলার মতো তেমন কিছু নয়। [“…বই হাতে এলে পড়ে দেখব”] তাই আমাদের জিজ্ঞাসা জাগে, ব্যক্তিগত চিঠিতে অরবিন্দ সম্পর্কে তাঁর পরিচয় বা অপরিচয়ের অস্পষ্টতার কথা স্বীকার করলেও ন বছর আগে তবে কিসের ভিত্তিতে তিনি সর্বসমক্ষে [‘মডার্ন রিভিউ’য়ে] “তাঁর আধ্যাত্মিক গভীরতা” নিয়ে এত বড় ঢালাও মন্তব্য করেছিলেন! পরিষ্কার কোনও নিজস্ব ধারণা না থাকলেও তিনি কি ইচ্ছে করেই অরবিন্দ সম্পর্কে প্রচলিত জনশ্রুতির গড্ডল স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন?

 

দিলীপ রায়ের সঙ্গে পত্রালাপে রবীন্দ্রনাথের অরবিন্দ-ভাবনা

পণ্ডিচেরিতে দুই মনীষীর সাক্ষাৎকারের পর রবীন্দ্রনাথ আরও তেরো বছর জীবিত ছিলেন। এই সময়ে তাঁর অরবিন্দ-ভাবনায় কি উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন বা বিবর্তন হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র, গায়ক ও অরবিন্দ-শিষ্য এবং সেই সূত্রে পণ্ডিচেরি আশ্রমের বাসিন্দা দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ থেকে। ঐ সাক্ষাতের পর থেকে প্রায় দুই দশক ধরে তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছেন, অরবিন্দ ছাড়াও মাদার ও আশ্রমের নানাজনের মতামত, মন্তব্য ও লেখাপত্র রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছেন এই প্রক্রিয়া ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়ার পরিচয়বাহী এই পত্রধারা থেকে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী অরবিন্দ-ভাবনার একটা ধারণা পাওয়া যায়।

১৯২৮ সালে রবীন্দ্রনাথের কাছে দিলীপকুমার তাঁর নামে একটি আশীর্বাদী কবিতার আব্দার জানালে তিনি তাঁকে একটি কবিতা লিখে পাঠান (৩১-১২-১৯২৮)। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ অরবিন্দকে কল্পনা করেছেন এক ‘ধ্যানমগ্ন গিরি তপস্বী’ ও নিজেকে এক ‘স্তব্ধ সরোবর’ রূপে আর দিলীপকুমার যেন সেই গিরি তপস্বীর আশিসধন্য এক ‘তরুণ নির্ঝর’! কবিতাটির প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ: “নিম্নে সরোবর স্তব্ধ হিমাদ্রির উপত্যকাতলে;/ ঊর্ধ্বে গিরিশৃঙ্গ হতে শ্রান্তিহীন সাধনার বলে/ তরুণ নির্ঝর ধায় সিন্ধুসনে মিলনের লাগি/ অরুণোদয়ের পথে। সে কহিল, ‘আশীর্বাদ মাগি, হে প্রাচীন সরোবর,’ সরোবর কহিল হাসিয়া,/ ‘আশীষ তোমার তরে নীলাম্বরে উঠে উদ্ভাসিয়া,/ প্রভাত সূর্যের করে; ধ্যানমগ্ন গিরি তপস্বীর/ নিরন্তর করুণায় বিগলিত আশির্বাদ নীর/ তোমারে দিতেছে প্রাণধারা।…” বোঝা যায়, অরবিন্দের তপস্যার ছবিটি এতদিনে রবীন্দ্রনাথের মনে গেঁথে গেছে।

