পারাপার

পারাপার | অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

গল্প লেখা সহজ নয়। অথচ গল্প ছড়িয়ে রয়েছে আলিবাবার রত্নভাণ্ডারের মতোই। কেবল চিনে নেওয়ার অপেক্ষা। একেকটা দুর্ধর্ষ দুপুর, মায়াবী সন্ধেরাত, অথবা গোধূলির বিকেল— প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা অবকাশেই গল্পেরা জন্ম নিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। অথবা আড়াল পড়ে যাচ্ছে তাদের। শীত-বিকেলের নেমে আসা কুয়াশার মতোই। গল্পের মধ্যেই কবিতারা বেঁচে আছে, আর কবিতারাও— বেঁচে আছে গল্পের অভ্যন্তরে। অপলক। নির্নিমেষ।

মাঝ-সকালে বাজার যখন ভাঙতে বসেছে, আন্দাজ সাড়ে এগারোটা বারোটার সময় বাজারগুলোর উপরে কেমন যেন একটা বিধ্বস্ত ভাব নেমে আসে। হাওয়াতে ধুলোর পরত জমে ওঠে। ছেঁড়া, ফাটা, ভাঙা, পচা সবজির অবশেষ। পায়ের নীচে মুচমুচ করে ওঠা ফুলকপি পাতার অংশ, ছেঁড়া কালো প্লাস্টিকের জঞ্জাল। সবকিছুই বুঝিয়ে দিতে থাকে, এ সময় শেষের সময়। পালা গুটোনোর সময়। ঠিক এই সময়েই আন্দোলন জমে উঠেছিল।

ছাত্র সংগঠনের আন্দোলন। ইস্যুটা বোধ করি জোরালো। সঠিক মনে পড়ছে না। তবে এমন একটা সময়ে, এমন একটা ইস্যুকে নিয়ে যে আওয়াজ তোলাটা জরুরি সে কথা অস্বীকার করা চলে না। ছেলেগুলো ভারী এক আবেগের সঙ্গে স্লোগান তুলছিল। নেতাগোছের ছেলেটি সদ্য পাতা একখানি টেবিলের ওইপাশে দাঁড়িয়ে মাইকের আয়োজনটাকে বুঝে নিচ্ছিল। হাওয়াতে ধুলোর পরত। পথচলতি মানুষজনেরা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল এদের আয়োজনটাকে। বাজারের এই অংশটিতে এমন ধরনের রাজনৈতিক সমাবেশ অতিমারির আগে অবধিও প্রায় দৈনন্দিন ঘটনা ছিল। মাঝের দু বছরে সেই অভ্যাসে ভাঁটা পড়লেও ইদানীং আবারও সেই অভ্যাস ফিরে আসতে শুরু করেছে। মিষ্টির দোকানের কারিগরেরা যারপরনাই বিরক্ত দৃষ্টিতে এদের মতলবটাকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এখন আর কারও চিৎকারই সহ্য হয় না। গত দু বছরে গড়পড়তা মানুষের সহ্যক্ষমতা নিয়ে প্রকৃতি এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা যথেষ্ট রকমেই হেলাফেলার পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন। ধুঁকতে ধুঁকতে অস্তিত্ব বজায় রাখা ভিন্ন যাদের আর কোনও উপায় নেই তাদের পক্ষে সংগ্রাম, লড়াই, অধিকার এই সমস্ত শব্দ বা শব্দবন্ধগুলি ক্রমশই অপ্রাসঙ্গিক থেকে অপ্রাসঙ্গিকতর হয়ে পড়েছে। এখন কেবল ডারউইন তত্ত্বের সত্যতা। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্টের বুলি কপচানো কেবল।

সমীরেশ বাজারে যাচ্ছিল। সল্টলেক আইটি সেক্টরে সমীরেশ মোটা মাইনের চাকুরে। যাদবপুর থেকে কম্পিউটার সায়ান্স নিয়ে এঞ্জিনিয়রিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন। ক্যাম্পাসিং। তারপর থেকেই নিজেকে ক্রমশ আরও আরও প্রস্তুত করে নেওয়া। একেকটা কোম্পানি পালটাতে পালটাতে আজ সমীরেশ যে জায়গাতে এসে পৌঁছিয়েছে, ওর বয়সে বড় একটা কেউ এমন সাফল্যের নজির দেখাতে পারবে না। আন্দোলন চলছে দেখে সমীরেশ থমকে দাঁড়ায়। আইটি সেক্টরের চাকুরে হলেও সমীরেশের পড়াশোনায় মিশে রয়েছে যাদবপুর। কাজেই স্লোগান, আন্দোলন, মিছিল, এগুলোর বিষয়ে সে এখনও ঠিক আর পাঁচজন মানুষের মতো গড়পড়তা নাক সিঁটকোনো হাবভাব দেখাতে পারে না। তবুও সে দাঁড়াল না বেশিক্ষণ। এগিয়ে গিয়ে পাশের বই-খাতা-কলম-পেন্সিলের দোকানে ঢুকল।

