অনন্ত কলির জন্যে

অনন্ত কলির জন্যে | মৃণাল চক্রবর্তী

মৃণাল চক্রবর্তী

 

প্রস্তাবনা

পশ্চাৎমঞ্চ প্রায় অন্ধকার। একটা ফ্যাকাসে আলোয় কালো দরজার আভাস পাওয়া যায়। গম গম শব্দ শোনা যায়, যেন কেউ কথা বলছে। খুব লো-স্পিডে গান চালালে যেমন লাগে, ঠিক তেমন। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে দুজন মহিলা। দুজনেরই বয়েস মধ্য-তিরিশ ছাড়িয়েছে। একজন জড়োসড়ো। মঞ্চে ঢুকেই সে আবার দরজার ভেতরে চলে যেতে চায়। কিন্তু দরজা বন্ধ এখন। মহিলা ২ তাকে টেনে নেয় বাইরের দিকে। মহিলা ১ কিছু বলতে যায়। কিন্তু খুব ভদ্র গলায় একটা ঘোষণা শোনা যায়…

ঘোষণা: বিদায় বন্ধুরা। তোমাদের আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি পরিচিত রাস্তায়। এখান থেকে সোজা গেলেই বাস-রাস্তা। সেখান থেকে বাস ধরে ফুলতলা। সেখানে ১২বি নির্মল বাজাজ স্ট্রিট। বাড়ির দোতলা। ডানহাতি ঘর। চাবি তোমাদের কাছেই আছে।

(প্রথম তাকায় দ্বিতীয়ের দিকে। দ্বিতীয় আশ্বস্ত করে মাথা নেড়ে)

ঘোষণা: ওখানে লাবণ্য দাস থাকবেন আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। অতএব, কোনও চিন্তা নেই।

(দ্বিতীয় প্রথমকে হেসে বোঝায় যে সত্যিই কোনও চিন্তা নেই)

ঘোষণা: অতএব, কোনও চিন্তা নেই, কিচ্ছুটি নেই। বিদায় বন্ধুরা। বিদায়।

(খুব জোরে মাইক বন্ধ হওয়ার শব্দ হয়। প্রথম চমকে গিয়ে দ্বিতীয়ের হাত ধরে। দ্বিতীয় আবার হেসে তাকে আশ্বস্ত করে। দুজনে অন্যদিকে এগিয়ে যায়। আলো কমে আসে)

 

নাটক শুরু

প্রথম দৃশ্য

(প্রধান মঞ্চ। সেখানে আলো জ্বলে। কেউ নেই। একটা ঘর। তার ঠিক মাঝখানে খাট। এক কোণে একটা স্টিলের আলমারি। তার দুটো পাট খোলা। রেডিওতে কথা বলার মতো গদগদ নারীকণ্ঠ বলে—)

নেপথ্য: আসুন ভাই, ভেতরে আসুন। কোনও চিন্তা নেই।

(সেই দুই মহিলা মঞ্চে ঢোকে। প্রথম আরও জবুথুবু। দ্বিতীয় তার দিকে তাকিয়ে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে। ঘরে ঢোকে)

নেপথ্য: নমস্কার।

(ভেতর থেকে এগিয়ে আসে যে বছর তিরিশের যুবক সে একেবারেই মেয়েদের মতো সেজেছে। কপালে টিপও পরেছে। এর নাম লাবণ্য। এ ট্রান্সভেস্টাইট)

লাবণ্য: আমি লাবণ্য দাস। আপনাদের নতুন জীবনে স্বাগত জানাই। ডানদিকে রান্নাঘর। বাঁদিকে বাথরুম। প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাবেন ওখানে। ঘর গোছানো, পরিষ্কার রাখার কাজটা কিন্তু আপনাদেরই করে নিতে হবে ভাই। রান্নাটাও। দেখুন, ভালো করে একবার নিজের সংসার দেখে নিন।

(একথায় প্রথম চঞ্চল হয়। দৌড়ে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে)

প্রথম: রান্নাঘরে সব আছে রুনু, মশলাপাতি সব।
দ্বিতীয়: এখানে আয়না আছে রানু, আয়না।
প্রথম: (উল্লসিত হয়ে ছুটে আসে) সত্যি বলছিস রুনু, আয়না আছে?
রুনু: এই তো। দ্যাখ। এটা আয়না। ওখানে রেবাদির অফিসে ছিল না? কেমন দেখাচ্ছে রে আমায়?
রানু: ভালোই তো। একটু খালি বয়স হয়েছে।

(রুনু খুশি হয় না। কিছু বলার আগে লাবণ্যর গলা শোনা যায়)

লাবণ্য: কাঁচা বাজার করা আছে। কিছু দরকার হলে নিয়ে আসতে পারেন। রাস্তার মোড়েই সবজিওলা…
রানু: (চিৎকার করে ওঠে) না। রাস্তার মোড়ে না।
লাবণ্য: ঠিক আছে। কদিন পরেই সব নর্মাল হয়ে যাবে। তাছাড়া আমি তো আছিই। টেবিলে আমার কার্ড। ফোন করবেন। (হেসে) বেশি করবেন না কিন্তু। কাজে থাকি তো। আচ্ছা, নমস্কার। (মোবাইল বাজে) হ্যাঁ, দিদি। অপারেশন শেষ। কোথায়? ছ নম্বর কলুটোলা। ও-কে, চলে যাচ্ছি। (শব্দ মিলিয়ে যেতে থাকে) পরশু রিলিজড হয়েছে তো? আমার মনে আছে।

(শেষে গুডবাই, ও-কে ইত্যাদি মৃদু গলায় শোনা যায়। সে চলে যেতে রানু বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। ফিরে আসে। টেবিলে কার্ডটা দেখে। রুনু হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। রানু কার্ড নামিয়ে রাখতেই বলে—)

রুনু: নম্বরটা ভালো করে দেখেছিস?
রানু: দেখেছি।
রুনু: (হেসে) দেখিসনি। পড়তে পারিসনি।
রানু: নিজের ইচ্ছে হলে নিজে দেখে নে না বাপু। আমাকে দিয়ে যাচাই করার কী আছে রে? আমি আর একবার রান্নাঘরটা দেখে আসি। হালকা করে মুসুর ডাল করে দিই, আর ঝুরো আলুভাজা?
রুনু: (পুরুষালি ভঙ্গিতে) সে তোমার সংসার, তুমি দ্যাখো। আলু-ফুলকপির একটা তরকারি কোরো তো।
রানু: করে দিচ্ছি। আর কিছু?
রুনু: না, না। ওই ব্যস। অনেকদিন পরে তোমার রান্না খাব আজ। দেখো আবার, ডুবিও না।
রানু: দেখি কতটা ডোবাতে পারি! তুমি এই ফাঁকে চট করে চানটা করে নাও বাপু। যেমন বেভুল মানুষ। হয়তো ভুলে যাবে। শেষে আমার ওপর যত তম্বি করবে।
রুনু: খবরের কাগজটা একবার দাও তো।
রানু: এখন আবার কাগজ পড়তে বসবে? এদিকে এত বেলা হল।
রুনু: আরে বাবা, কাগজটা দাও না। আর খোকাকে বলো চশমাটা দিয়ে যেতে।
রানু: (বিভ্রান্ত) কাগজ! খোকা! (এদিক-ওদিক খুঁজতে থাকে) কাগজটা? কাগজটা তো নেই!
রুনু: ওঃ! তাহলে খোকাই হয়তো পড়তে বসেছে ওটা নিয়ে। ওকে দিয়ে যেতে বলো।
রানু: খোকা— খোকা তো নেই! … ও পড়তে গেছে। ফিজিকাল সাইন্স পড়তে গেছে।
রুনু: পড়তে চলে গেছে! নিউজপেপার নিয়ে! তুমি কিছু বলোনি ওকে? কী করো বাড়িতে বসে সারাদিন? তুমি জানো না এই সময় রোজ আমি কাগজ…
রানু: কিন্তু তুমি তো এতদিন পরে…
রুনু: একটা ছুটির দিন বাড়িতে বসে শান্তিতে কাগজটাও পড়তে পারব না! যাও, যে করে হোক কাগজ নিয়ে এসো। যেখান থেকে হোক…
রানু: কিন্তু আমি তো এখন রান্না করব— আলু-ফুলকপির তরকারি— তুমি বললে…
রুনু: আঃ! বাজে তর্ক না করে কাগজটা নিয়ে এসো। আমি চাই না আলু-ফুলকপির তরকারি। ওই কাগজটাই চাই আমার। আর চাই চশমা। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না এখন… যাও কাগজ নিয়ে এসো। আমার কাগজ।

(কাঁচুমাচু মুখে বেরিয়ে যেতে থাকে রানু। বাইরে দরজার মুখে গিয়ে বাইরে তাকায়)

