বলরামপুর ফিরতে ফিরতে সন্ধে গাঢ়, গান্ধীদার উদ্বিগ্ন ফোন

গান্ধীরাম মাহাত | ঝুমুরশিল্পী

সোহম দাস

 


গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, লোকশিল্প-গবেষক

 

 

 

একজন মানুষের সঙ্গে ঠিক কতদিনকার মেলামেশা থাকলে তার সদ্য গত জীবনের টুকরো ছবিটা নিয়ে আঁকচারা কাটা যায়? স্মৃতিকথা লেখার কি কোনও যোগ্যতা হয়? এসব প্রশ্নের আড়ালে যে প্রচ্ছন্ন প্রশ্নচিহ্ন থাকে, তা হল, আসলে একজন মানুষকে নিয়ে বলার মতো কথা লিখতে চাওয়ার জন্য যে চেনাটুকুর দরকার পড়ে, সেই চিনতে আসলে কত সময় লাগে? এর জন্য বব ডিলান বা কবীর সুমন হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন বোধহয় নেই।

যেমন, গান্ধীরাম মাহাতর সঙ্গে আমার আলাপ ছিল প্রায় দু বছরের। সুঠাম সুন্দর চেহারা, পরিপাটি আঁচড়ানো চুল, মিষ্টি হাসির লোকটাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম পুরুলিয়ার সদর শহরে। সেদিন ছিল শুক্রবার। ডিআইসিও-র অফিসে একদল শিল্পীর ভিড় থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গান্ধীদা। সেইরকম আঁচড়ানো চুল, নীলচে সাদা ফুলহাতা জামার ওপরে চাপানো কালো স্লিভলেস কোট, কথা বলছিল অগ্রজ সুনীলদার সঙ্গে। সঙ্গে অনুজ ভাস্কর রায়।

তখন দুপুর গড়িয়েছে রাঢ়ভূমের এই জেলা সদরটিতে। সেদিন শুক্রবার। কারও কাছে হাটবার, কারও কাছে বা শহরে আসার দিন। ছৌ, গম্ভীরা, ঝুমুর শিল্পীদের থিকথিকে ভিড় হওয়ার দিন। তেমনই এক দিনে গান্ধীদার আবির্ভাব কলকাতা থেকে তার আগের দিনই আগত এক তরুণ, আনকোরা, উৎসাহী গবেষককে কোনও এক আলোকপথের সন্ধান দিয়েছিল। সেই গবেষক তখন তা বোঝেনি। কোন বিষয়ই বা সূচনাপর্বেই স্বচ্ছতা পায়?

রাঁচি রোডের ধারের অফিসটির বড় ঘরটিতে চেয়ারে বসে বসেই গান্ধীরাম মাহাত তাঁর ভ্রাতৃসম ভাস্কর রায়ের সঙ্গে গেয়ে ওঠেন ঝুমুর। ‘বাঁশিরে বিনতি করে।’ গানের কলিটা ধরার সঙ্গে সঙ্গেই গান্ধীরাম মাহাতর মিষ্টি হাসিটা যেন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর অঙ্গ সঞ্চালন, হাতের মুদ্রার সঙ্গে গান গাওয়ার অলঙ্কার হিসেবে জুড়ে যায় ওই হাসিটুকু। সামনের ভাস্কর রায়ও দিতে থাকেন সঙ্গত, পরে ক্রমশ তিনিও বুঝি মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার ভূমিকাতেই নিমজ্জিত হন। গান্ধীরাম মাহাত ভাস্করের থুতনি ধরেন, অনুজ শ্রোতাকে বুঝি মনে করেন পরমাত্মীয়।

দুজনের সামনের চেয়ারে বসে থাকা তরুণ গবেষক তখন কী ভাবছিল?

তা অবশ্য সে সেই মুহূর্তে ভেবে দেখেনি। আসলে, সেও শুনছিল। ভাবনার মধ্যে কেবল ছিল, এই অংশটুকু ভিডিও করে রাখা যায় কিনা। আসলে, কলকাতা থেকে সীমিতকালের জন্য আগত সে কেবলই কেজো দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছিল গোটা বিষয়টুকু। যে বিষয় নিয়ে সে কাজ করতে চেয়েছিল, সে বিষয়ের কাজ যে ওভাবে সম্পন্ন হতে পারে না, তেমনটা ভাবার মতো পরিণতিবোধ তার গড়ে ওঠেনি তখনও।

তারপর তার কথা হয় গান্ধীরাম মাহাতর সঙ্গে। “কী ব্যাপার বলেন?”

