সমস্ত অস্ত্রগুলো কেন্দ্রীভূত করো: কৃষক আন্দোলন ও তার সম্ভাবনাসমূহ

সুনন্দ

 

 




রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

 

যখন এই লাইনগুলো লিখছি, তখন রাজধানীর ৬টা সীমান্তের ৫টাই চলে গেছে কৃষকদের দখলে, আজ মাসাধিক কাল ধরে প্রায় আড়াই লক্ষ কৃষকের প্রহরায়। তবে এই চলমান কৃষক আন্দোলনকে শুধু এই অবরোধ দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। রাজনীতি সর্বদাই ক্রিয়াশীল বিচিত্র পদ্ধতিগুলির দ্বান্দ্বিক সমগ্রতা। কোনও সদর্থ বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য হল “বাস্তবতাকে জানা” থেকে “বাস্তবতার পরিবর্তন”-এ উত্তরণ ঘটানো, এবং এই উত্তরণের জন্য দ্বান্দ্বিক সমগ্রতাকে আয়ত্তে আনা আবশ্যক। এই ছোট প্রবন্ধটি সেই সামগ্রিকতার বয়ান তুলে ধরতে চায় যেখানে বর্তমান কৃষক আন্দোলন এবং তাতে নিহিত অজস্র সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত হয়েছে।

এই কৃষক আন্দোলনের সারবস্তু কী?

বর্তমান কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি তিনটি। ১. সংসদের বর্ষা অধিবেশনে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে মোদি সরকার যে তিনটি কৃষি আইন এনেছে সেগুলি সম্পূর্ণ বাতিল করা; ২. বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল ২০২০ বাতিল করা; এবং ৩. ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করবে এমন একটি আইন চালু করা। দিল্লি সীমান্তে যে কৃষকরা জড়ো হয়েছেন তাঁরা বেশিরভাগই পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের। এই অঞ্চলগুলিতেই সবুজ বিপ্লব হয়েছিল, এবং এই অঞ্চলগুলিই কৃষিতে সবচেয়ে বেশি পুঁজিবাদী অনুপ্রবেশ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু সেটা মাথায় রেখে এই গোটা আন্দোলনটাকে শুধু এই শ্রেণির কৃষকদের আন্দোলন হিসেবে দাগিয়ে দেওয়াটা মারাত্মক ভুল হবে। ভাগচাষ ব্যবস্থার ব্যাপক তারতম্য, কৃষির কাঠামো, সামন্ততান্ত্রিক এবং আধা-সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ এবং পুঁজিবাদী বিকাশের তারতম্য— এগুলিই ভারতীয় কৃষির চারিত্র। আর এই এত রকম বৈচিত্রের মধ্যে এটা মোটেও বাস্তবসম্মত নয় যে সমস্ত দেশের কৃষকরা একইভাবে একই সুরে সোচ্চার হবেন। এই কৃষক আন্দোলনের মূল কথাটাই হল কৃষিতে বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র কৃষক সমাজের ক্ষোভ এবং বিদ্রোহ। আবার এরকমটা ভাবাও ভুল হবে যে সরকারের তরফে কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটায়নের এই প্রক্রিয়া এই আইন তিনটির সঙ্গেই কেবলমাত্র শুরু হল। বস্তুত, প্রক্রিয়া চলছিলই— সারা দেশেই বিভিন্ন মাত্রায়— এই আইন তিনটি আনা হল সেই প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্বিত করার জন্য। ফলে যতই বাইরে থেকে এটিকে ধনী এবং মধ্য কৃষকদের নেতৃত্বে চলা একটি আন্দোলন মনে হোক না কেন, পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত যুক্তি অনুযায়ীই দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক এবং কৃষি মজুররা এর সারাংশে না থেকে পারেন না। কিন্তু সেটা তো এমনি এমনি হবে না। প্রয়োজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ীগত শক্তির— অর্থাৎ, সংগঠনের। এর অর্থ আবার এই নয় যে কৃষক সমাজের মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব অন্তর্হিত হয়েছে। বরং বিষয়টি এরকম, বড় পুঁজিপতিদের আগ্রাসন ভারতীয় কৃষিতে ইতিমধ্যেই চলতে থাকা অকৃষকীকরণের গতিকে তীব্রতর করে তুলবে। এবং সেটা এতটাই তীব্রতর হবে যে কোনও রাজনৈতিক শক্তি যদি এই আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে চায়, তবে তাকে সেই আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক এবং কৃষি-মজুরদের টেনে আনা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প থাকবে না। বলা বাহুল্য, এর জন্য ভারতীয় কৃষির বৈচিত্রপূর্ণ বিকাশের দিকে অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে।