রানু: কীভাবে কাগজ খোঁজে রে?
রুনু: ওই— এখানে-সেখানে— জুতোর বাক্সে— খাটের নীচে…
রানু: আর খোকাকে কী করে খুঁজব?
রুনু: কী?
রানু: কোত্থেকে খুঁজে আনব খোকাকে? দেবীদি তো বলেনি…
রুনু: (মুহূর্তে উঠে লাইট বন্ধ করে দেয়। খাটের ওপর বসে। অন্য চরিত্রের ভঙ্গিতে) বলিনি? বলেছি রানু…
রানু: না দেবীদি, বলেননি। তাছাড়া, আমার তো কোনও বাচ্চা হয়নি। তাই আমি…
রুনু: রুনুর হয়েছিল। একটা বাচ্চা হয়েছিল ওর।
রানু: কিন্তু ওর তো কোনও বর ছিল না। তাহলে কী করে…
রুনু: দেবতার বর ছিল। তাই। (হাসে) আর তোমার ছিল মানুষ-বর। সূর্য। (হাসে) কী? ছিল না?
রানু: না, আমার না। রুনুর ছিল।
রুনু: দেবীদিকে মিথ্যে কথা বলতে নেই। তুমি সূর্যের কথা ভুলে গেছ।
রানু: না, দেবীদি। আমি না, রুনু। আপনি ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না।
রুনু: আবার মিথ্যে কথা! এবার কিন্তু…
রানু: সত্যি কথা। আমি সূর্যকে চিনতাম। কিন্তু সাহস ছিল না আমার। রুনুর সাহস ছিল দেবীদি। ওর বিয়েটা ভেঙে গেল তো। তাই খুব সাহস ছিল ওর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান গাইত। সূর্য তখন এসে দাঁড়াত পূবের বারান্দায়। সিগারেট খেতে খেতে দেখত রুনুকে। রুনু জানত।

(রুনু উঠে এক কোণে যায়। একদিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে)

রুনু: ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে… ঘরেতে…

(পুরো গানটাই সে গেয়ে যাবে পেশাদারি দক্ষতায় সেই একই দিকে বিলোল দৃষ্টি রেখে। রানু সামনে বসে নিজের মনেই বলতে থাকে)

রানু: নিলাজ মেয়েছেলে। মা জানত। বাবা জানত না। বাবা ওকেই বেশি ভালোবাসত। মা সব ঢেকেঢুকে রাখত। আমি বাবাকে বলে দিয়েছিলাম। (হাততালি দিয়ে ওঠে) আমি বলে দিয়েছিলাম।

(রুনুর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রুনু গান থামিয়ে পেছনে একবার দেখে ধীরপায়ে চলে আসে সম্মুখ-মঞ্চে। রানুর জায়গায় বসে। রানু রুনুর চেয়েও সাহসী ভঙ্গিতে একই গান গেয়ে যায়। রুনু বলতে থাকে)

রুনু: রানুকে ছেলেরা একদম পছন্দ করত না। বাদল, আমার স্বামী, তো আমাকে বলেইছিল— ওঃ, খুব ক্যাটকেটে তো তোমার বোনটা। মেয়েছেলে না মুড়ো ঝাঁটা! (হেসে ফেলে) এমন সব কথা বলত না! কিচ্ছু মুখে আটকাত না ওর।

(পেছনে রানুর গান বন্ধ হয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় রুনুর পেছনে। সামনের দিকে তাকিয়ে বলে)

রানু: পুরুষ না চামার! কোন বাড়ি থেকে এসেছে কে জানে!
রুনু: (উঠে দাঁড়ায়) কী?
রানু: বাড়ির জামাই। মুড়ো ঝ্যাঁটা মেরে ফেলে দিতে হয়। নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা কোথাকার!
রুনু: এত বড় সাহস তোর! আমার স্বামীকে তুই… (ফুঁসতে থাকে)
রানু: (হাসে) নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা।
রুনু: (উন্মত্ত) অ্যাই…

(আলো নেভে)

 

দ্বিতীয় দৃশ্য

(প্রায় অন্ধকার মঞ্চ। বোঝা যায় যে কেউ শুয়ে আছে খাটে। বাইরে থেকে মহিলাকণ্ঠ শোনা যায়— রানুর গলা—)

রানু: না, না। কোনও অসুবিধে হয়নি। একটু দেরিতে দুধ পেলে কী আর অসুবিধে হবে! (গলা নামালেও শোনা যায়) আসলে আমার দিদি বলেছে আসল হল জিনিসের কোয়ালিটি।

(মঞ্চে আলো বাড়ে। রুনু উঠে বসে। মন দিয়ে কথা শুনতে থাকে)

পুরুষকণ্ঠ: আমার দুধের কোয়ালিটি আলাদা দিদি। আপনি না ফুটিয়ে ফেলে রাখুন, পচবে না।
রানু: আমি দিদিকে বলেছি সে কথা। কিন্তু ওর একটু… মানে… যাক গে, আপনি কিছু মনে করবেন না। (গলা নামিয়ে) না, ঘুমোচ্ছে। …না, শুনতে পাবে না…

(রুনু উঠে দাঁড়ায়। রেগে গেছে)

রানু: (হাসে) ধেৎ। কী সব বলেন না আপনি! না, না আমি ভেতরে যাব। আঃ, না…

(রুনু বেরোতে যাচ্ছিল। কিন্তু রানু দড়াম করে দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢোকে। দুজনে মুখোমুখি। নিজেকে সামলে নেয় রানু। হাসে রুনুর দিকে তাকিয়ে)

রানু: দুধওলা। যা মজার কথা বলে না…

(ঢুকতে যাচ্ছিল। রুনু আটকে দেয়)

রুনু: মজার কথা?
রানু: হ্যাঁ, মজার কথা। রাস্তা ছাড়।
রুনু: একই স্বভাব রয়ে গেল তোর। কয়লা ধুলে না যায় ময়লা।
রানু: তোর ময়লা বুঝি ধুলেই চলে যায়? পাড়ায় গিয়ে খবর নে, ওরা তোকে কী বলে ডাকত?
রুনু: কী বলে ডাকত?
রানু: দেবোদিদি। চাইলেই দেবে। (ভেতরে চলে যায়)
রুনু: দূ-র বোকা। আমি একটা দুপুরের মতো খা-খা আকাশ আটকে রেখে দেখে গেছি নারীজন্ম।/ আমি এক প্রান্তরের ছাঁটা ঘাসের মতো দেখেছি— পুরুষ আর প্রকৃতিকে।/ কীভাবে রৌদ্রদগ্ধ মাঠের ওপর নামে ক্ষণস্থায়ী জল।/ আমার বুক ফেটে গেল রে।/ সেই শব্দ শুনতে পেল সূর্য আর তাই/ ছাঁটা ঘাস পড়ে আছে সূর্য হেথা নাই।
রানু: (হাসতে হাসতে ঢোকে) আর সেই প্রস্ফুটিত মঞ্জুরিত অলি? প্রজাপতি শহরের প্রান্তে কানাগলি? নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবারে? দারুণ গর্ভের ব্যথা শনি-রবিবারে?
রুনু: একসময় ঝড়ের মতন সব প্রবল পুরুষ মদ খেয়ে অকস্মাৎ মোটা ব্যাটাছেলে/ কোথায় পালাবে কেষ্ট বৃন্দাবন অন্ধ করে তোকে যাব ফেলে।
রানু: অথবা হয়তো নিজেরই বোমার ঘায়ে হতভম্ব হয়ে যাবে জেলে।
রুনু: বোমার ঘা শুকোয়নি ভালো করে, জানিস? যত মুছি তত রক্ত। আমার বমি পেত। জেল থেকে বেরোল সেই রক্ত আর পেটে ব্যথা নিয়ে। কী এত ব্যথা করত কে জানে! ডাক্তার বলেছিল কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শেষে তো পাগল হয়ে গেল।
রানু: তারপর মারা গেল ক্যান্সারে। আমি তখন ওখানে ছিলাম না।
রুনু: তখন তুই সেখানে ছিলি। বৃন্দাবনে।
রানু: মাত্র কদিন। তারপরেই তো আবার সেই…
রুনু: তারপর তো মরেই গেল!
রানু: মারা তো যাবেই। কারও কথা শুনত? প্রোমোটারি লাইন অত সোজা? প্রোমোটার মরণশীল। কত শত্রু থাকে ওদের!
রুনু: কেউ কথা বলত? কার কথা শুনবে ভাই? কে বলবে প্রোমোটারি লাইন এত সোজা নয়!
রানু: হ্যাঁ ও-তো আমাদের দিঘা বেড়াতে নিয়ে গেছিল। কী মজা হয়েছিল না?
রুনু: কে বলবে ওকে? প্রোমোটারি করতে গেলে শত্রু হয়? মা-ও খুব আস্তে বলত সাবধানে যাস। যাতে ভাইও শুনতে না পায়। বাবা দুঃখী-মুখে শুয়ে থাকত। বিড়ি খেত।
রানু: না, তখন সিগারেট খেত।
রুনু: বাদলকে বালি সাপ্লাইয়ের কাজ দিয়েছিল ভাই। তখন বাদল রোজই মানে প্রায় রোজই আমার সঙ্গে শুত।
রানু: তোর বরটাকে আমি সহ্য করতে পারতাম না।
রুনু: আমার তো তবু একটা ছিল।
রানু: ওরকম পুরুষ থাকার চেয়ে না-থাকা ভালো।
রুনু: না-থাকার চেয়ে থাকা ভালো। নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবারে…

(কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে রানু। তারপর মিনমিনে গলায় বলে)

রানু: কোথায় এখন তোর সে বাদল?
রুনু: বাদল? আকাশে।

(ফোন বাজে। দুজনেই একসঙ্গে ধরতে যায়। রুনু ধরে। রানু ফুঁসতে থাকে রাগে। ঘরের জিনিস লণ্ডভণ্ড করে। রুনু ভ্রূক্ষেপ করে না। কথা বলে যায়)

রুনু: হ্যাঁ, আমি। না না, আমিই। গলাটা অন্যরকম লাগছে? তার মানে সব দিকে লক্ষ্য আছে? ছি ছি! কী বাজে কথা বলে! গলাটা অন্যরকম লাগছে কেন? কারণ… কারণ…

(রানু ফোনটা ছিনিয়ে নেয়। রুনু হাসতে থাকে)