তরুণ গবেষক উত্তর করে— “ঝুমুর নিয়ে কাজ করতে এসেছি। ঝুমুর শিল্পীদের সঙ্গে থেকে, তাদের আসরে বসে গান শুনে কাজটা করতে চাইছি। সুনীলবাবু আপনার কথা বললেন, ওখানে নাকি থাকার জায়গা আছে।”

“হ, হ। কোনও বেপার নাই। চলে আসেন।”

আশ্বস্ত হয় তরুণ গবেষক। গান্ধীদা বলে দিয়েছেন। সে তখনও জানত না, ক্ষেত্রসমীক্ষার পরবর্তী সময় জুড়ে এবং ক্রমশ, গান্ধীদা তাকে প্রতিক্ষণে আশ্বস্ত করে যাবেন।

গান্ধীদার সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছিল ওঁর ডেরায়। ২৪ বিঘে জমির উপর বাড়ি-বাগান-পোলট্রি-সহ দাঁড়িয়ে আছে রয়্যাল ছৌ একাডেমি। ‘বাঙালিস্য পশ্চিমাস্য’-মার্কা বরাভূমের স্টেশনটির আশপাশের ক্ষেত পেরিয়ে হাঁটাপথেই চলে যাওয়া যায় দিব্যি। কতদিন ট্রেনে যেতে যেতে ভেবেছি, ওই ক্ষেতি-বাড়িগুলো পেরিয়ে গেলে যে গ্রামগুলো, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে হয়, এই রোজকার এক্সপ্রেস ট্রেন দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্যরেখার কথা! চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে হারিয়ে যাওয়া স্টিলের চামচটা বুঝি কুড়িয়ে পেল গাঁয়ের কোনও শিশু। এমন আবোলতাবোল ভাবনাই কখন যেন সত্যি হয়ে আসে বরাভূমে এসে।

আর আছে সাহেবি আমলের পদচিহ্ন। মিশন। মিশনের হাসপাতাল। কুষ্ঠরোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ইটের পাঁজর বেরিয়ে আসা বর্জিত বাগানবাড়ির বিষণ্ণতা। ফেলে আসা সময়ের জগত। পরিমল ভট্টাচার্যের ‘ড্যাঞ্চিনামা’-র জগত। সব মিলিয়ে বরাভূম যেন ভরিয়ে দিয়েছিল প্রথম দর্শনে। ছোট্টবেলার বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে পাই লাকড়াকোচার জঙ্গল। ছৌ একাডেমির সামনে ম ম করে ধূ ধূ মাঠ। মাঝেমধ্যেই ট্রেন যাওয়ার শব্দে ভেসে ওঠে সিনেমার ভাষ্য।

বরাভূমের এমন রাঢ়ীয় সৌন্দর্যের মাঝেই কোথাও বুঝি জ্বলজ্বল করে গান্ধীদা। তার উদ্দাম কণ্ঠস্বরের মাদকতায় গবেষকের তরুণ মন জড়িয়ে পড়ে মায়ায়। “আসর কখন শুরু হবে, গান্ধীদা?”

গান্ধীদা উৎসাহিত তরুণকে উত্তর করেন— “হবে হবে। সবাই আসবে একে একে। তোমরা খাওয়াদাওয়া করে নাও। সলিলের হোটেল আছে এখানে। বড় রাস্তা দিয়ে একটু গেলেই দেখতে পাবে। আমরাও সব ওখানেই খাই। খেয়ে এসে সারা দুপুর আমাদের গান হবে।”

চেয়ারে বসা মানুষটি গান্ধীদা

সলিলের হোটেলটি বেশ বড়। গান্ধীদা আর ওর সহগায়কদের আড্ডা আর খাওয়ার জায়গা, দুইই। গান্ধীদা অবশ্য খেত সুখেন ডাক্তারের মেসে। ছৌ নাচের পুনরুত্থানের পিছনে বলরামপুরের যে মানুষটির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তিনি এই ডক্টর সুখেন্দু বিশ্বাস। গান্ধীদা ছিল সুখেন ডাক্তারের পুত্রের মতো। সুখেন্দু বিশ্বাসকে অবশ্য পুত্রশোক পেয়ে যেতে হয়নি। প্রিয় গান্ধীরামের মাত্র তিন মাস আগেই এ জগতের মায়া কাটিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।