জোসেফ স্তিগলিৎজের নতুন বইটাকে হাতে করে নিয়ে উলটিয়ে পালটিয়ে দেখছিল সমীরেশ। তখনই প্রশ্নটা ধেয়ে এল হঠাৎ। ইউনিভার্সিটি আর খুলবে না স্যার? অনেকদিন তো হয়ে গেল। আমাদের…। লোকটা এই দোকানেই কাজ করে। আগের থেকে আরও অনেকখানি রোগা হয়ে গিয়েছে— আমাদের ব্যবসাটা যে মার খাচ্ছে খুব। সমীরেশ বোদ্ধাসূচক একটা মাথা নাড়ে কেবল। মাস্কের আড়াল থেকে এই প্রশ্নের জবাবে সে কী বলবে প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারে না। একটু ভেবে নিয়ে বলল— খুলবে তো নিশ্চয়ই, আরও কয়েকটা দিন যাক। দেশব্যাপী ভ্যাকসিনেশনের সংখ্যাটা আরেকটু বাড়ুক। লোকটা মাথা নাড়ল। বুঝতে পেরেছে মনে হয়। সমীরেশ আবারও জোসেফ স্তিগলিৎজে ফিরে যায়। নতুন এই বইটাকে বেশ জোরদার বলে মনে হচ্ছে তার।

–একটা কথা বলব স্যার আপনাকে? কিছু যদি মনে না করেন, লোকটা আবারও জিজ্ঞেস করে।
–হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বলুন, সমীরেশ লোকটার দিকে তাকায়। ছোটবেলা থেকে মায়ের হাত ধরে তার এই দোকানে যাতায়াত। এই লোকটাকেও সে চোখের সামনে বুড়ো হতে দেখেছে। কিন্তু এতখানিও বুড়িয়ে যেতে দেখেনি। সে লোকটার চোখে চোখ রাখে— বলুন।
–আমার ছেলেটার জন্য একটা কাজ হবে স্যার? যেকোনও ধরনের কাজ। বিকম পাস গ্র্যাজুয়েট। ট্যালিতে ভর্তি হয়েছিল। খরচ টানতে পারিনি। কিন্তু কম্পিউটারেরও কাজ পারে মোটামুটি। কোনও একটা কাজ কি হয় না? লোকটা একনাগাড়ে অনেক কিছু বলে ফেলল। লোকটা হাঁপাচ্ছে এখন।

বাইরে থেকে সমীরেশ স্লোগানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। লোকটার তাতে কোনও ভাবান্তর হল না। এই সমস্ত স্লোগানেরা এদের কাছে আজ মূল্যহীন, অর্থহীন শব্দসমষ্টি কেবল। লোকটা যেন প্রসারিত হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে এসে কোনওভাবে তার সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। সমীরেশের এখন আর কিচ্ছুটি করার নেই। কিচ্ছুটি বলার নেই।

বাইরে এসে সমীরেশ দেখল আন্দোলনরত ছাত্রেরা শালু বিছিয়ে ফান্ড কালেকশন শুরু করেছে। যে ইস্যুতে তাদের আন্দোলন সেই নিয়ে আগামী সপ্তাহে রাজ্যব্যাপী বিক্ষোভ, এবং তারই সঙ্গে পথ অবরোধেরও কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেই উপলক্ষেই ফান্ড কালেকশন। পাশ থেকে কেউ একজন মন্তব্য করলেন— আন্দোলন না ছাই, উদরপূর্তির ব্যবস্থা কেবল। সমীরেশ একটা দোটানায় পড়ে গেল। ইস্যুটাকে সে সমর্থন করে। কিন্তু তাই বলে ভিতরে ভিতরে সে ঠিক এই ছাত্র সংগঠনটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নয়। তার সমর্থন সবসময়ই অন্য একটি সংগঠনের অভিমুখে। মূলগতভাবে দেখলে বর্তমান সংগঠনটির আদর্শ বা কর্মপদ্ধতির সঙ্গে সমীরেশের প্রিয় সংগঠনটির আদর্শ বা কর্মপদ্ধতির যে বিরাট একটা কিছু ফারাক রয়েছে, তাও নয়। কিন্তু সমীরেশের রাজনৈতিক বোধ তাকে নাড়া দিতে লাগল। আবার পরক্ষণেই সে ভাবল, দরকারের সময়ে জোটবদ্ধ সংগ্রামে অংশ নেওয়াটাও কি একটা রাজনৈতিক বোধের পরিচায়ক নয়? শত্রু যখন পরাক্রমশালী, তখন বিবিধ ভাগে ভেঙে গিয়ে শত্রুর শক্তি প্রদর্শনের সুবিধা করে দেওয়াটাও কি কাজের কথা হতে পারে কখনও? এইসময়েই সমীরেশের মনে পড়ল, যতই হোক সে চাকুরিজীবী। বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত ক্লাস। মাস গেলে মাইনে পাওয়ার জন্য তাকে অনেক সময়ই মুখ বুজে থাকতে হয়। লেবার কোড নিয়ে ইচ্ছে থাকলেও সে চেঁচামেচি করতে পারে না। সে মনকে প্রবোধ দেয়। টাকাটা সমীরেশ দেবে কি দেবে না, এইসব ভাবতে ভাবতেই সে রাস্তা পার হয়ে ওষুধের দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়।

