এক জটিল বিজ্ঞান এবং এক ভয়াবহ ইতিহাস

সীমন্তিনী ঘোষ

 


শিক্ষক, অশোকা ইউনিভার্সিটি

 

 

 

মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে জনস্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় কোনও সম্যক ধারণা তৈরি করা যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লুএইচও-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানসিক সুস্বাস্থ্য কেবলমাত্র মানসিক অসুস্থতার অনুপস্থিতি নয়। সুস্থ কর্মঠ জীবনযাপন, গোষ্ঠীগত জীবনে অবদান রাখতে পারা এবং নিজের জীবনের সার্বিক বিকাশ, এর সবকটিই মানসিক সুস্বাস্থ্যের নির্নায়ক। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী রাষ্ট্রসঙ্ঘের চার্টারে মানবাধিকারের তালিকার অন্তর্ভুক্ত অনেকগুলি অধিকারই মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। গ্রাসাচ্ছাদনের সুরক্ষা, নিরাপদ এবং সুলভ আশ্রয়, কর্মসংস্থানের যথাযথ বন্দোবস্ত এবং নিশ্চিত পারিশ্রমিক, শিক্ষাক্ষেত্রে সমান সু্যোগ ও সুবিধা প্রাপ্তি, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিষেবা, ভেদাভেদহীন সামাজিক ব্যবস্থা— প্রত্যেকটিই মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্যে জরুরি। কিন্তু যে কটি বড় আকারের সমীক্ষার তথ্য বর্তমানে উপলব্ধ, তার প্রত্যেকটি থেকে দেখা যায়, এই দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের নির্ণায়ক, মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পৃক্ত সচেতনতা এবং মানসিক অসুস্থতা— প্রত্যেকটিরই অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চ, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া এবং জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ইন্ডিয়া স্টেট-লেভেল ডিজিজ বার্ডেন ইনশিয়েটিভ-এর পক্ষ থেকে বিখ্যাত ল্যান্সেট সাইকায়াট্রি পত্রিকাতে প্রকাশিত একটি বিস্তারিত গবেষণাপত্র অনুসারে, ১৯৯০ থেকে ২০১৯ অবধি মানসিক ব্যাধিজনিত প্রতিবন্ধকতায় কাটানো বছরের সমষ্টিগত পরিসংখ্যান ২.৫ শতাংশ থেকে প্রায় দু গুণ বেড়ে ৫ শতাংশের কাছাকাছি হয়ে গেছে। এই গবেষণা সম্পর্কিত তথ্য আন্তর্জালে উপলব্ধ, এবং একটি ভিশুয়ালাইসেশন ওয়েবটুলের মাধ্যমে অনেক তথ্য সহজে বোঝা যায়। এই ওয়েবটুলের মাধ্যমে তৈরি এই চিত্রকল্পে দেখা যাচ্ছে ১৯৯০ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে ভারতে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে মানসিক অসুস্থতার দরুণ হৃত সময়ের নিরিখে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে।

২০১৯ সালে প্রত্যেক ৭ জন ভারতীয়র মধে ১ জন মানসিক ব্যাধির কবলে। ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, এই দেশে ১৩-১৭ বছর বয়স্ক কিশোর-কিশোরীদের মানসিক ব্যাধির ঝুঁকি অত্যধিক। এবং এই রিপোর্টের আরেকটি অত্যন্ত শঙ্কামূলক তথ্য হল, বয়স বা ব্যাধির প্রকারভেদে, রাজ্যনির্বিশেষে মানসিক ব্যাধির জন্যে যা পরিকাঠামো বা কর্মীর প্রয়োজন, তার ৮৫-৯২ শতাংশ অনুপস্থিত। অথচ কাগজে-কলমে ১৯৮২ থেকে প্রত্যেক রাজ্য, জেলা ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরিকাঠামো, ডাক্তার, নার্স বা আধিকারিক নিয়োগের প্রকল্প স্বাস্থ্যপরিষেবার অন্তর্ভুক্ত।

 

মানসিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা জানেন, যে বয়ঃসন্ধি মানসিক স্বাস্থ্যের নিরিখে একটি অত্যন্ত জরুরি ও সংবেদনশীল সময়। আজীবন মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে শৈশব এবং বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ভারসাম্য অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। মানসিক স্বাস্থ্যের আলোচনায় যাওয়ার আগে, একবার দেখে নেওয়া যাক, আমাদের দেশে অনূর্ধ্ব-১৮ জনসংখ্যা কেমন। ২০১১ আদমশুমারি অনুযায়ী ২৫.৩ কোটি ভারতবাসী বয়ঃসন্ধিস্থলে। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি। সংযুক্ত রাষ্ট্রের ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, যুব জনসংখ্যার নিরিখে, ভারত চিনের থেকে এগিয়ে, এবং বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে— আমাদের দেশে ৩৫.৬ কোটি মানুষের বয়স ১০-২৪ বছরের মধ্যে। ২০১৯ অবধি উপলব্ধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই দেশে কিশোরবয়সীদের ৭.৩ শতাংশ বিভিন্ন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই সময়ের মানসিক স্বাস্থ্যের নিরিখে যা দরকার, তা শৈশব এবং প্রাপ্তবয়সের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিকাঠামোর থেকে একদমই আলাদা।

পরিপূর্ণ জীবনের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো, সদ্যজাগ্রত সামাজিক বোধ, নিজের যৌনপরিচিতি এবং যৌনচিন্তার উন্মেষ, পুথিগত বা প্রথাগত শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত মূল্যবোধগুলির সঙ্গে পারিপার্শ্বিকের সাযুজ্য হাতেনাতে ঝালিয়ে নেওয়ার প্রবণতা— এই সমস্ত মিলিয়ে বয়ঃসন্ধি এমনিতেই একটি অত্যন্ত টালমাটাল সময়। এই সময়ে মানুষের মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে না। মস্তিষ্কের অগ্রভাগ, যা আমাদের যুক্তিপূর্ণ মতামত বা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, ১৩-৩০ বছরের মধ্যে এই ফোরব্রেনের আয়তন এবং কোষগুলির মধ্যে যোগাযোগ দ্রুত হারে বাড়তে ও পরিবর্তিত হতে থাকে। আজ থেকে দু দশক আগেও ভাবা হত মস্তিষ্কের বিকাশ ১৮-২১ বছরের মধ্যে পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ফাংশনাল এমআরআই জাতীয় গবেষণাপদ্ধতি যত উন্নীত হয়েছে, তত বোঝা গেছে, ৩০-৩২ বয়স অবধি মস্তিষ্কের অগ্রভাগের সঙ্গে বাকি অংশগুলির যোগাযোগ সম্পূর্ণ হয় না, সমানে চলতে থাকতে বিভিন্নরকম যোগাযোগের ভাঙাগড়া। বস্তুত সমস্ত জীবজগতের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক আলাদা, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক আজীবন শিখতে পারে, এবং পারিপার্শ্বিকতার নিরিখে আজীবন নিজেকে বদলাতে পারে, সে জৈবক্রিয়ার নিরিখে হোক, বা মস্তিষ্কের কোষগুলি যেভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, সেই সংযোগস্থলগুলিকে পালটে ফেলে হোক। এই থেকেই উৎপত্তি হয় মানুষের ব্যবহারের তফাতের।