সেদিনকার দুপুরের জন্য আনাড়ি গবেষক যত না প্রস্তুত ছিল, তার চেয়েও বেশি প্রস্তুত ছিলেন গান্ধীরাম মাহাত। গবেষক আর তার বন্ধুকে বারবার বলে যাচ্ছিলেন, প্রশ্ন তৈরি করে রাখো, লিখে রাখো। সেভাবেই কেমন এক সাবলীল সিস্টেমে চলে আসা পুরো ব্যাপারটা। কয়েক মিনিট আগে অবধিও কলকাত্তাইয়া দুই তরুণের মনে কাজ কতদূর হবে সেই নিয়ে সন্দেহ ছিল, সেই সন্দেহের রাস্তা বদল করে কর্মোদ্যম তখন ভর দিয়েছে তার সুবিশাল ডানায়।

গান্ধীরাম বসেছেন চেয়ারে। একসময়ে বলরামপুর রয়্যাল ক্লাবের হয়ে ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল খেলার উপহার ছিল কোমরে চোট। সেই স্মৃতিই মেঝেতে বসার অভ্যাসকে খর্ব করে। বাকিরা অবশ্য মেঝেতেই। চেয়ারে বসেই গান্ধীরাম অবতীর্ণ হন সঞ্চালকের ভূমিকায়। পরিচয় করিয়ে দেন শিল্পীর সঙ্গে আমাদের। যেন, সত্যি সত্যিই কোনও অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন তিনি। আসলে, পেশাদারিত্বের সহজাত বোধ। এ পেশাদারিত্ব কাউকে আঘাত করে না, বরং ঘা মেরে শিখিয়ে নেয়।

প্রথম শীতের আমেজ পুরুলিয়ার এই প্রান্তে। লাকড়াকোচার জঙ্গল, রেললাইনের ওপার থেকে ভেসে আসতে থাকে ঠান্ডা হাওয়া। তখনও আসর জমাটি। বাহাত্তর বছরের বিশ্বম্ভর পরামানিক, স্বাধীনতার বছরে যাঁর জন্ম, আর ওদিকে পঁচাশির নারান তন্তুবায়, গেয়ে চলেছেন গান। বিশ্বম্ভরেরই নিজের লেখা ‘বনজ সম্পদ, তায় উচ্ছেদে বিপদ, জলবায়ু অল্প, বাঢ়িবে দূষণ।’ আবার কখনও ধরছেন, ‘চলো যাব ডাক্তারের কাছে।’ বিশ্বম্ভরের কবিরাজি পেশা সেখানে যাচ্ছে মিলেমিশে।

কলকাতার দুই তরুণ তখন মিশ্র অনুভূতিতে বুঁদ। গানের মূর্ছনায় মুগ্ধ, আতিথেয়তায় আপ্লুত, আবার সন্দেহপ্রকাশের হেতু লজ্জিতও হয়তো। সেদিন সন্ধ্যায় দুজনে যখন রেললাইন পার হয়ে অন্ধকার লাকড়াকোচার জঙ্গল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যায়, তাদের মনে কোনও অসীম, সঞ্জয়, শেখর বা হরির উদ্দাম মাদকতাময় মধ্যবিত্ত নীচতার স্মৃতি ভেসে ওঠেনি, বরং, তাদের মন জুড়ে বিস্তার করেছিলেন নারান তন্তুবায়, বিশ্বম্ভর পরামানিক, চন্দন সিং সরদার। এবং, গান্ধীরাম মাহাত। তারা বরং নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ ঝগড়া করেছিল, আরও কেন প্রস্তুত হয়ে আসেনি, সেই বিষয়ে। তারপর একেবারে চুপ করে যায় তারা। নিঃশব্দেই পার হয় শাল-ঘেরা লাকড়াকোচাকে। সামনের সরু রাস্তাটা দিয়ে চলে যাওয়া গরুর গাড়ির কর্কশ শব্দও সেই নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করতে পারেনি।

