এক অন্য শীর্ষ, যে আমার বন্ধু ছিল

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় | সাহিত্যিক-সাংবাদিক

অনিরুদ্ধ ধর

 



লেখক পেশায় সাংবাদিক, চলচ্চিত্র-আলোচক ও চিত্রনির্মাতা 

 

 

 

 

শীর্ষর সঙ্গে প্রথম আলাপ কলকাতা টিভি-তে কাজ করার সময়। আলাপ হওয়ার কোনও তেমন কারণ ছিল না। তবু হয়ে গেল। কারণ, ওটাই ছিল আমাদের ডেস্টিনি। আমার আর শীর্ষর আলাপের হাইফেন ছিল ঋষি। ঋষিরাজ বসু। আমি কলকাতা টিভি-তে বিনোদন বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম। ঋষি ছিল ওই বিভাগের এডিটর। ভয়ঙ্কর ফাঁকিবাজ। কিন্তু এত লাভেব্‌ল যে, ওর ওই ফাঁকিবাজি সে তুলনায় নস্যি। একদিন সিগারেট ব্রেকে ঋষি আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল নিউজডেস্কের এক যুবকের। নাম শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ সুদর্শন চেহারা। কিন্তু আমার নজর কেড়েছিল ওর কণ্ঠস্বর। বেশ একটা গমগমে ব্যাপার ছিল সেই স্বরে।

তখন কলকাতা টিভি-র খুব খারাপ সময় চলছিল। যে কোনওদিন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আমরা তিনজন কাজ করি আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা করি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তো, একদিন এমনই এক আলোচনার শুরুতে শীর্ষ বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে আলোচনা করলে কিছু হবে না। তার জন্য সঠিক জায়গায় যেতে হবে।” এই বলে সামনেই একটা বার-কাম-রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেল আলোচনার জন্য। ঋষিও বেশ তাল দিল শীর্ষর প্রস্তাবে। রেস্তোরাঁয় ঢুকে মেনুকার্ড নিয়ে টানা পাঁচ মিনিট গবেষণা করে অর্ডার দিল শীর্ষ নিজেই। দু মাস কোনও টাকা পাচ্ছি না আমরা, কিন্তু তাতে শীর্ষর দেখলাম কোনও হেলদোল নেই। খানা এবং পিনায় কোনওরকমের সমঝোতা করতে ও নারাজ।

খানা-পিনার ব্যাপারে চরিত্রের এই “নো কম্প্রোমাইজ” ভাবটা শেষ দিন পর্যন্ত ছিল ওর। খেতে ভালবাসত, খাওয়াতেও। আমার মনে আছে, একবার সন্ধেবেলায় আমাদের আনারস খাওয়াবে বলে সারা দুপুর ইউটিউব থেকে আনারস কাটার ট্রেনিং নিয়েছে। এবং আমরা যখন সন্ধ্যায় ওর বাড়ি এসেছি, তখন পেশাদারদের মতো আনারস কেটে ওর চোখে-মুখে সে কী তৃপ্তি!

খাদ্যরসিক বা ফুডি বলতে যা বোঝায়, ও ছিল তা-ই। আর এই কারণেই ফেসবুকে ‘গ্যাস্ট্রনমিকাল’ নামের একটা খানা-পিনার গ্রুপই খুলে ফেলল। সেই দলের ও ছিল অ্যাডমিন। আদতে উত্তর কলকাতার মানুষ বলেই খাওয়াদাওয়া নিয়ে একটা ‘বাবু-সংস্কৃতি’ ওর মজ্জায় ছিলই। সত্যি কথা বলতে কী, শীর্ষর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের শুরু ওই শুঁড়িখানা থেকেই। খানা এবং পিনা সহযোগে। আর ওই দিনই শুঁড়িখানার গেলাসে ঠোকাঠুকি করে শুরু হয়েছিল আমাদের ‘বিকল্প রোজগার’-এর জীবন।

আমাদের আর এক বন্ধু অভিজিৎ ব্যানার্জির কথামতো আমরা একটা পার্টনারশিপ সংস্থা খুলে ফেললাম। এবং একটি টেলিভিশন চ্যানেলে একটা দৈনিক নন-ফিকশন অনুষ্ঠানের কাজ শুরু হয়ে গেল অচিরেই। এই কাজটা আমরা তিনজনেই ভালবেসে ফেললাম— অর্থের জন্য তো বটেই, তার চেয়েও বেশি ভালবাসা এই কাজের ক্রিয়েটিভ দিকটা নিয়ে। ক্রমশ এই ক্রিয়েটিভিটিই হয়ে দাঁড়াল আমাদের বন্ধুত্বের মূল জায়গা। শীর্ষর কাজ ছিল এই অনুষ্ঠানে ভয়েস দেওয়া এবং খুব প্রয়োজনে ক্যামেরা নিয়ে শুটিং করা।

