পুব আঁধারের অভিভাবক

পুব আঁধারের অভিভাবক -- তাপস কুমার দাস

তাপস কুমার দাস

 

স্নাতকোত্তর পড়াশুনার শেষে, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন গুজরাটের একটি সর্বভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাগারে রিসার্চ স্কলার হিসেবে ছিলাম কিছুদিন। সেখান থেকে মাসকয়েক বাদে কলকাতায় ফিরে আসি বাবার শারীরিক অসুস্থতা এবং আরও কিছু কারণে। এসে, কলকাতারই একটি গবেষণাগারে যোগ দিই। আমেদাবাদের সেই গবেষণাগারে আমার হোস্টেল রুমটা ছিল খুব স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে। হোস্টেল হাউসিংয়ের সবচেয়ে কোণের বিল্ডিংয়ের একতলার সবচেয়ে একটেরে ঘর— সহজে কারও নজরে পড়ত না বাইরে থেকে। ফলত ওই গবেষণাগারের দাদারা, যারা কিনা আমাকে খুবই ভালোবাসত, তাদের যাবতীয় অ্যালকোহলিক পানীয়ের স্টক এবং গাঁজা ও আরও প্রভূত নেশার জিনিসের স্টক আমার ঘরেই ডাম্প করত। গুজরাট তখন আপাতদৃষ্টিতে স্ট্রিক্টলি ড্ৰাই স্টেট, এবং সেইজন্যই আইনের ফাঁকফোকরও অনেক বেশি। আমেদাবাদ এক্সপ্রেসে কলকাতা থেকে যাওয়ার সময় দেখতাম মহারাষ্ট্র আর গুজরাট বর্ডারের স্টেশন নন্দুরবার এলেই ট্রেনে কোল্ড ড্রিঙ্কসের মতো করে ‘বিয়ার বিয়ার’ বলে হেঁকে হেঁকে মদ বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশি দামে। এমতাবস্থায়, অনেক বেশি দাম দিয়ে কেনা পানীয়ের স্টক নিরাপদে রাখার প্রয়োজন ছিল বৈকি। লোকের নজরে পড়বে না বলে, এবং ফোকলা দাদুর কাছে বাদামভাজা স্টক করার মতো অনুরূপ সুবিধাজনক কারণেও বটে— যেহেতু আমি তখন কোনও নেশা করতাম না, মানে একেবারেই না, মদ জিভেই ছোঁয়াইনি তখনও পর্যন্ত একটিবারের জন্যও জীবনে, অন্য নেশা তো দূরস্থান।

ওইরকম বিচ্ছিন্ন হোস্টেল রুমে থাকার অনেক সুবিধে ছিল, বন্ধুদের, বিশেষ করে বান্ধবীদের, লোকচক্ষুর অন্তরালে ওই ঘরে অনায়াস যাতায়াত তার মধ্যে একটা। তেমনি আবার মাঝে মাঝে বিচ্ছিরি ধরনের অসুবিধাতেও পড়তে হত। ইনস্টিট্যুট জয়েন করার কদিন বাদেই আমার সিভিয়ার ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়া হয়। একদিন রাত্রে ধুম জ্বর নিয়ে বাথরুম যেতে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাই। শরীরের উপরার্ধ মেঝেয় এবং নিম্নার্ধ খাটে— এই অবস্থায় সারারাত পড়ে থাকি অজ্ঞান হয়ে। ভোরবেলা হোস্টেলের ঘরমোছার মাসি ঘরে ঢুকে ওইভাবে আমাকে পড়ে থাকতে দেখে আতঙ্কে চিক্কুর দিয়ে লোকজন ডাকে— তারপর ডাক্তার-বদ্যি-হাসপাতাল ইত্যাদির পালা চলেছিল।

সেই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া থেকে সবে সেরে উঠেছি। একটু একটু বেরোই ঘর থেকে— দু-পা হাঁটতে মাথা টলটল করে। সেরকমই একটা দিনে ধীরে ধীরে পায়চারি করছি ঘরের সামনে, পেছন থেকে কার চাপা গলায় ডাক—

–এই যে তাপস!