মধ্যযুগীয় ঝুমুর কবিদের মধ্যে গান্ধীরাম মাহাতর প্রিয় ছিলেন ভবপ্রীতানন্দ ওঝা। একটা বহু পুরনো পাতলা বইয়ের সংস্করণ, যে ধরনের বইতে আমরা পাঁচালি দেখে থাকি, ভবপ্রীতার ঝুমুরের তেমন একটা বই। রোজ সন্ধেয় ওইটেই গান্ধীদার পড়াশোনার ডালি। সঙ্গে অবশ্য আরও কিছু বই। গান্ধীদার শালকাঠ-সজ্জিত কড়ি-বরগার ঘরের একমাত্র টেবিলের একপাশে রাখা থাকত সেসব বই। সবই পুরনো। সেদিন সন্ধেয় অবশ্য গান্ধীদা উদ্বিগ্ন ছিলেন, দুই অনাহুত অতিথিকে কোথায় থাকতে দেবেন, সেই চিন্তায়। অবশেষে একটি বড় ঘর খুলে দুটি তক্তপোশকে জুড়ে কয়েকটা কম্বল আর কাঁথা দিয়ে নিজে হাতে বিছানা করে দেওয়ার পর তাঁর চিন্তা কমে।

“কিছু কিছু ঝুমুরের পদ রয়েছে, একটু মানেগুলো বলে দেবে, গান্ধীদা? আমাকে তো ওই লেখার সময়ে অর্থগুলো দিতে হবে।”

“হ হ, কোনও অসুবিধা নাই। তবে রাতে। তোমরা খাওয়াদাওয়া করে নিও। আমরাও খেয়েদেয়ে আসব। তারপর।”

বলরামপুরে সন্ধে নামে ঝুপ করে। এইবার লাকড়াকোচার জঙ্গলের দিকে তাকালে সেখানে ঘুটঘুট করবে রহস্যময়ী অন্ধকার। তৈরি হবে গল্পের প্লট। থেকে থেকে ট্রেন বা মালগাড়ির শব্দকে মনে হবে কোনও সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ডের কান্না। বন্ধু বলবে, চ, সামনের মাঠটায় গিয়ে বসি। প্রচুর তারা দেখা যাবে। গান্ধীদাকে অবশ্য তখন পাওয়া মুস্কিল।

তারপর রাত নামলে, বলরামপুর রয়্যাল ছৌ একাডেমির বাগান-মোড়া জমিটায় ধোঁয়াটে অন্ধকার নেমে এলে, আমরা আবার ফিরে যাব ঝুমুরে। বন্ধু অনুরোধ করবে গান্ধীদাকে, একটা গান শোনান। গান্ধীরাম তাঁর স্কুলিং শুরু করেন অতি চেনা একটা ঝুমুরকে সামনে রেখে। সুনীল মাহাতর লেখা প্রথম ঝুমুর গান। ঝুমুরের পুনরুত্থান-যাত্রার সূচনা পর্বের অন্যতম গান। রাধা-কৃষ্ণের বৃন্দাবন, যমুনা নদীর উত্তর ভারতীয় দৃশ্যপট ছাপিয়ে সুনীল মাহাতর গানে এসে পড়ছে লালমাটির নিজস্ব চেতনা। যমুনাকে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে কাঁসাই কিংবা কুমারী নদী। শাল-পলাশের বনের শাখায় শাখায় ভেসে বেড়াচ্ছে সেইসব সুর। আর এভাবেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে একটা গান— “পিঁদাড়ে পলাশের বন/পালাব পালাব মন/নেংটি ইঁদুরে ঢোল কাটে/বতরে পিরীতি ফুল ফুটে।”

এ গান আমরা কমবেশি সকলেই শুনেছি। কিন্তু জেনে গেয়েছি কজন? বা ক্রমাগত অনেকেই যে ‘পিন্দাড়ে’ বা ‘ইন্দুরে’ বলে যান, তা যে ভুল, এই বোধ জেগেছে কজনের? বাড়ির পিছনের পলাশবনে ছুটিয়ে দেওয়া মনকে নিয়ে এমন একটি আনন্দময়তার গান, কী অসম্ভব মায়াময় তার কথা! তাকে তো গাইতেও হবে সেইমতো। গান্ধীদার কথায় পরিষ্কার উঠে আসে সেই আকুতি। ঘরময় ঘুরে ঘুরে গান্ধীরাম মাহাত ধরেন তাঁর সুর। প্রথমে ধীর লয়ে। ‘বন’-এর ‘ব’ আর ‘ন’-এর মধ্যে একটি উচ্চাঙ্গ টান, গান্ধীদার উদাত্ত-মিষ্ট কণ্ঠস্বর যেন আলিঙ্গন করে ওই দূরের লাকড়াকোচার বনটাকে। ওই বনেও যে পলাশ আর শালের ছড়াছড়ি। আমাদের বিরাট ঘরটায় সেই আওয়াজ গমগম করতে থাকে।