রানু: এবার? এবার ঠিক লাগছে তো? (রুনুর হাসি বাড়ে) না, কেউ হাসছে না তো! তারপর বাঁদির কথা মনে পড়ল তাহলে? ইস, না… শুধু বাজে কথা…

(রুনু হাসতে হাসতে রানুর ফেলে দেওয়া জিনিসগুলো গোছায়)

রানু: না, হাসছে না তো। কোথায়? না। ও ওটা… ওটা তো দূরে হকার ডাকছে…
রুনু: (হকারের গলায়) পুরনো ভাঙা বাসন বেচবে। পুরনো কাপড়-শাড়ি বেচবে।
রানু: হ্যাঁ, এখন বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে। তাই জোরে শোনা যাচ্ছে। ওই যে মেয়েগুলো আছে না, ফেলে দেওয়া জিনিস কেনে। ভাঙা বাসন, পুরনো কাপড়। তার বদলে নতুন বালতি দেয়, মগ দেয়।
রুনু: নতুন বালতি পাবে। নতুন বদনা পাবে।
রানু: একদম পাশ দিয়ে যাচ্ছে তো, তাই। না, ছাড়বেন না। আমি বলে দিচ্ছি। (রুনুকে সরিয়ে দেয়) যাও এখান থেকে। আমার কিচ্ছু নেই। আমার নতুন কিছু লাগবে না। যা!
রুনু: লাগবে লাগবে। নতুন খাট লাগবে। নতুন কাঁথা…
রানু: না। আপনি বলুন। আমি শুনছি। না, ছাড়বেন না।… যা এখান থেকে, যা।

(কিন্তু রুনু হেসে চলে আর বলে চলে)

রুনু: নষ্ট জিনিস বেচবে। ফালতু ফাটা জিনিস বেচবে।
রানু: না, বেচব না। শুনুন, আপনি বলুন না কেন…
রুনু: ফাটা জিনিস বেচবে…
রানু: না… না…

 

তৃতীয় দৃশ্য

(ফাঁকা ঘরে লাবণ্যর গলা শোনা যায়)

লাবণ্য: বাঃ! এই তো সুন্দর সাজিয়ে নিয়েছেন সংসার। শুধু বাইরের দরজার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। দরজা বন্ধ করতে হবে নিয়মমতো। যাতে বাইরে থেকে কেউ বা কিছু ভেতরে আসতে না পারে। দরজা খোলা ছিল বলেই না আমি কত সহজে ঢুকে এলাম ভেতরে। কিন্তু অন্য কেউ যদি…
রানু: (এসে পাশে দাঁড়ায়) রুনুকে আপনি বোঝান লাবণ্যদি। ও-ই বারবার দরজা খুলে দেয়। আমি কিচ্ছু খুলি না, জানলাও না।
লাবণ্য: না না, তা কেন? জানলা নিশ্চই খুলবেন, নাহলে বাতাস আসবে কোথা থেকে? জানলা বন্ধ করার ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণে থাকে, কিন্তু দরজা তো আর…
রানু: জানি। বেবিদি বলেছিল। কিন্তু আমি ভয় পাই। রুনু কিন্তু বেপরোয়া। ওকে বোঝান।

(দরজা নেপথ্যে সশব্দে বন্ধ হয়)

রুনু: (কথা বলতে বলতে ঢোকে) কে যে বারবার দরজা খুলে রাখে! এক মিনিটের জন্য বাইরে বেরিয়েছি চা কিনতে, আর ওমনি… একি লাবণ্যদি, কখন এলেন?
লাবণ্য: অনেকক্ষণ। দরজা খোলা থেকেই ঢুকেছিলাম। আপনি কিন্তু দরজা খোলা রেখে যাবেন না। ওতে বিপদ হতে পারে।
রুনু: কিন্তু আমি তো বাইরে থেকে…
রানু: মিথ্যে কথা। তুই-ই দরজা খুলে রেখে গেছিলি। পাশের ফ্ল্যাটের ড্রাইভারটা বেল দিয়েছিল, আর সেটা শুনেই তুই…
রুনু: কিন্তু আমি তো চা আনতে…
রানু: আবার মিথ্যে কথা! বাড়িতে চা ছিল, তুই ইচ্ছে করেই সেটা একটা কাগজে মুড়ে বেরিয়েছিলি। আমি সব জানি।
লাবণ্য: আঃ রানু-রুনু! আপনারা ছেলেমানুষি করবেন না। রুনু, দরজা যে-ই খুলে রাখুক, আপনি কিন্তু খুব দেরি করেছেন বাইরে। এতক্ষণ ধরে আমি এখানে… (মোবাইল বাজে) গুড মর্নিং দিদি, বারোর বি থেকে বলছি। রুটিন চেকআপ। নর্মাল। দরজার ব্যাপারটা ভুলে গেছে। জানলার ব্যপারটাও। কেস হিস্ট্রি মনে নেই।… বালি স্টেশন, দিদি? ছ-নম্বর? ও-কে। (মোবাইল অফ করে) চলি রানু-রুনু। টেক কেয়ার।

(রানু-রুনুর দৃষ্টি দেখে মনে হয় দূরে চলে যাওয়া লাবণ্যকে দেখছে। একটা সময় রুনু এগিয়ে যায়। রানু চেঁচিয়ে ওঠে)

রানু: কোথায় যাচ্ছিস?
রুনু: দরজা বন্ধ করতে। নমিতাদি বলে গেল।
রানু: না। তুই যাবি না। আমি যাব।

(এগিয়ে যেতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে হাসে রুনু)

রুনু: কোনও লাভ নেই। শু চলে গেছে।
রানু: কে শু?
রুনু: ড্রাইভার। (হাসে) ডিউটি শেষ করে চলে গেছে।
রানু: না, আমি যাব। (ছুটে বেরিয়ে যায়)
রুনু: (ঘরে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরতে ঘুরতে) আমি এক প্রস্ফুটিত মঞ্জরিত কলি। বলো বলো প্রিয়তম, কবে হবে প্রথম প্রণয়? সে কি আজ নয়? ওগো সে কি আজ মধুরাত্রে মধুচন্দ্রে নয়? (সশব্দে দরজা বন্ধ হওয়া শোনে) ফিরে গেলে? আজও তুমি ফিরে গেলে? রাতের শিউলিগন্ধ চুরি করে নিয়ে গেলে প্রিয়?

(রানু ঢোকে। রুনুকে দ্যাখে। গোমড়া মুখে বসে পড়ে খাটে)

রুনু: আমি কিচ্ছু বলিনি। একটা কথাও বলিনি ওর সঙ্গে। শুধু অ্যাক্টিং করছিলাম।
রানু: (রাগী ভঙ্গিতে এসে মুখোমুখি হয় ওর) কী ডায়লগ এগুলো, অ্যাঁ? রাতের ভ্রমর? মধুরাত্রে… মধুচন্দ্রিমায়?
রুনু: ওগুলো তো সংলাপ। ওর পরে গান হবে। ‘বিদায় করেছ যারে…’
রানু: গান হবে? কোথায় গান হচ্ছে? (জোরে কান মুলে দেয় তার) হচ্ছে গান? হচ্ছে?

(রুনু যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে)

রানু: হচ্ছে। এবার গান হচ্ছে। (রুনুর কান্নার গলা ছাপিয়ে) বিদায় করেছ যারে…

(আলো কমে আসে। রুনুর গলা থেমে যায়। রানু উঠে দাঁড়ায়। তার গলা কর্কশ। উচ্চারণ স্খলিত, মাতালের মত)

রানু: আর একদিন যদি ওইসব ডাইলগ শুনি, কলি ধরে মুচড়ে দেব। এইভাবে…

(শুয়ে থাকা রুনুকে কিছু করে সে, যা দেখা যায় না। গোঙানির শব্দ শোনা যায় শুধু)

রানু: (হাসে) আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার…

(শব্দ করে হাসে। আলো নেভে। আবার রুনুর গোঙানি শোনা যায়)

উপদৃশ্য

(রানুকে কেন্দ্র করে আলো জ্বলে। নাচের মুদ্রায় সে বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ করছে। প্রধানত বীরভাব। এই বীররসের ধরন অনেকটা চিত্রাঙ্গদার মতো। সেই চিত্রাঙ্গদার মতোই সমর্পণের নম্রতা। পেছনে বাজছে তারই কণ্ঠস্বর)

রানু: নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারে— পাথরের মতো এক-একটা পুরুষ— কোনওটায় শ্যাওলা জমেছে— কোনওটা শুকনো— কোনওটায় আকণ্ঠ তৃষ্ণা— কোনওটায় ঝাঁ ঝাঁ রোদ— নারীরে আপন ভাগ্য— এক এক ধাপ পথ পেরোতে এক একটা বাবা বাদল এক একটা ভাই এক একটা চাউনি পেটে ব্যথা— মা গো, আর কত ব্যথা অন্তরে অন্তরে— নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারে…

(বসে সে অসহায় ভঙ্গিতে। দু হাত সামনে বাড়িয়ে বলে)

রানু: হে সূর্য আমায় নাও আমি সন্তানবতী হই হে বাতাস আমায় বিকশিত করো পুরুষ আমায় গ্রহণ করুক/ হে অগ্নি আমায় কামনাদগ্ধ করো আমায় বাসনাজীর্ণ করো/ হে কৃষ্ণ তুমি আমার সখা হও আমায় দগ্ধ করো তুমি কোনওদিন ফিরে এসো না