ঘুরে দেখি বরুণদা। এককালে জগদীশ বোস ন্যাশনাল ট্যালেন্ট সার্চের (JBNSTS) হর্তাকর্তা, বর্তমানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের নামকরা অধ্যাপক, খুবই পরিচিত মুখ— তাই নামটা বদলে লিখলাম। বরুণদা তখন আমেদাবাদের ওই গবেষণাগারে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে ছিলেন। দেখলাম বরুণদার সঙ্গে একই হোস্টেল বিল্ডিংয়ে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে থাকা আরেক তামিল দাদা, যিনি বর্তমানে দক্ষিণ ভারতের একটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতের বিখ্যাত এক কেন্দ্রীয় সরকারি গবেষণাগারের অধিকর্তা, তিনি অল্পস্বল্প বাংলাও বুঝতেন।

দাদার ডাকে আমি মুখ ফেরাতেই, দাদা চশমাটা একটু নামিয়ে, চশমার ফাঁকের মধ্যে দিয়ে আমার মুখে শঙ্কিত দৃষ্টি স্থাপন করে কন্সপিরেটোরিয়াল ভয়েসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন:

–জাঙ্গিয়ার গুজরাটি কী হে?

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম— কেন আপনার কি সবকটাই ছিঁড়ে গেছে? তিনি হতাশ গলায় বললেন— হ্যাঁ ভাই! ইমিডিয়েটলি কেনা দরকার। দোকানে ইংরেজি বোঝে কি না বোঝে— জানো নাকি গুজরাটিটা?

–না বরুণদা, আমি কলকাতা থেকে অনেকগুলোই নিয়ে এসেছি। এক্সট্রাই আছে বরং। কিন্তু এ জিনিস তো আপনাকে ধার দেওয়া যাবে না…

হতাশ এবং ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে দাদা সামনে থেকে কেটে পড়লেন।

আমার স্টক পুরনো হয়ে গেলেও, আমেদাবাদে জাঙ্গিয়া পেতে অসুবিধা হয়নি পরে। কিন্তু ছোটবেলায় পাইনি, যে জাঙ্গিয়া খুঁজেছিলাম কৈশোরে, বেগুনির ওপর চওড়া কালো ডায়াগোনাল স্ট্রাইপ থাকবে জাঙ্গিয়া জুড়ে— কোথাও খুঁজে পাইনি সেরকম জাঙ্গিয়া।

জাঙ্গিয়া, বহিরাবরণীর মতো, বানানো যায় না অর্ডার দিয়ে কোনও টেলার্সে। জানতাম সেটা। তাও গিয়ে হামলা করেছিলাম পাড়ার ঘোষ টেলার্সে, বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড কালক্রমে পুরনো হয়ে ট-এর টিকিসহ সামনের এ-কার, এবং দন্ত্য স-এর রেফ উড়ে গিয়ে তখন পড়লে শোনাত ঘোষ ঢলাস। কার সঙ্গে ঢলানি এত, সে প্রশ্ন দাঁত বার করে করেই ফেলব ভেবেছিলাম দোকানের মালিক ঘোষদাকে, বাবার ভীম ঠ্যাঙ্গানির ভয়ে যদিও কখনও সে প্রশ্ন করা হয়নি। তাকেও ধরি গিয়ে—

–ঘোষদা, জাঙ্গিয়া বানিয়ে দাও না একটা, মাইরি? আমি এঁকে দেব কীরকম কাপড় দিয়ে কীভাবে বানাবে…

বহুক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে যে কথাটি বলেছিল ঘোষদা, তা ছাপার যোগ্য নয় বলে লেখা গেল না— বুঝহ লোক যে জানহ সন্ধান!

ফলে, জাঙ্গিয়া হল না। তখন প্রাণপণে পড়লাম আংটি নিয়ে— ও মদনকাকু, বানিয়ে দেবে গো?

