ইন্দ্রনীল মজুমদার
গদ্যকার, প্রাবন্ধিক; প্রিয় বিষয় কবিতা, পুরাতত্ত্ব, মার্গ সঙ্গীত
শততন্ত্রী বীণা। ছোট্ট শিবকুমারের বাবা উমাদত্ত শর্মা এই নামেই পরিচয় দিতেন স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত সন্তুর যন্ত্রটির। সুফি গানে, লোকগানে বাজত যন্ত্রটি। উমাদত্ত চাইছিলেন ছেলে শিবকুমার এই যন্ত্রটিকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত করুক। মীড়, আঁশ ওঠে না। হাতের ছোঁয়াও লাগে না। কিন্তু একটা বিশেষ ধ্বনি যা গম্ভীর ও গাঢ়। উমাদত্ত নিজেই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত গায়ক, তবলাবাদক। জম্মু বেতারকেন্দ্রে যুক্ত ছিলেন। বাড়িতে দিনরাত গানের মধ্যেই বেড়ে উঠছিল শিব। পাঁচ বছর বয়সেই বাবা ধরিয়ে দিয়েছিলেন তবলা। তেরো বছরে সন্তুর। চেয়েছিলেন ছেলে হবে সন্তুরের শিবকুমার। তবলায় আশ্চর্য দখল ছিল। জম্মু স্টেশনে যোগ দিয়েছিলেন তবলাবাদক হিসাবেই। পরবর্তীকালে তাঁর সন্তুরবাদনে ছন্দ, গতি, তালের বিন্যাস মনে করিয়ে দিয়েছে তাঁর তবলায় দখল। তবলিয়া জাকির হোসেনের সঙ্গে তাঁর বাজনার মণিকাঞ্চনযোগ স্মরণীয় হয়ে আছে এইজন্যই। যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা আর বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বাবার প্রেরণায় তিনি যন্ত্রটিকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন, পাল্টে নিয়েছিলেন তারের বিন্যাস। যন্ত্রের উপযোগী করেই এল বিশেষ বাজ— আলাপ, জোড়, গৎ সবই এল। প্রাধান্য পেল ছন্দ, লয়ের বিন্যাস। শুধু দুটি স্টিকে আটকে না থেকে আঙুলের ব্যবহারও করলেন সুরের টানা রেশের প্রয়োজনে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পেল নতুন এক যন্ত্র ধ্বনিমাধুর্যে যেটি জগৎ জয় করে ফেলল। নিজের আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন, Journey with a hundred strings. ইতিহাস গড়ে দিল কাশ্মিরের এক অখ্যাত লোকযন্ত্র। তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি ১৯৯৮ সালে অসলোতে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ভারতের রাগসঙ্গীত বাজালেন এক অচেনা যন্ত্রে যার নাম সন্তুর। ছয়ের দশকের শেষে উডস্টকে পণ্ডিত রবিশঙ্করের ভীমপলশ্রী দিয়ে জগৎসভায় যে ভারতের আবির্ভাব ঘটেছিল সে তখন অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে। এক সুদর্শন ঝাঁকরা চুল কাশ্মিরি বাদক বুঝিয়ে দিলেন ভারতের দেওয়ার শেষ নেই।

জন্ম হয়েছিল জানুয়ারি ১৯৩৮। ১৭ বছর বয়সে বোম্বেতে বাবার সঙ্গে প্রথম স্টেজে বসা। লাজুক, সুন্দর ছেলেটি কথা বলে কম। একা বাজনা নিয়ে থাকতেই ভালবাসে। শাস্ত্রীয় গানই তার আশ্রয়। বোম্বের গানকে উচ্চকিত আওয়াজ আর বিটসের প্রকাশ মনে হয়েছিল। পরে বলেওছিলেন সে কথা। শাস্ত্রীয় গান তাঁর কাছে উপলব্ধির ব্যাপার (মেহসুস)। প্রথম অ্যালবাম এল ১৯৬০, বয়স বাইশ বছর। তখনই টান পড়ল অন্যদিকে। বোম্বে জেনে গেল সন্তুরের কথা। ভি শান্তারামের ছবি ঝনক ঝনক পায়েল বাজে-র সঙ্গীত পরিচালক বসন্ত দেশাই গোপীকিষেনের নাচের সঙ্গে বাজাতে ডাকলেন। বললেন সন্তুর তিনি বোঝেন না, শিব যা করবেন তাই। তাতেই পাগল শান্তারাম। উঠে পড়ে লাগলেন শিবকে ধরে রাখতে। ছেলেটি রাজি নয়। বাড়ি ফিরতে হবে, এসব তার ভালো লাগছিল না। বলল এমএ পরীক্ষা দিতে হবে ফিরে, সাবজেক্ট ইকনমিক্স। কাশ্মিরে পড়াশোনার দাম আছে। কিন্তু নিয়তি কে ঠেকাবে। জুড়ে গেলেন বাঁশির হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। অন্নপূর্ণা