এক বুড়ির সঙ্গে ওষুধের দোকানের লোকটার তীক্ষ্ণ স্বরে ‘আলাপ’ চলছে তখন। সমীরেশ কান পেতে শোনে।

–একপাতা ওষুধের দাম আটচল্লিশ টাকা। আমাকে ডাক্তার চারখানা খেতে কইসে। পাতায় আছে দশটা। বাকি ছয়খান ওষুধের দাম আমি দেব কেনে? ও তো নষ্টই হবে গো। তার চেয়ে তোমরা কেউ কেটে রাখো না ওগুলান, আর কেউ চাইলে তারে দিয়ে দেবে এখন!
–এভাবে হয় না মাসি, পাতা কেটে এই ওষুধ বিক্রি করা বারণ আছে, লোকটা জবাব দেয়।
–তাই বলে আটচল্লিশ টাকার ওষুধে ছয়খান ওষুধ ফেলে দেওয়ারে লাগব? বুড়িটা প্রায় চিৎকার করে ওঠে এবার।

কিছুদিন আগে ধোপদুরস্ত কাপড়-পরা, ভদ্র, শিক্ষার পালিশ রয়েছে প্রথম দর্শনে এমনটাই মনে হওয়া— একজন মহিলাকেও কোনও একটি ওষুধের জন্য এভাবেই এই দোকানে তর্ক করতে দেখেছিল সমীরেশ। মানুষের ভিতরকার সমস্যাগুলো ক্রমশ যেন আস্তে আস্তে এক হয়ে আসছে। সমীরেশের এমনটাই মনে হচ্ছিল। নাকি এসব চিন্তাভাবনাকেই ইউটোপিয়ান বলা হয়ে থাকে? বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের মধ্যে কি কোনও সময়েই মিলমিশ সম্ভব? শ্রেণির মধ্যেকার আদানপ্রদান কতখানি মতবাদ-স্বীকৃত? সমীরেশ আবারও বুড়িটার দিকে তাকায়।

দরদাম করে, শেষ অবধি দুটো দশ টাকার নোটকে সে ফেরত হিসেবে আদায় করতে পেরেছে। দোকানের লোকটাকেও ওষুধের পাতাটাকে কেটে দিতে শেষ অবধি রাজি করানো গেছে। সমীরেশ দেখল সে গটগট করে বেরিয়ে সটান আন্দোলনকারী ছাত্রদের দিকে এগোল। পোশাকআশাক দেখে যতটুকু বোঝা যায়, বুড়ি নিশ্চিতভাবেই লোকের বাড়িতে কাজ করে। হয়তো বা বাসনপত্র ধুয়ে দেয়। হয়তো বা ঘর মোছে, কাপড় কাচে, রোগীর দেখভাল করে। বুড়ির হাঁটাচলার ভিতরে একটা ছটফটে ভাব লক্ষ করছিল সমীরেশ। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে বোধহয়। এই সময়েই এইধরনের মানুষেরা হাঁটাচলার ধরন বদলে নেয়। বাড়ি ফেরার তাড়াটা যেন বা হঠাৎ করেই তখন তাদের শরীরের মধ্যে, তাদের হাঁটাচলার মধ্যে, তাদের জীবনের মধ্যে প্রতিভাত হয়ে দেখা দেয়। তারা তখন বাড়ি ফিরতে চেষ্টা করে। সমীরেশ দু চোখ ভরে বুড়িটাকে অনুসরণ করতে চেষ্টা করছিল। আদায় করা দুটো দশটাকার নোটের ভিতরে একটাকে সে বেশটি করে মুড়িয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের শালুটার ভিতরে ছুড়ে দিল। ছাত্রদের স্লোগানটা যেনবা হঠাৎ করেই আরও বেশ একটু জোরদার হয়ে উঠেছে। সমীরেশ তার হাতের মনিব্যাগটাকে আবারও পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। সে আর মোটেই এসবে উৎসাহ পাচ্ছে না।

সমীরেশ আবারও রাস্তা পেরোল। বুড়িটা তার কাজ শেষ করে চলে গেছে। ছাত্রদের স্লোগানটা আবারও ফিকে হয়ে এসেছে। সমীরেশ কোনওভাবেই এদের আন্দোলনকে সমর্থন করবে না। জোসেফ স্তিগলিৎজের নতুন বইটাকেই সে বরঞ্চ কিনে ফিরবে আজ। ওতেই তার শান্তি। ওতেই তার আন্দোলন। এ্যাকাডেমিক!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...