নিরুপম চক্রবর্তী

নিরুপম চক্রবর্তী | প্রাগ শহরের রবীন্দ্রনাথ

প্রাগ শহরের রবীন্দ্রনাথ

 

হে ট্যুরিস্ট, নবীন ট্যুরিস্ট, তুমি বুঝি বা অতীব সদ্য আসিয়াছ প্রাগ নগরীতে। দেখিয়াছ চার্লস ব্রিজ, পুরানো চত্বরে চালু শহরের বিখ্যাত ঘড়িটি, কিংবা তার চতুঃপার্শ্বে গাঁজার দোকান। খাইয়াছ চিমনি কেক, চড়িয়াছ মেট্রো রেলে নগরীর গভীর গহ্বরে, ফানিকুলারেতে করি উঠিয়াছ পাহাড়চূড়ায়। দেখিয়াছ এ সকলই অন্যসব রাম-শ্যাম-যদু-মধু ট্যুরিস্টের মতো।

তুমি তো অবশ্য জানো সর্বব্যাপী ট্রামের লাইন, প্রগাঢ় আশ্লেষে তার এ শহর আলিঙ্গন করে। সমগ্র শহরব্যাপী ঘুরিতেছে বহুবিধ প্রাচীন ও অর্বাচীন ট্রাম। চার্লস ব্রিজ সন্নিকটে ওই দ্যাখো আসিতেছে ২০ নম্বর: চলো উঠি, হে ট্যুরিস্ট, এই ট্রাম ঠাকুরোভা যাবে।

এ কবিতা যেন এক চলচ্চিত্র। হে পাঠক, আমিও ট্যুরিস্ট আজ এ মুহূর্তে ট্রামের ভিতর। তুমি আর আমি, চলো, ফ্ল্যাশব্যাকে দৃশ্যান্তরে যাই। ১৯২১ সাল, ভিয়েনা হইতে ট্রেনে প্রাগ শহরেতে নামে জোব্বাধারী জাদুকর এক। সম্ভ্রান্ত তাহার মুখ, অবিন্যস্ত দীর্ঘশ্মশ্রু ভেসে যায় মেঘেদের সাথে। ১৯২১ সাল, ১৮ই জুন, বেলা ১১টা বাজে; পরিপূর্ণ সভাগৃহ চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ। আসিয়াছে ছাত্রগণ, অধ্যাপক, ডিন-ডন সকলেই উপস্থিত সেথা। সুবিপুল ফর্মালিটি, প্রথার নিগড়বদ্ধ ঋদ্ধ আয়োজন: বাংলার বাউল নিয়া বক্তৃতা দিবেন আজ কোনও এক নব অভ্যাগত।

খুলে যায় আবদ্ধ দুয়ার। সহস্র সূর্যের আলো মুহূর্তে প্রবেশ করে রুদ্ধশ্বাস প্রেক্ষাগৃহে। দুয়ারে দাঁড়ায়ে কেহ সৌরকরোজ্জ্বল। জ্যোতির্ময় আবির্ভাবে ল্যান্ডলক্‍ড এ প্রদেশে উছলিয়া উঠে দ্যাখো, হে পাঠক, বঙ্গ-উপসাগরের ঢেউ! সেই ঢেউয়ে ভেসে যায় সবটুকু ফর্মালিটি, সুগম্ভীর পুঁথি আর যাবতীয় গ্রন্থকীটগুলি। অজস্র সিগ্যাল দ্যাখো উড়ে যায়, বাউলের একতারা বেজে উঠে তাদের উড়ানে: তাহাদের দীর্ঘ ছায়া ভেসে থাকে ঢেউয়ের ফেনায়। চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার পরিবর্তে গান গায় রবীন্দ্র ঠাকুর। বিপুল সমুদ্রে দ্যাখো, ঝড় উঠে, রোমাঞ্চিত ছাত্রবৃন্দ নৃত্য করে, রোমহর্ষ জাগে। বিপুল তরঙ্গরোলে ভেসে যায় ডিনেদের কোট-প্যান্ট-টাই!

আসিয়াছে ঠাকুরোভা। ট্রাম থেকে, চলো, নেমে যাই। হে ট্যুরিস্ট, এইস্থানে রবীন্দ্রনাথের ওই আবক্ষ মূর্তিটি বুঝি আমাদেরই পথ চেয়ে জাগে। হরিৎ উদ্যানে এক কবির মুখশ্রী দ্যাখো উদ্ভাসিত এইক্ষণে, দিবসের অস্তরাগে রহস্যময়তা। নিঃশব্দে দাঁড়াই, চলো, ঘনীভূত হইবে প্রদোষ: কবিতার দেবদূত আধো অন্ধকারে একা, জাগে তার ঐশী স্বর, হে ট্যুরিস্ট, শুনিতেছ তুমি? ফুটিয়া উঠিবে বুঝি কৃষ্ণাকাশে নীহারিকা আরও রাতে প্রাগ শহরেতে। শেষ ট্রাম চলে গেলে এখানে কবির অঙ্গে পড়িবে তাহার আলো, যাহাতে নক্ষত্রগাথা লেখা।

বিশ্বস্ত পাঠক, চলো দেখি!

