আপাতত পালাচ্ছি আমরা

আপাতত পালাচ্ছি আমরা -- সোমেন বসু

সোমেন বসু

 

সরকারি বাসস্ট্যান্ড, থেকে একটু সোজা এগিয়ে রাস্তাটা ঘুরে গেছে ডানদিকে আর সেই রাস্তাবরাবর বাঁদিকে শুরু হবে জেলা হাসপাতালের লম্বা দেওয়াল, গেট দুটো পড়বে আরও একটু এগোলে। পুরো জায়গাটাতেই রাস্তার দুধারে বড়ছোট দোকানপাট। এক-আধটা নার্সিং হোম, ডায়াগনস্টিক সেন্টারও গজিয়ে উঠেছে এদিক-সেদিক এ গলি-সে গলি। হাসপাতালের দেওয়াল শেষ হতে না হতেই রাস্তার উল্টোধারে পলিটেকনিক কলেজ, তারপরে তো বেশ একটা জমজমাট বাজার, চৌমাথা, সেসব হয়ে রাস্তা ঢুকে গেল এক মধ্যবিত্ত পাড়ায়। চৌমাথার যে মাথাটা ডানদিকে ঢুকেছে, সেটায় ঢুকেই এই গঞ্জশহরের প্রধান কলেজখানা। আর একটা মাথা, স্কুলছুট ছেলের মতো, বাঁদিকে কোনাকুনি কেটে গেছে যেন অভিমানে, আর এই এতক্ষণের রাস্তা ধরে বয়ে আসা সজীব প্রাণময়তাটাও এই ছেড়ে যাওয়া সঙ্গীটিকে বেমালুম পরিত্যাগ করেছে চরম উদাসীনতায়। এই কেটে যাওয়া গোটা রাস্তাটায় একটা মোটে দোকান। সেটাও এখান থেকে দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলে কিছু নেই বলেই মনে হবে। বাড়িঘরও নেই। শুধু কিছু গাছ। জারুল আকাশমণি সেগুন…। যখন সন্দেহটা বাড়তে থাকবে যে এরকম একটা জায়গায় হঠাৎ করে এমন একটা নির্জন বীথির অবতারণা কেন, তখনই চোখে পড়বে প্রকাণ্ড এক দেওয়াল, সেই দেওয়ালের মধ্যে সেরকমই প্রকাণ্ড এক লোহার গেট। এটা জেলখানা। শুদ্ধ ভাষায় কারাগার, অধুনা সংশোধনাগার। আর জেলখানার পরেই এই দলছুট রাস্তাখানার একমাত্র দোকানটা মুখ বের করবে। ধীরেনের চায়ের দোকান। চায়ের সঙ্গে একদিন ঘুগনি আর একদিন আলুরদম পাওয়া যায়, পাউরুটি, ডিম। সন্ধেবেলা টুকটাক ভাজাভুজি— পেঁয়াজবড়ি, চপ। সবই জেলখানার জন্য। ব্যারাকে থাকা সিপাইরা এসে খায়। জেলখানাতেও সময়ে সময়ে দিয়ে আসতে হয় সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যার বা জেলারবাবু-ডেপুটি জেলারবাবুদের জন্য। দুপুরের দিকে আসে কয়েদিদের বাড়ির লোকজন। এই দেখা করাটাকে জেলের পরিভাষায় বলে ইন্টারভিউ, ধীরেন জানে। বেশিরভাগই গ্রাম্য লোকজন, শহরের লোকেরা নিজেদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে নেয় সাধারণত, সেও জানে ধীরেন। মোদ্দা কথা, ধীরেনের খরিদ্দার এই জেলখানাকেন্দ্রিক মানুষজন দিয়েই শুরু, এদের দিয়েই শেষ। কারণ এ রাস্তায় আর কোনও মানুষ নেই। এক যদি না হাইরোড বা বাইপাস— আসলে জাতীয় সড়ক— থেকে পথচলতি ক্ষুধার্ত, শ্রান্ত কেউ ধীরেনের দোকানটা দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়ে। দেখা যায়। ধীরেনের দোকানের পরে এই দলছুট রাস্তাটার আয়ু আর দু-আড়াইশো মিটার মাত্র। তারপরই সে গিয়ে পড়েছে এই গঞ্জ-শহরটাকে বেড় দিয়ে থাকা জাতীয় সড়কে। সেই হাইরোড থেকে দেখা যায় ধীরেনের দোকানটা। কিন্তু হাইরোডে তো খুব কম মানুষই হাঁটে।

এরকমই ওই ছেলে দুটো এসেছিল। গত পরশু। বেলা তখন চড়া। চৈত্র মাস। দোকানও ফাঁকা, রাতডিউটির সেন্ট্রিবাবুরা চা টোস্ট-মোস্ট খেয়ে, খবরের কাগজ পড়ে, খানিক গল্পগাছা করে উঠে ব্যারাকের দিকে চলে গেছে একটু আগেই। এখন ওদের স্নানখাওয়ার সময়। দোকানে টুকিটাকি গোছগাছ করতে করতে ও-ও খেয়ে নেবে ভাবছিল ধীরেন। বাড়ি থেকে একটা স্টিলের মুখবন্ধ চ্যাপ্টা বড় বাটিতে নিয়ে আসা খাবার। মা রেঁধে বেড়ে গুছিয়ে দেয়। ভাত ডাল তরকারি, কোনও দিন মাছ। বাড়িটা যে খুব দূর তা নয় ধীরেনের। এখান থেকে সাইকেলে— সাইকেলেই আসাযাওয়া— মিনিট কুড়ি লাগে। এই হাইরোডে পড়ে, হাইরোড এখানে তেরছা, উত্তর-পশ্চিম মুখো, উত্তর-পশ্চিমে হাফ কিলোমিটার মতো গিয়ে ডানদিকে, মানে উত্তর-পূবে, যে ইটের এবড়োখেবড়ো লালরঙা রাস্তাটা ঢুকে গেল, ওটা দিয়ে ঢুকে আর মিনিট দশ-বারো সাইক্লিং। পুরসভা শেষ করে এখান থেকে শুরু হয়ে যাবে পঞ্চায়েত এলাকা। দুপাশেই আবাদি ভুঁই। আর একটা বেখাপ্পা ইটভাটা। এই যে রাস্তাটার এই হাল, এর একমাত্র কারণ ওই ভাটা থেকে ইট বয়ে নিয়ে যাওয়া ট্রাক্টরগুলো।