উচ্চাঙ্গ শুরুর পরে গান্ধীদা বলেন— “এখন তোমার বিটটা দিব।” এরপর হাতে হাতেই তাল দিতে দিতে আবারও প্রথম লাইন থেকে শুরু। এবার একটু দ্রুত লয়ে। গান্ধীদার সঙ্গে আমরাও তাল দিতে থাকি। কিছুটা গেয়ে নিয়ে গান্ধীদা আবার বলেন— “একটা একটু স্পিডে হবে। তোমরা গাওয়ার সময়ে আরও স্পিড করো। অত স্পিড হবেক নাই।” গান্ধীরাম মাহাত বোঝাতে থাকেন একটি গানের সুরের পিছনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ— “তারপরে তো মেয়েগুলো নাচছে। এই যে মেয়েগুলো নাচছে, এই যে লহর, তখন সেই তিন কে ধা গা ধা, এই সিস্টেমটায় আসছে। এই সিস্টেমটা অনুযায়ী তো করতে হবে গানটা।” ওই কয়েকটা কথাতেই স্পষ্ট হয়, আমাদের শহুরে বাঙালিয়ানা কীভাবে ধ্বংস করছে আঞ্চলিকতার বৈজ্ঞানিকীকে।

বন্ধু চলে এসেছিল। রয়ে গিয়েছিলাম আমি। গান্ধীদাকে আশ্রয় করে। গান্ধীদাও সন্তানসম ভাইটিকে আগলে রেখেছিলেন। রাতে সলিলের হোটেল থেকে রুটি-তড়কা খেয়ে ফেরার সময়ের হাইওয়ে। আলো নেই। মোবাইলের টর্চ জ্বালেন গান্ধীদা। “সহমভাই, তোমার বাবা রিটায়ার করে গেছেন?”

উত্তর দিই— “না, আরও বছর তিনেক দেরি।”

দু-একটি গাড়ির আওয়াজের বিক্ষিপ্ত শব্দকে এড়িয়ে রাতের নিজস্ব যে নিস্তব্ধতা, তা ভেদ করে গান্ধীদা হেসে ওঠেন। “তাহলে তো তোমার বাবা আমার থেকে ছোট।”

রাতের রহস্যকে ছাপিয়ে আমার গলা রহস্যময় হয়— “তোমাকে সেজন্য জেঠু বলে ডাকব, ভাবছ নাকি?” সুখেন্দু বিশ্বাসের মেসবাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি ততক্ষণে। দুজনের একসঙ্গে হাসি। গান্ধীদা আশ্বাস দেন দাদার মতোই— “না না, গান্ধীদাই বলো। ওই নামেই সকলে ডাকে।”

সুখেন্দু বিশ্বাসের মেসবাড়িতে খেতেন গান্ধীদা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান সবকিছু। মানুষের ছবি। ভারতের কাছে কলকাতার গুরুত্ব কমে যাওয়ার পরেই রাঢ়ভূম হয়ে গিয়েছিল আরও বেশি প্রান্তিক। সেই প্রান্তিকতার সময়ের দলিল এই মেসবাড়ি। মানুষের ছবিগুলোও। গান্ধীদাদের বড় হওয়ার সময়ের সেই ক্যানভাস যে কেমন ছিল, তা জানতে চেয়েও বারবার পিছিয়ে আসি।

রাতে ফিরে আবার ঝুমুরের চর্চা হবে, গান্ধীদা বলবেন ওঁর আরেকটা নাম। সে নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের গন্ধ। নামটা ‘মহাত্মা’, ওই নামে গান্ধীদাকে ডাকতেন গুরু সলাবত মাহাত। ঝুমুরের অবিস্মরণীয় শিল্পী। জিজ্ঞাসা করতাম— “গলার কাজটা কি ওঁর থেকেই শিখেছিলে?” গান্ধীদা অহমিকার সঙ্গে উত্তর দিতেন— “হ্যাঁ। বাকিদের গান শুনবে আর আমার গান শুনবে। পার্থক্য আছে না?”

