পিরজাদা ও বামফ্রন্ট

রৌহিন ব্যানার্জি

 


রাজনৈতিক নিবন্ধকার

 

 

 

আব্বাস উদ্দিন সিদ্দিকী। এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতিতে সর্বাধিক না হলেও বহুল আলোচিত একটি নাম। কে তিনি? আজ থেকে তিন চার মাস আগেও তাঁর প্রধান পরিচয় ছিল তিনি একজন প্রিচার বা ধর্মগুরু— ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা। এই পরিচয়টি নিয়ে আমরা পরে বিশদে আলোচনা করব। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি রাজ্য রাজনীতিতে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক তাঁর নতুন দল— “ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট”-এর প্রধান হিসাবে এবং বাম-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে মহাজোট করে ভোটে নামার যৌথ সিদ্ধান্তের কারণে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিরোধিতা করছেন বিজেপি ও তৃণমূল সমর্থকেরা, কিন্তু সেইসঙ্গে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বাম সমর্থকদের একাংশও— তাঁরা মনে করেন, একজন “ধর্মীয়” নেতার সঙ্গে জোট করা বাম আদর্শের পরিপন্থী— এটা ঠিক নয়। আমরা এখন এই প্রসঙ্গটিই আগে একটু আলোচনা করে দেখব।

আব্বাস উদ্দিন সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আছে— যার কিছুটা সত্যি, কিছুটা মিথ্যা। সমস্যাটা হল, আমরা যারা সমালোচনায় নামছি, আব্বাসউদ্দিনরা আমাদের সিলেবাসের বাইরের মানুষ। আমরা এঁদের প্রশংসা বা সমালোচনা করতে নেমে খেয়াল করি যে এঁদের আমরা চিনিই না। ফলে সেই অপরিচয়কে ঢাকতে এনে ফেলি কিছু বহুলব্যবহৃত অ্যানেকডোট এবং চেনা ফর্মুলা। আব্বাসউদ্দিন একজন ধর্মগুরু, এবং নামে মুসলমান, অতএব তিনি সাম্প্রদায়িক— এই সহজ অঙ্ক আমরা মনে মনে কষে ফেলি— খেয়ালই থাকে না, অথবা থাকলেও সেটাকে গুরুত্ব দিই না যে তাঁর দলের নাম কিন্তু “ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট”— স্পষ্টভাবে উল্লিখিত সেকুলার শব্দটি, এবং বিন্দুমাত্র ধর্মীয় অনুসঙ্গ নামে অন্তত নেই। কিন্তু নাই বা থাকল— নেতার নামটি তো মুসলিম— অতএব তার সেই “সেকুলারিজম” বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি অবশ্যই সাম্প্রদায়িক, আমার সূত্র অনুযায়ী।

সূর্যকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, তাঁরা আইএসএফ-কে সাম্প্রদায়িক মনে করেন না, কারণ তিনি সর্বধর্মের কথা বলেন। আব্বাসউদ্দিনের রাজনৈতিক বক্তৃতা যখন শুনি, তিনি বলছেন নিম্নবর্ণ হিন্দু-মুসলমান-দলিতদের নিয়ে মহাজোটের কথা, বলছেন কৃষক আন্দোলনকে সমর্থনের কথা, বেকারদের কর্মসংস্থানের কথা— রাজনৈতিক দর্শনে বামেরাও তো এই কথাগুলিই বলে থাকেন— কিন্তু একজন মিশ্র, ভট্টাচার্য বা কারাত এই দলিত-মুসলমান জোটের কথা বললে তা বিশ্বাসযোগ্য অথচ একজন সিদ্দিকী বললে নয়? মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী যেন কাদের ভাষ্য?

