চলচ্চিত্রের দর্শকদের রুচি পাল্টাচ্ছে, চলচ্চিত্রকারেরাও

চলচ্চিত্রের দর্শকদের রুচি পাল্টাচ্ছে, চলচ্চিত্রকারেরাও -- সত্যব্রত ঘোষ

সত্যব্রত ঘোষ

 


প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

 

চলচ্চিত্র বিষয়ে নানান ধরনের তত্ত্বকথা শুনে ও পড়ে বড় হয়েছি আমরা। টিকিট কিনে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার নামে মনোরঞ্জনে অবগাহনের মানসিকতা সাধারনভাবে আমাদের রয়েই গেছে। এখানে, ‘টিকিট কেনা’ শব্দবন্ধটি লক্ষণীয়। ফিল্ম ক্লাবের সদস্য হয়ে অথবা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অথবা ফিল্ম সংক্রান্ত কোনও আলোচনায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে চেয়েছি, প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের ভাষা ও দর্শন বুঝব। অথচ টিকিট কিনে সিনেমা দেখলে এই জিজ্ঞাসু মনকে ঘুম পাড়িয়ে পর্দায় ফুটে ওঠা সাময়িক আবেগ ও উত্তেজনা উপভোগে আমরা বিশেষ দ্বন্দ্ব অনুভব করি না।

চলচ্চিত্র যেখানে একটি পণ্য, সেখানেই ‘কমার্শিয়াল সিনেমা’ ও ‘আর্ট হাউস মুভি’-র মধ্যে বিভাজনটি বর্তমান। এই দুই প্রান্তের মধ্যে সেতু তৈরির দায়িত্বটি মূলত যাদের, সেই চলচ্চিত্র-সমালোচকদের একটি বড় অংশই বাণিজ্যিক মানসিকতা এবং শৈল্পিক অভিব্যক্তির মধ্যে সামঞ্জস্যের ইঙ্গিতগুলি ধরতে পারেন না। অন্তত বাংলায় এই সমস্যাটি প্রকট। পর্দায় তারকাদের উপস্থিতি মানেই ছবিটি বাণিজ্যিক এবং ছায়াময় নীরব অভিব্যক্তির প্রাধান্য থাকলেই তা শৈল্পিক— এমন সরল এক মনোভাব নিয়ে সমালোচনা লেখার মানুষ এখানে অল্প নয়।

লকডাউনের সময়ে প্রেক্ষাগৃহগুলি দীর্ঘকাল বন্ধ ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই নির্মিত, অথবা এই সময়ে নির্মীয়মাণ কিছু ভারতীয় সিনেমা বিভিন্ন ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মে স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। যার প্রচলন লকডাউনের আগে প্রায় ছিল না বললেই চলে। চলচ্চিত্র বিতরক এবং প্রদর্শকদের ডিঙিয়ে সরাসরি প্ল্যাটফর্মগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি হওয়ার ফলে মরিয়া হয়ে ওঠা নির্মাতাদের আর্থিক দায় কতটা কমল, তা নিয়ে সাধারণ দর্শক হিসেবে মাথা না ঘামালেও আমাদের চলবে। কিন্তু ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নতুন সিনেমা দেখার এই ক্রমবর্ধমান দর্শকদের রুচি নিয়ে কিছু কথা বলাই যায়। কারণ, এই বিপুল সংখ্যক দর্শকদের মধ্যে একটি অংশ হয়তো ঘরে বসেই ‘সিনেমা’ দেখার নতুন মাধ্যম হিসেবে ওটিটি-কে মেনে নেবেন। সেক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক তা হল, ওটিটি-তে সিনেমা দেখার স্বাদ কতটা বর্তমান।