মানুষের ব্যবহার এমন বিপুলভাবে ব্যাপৃত, এবং এত বহুধাবিভক্ত যে কোন ব্যবহার স্বাভাবিক, আর কোন ব্যবহার অস্বাভাবিক, বা মানসিক ব্যাধি বলতে আসলে কী বোঝায়, এই নিয়েই মনস্তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিপুল দ্বন্দ্ব আছে। ১৯৭৩ সালে ডেভিড রোজেনথালের একটি লেখা মনস্তত্ত্ববিদ মহলে বিপুল জনপ্রিয় হয়। “On being Sane in Insane places” নামক এই লেখাতে রোজেনথাল দাবি করেন যে “মানসিক ব্যাধি” শব্দবন্ধটি ভিত্তিহীন। বস্তুত মনস্তত্ত্বের কারবার মানুষের ব্যবহার নিয়ে। ব্যবহার এবং মানসিকতা এতই বিপুলভাবে ব্যাপ্ত একটি সম্ভার যে তার মধ্যে কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা অস্বাভাবিক তা যাচাই করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব, এবং অনৈতিক। অসুখের ছাঁচে ফেলে স্বাভাবিক ব্যবহারকে অসুস্থ দাবি করে, অত্যাচার করে “সারিয়ে” তোলার নিদর্শনও মনস্তত্ত্বে ভুরি-ভুরি আছে। প্রথমেই বলা যায়, “হিস্টিরিয়া” শব্দটির প্রয়োগে অসংখ্য মহিলার চরম দুর্দশার কথা। চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটিসের আবিষ্কৃত এই শব্দের উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিক শব্দ হিস্টেরস বা জরায়ু (ইংরেজিতে ইউটেরাস) থেকে। আজকে যাকে সোমাটোফর্ম ডিজর্ডার বলা হবে, ভাবা হত, এই ধরনের উৎকণ্ঠা/অবসাদ-জনিত অস্বাভাবিক ব্যবহার কেবল মহিলাদের মধ্যেই দেখা যায়, এবং তার কারণ হিসেবে ভাবা হত, ঔরসহীন জরায়ু শরীরের মধ্যে ক্রন্দনরত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরসনের রাস্তা ছিল বিবাহ এবং সন্তানসূচনা, অথবা অত্যন্ত কড়া রাসায়নিক ব্যবহার করে যৌনাঙ্গের শুদ্ধিকরণ। রোগী অনেক সময়েই এমন চিকিৎসার ‘সুফল’ ভোগ করার জন্যে বেঁচে থাকতেন না। ইতিহাসের প্রারম্ভ থেকে ১৯৭০-৮০র দশক অবধি বিশ্ব জুড়ে মহিলারা এই একটি শব্দের বহুবিধ খেসারত দিয়েছেন। ১৯৭৩ অবধি সমকামিতাকে একটি মানসিক ব্যাধি বলে ডাক্তারি পরিভাষায় ভাবা হত, এবং কনভার্শান থেরাপি নামক একটি আদ্যোপান্ত বর্বরোচিত পদ্ধতিতে একে সারিয়ে তোলা যায়— ডাক্তারি মহলে এরকম ধারণা বহুল প্রচলিত ছিল। এর খেসারত দিয়েছেন বহু মানুষ, অপর-যৌনতার মানুষ। এখনও, জনগণের একাংশ সমকামিতাকে একটি রোগ বলে মনে করে থাকেন। বস্তুত, মানসিক “রোগ” বিষয়টি আদতে অত্যন্ত ঘোরালো। প্রথমত কোন ব্যবহার যে অস্বাভাবিক এবং চিকিৎসাযোগ্য তার সংজ্ঞা স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক নয়। এক দশক আগেও অটিজমকে একবারেই অসুখ বা ডিজর্ডার ভাবা হত। গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেছে, প্রথমত, অটিজম যাকে বলা হয়, সেটি একটি স্পেকট্রাম, যার মধ্যে নানা ব্যবহারিক রকমফেরের মাত্রাগুলি আলাদা। আরও দশ বছরের মধ্যে বোঝা যাচ্ছে যে এগুলি সম্ভবত অসুখ নয়, মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে গৌণ একাধিক প্রকারভেদ মাত্র।

 