ধীরেন ভাবছিল খেয়ে নেবে। ভাবছিল ফাঁকা আছে দোকান। তখনই চোখ পড়েছিল একটা বেঞ্চির কোণায় বসে থাকা খোচরবাবুর দিকে। তাই তো! খোচরবাবু তো আছে। খোচরগিরি করে করে কেমন একটা অশরীরী ভাব আয়ত্ত করে ফেলেছে যেন। মালুমই পাওয়া যায় না। হাসে ধীরেন মনে মনে। খোচর বললে রেগে যায়। তেনারা নাকি আইবি। আছে এরকম তিন-চারজন শহরে। ধীরেন চেনে সবাইকে। জেলখানার পাশে দোকান ওর। এদেরও জেলখানার পাশে ঘুরঘুর করতে হয় অবধারিত মাছির মতো। নিঃশব্দ মাছি— আবার হাসল ধীরেন। ভনভন করলে খোচরবাবুদের চলবে না।

এইসব আলগোছ ভাবনা, দু-একটা চায়ের কাপ ধোওয়া, বিস্কুটের বয়ামগুলো একটু ঠিকঠাক করে নেওয়া, মাঝেমাঝে আড়চোখে খোচরবাবুকে দেখা, এক-আধবার মুখবন্ধ টিফিনবাটিটার দিকেও তাকানো কারণ ধীরেনের খিদে পেয়েছে… এসবের মধ্যেই এসেছিল ছেলেদুটো।

–চা হবে নাকি দাদা? সামনে রাখা বেঞ্চিটাতে বসতে বসতে বলল একজন। বোঝাই যাচ্ছে গ্রামের চ্যাংড়া। দেশিপলি। মানে দেশিয়া বা পলিয়া। এখানকার রাজবংশীদের এই দুটো ভাগ। একটা গল্পও আছে সে নিয়ে, ধীরেন জানে। থাক সে পরে হবে সুযোগ পেলে। বিষয়টা হল রাজবংশীরা যেহেতু মঙ্গোলয়েড, তাই তাদের মুখের লেপাপোছা ভাবে সেটা বোঝা যায়। আর মুখ খুললে বোঝা যায় দেশিয়া না পলিয়া। অদ্ভুতভাবে এখানে দেশিয়া, পলিয়া এবং মুসলিমদেরও ডায়লেক্টে কিছু কিছু তফাত রয়েছে। বিশেষ করে ক্রিয়াপদে। এই ডায়লেক্ট শব্দটা ধীরেন শিখেছিল এক সেন্ট্রিবাবুর কাছে। অল্পদিনের জন্যই এসেছিল এখানে, ফরসা বেঁটেখাটো মাথায় টাক। কলকাতায় বাড়ি নাকি, দাবা খেলার খুব নেশা ছিল লোকটার। সে-ই একদিন এখানে চা খেতে খেতে কথাটা বলেছিল, মনে থেকে গেছে ধীরেনের।

এই এর পরেই দ্বিতীয় ছেলেটা মুখ খুলেছিল আর ধীরেন বুঝে গেছিল এরা পলিয়া।

–আরে ভুখ নাগিছে বায়ো! চা হবে পরে। খাবারদাবার কিছু ছে নি বড়কা-দা?
–ঘুগনিরুটি দিম? নাকি মুড়িঘুগনি খাবেন? পলিয়াতেই জবাব দেয় ধীরেন। পারে এখানে অনেক অ-রাজবংশীরাই। যেমন শিলিগুড়ির বেশিরভাগ বাঙালিই নেপালি ভাষাটা বলতে পারে।
–ঘুগনিমুড়িই দাও। রুটি মানে তো ওই পাউরুটিলা? নাঃ ওইলা চলবে নি ভুখের সময়ে…। দাও মুড়িঘুগনিই দাও। বলতে বলতেই জগ নিয়ে দোকানের কোণে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাতমুখ ধুতে শুরু করেছিল ছেলেদুটো।

তারপর খেতে খেতে জিজ্ঞেস করেছিল “তোমরা টিভি নাগান নাই বড়কা-দা?”

হেসে ফেলেছিল ধীরেন। “এঠিনা নোক কেদুর? টিভি নাগায়ে মোকই দেখবা হবে!”

সত্যি তো! এ রাস্তায় বাড়িঘর এবং মানুষজন— দুয়েরই যে অভাব, সেটা যেন তখনই মালুম পেল ছেলেদুটো। চারিদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু দেখল রাস্তাটা, লাইটপোস্ট, রাস্তার ধারের আকাশমণি, বাবলা কটা, সেগুন, একটু ঝোপঝাড়, আর জেলখানার লম্বা পাঁচিলখান। এতক্ষণ ক্লান্তি, আর তার চেয়েও বেশি করে খিদে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে এসব দিকে আর তাকানো হয়ে ওঠেনি। তাকালে কি আসত? জেলখানাটা দেখেই সহজ ভাবটাই নষ্ট হয়ে গেছিল যেমন! থানা-পুলিশের সংসর্গ সাধারণ মানুষের খুব একটা পছন্দের নয়, আর এ তো একবারে জেলখানা। শহরের লোক তাও কিছুটা কম আড়ষ্ট হয়, গ্রামের মানুষের তো কথাই নেই। ধীরেনের দোকানে বাইরের খরিদ্দার কম হওয়ার এটাও একটা কারণ।

টাউনিয়া একটা বাবু-কাটিং লোক যে অন্য একটা বেঞ্চিতে বসে— যে বেঞ্চিটা ধীরেনের অবস্থানের দরুন এখান থেকে খুব একটা দেখা যায় না— সেই বেঞ্চিরও পেছন কোণে বসে মাঝেমাঝেই ওদের দিকে কুতকুতে চোখ মেলে তাকাচ্ছিল, সেও বোধহয় নজরে পড়ে থাকবে ওদের তখনই।