এমন উত্তর কিঞ্চিৎ বেমানান ঠেকত। আমি বলতাম— “সবার দ্বারা তো সবটা হয় না। ওরা নিশ্চয় তোমার মতো এমন গুরু পায়নি।”

গান্ধীদা হাসতেন। যেমন হাসতেন প্রতি কথায়। “হ হ। তা ঠিক।”

ঝুমুর গাওয়ার রীতিতেই রয়েছে উচ্চাঙ্গ টান। আরেক প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী কুচিল মুখোপাধ্যায়ের মুখে যখন গান শুনেছি, তখনও আভাস পেয়েছি সেই টানের। গান্ধীদার গলায় সেই রীতি যেন নিজেই এক শিল্প হয়ে উঠত। আমার থাকার সেই বিরাট টিনের চালের ঘরে সে যখন গান ধরত, মনে হত ঘরটাও যেন শুনছে তাঁর গান। প্রথম রাতে ‘যার প্রেমেতে ঝুরে মরি/সে তো গেল মধুপুরি’ যখন তিনি ধরেছিলেন, তখন মনে হয়েছিল, গানের সেই ব্যর্থ প্রেমই বুঝি তাকে সমস্ত শরীর দিয়ে গাইয়ে নিচ্ছে। এ গান রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক। বিরহের সেই মেজাজকে গান্ধীরাম ওই রেওয়াজি টানেই ধরে ফেলতেন অনায়াসে।

গান্ধীদার কাছে যাঁরা ঝুমুর চর্চা করতে আসতেন, তাঁদের মধ্যেও গান্ধীদা চাইতেন এই ধারাকে বাহিত করে দিতে। বন্ধু চলে আসার সময়ে আমাকে অনুরোধ করেছিল, কয়েকটা গান রেকর্ড করে আনিস। সেবার আমার শেষদিনের থেকে যাওয়ার পূর্ণ স্মৃতি জুড়ে থেকেছে ‘কালো জলে কুজলা তোলে ডুবল সনাতন’ অথবা ‘একদিনকার হলুদবাটা তিনদিনকার বাসি’, সেগুলোর সুরেও ওই উচ্চাঙ্গের বোল। সেদিনই রাতে গান্ধীদা আমার খাতায় বাঁকানো অক্ষরে লিখে দিয়েছিলেন গানগুলি। হাতের লেখায় কোথাও থেকে যায় মানুষের স্মৃতি। ডিএনএ-ও কি থাকে?

পৌষ সংক্রান্তির সময়ে মানভূমে উৎসব চলে। টুসু পরবের আয়োজন। আখাইন যাত্রা, ভানসিংহের মেলা, টুসু ভাসান। কয়েকদিনের ছুটির মেজাজ, তারপর আবার রোজকার দিনগত সরণিতে প্রত্যাবর্তন। সেবারে গিয়ে কাউকে পাইনি। মথুরের চায়ের দোকান বন্ধ, সলিলের হোটেল বন্ধ, মথুর গোপের পান-বিড়ির দোকানও বন্ধ। এই মথুর গোপও ঝুমুর লেখেন। পান-বিড়ি বেচতে বেচতেই আমাকে আর বন্ধুকে দেখিয়েছিলেন, পুরনো খাতাটা। সবই অবশ্য তখন ছুটিতে, পরব চলছে যে।

শুধু গান্ধীদা রয়ে গেছেন। গান্ধীদার বাড়ি যাওয়া নেই, তার অতিথি গ্রহণ করার দায়িত্ব আছে। আমি এসেছি, সঙ্গে সায়নী। ছুটিতে অতিথি আসায় গান্ধীদা খুশিতে ডগমগ। ঘর পরিষ্কার করিয়ে রেখেছেন আগে থেকে। সহজভঙ্গিতে আপন করেছেন সায়নীকে। অবিবাহিত তরুণ-তরুণীকে জায়গা দিতে কাজ করেনি কোনও সামাজিক বাধা। শেষদিন পুরুলিয়া থেকে বাসে বলরামপুর ফিরছিলাম। বড়া উরমার কাছে বাস, সন্ধে ঘন, গান্ধীদা ফোন করছেন— “কত দূরে গো, তোমরা?”