এভাবেই বেশ কয়েক বছর ধরে চলেছিল দুই মনীষীর প্রশস্তি বিনিময়, লেখা ও মতামতের আদানপ্রদান— সোজাসুজি নয়, ভক্ত মারফৎ! কখনও দিলীপকুমার জানাচ্ছেন যে, তিনি “শ্রীঅরবিন্দের নীরব তপঃশক্তির নানা প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে নিত্যই চমৎকৃত” হচ্ছেন, কখনও বা তিনি পাঠাচ্ছেন শ্রীঅরবিন্দের কথোপকথন বা কোনও কবিতা। ১৯৩১ সালে দিলীপকুমারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে অরবিন্দ-প্রসঙ্গ: “শ্রী অরবিন্দ আত্মসৃষ্টিতে নিবিষ্ট আছেন। তাঁর সম্বন্ধে সমাজের সাধারণ নিয়ম খাটবে না। তাঁকে সসম্ভ্রমে দূরেই স্থান দিতে হবে – সব সৃষ্টিকর্তাই একলা, তিনিও তাই। আমাদের অভিজ্ঞতা সেইখানেই যেখানে জমেচে সকলের সঙ্গ – তাঁর উপলব্ধির ক্ষেত্র সকল জনতাকে উত্তীর্ণ হয়ে …” (১৮-৪-১৯৩১)। “অরবিন্দ আত্মসৃষ্টিতে নিবিষ্ট আছেন”— রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি থেকে মনে হয় পণ্ডিচেরিতে যে একটা আত্মিক “সৃষ্টির কাজ” শুরু হয়েছে বলে যে কথা অরবিন্দ ও তাঁর শিষ্যভক্তেরা এত দিন ধরে বলে আসছিলেন, রবীন্দ্রনাথেরও তাতে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে।

এর পরের বছর প্রবাসী-তে (মাঘ ১৩৩৮) প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি পড়ে দিলীপকুমারের ধারণা হয় যে, এতে নাম না করে তাঁর গুরুকে কটাক্ষ করা হয়েছে এবং ওই চিঠি পড়ে তাঁর ব্যথিত হবার কথাও তিনি তাঁকে জানান। তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কৈফিয়ৎ দিয়ে লেখেন, “…তুমি জানো শ্রীঅরবিন্দকে আমি অকৃত্রিম ভক্তি করি। তাঁকে আমি আধুনিক কালের ব্যবসায়ী অবতারের দলে গণ্য করতে পারি এমন কুৎসিত কথা তুমি কল্পনাও করবে এ আমার স্বপ্নের অতীত ছিল।… যাদের মহিমা ঊর্ধ্বলোকে বিরাজ করে তাদের ভক্তেরা তাঁদের সম্বন্ধে যেন নিশ্চিন্ত থাকেন, তাঁরা স্বতই নিরাপদ, অন্তত তাঁরা আমার মতো লোকের অবজ্ঞার লক্ষ্য হতেই পারেন না…“ ইত্যাদি। (১২-২-৩২)

দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক মহেন্দ্রনাথ সরকার ১৯৩৫ সালে ‘প্রকাশিত তাঁর ইস্টার্ন লাইট’ গ্রন্থে প্রাচ্যের সমকালীন বিভিন্ন দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এ-প্রসঙ্গে অরবিন্দের দর্শন নিয়ে আলোচনা থাকলেও বইটিতে রবীন্দ্রনাথের দর্শন সম্বন্ধে কোনও আলোচনা ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে বইটি পাঠানো হলে তিনি প্রাপ্তিস্বীকার করে লেখককে যে চিঠি লেখেন তা থেকে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। মহেন্দ্রনাথ ও দিলীপকুমারের কোনও বন্ধু  এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করে দিলীপ রায়কে একটি চিঠি লেখেন। দিলীপকুমার স্বভাবসিদ্ধভাবে এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পত্রাঘাত করলে দিলীপকুমারকে তিনি যা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা এ-রকম: “…একটা কথা জানিয়ে রাখি আমি নিজেকে কখনো সাধক বলে কল্পনাই করিনে। …… এই কথাই আমি মহেন্দ্রবাবুর পত্রে  জানিয়েছিলুম। তিনি যদি মনে করে থাকেন আমি শ্রীঅরবিন্দের উপর ঈর্ষা প্রকাশ করেছি তবে সে আমার দুর্ভাগ্য।” এ-টুকুতেই ক্ষান্ত না হয়ে অরবিন্দকে যে তিনি একজন সাধক হিসেবে স্বীকার করেন, সেটাও উল্লেখ করে চিঠির তিনি লিখলেন: “…কখনও কখনও ভ্রমক্রমে আমার কাছে সাধন সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে জিজ্ঞাসু এসেছেন, আমি অনেকবারই শ্রীঅরবিন্দের কাছে তাঁদের পথ নির্দেশ করেছি।” (৭-৯-১৯৩৫)