আরেকটি অভিযোগ, এই আব্বাসউদ্দিন সিদ্দিকী অত্যন্ত নারীবিদ্বেষী— তিনি প্রকাশ্য সভায় “বেশ্যা অভিনেত্রীদের” চাবকানোর আহ্বান রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট বক্তৃতাটি বর্তমান লেখকের শোনা নেই, কিন্তু তার মানেই উনি এরকম কিছু বলেননি, এমন দাবী করছি না। হতেই পারে একজন “ধর্মগুরু” হিসাবে তিনি এই ধরনের কথা বলেছেন, এবং বলে থাকলে তা অবশ্যই অতি নিন্দনীয়। সেই নিন্দা করেও আমরা রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করব, এই জোট বাম রাজনীতির পক্ষে একেবারেই বর্জনীয় কি না।

এখানে আরও একবার সেই প্রসঙ্গটা না চাইলেও চলে আসবেই, গ্রাম-গঞ্জ এমনকি মফস্বলেরও মেঠো রাজনীতির ভাষা আমরা, তথাকথিত শহুরে “শিক্ষিত” রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আদৌ বুঝি না। জোটের পক্ষে বাম তথা সিপিএম এর যেসব নেতাকর্মী কথা বলেছেন, তাঁরা এটা “না জেনে”-ই বলেছেন, এমন নয়— তাঁরা কিন্তু মাঠে ময়দানেই রাজনীতিটা করেন, ফেসবুকে নয়। শুধু কলকাতার রাজপথেও নয়। নারীবিদ্বেষী বক্তব্য এই চরম পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় তথা বঙ্গ রাজনীতিতে প্রথম উচ্চারিত হল, এমন তো নয়? বাম সহ (যতই দুর্ভাগ্যজনক হোক) প্রতিটা রাজনৈতিক দলে এরকম প্রচুর রত্ন আছেন— তাদের কজন সেই পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব ছেড়ে ময়দানি বক্তৃতায় স্পষ্ট ভাষায় দলিত-মুসলমান-নিম্নবর্ণ হিন্দু জোটের কথা বলতে পেরেছেন, সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

আরেকটা ন্যারেটিভ, এরা বিহারে ওয়েসির মতই, তৃণমূলের ভোট কাটবে এবং তদ্বারা বিজেপিরই সুবিধা হবে। এই তত্ত্ব অনেকটা “নো ভোট টু বিজেপি”-র মতই— পান থেকে চুন খসলেই “বিজেপি এসে যাবে”র জুজু। বাম জোটের স্পষ্ট নীতি, বিজেপিকে ঠেকাতে হলে একই সঙ্গে, একই গুরুত্ব দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকেও ঠেকাতে হবে। কারণ বিজেপিকে ঠেকিয়ে তৃণমূলকে আসার পথ করে দিলে, দু মাস বা পাঁচ মাস পর সেই তারাই বিজেপিতে যোগ দিয়ে দেবে না, এমন কোনও ভরসা আর করা যাচ্ছে না। কাজেই “তৃণমূলের ভোট কাটা” বামেদের, বাম জোটের সমস্যা হতে পারে না। সেটায় তাদের রাজনৈতিক অ্যাডভান্টেজ।

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে যতগুলো ভোট হয়েছে, ব্যতিক্রমহীনভাবে রাজনৈতিক দলগুলি চেষ্টা করেছে “মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক” নামে একটি সমসত্ত্ব ধারণাকে আমাদের মানসে চারিয়ে দেওয়ার। বিজেপির মত দল চেষ্টা করেছে পোলারাইজেশনের মাধ্যমে এই ভোটব্যাঙ্কের বাইরের ভোট নিজের কুক্ষিগত করার— যাতে সাম্প্রতিক কালে তারা সাফল্যও পেয়েছে যথেষ্ট, অন্যদিকে কংগ্রেস, জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, সপা, বসপার মত দলগুলি এমন কি বামেরাও চেষ্টা করে গেছে এই “মুসলিম ভোট” নিজেদের দখলে রাখবার। মুসলমান মানেই সে একটিই সমসত্ত্ব সমাজের অঙ্গ, তার কোনও ব্যক্তিগত মতামতের দাম নেই, তার কোনও নিজস্ব বিবেচনাবোধ, রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ বা প্রজ্ঞা— কিছুই নেই— এটাই আমাদের ধারণায় থিতু হয়ে গেছে।