সায়নীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে, যেন কতদিনের চেনা। “সায়নী ট্রেকিং পারবে। সহমভাইয়ের যা চেহারা, ওতে ট্রেকিং হবে না।”

সায়নী হাসত। গান্ধীদাও। আমি নিজপক্ষ সমর্থনের আপ্রাণ চেষ্টায় বলতাম— “চেহারা দেখে ভুলো না। তড়তড়িয়ে পাহাড়ে চড়তে পারি।”

গান্ধীদা সেসবকে পাত্তা না দিয়েই সায়নীকে বলেন— “সহমের যা ঘুম। বাবা রে, ভাঙতেই চায় না। সেবার আমি কতবার গিয়ে ডাকছি, ওঠেই আর না।”

এবার তিনজনেই হাসি। তারপর আমি বলি— “আর সেটাকে মেক-আপ দিতে পরের রাতে যে ঘুমই হল না, সেটা বলবে না?” সারারাত্তির চালের ওপর গাছ থেকে জল পড়ছে, হাওয়ায় দরজা ধাক্কাচ্ছে। পুরুলিয়াতে ফিরে যা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কুচিল মুখার্জির কাছে আর যাওয়াই হয়নি সকালে। আবার রাতে গিয়ে ইন্টারভিউ নিতে হয়।

ফিল্ডে ঘুরে বেড়ানোর এমন সব যা-তা কাণ্ডেই ভরে থাকে জীবন। সেসব পরে বড় উপভোগ্য লাগে। গল্পগুজব গড়ায়, আরও খানিক। গান্ধীদার ফুটবল খেলার কাহিনি। কলকাতা ময়দানে কৃশানু দে-র জোটসঙ্গী বিকাশ পাঁজির সঙ্গে খেলেছেন গান্ধীদা। সেইসব গল্পের সন্ধেরা ঘুরে বেড়াবে চিরকাল, বলরামপুরের ছৌ একাডেমির বাগানের গাছগুলোয়।

তখন সিএএ-এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসমাজ উত্তাল। আমরা, সদ্য-প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও ছিলাম। গান্ধীদার সঙ্গে কথা হচ্ছে সেসবের। গান্ধীদা জোর গলায় বলছিলেন— “এই আন্দোলনই ওদেরকে গদি থেকে টেনে নামাবে, মিলিয়ে নিও।”

সে আন্দোলন পরিকল্পিতভাবে ভেস্তে দেওয়া হল অতিমারির ভয় দর্শিয়ে। যদিও, আন্দোলনের ধারা স্তিমিত হয়নি। গান্ধীদার মতো মুক্তমনের মানুষেরা এই বিভেদকামী রাজনীতির পরিপন্থী, আমাদের প্রতিরোধের চেয়ে তাদের আজন্ম লৌকিক সংস্কৃতির প্রতিরোধ অনেক বেশি শক্তিশালী। আমার তাই গান্ধীদার কথায় বিশ্বাস করতে ভালো লাগে।

তখন সদ্য বই বেরিয়েছে আমার। গান্ধীদা শুনে বললেন— “একটা কপি আনলে না, আমার জন্য?”

সায়নী অনুযোগ করে— “আমাকেই দেয়নি, জানো?”

জোড়া অনুযোগে কোণঠাসা আমি বলি— “আমি নিজেই তো এক কপি পেয়েছি মাত্র।”

কপি পাঠানো হয়নি।

সন্ধে গাঢ় হলে আমি উঠি। খাবার আনতে যেতে হবে। সলিলের দোকান বন্ধ, যেতে হবে একটু দূরেই। গান্ধীদা বলেন— “সায়নী থাকুক আমার কাছে। তুমি গিয়ে কিনে আনো। খুব অন্ধকার থাকে ওদিকটা।”

হয়তো ভয়ের কিছুই নেই। তবু আমি একাই উঠি। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে হুডিটা ভালো করে জড়িয়ে নিই। সায়নী বলে দেয়— “রুটি আর পনির।”

নির্দেশিত খাবারের সন্ধান পেতে অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। সায়নী হয়তো একাই ঝুমুর শুনবে গান্ধীদার কাছে, গল্প শুনবে আরও। একা লাগবে না ওর।

গান্ধীদা আছেন, আমি নিশ্চিন্ত।

গান্ধীদা ছিলেন, আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম।


*অডিওগুলি সৌমেন্দু দাসের সৌজন্যে ও ভিডিওটি সুদীপ সিংহের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...