চা-ও খেল না আর চ্যাংড়াদুটো। একটু তাড়াহুড়ো করেই মুড়িঘুগনি শেষ করে দাম মিটিয়ে বেরিয়ে গেল। ধীরেন বলেছিল, যদিও দুটো চায়ে আর কী, আর ওর তখন খিদেও পেয়েছে— কিন্তু তবু তো খরিদ্দার। কিন্তু ওরা বলল— নাঃ অবা দাও। মেলা দূর যাবা হবে। বেলা থাকতে থাকতে… ইত্যাদি।

যদিও ধীরেন আর মাথা ঘামায়নি, কিন্তু টিফিনবাটিটা খুলতে খুলতে যে দেখেছিল ছেলেদুটোর পিছু পিছু মুখে একট রুমাল চাপা দিয়ে খোচরবাবুও রওনা দিল সেটা মাথায় থেকে গেছিল দাঁতের ফাঁকে ঢুকে থাকা মাছের কাঁটার মতো।

আর তারপর জেলখানার দিকে মাথা ঘুরিয়েই চোখাচোখি হয়ে গেছিল বিমলের সঙ্গে।

বিমলের, এমনিতে সব ভালো, কিন্তু চোখদুটোতে কী একটা যেন আছে। মানে, ভয়ঙ্কর— তাকিয়ে থাকা যায় না। হাট্টাগাট্টা চেহারা, হাইটটা বেশি না, চৌকোনো মুখ, বড়ির মতো নাক, একজোড়া মোটা মোচ। বাইরে থাকলে কেউ বুঝতেই পারবে না বিমল পোদ্দার অত বড় ক্রিমিনাল। ক্রিমিনাল বলছে, কারণ ধীরেন জানে, নইলে বলত না। একবার এরকম ক্রিমিনাল বলে সেন্ট্রিবাবুদের কাছে ধমক খেয়েছিল। কলকাতার সে সেন্ট্রিবাবুটা ছিল তখন।

–ক্রিমিনাল আবার কী! ওরা তো ইউটি। ক্রিমিনাল হবে কেন?
–ইউটি?
–আন্ডার ট্রায়াল। মানে যাদের বিচার চলছে। বাংলায় বলে বিচারাধীন বন্দি।
–তা ক্রিমিনাল না হলে পুলিশ ধরে কেন?
–পুলিশ কেন ধরে? হেসে উঠেছিল একজন সেন্ট্রিবাবু।
–পুলিশ অনেক কারণে ধরে। তোর সঙ্গে কোনও পয়সাওলা কারও, বা কোনও নেতা-ফেতার, কি ধর আমাদেরই কারও ঝামেলা লাগলে তোকেও ধরতে পারে। কেন এরকম দেখিসনি নাকি?
–ও বেচারা সারাদিন চায়ের দোকান করে আর আমাদের মুখ দেখে। দোকানটা অন্য জায়গায় হলে তাও দু চারটে ফ্রেশ লোকের মুখ দেখতে পারত, কিছু কথাবার্তা খবরাখবর কানে আসত। এখানে তো সেটাও হয় না…

সেন্ট্রিবাবুরা একটা কথা মাঝেমাঝেই বলে। কখনও ধীরেনকেই বলেছে, নিজেদের মধ্যে তো বলেই। “আরে আমরাও তো জেলই খাটছি। এই জেলখানা আর ব্যারাক ছাড়া আমাদের আছে আর কিছু জীবনে! একদম গরাদের ভেতরে থাকি না, এটুকুই…।” ধীরেনের মনে পড়ে গেছিল সে সময় এই কথাটা।

–হুমম… যাই হোক, যেটা বলছিলাম… পুলিশ ধরা দিয়ে কিছু হয় না। আমাদের দেশের আইন বলে একজন যতক্ষণ না দোষী প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ তাকে অপরাধী বলা যায় না। সেই হিসেবে এই ইউটিরা কেউই ক্রিমিনাল নয়…
–বিমলের কথা অবশ্য আলাদা। এক সেন্ট্রিবাবু বলেছিল একটু হেসে আস্তে করে।

ফলত, এই জিলা-জেলখানায়, যে জেলখানার সেরকম কোনও রক্তাক্ষর ইতিহাস নেই, যে জেলখানার ভেতরের কোনও ছাতিম-আকাশমণির ডাল থেকে এই শেষ বসন্তে হঠাৎ ডেকে ওঠে কোনও পথভোলা কোকিল, যে জেলখানার ওয়ার্ডের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে থাকে বাংলাদেশি জান-খালাসদের দীর্ঘশ্বাসে, যে জেলখানার বর্তমান সুপারিন্টেন্ডেন্ট ভেতরের গাছগুলোকে একের পর এক কাটিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে শোনা এবং দেখা যায়— সেই জেলখানায় গত সাত বছর ধরে বিমল পোদ্দার একটা বিষয়। ওকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ধীরেন যেমন পারে না বিমলের চোখদুটোকে বেশিক্ষণ ভুলে থাকতে।

বিমলকে ধীরেন প্রথম দেখেছিল ওই সাত বছর আগেই, মনে করতে পারে ও। তখনও এসব দোকান নেই, তখনও ওদের গায়ে ম-ম বাংলাদেশি গন্ধ, তখনও ওর বাবা বেঁচে। বাবার সঙ্গেই এসেছিল একদিন জহরকাকুর পানবিড়ির দোকানে। জহরকাকু বাংলাদেশে ওদের প্রতিবেশী ছিল, লতায়পাতায় সম্পর্কও ছিল একটা, কিন্তু আসল সম্পর্কটা সেই সম্পর্কের চেয়ে অনেকটাই গভীর ছিল। জহরকাকু এদেশে এসে গেছে তারও বছর তিনেক আগে। ধীরেনের বাবা বারদুয়েক এসে ঘুরেও গেছিল জহরকাকুদের বাসা থেকে। এখানে ওই হাসপাতালের সামনে জহরকাকু পানবিড়ির দোকান দিয়েছে একটা। চলে ভালোই। কিন্তু ধীরেনের বাবার পছন্দ নয় ও। সাত পুরুষের কাজ— সেসব ছেড়ে দেবে! পূর্বপুরুষরা অসন্তুষ্ট হবেন না! পরকালে জবাব দিতে হবে না! আসলে ওরা পাল— কুমোর। ঠাকুরবানানো কুমোর। জহরকাকুরাও। ওদেশে থাকতে তাই করত। কাজে টান পড়ল, পেটে টান পড়ল… অতএব… দেশান্তরী। সেটুকু আপস করে নিয়েছে ধীরেনের বাপ, কিন্তু কর্মান্তরীও হতে হবে! আর ঠিক এই জায়গাটাতেই ঘা দিয়েছিল জহরকাকু—