কী জ্বালা সই নাম রেখেছি দুঃখহরণ লজ্জাহরণ…

শব্দ থেমে যাক হঠাৎ। এক মুহূর্তের নৈঃশব্দ। হাততালির শব্দ শোনা যাক। মাতালের বিজড়িত গলায় শোনা যাক ‘তুমি যে আমার’। আজানের শব্দ। নদীর স্রোত আছড়ে পড়ছে। সব শব্দ থেমে গিয়ে বেজে উঠুক টেলিফোন। বাজতে থাকুক।

 

চতুর্থ দৃশ্য

(ঝকঝকে আলোয় ভালো পোশাক পরে বসে আছে রানু-রুনু। তাদেরই বয়েসি দুই মহিলা ঘরে এসেছে। শাঁখা-সিঁদুর পরা। তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। চায়ের কাপ পড়ে আছে পাশে। চারটে কাপ। দুটো প্লেটে পড়ে আছে অক্ষত বিস্কুট)

মহিলা ১: একেবারে বিনা নেমন্তন্নেই চলে এলাম। কিছু মনে করবেন না। শমিতা তো খুব গাঁইগুঁই করছিল। আমি জোর করে বললাম, আহা, এমন কী আর হবে? প্রতিবেশী তো। চল, আলাপ করে আসি। বড়জোর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে…

(হাসির শব্দ। দুজনের হাসি)

মহিলা ২: সত্যি, নমিতাটা এত জোর করল…
রুনু: না না, কী বলছেন! আমাদেরও তো ভালো হল। কী বল রানু? আমরাও তো একা একা…
রানু: একা মানে আমার তো হাতে এত কাজ… তবে এবার একাও…
নমিতা: হ্যাঁ, আপনি তো বাড়িতেই থাকেন। ওনাকে অবশ্য দেখি…
শমিতা: শুনিও ওনার কথা…
রুনু: আমার কথা শোনেন? কে বলে?
নমি: কেন? আমাদের চাকর মনু বলে, ওদের ড্রাইভার শু বলে।
রুনু: কী বলে? কী বলে?
নমি: বলে আপনি সুন্দর করে বন্ধুর মতো কথা বলেন। আমি তো বলি না।
শমি: আমি তো বলি না। আমরা তো বলি না। সেজন্যই ওরা আপনাকে খুব পছন্দ করে।
রানু: (কঠিন গলায়) হ্যাঁ, রুনু খুব মিশুকে। আমি ভাই রান্নাঘরেই ভালো থাকি। এটা-ওটা রান্না করি। আমার সময় ঠিক কেটে যায়।
রুনু: আপনাদের স্বামীরাও তো কথা বলেন। কীরকম গম্ভীর গলায় বলেন— থাক।
নমি: হ্যাঁ, তা তো বলতেই পারে।
শমি: বলতেই পারে। ওসব আমরা মাইন্ড করি না। (নমিতাকে) ছেলেরা তো বলতেই পারে।
রুনু: হ্যাঁ, গৌরদা তো সিনেমায় যাওয়ার কথা বলেছেন। শুধু উনি আর আমি। (রানুকে বলে) আমরা দুজনে।
রানু: আর নিতাইদা চান আমার সঙ্গে একলা হতে। কথা বলবেন।
শমি-নমি: মিথ্যে কথা।
রুনু: গৌরদা বলেন দিনের বেলা বকখালি সেরে আসার কথা।
নমি-শমি: মিথ্যে কথা।
রানু: নিতাইদা বললেন, ‘তোমাকে খুব কাছের থেকে দেখতে ইচ্ছে করে’।
নমি-শমি: (উঠে দাঁড়ায়) মিথ্যে কথা!
রুনু– এই তোমার স্বামী শু-দা না…?
শমি: মোটেই না। নিতাই আমার স্বামী। শু ড্রাইভার।
রুনু: আর তোমার স্বামী মনুদা না…
নমি: মনু চাকর। আমার স্বামী গৌর।
রানু: ইস, তোমার স্বামী গৌরটা না…
রুনু: তোমার স্বামী নিতাইটা না…
নমি-শমি: মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা।

(রানু-রুনুর হাসির শব্দ ছাপিয়ে যায় ‘মিথ্যে কথা’কে। ধীরে শব্দ কমে। রানু-রুনুর হাসির ভঙ্গি স্লো মোশনের মতো কমে আসে। একই ভঙ্গিতে গাইবে যাতে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের হিট গানগুলোই জানে সে। গান শেষ হলে সবাই হাততালি দেবে। অর্থাৎ দৃশ্যত দুজোড়া এবং কার্যত তিনজোড়া হাততালি)

শমি: ইস, নমিটা কী সুন্দর গান গায় দ্যাখ।
নমি: আর গান! প্যাকটিসই নেই।
রুনু: না। আপনি ভাল গেয়েছেন।
রানু: সুন্দর গেয়েছেন। … যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে…
রুনু: দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহালগনে?… সিনেমার গান না কেন?
নমি: না না তা কী করে হবে! তত ভালো তো…
শমি: ভালো-টালো ছাড়। আসল কথা হল চেনাশুনো।
রানু: এখন আমার বেলা নাহি আর বহিব একাকী বিরহের ভার— নমিতা-শমিতা, বড় ভার-ভার লাগে না সব?
রুনু: এখন আমার বেলা নাহি আর বহিব একাকী বিরহের ভার— কলিংবেল বাজলে কেমন লাগে?
রানু: বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না খুলো না— ফোন বাজলে? গৌর এল না নিতাই?
রুনু: সোনার গৌর কেন কেন্দে এল ও নরহরি
রানু: সোনার গৌর কেন কেন্দে এল ও নরহরি
নমি: এত পেশার কাজের। কোলেরটাকে নিয়েই তো দিন কেটে যায়। বড়টা যে কী করে…
শমি: আমার বাবা একটাই ভালো।
রুনু: ওরে তোর বা কী ভাব তার বা কী ভাব বুঝিতে নারি
রানু: সোনার গৌর কেন কেন্দে এল ও নরহরি
নমি: সন্ধের পর বাড়িতেই থাকে। আগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে বেরোত। এমন ওষুধ দিয়েছে না…
শমি: কী ওষুধ দিলি? সেইটা?
রুনু: সোনার গৌর কেন কেন্দে এল ও নরহরি
নমি: আবার কী! এখন তো বাড়িতেই থাকে সন্ধেবেলা।
রানু: দুপুরে বাইরে যায়। সোনার গৌর কেন কেন্দে এল…
শমি: আঃ, একটু থামুন তো! … গৌর, দেখেছিস তো, কেমন গম্ভীর?
রুনু: (গম্ভীর গলায়) চলুন না একদিন বকখালি ঘুরে আসি। সকালে যাব, সন্ধেবেলা ওয়াপস।
নমি: নিতাইদা তো কথাই বলে না।
রানু: (গম্ভীর গলায়) অনেক কথা বলার আছে। বেরোবেন?
নমি: আঃ, চুপ করুন তো! কোনও কথা বলতে দেবে না!
শমি: সত্যি, একটু চুপ করুন না। … তোর গৌরদা না…
রুনু: আমার বিয়েটা যদি হত, তাহলে আজ আমি ওদেরই মতো— তুই যদি বৃন্দাবনে চলে না যেতি তাহলে তুইও…
রানু: এখন আমার বেলা নাহি আর…
রুনু: না, মানে যদি হত আর কি…

(দুজনেই গানটা নিচু গলায় গাইতে থাকে। তাদের গলা ছাপিয়ে শোনা যায় নমিতা-শমিতার গলা)

নমি: হ্যাঁ, আর তোর নিতাইদা তো জানিস, কী মাথাগরম। একদিন ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে এমন ঝগড়া করল যে পরের দিনই রেগেমেগে বাবু বাইক কিনে বসল। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে জানিস? শনিবার তো বাবুর বেরোনো চাই-ই চাই। সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ দিয়ে যখন বাইকটা চালায় নিতাই, তখন মনে হয়…
শমি: দ্যাখ না, আমার খুব পছন্দ ছিল বাইক। কিন্তু তোর গৌরদা তো শুনেই রেগে আগুন। পাগল হয়েছ তুমি! গাড়ি ছেড়ে কেউ বাইক চালায়? তাছাড়া, গাড়ি চালানো নাকি ড্রাইভারের কাজ। কেমন রাগ ধরে বল?
নমি: তবে ভাই আমার মনে হয়, সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির চেয়ে বাইক অনেক ভালো। যে কোনও রাস্তা দিয়ে যেতে পারে। যতই ট্র্যাফিক ভারি হোক, তোর নিতাইদা না ঠিক রাস্তা বের করে নেয়।
শমি: আঃ, একটু চুপ কর না, আমাকে কথা বলতে দে। জানিস তো ভাই…

(রানু-রুনু উঠে গিয়ে দরজা খুলে ধরে। পেছন ফিরে যেন অন্যদের যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়)

শমি: এ জন্যই তোকে বারবার বলেছিলাম আইবুড়ো মেয়েদের বাড়ি না আসতে…
নমি: আমি বুঝতে পারিনি শমু, এরা সত্যিই খুব অলক্ষুণে।
শমি: তার ওপরে পাগলা গারদে ছিল তো। এ-জন্যই তোকে আমি বারবার বলেছিলাম…

(রানু-রুনুর দৃষ্টি দেখে বোঝা যায় বাকি দুজন বেরিয়ে গেল। রানু এসে খাটে বসে। আলো এখন খুব নরম। রুনু একটু পরে বলে)

