মুষল পর্ব— ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েবপত্রের প্রকাশ কিয়ৎকাল ব্যাহত হইয়াছিল। আমরা পাঠকদিগের নিকট মাসদুয়েকের বিরতি চাহিয়া লইয়াছিলাম। সাময়িক বিরতি, তথাচ চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর অদর্শন-সংবাদে আপনারা সবিশেষ বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন, আপনাদের সেই উদ্বেগ আমাদিগকে পোর্টাল মেরামতির কাজ যথাসম্ভব শীঘ্র সমাপন করিতে উদ্যোগী করিয়াছিল। অবশেষে, আপনাদিগের শুভেচ্ছা ও সহমর্মিতায়, সকল সমস্যা সমাধানান্তে, কিঞ্চিদধিক নূতন চেহারায় পুনরায় ওয়েবপত্রটি প্রকাশিত হইতে পারিল। আমাদের এই নূতন রূপপরিগ্রহকে আপনারা নিজ-নিজ রুচি ও বিশ্বাস অনুসারে ‘জগন্নাথদেবের নবকলেবর’, ‘গুটিপোকার প্রজাপতিজন্ম’, ‘গডজিলা রিটার্নস’ কিংবা ‘উন্নততর বামফ্রন্টের প্রত্যাবর্তন’ ইত্যাদি যে কোনও নামে অভিহিত করিতে পারেন… তবে, মোদ্দা কথাটি হইল এই যে, কাগজটির স্বকীয়তা বজায় রাখিয়াই সময়ের প্রয়োজনে তাহার বহিরঙ্গের চেহারা খানিক পালটানোর প্রয়াস করা গিয়াছে— তাহার ফলাফল কী দাঁড়াইয়াছে, তাহা আপনারাই বিচার করিবেন।

আমাদিগের তরফে আনন্দ দ্বিগুণ, তাহার কারণ, পত্রিকাটির পুনঃপ্রকাশ সম্ভব হইল মে মাসে, যাহা ঘটনাচক্রে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জন্মমাসও বটে। পাঠকদিগের স্মরণে থাকিবে, ২০১৭ সালের মে মাসে পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। সেই হিসাবে, এই বৎসর পত্রিকাটি পাঁচ বৎসর সম্পূর্ণ করিয়া ছয়ে পদার্পণ করিল। বয়সটি নানা কারণে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ— ছয় বৎসরে পা দিয়া এ-দেশের শিশুরা স্কুলে প্রবেশ করিবার ছাড়পত্র পায়। ধরিয়া লওয়া হয়, বিদ্যালয়ে প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে দুধে-দাঁত পড়িয়া বয়ঃপ্রাপ্তির পথে সে একধাপ অগ্রসর হইল। সেই প্রথামাফিক, এই বৎসরটি আমাদিগের বয়ঃপ্রাপ্তির ক্ষণ বটে। কালের বিচিত্র গতি মানিয়া আমরা অনতি-ভবিষ্যতে লায়েক হইয়া উঠিব কি না তাহা সময় বলিবে— তবে জ্যাঠা ছেলে লুকাইয়া বিড়ি টানিতে শিখিলে কান ধরিয়া টান দিবার দায়িত্ব আপনারা নিবেন, সে ভরসা আমাদিগের রহিয়াছে।