–কী দাদা তুমি সাতপুরুষের কাম সাতপুরুষের কাম করতেছ কও দেহি! সাতপুরুষের ভিটা ছাড়ি আসলা না?

উত্তর দিতে পারেনি ধীরেনের বাপ। জহরকাকু আবার বলেছিল—

–ব্যাপারটা বোঝো। এলায় রাজবংশীদের মধ্যে অত ঠাকুরদেবতার চল নাই। মূর্তি পুজে তো না-ই। ঠাকুর বলতে ওই এক বিষহরি। তাও ওরকম বড় মনসার মূর্তিটুর্তি ও শহরে এক-আধটা বাড়িত হয়তো পাবা। আর হামার এই বাংলাদেশিদের ঘরে হয়তো টুকটাক লক্ষ্মী সরস্বতী এইলা বিকোবে। তা সে কয়টা? এই ভরসায় চলবা তুমি? পেট চলবে? সংসার চলবে?

দুটো খরিদ্দার সামলে, একটু দম নিয়ে আবার বলেছিল জহরকাকু—

–একটা ব্যবসার ধান্দা দেখো দা। আমার কথাটা শুনো। তোমাকও দেখবা হবে না। আমিই ব্যবস্থা করে দেব একটা। কিন্তু তুমি ভাইবা দেখো কথাটা। আর মাটির কাম? তা অসুবিধা কী! বাড়িত করবা টুকটাক। ভাজতাটাকেও শিখায়ে থোবা। কিন্তু ওই দিয়ে পেট চালবার আশা কইরো না…

পাশের দোকানে চা বলেছিল জহরকাকু। আর ধীরেনের জন্য লাড্ডু। চায়ের দোকান যার, ধীরেন ততক্ষণে বুঝে গেছিল, সেও বাংলাদেশি। এতক্ষণ জহরকাকুর কথাগুলো শুনছিল, নিজের মনেই মাথাও নাড়ছিল সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে।

–বও। বা একটু ঘুইরা বেড়াও। আমি এখনই বন্ধ করব হনে দোকান। তারপর এক জায়গায় নিয়া যাব তোমারে…

সেদিনই প্রথম কিশোর ধীরেন জেলখানা দেখেছিল। আর দেখেছিল, এক লহমার জন্য, বিমল পোদ্দারের দুটো চোখ। গোটা মানুষটার অন্য কিছুই মনে ছিল না মাঝের দুই বছর। কিন্তু ওই চোখ দুটো হানা দিত ধীরেনের চেতনে যখনতখন।

এক সেন্ট্রিবাবুর সঙ্গে খাতির ছিল জহরকাকুর। তার কাছেই নিয়ে এসেছিল ধীরেনের বাপকে।

–এই যে সার… আমার দাদা হবে…
–তুমিই দেবে দোকান? দাও দাও… এখানে রাস্তার ধারে একটা গুমটি মতো করো। এখানে আমরা আছি, কেউ ঘাঁটাবে না। আমাদের খুব অসুবিধা হয় একটু চা পানি খাওয়ার। সাইড খরিদ্দার পাবে না বিশেষ এখানে। কিন্তু এই জেলখানাতেই যা বেচাকেনা হবে ভালোই চলে যাবে তোমার…

কিসের দোকান, কোথায় দোকান ধীরেনের বাপের কাছে এসব পুরোটাই ধোঁয়াশা তখন। জহরকাকু আসতে আসতে কোনও ইশারাও দেয়নি। তার ওপর জেলখানা, পুলিশ, সদ্য তখন বাংলাদেশ থেকে এসেছে ওরা। এই প্রথম পর্যায়ে যেসব জিনিস এড়িয়ে থাকার কথা, জহর যেন সেগুলোর মধ্যেই নিয়ে ফেলেছে তাকে। ধীরেনের বাপ হাঁ হুঁ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি সেদিন।

সন্ধে নেমে আসা জেলখানার সামনে, রাস্তার এবং জেলগেটের চড়া আলোগুলোকে একটু পাশ কাটিয়ে এক আলো-আঁধারিতে চলছিল এইসব হুঁ-হাঁ জাতীয় আলাপ। ধীরেন সেসবের অনেক কিছু শুনতে পায়নি। ও হঠাৎ দেখতে পেয়েছিল দুটো চোখ জেলের কোণার পাঁচিল ফাটিয়ে যেন ওদের দেখছে এক মনে। মানুষের এমন চোখ এর আগে কখনও দেখেনি ধীরেন। এমনই মশগুল করে দিয়েছিল চোখগুলো ওকে যে জেলপ্রাচীরের ওই কোণে যে একটা সরু গেট আছে, তাতে লোহার দরজা আছে, তার পেছেনে একজন সিপাই আছে, এসব কিছুই সে নজরে আনতে পারেনি।

ধীরেনের বাপ দোকানটা করেনি, যথারীতি, ওদিকপানে মাড়ায়ইনি আর। যেটা করল, এদিক সেদিক কিছু ভটকে বেড়িয়ে, মাটির কাজের হালচালের খোঁজখবর করে টরে বছরখানেকের মাথায় মরেই গেল।