শ্রমিক-কৃষক ঐক্য: স্লোগান থেকে কাজে

চলমান কৃষক আন্দোলনের ভিডিওগুলিতে দেখা যাবে কীভাবে ‘শ্রমিক-কৃষক একতা’ স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর গুরুত্ব হল এই যে কৃষকরা তাদের উপর ঘটতে থাকা নিপীড়নের শ্রেণিভিত্তিকে অনুধাবন করতে পেরেছেন। যেমন অনুধাবন করেছেন প্রত্যাঘাতের জন্য আবশ্যিক শ্রেণিভিত্তিকেও। কৃষি বর্তমানে ছদ্ম জীবিকার বা শ্রমের মজুত বাহিনীর চারপাশের যে বর্ণবলয়, তার অন্যতম উৎস। নব্য-উদারবাদের তিনটি দশক ধরে কৃষককে সম্পদচ্যুত করে কর্পোরেটের সম্পত্তি বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি চলছে, অধুনা আঘাতটি সেই প্রক্রিয়াকে নতুনতর স্তরে নিয়ে যাবে। ফলে এই ৩টি কৃষি আইনকে আলাদাভাবে দেখলে চলবে না। এগুলিকে ৪টি শ্রম কোডের সঙ্গে সন্নিহিত করে বিশ্লেষণ করতে হবে। এবং এই ৭টি আইনকেই সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সমস্যা এবং এমনকি চাকুরিবিহীন বৃদ্ধির উপরে ন্যস্ত একটি মডেলের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। একদিকে এই ৭টি আইন বৃহৎ পুঁজির জন্য সর্বাধিক মুনাফার রাস্তা খুলে দেবে, অন্যদিকে শ্রমিকশ্রেণিকে ঠেলে দেবে শ্রম কোডগুলির মাধ্যমে দাসত্বের দিকে। চিরবর্ধমান মজুত শ্রম আরও বৃদ্ধি পাবে, বৃহৎ পুঁজি আরও বেশি করে গিলে খাবে কৃষিকে। এই হল সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত, যার সামনে দাঁড়িয়ে মজুর-কিসান একতার স্লোগান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, শুধুমাত্র উৎপাদক শ্রেণিগুলিকেই নয়, চাকুরিহীন যুবসম্প্রদায়কেও এই একতায় জড়িয়ে নিতে।

‘আম্বানি-আদানিকে বয়কট করো’-র তাৎপর্য

সমস্ত জনবিরোধী নীতির পেছনে বৃহৎ বুর্জোয়াদের যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে এই কৃষক আন্দোলন তাকে সামনে টেনে এনেছে। হিন্দুত্ববাদ ওবং নব্য-উদারবাদের সংমিশ্রণে গঠিত যে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা আজ আমাদের দেশে কায়েম হয়েছে, তার শ্রেণিভিত্তি এখনকার মতো নগ্নভাবে আগে কখনও প্রকাশ পায়নি। যাই হোক, আমাদের আম্বানি-আদানিকে শুধুমাত্র ক্রোনিবাদ বলে দেগে দেওয়ার ভুল করলে হবে না— তারা পুঁজিবাদের প্রতীকও বটে। এই গুরুত্বপূর্ণ তফাতটা বোঝার জন্য এখানে কিছু শব্দ ব্যয় করাই যায়। পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকরা ক্রোনিবাদ সম্পর্কে বলবেন যে, কিছু পুঁজিপতির অন্যদেরকে হটিয়ে নিজেদের স্ফীত হওয়ার এবং টিঁকে থাকার মরিয়া প্রয়াস থেকেই ক্রোনিবাদের উদ্ভব হয়। এবং সে তখন একটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে প্রবেশ করে।