মানসিক ব্যাধি ও তার চিকিৎসা, দুইয়ের ইতিহাসেই কিছু ভয়াবহ অধ্যায় আছে, যার উৎপত্তি উনিশ শতকের শেষদিকের বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষের মধ্যে। ডারউইনের বিবর্তনবাদের হাত ধরে জন্ম নেয় সামাজিক বিবর্তনবাদ— যদিও এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। সেই যুগের বিজ্ঞান, ও চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিতরা নিজেদের বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতায় চূড়ান্ত আস্থা রেখে বুদ্ধি, বিদ্যালাভের উপযোগিতা, সামাজিক কর্তব্যের দায়ভার নেওয়ার ক্ষমতা সব কিছুর শিরোপা শ্বেতাঙ্গ পুরুষের মাথায় তুলে দেন। গ্যাল্টন, ফিশার, পিয়ার্সন প্রভৃতি অতলান্তিক মহাসাগরের দুইদিকেই গড়ে তোলেন বিজ্ঞানের ভয়াবহ এক অবদান— ইউজিনিক্স। বিজ্ঞানের আড়ে ভয়াবহ জাতিবিদ্বেষ এবং নারীবিদ্বেষ, দুইয়েরই প্রবল বিকাশ ঘটে এই সময়ে। হয়তো সেই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শাসনকে ইতিহাসে বৈধ প্রতিপন্ন করতে এই শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বিবর্তনের শিখরে বসে থাকার যুক্তিকে জনমানসে গেঁথে দেওয়ার প্রয়াস দরকার হয়ে পড়েছিল। অ্যাঞ্জেলা সাইনি তাঁর দুটি বইতে লিখেছেন এই দুই বিদ্বেষকে বিজ্ঞানের আড়ে আপামর জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার ইতিহাস— সুপিরিয়র (বর্ণবিদ্বেষ এবং ইউজিনিক্সের ইতিহাস) আর ইনফিরিয়র (বিজ্ঞানের অপব্যাখা করে নারীবিদ্বেষকে জনসাধারণের মধ্যে চারিয়ে দেওয়ার ইতিহাস)। ইউজিনিক্সের চুড়ান্ত বিষোদ্গারণ ঘটে নাৎসি জার্মানির নানা পৈশাচিক প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দু-তিন দশকে বিশেষ করে মনোবিজ্ঞ্রানীরা ব্যবহারের জৈবিক ব্যাখা করার প্রবণতা থেকে দূরে সরে থাকেন। ১৯৫২ সালে ওয়াটসন-ক্রিকের ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার করার হাত ধরে গবেষণাক্ষেত্রে মস্তিষ্কপ্রসূত নানা প্রণালী, মানুষের ব্যবহারের নানাদিকের সঙ্গে জিন বা নানা রাসায়নিকের সরাসরি সংযোগ নিয়ে উৎসাহ ফের বাড়তে থাকে। এই সময়ের জীবন-বিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে উঠে আসে ওয়ান জিন ওয়ান প্রোটিন হাইপথেসিস— যে, একটি প্রক্রিয়ার জন্যে একটি জিন দায়ী। কিন্তু যে কোনও ব্যবহারকে এত সরলভাবে একটি জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া দিয়ে বোঝা যাবে কিনা, এই নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের একাংশ সব সময়েই সন্দিহান ছিলেন। ৩০-৪০ বছরের সমূহ গবেষণার পরেও মানসিক ব্যাধির সরাসরি জেনেটিক ব্যাখ্যা ধোঁয়াটে রয়ে যায়। বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজমের প্রবক্তারা অবশ্য কখনওই চুপ করে থাকেননি। বিশেষ করে অ্যালসহাইমার ডিজিজ বা পক্ষাঘাতের মতো সরাসরি মস্তিষ্কের রোগের গবেষণার উন্নতি, ও বিশেষ করে কিছু জেনেটিক মিউটেশন আবিষ্কারের পরে বিহেভিওরাল জেনেটিক্সের গবেষণায় নতুন উদ্যমে আবার শুরু হয় মানসিক রোগের জৈবরাসায়নিক এবং জেনেটিক ব্যাখা খোঁজা। ১৯৫০-৬০-এর দশক থেকে প্রথম মানসিক রোগে ব্যবহৃত ওষুধ থোরাজিনের আবিষ্কারের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বহুজাতিক ওষুধের কোম্পানিগুলিও ধীরে ধীরে গবেষণায় বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করতে শুরু করে। জেনেটিক ব্যাখা না পাওয়া গেলেও, ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে মনোরোগের বিভিন্ন ওষুধ। জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো বোঝা যায় যত, তত ডাক্তার ও গবেষকরা বুঝতে থাকেন, মনোরোগ বা যে কোনও সাধারণ ব্যবহার কখনও একটি মাত্র জিন বা রাসায়নিক প্রণালীর পরিণাম হতে পারে না। নিদর্শন হিসেবে, অবসাদ বা ডিপ্রেশনের ৭-৮ রকম জৈবরাসায়নিক ব্যাখ্যা আছে। ২০২২ অবধি অন্তত ৪০-৪৫টি জিন পাওয়া গেছে যা ডিপ্রেশনের সঙ্গে জড়িত বলে ভাবা হয়। এই জিনগুলির একাংশ আবার স্কিৎজোফ্রেনিয়ার সঙ্গেও জড়িত। ডিপ্রেশনের নতুন যে ওষুধগুলি ডাক্তারেরা দিয়ে থাকেন, ডোজ বদলে দিলে সেগুলো অন্য অনেক মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও ব্যাবহার করা যায়। অনেক রোগীর অবসাদ উৎকণ্ঠা আবার কোনও ওষুধেই বাগ মানে না। এই নানারকম জটিলতা বুঝতে যখন চিকিৎসক/মনোবিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম হচ্ছেন, এবং অজস্র বিক্ষিপ্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও জীবন বিজ্ঞান দিয়ে মানসিক ব্যাধি বোঝা যাবে এই আশা বিজ্ঞানীদের একাংশ একরকম পরিত্যাগ করেছেন, বিহেভিওরাল জেনেটিক্সে তখন একটি ছোটখাট বিস্ফোরণ ঘটে গেল।