ধীরেন ফিরে এসেছিল এখানে তারও বছরখানেক পর। জহরকাকুর সঙ্গেই। সেই সেন্ট্রিবাবুটা— সেন্ট্রি শব্দটা শুনেছে এবং শিখেছে তখন ও— ছিল না, বদলি হয়ে গেছে নাকি, তাই জহরকাকু ব্যারাক থেকে ডেকে বের করেছিল অন্য একজনকে। জেলসিপাইদের সঙ্গে জহরকাকুর এত চেনাজানা কিসের! জিজ্ঞেস করেছিল ধীরেন পরে।

–বলিস না কাউকে! জেলখানায় বিড়ি সিগারেটের সাপ্লাইটা আমিই দিই। এখানে তো দোকান নাই কোনও। এই সেন্ট্রিবাবুদের হাত করে এইডা ধইরে নিছি…

যে সেন্ট্রিবাবুটা বেরিয়ে এসেছিল সেদিন জহরকাকুর ডাক শুনে, কালো মোটামতো একটু, চোখদুটা সেয়ানা সেয়ানা, সে ওদের কাকা-ভাজতাকে নিয়ে এসেছিল ওই কোণের সরু গেটটার এখানে। ওখানে তখন যে সেন্ট্রিবাবুটা ছিল, তার সঙ্গে একটু ফিসফিস, আর, তার ফলস্বরূপই হবে, একটু পরে ওখানে এসে হাজির হয়েছিল সেই চোখজোড়া। যে চোখজোড়া এই দু বছর ধীরেনকে প্রায়শই অশান্ত করে রাখত।

–আরে এ তো বাচ্চা ছেলে। মিষ্টি মুখটা… তাই না হরবিলাসদা? কর কর বাবু… আরামসে দোকান কর… কোনও সমস্যা নেই… কেউ ঘাঁটাবে না তোকে… একটা কাঠের ফ্রেম মতো করবি… পাম্প স্টোভ… দুটো বেঞ্চি…

ওর দোকান সাজানোর পরামর্শ দিচ্ছে সেই দুটো চোখ! আরও কত কিছু বলছিল বিমল। ধীরেন তাকিয়েছিল চোখদুটোর দিকে সম্মোহিতের মতো। চোখদুটো, যথেষ্ট কোমল তখন, কিন্তু সাধারণ চোখের কোমলতা অর্জন করা যে অসম্ভব ওদের পক্ষে বুঝতে পারছিল ধীরেন। বিমল কথা বলছিল যথেষ্ট আন্তরকিভাবে। যেন সত্যিই ও অনেকদিনের চেনা। যেন সত্যিই ওকে অবলীলায় বাবু বলে ডাকার সম্পর্ক ওর সঙ্গে….

–…দশ হাজার টাকা দিস বাবু। উকিলগুলা যা চামার… নাঃ! তুই আর সেসব কী করে জানবি… বাচ্চা চ্যাংড়া! টাকাটা দিস… আরে! মুখটা অমন করছিস কেন? অত পারবি না?… আচ্ছা যা আট হাজার দিস…

মুখটা কীরকম করেছিল জানে না ধীরেন! আদৌ কি কিছু করেছিল? করা সম্ভব ছিল ওর পক্ষে ওরকম একটা ঘোরের মধ্যে? টাকাটা চাইতে কি সঙ্কোচ হচ্ছিল বিমলের? পাঁচ হাজার টাকায় রফা হয়েছিল শেষ অব্দি। ধীরেন কথা বলেনি, জহরকাকুই একটু দরাদরি করেছিল। ফেরার পথে জহরকাকু বলেছিল—

–ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল ওয়। এই জেলখানায় ওর রাজ চলে। সিপাইগুলারে দেখতাসিলি… যেন উয়াই ওদের বস। সুপারকেই যা একটু মান্যি করে। মান্যি ওই… আসলে লেনদেনের সম্পর্ক। চারটা মার্ডার করসে। দিল্লি থেইক্যা ধরে আনছে ওরে পুলিশ…

পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল ধীরেন। তারপর দোকানের কাঠামো, বেঞ্চ, স্টোভ এই সব কিনে আরও কিছু খরচাপাতি করে দোকানটা লাগাতে লাগাতেই খবর পেয়েছিল চার-টা পাঁচ হয়ে গেছে। ওর দোকানে বসেই আলোচনা করছিল সেন্ট্রিবাবুরা, সেও যেন ফিসফিস করে…

–সাক্ষীটাকে মার্ডার করিয়ে দিল…
–কনভিক্ট হয়ে যেত এই সাক্ষীটা হলে…
–জেলের ভেতরে বসে বসে কাজ সেরে দিল, হ্যাঁ?
–আস্তে বলো…

সেদিন ভাসাভাসা, পরে একদিন সুধাময়দার সঙ্গে কথা হয় ধীরেনের। সুধাময়দাও সেন্ট্রিবাবু। এখানকার নয়, আরও উত্তরের।

–এই লোকটা সাক্ষী দিলে সাজা হয়ে যেত বিমলের। কেসটাতে এই লোকটাই ছিল গাঁট। দিল মারিয়ে…
–কাকে দিয়ে মারাল?
–আরে বিমলের লোকের অভাব! এইখানে এই যে মস্তান গ্যাংগুলা আছে, জেলে ছুটি কাটাতে আসে মাঝেমাঝেই সব, দেখিস তো ওই সরু গেটের ধারে এসে বিমলকে ভেট দিয়ে যায় মাঝেমধ্যেই, সবাই বিমল বলতে অজ্ঞান। বিমলকে দলে টানার জন্য মুখিয়ে আছে সব দল…

চারটে খুন— নিহত মানুষ— লাশ— মাথায় বা গলায় বা বুকে কিছু চাপ রক্ত নিয়ে চোখ উলটে পড়ে আছে— খুন বললে যেরকম রূপকল্প চোখের সামনে ভাসিয়ে নেওয়া যায় আর কি— তার সঙ্গে আরও একটা ওরকম লাশ— সেই মানুষটা যে লাশ হল, তার কলকাঠি নড়ল জেলখানার ভেতর থেকে— মানে শরীরকে বন্দি রেখেও আটকানো যায় না হাতদুটোকে যে হাতদুটো কিনা মানুষ মারতে পারে অবলীলায়— ধীরেনের মস্তিষ্কে এই সমস্ত ছবিগুলো মিশে তৈরি হয়ে গেছে দুটো চোখের ছবি। ওই চোখদুটো বড় অস্বস্তিতে রাখে ধীরেনকে। সে যতই বিমল ওর সঙ্গে বাবু বাবু বলে কথা বলুক না কেন।