পাঠক বলতেই পারেন, এই ধারণা তাঁরা পেয়েছেন অভিজ্ঞতা থেকেই; বারেবারে দেখেছেন কোনও ইমাম ডাক দিচ্ছেন “সাচ্চা মুসলমান হলে অমুককে ভোট দিন” বলে, আর সেই ডাক নিজেদের পক্ষে দেওয়ানোর জন্য নেতারা ইমামের দরবারে হত্যে দিচ্ছেন। আপনার অভিজ্ঞতা এই অবধি সত্যি— বাকিটা নির্মিত। ইমামের ডাকে কতজন “সহি মুসলমান” সেই দলকেই ভোটটা দিলেন, সেই হিসাব প্রায় কখনওই করা হয়ে ওঠেনি— কারণ কেনই বা করব? আমাদের ধারণায় মুসলমানেরা তো ভোটব্যাঙ্কই। প্রেডিক্টেবল, গড্ডল প্রবাহ।

আব্বাসউদ্দিন এখানেই মোক্ষম চালটা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলায় মুসলিম ভোট তৃণমূল কেন পাবে, যারা তাদের কর্মসংস্থান দিতে ব্যর্থ? মুসলিম ভোটই যদি হয়, (অর্থাৎ মেরুকরণ, যা সব রাজনৈতিক দলই করছে), তবে তা পাক মুসলমানদেরই দল— এবং সেই দল একই সঙ্গে “সেকুলার”ও বটে। তিনি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। মতুয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে দাবী জানিয়েছেন। তাঁর এই আক্রমণ তৃণমূল এবং বিজেপি, উভয়কেই নাড়া দিয়েছে, একটি নবাগত দল হিসাবে একটু বেশিই নাড়া দিয়েছে, সন্দেহ নেই। যে আসনগুলিতে আইএসএফ প্রার্থী দিচ্ছে সেগুলি সবই বর্তমানে তৃণমূল অথবা বিজেপির দখলে— তাঁর রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্নের জায়গা নেই।

ফুরফুরা শরিফ সম্বন্ধেও আরেকটু জানতে বলব পাঠককে। মুসলমান তীর্থ হয়েও হুগলি জেলার এই জনপদটি কিন্তু শুধু সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ নেই। ফুরফুরা শরিফের পির এবং পিরজাদারা (খেয়াল করবেন, মৌলবি বা মৌলানা নয় কিন্তু) সুফি সংস্কৃতির ধারক— যে সুফিকে এমনকি ইসলামোফোবিকদেরও একটা বড় অংশ মানবিক ইসলাম বলে মান্যতা দিয়ে থাকেন। এখান থেকেই ইসলামিক সংস্কৃতি বাংলা-বিহার-অসম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই যে দলের নাম “ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট”— এ নামকরণ ততটাও ভুইঁফোড় নাও হতে পারে। পটভূমি তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিনের ইতিহাসে। পিরের সংস্কৃতিও আমাদের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির গল্পই বলে। এখনও, আজ এই আকালেও গ্রামে-গঞ্জে বহু অঞ্চলেই হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশিই থাকে, পায়েস-নাড়ু-পোলাও-এর বাটি চালাচালি হয়। মাজারে সিন্নি চড়ান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ, আজও। আমরা না গেলে দাঙ্গা লাগে না। আব্বাসউদ্দিন নামটা আমাদের শহুরে ভদ্রবিত্ত বৃত্তে যতটা বিবমিষা উদ্রেককারী, গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র ততটা নয়।

এবং লেখকের ব্যক্তিগত মত, আইএসএফ-এর সঙ্গে বামদলের এই জোট বামেদের পক্ষে একটা প্রায়শ্চিত্তের সামিল। মুসলমানদেরকে কখনও হলেও ভোটব্যাঙ্ক ভাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। বামদল, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি যদি শহুরে মধ্যবিত্তের (পড়ুন হিন্দু মধ্যবিত্তের) চাওয়া পাওয়ার ভিত্তিতে চলাটুকু থেকে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের ভাষাকে আবার চেনাবোঝার পথে ফিরে আসে, তবে বুঝব তারা সঠিক দিশায় চলছে। নির্বাচনী জয়পরাজয় দিয়ে সে দিশার সামগ্রিক হিসাব হয় না। আরএসএস পঞ্চাশ বছর নিয়েছে বিজেপিকে আজকের জমিটা দিতে। কমিউনিস্টদের অত সময় লাগে না, যদি তাদের দিশা সঠিক থাকে, কারণ তারা মানুষের খিদের খবর রাখে। সেটাই তাদের ধর্ম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...