১৯৭০-এর দশক থেকে হিংসাত্মক ব্যবহারের সঙ্গে একটি জিনের সম্পৃক্ত থাকার মর্মে কিছু প্রমাণ ছিল। Monoamine Oxidase-A বা MAO-A জিনের এক্সপ্রেশন কম, এমন ধারকদের ভাবা হত অপরাধপ্রবণ বা হিংসাত্মক। আভশালোম কাস্পি আর টেরি মোফিট প্রায় ৩০০০০ মানুষের ৩০ বছরের জীবনের তথ্যসমষ্টি থেকে প্রমাণ করলেন, এই জিনটি তখনই অপরাধপ্রবণতা বা অসামাজিক আচরণের সঙ্গে জড়িত যখন জিনের বাহকের শৈশবে কোনও বড় মাপের দুর্ঘটনা, অত্যাচার বা অঘটন রয়েছে। ছবিটা দেখলে বুঝতে সুবিধে হবে।

ঠিক একই জিনিস দেখা গেল আরেকটি জিন 5HTT Serotonin Transporter-এর ক্ষেত্রে। সেরোটনিন অবসাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মস্তিষ্কের কোষে সেরোটনিন আদানপ্রদান যে প্রোটিনের মাধ্যমে হয়, তার জিনটি তিন প্রকারে জনসাধারণের মধ্যে পাওয়া যায়— long/long (l/l), long/short (l/s) এবং short/short (s/s)। এই প্রকারগুলিকে অ্যালেল বলা হয়। একটি জিনের দুটি অ্যালেল প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, একটি পিতৃপ্রদত্ত, একটি মাতৃপ্রদত্ত। সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে s/s অ্যালেলটি অবসাদের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নিচের ছবিগুলো দেখলে বোঝা যাবে, s/s অ্যালেলটি অবসাদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু অবসাদের পরিমাণ শুধু এই অ্যালেলের ওপরে নির্ভর করে না। জীবনে বড় অঘটন যত বেশি, এই অ্যালেলের বাহকদের মধ্যে অবসাদের হার তত বেশি।

এই জিনিসকে বিহেভিওরাল জেনেটিস্টরা বলেন জিন-এনভায়রনমেন্ট ইন্টারঅ্যাকশন। নেচার (প্রকৃতি) ও নার্চার (পারিপার্শ্বিকতা)-এর ক্রমাগত সংঘাতের ওপরে নির্ভর করে ব্যবহার কোন পথে যাবে। বর্তমানে মনোবিদ্যার মূল সূত্রগুলির মধ্যে একটি প্রধান সূত্র এই GXE Interaction. যে কোনও ব্যবহার অথবা যে কোনও জটিল মানসিক রোগ, এই কাঠামোতে ফেলে বোঝা যায়। জৈবিক গঠন বা পারিপার্শ্বিকতা, কোনও একটিকে বড় করে দেখলে কিছুতেই স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক ব্যবহারকে বোঝা যাবে না।