কাকার পেয়ারের বন্ধু মদনকাকু, শ্রী মদন মোদক, বিভিন্ন কারখানায় চাকরি করতেন, ফুরণে খেটে বেড়াতেন বলাই ভালো। যন্ত্রপাতি বুঝতেন খুব ভালো, এবং অসাধারণ লেদ মেশিন চালাতেন। আড়িয়াদহ এলাকার বাঙালিবাড়ির কারখানার একটা বড় ভরসার জায়গা ছিলেন মদনকাকু।

আমার অনুরোধ রাখলেন। সপ্তাহখানেকের মাথাতেই এসে গেল আংটিদুটো— একটায় খুলির ছাপ, অন্যটায় উল্টো স্বস্তিকামার্কা শুভচিহ্ন। দুটো স্টেনলেস স্টিলের আংটি, যার মাথাটা চৌকো এবং চওড়া, দক্ষিণেশ্বরের মেলা থেকে কিনে বহুযত্নে লেদ মেশিন দিয়ে খোদাই করে অরণ্যদেবের আংটিদুটো বানিয়ে দিয়েছিলেন মদনকাকু। হাতে পেয়ে আমি আকাশজোড়া হাঁ করে উল্লাসের একটা চিৎকার দিলাম, তারপর চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তর উচ্চমাধ্যমিক পদার্থবিদ্যার বইয়ের কোএফিসিয়েন্ট অফ রেস্টিট্যুশন বার করার অঙ্কের রবারের বলের মতো বারকয়েক বাড়িরই মেঝেতে হপ করে নিয়ে, দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম পাশের কালোমাঠে (ঘেঁষ, অর্থাৎ কয়লার গুঁড়ো দিয়ে পুকুর বুঝিয়ে সে মাঠের সৃষ্টি, তাই নাম কালোমাঠ)। বন্ধুদের এখুনি দেখাতে হবে এই অমূল্য সম্পদ!

এভাবেই অরণ্যদেব নিফাঁকভাবে অধিকার করে রেখেছিলেন আমার ছোটবেলা। ফ্যান্টমকে অরণ্যদেবই বলতাম আমরা, বেতাল নয়— বেতাল বলতে বেতাল পঞ্চবিংশতি বুঝতাম, যদিও ইন্দ্রজাল কমিক্সে বেতালই বলা হত মিস্টার ওয়াকারকে। ‘অরণ্যদেব’ নামটি দিয়েছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয়। ভারতবর্ষে সবথেকে বেশি সংখ্যক অরণ্যদেবের কমিক্স প্রকাশ করে বেনেট, কোলম্যান অ্যান্ড কোম্পানি (যাঁরা টাইমস অফ ইন্ডিয়া বার করে থাকেন)— ১৯৬৪ থেকে (লি ফকের ফ্যান্টমের কমিকস্ট্রিপ ভারতবর্ষে যদিও প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে, দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে) ১৯৯০ পর্যন্ত এই সময়সীমার মধ্যে মোট ৪১৪টি কমিক্স। প্রথমে ১৬ পাতার (সঙ্গে অন্যান্য ফিলার), তারপর ২৪ পাতার এবং ফাইন্যালি ৩২ পাতার কমিক্স— প্রথমে প্রতি সপ্তাহে, পরে মাসিক এবং কখনও পাক্ষিক, এবং আরও পরে আবার সাপ্তাহিক— এইভাবে। প্রথমে ইংরেজি দিয়েই শুরু হয়, দ্রুতই বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাতেও প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলায় প্রকাশনা শুরু হয় উনিশশো ছেষট্টি সালের জানুয়ারি থেকে, ইন্দ্রজাল কমিক্সের তেইশ নম্বর (চৌষট্টির মার্চের প্রথম প্রকাশ, দ্য ফ্যান্টমস বেল্ট-কে প্রথম সংখ্যা ধরলে) সংখ্যা থেকে। আমার জন্মের পাঁচ বছর আগে থেকেই। আমি বরাবর বাংলাটাই পড়ে এসেছি।

