নোঙর

সোমেন বসু

 

নোঙরের চাহিদা কি অন্যায়? বরং খুবই স্বাভাবিক নয় কি? কোনও কবি হয়তো প্রেয়সীর পাখির নীড়ের মতো চোখে তল্লাশ করে আর কোনও বটচারা স্যাঁতস্যাঁতে ফুটিফাটা স্মৃতিজর্জর অট্টালিকার দেওয়ালে শ্যাওলার গা ঘেঁষে ঝুরঝুরে চুনসুরকির মধ্যে দিয়ে শিকড় চারিয়ে দেয়। নোঙরেরই তো সন্ধান।

তৃণা ভাবত ওই যুবকই নোঙর। ঘাড়ছাপানো রেশম রেশম এলোচুল, পশম পশম দাড়ি, গিটার, কবিতা গান লেখার খাতা, নজর না দেওয়া জামাকাপড়। কিশোরীবেলার সদ্য শেষ করা রবিনসন ক্রুশোই যেন। একদিকের অসুস্থ পরিবারজীবন, অন্যদিকের চোখে বয়সোচিত মায়াকাজলে ভর করে ও উড়ে বেড়াত ওই যুবকের সাথে। বাগবাজার ঘাট, উল্টোডাঙ্গা ফুটব্রিজ, কলেজ স্কোয়ার, নন্দন। ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পেত, পেত তটভূমির ভিজে বালির গন্ধ। হাতের আঙুলগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকতো আধময়লা, কুঁচকোনো পাঞ্জাবীর আস্তিনটা।

সময় খুব নিষ্ঠুর। কত কিছুকেই পালটে দেয় নির্বিকারে। মহার্ঘ একহাজারি নোট কাগজ হয়, নাস্তিক বিজেপি হয়। রবিনসন ক্রুশো বাঘ হল। বাঘ খারাপ কিছু নয়, বেশ শৌর্যবীর্যের প্রতীক। আবার বোধহয় পৌরুষেরও। তৃণার কাছে একটা অতিরিক্ত– ভয়ের। সেই যে ছেলেবেলায় একবার চিড়িয়াখানায় গেছিল বাবা-মা’র সাথে, ঠিক বাঘের খাঁচাটার আসার আগেই শুরু হয়েছিল বাবা-মা’র মেগাসিরিয়ালটার বোধহয় তিনহাজার সাতশো চুরাশি নম্বর পর্ব, বাবার চোখ লাল আর মা’র চোখ ভিজতে শুরু করেছিল, তৃণা ভয়ে ভয়ে একবার এর একবার ওর মুখের দিকে চাইতে চাইতেই তাকিয়েছিল সামনে চলে আসা বাঘবাবাজীর দিকে। খাঁচার ভেতরেই, বাইরে নয়, কিন্তু মুশকিলটা হয়েছিল, সে ল্যাদ খাওয়া ছেড়ে ঠিক তক্ষুনি গা হাত পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সশব্দে একটা বিরাট মুখব্যাদান করল, ঠিক তৃণারই দিকে তাকিয়ে। চিৎকার করে উঠেছিল ও। তার একটা প্রত্যক্ষ ফল ফলেছিল মেগাসিরিয়ালের ওই এপিসোডটা নির্দিষ্ট সময়ের খানিক আগেই বন্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু তৃণার মনে ভয়ের প্রতীক হিসেবে বাঘ একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল। না, এমন নয় যে ওর কোনও ফিয়ার সাইকোসিস হয়ে গেছিল বা বাঘের ছবি দেখলেই হিস্টিরিয়া হত। বরং ব্যাপারটা এমন যে ভীতিপ্রদ কিছুর উপমা দিতে হলেই ওর বাঘের কথা মনে পড়ত এবং এখনও পড়ে।

এখনের কথা বলতে মনে পড়ল, তৃণার কাছে খাতাটা এখনও আছে। সেই কবিতা গান লেখা খাতাটা। বস্তুত, ওটাই এই হাসপাতালে ওর সঙ্গী। হাসপাতাল বলছি, তৃণার তাই ভাবতে ভালো লাগে তাই। নইলে বৃদ্ধাবাসও বলা যায়, বা অ্যাসাইলাম, বা অন্যকিছু। কিন্তু নিজেকে বৃদ্ধ, পাগল বা অন্যকিছু ভাবাটা মানুষের ইনস্টিংক্ট বিরোধী। রুগি ভাবাটাও, তাও সেটা মন্দের ভালো। তাই তৃণার কাছে এটা হাসপাতাল। এই ঘরটা তিনতলায়। এর পুরু দেওয়ালের মাঝে একটা ছোট্ট জানালা আছে। সেটাতে উঁকি মারলে একটু দূরে কম্পাউন্ডের উঁচু পাঁচিল ছাড়িয়ে একটা পুকুর দেখা যায়, পাশে একটা ছোট ঘাসে ঢাকা জমি। তৃণা ছবি আঁকে, ওই খাতাটায়। আঁকত আগে। মোটের ওপর ভালোই। মাঝে অনেকদিন বিরতির পর এখন আবার। কিন্তু ও প্রাণপণে একটা নোঙর আঁকতে চায়। আঁকশিগুলো দিয়ে বেলাভূমিকে আঁকড়ে ধরে আছে বেশ। এমন একটা নোঙর। কিন্তু সেটা কেমন করে যেন খালি একটা বাঘের মুখ হয়ে যায়। সেটা অখুশি করে না অবশ্য তৃণাকে। বরং বাঘ হয়ে যাওয়ার পর ও বেশ যত্ন করতে থাকে সেটাকে। শান্ত হয়ে মুখের রোম আঁকে, গোঁফ, শেষে চক্ষুদান করে। বেশ মায়াভরা হয় চোখদুটো। তারপর গলার কাছে একটা দাগ দেয়। গোটা অঙ্কনপ্রক্রিয়াটায় এই পর্যায়ে এসেই তৃণার শান্তিভঙ্গ হয়। ও আকুলিবিকুলি করে ওই দাগটাকে লাল করতে চায়, পেন্সিলটা ঘষে বারবার, কিন্তু কালো উডপেন্সিলে আর লাল দাগ হবে কী করে! একটা লালরঙ বা লাল পেন্সিল বা লাল কালির কলম হলেও বেচারি শান্ত হতে পারত। কোত্থেকে পাবে? জেলখানায় এই যে একটা পেন্সিল পাওয়া গেছে, সেটাই ঢের নয় কী?

তবে তৃণা কিন্তু প্রতিবার নোঙরই আঁকতে চায়! সত্যি…!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অনেকদিন পর আবার পুরোনো চেনা গন্ধটা পেলাম। খুব ভালো লাগলো। কিন্তু খিদেটা ঠিক মতো পাওয়ার আগেই গন্ধ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

Leave a Reply to ঋতব্রত Cancel reply