রুনু: ওরা তাহলে বোধহয় আর আসবে না, না রে?
রানু: এখন তো তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ওরা বলেছিল। আজ আসবে বলেছিল।
রুনু: তাহলে এল না কেন?
রানু: হয়তো বরেরা বেরোতে দেয়নি।
রুনু: বরেরা খুব জোর করে, না?
রানু: নিজেদের ইচ্ছেমতো। ইচ্ছে হলে জোর করবে, না হলে ঘুমোবে। আমি দেখেছি।
রুনু: বৃন্দাবনেও এরকম?
রানু: সেখানে আরও বেশি। অনেক গাছ আছে তো, যমুনা নদী আছে। ওরা গাছের নিচে যমুনার তীরে ঘুমোয়। বরেরা।
রুনু: আর বৌয়েরা? তারা জেগে থাকে?
রানু: সব মেয়ে জেগে ওঠে যেইমাত্র স্বামীরা ঘুমায়/ যেইমাত্র কালো জলে ঘোর নামে বুড়ি যমুনায়।/ সব লোক মুখ ধুয়ে হাত মুছে যেই কাজে যায়/ সব মেয়ে ঘুমপাখি তাদের স্বামীরা যমুনায়।
রুনু: যমুনা কি বোঝে কিছু? /যমুনা কি জানে কারও অন্তরের কথা?/ হৃদয়ের ধারাভাষ্য, প্রেমের করুণ কোমলতা?/ মেয়েরা কী চায় বল তো, হৃদয়ের কোমলতা চায়? /তবে কেন সব জল যমুনায় যায়?
রানু: কেন বল তো?
রুনু: কী জানি! চা খাবি?
রানু: নাও খেতে পারি।
রুনু: জানলাটা খুলে দিস না কেন?
রানু: না না। হাত কেটে যাবে। খুব জং ধরে গেছে। এতদিন ধরে ভয়ে ভয়ে…
রুনু: বড্ড ভয় তোর!

(রুনু পশ্চাৎমঞ্চে এগিয়ে যায়। জানলা খোলার চেষ্টা করে। রানু বসে থাকে করুণ মুখে। একটা শব্দ হয় জানলা খোলার। তীব্র শব্দ নয়। রানু চমকে ওঠে)

রুনু: এই তো খুলে দিলাম জানলা। কিছু হল? কিছু হল আমার? বোকা মেয়ে। এত ভয় কেন তোর? তাছাড়া কোনও জং ধরেনি তো কোথাও। তুই যে বললি…
রানু: (কেঁদে ফেলে) মিথ্যে কথা বলেছিলাম। কী করে জং ধরবে? আমি তো দুবার, চারবার, দশবার জানলা খুলি। রোজ। তুই যখন দোকানে যাস মিথ্যে কথা বলে। আমি কী করব তখন? জানলা না-খুলে আমি কী করব? আমি তো এখনও খুব ভয় পাই। … একদিন রাস্তায় নিয়ে চল না আমাকে। কী রে, নিয়ে যাবি?
রুনু: মিথ্যে কথা কেন বলিস আমাকে? মিথ্যে তো শুধু আমি বলব।
রানু: সেদিন দুপুরবেলা আমার বুকে জ্বলে যাচ্ছিল রুনু। আমায় তুই রাস্তায় নিয়ে চল। পাশের বাড়িতে রেডিও বাজে রে রুনু, আমায় নিয়ে চল। কী রে, নিয়ে যাবি না? রুনু?

(রুনু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রানু তার পিঠে মাথা রাখে। নেপথ্য সঙ্গীত)

 

পঞ্চম দৃশ্য

(রাস্তা। নার্ভাস রানুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে রুনু। অন্ধকার রাস্তা। দু-একটা আলো জ্বলছে লাইটপোস্টে। বন্ধ বাড়ি থেকেও আসছে কিছু আলোর রেখা)

রুনু: ওরকম ক্যাবলার মত হাঁটছিস কেন? এই প্রথম রাস্তায় নেমেছিস? (সরে যায়) নিজে হাঁট।
রানু: ভয় করছে। আমি পারব না।
রুনু: পারবি। হাঁট। হেঁটে আমার কাছে আয়। (দু হাত বাড়িয়ে দেয়) আয়।
রানু: এই আসছি। (টলমল পায়ে এগিয়ে যায়) আসছি।
রুনু: ভেরি গুড। তুমি পারছ খুকু। বড় হয়ে গেছ। এরপর তোমার বিয়ে হবে। হাতি নাচবে ঘোড়া নাচবে। এসো। (এদিক ওদিক সরে গিয়ে রানুকে ডাকতে থাকে সে) আয় আয় টিয়ে।
রানু: তুই কেন সরে যাচ্ছিস? আমি একসঙ্গে এত দিকে কী করে যাব? কোন দিকে যাব?

(নেপথ্যে কোলাহল। রানু চমকে উঠে পড়ে যাচ্ছিল। রুনু এসে ধরে ফেলে তাকে)

রানু: কারা হাসছে? কারা?
রুনু: কেউ হাসছে না। খেলা দেখছে বোধহয়। … লুকোচুরি খেলবি?
রানু: না। বাড়ি যাব।
রুনু: খালি বাড়ি বাড়ি করে। যা লুকো, আমি চোর।

(নেপথ্যে আবার হইচই। রানু আঁতকে ওঠে)

রুনু: কেউ বোধহয় গোল দিয়েছে। কেউ সেঞ্চুরি করেছে। যা লুকো।

(রানু অনিশ্চিতভাবে চলে যায় একদিকে। রুনু চোখ বন্ধ করে থাকে। অপেক্ষা করে কোনও সঙ্কেতের। পায় না। চোখ খোলে)

রুনু: টুকি দে রানু। টুকি দে।

(উত্তর নেই। রুনু চারদিকে খুঁজতে থাকে তাকে। পায় না)

রুনু: রানু, কোথায় তুই? আমি হারিয়ে গেছি। টুকি দে রানু। টুকি দে। (কেঁদে ফেলে) রানু…

(নেপথ্যে ‘টু-কি’ শোনা যায়। রুনু মুহূর্তে সাহস ফিরে পায়। শব্দ অনুসরণ করে যেতে যেতে বলে)

রুনু: খুব পাজি হয়েছিস। ঠিক ধরে ফেলব তোকে। এই তো।

(কেউ নেই)

রুনু: দাঁড়াও বের করছি তোমার চালাকি। (এদিক ওদিক খোঁজে। পায় না) বেরিয়ে আয় রানু। আমার ভালো লাগছে না। এবার আমি ঠিক চলে যাব। তখন বুঝবি।

(অন্যদিক থেকে রানুর ‘টু-কি’ শোনা যায়। এবার সাবধানী ভঙ্গিতে সেদিকে যেতে থাকে রুনু)

রুনু: এবার যদি দেখি… আমি কিন্তু… রানু রানু…

(নেপথ্যে হইচই। চমকে ওঠে রুনু)

রুনু: কে? অমন চেঁচাল কে? রানু রানু। আমি হারিয়ে যাচ্ছি রানু। (মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়ায় সে। উদ্ভ্রান্ত দেখায় তাকে। কোলাহল বেড়ে চলে। দু হাতে কান চেপে চোখ বন্ধ করে রুনু) রানু, রানু। আমি হারিয়ে গেছি। আর ফিরব না। রানু, তুই একা হেঁটে যেতে পারবি তো?

(ধীরে ধীরে বসে পড়ে। আলো কমে আসে। অল্প আলোয় মঞ্চে ঢোকে রানু। এসে দাঁড়ায় তার পাশে। দূরের দিকে তাকিয়ে বলে)

রানু: আমাকে ছাড়া ও চলতে পারে না দেবীদি। বারবার হারিয়ে যায়। ওর জন্যই তো আমাকে এখানে আসতে হল। আপনার কাছে। আমি ছাড়া ও… বারবার হারিয়ে যায়।

(পেছনে কোলাহল। হাততালির শব্দ। আলো নেভে)

 

ষষ্ঠ দৃশ্য

রুনু: আমি যদি ডলি হতাম, পলি হতাম, মলি হতাম, আমি যদি হেনাদির মতো তানপুরা নিয়ে গান শিখতে যেতাম রিক্সা করে, তবে এতদিন আমায় আর হারিয়ে যেতে হত না। দশমীর দিন সিঁদুর খেলে, লক্ষ্মীপুজোয় উপোস করে পরদিন দার্জিলিং চলে যেতাম। এরকম অন্ধকার রাতে ম্যালের ওপর আইসক্রিম খেতাম। তখন আমার দ্বিতীয়টা পেটে। (হাসে) কী সুন্দর নাচত রানু। গীতিনাট্য-নীতিনাত্য সব একেবারে এ-ক্লাস নাচত। জীবনদা বলেছিল ওকে নিয়ে আসানসোলে প্রোগ্রাম করবে। বাবা সেই শুনে রানুকে কী মারল!