ইন্দ্রজাল কমিক্স ছাড়াও, তামিল ভাষায় মায়াবী, রানি কমিক্স এবং মুথ্যু কমিক্স বেরোত অরণ্যদেবের (মানে ফ্যান্টমের), লি ফক এবং সাই বেরির আঁকা। ইংরেজিতে আরও একাধিক প্রকাশনালয়, যেমন ডায়মন্ড কমিক্স, অরণ্যদেবের কাহিনি বার করেছে। ১৯৯২ সালের আনন্দমেলার ৫ আগস্ট সংখ্যায় অরণ্যদেব কমিকসের বিবর্তন নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একাধিক আলোচনা আছে।

শুধু অরণ্যদেবই নয়, বাকিরাও— লি ফকেরই ম্যানড্রেক, আলেক্স রেমন্ডের মহাকাশচারী ফ্ল্যাশ গর্ডন আর গোয়েন্দা রিপ কার্বি (দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় কমিক স্ট্রিপ হিসেবেও বেরোত দীর্ঘদিন), রয় ক্রেনের মানবিক গোয়েন্দা বাজ সায়ার, এলেন স্যান্ডার্সের গোয়েন্দারা— মাইক নোমাড, কেরি ড্রেক আর লেফটেন্যান্ট (লেফ্টি) ড্রেক, স্টিভ ডাউলিংয়ের মহাপরাক্রমশালী গার্থ, আর সম্পূর্ণ দেশীয় আবিদ সুর্তির (পরে জগজিৎ উপ্পল) লেখায় এবং গোভিন্দ ব্রহ্মনিয়ার (পরে বি প্রমোদ) রেখায় বাহাদুর— মানে বাংলা ভাষায় বেরোনো ইন্দ্রজাল কমিক্স এর সব চরিত্রই ছিল ছোটবেলায় আমাদের আত্মার আত্মীয়। আলেক্স রেমন্ডের ফিল করিগান বাংলায় বার করেনি ইন্দ্রজাল কমিক্স যতদূর মনে পড়ে, তবে মাইক ব্যারনের লেখায় আর ভ্যাল মায়েরিকের ছবিতে চারটে ব্রুস লি-র (যার মধ্যে একটা গল্প দু সংখ্যা ধরে, দু ভাগে) কমিক্স বেরিয়েছিল বাংলায়। ১৯৯০ সালের ১৬ এপ্রিলে শেষ সংখ্যা বেরিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে, সমস্ত চরিত্র মিলিয়ে মোট ৮০৩ খানা ইন্দ্রজাল কমিক্স বেরোয়। তার অর্ধেকের বেশিই অরণ্যদেব।

প্রকৃত প্রস্তাবে অনেক দিক থেকেই অরণ্যদেব অসাধারণ, বা পায়োনিয়ার। অরণ্যদেবই প্রথম কমিক চরিত্র যিনি ওরকম গা-আঁট পোশাক পরতেন (যে ডিজাইনের আইডিয়া লি ফক ধার করেছিলেন সম্ভবত রবিনহুডের পোশাকের সামান্য তারতম্য ঘটিয়ে), যে কস্ট্যুম পরে অন্যান্য কমিক হিরোদের আর্কিটাইপাল বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে অবশ্য অরণ্যদেবের কস্ট্যুম এবং অন্তর্বাস দুটিই ছিল ঘন নীল রঙের, গোটা চল্লিশেক সংখ্যা পর থেকে বহির্বাসের রং নীল থেকে বেগুনি হয়ে যায়। অন্তর্বাস নীলকালোই থাকে। প্রকাশনার একেবারে প্রথমদিকে দু-একটা কমিক স্ট্রিপের ফেসিং পেজে অরণ্যদেবের চোখ দেখা গেলেও, তারপর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চোখঢাকা মুখোশ থাকে অরণ্যদেবের, যাতে কখনওই তাঁর চোখের মনি দেখতে না পাওয়া যায়। একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে লি ফক জানান, এই মণিবিহীন এপিয়ারেন্স তাঁর মাথায় আসে গ্রিক ভাস্কর্যের মণিহীন অবয়ব দেখে। চোখের মণি না থাকায় গ্রিক মূর্তিগুলো এক অদ্ভুত সাররিয়াল এবং অপার্থিব রূপ পেত, দৃশ্যগতভাবে অরণ্যদেবের মধ্যে সেই অতিমানবিক ফ্লেভার আমদানি করতে চেয়েছিলেন ফক সাহেব। যদিও সে অর্থে কোনও অতিমানবিক বৈশিষ্ট্য অরণ্যদেবের ছিল না। কমিক স্ট্রিপের অন্যান্য হিরোর মতো, যেমন স্পাইডারম্যান বা সুপারম্যান— কোনও অপার্থিব, অতিমানবিক, জাদুগুণসম্পন্ন ফিচার অরণ্যদেবের ছিল না, তিনি শত্রুদের জয় করতেন বুদ্ধিবলে (অনেক ঘটনাতেই অরণ্যদেবের বাস্তবসম্মত মেধার পরিচয় পাওয়া যায়) এবং দেহবলে। সে অর্থে অরণ্যদেব একজন আপাদমস্তক মানুষ, হিরো হলেও তিনি তাই আমাদের মতোই মানুষ, সুপারপাওয়ারওয়ালা কোনও অবাস্তব সুপারহিরো নন। অরণ্যদেবের অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে, ফলত, রিলেট করা সহজ, অজান্তেই তাই তিনি হিরো হয়ে ওঠেন ব্যক্তিস্তরে।