তখনই শীর্ষর একটা ভাল গুণের পরিচয় পেয়েছিলাম। সেটা হল অন্যের কথা মনে দিয়ে শোনা। যদি বলতাম, “তোমার ভয়েস-ওভারটা বড্ড ফ্ল্যাট লাগছে। অন্য কিছু করবে?” এতটুকু তর্ক না-করে ও অন্যভাবে ব্যাপারটা করে বলত, “এবার দেখো তো, ঠিক আছে কি না?” ওর জন্যই আমাদের চরিত্রেও এই বদলটা এল। আমরাও অন্যের কথা শোনা শুরু করলাম। ওর সাংবাদিক থেকে সাহিত্যিক হয়ে ওঠার ঘটনা আমার চোখের সামনে। আমি গপ্পো-গাছা না-লিখলেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওর লেখার দ্বিতীয় পাঠক ছিলাম আমি। সে ছোট গল্পই হোক, কি বড় উপন্যাস। প্রথম পাঠক ওর স্ত্রী। পড়ার পর যদি বলতাম, “এই জায়গাটা ওই রকম করে দিলে ভাল লাগবে।” ও মন দিয়ে শুনত আমার সাজেশন, তারপর ওর মতো করে ঠিক বদল করে দিত। কোনও কারণে ওর একটা অদ্ভুত বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল আমার প্রতি।

শীর্ষর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ঠিক ১৩ বছরের। এই ১৩ বছরে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি অসংখ্য। বিশেষ করে বিদেশি ওয়েব পোর্টালের কাজ এখনও চলছে। কোনওদিন কোনও ব্যাপারে ওকে অসহিষ্ণু হতে দেখিনি, অন্তত যৌথ কাজের ব্যাপারে। ও একটা নির্দিষ্ট আচরণবিধি মেনে চলত কাজের ব্যাপারে। তিনজন বাঙালি একজোট হলে কাজ হয় না— এই মিথ আমরা ভেঙে দিতে পেরেছি টানা ১৩ বছর একসঙ্গে কাজ করে। এটা সম্ভব হয়েছিল আমাদের বাঙালি চারিত্র্য আমরা বদলে ফেলেছিলাম বলেই। ইগো-হীন হওয়ার এই কালচার শীর্ষই তৈরি করে দিয়েছিল আমাদের মধ্যে।

কাজের বাইরে যখন আমরা বন্ধু, তখন ও ছিল মস্ত আড্ডাবাজ। এবং বন্ধুবৎসল। ওর গড়িয়াহাটের বাড়ির ডাইনিং টেবিলটা ছিল আমাদের আড্ডার জায়গা। করোনা আসার আগে প্রতি রবিবার সন্ধেয় সেই আড্ডার শরিক শীর্ষ, আমি, নন্দিনী (শীর্ষর স্ত্রী) এবং কীর্তীশ (শীর্ষর এক বন্ধু)। ওই আড্ডায় লেগপুল করা হত শীর্ষকে, ওর পিটপিটে স্বভাবের জন্য।

ভয়ঙ্কর রকমের পিটপিটে স্বভাব ছিল শীর্ষর। ঘরের সবকিছু থাকবে একদম প্রথম দিনের মতো। সেটা ল্যাপটপ হতে পারে, হতে পারে মদ খাওয়ার গেলাস, হতে পারে ডাইনিং টেবিলের কাচ। আমরা প্রত্যেকে চাপে থাকতাম ওর এই স্বভাবের জন্য। বিশেষ করে আমি। ঠিক কখনও কম্পিউটারের স্ক্রিনে হাত দিয়ে ফেলেছি, অথবা ডাইনিং টেবিলের কাচে খাবারের টুকরো ফেলেছি। তক্ষুণি পাতলা কাপড় দিয়ে স্ক্রিন পরিষ্কার কিংবা টিস্যু পেপার দিয়ে টেবিলের কাচ পরিষ্কার করা শুরু করে দিত। আমরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, আর ও আড়চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসত।

সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপারে কতটা নাক গলাত জানি না, কিন্তু বাড়ির প্রত্যেকের জামা-কাপড় মেশিনে কাচা, সেগুলো শুকোতে দেওয়া এবং পরে প্ৰতিটা ইস্ত্রি করা ছিল ওর রোববার বিকেলের রুটিন। আমরা হাসাহাসি করলেও ওকে ওই কাজ থেকে কখনও বিরত করতে পারিনি।

ওর সঙ্গে শেষ দেখা গত ডিসেম্বরে। প্রায় বছরখানেকের ফারাকে সেদিন গিয়েছিলাম ওর বাড়ি। মহামারির কারণেই যাওয়া হয়নি এতদিন। সেদিন ছিল মাছ-খাওয়ার পার্টি। কথা হয়েছিল, শীত শেষ হওয়ার আগেই আবার আড্ডা হবে। কিন্তু তারপর আবার কোভিডের দাপট শুরু হল। আবার দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ। টেলিফোনে মাঝে মাঝেই বলত, “সাবধানে থাকবে কিন্তু।” আমিও ওকে বলতাম সাবধানে থাকতে। কিন্তু সে কথা ও শুনল কই!

এইসব মহামারি নিশ্চিত কোনও একদিন চলে যাবে। হয়তো জীবন ফিরে আসবে সেই পুরনো ছন্দে আবার। কিন্তু গড়িয়াহাটের ওই বাড়িতে ওই ডাইনিং টেবিলে বসে খানা-পিনার ভরপুর আড্ডায় কেউ আমাকে আর বলবে না, “আবার তুমি পেঁয়াজের টুকরো টেবিলে ফেললে? আমাকে আবার মুছতে হবে।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...