এর থেকে প্রশ্ন ওঠে, কোনটি বেশি জরুরি? জৈবিক গঠন না পারিপার্শ্বিক? এর কোনও সরল উত্তর নেই। ক্ষেত্রবিশেষে এর উত্তর বদলায়। যে মানসিক ব্যাধি খুব সাধারণত দেখা যায়, যেমন উৎকণ্ঠা, অবসাদ, বা দুর্ঘটনাজনিত স্ট্রেস— এদের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক কারণগুলির অবদান তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে সিরিয়াস মেন্টাল ইলনেস বলা হয়, যেমন স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিজর্ডার, এদের ক্ষেত্রে জেনেটিক বা বায়োলজিকাল প্রক্রিয়াগুলির অবদান অনেক বেশি। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই, একটি দুটি জিন নয়, অন্তত ৪০-৫০টি বিভিন্ন জিনের অবদান থাকতে পারে, অনেক ক্ষেত্রে ৭৫টি জিনও পাওয়া গেছে। এক এক করে সেগুলিকে ওষুধের মাধ্যমে কিছুই করা সম্ভব না, কারণ প্রত্যেকটির একক অবদান খুব নগণ্য। কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণগুলি জানা থাকলে সেগুলি বদলে ফেলা তূলনামূলকভাবে অনেক সহজ। কারও MAO-A অ্যালেলটি কম বা বেশি আছে কিনা জানলেও, সেটাকে বিশেষ কিছু করা সম্ভব না— কারণ ওই প্রোটিনটির আরও অনেকরকম কাজ আছে নিউরনের মধ্যে— ওষুধ দিয়ে অকেজো করে দিলে বা পরিমাণে বাড়িয়ে দিলে অন্য অনেক প্রক্রিয়াতে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু বাড়িতে বাচ্চাদের সুরক্ষা বজায় রাখা, মারধর বা অন্যরকম অত্যাচার না করা, বা বড় মাপের দুর্ঘটনার থেকে বাঁচিয়ে তাদের পালন করা, এগুলি তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ।

এই প্রমাণগুলি আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে জৈব প্রক্রিয়া, জেনেটিক গঠন যেমন ব্যবহারকে প্রভাবিত করতে পারে, ঠিক তেমনই, পারিপার্শ্বিকতাও ব্যবহারকে প্রভাবিত করে, এবং জৈব গঠনকেও পালটে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঠিক এই জায়গা থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারভিত্তিক সংজ্ঞা্র পক্ষে সওয়াল করা যায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকারের মধ্যে যে ইনেলিয়েনেবল রাইটের কথা বলা আছে, যার কিছু উদাহরণ এই লেখার গোড়াতেই দেওয়া হয়েছে, যথা সুরক্ষা বোধ, খাদ্য, স্বাস্থ্য, কর্মের সুষম সংস্থানই প্রত্যেকটি মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্যে প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক কারণ। জৈব গঠন বা প্রক্রিয়াগত দিক থেকে ব্যক্তিবিশেষের যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, কোনও মনোরোগের দিকে, পারিপার্শ্বিক কারণগুলিকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেকটাই আটকে দেওয়া সম্ভব।

 

মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষদের ইতিহাসের একটি বিরাট সময়ে জুড়ে পশুর অধম ভাবা হত। ঐতিহাসিকভাবে মানসিক রোগীদের ভূতে পাওয়া, জ্বীন ভর করা ইত্যাদি নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যাখ্যার দরুণ চরম অত্যাচার, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। এক সময়ে রয়াল বেথলেহেম হাসপাতালে মানসিক রোগীদের চূড়ান্ত নিগ্রহ দেখতে টিকেট কেটে যাওয়া যেত, সার্কাস দেখতে যাওয়ার মতো। বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষের অনেক পরেও মানসিক ব্যাধি সম্বন্ধে আজও নানারকম অপব্যাখা চতুর্দিকে। মানসিক ব্যাধি যে কোনও চারিত্রিক দুর্বলতা নয়, তার যে একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে, এইটুকু বোঝাতেই প্রাণান্ত হয়। এই নিয়ে যা লেখাপত্র আছে, বেশিরভাগ ইংরাজিতে, ফলে আমাদের দেশের একটি বড় অংশের কাছে তা সহজে পাঠ্য নয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বোঝার সময়ে এই সত্যিটা বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়— জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ার পাশে পারিপার্শ্বিকতার অবদান না বুঝলে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেই জ্ঞানের প্রয়োগ না করলে, রোগীর বা রোগের নিরসন হবে না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. মনে হল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য নয়।তবে খুবই জরুরি বিষয় আলোচনা হয়েছে।অবশ্যই পড়া উচিত।

1 Trackback / Pingback

  1. মানসিক অসুস্থতা: এক নীরব অতিমারি — ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় যাত্রা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

Leave a Reply to হীরক সেনগুপ্ত Cancel reply