ইন্দ্রজাল ছাড়াও, অবশই টিনটিন এবং অন্য কমিক্স ছিল আমাদের জীবনে। ছিল হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে ফন্টে, নোলেদা, গাবলু (কোথাও কোথাও গাবলুকে গুণধরও বলা হত, ইংরেজিতে হেনরি— কার্ল টমাস অ্যান্ডারসনের সৃষ্টি) ইত্যাদি। ইন্দ্রজাল কমিকের মধ্যে মধ্যেও গুঁজে দেওয়া থাকত কিছু দিশি কমিক্স স্ট্রিপ— শিহাবের চিম্পু, প্রকাশের কিট্টু, শেখর জাঠারের বাবুয়া, অনামী চিত্রকরের আঁকা চরিত্র পারো, বা বুদ্ধির্যস্য শিরোনামে আকবর-বীরবল, কখনও বা বিদেশি ছোট্ট রাজার (অটো সোগলোর আঁকা লিটল কিং, অনেকটা মূকাভিনয় ছাঁদে কমিক স্ট্রিপ) গল্প। গোচিনি-ইউদেরজো-ফেরির এস্টেরিক্স-ওবেলিস্ক পড়তে শুরু করেছিলাম অনেক পরে, বাংলায় অনুবাদ যবে থেকে আনন্দমেলায় বেরোতে শুরু করল, তখন থেকে। ছোটবেলা থেকেই আমি ইংরেজিতে কোনও কিছু পড়ে রসাস্বাদন করতে পারি না সেভাবে, মানে এন্টারটেনমেন্ট লিটারেচারের কথা বলছি, সিরিয়াস প্রবন্ধ ইত্যাদির কথা না। এই বদভ্যাস আমার এখনও রয়ে গেছে। যে কোনও বিশ্বসাহিত্য আমি এখনও ইংরাজির বদলে বাংলা অনুবাদে পড়তে স্বচ্ছন্দ। ফলত আর্চি ইত্যাদি সেভাবে আমাকে আকৃষ্ট করেনি কোনওদিনই। মাঝে মাঝে হাতে পেলে পাতা উল্টে দেখতাম, এইটুকুই। এককালের অতি জনপ্রিয় চাচা চৌধরীও আমাকে টানেনি তেমন, অন্যান্য কমিক্স কাহিনির  ঝকঝকে বুদ্ধিমত্তার ছাপ কখনও খুঁজে পাইনি সেখানে। তা ছাড়া, চাচা চৌধরী আর সাবুর গল্পের অতি এক্সপ্লিসিট অবাঙালি ফিচার্সও মনে হয় সেতুবন্ধনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল— সেটি সম্ভবত অনুবাদকের সীমাবদ্ধতা, ভূমিকায় চাচা চৌধরীর স্রষ্টা প্রাণ (প্রাণ কুমার শর্মা) গোয়ালিয়র থেকে তাঁর বিএ ডিগ্রিটি ‘হাসিল করেছেন’ পড়েই কমিক্স পড়ার উৎসাহ অনেকটাই চলে গিয়েছিল— বাংলা ভাষায় হিন্দিয়ায়ণ আমাদের ছোটবেলায় খুব একটা গ্রহণযোগ্য বা আকর্ষণীয় ছিল না, বরং তা বাংলা বলতে বা লিখতে না পারার সীমাবদ্ধতা হিসেবেই দেখা হত।