প্রেক্ষাগৃহে বসে বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে উৎসুক হলেও সাম্প্রতিক কয়েকটি ভারতীয় ছবি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখবার সূত্রে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজছিলাম। তাতে আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হল। কতটা বড় বা ছোট পর্দায় ছবিটি দেখানো হবে, তা আগে থেকে ভেবে নিয়েই কি চলচ্চিত্রকারেরা নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করেন? মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের নমনীয় দিকটি এই যে, সে যেমন অনন্তে বিস্তৃত হতে চায়, তেমনি ঘেরা একটি কোণের সূক্ষ্ম দিকগুলির প্রতিও তার শানিত নজর। সুতরাং চলচ্চিত্রকারেদের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে একটি হল মানসচক্ষে তিনি যে দৃশ্যগুলিকে দেখছেন, তা বাস্তবায়িত করা। আগের প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের ক্ষেত্রে সম্ভবত এই দায়িত্ব পালন অপেক্ষাকৃত মসৃণ ছিল। কারণ, এখনকার চলচ্চিত্রকারদের বিকল্প পথগুলির সঙ্গে বোঝাপড়া করেই নিজেদের ভাবনাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। এটি যে একটি ফাঁদ, তা বোঝানোর জন্যে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

স্মার্টফোনের সুবাদে বর্তমানে দৃশ্যজগতের অস্বাভাবিক বিস্ফোরণকে আমরা ব্যবহারকারীরা এখন প্রায় স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছি। দৃশ্যজগতের এই সহজ উন্মোচনের যে মৌতাত, তাতে নতুনত্বের আস্বাদ হয়তো নেই, কিন্তু আছে নিশ্চিন্ত, নিরবধি, নিষ্ক্রিয় কালযাপনের এক সাধারণ উপায়। তাই স্মার্টফোন আমাদের নিত্যসঙ্গী। লক্ষণীয় হল, স্মার্টফোনের যে স্ক্রিন, তার আনুপাতিক মাপটিও নির্ধারিত হয়েছে সিনেমার পর্দায় যে প্রেক্ষণ হয়, সেই মাপে (১৬:৯)। এর আগে টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ করেছি যে তার আনুপাতিক মাপ এবং সিনেমার বর্তমান প্রেক্ষণ ব্যবস্থা এক। একই সাথে মনে রাখতে হবে অ্যানালগ পদ্ধতি অবসানের পর ডিজিটাল প্রযুক্তি সার্বজনীন হয়ে যাওয়ার ফলে চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ, সম্পাদন এবং প্রেক্ষণের সঙ্গে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রসারণ বা স্মার্টফোনে ভিডিও এডিটিং-এর কোনও অ্যাপের সহায়তায় চলমান ছবির প্রাথমিক সম্পাদন পদ্ধতি— এদের মধ্যে রকমফের সামান্যই। চলচ্চিত্র এবং ভিডিও চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনার সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, তাদের জন্য এই এক-কেন্দ্রাভিকতা (কনভারজেন্স) শিল্পগত এবং ব্যবসায়িক দিক থেকে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। টেলিভিশনে চলচ্চিত্র দেখায় ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত হওয়া দর্শকদের একটি বড় অংশই মেনে নিতে পারলেন না যে টিকিট কিনে প্রেক্ষাগৃহে বসে লম্বা একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক অনুষ্ঠান দেখতে হবে। চলচ্চিত্রকারদের এই সহজ পথ নির্বাচনের জন্যেই মূলত তাঁরা চলচ্চিত্র-বিমুখ হলেন।

এতে চলচ্চিত্রকার এবং দর্শকদের মধ্যে যে ব্যবধানটুকু বর্তমান, সেখানেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলির সাম্রাজ্য। অন্তত, কোভিড লকডাউনের দিনগুলিতে তো বটেই। সেই সময়ে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যে ভারতীয় ছবিগুলি মুক্তি পায়, তার কয়েকটি দেখে মনে হল কিছু নবীন ও প্রবীণ চলচ্চিত্রকার এখনও নাটকীয়তার সস্তা মোচড়ে আস্থা না রেখে চলচ্চিত্রের ভাষায় গল্পগুলিকে পর্দায় যেভাবে ফুটিয়ে তুলতে চান, তা পেরেছেন। স্মার্টফোনের সঙ্কুচিত পর্দাতেও এই প্রয়াসগুলির গভীরতা হারায়নি। অথচ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে ওরা প্রমাণও করে দিচ্ছে যে জনসাধারণের রুচি পাল্টাচ্ছে।

