শুভাশিস মৈত্র
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
উত্তরপ্রদেশে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছেন যোগী আদিত্যনাথ। বিজেপির এই জয় বলে দেয় অত বড় কৃষক আন্দোলনের প্রভাব ভোটের ইভিএমে সেভাবে পড়ল না। আরও বড় ঘটনা হল এই যে, লখিমপুর খেরি, হাথরস, উন্নাও— বিজেপির কলঙ্কের এই তিন কেন্দ্রেও আগের থেকে বেশি ভোটে বিজেপি জয় পেয়েছে। তাহলে কী দাঁড়াল? শাসকদলের অন্যায়, অবিচারের কোনও প্রভাব ভোটের বাক্সে পড়বে না? পশ্চিমবঙ্গে বগটুইয়ের গণহত্যা এবং বেশ কয়েকটি ধর্ষণ, গণধর্ষণের ঘটনার পরেও সাম্প্রতিক কয়েকটি আসনে উপনির্বাচনে দেখা গেল বিপুল ভোটে জয়ী হলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা। এই জায়গায় উত্তরপ্রদেশের ভোটারদের সঙ্গে আমাদের রাজ্যের ভোটারদের ভোটদানের আচরণে অদ্ভুত মিল। এটা এখন বলা যায় প্রায় সর্বভারতীয় ছবি। আমাদের দেশে নির্বাচন ক্রমশই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। যে ভোটার বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন তিনি আসলে নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিচ্ছেন। বিজেপির অন্য নেতারা কে কী বলছেন, করছেন সেদিকে তাঁদের নজর নেই। আমাদের রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই থাকেন প্রচারে, সব কেন্দ্রে তিনিই প্রার্থী। নরেন্দ্র মোদির দক্ষতা বেশি। ফলে এখন নরেন্দ্র মোদিই সরকার, তিনিই ভারত, এই বিশ্বাস তিনি অনেকটাই জনমনে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, দেবকান্ত বড়ুয়া বলেছিলেন বটে, কিন্তু সেই স্লোগানকে তিনি জনমনে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। মোদি পেরেছেন। মোদির সমালোচনাই মনে করা হচ্ছে দেশের বিরোধিতা। নরেন্দ্র মোদির প্রভাব অবশ্য তাঁর দলেও প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কার্যত তিনি এবং আমিত শাহই এখন বিজেপি দলটা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি সাংবাদিক শঙ্কর অর্নিমেশ ‘দ্য প্রিন্ট’-এ, এই নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট লিখেছেন। বিজেপির বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে কমিটিগুলোর মধ্যে দিয়ে হয় তার মধ্যে অন্যতম হল পার্লামেন্টারি বোর্ড। এই পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক হচ্ছে না গত প্রায় দু বছর। বোর্ডসদস্য অনন্ত কুমার, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি প্রয়াত হয়েছেন। বেঙ্কাইয়া নায়ডু উপরাষ্ট্রপতি হয়েছেন, হরচন্দ গেহলট রাজ্যপাল হয়ে গিয়েছেন, এই সব পদ কিন্তু শূন্যই পড়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই উত্তরপ্রদেশে জয় এনে দেওয়ার পর যোগী আদিত্যনাথ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য হবেন, এটা সবাই ধরেই নিয়েছেন। কিন্তু এখনও তার কোনও লক্ষণ নেই। রাজনৈতিক মহলে এমন মত আছে যে মোদি-শাহ পার্লামেন্টারি বোর্ডে যোগীর অন্তর্ভুক্তিতে অনাগ্রহী। পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক ছাড়াই কিন্তু দেখা যাচ্ছে বড় বড় সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে। সেই সব সিদ্ধান্ত মোদি-শাহ-ই নিচ্ছেন। এবং পার্লামেন্টারি বোর্ডের প্রধান জে পি নাড্ডার মাধ্যমে তা রূপায়ণও করা হচ্ছে। যেমন হল ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী বদল। বিপ্লব দেবের পরিবর্তে নতুন মুখ্যমন্ত্রী হলেন মানিক সাহা। উত্তরাখণ্ডে দুবার, গুজরাটে এবং কর্নাটকে একবার করে মুখ্যমন্ত্রী বদলের মতো বড় সিদ্ধান্তও কিন্তু পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক ছাড়াই হয়েছে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির সুবিধা হল যে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বড় আন্দোলন, প্রতিবাদ কিছুই নেই। পেগাসাসের মতো বিষয় নিয়েই কংগ্রেস সিপিএম পথে নামতে পারল না। শাহিনবাগ এবং কৃষক আন্দোলন পর্ব মিটে গিয়েছে। রাফাল জেট কেনা নিয়ে অরুণ শৌরি বলেছিলেন এটা বোফর্সের থেকেও বড় কেলেঙ্কারি,[1] এমন ইস্যু নিয়েও কংগ্রেস, সিপিএম সংসদের বাইরে কার্যত কিছুই করতে পারেনি। তৃণমূলও একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে। বোফর্স নিয়ে কিন্তু জ্যোতি বসু, আদবানি, বাজপেয়িদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি সক্রিয়। এটা হয়ে গিয়েছে মোদি সরকারের একটা বিরাট সুবিধে। হিজাব, আজান, বুলডোজার। এরকম আরও অনেক, একের পর এক এমন সব সিদ্ধান্ত বিজেপির বিভিন্ন রাজ্য সরকার, পুরসভা নিচ্ছে, যার সঙ্গে একমত না হলেও তা নিয়ে কার্যত নীরব বিরোধী সব রাজনৈতিক দল। এই সব সিদ্ধান্তের লক্ষ্য প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু ভারতীয়রা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি সংখ্যালঘু ভোটারদের সম্পর্কে বলেছিলেন ভোট দিলে লাথি খেতেও তিনি রাজি, তাঁরও কোনও নির্দিষ্ট, স্পষ্ট ভূমিকা নেই এইসব বিষয়ে। এই যে ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস ঘোষণা করল ভারতে মুদ্রাস্ফীতি গত আট বছরে সর্বোচ্চ, ৭.৭৯ শতাংশ ছুঁয়েছে, তা নিয়ে বিবৃতি অনেক শোনা গেল, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে যে ধরনের আন্দোলন দেখা গিয়েছিল সেরকম কি দেখা যাচ্ছে? উত্তর হল না। কেন নেই আন্দোলন?