এক শতাব্দী আগে, অত্যন্ত সুচারুভাবে লেনিন পুঁজিবাদের এই মিথ্যা দাবীগুলিকে নস্যাৎ করেছিলেন। ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’-এ তিনি লিখেছিলেন:

পঞ্চাশ বছর আগে মার্ক্স যখন ক্যাপিটাল লিখছেন তখন অবাধ বাণিজ্যের নীতি বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদের কাছে ছিল “স্বাভাবিক ন্যায়”-এর মত। মার্ক্স পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন অবাধ প্রতিযোগিতা উৎপাদনের ঘনীভবন ঘটায় যা একটি স্তরে গিয়ে মনোপলিতে পর্যবসিত হয়। সরকারি বিজ্ঞানচর্চা নীরব থাকার ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে মার্ক্সের এই কাজকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিল। আজ সেই মনোপলিই জ্বলন্ত সত্য। অর্থনীতিবিদেরা পাহাড়প্রমাণ বইপত্র লিখছেন মনোপলির বহুস্তরীয় প্রতিফলনকে ব্যাখ্যা করতে এবং সমস্বরে ঘোষণা করছেন, ‘মার্ক্সবাদ ব্যর্থ’। কিন্তু, ইংরেজি প্রবচন যেমন বলে, তথ্য অতীব নাছোড় বিষয়, আমরা পছন্দ করি বা না করি তথ্যকে অস্বীকার করা যায় না। বাস্তব তথ্য দেখায়, অবাধ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের নিরিখে বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশগুলির পার্থক্য মনোপলিরই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু প্রকরণের জন্ম দেয় অথবা জন্মের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এইসবই উৎপাদনের ঘনীভবনের ফল, যা শেষ বিচারে, পুঁজিবাদের বর্তমান বিকাশের স্তরের একটি সাধারণ ও মৌলিক নীতি।

ভেবে দেখুন ক্রোনিবাদই বা আসলে কী! মনোপলি নির্মাণের পদক্ষেপই তো! লেনিনের সেই কথাগুলি এইসময়ে কার্যপদ্ধতির পথনির্দেশক হয়ে দাঁড়ায় যখন তিনি বলেন:

রূপান্তরকালীন বৈশিষ্ট্যে পর্যবসিত হওয়ার বদলে কার্টেলগুলি অর্থনৈতিক জীবনেরই অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে।

সার কথা হল, পুঁজিবাদের এমন কোনও পরিশুদ্ধ রূপ আর নেই যাতে ফেরত যাওয়া যেতে পারে। এক সঙ্কট থেকে আরেকটা সঙ্কটের বিষাক্ত আবর্তে ঘুরপাক খাওয়াই হল পুঁজিবাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। আর এই প্রতিটা নতুন সঙ্কটেই একচেটিয়াত্বের (মনোপলি) মাত্রা এক ধাপ করে বেড়ে যায়। আজকে আমরা কী দেখছি? একদিকে অর্বুদপতিদের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমজীবী জনগণ কর্মচ্যুত হচ্ছেন, জীবন-জীবিকার অপচয় ঘটছে ব্যাপক হারে, মজুরিতে ধ্বস নামছে। এ একেবারে বিশুদ্ধ পুঁজিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রেক্ষিতেই আজকের এই কৃষক আন্দোলন একটা সন্ধিক্ষণের জন্ম দিয়েছে। এখন শ্রমিক এবং শ্রমের যে মজুতবাহিনী সেই বেকার যুবকদের আরও হাজার হাজার যুদ্ধফ্রন্ট খুলে কৃষকদের এই যুদ্ধফ্রন্টের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমাদের অবশ্যই সমস্ত হাতিয়ারগুলিকে সক্রিয় করতে হবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অস্ত্রই যেন একই দিকে কেন্দ্রীভূত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি হিন্দুত্ববাদ-নব্য উদারবাদের এই সংমিশ্রণের শ্রেণিভিত্তিকে ধ্বংস করতে চাই এবং তার কর্তৃত্বকে নাকচ করতে চাই, তাহলে এটাই তার একমাত্র রাস্তা। মাঝামাঝি কোনও পথ নেই। কারণ মধ্যপন্থার কোনও অস্তিত্বই নেই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4874 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...