ইন্দ্রজাল কমিক্স কিনতাম আড়িয়াদহ শখের বাজারের রমানাথকাকুর দোকান থেকে। প্রসন্ন ইলেক্ট্রিকের উল্টোদিকে দুর্গামাঠের গায়ে ছকুদাদুর সেলাইয়ের দোকান (সেলাইয়ের দোকানই বলতাম বরাবর, টেলার্স নয়), যেখানে বসে আড্ডা দিত বাবা, পরিমল ডাক্তারবাবু, বীরুদাদু (বাবার মামা সে সূত্রে আমার দাদু, কিন্তু আসলে বাবারই বয়সী) ইত্যাদির সঙ্গে, তার গায়েই রমানাথকাকুর দোকান। ভাঁজকরা কাঠের পাল্লা-দরজা খুলে মেলে, তার গায়ে দড়ি টাঙিয়ে সেখানে ক্লিপ দিয়ে মেলা থাকত ইন্দ্রজাল কমিক্স, বিভিন্ন ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজ। দোকানের ভিতরে থাকত মনিহারি জিনিসের সম্ভার, পুজো-কালীপুজোয় ক্যাপবন্দুক বাজি মাথার ফিতে আর যা যা সব। রমানাথকাকু সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ দিতেন সকালে, তারপর এসে এই দোকান খুলতেন। ম্যাগাজিন আর কমিক্স আমি রমানাথকাকুর দোকানে গিয়েই কিনতাম— বাবা পয়সা দিয়ে দিত পরে, খাতা ছিল রমানাথকাকুর দোকানে।

সোমবার সোমবার বেরোত ইন্দ্রজাল কমিক্স। অনেক সময় কমিক্সের শেষ পাতায় লেখা থাকত পরের সপ্তাহে কী বেরোবে, অনেকসময় থাকত না। ফলে সোমবার সন্ধ্যায় রমানাথকাকুর পাল্লা-দরজায় কী ঝোলানো থাকবে সেটা ছিল জব্বর সাসপেন্সের বিষয়! মাসের প্রথম সোমবারের সন্ধ্যাটায়, রমানাথকাকুর দোকানের পাল্লা-দরজা, ওঃ যেন স্বর্গ! কমিক্স, আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর ভারতী, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, খেলা, খেলার আসর, স্পোর্টসস্টার, স্পোর্টসওয়ার্ল্ড (শেষের দুটো ইংরেজিতে বলে পড়তাম না সেভাবে, ও দুটো  কিনতাম ফাস্ট বোলার আর টেনিস প্লেয়ারদের ফটো কেটে খাতায় সাঁটব বলে, প্রধানত ফাস্ট বোলারদের ছবির জন্য)— উফফ কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব ঠিক করতে পারছি না— এদিকে টালির বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না ভালো করে, বাবার পকেটে ফুটো। মাঝে মাঝে মনে হত এক হ্যাঁচকায় সবকটা বই পাল্লা-দরজা থেকে উঠিয়ে নিয়ে ‘শালা লুঠ লিয়া’ বলে প্রবলবেগে দৌড় দিই!