–আপনারা যে ইউটি বলেন, তা বিমল পোদ্দারও তো ইউটি… তাই না? ওয়ার জামিন হয় না কেন? একদিন জিজ্ঞেস করেছিল ধীরেন।
–বিমলের জামিন হওয়া মুশকিল আছে। আড়চোখে কোণের ওই সরু গেটটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে গলাটা একটু নামিয়ে বলেছিল কলকাতার সেই সেন্ট্রিবাবু। ধীরেন দেখেছে, খুব হয়তো হইচই আড্ডা হচ্ছে ওর দোকানে সেন্ট্রিবাবুদের, তখনও যদি কোনও প্রসঙ্গে বিমলের নাম চলে আসে— আসেই, করোনার আলোচনায় লকডাউনের মতো— তখনই সেন্ট্রিবাবুরা অবধারিত এই কাজ দুটো করে। কোণের সরু গেটটার দিকে কটাক্ষপাত, আর গলার ডেসিবেল একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিয়ে আসা।

–এখানকার আইসি বিমলের কেসটাকে ইগোতে নিয়ে নিয়েছে আসলে। কলকাতাবাবু বলেছিল।
–বিমলও তো পাঙ্গা নিয়েছিল না আইসির সঙ্গে… হরবিলাস বলেছিল পাশ থেকে।
–হ্যাঁ, শুনেছিলাম সেটা…
–ওই দিল্লি থেকে বেড়ি পরায়ে এনে পিসিতে যখন পেটাচ্ছে, সেই সময় আইসিকে বলেছিল, রাখতে পারবেন আমাকে আটকে? তিন মাস পর তো ছাড়তেই হবে। তারপর?

একট ভক্তি ভক্তি ভাব যেন হরবিলাসদার গলায়। টের পায় ধীরেন।

–তবে নতুন আইন এসেছে দেশে। এতে আর ওই নব্বই দিন, একষট্টি দিনের মাথায় জামিনের গল্প নাই। শুনেছেন তো? কলকাতাবাবু জিগিয়েছিল।
–সে কোন আইন? টাডা নাকি?
–ইউএপিএ। এগুলো খবর রাখেন না কেন? আরে আপনিও তো রাষ্ট্রের একটা পার্ট হরবিলাসদা। হাসতে হাসতে বলেছিল কলকাতাবাবু। এই আইনে পুলিশ যাকে ইচ্ছে সন্দেহের বশে ঢোকাতে পারবে। যদ্দিন খুশি আটকে রাখতে পারবে। এমনকি আপনি যে নির্দোষ, সেটা নাকি আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে। পুলিশ আপনাকে দোষী প্রমাণ করবে না।
–কও কী! তাইলে তো জেলটা বিমলে ভইরে যাইব…
–বা জান খালাসে… হাসতে হাসতে বলেছিল কলকাতাবাবু।

হ্যাঁ, ধীরেন জানে জান খালাস কাকে বলে। এও জানে এই জেলের ষাট ভাগই ওরকম জান খালাস। এরা বাংলাদেশি। এদের সাজা খাটাও হয়ে গেছে। কিন্তু তাও জেলে। কারণ এদের পুশব্যাক হবে। তাতে দুই রাষ্ট্রের প্রথমে এক মত, তারপরে এক সময় হতে লাগবে। সেইসব হতে হতে দু-তিন বছরও ঘুরে যায়। ততদিন এরা, জেলখানার পরিভাষায়, জান খালাস। জেলখানার ফ্রি লেবার, বিমল পোদ্দার বা টাউনের মস্তানদের ব্যক্তিগত চাকর, আক্ষরিকভাবেই।

সেদিন ছেলে দুটো যাওয়ার পর বিমলের সঙ্গে চোখাচোখি হতে বিমল ডেকেছিল ওকে। কাছে যেতে বলেছিল, একটা নাকি সুখবর আছে। দেবে ওকে দুদিন পর।

–কেন? এখনই বলো… বিমলের চোখের দিকে তাকিয়ে এখনও কথা বলতে পারে না ধীরেন। অস্বস্তি হয়।
–নাঃ! যদি না হয়! বলা যায়! দুদিন পরই শুনিস… যা খেয়ে নে গিয়ে… খাস নাই তো এখনও…

খেয়ে নিয়েছিল ধীরেন। খেয়ে, টিফিনবাটিটা মেজে ধুয়ে, দোকানটা আরও কিছু গুছিয়ে বসেছিল গিয়ে দোকানের পাশের শিমুলগাছটার তলায়। এখানেই দুপুরে একটু জিরোয় ও। বেশিক্ষণ না, ইন্টারভিউ শুরু হবে একটু পরেই, একজন দুজন আসা শুরুও হয়ে গেছে। সত্যি, ক্রিমিনাল? এইসব যে লোকগুলো আসে, তাদের বাড়ির ছেলেটা, লোকটা! হদ্দ গ্রামের মানুষ, হাতে গুনে বলে দিতে পারবে জীবনে কতবার শহর দেখল, পাকা রাস্তা দেখল। অনেকেই এরকম আছে, জানে ধীরেন, এই বাড়ির লোকটা জেলখানায় থাকার সময়কালে দেখা করতে আসার কয়েকবারই তাদের শহর দেখা। লেপাপোঁছা মুখগুলো থেকে অনাবিল সারল্য চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে এই গড়িয়ে পড়া ঘামের ফোঁটার সঙ্গে। যে কেউ দেখতে পায়, এতটাই প্রকট।

