লোধি কলোনির গ্রাফিটি দেওয়াল— এক নাগরিক রূপকথা

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

শীতের শুরুর ভিসুয়াল হেজ। স্টাবল বার্নিং। দূষণ। রাজনীতির কচকচি। হাইরাইজার। ভাষাবিদ্বেষের সাম্প্রতিকতা। বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা। মোটামুটি রাজধানী শহরের এমনই কিছু সংজ্ঞার বাইরে অন্য এক দৃশ্যকল্প নির্মাণ। দেশ এবং দেশের গণ্ডির বাইরের বেশ কিছু চিত্রশিল্পীর কাজ। স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ। সরকারি সাহায্য। স্থানীয় মানুষের হাত বাড়ানো। পর্যটন। এবং সর্বোপরি নান্দনিকতা। এইসবের সহাবস্থান দিল্লির লোধি কলোনির বিখ্যাত গ্রাফিটি শহর। দক্ষিণ দিল্লির বিখ্যাত লোধি গার্ডেন ঘুরে জোরবাগ মেট্রো স্টেশনের অদূরে খান মার্কেট এবং মেহেরচাঁদ মার্কেটের মাঝে এমনই এক গ্রাফিটি কলোনিতে চলে এসেছিলাম শীতের এক সকালে। এবং একটা জার্নিতে, একটা সকালে এই দেখা ফুরোবার নয়।

২০১৫। এনজিও এসটি প্লাস আর্ট ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে লোধি কলোনির দুটি দেওয়ালে প্রথম গ্রাফিটি নির্মাণ। এবং সেখান থেকে একেবারে ২০১৯। বাইশটি দেওয়ালচিত্র। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা কিছু গ্রাফিটি আর্টিস্ট। কারা কারা এলেন? সিঙ্গাপুর থেকে ব্র্যান্ডন টে, ইপ ইয়ু চং, স্যাম লো, অস্ট্রেলিয়ার জর্জিয়া হিল, রেকো রেনি, নিউজিল্যান্ডের অ্যারন গ্ল্যাসন, সুইজারল্যান্ডের ক্রিশ্চিয়ান রেবেচ্চি, পাবলো টোগনি, ইংল্যান্ডের করিন কেনিংটন, হ্যারি ফেইবার, জাপানের ইয়ো নাগাও কিংবা নেদারল্যান্ডের ড্যান বোটলেকের মতো শিল্পীর পাশাপাশি এদেশ থেকে সমীর কুলাভুর, হানিফ কুরেশি, সাজিদ ওয়াজিদ, সিলো শিব সুলেমান, রাকেশ কুমার প্রমুখ। এসটি প্লাস আর্ট ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের পাশে নান্দনিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আর্থিকভাবে সহায়তায় এল এশিয়ান পেইন্টস। দিল্লির পর্যটন ঐশ্বর্যে নতুন পালক তৈরি হল— লোধি কলোনির গ্রাফিটি দেওয়াল।

এ এক অদ্ভুত মিউজিয়াম, যে মিউজিয়ামে কোনও টিকিট নেই। প্রেমিক-প্রেমিকা ছবি তুলছেন। একদল ছেলে স্ট্রিট ক্রিকেট খেলার ফাঁকে উঁকি মারছে গ্রাফিটি দেওয়ালে। আর্ট কনোইসিওর এবং শিল্প ঐতিহাসিকেরা সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন লোধি কলোনির নাম। সাধারণ পর্যটকেরাও ঐতিহাসিক দিল্লি ভ্রমণের মাঝে একটা সকাল বেছে নিচ্ছেন লোধি কলোনির জন্য। স্থানীয় মানুষ বাজার করার ফাঁকে মন ভরে তাকিয়ে আছেন তাঁদের নিজেদের ঘরবাড়ির দিকে।

কী কী নেই? বিষয়বৈচিত্রে তাক লাগিয়ে দেয় গ্রাফিটি দেওয়াল। নান্দনিক বোধের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজ-সচেতনতা, বা পরিবেশ আন্দোলনকে। শিল্পী স্যাম লো-র আঁকায় অ্যানথ্রোপোজেনিক হিংস্রতায় ছটপট করা খাঁচার পাখি আশ্চর্য এক বিমূর্ততায় মুক্ত হয়ে গেছে গ্রাফিটি দেওয়ালে। আধুনিক এবং নির্বোধ সেলফিসর্বস্ব প্রজন্মের ঘাড় বেঁকে যাওয়া এক প্রতিমূর্তি এঁকে রেখেছেন শিল্পী সমীর কুলাভুর। শিল্পী ইপ ইউ চং দিল্লির স্থানীয় মানুষ, স্ট্রিট লাইফ, সবজি বাজার, ইটের সেলুন— তৈরি করেছেন দেওয়ালে দেওয়ালে। অথবা বিশ্ব-উষ্ণায়ন বা যমুনার দূষণের মতো টাটকা বিষয়। কোথাও আবার সুইস শিল্পীদের ভাবনায় গোটা দেওয়ালজুড়ে আঁকা রংবেরঙের প্রিজমের উপর বসে থাকা এক মহাকাশচারী। গোন্দ উপজাতির শিল্পী রাকেশ কুমারের মিউরালে গাছ, পাখি আর পাতা দিয়ে তৈরি এক নিবিড় নাগরিক অরণ্য।

অবশ্য কিছু অন্য কথাও থেকে যায়। অত্যধিক পর্যটনে কোথাও সাধারণ জীবনযাপনে আপস চলে আসে। খান মার্কেট সংলগ্ন লোধি কলোনির এই অঞ্চল গ্রাফিটি দেওয়ালটুকু বাদ দিলে প্রায় খুব সাধারণ একটি কলোনি টাউন। ফলে এই স্ট্যাটাস কো-র মাঝে অত্যধিক নান্দনিকতা কোথাও কোথাও সন্দেহের চোনা ফেলে দিয়েছে বেশ কিছু অধিবাসীর মনে। ভোর থেকে পর্যটক আসার রেওয়াজ। সেলফি-সর্বস্বতা এবং তার ফলে স্থানীয় জীবনযাপনে, যাতায়াতে অসুবিধে— এসব চলে আসে আনুষঙ্গিকভাবেই।

অবশ্য সামগ্রিকভাবে লোধি কলোনির দেশের প্রথম পাবলিক আর্ট ডিসট্রিক্টের মর্যাদা পেয়ে তৃপ্ত। কলোনির আর্ট ফেস্টিভালের কিউরেটর এবং এসটি প্লাস আর্ট ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গিউলিয়া অ্যামব্রোগির কথায়, ‘There’s no ticket that has to be paid, there is no education or upbringing required to just stop by and admire the pieces. Because of the appropriation of public spaces which, in one way or the other, are not connected to ourselves, they are for everybody to experience, for everybody to live in: like a very political sort of stand.”

লোধি কলোনির এইসমস্ত সাধারণ রংচটা দেওয়াল এভাবেই পথচলতি সবার সঙ্গেই জড়িত হয়ে যাক, অ্যামব্রোগির ভাষায় যা ‘Connected to ourselves’। ছবি ফুটুক, রং আসুক নাগরিকতায়…


*সবকটি ছবি লেখকের তোলা

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. মুষল পর্ব— ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম যাত্রা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...