লকডাউনের শুরুর দিকে ‘নিরন্তর’ দেখেছিলাম। চন্দ্রাশিস রায়ের পরিচালিত প্রথম ছবিটির কাছে আবার ফিরে গেছি। কারণ, চলচ্চিত্রে কাঙ্খিত যে নমনীয় বিস্তৃতির দুর্লভতা, তা এতে রয়েছে। উন্মুক্ত পাহাড়ের বুকে উন্মোচিত স্বাভাবিক কিছু মুহূর্ত দিয়ে শুরু করে ক্রমশ অনিশ্চয়তা, বিরক্তি এবং কিছুটা ভয় এবং বিভ্রান্তি নিয়ে ছবিটি নিয়ে আসে শহরের চার দেওয়ালের মধ্যে গ্লানি, ক্লান্তি আর নীরবতা। সুলিখিত এক চিত্রনাট্যের সাহায্যে বিপ্রতীপ এই দুই ভৌগোলিক ক্ষেত্রকে একই তলে আনবার জন্যে যে যত্ন এবং চলচ্চিত্রের ভাষার প্রতি আস্থা চন্দ্রাশিস দেখিয়েছেন, তা অনবদ্য। কারণ, প্রাযুক্তিক এবং ব্যবহারিক শর্তগুলিকে নিজের পক্ষে এনেই তো চলচ্চিত্রকার নিজের শৈল্পিক চাহিদা অনুযায়ী কাল (টাইম) এবং পরিসর (স্পেস) নিয়ন্ত্রণ করেন। সেইভাবেই পর্দায় মুহূর্তগুলির জন্ম দেন। অনুশীলনের সেই অবকাশ ও মানসিকতা এখন বাংলায় সত্যিই দুর্লভ।

সুঠাম, বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রনাট্যই যে চলচ্চিত্রের মেরুদণ্ড তা আবার বোঝা গেল মাদ্রাজ টকিজ-এর ‘পুত্থাম পুধু কালাই’ (টাটকা নতুন এক সকাল) নামে পাঁচটি তামিল ছবির একটি সঙ্কলনে। যে উষ্ণ মমত্ববোধ এবং প্রত্যয় এই ছবিগুলিতে ফুটে উঠেছে, তার জোরেই তো চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে সর্বজনগ্রাহ্য এক সজীব মাধ্যম। সুধা কোঙ্গারা, গৌতম মেনন, সুহাসিনী, রাজীব মেনন এবং কার্তিক সুব্বারাজরা চেয়েছেন এটা বোঝাতে যে লকডাউনে আটকা পড়া মানুষগুলি যতই নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে লকডাউনের যাপন শুরু করুক না কেন, একে অপরের সংস্পর্শে তাঁদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবেই। কারণ লকডাউন মানে তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের অখণ্ডতাও, যার সুবাদে পাশের মানুষটিকে নতুন আলোকে চেনা যায়। তাই, দৌহিত্রের সাহচর্যে পিতামহ ভোলেন নিজের মেয়ের প্রতি অভিমান। বাবার প্রতি জমে থাকা দীর্ঘদিনের অভিযোগ দূর হয় যখন অসুস্থ মাকে দেখতে তিন বিবাহিতা বোন আবার একে অপরের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসে। প্রেমিক-প্রেমিকা প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে নিজেদের সন্তানদের জানিয়ে একত্র যাপনের সূচনা করেন। নেশাসক্ত সুরস্রষ্টা প্রাক্তন প্রেমিকের সাহচর্যে এসে নেশামুক্তির প্রয়াস পায়। অদ্ভুত ঘটনাচক্রে তরুণ চলচ্চিত্রকার লাভ করে প্রথম ছবি তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ। এমন বিষয়গুলি চলচ্চিত্রকারদের তখনই ছবি বানানোর প্রক্রিয়ায় জড়ায় যখন তাঁরা নাটকীয়তার সস্তা মোচড়ে আগ্রহী না হয়ে, প্রযুক্তি-তাড়িত চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহী না হয়ে মানুষদের গভীরভাবে চিনতে চাইছেন, চেনাতে চাইছেন। লকডাউনের দিনগুলিতে ক্লান্ত, হতাশাক্লিষ্ট, বিভ্রান্ত, অভিমানী, একা মানুষগুলি দ্বীপ হয়ে না বেঁচে অন্য মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে রেখে যাচ্ছেন মানবিকতার স্নিগ্ধ পরিচয়।