এদের কথা ভাবে ধীরেন দুপুরের এই শিমুলতলায় বসে। বেঞ্চিটা আছে, সেটাও ছায়াতেই, চাইলে ওটার ওপরে একটু লম্বা হয়েও নেওয়া যায়, কিন্তু ধীরেন এই শিমুলতলাতেই বসে ঘাসের ওপর। ওর ভালো লাগে। এখানে বসলে ওর বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। সেই ঘর, উঠোন, বাবার ঠাকুর গড়ার ঘর, সেখানে পর্যায়ক্রমে লক্ষ্মী কালী কার্তিক সরস্বতী গণেশ বিশ্বকর্মারা জন্ম নিত বাবার হাতে, তারপর চলে যেত সময় হয়ে গেলে। করিমচাচা ছিল বাবার হেল্পার। মূর্তি বানাতে, লক্ষ্মী সরস্বতী এসব পুজোর আগে ছোট বড় বেশ কিছু মূর্তি নিয়ে বাবা যে গঞ্জে গিয়ে দোকান লাগাত, সেখানেও বাবা আর করিমচাচা। ধীরেনের মনে পড়ে বারদুয়েক ও-ও গেছে বাবা আর চাচার সঙ্গে এরকম দোকানদারি করতে। উঠোনের ধারে একটা আমগাছ ছিল ওদের। কী যে জাতের আম, বড় অদ্ভুত! কাঁচাতেই এমন মিষ্টি আম আর কখনও খায়নি ধীরেন। রাখা যেত না গাছটায় আম। ফলতে শুরু, আর ছেলেছোকরাদের উৎপাতও শুরু। মা কাঁউকাঁউ করত— আরে তোদের জ্বালাত গাছের আম কি একটাও খাবা পারব না রে! কাঁউকাঁউয়ের মাত্রা বাড়লে ছেলেরা হয়তো অভিমানে, বা বাড়ির বড়দের শাসনে দুদিন রেহাই দিল গাছটাকে। তখন আবার রাতে খেতে বসে বাবা-মাই গল্প করবে— চ্যাংড়াগুলান গেল কই! দুদিন গাছে হাত লাগায় নাই! গাছটা— আছে এখনও? কেমন আছে?

ইন্টারভিউ করতে আসা লোকজনের কাছে টুকটাক বিক্রিবাটা হল কিছু। চা-বিস্কুট। সকালের ঘুগনি। তারপর বিকেলে ভাজাভুজি করাও হল। আলুর চপ, ধনিয়ার চপ, বেগুনি বা কুমড়ি, রসুনের চপ, পেঁয়াজবড়ি। সবই মা বানিয়ে দেয় বাড়ি থেকে। সবই বলতে বেগুন বা কুমড়ো ফালি করে সরু সরু কেটে, ধনেপাতার শিকড়টা বাদ দিয়ে, পেঁয়াজ কুচিয়ে আর আলুসিদ্ধ করে একটু ঝালমশলা মাখিয়ে চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা করে— ওই চপে যেরকম থাকে আর কি! ধীরেনের কাজ একটু বেসন গুলে তাতে এগুলো ডুবিয়ে ভেজে তোলা। এসব করতে করতেই আঁধার নামে। মর্নিং ডিউটির সেন্ট্রিবাবুরা এই বিকেল সন্ধের সময়ে বসে এসে একদফা। চা ভাজাভুজি গল্পগাছা। জেলারবাবুদের জন্য জেলখানাতেও পাঠাতে হয়ে সন্ধের পরে কিছু ভাজাভুজি। রোজ না। একেকদিন, বিশেষ করে যেদিন সুপার থাকেন, সেদিন টাউন থেকে প্যাকেট করা খাবার আসে, কাবাব টাবাব বলে, সেন্ট্রিবাবুদের কাছেই শুনেছে ধীরেন। আর এসব সেরে দোকান গুটিয়ে, টুকটাক বাসনকোসন জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে সাইকেলে ঝুলিয়ে বাড়ি। কালকেও গেছিল এরকম। আজকেও যাবে।

আজ সেই যাওয়াটার আগেই কোর্টের গাড়ি এল। এও রোজই আসে। রোজ বলতে কোর্ট খোলা থাকলে। দিনে দুবার। সকালে নিয়ে যেতে, আর এরকম সন্ধেয় নিয়ে আসতে। এই গাড়িটা চালায় জীবনদা। সকালে আসে যখন, ধীরেনের দোকানে বসে একটু চা-বিস্কুট খায়। কোর্ট সিপাইবাবু তখন জেলের ভেতরে যায়, কজনকে নিয়ে যাচ্ছে সেইসব খাতাপত্রের কাজকর্ম সারে। রাতে ফেরার সময় আর এসব হয় না। ধীরেনেরও তাড়া থাকে ফেরার, জীবনদাদেরও। কোনও কোনওদিন তো রাতে কোর্টের গাড়ি আসার আগেই ধীরেন দোকান গুটিয়ে ফিরে যায়।

আজ সেরকম দিন নয়। ধীরেন ছিল। দোকান গোছাচ্ছিল। জীবনদা কালো গাড়িটা নিয়ে এসে থামাল ওর দোকানের একটু দূরে জেলগেটের সামনে। তারপর ড্রাইভারের গেটটা খুলে লাফ দিয়ে নামল। নেমে এগিয়ে এল ধীরেনেরই দিকে। সুধাময়দাও এসেছে তখন ওখানে। ওর ডিউটি নেই, তবু আসে এই সময় কোর্টের গাড়ি এলে ব্যারাক থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে। ধীরেনের দোকানের দিকেই আসে। দেখে নতুন মুখ কারা এল, কে চলে গেল। জীবনদা ওখানে এসে বলল—

–নাও, এখানেও শুরু হয়ে গেল এবার…
–জঙ্গিদের কথা বলছ? শুনলাম… সুধাময়দা বলল।
–চ্যাটের জঙ্গি! মুখ খারাপ করিও না তো! দেখো না… নামবে তো এখনই… কেমন জঙ্গি নিজেই দেখে নাও…