এই সব চিঠিপত্রে অরবিন্দের যোগীজীবন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সে-সব অভিমত আমরা লক্ষ করি, তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতা থেকে রবীন্দ্র-নিন্দিত গুপ্তবিপ্লবের হোতা বা প্রকাশ্য জনজীবন ছেড়ে যোগাভ্যাসের অজ্ঞাত মার্গের পথিক— অরবিন্দের জীবনের গতিমুখ যেদিকেই পরিবর্তিত হোক না কেন, তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নহীন শ্রদ্ধা সব সময় অবিচল থেকেছে! তাঁর কাছে অরবিন্দের পরিচয়টি যতই অস্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ থাকুক, তিনি বারবার তাঁর একদা-উচ্চারিত ‘নমস্কার’টির পুনরাবৃত্তি করে বুঝিয়ে দিয়ছেন যে, বিচার-বিশ্লেষণ নয়, অরবিন্দকে সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখাই তাঁর নীতি। অরবিন্দের ভূমিকা ও মতবাদের বিপুল পরিবর্তন ঘটলেও তাঁর ‘নমস্কার’টি কখনও প্রত্যাহৃত হয়নি, শুধু তার রকমফের ঘটেছে।


বিশেষ দ্রষ্টব্য: জাতীয় শিক্ষাপরিষদে রবীন্দ্রনাথ ও অরবিন্দের কল্পনাভিত্তিক ছবিটি কম্প্যুটারের সাহায্য তৈরি।
আকর-পঞ্জী:

  1. অরবিন্দ ঘোষ/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর — ব্যক্তিপ্রসঙ্গ/ রবীন্দ্ররচনাবলী। (বিশ্বভারতী, ২০০০), ৩১শ খণ্ড।
  2. ‘নমস্কার’ – সঞ্চয়িতা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
  3. ‘স্বদেশী সমাজ’, ‘যজ্ঞভঙ্গ’, ‘দেশহিত’ – আত্মশক্তি ও সমূহ/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
  4. রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা চিঠি – চিঠিপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড)/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
  5. জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুকে লেখা চিঠি – ঐ (ষষ্ঠ খণ্ড)/ ঐ,
  6. মুক্তি কোন পথে/ সম্পাদনা – অশোককুমার মুখোপাধ্যায়,
  7. স্বদেশী আন্দোলন: রবীন্দ্র-অরবিন্দ মতদ্বন্দ্ব/ শংকরীপ্রসাদ বসু।
  8. রবিজীবনী, ষষ্ঠ ও সপ্তম খণ্ড/ প্রশান্তকুমার পাল।
  9. রবীন্দ্রজীবনী, তৃতীয় খণ্ড/ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
  10. একটি অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকার এবং প্রসঙ্গ/ চিত্তরঞ্জন দেব – দেশ, ১১-১-১৯৮৬।
  11. দিলীপকুমার রায় ও রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ [১৯২৩-৩২] – পত্রাবলী, সাহিত্যসংখ্যা ‘দেশ’, ১৩৮৩।
  12. দিলীপকুমার রায় ও রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ [১৯৩৩-৪০] – পত্রাবলী, সাহিত্যসংখ্যা ‘দেশ’, ১৩৮৪।
  13. মহেন্দ্রনাথ সরকার ও দিলীপকুমার রায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি – পত্রগুচ্ছ-৩, পত্রাবলী, শারদীয় দেশ, ১৪০৮
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4853 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...