এই স্নিগ্ধতার অন্য এক রূপ ফুটে ওঠে সতীশ কৌশিকের ‘কাগজ’-এ। নাটকীয়তার সস্তা মোচড়সন্ধানী কোনও নির্মাতা যদি ভরতলাল মৃতকের জীবননির্ভর একটি চলচ্চিত্রের প্রয়াসী হতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আক্ষরিক অর্থে বেঁচে থাকার লড়াইটার মর্মবিদারক দিকগুলিকে চটুলতায় ভেসে যেতে দেখতাম। হাস্য-করুণ রসে জারিত এমন একটি ভারতীয় ছবির অভাব আমরা দীর্ঘ সময় অনুভব করেছি। ‘পরশপাথর’-এ আটপৌরে পরেশ দত্তের জীবনে হঠাৎ সমৃদ্ধি জটিলতা সৃষ্টির পর আবার তাকে মাটিতে ফিরিয়ে আনে। সেই মাটিতে অল্পে খুশি থাকা ব্যান্ডপার্টির মালিক হঠাৎই সঙ্কটাপন্ন হন ‘কাগজ’-এ। আইনত তিনি যে বেঁচে আছেন তা প্রমাণ করবার জন্যেই সামগ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁকে লড়াই শুরু করতে হয়। নির্বিকার এক জগদ্দলের বিরুদ্ধে এই একক যুদ্ধই তাঁকে এমন অনেক মানুষের সংস্পর্শে আনে যারা এই অন্যায়ের শিকার। যে রাজনীতি ‘কাগজ’-এর উপজীব্য, তা আসলে জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানবিকতারই এক জরুরি আবেদন। যা ভারতবর্ষের বহুস্তরীয় সামাজিক বাস্তবতায় বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষদের অসাধারণত্বে উন্নীত করে।

সমাজ একমাত্রিক নয়। তবু তার দস্তুর সাদা আর কালোয় সবকিছুকে দেখা। পরিবারও তাই। সাদা আর কালোর মাঝে যে বিস্তীর্ণ ধূসর অঞ্চলের নানান স্তর, রেণুকা সাহানের ‘ত্রিভঙ্গ’র অধিষ্ঠান সেখানেই। সংযোগের যুগ বলে চিহ্নিত এই বর্তমান সময়ে যখন মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগই দুর্লভ হয়ে উঠেছে, পরিবারের সদস্যরা সেই ব্যবধানের অন্যতম শিকার। রেণুকা তাঁর প্রথম ছবিটিতে একই পরিবারের তিন প্রজন্মের নারীর পরস্পরকে ছুঁতে পাওয়ার গল্পটিকে বুনে তোলেন অনুশোচনাহীন এক আত্মকথনের মাধ্যমে, যা আবার সহমর্মী এক পুরুষেরই সংরক্ষণ। পিতৃতন্ত্রে অভ্যস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীর সোচ্চার প্রতিবাদই এই ছবির মূল উপজীব্য নয়। স্বাধীন নারীর নিভৃত উপলব্ধির মুহূর্তগুলি আত্মজাকে উত্তরাধিকার হিসেবে দান করবার তাগিদে যে উষ্ণতা, তার পরশটুকু দর্শকদের অন্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যেই রেণুকার এই আন্তরিক আয়োজন।

বিষাদ, বিরক্তি আর বিভ্রান্তি ভরা লকডাউন এবং পরবর্তী দিনগুলিতেও ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলির সুবাদে এই ছবিগুলি চলচ্চিত্র মাধ্যমের নিজস্বতায় যে মাধুর্য ছড়িয়ে দিল, তা কম পাওয়া নয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...