 

প্রাগঐতিহাসিক

প্রাগ শহরেতে দেখি অনেকেই বই পড়ে বাসে ট্রামে এবং মেট্রোতে।
একদিন ফাঁকা বাসে গ্রন্থমগ্ন কোনও যুবতীর
দুগ্ধপোষ্য শিশু এক মাতার অজান্তে নামে সিট থেকে, অতঃপর
চলন্ত বাসেতে তার ভয়হীন ইতস্তত বিচরণ আর
পরিশেষে, বিপুল অবাক চোখে
আমার সিটের পাশে এসে
আধোস্বরে কতকিছু বলে যায় এই বিদেশিকে!

মাতার ভ্রূক্ষেপ নাই। গ্রন্থ তারে শিখায়েছে এ জগতে সকলে স্বাধীন!
এদেশে দেওয়ালে কেহ লিখে নাই, যতটুকু পড় ঠিক ততটাই তুমি মূর্খ হও!
(সে যেন কাহার বাণী? কৈশোরের কলিকাতা, দেওয়ালে স্টেনসিলে ছাপা যুবা মাও-সে-তুং!)

আমি এই শহরের দেওয়াল লিখনগুলি পড়িয়াছি।
আমি এই শহরেতে আশ্চর্য ফলক কিছু দেখিয়াছি।
স্মিত হাসি বিশপের সুশীল মূর্তির পাশে
কেহ বা কাহারা যেন লিখিয়াছে:

আহা কী আনন্দ হয়
যখন হইতে পারো তুমি গ্যাংস্টার!

আরও বহুদূরে এক চিত্ররূপী হরিৎ প্রান্তরে
একটি ফলক আছে
(হে ট্যুরিস্ট! তোমরা তো এইসব খোঁজো নাই জানি কভু, আমি খুঁজিয়াছি!)
তাহাতে লিখিত আজও:

সত্যমেব জয়তে
(পড়িছে পথিক!)
আমরা তো আজও বিশ্বাসী
(ইহারা কি তিমিরবিনাশী? ভাবিছে পথিক)
৫. ৫. ১৯৪৫
ইহাদের মৃত্যু আজ আমাদের বাঁচায়ে রেখেছে।
১৯৩৮-১৯৪৫

এর নীচে ন’টি নাম। পরিচিত কেহ নয়, কোনওদিন শুনি নাই তাহাদের মৃত্যুকথা
কোন গাথা তাহারা রচেছে?
ভাবিতে ভাবিতে দেখি ১৯৩৮ সাল ম্যাজিকের মতো ফিরে আসে:
নাৎসি কবলিত প্রাগ। নয়জন পার্টিজান, রক্তাক্ত ও গুলিবিদ্ধ,
এ হরিৎ প্রান্তরেতে আমার সম্মুখে শুয়ে আছে!

অতঃপর ১৯৪৫। নাইনটিন ফরটিফাইভ।
হে পাঠক! (যদি বা পাঠক কেহ থাকো!)
একটু খুঁজিলে পরে পেয়ে যাবে নাতিদূরে
আরেকটি ফলক।
তাহাতে এখনও লেখা:

৯-১৯ মে ১৯৪৫
লালফৌজ এ শহর মুক্ত করিয়াছে।

আমার খোঁয়াড়ি ভাঙে, শিশুটি এখনও হাসিতেছে
আমার দিকেতে চেয়ে।
সে বুঝি বলিতে চাহে: হে প্রগাঢ় পিতামহ,
(তার স্বর জীবনানন্দিত!)
তুমি শুধু দেখিয়াছ স্টেনসিলের মাও-সে-তুং
তোমার শহরে সেই ষাটে ও সত্তরে?
ব্রেজ়নেভের নাম তুমি দেখিয়াছ কদাপি কি তোমার দেওয়ালে?
১৯৬৮ সালে প্রাগের সড়কে তুমি দেখিয়াছ উহাদের ট্যাঙ্ক?
প্রিস্তি জ়াস্তাভ্‍কা দেভিস্কা
এই বাস এর পরে থেমে যাবে দেভিস্কা স্টপেতে।
ওখানেই নেমে যাও, মেট্রো নিয়ে চলে যাও ম্যু়জ়িয়াম তুমি
তাহারই চত্বরে জেনো আছে এক স্মরণিকা,
লিখা আছে তাহার উপরে:
বিংশতিবর্ষীয় ছাত্র ইয়ান পালাস, প্রতিবাদে এইস্থানে
আপনাকে অগ্নিদগ্ধ করে।।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to দেবব্রত Cancel reply