দেবীর ছাত্র, বোম্বের সঙ্গীতজগতে সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ। অন্নপূর্ণা দেবী খুশি ছিলেন না হরির এই ফিল্মি ব্যাপারে। সন্তুরে মুগ্ধ হরিপ্রসাদ বুঝলেন সন্তুরের অনন্ত সম্ভাবনা। তারপর অন্য ইতিহাস। একের পর এক মাইলফলক হিন্দি চিত্রসঙ্গীতে, প্রবাদ হয়ে দাঁড়াল শিবহরি নামে যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালক। মদনমোহনজির পরে আবার মোড় ঘুরে গেল হিন্দি গানের। বাঁশির অবিশ্বাস্য শ্বাস আর সন্তুরের গাঢ় গুঞ্জন নিয়েই এল চল্লিশটারও বেশি কালজয়ী গান। এরই মধ্যে আবার দিক পাল্টে দিল একটা এলপি রেকর্ড— কল অব দ ভ্যালি। সাল ১৯৬৭, গোটা দেশে বইতে লাগল ঝিলম নদীর কলকল আর সর্ষেক্ষেতের শনশন হাওয়া। শিবকুমারের সন্তুর, হরিপ্রসাদের বাঁশি আর ব্রিজভূষণ কাবরার গিটার। তিন তরুণ ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন শাস্ত্রীয় সুরের শ্বাস। রাস্তায় চলতে চলতে মানুষ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী রাগ, আলাপ না গৎ, কী তাল কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকে স্বর ঢুকে যাচ্ছে। তবলার অসামান্য ব্যবহার, গিটার, বাঁশি আর সন্তুরের ধ্বনির তরঙ্গ খুব সরলভাবেই সঙ্গীতবোধের পুনর্জন্ম ঘটাল। এখনও এটি শুনেই যে কেউ শাস্ত্রীয় গানে ডুব দিতে পারেন। শুরুতেই আহির ভৈরবের বুক টানা শ্বাস, পরে পিলু। অন্য পিঠে ভূপ, দেশ আর পাহাড়ি। পাহাড়িতে শিবকুমার দেখিয়ে দিলেন সন্তুর কী করতে পারে। সত্যিই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল পাহাড়, নদী আর শস্যক্ষেত। অনেক রিমেক হল এটার। ভ্যালি রিকলস, রিভার কল এইসব নামে। কিন্তু আর সেই ম্যাজিক এল না। আমরা আর একজনকেও মনে রাখলাম না। তিনি ব্রিজভূষণ কাবরা। এর মধ্যেই আমরা পেলাম শিবকুমারের কিরোয়ানি, জয়জয়ন্তী। কিন্তু ফিল্ম তো তাঁর কপালেই লেখা। শিব-হরির পরিচালনায় এল পরপর— সিলসিলা (১৯৮১), ফয়সালা (১৯৮৫), চাঁদনি (১৯৮৯), লামহে (১৯৯১), ডর (১৯৯৩)। প্ল্যাটিনাম ডিস্কের ছড়াছড়ি। তবুও তারপর আর বোম্বেতে ফিল্মে কাজ করলেন না। এমনকি ফিল্মে অভিনয়ের ডাকও দিয়েছিলেন খাজা আহমেদ আব্বাস। বলেছিলেন তুমি কি জানো তুমি দেখতে সুন্দর। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেই ছেলে। তাঁর মন কখনও চটুলতায় যায়নি, এমনকি ফিল্মসঙ্গীতের মধ্যেও না।
জনপ্রিয়তা, পরপর পুরস্কার পেয়েছেন অনেক। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, অগুন্তি প্ল্যাটিনাম ডিস্ক। কিন্তু শিবকুমার বোধহয় ব্যাতিক্রমী। কোনও লোভই তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারেনি। শুদ্ধ শাস্ত্রীয় গানই তাঁর বাসা। আজকের দিনে এটা উদাহরণ একটা। পঞ্চাশের শ্রোতা শুনবেন তাঁর কিরওয়ানি, পিলু আর সত্তর বছর বয়সে শুনবেন তাঁর রাগেশ্রী (১৯৯১) আর বিলাসখানি টোড়ি (১৯৯৪)। তার সঙ্গেই জাকির হুসেনের তবলার অনবদ্য সাথ। সন্তুরে আলাপ ও স্বরবিস্তারকে তিনি অন্য স্তরে তুলে দিয়েছিলেন। আর ছন্দ, লয় ও তালের খেলায় তিনি দেখিয়ে দিলেন সন্তুর একটি সর্বমান্য শাস্ত্রীয় বাজ। বুঝিয়ে দিল আমাদের গান ড্রামবিটস থেকে কিছু দূরে। বাবা উমাদত্তের সাধ পূর্ণ হয়েছে। সন্তুরের আর এক নাম শিবকুমার শর্মা। শিব চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর শততন্ত্রের যাত্রা বাঁকে বাঁকে উড়িয়ে দিয়ে গেল সুরের বিজয় পতাকা। তা উড়তেই থাকবে।


গদ্যকার, প্রাবন্ধিক; প্রিয় বিষয় কবিতা, পুরাতত্ত্ব, মার্গ সঙ্গীত