ইন্দ্রজাল কমিক্সের সব চরিত্রই গোগ্রাসে গিলতাম, তবে অরণ্যদেব ছিলেন আমার অলটাইম ফেভারিট। কিছু পেরিফেরাল রিজনসও ছিল— ডায়না পামার-ওয়াকার তার মধ্যে একজন। যাবতীয় কমিক্সের সমস্ত টু পিস সুন্দরীদের (ম্যানড্রেকের বান্ধবী নার্দা, লুথারের বান্ধবী কার্মা, ম্যানড্রেকের বোন স্বর্ণকেশী লেনোর, রিপ কার্বির বান্ধবী মোমো আমুর, ফ্ল্যাশ গর্ডনের বান্ধবী ডেল আর্ডেন… আরও যারা যারা) মধ্যে বিকিনি পরা ডায়নাই আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়া এবং যৌন আবেদনময়ী ছিলেন (এবং এখনও আছেন, কমিক্সের চরিত্রের বয়েস বাড়ে না, তারা জাগন্ত হাইবারনেশনে থাকে কি?)। আর ছিল কানাকানি কুঞ্জের ফিসফিসানির আকর্ষণ। পুবের আঁধারের অভিভাবক— নামটার মধ্যে খানিকটা শভিনিজম এবং হোয়াইট সুপ্রিমেসি থাকা সত্ত্বেও অরণ্যদেবের এই উপাধিটাই আমার বেশি প্রিয় ছিল, চলমান অশরীরীর থেকেও। ঘটনাচক্রে পরে জানতে পারি (কমিক্সের একটি বিশেষ সংখ্যা পড়ে) অরণ্যদেবের শাশুড়ি লিলি পামারের কাছে ডায়নাও বলেছিল অরণ্যদেবের এই নামই (মতান্তরে, উপাধি) নাকি তার সবথেকে প্রিয়।

অরণ্যদেবের কমিক্স নিয়ে বিরূপ সমাজতাত্ত্বিক সমালোচনা আছে। লি ফক এই কমিক্সের পাতায় পাতায় গুঁজে দিয়েছেন হোয়াইট সুপ্রিমেসির উপপ্রমেয়, এই নিয়ে বহু লেখা আছে। নিউ লেফট ইডিওলজির ওপর ভিত্তি করে সুইডেনে নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে অরণ্যদেবের কমিক স্ট্রিপ (উৎসাহীরা রবার্ট আমানের লেখা, স্প্রিঙ্গার ভারল্যাগ থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ফ্যান্টম কমিক্স অ্যান্ড দ্য নিউ লেফট’ শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন)। উল্টোদিকে, অরণ্যদেবের তুমুল জনপ্রিয়তার প্রভাব এমনভাবে পড়েছিল ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে যে  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি অধিকৃত নরওয়েতে নরওয়েজিয়ান রেজিস্ট্যান্স গ্রুপের (যাঁরা নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়তেন বা লড়াই সংগঠিত করতেন) গোপন পাসওয়ার্ডই ছিল ‘ফ্যান্টম’! তবে আমার কাছে সেসব তাত্ত্বিক কচকচি কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি অরণ্যদেবের গল্পের রসাস্বাদনে। সে অর্থে দেখতে গেলে ঠাকুমার ঝুলি থেকে শুরু করে অবন ঠাকুর, রবিবাবু হয়ে সমস্ত শিশুসাহিত্যই বায়াসড— সুপ্রিমেসি, ডিসক্রিমিনেশন, মিসোজিনি, ভায়োলেন্স, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা গিজগিজ করছে পাতায় পাতায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শিশু ও কিশোরী/কিশোর সাহিত্যের। সোশ্যাল মিডিয়ায় পিঠচাপড়ানি পাওয়ার জন্য সেসব ডিসক্রিমিনেটারি ন্যারেটিভ নিয়ে দু-পাঁচ লাইন লিখে ফেলাই যায় হয়তো, কিন্তু সেসবকে আমি রসাস্বাদনের রাস্তা আটকে দাঁড়াতে দিতে রাজি নই। সম্পূর্ণ পলিটিক্যালি কারেক্ট এন্টারটেনমেন্ট লিটারেচার বলে কিছু হয় না, হতে পারে না।