(ফোন বাজার শব্দ। আলো সামান্য বাড়ে। রুনু কিছু একটা পড়ছে। না-তাকিয়ে ফোন ধরে)

রুনু: হ্যালো, বিলাসদা? কেমন আছেন? হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সব কটা চ্যানেলেই রোজ দেখছি আপনার কাজ কত কম। না না, স্ক্রিপ্ট পড়ছিলাম। খুব ইন্টারেস্টিং একটা টেলিফিল্মের কাজ। আমাকে নিয়েই। বিজয়দার ডিরেকশন। হ্যাঁ। কবে? এ বাবা। ওই সময় তো আউটডোরে যাব। ভীমতালে। ওই একটা হিন্দি সিরিয়ালের কাজে। ছোট কাজ। না না, তেমন কিছু নয়। ইস, একটু আগে বলবেন তো? হ্যাঁ, খুব বুঝেছি। আপনার সব কিছুই তো লাস্ট মোমেন্টে। এ মা, কী অসভ্য! (বেল বাজে) হ্যাঁ, বোনই মনে হয়। ঠিক আছে, রাখি? আমার রোল কিন্তু চাই-ই চাই। বা-ই।

(ফোন রাখে। ডাক্তারের এপ্রন পরে রানু ঘরে ঢোকে। স্টেথোস্কোপ নামায়)

রুনু: কী হল অপারেশনের? কোনও প্রবলেম হয়নি তো? বলছিলি খুব ক্রিটিকাল কেস…
রানু: জয়েন্ট সেক্রেটারির বৌয়ের অপারেশন, ক্রিটিকাল হবে না? একসময় তো দেখি প্রেশার পড়ছে হু হু করে। তখন মাথায় বুদ্ধিটা এল। সিমান্টা ক্রুসিয়ামায় একটা আলপিন ঢুকিয়ে দিলাম। হাইপেলাজিয়া শুরু হল। আমার জুনিয়র সঞ্জীব দেখছি হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমি নিচু গলায় বললাম, আ মোমেন্টারি ফ্লিকার, সঞ্জীব। এটা না থাকলে ডাক্তার হওয়া যায় না। (ওঠে) যা হোক, চিফ মিনিস্টার তো বলেই দিলেন, আজ কি টিভিতে আলপিনের উপকারিতা নিয়ে কিছু বলবেন? (হাসে) সাম সেন্স অফ হিউমার! … তুই কী পড়ছিস? নতুন স্ক্রিপ্ট?
রুনু: হ্যাঁ, কাল খুব ভোরে শুটিং। খুব ইন্টারেস্টিং স্ক্রিপ্ট, জানিস? আমারও এরকম মনে হয়। মানে আমার চরিত্রটা যা ভাবছে আর কী। আমি যদি রানু হতাম রুনু হতাম রিনা হতাম তাহলে আমি আজ একটা অন্ধকার ঘরে বসে আমার নারীজন্ম হারিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতাম।
রানু: এসব কাকে বলছে মেয়েটা? নিজেই নিজেকে?
রুনু: না, সঞ্জীবকে। বোঝাই যাচ্ছে এটা আমার ক্লোজআপ যাবে। খুব মন দিয়ে বলতে হবে।
রানু: হ্যাঁ, মাঝবয়সি মাগী-মাদের মাথা খাওয়ার মতো করে বলতে হবে।
রুনু: তোর ভাষা খুব বিশ্রী হয়ে গেছে রানু। এদিকে এত বড় ডাক্তার। যা, স্নান করে আয়।
রানু: কেন? তোর কোনও প্রডিউসার-ডিরেক্টর বাবু তোকে ফোন করবে নাকি? আমাকে সরাতে চাইছিস কেন?

(রুনু কিছু বলতে গিয়ে বলে না)

রানু: আমি স্নানেই যাচ্ছি। মালাকে বল আমার ড্রিঙ্কস দিতে। (ভেতর দিকে চলে যায়)
রুনু: আমি যদি পলি হতাম, রানু হতাম, জলি হতাম, রুনু হতাম তাহলে আমিও মালার মতো ড্রিঙ্ক এগিয়ে দিতাম। আমার বরও আমাকে ছেড়ে চলে যেত। … না, এটা না। (স্ক্রিপ্ট দেখতে দেখতে) ভেবে দেখুন সঞ্জীব, আপনি কিন্তু আগুন নিয়ে খেলতে চলেছেন। আমার ভেতরে আর কিছু নেই, শুধু পড়ে আছে অন্ধকারে কুঁকড়ে যাওয়া একটা মন। সঞ্জীব বলছে (উল্টোদিকে বসে) ‘ওই মনটাকেই তো আমি এক টুকরো আলোর রোশনাই দিতে চাই। আপনি আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন না রানু।’ … কাট ইট। নামটা রুনু। সেটাই বলুন। … ‘কেন? হোয়াট’স সো স্পেশাল অ্যাবাউট ইট? রুনু আর রানুতে ফারাক কী আছে?’ … আরে দাদা, ওই নামে সবাই ডলিদিকে আগে ডেকেছে। এখন হঠাৎ করে আপনি নাম পালটে দিলে তো হবে না স্যার। … তাছাড়া তাছাড়া (উত্তেজিত হয়ে রুনু নিজের জায়গায় এসে বসে) তাছাড়া রানু আর রুনুতে তফাত আছে। কী করে আপনি এ-কথা বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। সঞ্জীবে আর প্রদীপে তফাত নেই? দুটো তো আসলে আলাদা মানুষ। যেমন রানু আর রুনু— এক একটা নাম মানে তো এক একটা জীবন। এই ধরুন আমি আর আমার ছোট বোন রানু— আমাদের মধ্যে কোনও তফাত নেই, অ্যাঁ?

(রানু গ্লাস হাতে ঢোকে অন্য পোশাকে। হাসছে সে)

রানু: প্যাক আপ। রানু আর রুনুতে তফাত নেই বলছে কে?
রুনু: দ্যাখ না, সঞ্জীব বলছে। আমি বারবার বলছি…
রানু: কচু জানে তোর ওই সঞ্জীব। আমি বলছি ওকে— লিসন ইউ বাগার, রানু মানে সেইসব যা রুনু নয়, কক্ষনও হতে পারে না। আর…
রুনু: আর রুনু মানেও ঠিক তাই। যা কখনও রানু…
রানু: হবে না। হতে চায় না। এসব বুঝিয়ে বল তোর ওই সঞ্জীবকে। (মোবাইলে কল আসে) হ্যালো? হ্যাঁ, বলছি। … মনে হচ্ছে এলিবিয়ম ফোরসাটায় ইনফেকশন। তবে না দেখে বলা যাবে না। না, আমি পরশুই মেলবোর্ন যাচ্ছি। আমার জুনিয়র সঞ্জীবকে দেখিয়ে নিন। ও আমায় জানাবে। … দেখুন এটা তো আর পার্লামেন্টে বাজেট পেশ করা নয়, এটা হিউম্যান বডির ব্যাপার, যা পার্লামেন্টে পৌঁছনোর আগেই, যাকে বলে, বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়— হা হা হা। পনেরো তারিখ ফিরছি। বাই। (মোবাইল বন্ধ করে) শালা এমপির বৌয়ের অসুখ যেন মেডিক্যাল সায়েন্সের শেষ চ্যাপ্টার। … মালা, চাট কোথায়? আমার চাট?
রুনু: ওই তো চাট। এমন মাতলামো করছিস কেন?
রানু: (অদৃশ্য চাট খেয়ে) মাতলামো নয়, ইউ উওম্যান। আমার হাতের কাছে সব থাকবে। যেমন থাকে ওই ইডিয়েট গোট অব আ ডকটর জনার্দনের কাছে। শালা কী বোঝে ডাক্তারির? কিসসু না। পুরুষ বলে সব অন্যরকম, অ্যাঁ জনার্দন ভুঁইয়া? (মদ খায়) এদিকে আমাদের রইন্দনাথ, ইয়ে, বলেছে— নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবারে— শালা…
রুনু: রানু তুই এবার খেয়ে নে। শুয়ে পড়।
রানু: শাট আপ, উওম্যান। শোব কেন? কীসের সঙ্গে? তোর ওই সিরিয়ালের সঞ্জীবের সঙ্গে? অ্যাঁ? শালা আধমাগী। আমি যাব অস্ট্রেলিয়া। শোব আমার পছন্দের পুরুষের সঙ্গে। এড লারকিন্স। ওঃ, কী পুরুষ, পুরুষ! ষাঁড়ের মতো গোঁয়ার, ঈশ্বরের মতো উদাসীন আর… আর (উঠে দাঁড়ায়) ব্যাচেলর।
রুনু: ব্যাচেলর? এড লারকিন্স? কিন্তু তুই বলেছিলি ওর একটা বৌ আর দুটো বাচ্চা আছে!
রানু: ছিল। বৌ বাচ্চা সব ছিল, এখন নেই। আমার কাছে ব্যাচেলর মানে তাই— সব ছিল, কিছু নেই। সেখানে আছি আমি। রানু। আমি শাসন করছি তাকে। গলে যাচ্ছি তার কাছে। আবার উদাসীন বরফ হয়ে যাচ্ছি তার কাছে। এরই নাম— ইয়ে— নারীকে আপন ইয়ে— জয় করিবারে… (মাতাল। হোঁচট খেয়ে সামলায়)
রুনু: আমি কতদিন ভেবেছি সঞ্জীব কোথায় আছে সে পুরুষ যার কাছে আমি নতজানু হয়ে বসে থাকব। অপেক্ষায় হয়ে থাকব প্রোষিতভর্তৃকা।
রানু: শাট আপ। (এগিয়ে যায় ঘর ছেড়ে বেরোনোর জন্য) এড লারকিন্স সেই পুরুষ। আমার পেশেন্ট ছিল অ্যাডেলাইড হসপিটালে। আমার পুরুষ— আমার পেশেন্ট। হা হা হা। জানিস এর মানে কী? জানিস না। এর মানে হল নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারে…  হা হা হা… (হঠাৎ পড়ে যায়। আর্তনাদ করে) আঃ!
রুনু: (উঠে দাঁড়ায়) এ কী হল সঞ্জীব? হঠাৎ আপনার…

(এগিয়ে যায় রানুর কাছে। রানু কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ মুখে হাসি আনে রুনুর)