পত্রিকার নবত্বপ্রাপ্তির আনন্দটি বিষয়সূচিতেও প্রতিফলিত হইতে দেখিলে আমাদিগের আনন্দ হইত, কিন্তু এই সংখ্যার প্রচ্ছদ-বিষয় হিসেবে আমরা, আনন্দ নয়, অন্ধকারকেই বাছিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছি। বিষয়-ভাবনার নামের মধ্যে মহাভারতের এক অতীব অন্ধকারময় কাহিনিখণ্ডের স্মৃতি রহিয়াছে। মুষলপর্ব মহাভারতের সেই সময়কে সূচিত করে, যখন ক্লেদ ও কলুষের ভাণ্ড পূর্ণ হইয়া উপচীয়মান; অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ভ্রাতৃহত্যার পাপে মানব স্বীয় গরিমাকে বিসর্জন দিয়াছে; ব্যক্তিস্বার্থ যেখানে গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে— “সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে”।  পশ্চিমবঙ্গ নামক ভারতের পূর্বপ্রান্তের ক্ষুদ্র রাজ্যটির দিকে তাকাইলেই সে দুর্দৈব সাদা চক্ষে প্রতীয়মান হয়— তাহার জন্য সমাজবিদ হইবার প্রয়োজন হয় না। বস্তুত, সমাজটিকে সানুপুঙ্খ দেখিবারও দরকার হয় না— দলীয় রাজনীতির একটি-দুটি চাল টিপিলেই হাঁড়ির পুরা হাল সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া সম্ভবপর হয়। শাসক বা প্রধান বিরোধী দলের তকমাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলদুইটির বড়-মাঝারি-ছোট নেতৃবৃন্দের আচার-আচরণ দেখিলে মনে হয়, যদুবংশের ধ্বংস সমাসন্ন, এবং সে পরিণাম ত্বরান্বিত করিতে উভয় শিবিরের প্রত্যেকে যেন উঠিয়াপড়িয়া লাগিয়াছেন। গঠনশীল রাজনীতির অনুশীলনের পরিবর্তে দলের অন্দরে পারস্পরিক কোন্দলই আজ যুগচিহ্ন। জগাই মাধাইকে শাসাইতেছে, মাধাই জগাইকে; গুপী বলিতেছে বাঘার দোষ, বাঘা বলিতেছে গুপীর— এরূপ পরিস্থিতিতে আর যাহাই হউক, সমাজের স্থায়ী উন্নয়ন যে সম্ভব নহে তাহা শিশুতেও বুঝে। এমত পরিস্থিতিতে কাণ্ডজ্ঞান আমাদিগকে পরামর্শ দিয়াছে— ব্যাধি যতই দুরারোগ্য হউক, লুকাইয়া রাখিলে তাহার নিরসন হয় না; বরঞ্চ লুক্কায়িত গরলকে প্রকাশ্যে আনিতে পারিলেই রুগির ‘কাথারসিস’ ঘটে— অসুস্থতার অবসান হয়।

সেই কাণ্ডজ্ঞান হেতুই আমাদিগের এই সংখ্যার বিষয়ভাবনার কেন্দ্রে ‘মুষল পর্ব’। অতীব প্রাসঙ্গিক এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিবন্ধের মধ্য দিয়া আমরা এই অসুস্থতার লক্ষণ, কার্যকারণ ও নিরাময় বিষয়ে আলোকপাত করিতে চাহিয়াছি। নিবন্ধগুলি রচনা করিয়াছেন অশোক মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস মৈত্র, শঙ্কর রায়প্রসেনজিৎ বসু

সম্প্রতি প্রয়াত হইয়াছেন বিশ্রুত সন্তুরবাদক শ্রী শিবকুমার শর্মা। এই সংখ্যায় আমরা তাঁহাকে শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিলাম। এতদ্ব্যতীত, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, অণুগল্প, অনুবাদ সাহিত্য, ফটোফিচার বিভাগ যথাপূর্বং রহিল। রহিল স্টিম ইঞ্জিন, বিশেষ নিবন্ধ, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর-ও।

পরিশেষে জানাই, সাময়িক বিরতির পর পত্রিকাটিকে নূতন চেহারায় আপনাদিগের হস্তে তুলিয়া দিতে পারিয়া আমাদিগের আনন্দের সীমা নাই। কিন্তু, সে আনন্দের ভাগিদার হইতে গিয়া কাগজটির দুর্বলতাসমূহ আপনাদিগের চক্ষের আড়ালে চলিয়া যাউক, তাহা আমাদিগের কাম্য নহে। বরং পূর্বাপেক্ষা অধিক মনযোগের সহিত কাগজটি পড়িবেন, ভুলত্রুটিগুলি যথাপূর্ব ধরাইয়া দিবেন, এই আশা রাখি।

সপ্রণাম, ইতি।

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
অভীক ভট্টাচার্য

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...