২০২১-এর জুন মাসে পিউ রিসার্চ সেন্টার ‘রিলিজিয়ন অ্যান্ড ইন্ডিয়া: টলারেন্স অ্যান্ড সেগ্রেগেশন’ নামে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে। যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমীক্ষা জগতের তারকা যাকে বলা হয়, সেই রোনাল্ড এফ ইঙ্গলেহার্ট তাঁর শেষ বই ‘রিলিজিয়ন’স সাডেন ডিক্লাইন, হোয়াট’স কজিং ইট, অ্যান্ড হোয়াট কামস নেক্সট?’-এ লিখেছেন, ২০০৭-২০১৯, এই ১২ বছর সময়ে পৃথিবীর ৪৯টি দেশের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে ৪৩টি দেশের ক্ষেত্রে মানুষ যখন ধর্ম সম্পর্কে আগের থেকে অনেক কম সচেতন হয়ে পড়েছেন। ভারতে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। এখানে ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
এর কারণ কী? এর প্রধান কারণ, রামমন্দির আন্দোলন। গত তিন দশকে এই আন্দোলন ভারতীয়দের একটা বড় অংশের মানুষের মনকে অনেকটাই পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছে। খুব বড় মাপের কোনও মানবাতাবাদী, সামাজিক আন্দোলনই ভারতীয় সমাজকে এই সংখ্যাগুরুবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রভাব থেকে হয়তো কিছুটা মুক্ত করতে পারে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল, এমন কোনও আন্দোলনের সম্ভাবনা অন্তত এখনই দেখা যাচ্ছে না।
এর ফলে দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের পাশ থেকে কার্যত সব সেকুলার দল সরে গিয়েছে। যেন সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বললে, বিজেপির তোষণের তকমা গায়ে লেগে যাবে। সেকুলার কথাটাই তাদের অনেকে (বামপন্থীরা বাদে) এখন জোর গলায় বলতে ইতস্তত করছে। কারণ সব থেকে বড় বিরোধী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস অতীতে সংসদে সংখ্যার জোরে শাহ বানু মামলার রায় বদলে দেওয়া, রামমন্দিরের তালা খুলে দেওয়া ইত্যাদি কাজের মধ্যে দিয়ে যে ভোটব্যাঙ্ক পলিটিক্স করেছে, তাতে তাদের ‘সেকুলার’ চরিত্র নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করেছে বহুদিন আগে থেকেই। এর সুযোগ হিন্দুত্ববাদীরা নিয়েছে বেশ দক্ষতার সঙ্গে।
এই মুহূর্তে কংগ্রেসের ভোট ১৯ শতাংশ। বামপন্থীরা দুর্বল। কখনও আপ, কখনও টিএমসি, কখনও টিআরএসের মতো আঞ্চলিক দল কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু অতীতে বিজেপি যেভাবে নানা কৌশলে মনমোহন সিং-এর নতৃত্বে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল, কংগ্রেস, বামপন্থী দলগুলি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, ইস্যু থাকা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোনও বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশের মোদি সরকারের প্রচারক হয়ে ওঠা, তিল তিল করে গড়ে তোলা বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়তা তলানিতে চলে যাওয়ায় যে পরিবেশের জন্ম হচ্ছে, এই পরিস্থিতিই ইলেক্টেড অটোক্র্যাসির জন্ম হয়।
[1] Som, Vishnu. “Rafale Scandal Bigger Than Bofors”, Says Arun Shourie. Reliance Responds. NDTV. 9 Aug 2018.