রুনু: আর চিন্তা নেই। সব ঠিক হয়ে গেছে। সব। ওঠ রানু, (হাত বাড়ায়) আমার হাত ধর। আমার হাত ধরুন, ডক্টর। আমি রুনু বলছি। মেট্রন রুনু।
রানু: (উঠতে উঠতে) আমার কী হয়েছিল মেট্রন? আমি কি— মানে— ড্রাঙ্ক— মানে উল্টোপাল্টা কিছু বলেছি? কী হয়েছিল?
রুনু: একটা ব্ল্যাকআউটের মতো। সারাদিন না খেয়ে থাকলে যা হয়, আপনাকে তো আগেও বলেছি সার। কিন্তু আপনি তো কথা শুনবেন না।
রানু: কথা তো আমার কানে পৌঁছয় না মেট্রন। শুনতে চাইলেও শুনতে পারি না। তার আগেই নেশা হয়ে যায়। আর সেই নেশার চোখে আমি পেরিলিয়াম সোংটাকা দেখি। ঘুমিয়ে পড়লে দেখতে পাই বড় একটা অপারেটিং থিয়েটার। আমার পেশেন্টের পেটটা কাটতে গিয়ে দেখলাম সেখানে একটা আয়না ঢোকানো আছে। আয়নায় আমি দেখলাম নিজেকে। শুঁটিয়ে যাওয়া এক বুড়ির মুখ। আর আমার পেশেন্ট কে জানেন? আমার বোন রুনু, মেট্রন। রুনু!
রুনু: আমি চিনি রুনুকে। অ্যাকট্রেস তো? ওই সেদিন একটা সিরিয়াল দেখলাম ‘নারীকে আপন ভাগ্য’— সেটায়।
রানু: বালের অ্যাকট্রেস! ওরকম অ্যাকট্রেস রাস্তায় পড়ে আছে কত। প্রোডিউসারগুলো এক-একটা বুড়ো বাঘ, জানেন মেট্রন? (মেট্রনকে নিজের দিকে টানতে থাকে) একেবারে আষ্টেপৃষ্টে সাপটে ধরবে ওদের। তারপর একেবারে অজগরের মতো… (আরও কাছে টানে রুনুকে। মুখে তীব্র ভায়োলেন্স) অজগরের মতো… গিলবে… গিলে খেয়ে নেবে।
রুনু: (চটুল হাসি মুখে) কীসের মতো গিলবে? বাঘের মতো? না অজগরের মতো?
রানু: (টেনে নিয়ে যেতে থাকে খাটের দিকে) বাঘের মতো। চলো।
রানু: (যেতে যেতে) তবে যে বললে অজগরের মতো?
রানু: না, অজবাঘের মতো। (দুজনে খাটের ওপর বসে পড়ে) আগেরবারই বলেছিলাম, ওসব সঞ্জীব-ফঞ্জিব কাটাও। তোমাকে আইদার প্রোডিউসার অথবা ডিরেকটরের সঙ্গে থাকতে হবে।
রুনু: (শুয়ে পড়ে) থাকতে হবে মানে?
রানু: না, ওটা না। ওঠো।
রুনু: ওটা না মানে কী বিলাসদা? আমি তো জানতাম ওটাই।
রানু: ভুল জানতে। অনেক আগে জানতে। (ওকে বিছানা থেকে তুলতে তুলতে) বিজয়ের সঙ্গে জানতে। আমি বিলাস। তুমি বিজয়কে ভুলে যাও। (ইশারা করে সামনে আসতে) আমার ছবির শুটিং সামনের মাসে শুরু হবে, তুমি হিরোইনের দিদি, অনেকদিনের কাজ। সঞ্জীব তোমার হাজব্যান্ডের রোল করবে। প্রথমে তো রাজি হচ্ছিল না। বলছিল, দূ-র। ওর কোনও বক্স নেই। আপনি রানুকে নিন বিলাসদা।
রুনু: শুয়োরের বাচ্চা। (নেমে এসে রানুর সামনে দাঁড়ায়) বলুন কোনটা?

(রানু হাসতে থাকে। রুনু ধীরে ধীরে বসে পড়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে। পেছনে তারই গলায় গান ফেড ইন করে— ‘আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার…’। তাকে ছাপিয়ে শোনা যায় রানুর হাসি)

 

সপ্তম দৃশ্য

(দুই বোন চোর-চোর মুখে বসে আছে। লাবণ্য সামনে উত্তেজিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে)

লাবণ্য: আপনাদের ওপর নির্দেশ ছিল বাইরে না যাওয়ার, আপনারা গেছেন। গীতাদি বারবার বলেছিল ব্যাটাছেলেদের এড়িয়ে যেতে। আপনারা সে-কথা শোনেননি। গী–তাদির কথা শোনেননি! একবারও ভাবেননি যে হারিয়ে যেতে পারেন রাস্তায় বা ব্যাটাছেলেদের লোভে। একবার হারিয়ে গেছিলেন, মনে ছিল না! কী কষ্ট করে যে আমরা মানে গীতাদি আপনাদের ফিরিয়ে এনেছিলেন/ছিলাম মনে নেই! কত কষ্ট করে তবেই না আমরা আপনাদের জন্য রাস্তা বেছে দিয়েছি। কিচ্ছু মনে নেই! ফাস্টেটিং!

(রানু-রুনু একে অন্যের দিকে তাকায়। লাবণ্যের ফোন আসে)

লাবণ্য: হ্যালো, আমি লাবণ্য। (উল্টোদিক থেকে জড়ানো গলায় বাজে ঠাট্টা শোনা যায়। মাগী কথাটা বোঝা যায়) তোর বাপকে গিয়ে বল না শুয়োরের বাচ্চা। তোর বাপ মাগী। চোদ্দগুষ্টি মাগী।

(ফোন বন্ধ করে লাবণ্য। অপমানটা সহ্য করে নেয়। রানু-রুনু উঠে গিয়ে দুপাশে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রাখে)

লাবণ্য: আমাকে তো বাইরে যেতেই হবে। সবাইকে আনতে আর নিয়ে যেতেই হবে। বাঁচতে দেবে না। আমি আমার মতো বলে বাঁচতে দেবে না। বাচ্চাগুলোকে পেছনে লাগিয়ে দেয়। বলে মাগী মাগী বলে চেঁচাতে। আমি মাগী হলে তো একভাবে মরতাম! বেশ হত। … এভাবে ওরা বাঁচতে দেবে না।

(নেপথ্যসঙ্গীত। দৃশ্য শেষ)

 

অষ্টম দৃশ্য

(মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রের ঘর। বিশেষ ইউনিফর্ম পরে রানু বসে আছে সামনে তাকিয়ে। রুনু এক কোণে দাঁড়িয়ে। মৃদু আলো। লারাস থিম বাজবে প্রলম্বিত সুরে। রুনু নিচে লেখা গানটা গাইতে গাইতে চলে আসে সামনে)

রুনু: বসন্তের হাওয়ায় কী মনে পড়ে যায়/কী ছিল আগে কী আছে কোথায়?

(এক স্বপ্নিল আলোর মধ্যে যেন আলতো পায়ে হারিয়ে যায় রুনু। রানু একইভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আলো বাড়ে। রানু একই দিকে তাকিয়ে কথা বলতে থাকে)

রানু: ১২বি নির্মল বাজার স্ট্রিট কোথায় আমি জানি না। এরা বলছে সেখানে আইবুড়ি মেয়েরা ছিবড়ে হয়েও বাঁচতে পারবে। আমাদের ছুটি। আজ আমাদের ও-বাড়িতে নিয়ে যাবে। ও-বাড়িতে জানলা থাকবে। সেই জানলা খোলা যাবে সকাল-সন্ধেবেলা। রুনুর জন্যে। ওর জানলা দেখার বাতিক আছে। আমার সেরে গেছে। কিন্তু ও যদি সত্যি জানলা খুলে বাইরে তাকাতে পারে, আমার খুব ভালো লাগবে। তখন আমি ওকে দেখব। ওর মুখে গলায় এখনও আঁচড় পড়েনি। তাই ও বাইরে তাকালে ওকে সুন্দর লাগবে।

(উঠে দাঁড়ায়। আরও সামনে এগোয়। চোয়াল শক্ত। মুখে হিংস্রতা ফুটে ওঠে)

রানু: ইস, আমি যদি ওর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারতাম। (হাসে) তারপর না হয় জগাইমাধাইধানাইপানাই যা ইচ্ছে হত। এছাড়া তো আর কিছু করতে পারতাম না আমি। আমি কি বৌবাজার ঢাকুরিয়ায় লম্বা মিছিল দেখাতে দেখাতে বলতে পারতাম, দ্যাখ রুনু, আমাদের মিছিল, আমাদের ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে কোথায়। চলে যাচ্ছে লাইব্রেরিতে, হুশ চলে যাচ্ছে সভায়, হুশ চলে যাচ্ছে নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারে। আমি কি বলতে পারতাম, যে শুয়োরের বাচ্চাটা অটোয় যেতে যেতে তোর এক খাবলা খেয়ে নিয়ে যায়, তার বিচি দু হাত দিয়ে খিঁচে ধর। মারুক, কত মারবে? তুই কিন্তু ছাড়বি না। দেখবি এক সময় মার বন্ধ হয়ে যাবে। কেতরে পড়ে থাকবে তোর রক্ত মেখে। ওই রক্তেই জন্ম শালা বেজন্মার।

আমার যদি মেয়ে হত আমি বলতাম, মার। মারতে শেখ। অন্যে মেরে তোকে পাগল বানাবে, নিজে পাগল হলে আবার সুস্থ হয়ে ফিরে যাবে মর্দাদের দুনিয়ায় মর্দার মতো। তুই তো পারবি না। আমার যদি ছেলে হত, আমি বলতাম, একটু মেয়ে হতে শেখ বাবা, তাহলে কটা সঙ্গী পাই। এমনিতে কেউ কোথাও নেই তো। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটলে শুধু নিজের মাংসের ভয় করবে। অপণা মাংশেঁ হরিণা বৈরী!