অরণ্যদেব তাই আমার কাছে হিরো। ফাদার ফিগার। এবং এখানেও মানবীবিদ্যার সূত্রে হিরোইজম জিনিসটাই প্যাট্রিয়ার্কি স্পন্সর্ড— সেইসব সমালোচনার প্রসঙ্গ উঠে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু সমস্ত বিরূপ প্রতিযুক্তিকে এক ঝটকায় অবজ্ঞা করে অরণ্যদেবই আমার হিরো। কারণ আমি কাওয়ার্ড, আমি আমজনতা। আর আমজনতার একজন হিরো লাগে। সমস্ত ক্ষোভ দুঃখ বঞ্চনা না পাওয়ার নিষ্ফল হতাশা মেটাতে যে রাগ মেঘগর্জনের মতো গুর গুর করে ডেকে ওঠে মাথার ভেতর, সেই রাগই হিরোর জন্ম দেয় ফ্যান্টাসিতে। যেমন অরণ্যদেব, যেমন অ্যাংরি ইয়াংম্যান অমিতাভ্ বচ্চন। ছয়ের দশকের শেষে এবং সাতের দশকের শুরুর টালমাটাল আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির আবহে অমিতাভের উঠে আসার কথা ভেবে দেখুন। মনে করে দেখুন, বিশ্লেষণ করুন তাঁর উঠে আসার সময়টা। আগে সিনেমায় রাগ বলতে লোকে বুঝত গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার চোখ গোল গোল করে— অমিতাভ্ এসে পাল্টে দিলেন সিনারিওটা— ওরকম ঠান্ডা রাগ, কিন্তু ফ্যাটাল, লোকে আগে দেখেনি, আগে কখনও দেখেনি নিজেকে একই ঘরে ভিলেনদের সঙ্গে তালা বন্ধ করে ফেলে জানলা গলিয়ে চাবি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে পাই পয়সার হিসেবে মিটিয়ে নেওয়ার হিরোইক বাহাদুরি।

অরণ্যদেবও সেরকম। চেঁচান না, অকারণে ক্রোধ নেই, নিজের ওপরে অসীম নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু রাগলে ভয়ঙ্কর, অপরাধীদের প্রতি নির্মম। ক্রুদ্ধ অরণ্যদেবের ঠান্ডা গলা বাঘের রক্তও জল করে দেয়— অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ নাকি এমনই। সেই অরণ্যদেব, কাজে কাজেই, আমার হিরো।

ঠিক যেমন ছিল আমার বাবা, সমস্ত না পাওয়া, বিপদ, অপ্রাপ্তি, আশঙ্কাকে দূরে রেখে দিত আমাদের থেকে। বিপদে পড়লে, যে বিপদ আমার নিজের ক্ষমতায় কাটিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই, সেরকম বিপদে, আমি তাই অরণ্যদেবকে ফ্যান্টাসাইজ করতাম বাবার মধ্যে। অরণ্যদেব আর বাবা যেন কবে একাকার হয়ে গেছিল আমার মধ্যে, পুবের আঁধারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন আমারই অভিভাবক।

হয়তো আমাদের প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই।

তারপর, শের্ভনোহ্রাদের (Chervonohrad) লেনিনের মূর্তির মতো যেদিন ভেঙে পড়ল বাবার ভিতরের অরণ্যদেব, বাড়ি বয়ে আসা পাওনাদারের গালি খেয়ে— আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মূক ও বিমূঢ় আমি উপলব্ধি করলাম বাবা কখনও অরণ্যদেব হতে পারে না, মানুষ কোনওদিন হিরো হয় না। তখন আমি রাতের বেলায় ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিছানায় বসে অরণ্যদেবকে ডাকতাম বাবার নিরাপত্তার জন্য।

বাঙালিবাড়ির কারখানার লেদ মেশিনে বানিয়ে দেওয়া আংটিদুটো হাতে পরে স্তব্ধবাক আমি কার দিকে ঘুঁষি পাকিয়ে ছিটকে ওঠার চেষ্টা করতাম সেইসব দিনে?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...