ধীরেন কিছু বুঝতে পারছিল না। কাদের কথা হচ্ছে? জীবনদা আবার বলে—

–মনটা ভার হয়ে রয়েছে জানো? কী আছাড়িপিছাড়ি কান্না চ্যাংড়াদুটোর মা-বাপের। দেখলেই বোঝা যায় বেহুদা গ্রামের লোক, চাষবাস ছাড়া কিছুই জানে না, বোঝে না। আমার তো মনে হয় ওই চ্যাংড়াদুটো কামতাপুর শব্দটাই এই প্রথম শুনল জীবনে…
–কিন্তু হঠাৎ করে ইউএপিএ দিল কেন একেবারে?
–এটা বোধহয় পলিসি এখন। সরকার চেঞ্জ হয়েছে না? এখন হয়তো থানাতে ইউএপিএ-রও মান্থলি টার্গেট থাকবে। অন্য স্টেটে তো শুনি, ছেলেপিলে ধরছে আর ইউএপিএ দিয়ে আটকে রাখছে। এবার আমাদের এখানেও শুরু হল…

সন্ধের তখন গুম মারা ভাব ছিল। গাছের কোনও পাতাও কাঁপছিল না। গোটা আবহে ছড়িয়ে ছিল একটা আঠালো বিরক্তি। উত্তেজিত জীবনদার কথা শেষ হয়েছিল। সুধাময়দার দীর্ঘশ্বাসটা নিঃশব্দে মিশে গেছিল ভারী বাতাসটায়। কোর্টের কালো ভ্যানটা থেকে তখনই নিজেদের ভারী পা দুটো টেনে নেমে এল ওই চ্যাংড়া দুটো। তোমরা টিভি নাগান নাই বড়কাদা— প্রশ্নটা হঠাৎ ধাক্কা মেরে গেল সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ধীরেনের কানে। আর চোখের সামনে ভেসে উঠল খোচরবাবুর খ্যাঁকশিয়ালের মতো মুখটা।

কেমন একটা ঘোরের মধ্যে সাইকেল ঘুরিয়ে প্যাডেলে চাপ দিতেই ধীরেন স্পষ্ট বুঝতে পারল খোচরবাবু আসছে ওর পেছনে। ওইরকম হাত দিয়ে রুমালটা চাপা দিয়ে রয়েছে মুখে, হাঁটছে সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে! প্রাণপণ প্যাডেলে চাপ দিল ধীরেন। বিমল বলেছিল কী যেন সুখবর দেবে! কী খবর? কার জন্য সুখবর? ধীরেনের সামনের ঘোর অন্ধকারটার মধ্যে দুলতে লাগল বিমলের চোখদুটো। সামনে হাইরোড…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

9 Comments

  1. ওই খাদের ধাক্কাটা আমারও লাগল বুকে। কিন্তু শুধু ধাক্কার দিকে মনোযোগ দিলে বাকি গল্পটার প্রতি অবিচার হবে। বাকি গল্পটা এত সুন্দর, এত শোভন, এত সংযত। খুব ভালো লাগল, সোমেন। খুবই ভালো লাগল।

  2. ওই যে শুরুর, ‘ এরকমই ওই ছেলে দুটো এসেছিল। গত পরশু। বেলা তখন চড়া। চৈত্র মাস।’ খুব সাদামাটা বিবরণে তাদের নিয়তির কোনও অনুমানই থাকে না। কিন্তু ধীরে ধীরে ওরা যেন এক গোপন ফাঁদের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকে। রাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর হাঁ। খুব ভালো গল্প।

  3. পাঠক একটা পর্যায়ে যখনই আগ্রহ হারাবে হারাবে করে তখনই পাঠকের ঘেটি ধরে টেনে নিয়ে যায়, আবার আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মাথা অব্দি জলে ঠেলে ফেলে দেয়! একবার জলে পড়ে গেলে আর উঠতে পারে না পাঠক, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আজকালকার পাঠক ভালো না- বড় তাড়া তাঁদের। তাঁরা কি এই গল্প পড়ার জন্য প্রস্তুত?

  4. নিরীহ রকম হাসিখুশি মুখে অন্তর্ঘাত ঘটানো ভাল ছোটগল্পের অবশ্যকৃত্য। সোমেনদা, তোমার গল্প সেই কর্তব্যে সমর্থ হয়েছে একশো ভাগ। পাঠকের মনে একটা অনিবার্য ও চোরাগোপ্তা ঢেউ রেখে যায়। কিন্তু তার পাশাপাশি বলব, একটা স্মিত নৈমিত্তিক উঠে এসেছে এই লেখাটায়, বহু দিন, অন্তত নন ফিকশনের বাইরে যার কোনও অস্তিত্ব টের পাই নি। এক জন লিখেছেন দেখলাম ‘ডিটেলিং’– আরও তলিয়ে ভাবলে, একটা নির্দিষ্ট পরিসর, তার রোজকার বেঁচে-থাকা– অথচ কোনও ঢ্যাড়াপেটানো নন্দিত ঘোষণা নেই, সকলই নিত্যবৃত্ত। লেখক যেন-বা এক ছায়ামানুষ, সবই দেখেন এবং নির্লিপ্ত মুখে ক্যামেরা বাগান।

  5. বেশ আটপৌড়ে গল্পের শুরুটা। নির্লিপ্তভাবে ভাঁজ খুলতে খুলতে এগিয়ে যাওয়া। পরিণতির ধাক্কা সপাটে এসে পাঠকের বুকে লাগবে— খুব ভালো একটা গল্প পড়বার আনন্দ পেলাম। গল্পকারকে আন্তরিক অভিনন্দন।

  6. অসাধারণ গল্প।

    সংলাপ, বর্ণনা, নির্লিপ্ত গতি নিয়ে গল্পটি সাহিত্যের বাস্তবতা টপকে যায়। শেষে হিম শীতল অন্ধকারের ছবি পাঠকের সামনে ঝুলে রাখবার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে গল্পটির।

  7. একদিকে উদ্বাস্তু জীবনের টিকে থাকার লড়াই (“লড়াই” টা তো আমাদের কয়েনেজ, ধীরেনদের কাছে নেহাতই রোজনামচা), অন্যদিকে তার পেছনে চলতে থাকা রাষ্ট্রের পুতুলনাচ – গল্পের বুনন খুব ভালো লাগল সোমেনদা৷

Leave a Reply to sailen sarkar Cancel reply