মাংস না থাকলে কী থাকবে রে? তোর কী আছে? নেই তো কিছু! তাই তো হাত আর দাঁতের সঙ্গে বাড়তি একটা মাংসের টুকরো, ভেতরে পেশি আছে। সেটা দাঁড় করাতে লেগে যায় নায়াগ্রা ভায়াগ্রা কত কিছু। আর যে রেপ করে, যারা যারা করে, তারা তো এমনি এমনি খায়! আমাদের ভয় ওদের ভায়াগ্রা, যন্ত্রণার চিৎকার ভুটানি তেল।

আজ আমাদের ছুটি। এখন আসবে সেই ছেলেটা যে আসলে সেই মেয়েটা। ওকেও মেরেছে, না? নিশ্চয়ই মেরেছে। দাড়ি-গোঁফ আছে, তবুও মেরেছে। আহা, মারবে না? কিছুটা তো আমাদের মতোও আছে, (নারীভঙ্গিতে হাঁটে) না? তাই নিয়ে দু-খাবলা। (হাসতে থাকে) আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি— ছুতি ছুতি… (বাচ্চা মেয়ের মতো লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে যায়)

(আলো কমে আসে। আবার সেই স্বপ্নিল আলো। রুনু ঢোকে)

রুনু: আহা রে আমার নতুন বাড়ির জানলা! আহা রে আমার ফেলে আসা রাস্তাঘাট, আমার মা। উলটো দিকের বারান্দায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে এখনও রাজাদা সিগারেট খায়? ওকে আমার খুব ভালো লাগত। আমাকে আবার পড়া শুরু করতে বলেছিল। বই দিয়েছিল কটা যেন। এটা কেউ জানে না, দিদিও না, ও আমাকে মনোরমা স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিল ক্লাস ইলেভেনে। ফ্রি করে দিয়েছিল সব। আমি অবশ্য স্কুলে আর যেতে পারিনি। রাজাদা জানতে পেরে গিয়েছিল। এরপর একদিন ও আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমাকে দেখে আর বারান্দা থেকে একগাল হাসত না রাজাদা।

ও জানতই না আমি ওর জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। পাড়ার পুজোয় আমি কবিতা আবৃত্তি করতাম। একসময় রাজাদা এসে দাঁড়াত। শুনত মন দিয়ে। আমাকে একবার বলেছিল, বাঃ! তুই শক্তির কবিতা পড়িস! এরা তো সব রইন্দনাথ-নজরুল-সুকান্ত নিয়েই পড়ে আছে।

সে-বছর আমি শক্তির কোন কবিতা পড়েছিলাম, মনে নেই। কিন্তু ষোলো বছর বয়েসে আমি ওই ঠোঁট-বেঁকা রাজাদার দিকে তাকিয়ে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে তাকিয়ে, আবৃত্তি করেছিলাম— ‘আমার কাছে এখনও পড়ে আছে/ তোমার, প্রিয়, হারিয়ে যাওয়া চাবি/ কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো?’ তুমি আজ কেমন করে তোরঙ্গ খোলো, রাজাদা? কেউ কি বিশ্বাস করবে যদি বলি, সত্যি আমি তোমার থুতনির তিলটার দিকে তাকিয়েই আবৃত্তি করেছিলাম? ষোলো বছরে বুক ধড়াস করে কাঁপে। তুমি যখন হাততালি দিচ্ছিলে আমার মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে হার্টটা! কী লজ্জার ব্যাপার হবে সেটা। স্টেজ থেকে নামার পরে তুমি মাথায় দুটো টোকা দিয়ে বলেছিলে, কিন্তু আব্বৃত্তি বলবি না, বলবি আবৃত্তি! কী বলবি?

আমার হাত-পা তখন নিথর। ফিসিফিসফিসে গলায় বলেছিলাম, আবৃত্তি। আবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি। আমি কাঁপতে কাঁপতে একটু এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলাম বুড়ো ছাতিমগাছটার নিচে। তোমার ছোঁয়া বিবশ করে দিয়েছিল আমাকে। আমি বারবার বলছিলাম, আবৃত্তি আবৃত্তি…

কিন্তু পরের বছর আমি তো আর স্কুলে যাইনি। তাই তুমি আমার আবৃত্তি শোনোনি। আমি অনেক যত্ন করে শিখেছিলাম, তোমার কথা শুনতে পারিনি বলে শিখেছিলাম, কোনওদিন শুনতে পারব না বলে শিখেছিলাম, অনেক হয়েছে সন্ধ্যা, সারাদিন ভেঙেছ পাথর। (পুরো কবিতা)

বলেছিলাম, যে-কথা বলোনি আগে এ-বছর সেই কথা বলো!

আমি তোমার পায়ের কাছে বসে বলেছিলাম। একমাত্র আমরাই বলতে পারি ওভাবে। আমরাই বলতে পারি, যে-কথা বলোনি আগে…

কিংবা হয়তো তুমিও বলতে পারতে। কিন্তু কিছু না বলে তুমি অন্ধকার হয়ে ছিলে।

আমার পক্ষে পড়াশুনো করা সম্ভব হত না রাজাদা। তুমি শুধু এটা বোঝোনি। আমার বাড়িতে তো তুমি আসতে না। বাবার কাছে আসত মনু, বাদল, তারকরা। ছোট লাল-সবুজ প্যান্ট পরে ওরা তাস খেলত, মদ খেত, আর বারবার বাথরুমে গিয়ে মেঝে নোংরা করে হিসি করত। দিদিকে দিয়ে বাবা চাট পাঠাত। ভেবেছিল, এভাবেই ওর বিয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু সেসব কিছু না হয়ে আমার বোকা দিদিটা ছিবড়ে হয়ে গেল।

আমি আর মা বারান্দায় বসে থাকতাম। মা ঘ্যানঘেনে গলায় বলত, অরা কিছু দিল?

‘কিছু’ মানে টাকা। মা সবসময় টাকার কথা ভাবত। পাড়ার ফাংশানে কে দেবে টাকা?

তুমি এটা বোঝোনি রাজাদা।

কিন্তু সেসব ঠিক আছে। এবার বেরিয়ে আমি তোমার কাছে যাব। আবার বলব, এ-বছর সেই কথা বলো! আমি সেরে গেছি রাজাদা। নতুন বাড়িতে গিয়ে একটু গুছিয়ে নিয়েই আমি তোমার কাছে যাব। তারপর কী হবে আমি জানি না।

(নেপথ্যে ফাগুন দিনের হাওয়ায়…)

কিন্তু আমার একটা জানলা তো থাকবে। দিদি, এই দিদি, জানলা থাকবে না আমার?

(রানু হাসিমুখে ঘরে আসে। জড়িয়ে ধরে তাকে)

রানু: সব থাকবে। এমনকি জানলা দিয়ে রোদ পড়বে আমাদের ঘরে। জাফরি-কাটা রোদ, বুঝলি তো?
রুনু: আমরা সেরে গেছি। তাই না দিদি?
রানু: হ্যাঁ রে, পাগলি! আর তাই তো আমরা ফিরে যাচ্ছি। শুনলি না সেদিন লাবণ্য বলল, আপনাদের ওখানে গিয়ে আমিও মাঝেমধ্যে থাকব, বুঝলেন? মেয়েতে মেয়েতে অনেক শান্তি, জানেন? না, জানেন না।
লাবণ্য: (নেপথ্যে) না, জানেন না। আপনারা হলেন মেয়ে আর আমি মাগি!

(এক কোণে লাবণ্যকে দেখা যায়। যেন প্রার্থনা করছে)

লাবণ্য: নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারে যা দিয়েছ/ মাগিদের তা দিলে না কেন?/ দাড়ি-গোঁফ, আধখানা যৌন-অঙ্গ সব দিলে ফ্রি-তে/ শুধু শালা বানচোদ, বর্মখানি ভুলে গেলে দিতে।

(রানু-রুনু লাবণ্যের কাছে যায়। তাকে দু হাত ধরে তোলে। দাঁড়িয়েই লাবণ্য পেশাদার ভঙ্গিতে বলতে থাকে)

লাবণ্য: আপনারা সম্পূর্ণভাবে তৈরি চেনা পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য। আবার সেই সুন্দর আলো, মুক্তির আনন্দ, আর গেরস্থালির সেই মিইইষ্টি দুনিয়ায়। মনে রাখবেন, দেবীদি-গীতাদি সবাই বলেছেন, সব মিছিল আমাদের জন্যে। চলুন বন্ধুরা, আজ আপনাদের নিয়ে যাই, সেই আশ্চর্য সুন্দর মুক্ত পৃথিবীতে! (ফোন আসে) হ্যালো, হ্যাঁ গীতাদি, আমরা সব রেডি। ট্যাক্সিও এসে গেছে।

(তিনজন এগিয়ে যায়। নেপথ্যে, ফাগুন দিনের হাওয়ায়…)

আলো নেভে। মঞ্চ অন্ধকার। আলো জ্বললে নাটকটা আবার শুরু হয় নাটকের একদম প্রথম থেকে। যেমন হওয়ার কথা। অথবা শুরু নাও হতে পারে। এটাই শেষ হতে পারে।


*এই নাটক অভিনয় করতে চাইলে লেখকের লিখিত অনুমতি দরকার

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...